গৌড়ানন্দ কবি ভনে

প্রেসিডেনট নিকসনের মারাত্মক ভুল

প্রেসিডেনট নিকসনের মারাত্মক ভুল

‘শুনেছেন? প্রেসিডেনট নিকসন পদত্যাগ করেছেন’ প্রোফেসর পাংচুর টেলিফোন আমার ঘুম ভাঙাল।

চোখ মুছতে মুছতে বললাম, ‘কে বললে?’

‘এই মাত্তর রেডিওতে শুনলাম।’ প্রোফেসার পাংচু আফশোস করে বললেন, ‘বেচারি! ‘ তারপর বোধ হয় বিদায়ী প্রেসিডেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এক মিনিট নীরবতা পালনই করলেন। তারপর আবার বললেন, ‘অথচ জানেন, যদি আমার পরামর্শ শুনতেন তাহলে এই বিপাকে তাঁকে আর পড়তে হত না। ভাবমূর্তিটাকে উজ্জ্বল রেখে একেবারে বিজয়ী হয়েই বেরিয়ে আসতে পারতেন।

‘বলেন কি? এমন পরামর্শ তিনি নিলেন না।’

‘গ্রহের ফের। তাছাড়া আর কী বলা যায় বলুন? না হলে এমন তুখোড় হুঁশিয়ার একটা লোক, এই রকম সব ঠিকে ভুল করেন?’

তো যা বলেছেন। ওঁর মত একজন লোকের পক্ষে ওয়াটারগেট ভবনে ডেমোক্রেটিক পারটির অফিসে আড়ি পাতার ব্যাপারে জড়িয়ে পড়াটা মারাত্মক ভুলই হয়েছে।’

‘আরে দূর মশাই, ইলেকশন জেতার জন্য ওসব করতেই হয়। ওটা আবার ভুল কী? তাহলে তো আপনি শত্রুপক্ষের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়াটাও ভুল বলে বসবেন। ওসব হল স্ট্র্যাটেজি। না না, ওয়াটারগেটে আড়ি পেতে ওঁরা কি ভুল করেননি?’

তাহলে আপনি বলতে চান, হোয়াইট হাউসে বসে প্রেসিডেনট নিকসন তাঁর চামচাদের সঙ্গে গোপনে যে-সব ফন্দি-ফিকির এঁটেছিলেন তার টেপগুলো আদালতে কি সেনেট তদন্ত কমিটিতে জমা না দেওয়াটাই ভুল হয়েছিল?’

‘আমি কী পাগল যে সে-কথা বলব, আমি কি ফন্দি এঁটেছি না এঁটেছি, তা অন্যকে জানাতে যাব কোন দুঃখে? টেপগুলো না দিলে নিকসনের কোনও অন্যায় হত না। দিয়েই তিনি ভুল করেছেন।’

তবে কি আপনি আয়কর গোপন করাটাই নিকসনের ভুল বলতে চান?’

‘আরে না মশাই। ভি আই পি-দের পক্ষে আয়কর ঠিক ঠিক দিয়ে দেওয়াটাই বরং গর্হিত কাজ। আয়কর গোপন করলেই বরং ওঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থাকে। আমাদের বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের কেউ কেউ তো আয়কর দিতে ভুলেই যান। তা বলে কি তাঁদের পদত্যাগ করতে হয়? এদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিন্তু এ কথা বলতেই হয় যে, আমাদের দেশের গণতন্ত্রের বনিয়াদ আমেরিকার চাইতে অনেক স্ট্রং। কিছুতেই টলে না।’

‘তাহলে? ও বুঝেছি ইলেকশন ফানডে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গোপনে মোটা টাকা নেওয়াটাই নিকসনের কাল হয়েছে। সত্যিই তো ওটা অন্যায়। তাই না?’

‘কিছু বুঝেছেন। মোটা মোটা টাকা না এলে মোটা মোটা ইলেকশন কীভাবে ম্যানেজ করা যাবে? আমেরিকার কথা ছেড়েই দিন, আমাদের গরিবি হটাও নির্বাচনেরই বা খরচা চলবে কী করে? গোপন টাকা না এলে? আপনি মশাই ডেঞ্জারাস লোক। এ-ধরনের কথা বেশি বলবেন না। ডি আই আর-এ কি মিসার কোন দিন চালান হয়ে যাবেন।’

‘তাহলে আপনি নিকসনের ভুল কাকে বলছেন? প্রেসিডেন্ট জাতির কাছে মিথ্যা ভাষণ করেছেন?’

‘নেতাদের ভাষণের আবার সত্যি মিথ্যা কী মশাই? তাহলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।’

‘তাহলে? প্রেসিডেন্ট গিন্নী যে গহনাগুলো হাতিয়ে নিয়েছেন সেই কাজকেই –

‘মেয়েছেলে দুটো গয়না পরেছে তাতে মহাভারত একেবারে অশুদ্ধ হয়ে গেল! যত্তো সব!’

‘কী মুশকিল, তাহলে ভুলটা কোথায় করলেন নিকসন, সেটা বলবেন তো?’

‘নিসনের ভুলটা কোথায় হয়েছে জানেন? না না, তাঁর কাজে কর্মে এমন কোনও ভুল হয়নি। নেতাদের যা যা করা উচিত তিনি তাই-ই করেছেন। ওঁর ভুলটা হয়েছে তদন্তের ব্যাপারে।’

‘তদন্তের ব্যাপারে নিকসন কী করবেন?

‘বলছেন কী মশাই! নিকসনের বিরুদ্ধে তদন্ত, উনি কি করবেন মানে? আমি তো সেই পরামর্শই দিয়েছিলাম।’

একটু থেমে প্রোফেসর পাংচু বললেন, বিস্তারিত বলার সময় এখন আসেনি। সাপেক্ষে বলছি।’

‘বলেছিলাম’ প্রোফেসার পাংচু বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব, আপনি প্রথমেই এই মর্মে ঘোষণা করুন : হে আমার দেশবাসী, আমার বা আমার প্রশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র বিরোধী কাজ, ক্ষমতার অপব্যবহার সরকারী সম্পত্তি গ্রাস, ঘুষ গ্রহণ, আয়কর ফাঁকি, বিবিধ দুর্নীতি প্রভৃতি বিষয়ে আমি তদন্ত করতে উদ্যোগী হয়েছি এবং এই কারণে আমি খাঁটি অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিশিষ্ট এক তদন্ত কমিশন নিয়োগ করেছি। আমার বা আমার প্রশাসনের বিরুদ্ধে যার যা কিছু অভিযোগ আছে, নাম ঠিকানা সহ আমার কাছে দায়ের করুন। বিঃ দ্রঃ প্রত্যেকটি দরখাস্ত প্রোফেসার পাংচুস ওয়ানডার ইংকে অবশ্যই লিখিত হওয়া চাই। অন্য কালিতে লেখা দরখাস্ত গ্রাহ্য হবে না। দ্বিতীয় প্রস্তাব : দরখাস্ত আসামাত্র এফ বি আই, সি আই এ এবং আমেরিকার বাঘা বাঘা প্রাইভেট ডিটেকটিভদের তাদের পিছনে লেলিয়ে দিন। সব শা— হাওয়া হয়ে যাবে। কমিশনের সামনে হলফনামা দাখিল করার লোক পাওয়া যাবে না। তৃতীয় প্রস্তাব : অবশেষে কমিশন মাত্র একটি অভিযোগ সম্পর্কে বিচার করতে বাধ্য হবেন। সে অভিযোগটি এসেছিল আরিজোনার এক স্কুলের ছাত্রী মিস ললি পপের কাছ থেকে। তার অভিযোগ : প্রেসিডেনট তাকে এক প্যাকেট চুইং গাম কিনে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। প্রেসিডেনট শপথ নিয়ে জানাবেন, এ অপরাধ তাঁর ইচ্ছাকৃত নয়। তিনি দাঁতাতের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকার কথাটা একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। কমিশন সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে প্রেসিডেনটকে মৃদু ভর্ৎসনা করবেন এবং রায় দেবেন যে প্রেসিডেনটকে টেলিভিশনের সামনে মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’

‘বখেড়া এখানেই মিটে যেত’, পাংচু বললেন, ‘আর তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য প্রেসিডেনটের ভাবমূর্তি কত উজ্জ্বল হত, ভেবে দেখুন তো।’

১০ অগাস্ট ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *