প্রেম
আমার সেই বয়েসে একবার প্রেমে পড়ার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল। সেই বয়েসে, যে বয়েসে ঠোঁটের ওপর কচি কচি গোঁফের দুর্বো জন্মায়। দাড়িতে দু-এক গোছা ছাগুলে চুল দেখা যায়। গলাটা একটু ভারি ভারি হয়। মানুষ পাকা পাকা কথা বলতে শেখে। সবজান্তা, হাম-বড়া ভাব। লঘু গুরু জ্ঞানশূন্য। সব কথাতেই এক কথা যান যান, আপনি কি বোঝেন, আপনি কি জানেন? সেই বয়েস।
প্রেমে পড়তে হলে একটি মেয়ে চাই। যে-সে মেয়ে হলে হবে না। সুন্দরী হওয়া চাই। ডানা কাটা না হোক, দেখলে যেন প্রেমের উদয় হয়। নায়িকাদের বর্ণনা কত উপন্যাসে পেয়েছি। ছায়াছবির পর্দায় দেখেছি। চাঁদের আলোর ঝিলিক ফুটছে। গাছের ডাল ধরে নায়িকা গান গাইছে। ঝোপে কোকিল ডাকছে কু-উ-উ।
আমার বন্ধু সুখেন সেই বয়েসেই আমার চেয়ে অনেক বেশি পেকেছিল। হিন্দি সিনেমা দুমুড়ি চালে দেখত। ইংরেজি ছবির হিরো-হিরোইনের নাম কন্ঠস্থ ছিল। বুকপকেটে ম্যারিলিন মোনরোর ছবি পুষত। সে এক ছেলে ছিল বটে।
সুখেন বললে, সব মেয়েই তো আর প্রেমে পড়ে না। যেমন ধর, সকলের সর্দি হয় না। ন-মাসে ছ-মাসে হয়তো একবারই হল। কারুর আবার বারো মাসই সর্দি। সকাল হল তো ফ্যাঁচোর ফ্যাঁচোর হাঁচি। একে বলে সর্দির ধাত। এইরকম কারুর কাশির ধাত, কারুর পেট খারাপের ধাত। সেইরকম কোনো কোনো মেয়ের প্রেমের ধাত থাকে। ধাত বুঝে এগোতে হয়।
সে আমি কী করে বুঝব ভাই?
খোঁজখবর নিতে হবে। অতই সোজা চাঁদু। ঘুরে ঘুরে বাজার দেখো। তারপর ঝোপ বুঝে মারো কোপ। রাস্তায় ঘাটে, বাসে ট্রামে যেখানেই দেখবি কোনো মেয়ে তোর দিকে পুটুস করে তাকিয়েছে, তুই ক্যাবলার মতো চোখ সরিয়ে নিবি না, তুইও তাকাবি কটমট করে। বড়ো বড়ো চোখ। মেয়েটা যদি আবার তাকায়, তোর চোখে চোখ পড়বেই। চোখে জাদু থাকে, জানিস?
না ভাই।
কি জান তুমি? চোখের ফাঁদে আটকে ফেলবি। চোখে হাসবি। চোখে চোখে বলবি, সুন্দরী, তুমি আমার তুমি আমার। সম্মোহিত করে ফেলবি। নিজেকে ভাববি অজগর, সামনে তোর হরিণী।
তুই চোখ মারতে বলছিস? ও ভাই অসভ্য ছেলের কাজ।
তুই একটি গর্দভ। চোখ মারা নয়। চোখে ভাবের খেলা। সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখেছিস? এই চোখে জল, এই চোখে হাসি, এই চোখে প্রেম, এই চোখে ঘৃণা। সব চোখে-চোখেই মনের প্রকাশ। তেমনভাবে তাকাতে পারলে রয়েল বেঙ্গল ল্যাজ গুটিয়ে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে।
ও ভাই আমি পারব না। আমার ক্ষমতায় কুলোবে না। আমি কি সুচিত্রা সেন?
দূর মড়া! সুচিত্রা সেনের মতো অভিনয় ক্ষমতা, চোখের ভাষার কথা বলছি। বাড়িতে বড়ো আয়না আছে?
তা আছে।
আয়নার সামনে দাঁড়াবি, দাঁড়িয়ে চোখের ট্রেনিং শুরু করবি। ঘরে কাউকে ঢুকতে দিবি না। হাসবি কাঁদবি রাগবি গলবি চমকাবি চমকে দিবি। মুখের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হবে না। সব চোখে। চোখকে খেলাবি। এই হল তোর প্রেমের প্রথম পাঠ। এইটে উতরে গেলে দ্বিতীয় পাঠ।
মনে মনে ব্যাপারটা চিন্তা করে সুখেন ইয়ারকি করছে বলে মনে হল না। সত্যিই তো, বশীকরণ বলে একটা ক্রিয়া অবশ্যই আছে। তা না হলে পাঁজিতে এত বিজ্ঞাপন থাকে কেন? জাদুকর পি. সি. সরকার হল-সুদ্ধ লোককে হিপনোটাইজ করে কত খেলাই তো দেখিয়ে গেছেন। সেই সময়ের খেলা! নটার সময় সাতটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলেন।
আমাদের পাড়ার কার্তিককে মেসমেরাইজ করে এক গুণী ব্যক্তি নাম রেখে গেলেন কাকাতুয়া। বলেছিলেন ফিরে এসে ঠিক করে দোব। তিনি আর ফিরলেন না। সেই থেকে কার্তিক কাকাতুয়া। কাকাতুয়া বললে সাড়া দেয়। কার্তিক বললে সাড়া দেয় না।
দুপুর বেলা বড়ো বউদির ঘরে চোখের ট্রেনিং শুরু হল। কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে। সব তাহলে কেঁচে যাবে। বাড়িতে প্রাণীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। দুপুরের দিকে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই ধুঁকতে থাকে। বড়ো বউদির নাক ডাকে। আমার ছোটো বোন পিয়া কলেজে চলে যায়। এই হল সাধনার উপযুক্ত সময়।
নিজের চোখে আগে কখনো আমি অমন করে দেখিনি। কেউ দেখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। আমরা সাধারণত আয়নার সামনে দাঁড়াই, ঝট করে চুল আঁচড়াই, সট করে সরে আসি। এ একেবারে নিজের মুখোমুখি ফেস টু ফেস। নিজেকে নিজে দেখা। কখনো প্রেমের দৃষ্টিতে, কখনো ঘৃণার দৃষ্টিতে, কখনো আমন্ত্রণের দৃষ্টিতে, আও না পেয়ার করে, লাভ করে, আও না।
দুপুরটা কয়েকদিন এইভাবেই বেশ কাটল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি ঠেকিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে চোখে চোখে কথা বলে। হঠাৎ একদিন পিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেলুম। আমি জানতুম না ধরা পড়ে গেছি। পিয়া কোন সময় পিছন থেকে দেখে সরে পড়েছে। মনে হয় একটু ভয়ও পেয়েছিল। চুপি চুপি বড়ো বউদিকে বলেছিল, দাদা দুপুরবেলা তোমার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী করে বলো তো। আমাদের পুসিটাকে আয়নার সামনে বসিয়ে দিলে ঠিক ওইরকম করে। ফ্যাঁসফোঁস, থাবা-মারা।
বড়ো বউদি বড়ো চালাক মেয়ে। দুপুরে বিছানায় পড়ে রইলেন মটকা মেরে। সাধনার পথে বেশ কিছু দূর এগিয়েছি। একেবারে তন্ময়। চোখে চোখে হাসি চলছে। বউদি বললে, কী হচ্ছে?
চমকে উঠেছিলুম। ধরা পড়ে গেছি, কী লজ্জা!
বললুম অভিনেতা হব তো, তাই একটু চোখ সাধছি।
সে আবার কী? লোকে তো গলা সাধে, চোখ সাধা জিনিসটা কী?
আছে, আছে। সে তুমি বুঝবে না বউদি।
কোনোরকমে পালাতে পারলে বাঁচি। ছাদের ঘরে পুরোনো বইয়ের গাদা থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া একটা বই পেলুম, ত্রটক সাধনা, তিনচার হাত দূরে দেওয়ালের গায়ে সবুজ একটা বিন্দু লাগিয়ে পদ্মাসনে বসে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকো, যেন চোখের পলক না পড়ে। পাঁচ সেকেণ্ড দশ সেকেণ্ড, মিনিট, এক দুই পাঁচ দশ, ঘণ্টায় চলে যাও। তারপর দিনে।
‘তোমার চক্ষুদ্বয়ে জ্যোতি খেলিবে। অলৌকিক দৃশ্যসমূহ চক্ষুর সম্মুখে ভাসিয়া উঠিবে। চরাচরে তোমার দৃষ্টি প্রসারিত হইবে। উড্ডীয়মান পক্ষীর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাইলে ভস্ম হইয়া পড়িয়া যাইবে। যাহার দিকে তাকাইবে সেই তোমার বশীভূত হইয়া কুক্কুর কুক্কুরীর ন্যায় পদপ্রান্তে পতিত হইবে, কম্পমান শাখার ন্যায়।’
ভজন করনা চাহি রে মনুয়া, সাধন করনা চাহি রে মনুয়া। সেই সাধনে অ্যায়সা ফল ফলল। একদিন রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়ে চলেছে। একটিকে মনে বড়ো ধরে গেল। মনে হল প্রেমের ধাত। সুখেন যেমন বলেছিল, সর্দির ধাত কাশির ধাত পেটের অসুখের ধাত। মিষ্টি, নরম নরম চেহারা। অবাক জলপানের মতো মুখ। মা দুর্গার মতো চোখ। ডুরে শাড়ি পরেছে। রাস্তায় যেন কাঁপন ধরেছে।
ভ্রূচাপে নিহতঃ কটাক্ষবিশিখো নির্ম্মাতু মর্ম্মব্যথাং
শ্যামাত্মা কুটিলঃ করোতু কবরীভারোহপি মারোদ্যমম।
মোহন্তাবদয়ঞ্চ তন্বি তনুতাং বিম্বাধরো রাগবান
সদবৃত্ত স্তলমন্ডলস্তব কথং প্রাণৈর্মম ক্রীড়তি।।
টাটকা গীতগোবিন্দ ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসতে লাগল। হে সুন্দরী, তোমার নজরোকা তীর ভুরুর ধনুর ছিলে টেনে অমন করে আর মেরো না, আমার মর্ম ফেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না সখি। এ তো তোমার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তোমার কালো কুটিলকেশ আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছে, এও স্বাভাবিক। তোমার বিম্বফলতুল্য রাগযুক্ত অধর আমার মোহ উৎপাদন করছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু তোমার ওই সদবৃত্তস্তলমন্ডল কেন আমার প্রাণ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলবে! আমি সইতে পারি, না বলা কথা, মন নিয়ে ছিনিমিনি সইব না, সইব না। গীতগোবিন্দ আবৃত্তি করে ভীষণ সাহস এসে গেল। বল বীর নয়, তাকাও বীর। কীভাবে তাকিয়েছিলুম জানি না। একটি মেয়ে আর একটিকে বললে, দ্যাখ ভাই, পাগলটা তোর দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। তারপর রাস্তায় ষাঁড় দেখে মেয়েরা যেভাবে হুটোপাটি করে পালায়, সেইভাবে দু-জনে গলাগলি, টলাটলি করতে করতে পালাল। একজনের পা থেকে চটি ছিটকে নর্দমায় পড়ে গেল। অনেক দূরে গিয়ে তারা আর একবার ফিরে তাকাল ভয়ে ভয়ে। যেন দেখছে ষাঁড়টা কত দূরে!
মনে বড়ো ব্যথা পেলুম। আরও অবাক হলুম, সবাই যখন বলতে লাগল চোখ রাঙাচ্ছ কেন? তোমার চোখ রাঙানির আমরা তোয়াক্কা করি না হে। যার দিকে তাকাই তিনি একই কথা বলেন, চোখ পাকাচ্ছ কেন? মাথা ঠাণ্ডা করো, মাথা ঠাণ্ডা করো। গুরুজনের সঙ্গে কথা বলার সময় একটু সমীহ করে বলতে হয়!
বড়ো বউদির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই চমকে উঠলুম, এ আবার কে রে! চোখ দেখলে মনে হয়, এখুনি গেয়ে উঠবে, ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান।’ চোখের পাতা পড়ছে না, মণি দুটো পাথরের মতো স্থির। নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছি। কান ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, আর করব না স্যার।
চোখের ডাক্তার বললেন, এ কী করে এনেছ হে। একে বলে চোখ ঠিকরে যাওয়া। কী করে এরকম করলে? ভূত দেখলে এরকম হতে পারে। আমরা পড়ে এসেছি। দেখলুম এই প্রথম। তুমি বোসো বোসো।
আউটডোরে কোনো পেশেন্ট কখনো এমন খাতির পায় না। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে, অন্য রুগিদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি একের পর এক ছাত্র আর অন্যান্য ডাক্তারদের ডেকে এনে দেখাতে লাগলেন। এ রেয়ার কেস, পড়া ছিল, দেখা ছিল না। তাঁরা আসেন, সামনে ঝুঁকে পড়ে দেখেন, চোখে যন্ত্র লাগান, আর বলেন, রেটিনা হুপ করে বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারি ভাষা বোঝা যায় না। রেটিনা শব্দটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। হুপ শব্দ তো হনুমানে করে। তার মানে, কিছু একটা হনুমানের মতো লাফিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
চোখের পাওয়ার মাপতে মাপতে ডাক্তারবাবু বললেন সত্যি করে বলো তো বাবা, কী করে এমন করলে? ভূত নিশ্চয়ই দেখনি, চোখের সামনে কাউকে কী খুন হতে দেখেছ?
আজ্ঞে, ত্র্যাটক সাধনা।
সেটা কী বস্তু ভাই? পিশাচ সাধনা ধরনের কিছু?
আজ্ঞে না, দেয়ালে সাঁটা একটা সবুজ বিন্দুর দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে বসে থাকা।
সর্বনাশ! একে বলে ফিক্সড স্টেয়ার। আই বল সকেটে সেঁটে গেছে। এ দুর্বুদ্ধি তোমাকে কে দিলে?
আজ্ঞে, প্রাচীন গ্রন্থ।
সেটিকে পুড়িয়ে ফেলো। খবরদার, ওসব আর ভুলেও করতে যেও না। এই নাও তোমার চশমার পাওয়ার। সঙ্গে গোটাতিনেক ব্যায়াম রইল। প্রথম: চোখ নাচানো। ডাইনে ঘোরাও, বাঁয়ে ঘোরাও, ওপরে তোলো, নীচে নামাও। দ্বিতীয়: ব্লিংকিং। অনবরত চোখ পিটপিট করে। নন-স্টপ। তৃতীয়: কাপিং। হাতের তালু দিয়ে দু-চোখ ঢেকে, মাথা পেছনে হেলাও। শেষ উপদেশ: সুখে আছ, তাই থাকো, ভূতের কিল খেতে যেও না, কেমন?
চোখ বাঁচাতে শুরু হল চোখের ব্যায়াম। চোখ ঘোরানো, চোখ নাচানো, চোখ পিটপিট, পাতা ফেলা আর খোলা। সুখেন ঠিকই বলেছিল, চোখ বড়ো সাংঘাতিক জিনিস। সেই সময় বাজারে একটা গানও বেরিয়েছিল, বলা কী যায় সহজে, বুঝে নাও, বুঝে নাও চোখের ভাষা। চোখ ওই রকম করতে করতে এমন মুদ্রাদোষ দাঁড়িয়ে গেল, সব সময়েই করে চলেছি, অজান্তেই করে চলেছি।
পিতৃবন্ধু বিধুজ্যাঠার মাথায় মাথায় তিন মেয়ে। সব ক-টি মেয়েই বেশ সুন্দরী। পিতৃদেব একদিন সকালে বললেন, বিধুবাবুর বাড়ি থেকে চট করে একবার গুপ্তপ্রেস পাঁজিটা নিয়ে এসো তো।
বিধুজ্যাঠার বাড়িতে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল বড়ো মেয়ে রেখা। জিজ্ঞেস করলুম, বিধুজ্যাঠা?
রেখা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললে, ‘হ্যাঁ, বাবা আছেন।
রেখা পেছোতে শুরু করেছে। চোখেমুখে একটা ভয়, একটা কেমন যেন বিস্ময়ের দৃষ্টি। আমি এক পাও এগোইনি, দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমি বললুম, একবার ডেকে দাও তো, একবার ডেকে দাও তো।
রেখা প্রায় ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। যেতে না যেতেই বিধুজ্যাঠা এলেন, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। আদুর গা। সাদা মোটা পইতে বুকের এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। চোখ দুটো ভাঁটার মতো লাল।
বাঁজখাই গলায় বললেন, কী চাই?
সাধারণ এভাবে কথা বলেন না। অবাক হলুম। বললুম, পাঁজি আছে, পাঁজি? বাবা একবার চাইলেন।
হ্যাঁ, আছে ছোকরা—বলে ঠাস করে গালে এক বিরাশি সিক্কার চড় হাঁকালেন।
এ আবার কি? চড় আবার কবে থেকে পাঁজি হল! কিছু বোঝার আগেই আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, চলো তোমার বাবার কাছে।
তিন মেয়ে রকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, অসভ্য ছেলে।
বাড়ির সামনের হারাধন মুদী দোকানের টাটে বসে বসেই চেল্লাতে লাগল, কী করেছে জ্যাঠামশাই, কী করেছে জ্যাঠামশাই?
আমি হাঁ হয়ে গেছি। অপরাধ জানলুম না, ফাঁসিতে চলেছি।
বাবা বললেন, কী, করেছিল কী, বিধুদা? জুতো পায়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছিল?
তার চেয়েও অনেক, অনেক গর্হিত কাজ, চোখ দিয়ে আমার মেয়েদের অশ্লীল, কামার্ত ইঙ্গিত করেছে।
ইজ ইট?
ডিফেন্সের কোনো সুযোগই পেলুম না। কিল, চড়, ঝাঁটা, জুতো লাঠি। মিনিট দশেক শরীরের ওপর দিয়ে ভূমিকম্প চলে গেল। বড়ো বউদি এসে উদ্ধার করলেন। বড়দা বেরিয়ে এসে বললেন, কী হয়েছে কী?
বাবা আর বিধুজ্যাঠা দু-জনেই সমস্বরে আমার অপরাধ পেশ করলেন।
বড়দা বললেন, ছি ছি, না জেনেশুনেই, এত বড়ো একটা ছেলের গায়ে হাত তুললেন? সম্পূর্ণ নিরপরাধ একটা ছেলের গায়ে? জানেন না, ও গুরুতর একটা চোখের অসুখে ভুগছে। মেজর মিত্রর চিকিৎসায় আছে।
দু-জনেই সমস্বরে বললেন, অ্যাঁ! বল কী? কই, তোমরা আগে তো কিছু বলনি! ছি ছি ছি।
বিধুজ্যাঠা আমার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ক্ষমা করো বাবা। তুমি একবার আমার বাড়িতে চলো। আমরা সবাই মিলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব।
কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম, আজ আর আমার যাবার মতো অবস্থা নেই জ্যাঠামশাই।
বিকেলের দিকে ভীষণ জ্বর এসে গেল। চোখ বুজিয়ে পড়ে আছি। সর্বঅঙ্গে বিষ ফোঁড়ার মতো ব্যথা। বউদি এসে কপালে হাত রেখে বললে, দেখ কে এসেছে তোমাকে দেখতে।
চোখ খুলে দেখি রেখা।
ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললুম। যা দেখেছি তাই যথেষ্ট। এখনও হয়তো আমার চোখ সেই ভাবেই নাচছে। আবার না জুতো খেতে হয়।
বউদি বললেন, তাকিয়ে দেখো কে এসেছে।
আমি ইচ্ছে করে প্রলাপ করতে লাগলুম, না না, আমি আর যাব না, আর পাঁজি আনতে যাব না মা!
রেখা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে উঠল, বউদি, আমিই দায়ী, আমিই দায়ী। কিছু হবে না তো? সেরে উঠবে তো?
বউদি বললেন, সারা শরীর বিষিয়ে উঠেছে। তা ছাড়া বড়ো অভিমানী ছেলে, দেহের চেয়ে মনে বেশি লেগেছে।
চার বছর পরে মুসৌরীর এক হোটেলে আমি আর রেখা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কাঠের মেঝের ওপর আমাদের সুটকেস। তখনও খোলা হয়নি। সামনে কাঁচের জানলা। সকালে রোদে হিমালয়ে সোনা খেলছে। রেখার কাঁধে আমার একটা হাত। রেখার একটা হাত আমার কোমরে। রেখার মাথা আমার কাঁধে।
আমি বলছি, সেদিন জুতো খাইয়েছিল, আজ অন্য কিছু খাওয়াও।
রেখা বললে, আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন?
আমি বলছি, আজ যদি দাদা বেঁচে থাকতেন?
চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। দরজার কাছ থেকে হোটেলবয় বলছে, কফি, মেমসাব।