প্রেম

প্রেম

মাত্র বারো ঘণ্টা তারা একসঙ্গে ছিল। অসিতা আর সুপর্ণ। সুপর্ণ অফিসের কাজে একদিনের জন্যে বোম্বাই থেকে কলকাতা যাচ্ছিল। আর অসিতা কলকাতা থেকে বোম্বাই এসেছিল তার দাদার কাছে। তার দাদা বোম্বাই-এ বড় চাকরি করেন, অসিতার একটি বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন এবং পাত্রপাত্রীর দেখাশোনার জন্যে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পাত্রপাত্রী দু’জনেই দু’জনকে পছন্দ করেছে। তারপর সাতদিন বোম্বাই-এ কাটিয়ে অসিতা কলকাতায় ফিরে যাচ্ছে। এরপর অভিভাবকেরা যথাকৰ্তব্য করবেন।

ভোরবেলা সান্টাক্রুজ বিমানবন্দর থেকে প্লেন ছাড়ল। ক্যারাভেল প্লেন, ঘণ্টা তিনের মধ্যে কলকাতা পৌঁছে যাবে।

অসিতা আর সুপর্ণ পাশাপাশি সীট পেয়েছিল। প্লেন আকাশে উঠলে তারা অন্য যাত্রীদের লক্ষ্য করল, কিন্তু বাঙালী আর কেউ থাকলেও চেনা গেল না। পরিদর্শন শেষ করে তারা পাশের দিকে চোখ ফেরাল। সুপর্ণ দেখল, তার পাশে বসে আছে একটি ছোটখাটো সুশ্রী মেয়ে; তার সাজ-পোশাক শাড়ি পরার ভঙ্গি দেখে সন্দেহ থাকে না, সে বাঙালী মেয়ে। অসিতা দেখল, বিলিতি পোশাক-পরা সাতাশ-আটাশ বছরের সুদর্শন যুবা, বাঙালী কিনা চেনা যায় না।

সুপর্ণর মুখে হাসি ফুটল, সে বলল—‘আমিও বাঙালী।’

অসিতা লজ্জা-লজ্জা হাসল—‘আমি আন্দাজ করেছিলুম, কিন্তু—’

সুপর্ণ বলল—‘কিন্তু বিজাতীয় পোশাক দেখে নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। আপনি কি বম্বেতেই থাকেন?’

‘না, কলকাতায় থাকি। বম্বেতে আমার দাদা থাকেন।’

‘ও-বেড়াতে এসেছিলেন। আপনার দাদার নাম কি?’

অসিতা নাম বলল। সুপর্ণ বলল—‘আমি চিনি না।’

‘আপনি বুঝি বম্বেতেই থাকেন?’

‘বছরখানেক আছি। তবে আমার বাউণ্ডুলে চাকরি, কবে কোথায় বদলি হয়ে যাব কিছু ঠিক নেই।’

এয়ার হোস্টেস এসে সকলকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। খেতে খেতে দু’জনে গল্প করতে লাগল। সহজ সরল গল্প; কার বাড়িতে কে কে আছে, কে কোন দেশে বেড়াতে গিয়েছে, কোন লেখক কার প্রিয়, এইসব। তারা যে দু’জনেই অবিবাহিত, প্রশ্ন না করেও তা জানতে পারল।

হঠাৎ কো-পাইলট এসে যাত্রীদের সামনে দাঁড়াল, হাত তুলে বলল—‘একটি নিবেদন আছে। ভয় পাবেন না। ইঞ্জিন একটু গোলমাল করছে, আমাদের ঘণ্টাখানেকের জন্যে নাগপুরে নামতে হবে।’

যাত্রীরা উদ্বিগ্ন মন নিয়ে বসে রইলেন। অসিতা আর সুপর্ণ পরস্পরের মুখের পানে চেয়ে হাসল। যেন ভারি সুখবর।।

প্লেন নাগপুরে নামল। ইঞ্জিনের ত্রুটি কিন্তু সহজে মেরামত হলো না, প্রায় ন’ ঘণ্টা লেগে গেল। এই ন’ ঘণ্টা সুপর্ণ আর অসিতা একসঙ্গে রইল; এয়ারপোর্টের খাবার ঘরে একসঙ্গে লাঞ্চ খেল, একসঙ্গে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল, পাশাপাশি বসে গল্প করল। তারপর যখন প্লেনে ওঠবার ডাক পড়ল, তখন দু’জনে উঠে পাশাপাশি বসল। প্লেন ছেড়ে দিল।

প্লেন যখন দমদমে পৌঁছুল, তখন রাত্রি হয়ে গেছে। দু’জনে প্লেন থেকে নেমে বাইরের ভেস্টিব্যুলে এসে দাঁড়াল। সুপর্ণ বলল—‘দিনটা কোন্‌ দিক দিয়ে কেটে গেল জানতেই পারলাম না।’

অসিতা একটু ফিকে হাসল, বলল—‘আমার দাদা গাড়ি এনেছেন। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

সুপর্ণ লোভ দমন করে বলল—‘আপনি যাবেন বারাকপুরে, আপনাদের কষ্ট দেব না। আমি স্টেশন ওয়াগনেই যাব।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল—‘আচ্ছা।’

অসিতা তার হাতে হাত মেলাল, বলল—‘আচ্ছা।’

চার বছর কেটে গেছে।

সুপর্ণ বিয়ে করেছে, একটি ছেলে হয়েছে। ছেলের বয়স যখন বছরখানেক, তখন সুপর্ণ বাঙ্গালোরে বদলি হলো। এর আগে সে বাঙ্গালোরে আসেনি, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এসে উপস্থিত হলো।

বাঙ্গালোরে বাঙালী বাসিন্দার অভাব নেই, কিন্তু সুপর্ণ যে-পাড়ার বাসা পেয়েছিল, সে পাড়াটি উচ্চবর্গের হলেও সেখানে বাঙালীর সংখ্যা কম। তারা গোছগাছ করে বসবার পর একদিন বিকেলবেলা সুপর্ণর সদর দরজার ঘন্টি বেজে উঠল।

সুপর্ণ এসে দরজা খুলে দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণ বাঙালী মিথুন। যুবকটি অপরিচিত, কিন্তু যুবতীকে দেখেই সুপর্ণ চিনতে পারল—অসিতা। দু’জনেই চক্ষু বিস্ফারিত করে করে চাইল।

যুবকটি একমুখ হেসে বলল—‘আমার নাম মন্মথ চৌধুরী, কাছেই থাকি। পাড়ায় বাঙালী এসেছেন শুনে এলাম। এ আমার স্ত্রী অসিতা।’

‘আসুন আসুন।’ সুপর্ণ তাদের লিভিং রুমে নিয়ে গিয়ে বসাল, নিজের স্ত্রী তৃপ্তিকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল। তৃপ্তি মেয়েটি কান্তিময়ী হাস্যমুখী গৃহকর্মে নিপুণা। সে অসিতার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল, ছেলেকে এনে দেখাল। কথাবার্তায় জানা গেল অসিতার একটি মেয়ে হয়েছিল, আঁতুড় ঘরেই মারা যায়। তারপর আর হয়নি।

ওদিকে মন্মথ আর সুপর্ণও খুব গল্প জমিয়েছিল। দু’জনে সমবয়স্ক, কর্মক্ষেত্রেও সমপদস্থ। ঘণ্টাখানেক পরে চা-টা খেয়ে মন্মথরা উঠল, বলল—‘এবার আপনাদের পালা। আমার বাসা কাছেই।’ সে নিজের ঠিকানা দিল। যাবার সময় অসিতা সুপর্ণর পানে চেয়ে একটু মুখ টিপে হাসল। কিন্তু তাদের পূর্ব পরিচয়ের কথা দু’জনেই চেপে গেল।

পরদিন বিকেলবেলা সুপর্ণ তৃপ্তিকে বলল—‘চল ওদের বাড়ি যাই।’

তৃপ্তি একটু ভুরু তুলে বলল—‘আজই?’

‘দোষ কি?’

‘বেশ চল।’

দু’জনে মন্মথ চৌধুরীর বাড়ি গেল। সেখানে আদর-আপ্যায়ন খাওয়া-দাওয়া। তারা যখন বাড়ি ফেরবার জন্য উঠেছে তখন অসিতা সুপর্ণর দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসল।

তারপর রোজই যাওয়া-আসা চলতে লাগল। এরা একদিন যায় তো ওরা একদিন আসে। গল্পসল্প হয়, অসিতা অন্য দু’জনের অলক্ষ্যে মুখ টিপে হাসে।

মাসখানেক এইভাবে চলবার পর ক্রমে মন্মথ আর তৃপ্তি এই যাওয়া-আসার পালা থেকে খসে পড়ে। কেবল সুপর্ণ আর অসিতা আসে যায়। বিকেল হলেই তাদের মন অন্য বাড়ির দিকে টানতে থাকে।

তিন মাস কেটে গেল। তাদের সম্বোধন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এল। একদিন সুপর্ণ অসিতাদের বাড়ি গিয়ে দেখল মন্মথ বেরুচ্ছে। মন্মথ বলল—‘আমাকে একবার বেরুতে হবে। তুমি বোসো ভাই, পালিও না! আধ ঘন্টার মধ্যেই আমি ফিরব।’

মন্মথ চলে গেল। অসিতা আর সুপর্ণ টেবিলের দু’পাশে মুখোমুখি বসল। এই তাদের প্রথম জনান্তিকে দেখা। অসিতা মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বলল—‘আমাদের কী হয়েছে বলো দেখি?’

সুপর্ণ তার পানে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল—‘তোমাকে রোজ একবার না দেখলে থাকতে পারি না।’

অসিতা বলল—‘আমিও না।’

‘কিন্তু আমি তৃপ্তিকে ভালবাসি।—’

‘আমিও আমার স্বামীকে ভালবাসি।—তবে এটা কী?’

সুপর্ণ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল—‘জানি না।—পৃথিবীটা ভারি আশ্চর্য জায়গা।’

অসিতা স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল—‘পৃথিবীটা ভারি আশ্চর্য মিষ্টি জায়গা।’

মন্মথ ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা নীরবে মুখোমুখি বসে রইল।

সত্যি এটা কী? প্রেম?

১১ ডিসেম্বর ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *