প্রেম

প্রেম

কী কায়দায় আলাপ হয়েছিল সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

ছোকরা আইন পড়ে।

একদিন বলল চ, একটা ইনট্রেসটিং মোকদ্দমা হচ্ছে। এদেশের নিয়ম, আইন পরীক্ষা দেবার পূর্বে ছ বার না দশবার আমার সঠিক মনে নেই– আদালতে হাজিরা দিতে হয়, বোধহয় সরকারি উকিলের অ্যাসিসট্যান্টরূপে দু-চারবার কাগজপত্রও দুরস্ত করে দিতে হয়।

সুইস আদালত আদৌ ভীতি উৎপাদক নয়। কেমন যেন ঘরোয়া ঘরোয়া ভাব।

অথচ মোকদ্দমাটা বেশ গুরুতর বিষয় নিয়ে।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটি যুবতী। সুন্দরী বলা চলে না, সাদামাটা, তবে দেখতে ভালোই। এবং তার চেয়ে বড় কথা, মেয়েটি বেশ স্বাস্থ্যবতী। মুখের রঙটি যেন শিশিরে ভেজা। জানা গেল, মেয়েটি সুইস ইতালিয়ান।

দোস্ত ফিসফিস করে বলল, জানিস তো, জাতে সুইস হলেও এই ইতালিয়ানরা একটু আস্টেডি অর্থাৎ উড়ুক্কু ভাব ধরে।

প্রেমট্রেমের ব্যাপার আদালত সংক্ষেপেই সারে। তবে এস্থলে বিবরণীটি নিশ্চয়ই কোনও রোমান্টিক ছোকরা পুলিশ লিখেছিল। প্রেমটা হয়েছিল গভীরই। প্রতি ছুটির দিনে উইক-এন্ড, এমনকি কাজকর্মের ফাঁকেফিকিরে সিনেমা-কাবারে-সুইমিং পুল। বেশ স্ফূর্তিতে কেটেছে দিনগুলো– কোনও সন্দেহ নেই। এবং কোনও সন্দেহ নেই মেয়েটাই মজেছিল মরমে মরমে।

সরকারি উকিল গলাখাকরি দিয়ে বললেন, এবং খর্চাটা মেয়েটির কষ্টে জমানো টাকা থেকে।

আমার কান ছিল বিবরণীর দিকে, চোখ মেয়েটির পানে। এতক্ষণ তার মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন হয়নি। এবারে তার ঠোঁটের কোণে যেন ঈষৎ অসহিষ্ণুতার ভাব দেখা গেল।… উকিল পড়ে যেতে লাগলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আসামি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। প্রকাশ, ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করেছিল, আসামিকে বিয়ে করবে। আসামির পিতামাতা ধর্মভীরু, সে-ও প্রতি রোববারে গির্জেয় যেত। আসামি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে জানামাত্রই ছেলেটা পালায়।

এবারে বিবরণী প্রথম পুরুষে– মেয়েটির বাচনিক।

আমার এই বিপদে আমাকে সাহায্য করবার মতো সে শহরে কেউ ছিল না; জমানো কড়িও ফুরিয়ে গিয়েছে। তখন স্থির করলুম, গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবা-মাকে সব খুলে বলব। তারা আঘাত পাবেন জানতুম, কিন্তু এছাড়া আমি অন্য পথ খুঁজে পেলুম না।

বাড়ি ফিরে যে অবস্থা দেখলুম তাতে বাবা-মাকে কিছু খুলে বলার সাহস আমার আর রইল না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমার দু বছরের ছোট বোনটি– সে-ও শহরে গিয়েছিল কাজ নিয়ে, সে-ও ফিরে এসেছে পেটে বাচ্চা নিয়ে। তাকে কে দাগা দিয়েছে শুধধাইনি। আমি কী কষ্টের ভিতর দিয়ে গিয়েছি সে শুধু আমিই জানি। সে বাবা-মাকে সব খুলে বলেছে। আমাকে বলল, তাঁরা বড় আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু তাকে গ্রহণ করেছেন, বাচ্চাটাকেও মানুষ করবেন।

আমি তখন করি কী? দু-দুটো মেয়ে কুপথে গেল– অথচ তারা কত যত্নেই আমাদের মানুষ করেছিলেন। আমি তাদের কী করে বলি, আমিও কুপথে গিয়েছি। আর দু-দুটো বাচ্চা তারা পুষবেনই-বা কী করে?

আমি স্থির করলুম, আমার বাচ্চাটাকে আমি বিসর্জন দেব। হাজার হোক, আমার ছোট বোন। তার হক বেশি। আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। সে বেচারি একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমিও যদি মুখে কলঙ্কের ছোপ মাখি তবে তার হয়ে পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই দেব কী করে?

আমি মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলুম। সে যেন একেবারে পাষাণ হয়ে গিয়েছে।

এবারে সরকারি উকিল বললেন, নদীপারে নির্জনে আসামি বাচ্চা প্রসব করে তাকে জলে ফেলে দেয়। তার পর একটু থেমে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কিন্তু সেখানে আর কেউ ছিল না বলে প্রমাণ করা অসম্ভব না হলেও সুকঠিন, বাচ্চাটা মৃতাবস্থায় জন্মেছিল কি না।

সমস্ত আদালতঘর নিস্তব্ধ, নীরব।

এইবারে প্রথম জজ মুখ খুললেন। সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টি ফেলে শুধোলেন, বাচ্চাটা জন্মের সময় জীবিত না মৃত ছিল?

মেয়েটি একবার মুখ তুলে তাকিয়ে ফের মাথা নিচু করল। বলল, আমি সত্যই শপথ করে বলতে পারব না। আমি আমার আমি তখন সবকিছু বুঝতে পারিনি।

আশ্চর্য, জজ তো নয়-ই সরকারি উকিল পর্যন্ত কোনওরকম জেরা বা চাপাচাপি করলেন না, প্রকৃত সত্য উঘাটন করার জন্য। কারণ এটা তো আইনত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাচ্চা জ্যান্ত জন্মে থাকলে এটা খুন হয়তো মারডার নয় ম্যানটার– আর মৃতাবস্থায় জন্মে থাকলে বা জন্মের পরেই যদি মরে গিয়ে থাকে তবে বাচ্চা প্রসবের কথা পুলিশকে জানায়নি বলে অপরাধটা কঠিন নয়–হাইডিং অব এভিডেন্স, সত্য তথ্য নির্ধারণের প্রমাণ গোপন করেছে শুধু।

মোকদ্দমা এখানেই শেষ বলা যেতে পারে। কিন্তু জজ তবু একটা প্রশ্ন শুধোলেন, আড্ডা, তুমি সেই ছেলেটার সন্ধান নিলে না কেন? তাকে বিয়ে করাতে বাধ্য করালে না কেন?

কুণ্ডলি পাকানো গোখরো সাপ যেরকম হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায় মেয়েটা ঠিক সেইরকম বলে উঠল, কী! সেই কাপুরুষ– যে আমাকে অসহায় করে ছুটে পালাল! তাকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাকে দেব সেই কাপুরুষের, সেই পশুর নাম! তার পর দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। গোঙরানোর শব্দ কানে এল।

আমি তার মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারিনি।

প্রেম যে কী দ্বেষ, কী ঘৃণায় পরিণত হতে পারে তার বিকৃত মুখে দেখলুম– পূর্বেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।

আমি বসেছিলাম একেবারে দরজার পাশে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম।

দু দিন পরে দোস্তের সাথে ফের দেখা।

বলল, ছোঃ, তুই বড্ড কাঁচা। পালালি?

 কী সাজা হল?

চার মাস। কিন্তু জেলে যেতে হবে না। গাঁয়ের পাদ্রি সাহেবের কাছে প্রতি সপ্তাহে একবার করে হাজিরা দিতে হবে– গুড় কনডাকটের রিপোরট দেবার জন্য। আদালত বললেন, সমস্ত পরিবার যে বদনামের পাবলিসিটি পেল, সে-ই যথেষ্ট সাজা– আর যার ফাঁসি হওয়া উচিত সে তো আদালতে নেই।

প্রেম যে কী দ্বেষ, কী ঘৃণার—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *