প্রোটকল

প্রোটকল

শ্রীল শ্রীযুক্ত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,

মহাত্মন,

স্বভাবতই সর্বপ্রথম প্রশ্ন উঠবে, উপরিস্থ পদ্ধতিতে আপনাকে সম্বোধন করবার হক আমার আছে কি না? অর্থাৎ এটিকেটে বাধে কি না? আরও সরল আন্তর্জাতিক পরিভাষা ব্যবহার করতে হলে বলব, আমার এ আচরণ প্রোটকল-সম্মত কি না।

ভয় নেই। আমি শব্দতত্ত্ব নিয়ে অযথা মাথা ফাটাফাটি করব না। সামান্যতম যেটুকু নিতান্তই না হলে চলে না তারই দিকে আপনার তথা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ভোজনারম্ভে তিক্তবস্তুর ন্যায় যৎসামান্য।

কোনও কোনও শব্দের পরিধি পরিব্যাপ্তি দিন দিন বেড়ে যায় কোনওটার আবার কমে। এই ধরুন না, কনটাক্ট শব্দটি। একদা বোঝাত নিতান্ত স্থূলভাবে শারীরিক সংস্পর্শে আসা।

সে আমলে যদি কেউ লিখত উপমন্ত্রী সুশীলাবালা দাসী গত রাত্রে শ্রীযুক্ত নটবর নায়ককে কনটাক্ট করেছেন তবে সেটা প্রায় অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে যেত। আজ স্বচ্ছন্দে বলি, প্রাচীন নব্যন্যায় অধুনা প্রতীচীর এপিস্টমলজির কন্টাক্‌টে আসাতে উভয়ই উপকৃত হয়েছেন। অবশ্য তার অর্থ কী, আল্লায় মালুম।

প্রোটকল শব্দটির বেলাও তাই হয়েছে। একদা গ্রিক ভাষাতে বোঝাত– যেমন ধরুন, আপনার একখানা টাইম-টেবিল আছে। হঠাৎ ইশটিশানে পেয়ে গেলেন, হ্যান্ড-বিল-পারা একখানা নোটিশ। তাতে ট্রেনের সময় পরিবর্তনের নবীন ফিরিস্তি রয়েছে। আপনি সেটি আপনার টাইম-টেবিলের যথাস্থলে গঁদ দিয়ে সেঁটে দিলেন। তখন এ কাগজের টুকরোটি পেয়ে গেলেন পৈতে। হয়ে গেলেন প্রোটকল। গেরেমভারি নাম। এ পাড়ার মেধো হয়ে গেলেন ভিন্‌পাড়ার মধুসূদন।

সরকারি না-হক ট্যাকশো যেরকম বাড়তে বাড়তে পর্বতপ্রমাণ হয়ে যায় এ শব্দটিও আড়াই হাজার বছর ধরে বাড়তে বাড়তে তার তনুটিকে অদ্যকার বন্ধু করে তুলেছে। বেশ এক যুগ পূর্বে এটিকেটের মহানগরী প্যারিসে পররাষ্ট্র বিভাগ বা ফরেন আপিসে একটি ভিন্ন বিভাগ খোলা হয়েছে; তার নাম প্রোটকল বিভাগ। একটা পুরো পাক্কা আস্ত ডিপারটমেন্ট।

রাজ্যচালনার কোন গুরুভার এঁদের স্কন্ধে সমর্পিত হয়েছে?

বহুবিধ। এমনকি আমার মতো লোক না পারলেও আপনি এদের সাহায্য তলব করতে রেন। অবশ্য কলকাতাতে এরকম পুরো-পাক্কা-প্রোটকল বিভাগ আছে কি না, আমি সঠিক নিনে। ধরুন আছে। আরও ধরুন, আপনি, সম্পাদক মশাই, কোনও পারটিতে নর্থ পোলের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। কথায় কথায় বেরিয়ে গেল তিনি ভারতীয় ফলমে বড়ই ইনটেরসটেড। পরিচয় নিবিড়তর হল। ইতোমধ্যে তিনি আপনাকে একটি খাসা উনারও খাইয়ে দিয়েছেন। সেটি রিটার্ন করতে হয়। কনসাল বিপত্নীক। একটি অবিবাহিত মেয়ের বয়স একুশ অর্থাৎ সোসাইটি করার বয়স হয়েছে। অন্য মেয়েটি পল্টনের কেপটেনকে বিয়ে করেছেন। তিনি একা এসেছেন কলকাতায়, বাপের কর্মস্থলে। ওদিকে আপনি সাউথ পোলের কনসুলেট জেনারেল শার্জে দাফেরকেও ওই দিনই নিমন্ত্রণ করেছেন। তাঁর ভামিনী ও এক কন্যাও সঙ্গে আসছেন। কন্যাটির স্বামী ছিলেন। তিনি স্বামীর কাছ থেকে সেপারেশন নিয়ে পিতার সঙ্গে বাস করেন।… ডিনারে আরও ইনি উনি তিনি আসবেন।

এবারে আমরা আসছি ইংরেজিতে যাকে বলে– থিক্‌ অব্ দ্য বেটুল-এর। অর্থাৎ মূল সমস্যায়। আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন প্রিসিডেনস বস্তুটি সাংঘাতিক। আপনার ড্রয়িংরুমে ককটেলাদি পান করার শেষের দিকে যখন বাটলার এসে আপনার স্ত্রীর সামনে বাও করবে তখন তিনি মুচকি হাসবেন প্রধান অতিথির দিকে। সেই মসিয়ো ল্য কনস্যুল জেনারেল যেন পবনে ভর করে আপনার স্ত্রীকে এসে দান করবেন তার দক্ষিণ বাহু। তারই উপর নির্ভর করে দু-জনাতে এগোবেন খানা-কামরার দিকে। এর পর যাবেন আপনি। কিন্তু দক্ষিণ বাহু দান করবেন কাকে? সাউথ পোলের শার্জে দাফেরের স্ত্রীকে, না নর্থ পোলের অবিবাহিতা কন্যাকে, না কেপটেনের স্ত্রীকে, না কর্নেলের তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে?…এবং তার পর আসবেন কোন জোড়া, তার পর, ইত্যাদি।

তাই আপনি সুবুদ্ধিমানের মতো পূর্বাহেই ফোন করেছেন, শ্যা দ্য প্রোটকলকে– অর্থাৎ প্রোটকলের বড় কর্তাকে। অতি অমায়িক লোক। তদুপরি আপনি সম্মানিত কাগজের তারই মতো শ্যা, বড় কর্তা। কে কতখানি সম্মান পাবেন, তাদের দফতর ফিষ্টি দিলে আপনার প্রিসিডেনস কী– অর্থাৎ কার আগে কার পরে আপনি খানা-কামরায় ঢুকবেন তার প্রোটকলে আপনার নাম উঁচুর দিকে। অতএব একগাল হেসে বললেন,–সে কী মসিয়ো– (ভুললে চলবে না, আন্তর্জাতিক প্রোটকলের ভাষা এখনও ফরাসিস্!) আপনি অতখানি আঁবায়াসে (এমবারাট) হচ্ছেন কেন? এ যে একেবারে ডিমের খোসায় কালবোশেখী। আপনি তো আর অফিশিয়াট ডিপ্লোমেটিক ডিনার দিচ্ছেন না। কী বললেন? না, না, না পারলো, আমি আপনার ব্যান-কুয়েটটাকে মোটেই হেনস্তা করছিনে। তবু বলছি, ওটা তো।

ওই আনন্দেই থাকুন, সম্পাদক মশাই, ওঁকে বিশ্বাস করেছেন কী মরেছেন।

যতই ঘরোয়া বাড়ির ব্যাপার ফেমিলি ওয়ে বলে নেমন্তন্ন করুন না কেন, এবারে খাঁটি দিশি তুলনা দিচ্ছি সেখানে যদি মাছের মুড়োটা আপনার দিদির শ্বশুরকে না দিয়ে দেওয়া হয় আপনার ভাগ্নের শ্যালাকে, তদুপরি উনি কুলীনস্য কুলীন, আর কালো ছোকরা মৌলিকস্য মৌলিক, তা হলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে? আমি বলছি না, শ্বশুরমশাই বাড়ি ফিরে অ্যাট হিজ আরলিস্ট কনভিনিয়ে আপনার দিদির পিঠে ছি, ছি, তিনি আবার বৌমা–দু ঘা না না, তা বলছিনে।

প্রোটকলের শ্যাফ সবিশেষ অবগত আছেন যে আপনি তার স্তোকবাক্য সিরিয়স নেননি। তিনিই বলবেন।

সে তো হল। কিন্তু ওই যে বললেন সাউথ পোলের ডিভোর্স কন্যা–স্বামী ছিলে কর্নেল–তিনি এখন কী নামে পরিচয় দেন? ঠিক ডিভোর্স তো হয়নি–হয়েছে সেপারেশন।

সেটা কি ইমপরটেন্ট?

ভেরি, ভেরি। মহিলাটি যদি স্বামীর নাম ত্যাগ করে পুনরায় তার মেডেন (কুমারী) নাম, অর্থাৎ তার পিতার নাম গ্রহণ করে থাকেন তবে তিনি পাবেন সেই পরিবারের র‍্যাঙ্ক, নইলে পাবেন কর্নেলের বিবাহিতা স্ত্রীর র‍্যাঙ্ক। তার পর দেখতে হবে

ততক্ষণে আপনার মাথাটি তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। ভাবছেন, এবারে আর ডিমের খোসাতে টর্নাডো নয়, আপনার কানের টিপেনামে চলেছে মহাবেগে যুগ রুশমার্কিন নির্মিত স্পুটনিক।

আম্মো ভাবছি আজ যদি ডাচেস অব উইনজর তৃতীয় বারের মতো যদি, মানে, ইয়ে হয়ে যান তবে তার নাম কী হবে? শুনেছি, হালে নাকি তিনি লন্ডনে জলচল হয়ে গেছেন। ডুককে বিয়ের পূর্বে মিসেস সিমসন অবস্থাতে তিনি রাজবাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন যদ্যপি রাজমাতা মেরি সে দাওয়াত বর্জন করেন। তাঁর সে বামনাই নাকি প্রোটকল-নিন্দিত অপকর্ম হয়েছিল। ঈশ্বরেচ্ছায় তিনি দেহরক্ষা করেছেন। এখন প্রশ্ন, ডাচেস যদি আরেকটা ডিভোর্স নেন তবে তিনি লন্ডনে সাধনোচিত ধাম পাবেন কি না, অর্থাৎ বকিংহম ধামে নিমন্ত্রিত হবেন কি না?

হাসছেন? হাসবার জিনিস মোটেই নয়। চাকরি যেতে পারে। রুটি মারা যেতে পারে।

নিন্ হিটলারের যে কোনও প্রামাণিক জীবনী। পড়ুন ঘটনাটা। হিটলার গেছেন ইতালি– স্টেট ভিজিটে। সঙ্গে গেছেন ফরেন আপিসের শ্যাফ দ্য প্রোটকল। শ্যাটি সাতিশয় খানদানি ঘরের ছেলে। পোষা বেড়ালটাকে আগে দুধ দিতে হয়, না কুকুরটাকে হাড়ি– সে প্রোটকল তিনি সাত বছর বয়সেই পারিবারিক কাসূলে যুক্তিতর্কসহ সপ্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

ইতালির রাজা সর্বান্তঃকরণে ঘেন্না করতেন হিটলারকে অবশ্য অনুভূতিটি ছিল উভয়পক্ষীয়, সাতিশয় বরাবরেষু! রাজা পাতলেন ফাঁদ, হিটলারকে অপদস্থ করার জন্য। শেষ মুহূর্তে কী একটা হয়ে গেল রদবদল। যার ফলে হিটলার উপস্থিত হলেন কী এক পরবে সিভিল ড্রেস পরে, যেখানে আর সবাই মুনিফর্মে! কিংবা উল্টোটা।

বিশ্বসংসার জানে হিটলার ছিলেন অত্যন্ত বদ-মেজাজি লোক যদিও একথাও সত্য যে মিষ্টি ব্যবহার করতে চাইলে তিনি পারমিট-প্রার্থী মেবারবাসীকে তিন লেনথে হারাতে পারতেন– দুষ্টলোকে বলে, তিনি তখন মেঝেতে শুয়ে পড়ে কারপেট চিবুতে আরম্ভ করতেন– তাকে নাকি বলা হত The Carpet-Eater!

প্রোটকল শ্যাফ বরখাস্ত হয়ে প্রথমতম ট্রেনে নাক বরাবর আপন গায়ে। হিটলার তার মুখদর্শন পর্যন্ত করেননি।

অবশ্য এর সরল দিক নিয়েও একাধিক কাহিনী আছে। বাল্যকালে হিটলার যে অস্ট্রিয়ার নগণ্য প্রজা ছিলেন সেই বিরাট অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির মহিমান্বিত সম্রাট ছিলেন কাইজার ফ্রানস যোজেফ। তাঁর ভাব-ভালোবাসা ছিল সুন্দরী অভিনেত্রী শ্রীমতী শ্রাটের সঙ্গে। তিনি প্রায়ই কাইজারকে বলতেন, আপনি স্টেজের উপর গিরাডির রসিকতা শুনে হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়েন। স্টেজে আবার রসিকতা করার সুযোগ পান গিরার্ডি কতটুকু? পাবৃ-এ, বার-এ, চায়ের মজলিশে তিনি যা একটার পর একটা ছেড়ে যান তার তুলনায় কেউ কখনও করতে পেরেছেন বলে কোনও কিংবদন্তী পর্যন্ত এই বিরাট ভিয়েনা শহরে নেই। তাই গিরার্ডিকে কফি পানে নিমন্ত্রণ করা হল। কাইজার তো এলেন বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে। এদিকে কী আশ্চর্য! গিরাডি-র কোটের বোতাম ওপরবাগে উঠতে উঠতে যেন তার ঠোঁটদুটোকেও বোমিত করে দিয়েছে। নিজের থেকে কথা কন না আদৌ, প্রশ্ন শুধলে মহা সম্ভ্রমে যেটুকু বলেন সেটি তার গোঁফের ছাঁকনিতেই আটকা পড়ে যায়।

কফি পান খতম হতে চলেছে। শেষটায় থাকতে না পেরে হতাশ কাইজার ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বললেন, মাই ভেরি ডিয়ার গিরার্ডি! আপনার মজলিশ-জমানো কথার ফুলঝুরি সম্বন্ধে আমি কত মুখে কতই না বেহদ্দ তারিফ শুনেছি– আর এ কী?

রুমাল দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে এক্কেবারে গ্রাম্য ভাষায় গিরার্ডি বললেন, হুজুর জাঁহাপনা! অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির কাইজারের লগে অ্যাগুবার আপনে কফি খাইতে বইয়া দ্যাহেন না!

বেচারি গিরার্ডি প্রোটকলকে কনস্লট করে কফি খেতে এসেছিলেন!

তার শেষ বাক্যটি ঠিক প্রোটকলসম্মত কি না সে নিয়েও আমার মনে ধোকা আছে।

একদম হালের ঘটনায় চলে আসি।

এই গত ৯/১০ জুন তারিখে আরব রাষ্ট্রগুলো এবং ইজরাএল সকলেই যখন অস্ত্রসম্বরণ (সিস ফায়ার) করতে রাজি হয়ে গেছেন তখন রাশা ইউনাইটেড নেশনের সিকুরিটি কৌনসিলের বিশেষ জরুরি সভা ডাকার জন্য প্রস্তাব পাঠাল; তার অভিযোগ, ইজরাএল সিস ফায়ার করেনি ক্রমাগত সিরিয়ার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিটিং বসল সকাল নটা-দশটায়। এদেশে তখন রাত বারোটা। মিটিঙে বসানো মাইকের মারফত তার প্রত্যেকটি বাক্য ভইস অব আমেরিকার নিউজ রুমে আসছে। সেইটে ফের বেতারিত হয়ে রিলের পর রিলের মারফত ভারতে পৌঁছচ্ছে। অধমের অন্দ্রিা ব্যাধি আছে।

এই সিকুরিটি কৌনসিলের কর্মপদ্ধতি অতিশয় ছিমছাম। যে যার বক্তব্য বলে যান সাধারণত অতিশয় শান্ত-কণ্ঠে। কেউ কাউকে বাধা দিয়ে আপন কথা বলতে চায় না– অতি দৈবেসৈবে কেউ যদি কখনও করে তবে বার বার মাফ চেয়ে, ও বাধাপ্রাপ্ত বক্তাও সঙ্গে সঙ্গে থেমে যান। চেল্লাচেল্লি হৈ-হুঁল্লোড়ের কথাই ওঠে না।

প্রেসিডেন্ট গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি এখন সোভিয়েত রাশিয়ার মহামান্য (ডিসটিংগুইসট শব্দটি প্রতিবার প্রতি মেম্বারের উল্লেখ করবার সময় ব্যবহার করাটা প্রোটকলানুযায়ী নিরঙ্কুশ বাধ্যতামূলক) ডেলিগেটকে ঘরের ফ্লর ছেড়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ তখন ঘরের ফ্লর মেঝেটাতে দাঁড়িয়ে কথা বলার হক সোভিয়েত ডেলিগেটের। অবশ্য তিনি ফ্লর গ্রহণ না-ও করতে পারেন।

মহামান্য রাশান ডেলিগেট দাঁড়িয়ে বললেন, স্পাসিব– কিংবা ব্লাগোদারিয়ু ভাসও বলে থাকতে পারেন। অর্থ একই; থ্যাঙ্কু। অর্থাৎ তিনি ফ্লর গ্রহণ করলেন।

তার পর এখন যে বিবৃতি নিবেদন করছি সেটা স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে। সন্দেহপিচেশ পাঠক আমার অত্যল্পই। তাঁরাও ওই সময়কার খবরের কাগজ পড়ে চে-অপ্ করে নিতে পারবেন, তাদের হাত দিয়ে আমি দা-কাটা তামাক অর্থাৎ সাতিশয় স্কুল ভুল– খেয়েছি কি না। কিন্তু আমি অতি সংক্ষেপে সারছি।

রুশ : থ্যাঙ্কস, মি. প্রেসিডেন্ট! আমি বলতে চাই, এই সম্মানিত কৌনসিল আরব এবং ইজরাএল উভয়কে আদেশ দিয়েছেন সিস-ফায়ার মেনে নিতে। সিরিয়ার মহামান্য ডেলিগেট বলেছেন, সিস-ফায়ার মেনে নেওয়া সত্ত্বেও ইজরাএল সিরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়িসহ ক্রমাগত রাজধানী দিমিশকের (ডিমেকাস্, দামা, ডামাস্কুস) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বোমারু বিমান অনবরত রাজধানীর উপর বোমাবর্ষণ করছে। আমি প্রস্তাব করি, কৌনসিল সর্বসম্মতিক্রমে ইজরায়েলের এ আচরণের নিন্দা করুক। ধন্যবাদ, মি. প্রেসিডেন্ট।

(বক্তৃতা শেষ করে কোনও কোনও সদস্য ভবিষ্যতে তার বক্তৃতার কী ভাষ্য হবে না হবে সে বাবদে তার অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার দাবি জানান। পক্ষান্তরে বক্তব্য স্পষ্ট হ্যাঁ, না বা নিতান্ত দ্ব্যর্থহীন হলে সে অধিকার যে রাখছেন না, সেকথাও বলে দেন। এটার প্রয়োজন এই কারণে যে কৌনসিলের বাহান্ন রঙের নানান চিড়িয়া নানান বুলি কপচান। অনুবাদ নিয়ে পরে তাই নানা হক-না-হক তর্ক ওঠে)।

প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি এখন ইজরাএলের মহামান্য ডেলিগেটকে ফ্লর ছেড়ে দিচ্ছি!

ইজরাএল ডেলিগেট : আমার মহামান্য সরকার যখন সিস-ফায়ারে স্বীকৃতি দেন তখন তিনি স্পষ্ট বলেন, আমরা সিস-ফায়ার মানব, কিন্তু শর্ত (অন কন্ডিশন) যে আরবরাও তাই মানবে! অতএব সিস-ফায়ারটা মুচুয়াল করতে হবে। ইতোমধ্যে আমার মহামান্য সরকার তাঁর সেনাবাহিনীকে সিস-ফায়ারের হুকুম দিয়েছেন।

এ উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে হয়তো-বা রুশ ডেলিগেট নিন্দাসূচক প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে পারেন। সে সম্ভাবনা দেখে প্রেসিডেন্ট ফের রুশকে ফ্লর দিলেন।

রুশ : (অতি সামান্য অসহিষ্ণু কণ্ঠে) মি. প্রেসিডেন্ট! এ তো বড় তাজ্জব কি বাত! এই মচুয়াল সিস-ফায়ার রহস্যটা কী? মহামান্য ইজরাএল ডেলিগেট কি বলতে চান, প্রথমে, পয়লা, সিরিয়া সিস-ফায়ার করবে, তবে ইজরাএল অস্ত্রসংবরণ করবেন? তদুপরি, মি. প্রেসিডেন্ট, চুয়াল শব্দটাই আমাদের অনুশাসনে নেই। এবং আসল তত্ত্ব, ইজরাএলই আক্রমণ করেছে প্রথম। সিস-ফায়ার করতে হবে তাকেই প্রথম। আচমকা ওই মুচুয়াল শব্দ আমদানি করে ইজরাএল কথার মারপ্যাঁচ (কজিস্টরি) আরম্ভ করে মূল সত্য এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? (তার পর অতি সামান্য ব্যঙ্গের সুরে– লেখক) এর পর বুঝি সফিরি আরম্ভ হবে! (কথার প্যাঁচে সত্য গোপন ও মিথ্যা ভাষণের ভদ্র নাম সফিরি–রুশ সদস্য ফেদেরেকো কব্জিস্টুরি ও সফিস্টুরি দুটো শব্দই ব্যবহার করেছিলেন যৎসামান্য ব্যঙ্গের সুরে কারণ ইজরাএল সদস্য যে সত্যি সত্যিই পাঁকাল মাছের গা মোচড়ানো আরম্ভ করে দিয়েছেন সেটা ততক্ষণ শক্ৰমিত্র সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে– লেখক)। মি. প্রেসিডেন্ট! আমি আদৌ অবিশ্বাস করছিনে যে, ইজরাএল সরকার তার সেনাবাহিনীকে সিস-ফায়ারের হুকুম দিয়েছেন, কিন্তু মহামান্য ইজরাএল সদস্য বলুন, তারা সেটা মেনে নিয়েছে কি না, তিনি বলুন, তারা সিরিয়ায় ক্রমাগত আরও অনুপ্রবেশ করছে কি না? থ্যাঙ্কু মি. প্রেসিডেন্ট।

প্রেসিডেন্ট : আমি মহামান্য এজরাএলের ডেলিগেটকে ফ্লর দিচ্ছি।

এর পর কিছুক্ষণ চুপচাপ। তার পর শোনা গেল ফের প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বর : আমি মহামান্য বুলগেরিয়ার ডেলিগেটকে ফ্লর দিচ্ছি। স্পষ্ট বোঝা গেল মহামান্য ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করলেন না। পোটকলানুযায়ী প্রেসিডেন্ট তাঁকে হুকুম দিতে পারেন না।

বুলগেরিয়া (ঈষৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বস্তুত একমাত্র ইনিই কিঞ্চিৎ উত্তেজনা দেখান যদিও সর্বদ্রতা বজায় রেখে। ইজরাএল কথা বলেছে স্বভাবতই বিজয়ীর গর্বিত কণ্ঠে, সিরিয়া করুণ ফরিয়াদভরা সুরে আর ইজরাএলের জয়ে খুশিতে ডগমগ মার্কিন তথা তার ফেউ ইংরেজ করেছে হে-হে-হে-হে) : মি. প্রেসিডেন্ট! ইজরাএল উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমি শুধু জানতে চাই, ইজরাইলি বাহিনী এখন কোথায়? সিরিয়াতে? হ্যা কি না তিনি স্পষ্ট বলুন। তিনি যদি কথা বলেন তবে আমাদের যা বলার বলব, তিনি যদি না বলেন তবে আমরা ভেবে নিয়ে জেনে যাব। (ডিলেমাটি সুন্দর If Israel speaks, we shall speak; if Israel does not speak we shall know,- 977)

প্রেসিডেন্ট পুনরায় ইজরাএলকে ফ্লর দিলেন। খানিকক্ষণ চুপচাপ।

প্রেসিডেন্টের গলা : আমি মালির মহামান্য ডেলিগেটকে ক্ষুর দিচ্ছি।

এর থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করেননি, করতে চান না। এর পর বোধহয় কর্মসূচিতে মালি রাষ্ট্রের নাম ছিল।

মালি : মি. প্রেসিডেন্ট! আমরা সবাই এখানকার সদস্য। এক সদস্য যদি অন্য সদস্যের কাছে কিছু জানতে চান তবে আপনি তাকে সেটা শুধোচ্ছেন না কোন বিধি অনুসারে? থ্যাঙ্কু! (বা ওই ধরনের)

প্রেসিডেন্ট; আমি সম্মানিত মালি সদস্যের কাছে জানতে চাই, আমি যে সম্মানিত ইজরাএলি সদস্যকে সম্মানিত রুশের প্রশ্ন জিগ্যেস করব তা কোন বিধি অনুযায়ী? মালি কোনও উত্তর দিতে চান কি না ঠাহর হল না। কারণ ইতোমধ্যে রুশ সদস্য ফ্লর চাইলেন। প্রেসিডেন্ট সসম্মানে তাই দিলেন।

রুশ : মি. প্রেসিডেন্ট! সভার কাজ সুষ্ঠুরূপে চালাবার জন্য আমরা ওয়ার্কিং এরেঞ্জমেন্ট মেনে নিয়ে থাকি। সেই অনুযায়ী যে কোনও সদস্য যে কোনও খবর যে কোনও সদস্যের কাছে চাইতে পারেন। এই তো আমরা সভার সদস্য সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্তকে অনুরোধ করলুম, সিরিয়া থেকে তাজা খবর আনিয়ে দিতে। তিনি দিলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

তৎসত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট সম্মানিত ইজরাএলি সদস্যকে প্রশ্নটি শুধোলেন না। তিনি কিন্তু একাধিকবার তাঁকে সসম্মানে ফ্লুর ছেড়ে দিলেন। ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করলেন না।

তবেই বুঝুন, সম্পাদক মশাই, প্রোটকলের ঠেলা কী চিজ!

কিন্তু চিন্তা করলে দেখতে পাবেন মি. প্রেসিডেন্ট থুড়ি সম্পাদক মশাই (ক্ষণতরে ভাবছিলুম, আমি বুঝি সেকুরিটি কৌনসিলে পৌঁছে গিয়েছি!) এটা কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। আমি প্রাচীনপন্থী পদি পিসির অপজিট পুংলিঙ্গ। যা নাই ভারতে! খুলে বলি।

সেকুরিটি কৌনসিলের কার্যকলাপ যখন আমি সরাসরি বেতারে শুনছি তখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছিল এইরকমই একটি ধুন্ধুমার যেন আমি সশরীর কোথাও দেখেছি। হ্যাঁ, হা– ওই ধুন্ধুমার কথাটাই সব মনে করিয়ে দিল। যে মধুকৈটভনিধন শ্রীবিষ্ণুকে আর্যদ্রাণ সায়ংপ্রাতঃ স্মরণ করেন সেই বিষ্ণু তথা অন্যান্য দেবাদিকে প্রচণ্ড নিপীড়ন আরম্ভ করে মধুকৈটভের পুত্র ধুন্ধুমার এবং অবশেষে নৃপতি কুবলাশ্ব কর্তৃক নিহত হয়। মহাভারতের • আপ্তবাক্যমধ্যে সেটি লিপিবদ্ধ আছে।

ধুন্ধুমার স্মরণ করিয়ে দিল সেই সভা, যেখানে দ্রৌপদী লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। আমি জাতিস্মর। আমি সে সভায় উপস্থিত ছিলুম তখনকার দিনের পি-টি-আই চিফ রিপোর্টার মূলগায়েন সঞ্জয়ের দোহাররূপে।

পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে দুইটি নিরপরাধ ব্যক্তি যেভাবে আত্মসমর্থন করেছেন তার তুলনা আজো ইহসংসারে অলভ্য। ঐতিহাসিক যুগে সোক্রাতেস, তার বহু পূর্বে দ্রৌপদী।

কিন্তু অবিস্মরণীয় তত্ত্ববাক্য : সোকরাতেস জাত দার্শনিক, পড় তার্কিক। তিনি যে আত্মপক্ষ সমর্থনকালে শাণিত শাণিত তর্কবাণে অ্যাথিন্স নগরীর নভোমণ্ডল দিবাভাগে তমসাচ্ছন্ন করে দেবেন তাতে আর বিচিত্র কী? সেকুরিটি কৌনসিল প্রসঙ্গে পূর্বেই নিবেদন করেছি, রুশ প্রতিনিধি ফেদেরেনকো ইজরাএলকে সফিস্ট আখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। সোকরাতেস এইসব সফিস্টুদেরই নগরীর মুক্ত হট্টে বাক্যেতর্কে নিত্য নিত্য অম্লত পান করাতেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন অত্যাশ্চর্য অবিস্মরণীয় হলেও সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য নয়।

কিন্তু একবস্ত্রা যাজ্ঞসেনী আত্মসমর্থন হেতু দুর্যোধনের সভামধ্যে যে যুক্তিজাল বিস্তার করে কতিপয় সূচ্যগ্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন তার সম্মুখে তদানীন্তন ভারতের গুণীজ্ঞানী শূরবীর সমন্বিত সর্ববৃহৎ সভা নিরঙ্কুশ নিরুত্তর। অসূর্যম্পশ্যা কৃষ্ণা যে আইনকানুন প্রোটকল সম্বন্ধে কতখানি অনভিজ্ঞা ছিলেন তা তাঁর সভা মধ্যে রোদনের সময়ই ধরা পড়ছে : হায়, আমি স্বয়ংবরকালে রঙ্গমধ্যে ক্রমাগত ভূপালগণের নেত্রপথে একবার নিপাতিত হইয়াছিলাম, ইতোপূর্বে যাহারা আর আমাকে দেখেন নাই, এক্ষণে আমি তাহাদেরই সম্মুখে সভামধ্যে উপস্থিত হইয়াছি, যাহাকে পূর্বে গৃহমধ্যে বায়ু ও আদিত্য পর্যন্ত দেখিতে পান নাই… (আমরা বলি) তিনি যে সোরাতেসের মতো সেকালের কোনও প্রটো-আকাডেমির সদস্য ছিলেন না অথবা ডক্টরেট অব জুরিসপ্রুডেন্স পাস করেননি সে বাবদে আমরা স্থিরনিশ্চয়, দৃঢ়প্রত্যয়। তাই পাঞ্চালীর ডিফেন্স আমাদের কাছে ঘূতলবণতৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধনসমস্যাহীন কলিকাতা মহানগরীর মতো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

এ যেন সেকুরিটি কৌনসিলের ঠিক উল্টো পিঠ। হেথায় তাবৎ সভা কা কা রবে চিৎকার করছে কিন্তু ডিসটিংগুইশ ইজরাএল প্রতিনিধি নিপ, নীরব। অথচ তার জিভে ফোস্কা পড়েনি, তার টনসিলে বাত হয়নি। সভায় ৯৫ নয়াপয়সা মেম্বর কোনও প্রোটকল খুঁজে পাচ্ছেন না যেটা গজাঙ্কুশের মতো প্রয়োগ করে ইজরাএলের দাঁতকপাটি খুলতে পারেন।

আর হেথায় দ্রুপদতনয়া বারবার একটিমাত্র প্রশ্ন জিগ্যেস করছেন, ধর্মরাজ দূতক্রীড়ায় অগ্রে আমাকে কি নিজেকে বিসর্জন করেছেন? (ইজরাএলকেও মাত্র একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করা হয়েছিল ইজরাএলি বাহিনী এখন কোথায়?) যুক্তিটি অতি সুস্পষ্ট। ধর্মরাজ যদি নিজেকে স্টেক করে আগেভাগেই খুইয়ে ফেলে দুর্যোধনের দাস হয়ে গিয়ে থাকেন তবে যেহেতু দাসের কোনও সম্পত্তিতে অধিকার থাকতে পারে না অতএব দাস যুধিষ্ঠির কৃষ্ণাকে স্টে করতে পারেন না (দাস হবার পূর্বেও তিনি মাত্র ২০% মালিক কিন্তু এ লপইনট বোধহয় তখন ওঠেনি।(১)

তা সে যা-ই হোক, ওই একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তরই তিনি পাচ্ছেন না। এবং হা অদৃষ্ট! কোনও প্রোটকলও খুঁজে পাচ্ছেন না যার চাপে তিনি সভাসদদের মুখ খোলাতে পারেন। বরঞ্চ ভীষ্ম যে প্রোটকল উত্থাপিত করলেন তার মোদ্দা : ডিসটিংগুইশট দ্রুপদতনয়া তাদের প্রশ্ন শুধিয়েছেন (ইংরেজিতে এস্থলে বলে বার্কিং আপ দি রং ট্রি)। তার উচিত তার স্বামী ধর্মরাজকে এ প্রশ্ন জিগ্যেস করা। তিনিই বলতে পারেন, কৃষ্ণা জিতা বা অজিতা!

কিন্তু বিদুর যে জিনিসের আশ্রয় নিলেন, সেটাকে প্রিসিডেনস, নজির বা হদিস বলা যেতে পারে, ঠিক প্রোটকল নয়। তাঁর মতে মহর্ষি কশ্যপ দৈত্যকুলের প্রহ্লাদকে অনুশাসন দেন হে প্রহ্লাদ, যে ব্যক্তি জানিয়া শুনিয়াও প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দেয় এবং যে সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে তাহারা সহস্ৰ সংখ্যক বারুণ-পাশ দ্বারা বন্ধন পায়।(২) অর্থাৎ silence সর্বাবস্থায় golden নয় (অবশ্য এস্থলে gold is silent, কারণ সভাসদদের আর সকলেই দুর্যোধনের gold 60161 silent!)

কিন্তু এ নজির ধোপে টিকল না। মহাভারতকার বলছেন, বিদুরের বাক্য কর্ণগোচর করিয়া সভাস্থ পার্থিবরা কিছুই প্রত্যুত্তর করিলেন না!!!

কিন্তু এ সব চুলচেরা বাগ্‌বিতণ্ডার মূলে কে?

দ্রৌপদী যে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন সেটা তো কেউ সেকেন্ড করবে। নইলে সেটা উলট্রা ভিরেস, নাকচ।

নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে সেকেন্ড করে বসল দুর্যোধনের ছোট ভাই চ্যাংড়া অর্বাচীন বিকর্ণ! তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, যাজ্ঞসেনী যাহা কহিয়াছেন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, ইহারা আসিয়া এ বিষয়ে কিছু বলুন। তার পর তিনি যখন দেখলেন সভাসদবর্গের কোনও ব্যক্তিই সাধু অসাধু কিছুই কহিলেন না তখন হস্তে হস্ত নিষ্পেষণ করিয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, অর্থাৎ অনেক যুক্তিতর্ক দেখিয়ে রায় দিলেন, এই সকল বিচার করিয়া দেখিলে দ্রৌপদীকে জয়লব্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না।

সর্বনাশ! আজকের দিনের ভাষায় বলতে গেলে এ যেন নিতান্ত চ্যাংড়া ঘানা বা মালি রাষ্ট্র সেকুরিটি কৌনসিলে বলে বসল, এই সকল বিচার করিয়া দেখিলে (অর্থাৎ যেহেতু ইজরাএলই প্রথম আক্রমণ করেছে) সাইনাইকে ইজরালের (প্রাচীন দিনের ভাষায় দুর্যোধনের) জয়লব্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না।

ধুন্ধুমার লেগে গেল সভায়, মহাভারতের ভাষায় সঙ্কলরবে (একসুরে) তুমুল নিনাদ উঠল সভাস্থলে। এখানে আমার বলা উচিত যে, বিদুরাদি কেউ কিছু বলার পূর্বেই বিকর্ণ আপন রায় দিয়ে বসে আছেন। তাঁর ভয় হয়েছিল, প্রবীণরা নীরবতা দিয়ে দ্রুপদনন্দিনীর প্রশ্নটি পিষে ফেলবেন– নীরবতা যে শুধুমাত্র হিরন্ময় তাই নয়, সরব প্রশ্নকে নিধন করার মারণাস্ত্রও বটে।

অনেকেই বিকর্ণের পক্ষে সায় দিচ্ছেন দেখে কর্ণ ফ্লর গ্রহণ করলেন। বললেন, হে বিকর্ণ, এই সভায় বহুবিধ বিকৃতি দৃষ্ট হইতেছে বটে।

আমরাও বলি, সেই কথাই কও। বিকৃতি মানে প্রোটকল-সম্মত নয়!

কর্ণ বললেন, তুমিই কেবল বালস্বভাবসুলভ অসহিষ্ণুতায় অধৈর্য হইয়া স্থবিরোচিত বাক্য প্রয়োগ করিতেছ। তুমি দুর্যোধনের কনিষ্ঠ, পর্ব বিষয়ে যথাবৎ অভিজ্ঞ হও নাই।

এইবারে কর্ণ মারলেন পেরেকটার ঠিক মাথার উপর মোক্ষম ঘা। এই পর্ব বস্তুটি কী? কারণ মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের যে নির্ঘণ্ট আছে তার প্রথমটার মতে বিকর্ণের নম্বর আট, দ্বিতীয়টার মতে উনিশ।

আর পর্ব অর্থই হচ্ছে নির্দিষ্ট–আমাদের পরব মাত্রই হয় নির্দিষ্ট দিন ক্ষ্যাণে। তাই পর্বই হচ্ছে প্রোটকল। যা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, যার থেকে নড়চড় নেই। বিকর্ণ সেই প্রোটকল ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু তার ও দ্রৌপদীর কার্যোদ্ধার অংশত হয়ে গেছে। ওদিকে আবার কর্ণ স্বয়ং করে বসেছেন প্রোটকলে গলদ!

কারণ সভারম্ভেই মি. প্রেসিডেন্ট দুর্যোধন প্রোটকল ধার্য করে দিয়েছেন– কর্ণ যাকে পর্ব বলেছেন যে, কৌরবগণ দ্রৌপদীর সমক্ষে তাহার প্রশ্নের উত্তর করুন। অর্থাৎ তিনি ফ্লর দিয়েছেন কুরু সদস্যদের। অপিচ কর্ণ আইনত (ডে জুরে) রথচালক শ্রেণির লোক– আজকের ভাষায় শোফার সর্দারজি ক্লাস (যদ্যপি প্রকৃতপক্ষে (ডে ফাটো) তিনি কুন্তীনন্দন প্রথম পাণ্ডব; কিন্তু সদস্যগণ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলে এ বিবেচনা এস্থলে উঠতে পারেনি, কস্মিনকালে ওঠেওনি]। তিনি ফ্লর গ্রহণ করতে পারেন না। তবে বিকর্ণ যে প্রোটকল ভঙ্গ করেছেন সেটা হয়তো তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন– কারণ পইন্ট অব্‌ অরডার সভাসীন যে কোনও সদস্য যে কোনও সময়ে তুলতে পারেন। কিন্তু তার পর কর্ণ যখন বললেন, দ্রৌপদী ও পাণ্ডবগণের যাহা কিছু আছে সে সমুদয়ই শকুনি ধর্মতঃ জয় করিয়াছেন তখন তিনি বিলকুল আউট অব্ প্রোটকল। কারণ প্রেসিডেন্ট রুলিং দিয়েছেন, উত্তর দেবেন কৌরবরা।

অতএব দ্রোণ যে ফ্লর গ্রহণ করেননি সেটাও অতিশয় করে। কারণ তিনি ও অন্যান্য কৌরবেররা অবগত আছেন ব্যাপারটা বহুলাংশে কুরু-পাণ্ডবের ঘরোয়া ব্যাপার। যে শকুনি সর্বস্ব জয়লাভ করেছেন তিনিও তার হক্কের দাবি করে ফ্লর চাননি।

বস্তুত সভাপতিরূপে ডিটিংগুইশ প্রেসিডেন্ট মি. দুর্যোধনের আচরণ অক্ষরে অক্ষরে প্রোটকলসম্মত। তিনি কুরুকুলকে ক্ষুর দিয়েছেন কিন্তু কি ভীষ্ম কি বিদুর কাউকে কিছু বলার জন্য কোনও চাপ দিচ্ছেন না।

অবশেষে তুমুল বাগ-বিতণ্ডার পর প্রেসিডেন্ট দুর্যোধন যখন স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে কুরুকুলের কেউই আপন সুচিন্তিত অভিমত দিচ্ছেন না, যাজ্ঞসেনী যে জিতা সে রায় দূরে থাক (কর্ণের রায়ের মূল্য নেই, এবং দুঃশাসন তখন প্রতিহারী বা বেলিফ বা সভার মারশাল; এবং তিনিও সুদ্ধমাত্র দ্রৌপদীকে অপমানার্থে দাসী দাসী বলে সম্বোধন করছেন, যুক্তিতর্ক দ্বারা শকুনির লিগেলরাইট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি) তখন তিনি যে রুলিং দিলেন সেটাও অতিশয় ন্যায্য। তিনি জানতেন যে যদিও তিনি আইনত প্রেসিডেন্ট, তবুও এ তত্ত্ব অনস্বীকার্য যে কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম কুরুকুলের সর্বোচ্চ আসন ধরেন। তিনি যখন স্পষ্ট বলেছেন, স্বয়ং ধর্মরাজ এর মীমাংসা করুন তখন এ সিদ্ধান্ত এক হিসেবে তাবৎ কুরুবংশের সিদ্ধান্ত। এবং যেহেতু দুর্যোধন সভারম্ভেই বলেছেন কুরুকুল উত্তর দেবেন তখন যুক্তিযুক্তভাবেই শেষ উত্তর দিলেন, কুরুকুলের সিদ্ধান্ত; ধর্মরাজ উত্তর দেবেন। কিন্তু ধর্মরাজ যখন ফ্লর গ্রহণ করলেন না, তখন তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, (ধর্মরাজ যখন ফ্লর নিচ্ছেন না তখন প্রোটকলানুযায়ী তাঁর কনিষ্ঠেরা ফ্লর পাবেন– হুবহু যেরকম অপর পক্ষে বিকর্ণ পেয়েছিলেন) হে যাজ্ঞসেনী, ভিম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের মতই আমার মত।

এবং এঁরাও ফ্লর গ্রহণ করলেন না। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন না।

এখানেই সভা শেষ।

সম্পাদক মহাশয়, যতই চিন্তা করি, পুনরায় মহাভারত অধ্যয়ন করি, পুনরায় চিন্তা করি, তখন দেখি, সেই অতি প্রাচীনকালে আমরা কতখানি ন্যায়ধর্ম ও প্রোটকল মেনে সভা চালাতুম! যদি দুঃশাসনের অনার্য চরণের কথা তোলেন তবে বলব সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়, দুর্যোধন কর্তৃক দ্রৌপদীকে উরুমধ্য প্রদর্শন অনুচিত কিন্তু সেগুলো ইনট্রিগেল পার্ট অব দি প্রসিডিংস অব দ্য মিটিং নয়, সভার কর্মসূচির অন্তর্গত অবর্জনীয় অংশ নয়। দুঃশাসন ও দুর্যোধন শুধু অতিশয় রূঢ় পদ্ধতিতে দেখাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের মতে দ্রৌপদী জিতা। সভার কার্যকলাপে প্রোটকল আদৌ লাঞ্ছিত হননি।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, সম্পাদক মহাশয়, সে যুগে ফিলিমি ছিল না, তার মাসিক ছিল না, তস্য সম্পাদক ছিলেন না। কাজেই তাঁকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয় সে-বাবদে কোনও প্রোটকল খুঁজে পেলুম না। তবু খুঁজছি, কারণ দুধ না পেলেও পিটুলি পাব নিশ্চয়ই!!

————

১. ইসলামে দাস যেমন আইনগত পূর্ণ নাগরিক নয় (সেখানেও সে কোনও কিছু স্টেক করতে পারে না) ঠিক তেমনি সে কোনও আইনভঙ্গ করলে (চুরি, ডাকাতি) তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা হয় না। খেসারত দিতে হয় মুনিবকে।

২. জ্বর-জ্বালাদি রোগকেও পাশ বলে ধারণা করা হত বলে অথর্ববেদে ঋষি পাশমুক্তির জন্য বরুণদেবকে আহ্বান জানাতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *