প্রেম – মনোজ সেন
দময়ন্তী বলল, ‘তোমাকে আমি দোষ দিই না, দোষটা আমাদের সমাজব্যবস্থার। আমি যদি মেমসাহেব হতুম, তুমি যদি জানতে যে একটু বেচাল হলেই ডিভোর্স কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারি অথবা গটগটিয়ে অন্য লোকের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে পারি, তাহলে দেখতুম কেমন তুমি আমাদের বিয়ের তারিখ ভুলে যাও। শাড়ি আমার চাই না, ও আমার অনেক আছে। ফুলেরও দরকার নেই, সে আবার তোমায় মানায় না। কিন্তু আজকের দিনে তোমার খেলা না দেখলেই চলছিল না? শিবেনবাবুরা কখন থেকে এসে বসে আছেন, আর তুমি পরমানন্দে খেলা দেখছ ?’ বলতে বলতে অভিমানে গলা ধরে এল।
শিবেন দাঁত বের করে হাসছিল। সমরেশ সেদিকে কটমট করে চেয়ে বলল, ‘তুই দেঁতো কুমীর হয়ে যা।’ কিন্তু এই দগ্ধ কলিযুগে অভিসম্পাতগুলো একেবারেই ফলে না, এমন কি দুর্বাসা হলেও না।
দময়ন্তী রেগেমেগে বলল, ‘হ্যাঁ। তুমি তো শিবেনবাবুকে অভিশাপ দেবেই। ওঁর অপরাধ, উনি দিনটা ঠিক মনে করে রেখেছেন, আর আমাদের অভিনন্দন জানাতে এসেছেন।’
সমরেশ বলল, ‘আমি মোটেই সেজন্যে অভিশাপ দিইনি! আমি রাগ করছিলুম, কারণ ওর তোমার কথার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল কিন্তু করেনি, সেজন্যে। ওর বলা উচিত ছিল যে আমাদের সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত ভাল, মেয়েদের মোটেই বেশি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়।’
দময়ন্তী রাগে, ক্ষোভে বাক্যহারা হয়ে গেল। হাত-পা ছুঁড়ে প্রতিবাদ করে উঠল রমলা, ‘ও হো হো, কী আমার গুরুঠাকুর এলেন রে! বিধান দিচ্ছেন, মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়। তা তো দেবেনই। হাজার হলেও পুরুষমানুষ তো! বিয়ের আগে লম্বা লম্বা ভালবাসার বকুনি দিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেমের কথা বলে, ভুলিয়ে ভালিয়ে একবার রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দাও, ব্যস, সব কর্তব্যের ইতি। তখন যদি বলি, বিয়ের আগে তুমি আমাকে এই বলেছিলে, তাই বলেছিলে, তখন কী রাগ ! নির্লজ্জের মত বলে কি, আমি কক্ষণো এসব বোকা বোকা কথা বলতেই পারি না। তখন কোথায় প্রেম, কোথায় কি !’
সমরেশ বলল, ‘তুমি আমাকে গুরুমশাই বল, আর যাই বল, একটা কথা তোমার রাগ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে তোমার শাস্ত্রজ্ঞান বলতে একেবারে কিছুই নেই। আমাদের শাস্ত্রে বলেছে,—লেখনী, পুস্তিকা, জায়া, পরহস্তংগতা গতা। যদি সা পুররায়াতি ভ্ৰষ্টা নষ্টা চ মর্দিতা ॥ অর্থাৎ কলম, বই আর গিন্নী যদি পরহস্তগত হয়, তবে তা একেবারেই গেছে বলে ধরে নিতে হবে। যদি বা পুনরায় ফেরৎ পাওয়া যায়, তবে ভ্রষ্ট, নষ্ট বা মর্দিত অবস্থায় হস্তগত হয়।’
দময়ন্তী অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির মতই নিশ্চল হয়ে বসে রইল, বোঝা গেল কথা বলার প্রবৃত্তিই ও হারিয়ে ফেলেছে। রমলারও প্রায় তদ্রূপ অবস্থা, তবু প্রতিবাদ করার সামর্থ্য একেবারে চলে যায়নি। বললাম, ‘আপনিই গণ্ডমূর্খ, শাস্ত্র কিছুই জানেন না। আমরা স্বাধীনতার কথা বলছিলুম। স্বাধীনতা আর পরহস্তগত হওয়া কি এক জিনিস ?’
সমরেশ বলল, ‘বিলক্ষণ! সে বিষয়েও শাস্ত্রে বলা আছে—পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। পুত্ৰাস্তু স্থবিরে কালে, স্ত্রিয়ো নাস্তি স্বতন্ত্রতা ॥ মেয়েদের স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নেই। তোমরা যেটাকে স্বাধীনতা বলছ, সেটা আসলে পরহস্তগত হওয়া বা হাত-বদল হওয়ারই স্বাধীনতা। তোমাদের তো গুণের ঘাট নেই। এই শিবেন, তোর সেই পদ্মিনী চৌধুরীর গল্পটা বলে দে তো। আট বচ্ছর স্বামীর সঙ্গে কী প্রেম! পাড়ার লোক বলত আদর্শ দম্পতি। যেই স্বামী ব্যবসা উপলক্ষে বাইরে গেলেন, একমাস যেতে না যেতেই তাঁর এক বাউণ্ডুলে মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করে দিলেন। তারপর তো প্রকাশ্যেই বেলেল্লাপনা শুরু হয়ে গেল। তবে তার উপযুক্ত শাস্তিও পেয়েছেন। মাসতুতো ভাইটি বৌদিকে খুন করে টাকাপয়সা হাতিয়ে চম্পট দিয়েছে। তাই তো বলি, তোমাদের যে স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, সেটা তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য।’
দময়ন্তী সমরেশের দিকে সম্পূর্ণ পেছন ফিরে বসে শিবেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনাটা কি? পদ্মিনী চৌধুরী কি স্বাভাবিক মেয়ে ?’
শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্বাভাবিক মেয়ে বৈকি। বীরেশ্বর বসাকের একমাত্র সন্তান, ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায়, বাপের চোখের মণি। ভদ্রলোক নিজে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, মেয়েকেও প্রচুর লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। পদ্মিনী এম-এ পাশ করেছিল, কাগজে মাঝে মাঝে কবিতাও লিখত। পড়েছেন কিনা জানি না।’
রমলা বলল, ‘পদ্মিনী চৌধুরীর কবিতা যেন পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, সেগুলো কি ভয়ানক সেন্টিমেন্টাল ফ্লপি সব কবিতা ? ’
শিবেন বলল, ‘হতে পারে। আমি কোনদিন পড়িনি।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘বীরেশ্বর বসাক কে ?’
‘বীরেশ্বর বসাক ছিলেন ব্ল্যাকউড ফ্রেট ক্যারিয়ার কোম্পানির মালিক। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে না ঢুকে ব্যবসায় নেমেছিলেন, এবং গত বছর যখন মারা যান, তখন তিনি লক্ষপতি লোক। কিন্তু খুব ভদ্র, বিনয়ী লোক ছিলেন এবং ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা মোটামুটি সৎভাবেই করে গেছেন। ব্যবসায় নামার জন্য তাঁর যেসব আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে একঘরে করেছিলেন, তাঁরাই তাঁর কাছ থেকে দু’ হাত পেতে সাহায্য নিয়েছেন, তিনিও উদার হৃদয়ে কোনরকম প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করেননি।
‘তাঁর মেয়ে পদ্মিনী কিন্তু তাঁর মত হয়নি। বীরেশ্বর উদার হলেও ছিলেন অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, কিন্তু পদ্মিনী ছিল ঠিক উল্টো। এতই সে সর্বসময় নিজের স্বপ্নজগতে বিচরণ করত যে, তার বন্ধুরা বা প্রতিবেশীরা অনেকেই ওকে অত্যন্ত ন্যাকা বলেই মনে করত। যতদিন স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে ছিল, ততদিন তার সঙ্গে একেবারে লেপ্টে থাকত। সবাইকে বলত, ভালবাসা ছাড়া নাকি ওর পক্ষে জীবনধারণ করাই অসম্ভব। স্বামী বাইরে গেলে ওই ভালবাসার সন্ধানেই বোধ হয় তাঁর ভাইয়ের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল, কিন্তু জীবনধারণের বদলে জীবনহরণই হয়ে গেল।’
‘স্বামী বাইরে গিয়েছিলেন কেন ? ’
‘বীরেশ্বরের জামশেদপুরে একটা বড় অফিস আছে, সেটা দেখাশুনো করবার জন্য। কলকাতার অফিসে বীরেশ্বরের শ্যালক সদানন্দ রায় বসে আছেন আজ পঁচিশ বছর, কাজেই এখানে কোন চিন্তা নেই। কিন্তু জামশেদপুরে কোন ভাল লোক ছিলেন না বলে বুদ্ধদেববাবুকে ওখানে গিয়ে থাকতে হচ্ছিল।’
‘এই সদানন্দ রায় কেমন লোক ?’
‘এরকম অসার্থকনামা লোক আমি জীবনে কক্ষনো দেখিনি। তাঁকে কেউ কোনদিন হাসতে দেখেনি, আনন্দ করতে দেখেনি। সব কিছুতেই তিনি বিরক্ত, সব কিছুই তাঁর কাছে কোন না কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
সমরেশ বলল, ‘সদাই মরে ত্রাসে, ওই বুঝি কেউ হাসে ?’
‘ঠিক তাই। ভদ্রলোক অত্যন্ত রোগা, দড়ির মত পাকানো চেহারা এবং বিশ্বের যত রামগরুড়ের ছানাদের গাম্ভীর্য তাঁর অন্ধকার মুখে পুঞ্জীভূত করে রেখেছেন।’
‘ইনি কাজে কর্মে কেমন ?’ দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল।
‘ব্ল্যাকউড ফ্রেট কোম্পানির প্রায় জন্ম থেকেই উনি কর্ণধারের পদে রয়েছেন। কোম্পানিটা বড় করে তোলার মূলে ওঁরও যথেষ্ট অবদান আছে। তবে বীরেশ্বর প্র্যাকটিক্যাল লোক ছিলেন, জানতেন শ্যালকো গৃহনাশায়, সেজন্য তাঁকে কোনদিন পার্টনার করেননি। ভদ্রলোক বেশ কম মাইনে পান। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। কাজেই মুখে তাঁর হাসি যদি না-ই থাকে, তাহলে তাঁকে বড় দোষও দেওয়া যায় না, তাই না ?’
‘পদ্মিনীর স্বামী কেমন লোক ?’
‘বুদ্ধদেব চৌধুরী কেমন লোক, সেটা এককথায় ঠিক বোধ হয় বোঝান যায় না। বলতে পারেন, অত্যন্ত রোমান্টিক চরিত্র। অবশ্য তা না হলে, পদ্মিনী ওঁকে বিয়ে করবেই বা কেন?
‘ভদ্রলোকের জীবনটাই একটা রোমান্স, বলতে পারেন উপন্যাসের মত। পূর্ববাংলায় কলিপুকুরের জমিদার বংশের ছেলে। ১৯৪৮ সালে, ওঁর যখন ছ’ বছর বয়েস, তখন দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত হয়ে এক জাঠতুতো ভাইয়ের সঙ্গে এসে ওঠেন শিয়ালদা স্টেশনে। আর একজন আত্মীয়স্বজনও তখন বেঁচে ছিলেন না। ওই স্টেশনেই কাটান আট বছর। একটা সেলুনে চাকরের কাজ করতেন আর যা মাইনে পেতেন, তা দিয়েই বই কিনে স্টেশনের আলোয় পড়াশুনো করতেন। সেলুনের মালিক দয়াপরবশ হয়ে ওঁকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রাইভেটে বসবার ব্যবস্থা করে দেন, বুদ্ধদেববাবু ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেন। তারপর সেলুনের কাজ ছেড়ে দেন, কারণ সেলুনটাই উঠে যায়। তখন এদিক ওদিকে ছেলে পড়িয়ে আর এর ওর তার বাড়ির রোয়াকে শুয়ে রাত কাটাতেন। এই করে করে প্রথমে ইন্টারমিডিয়েট এবং পরে বি-এ পাশ করেন প্রাইভেটে। তারপর ভদ্রলোক করেননি হেন কাজ নেই—শেয়ার বাজারের দালালি, ওষুধ বিক্রি, পুরোন গাড়ির ব্যবসা, কলেজে প্রফেসারি, কি নয়? কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে যে কাজই করুন না কেন, পড়াশুনোর অভ্যেসটা বরাবরই বজায় রেখে গেছেন। তার ফলে আজ ওঁকে যে কোন বিষয়ের ওপর আধ ঘণ্টা লেকচার দিতে বলুন, অনায়াসে দিয়ে দেবেন। সত্যিকারের ইন্টেলেকচুয়াল, যেমন মধুর স্বভাব, তেমনি পাণ্ডিত্য আর তেমনি রুচিজ্ঞান। একসময় অসহনীয় দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে ওয়ান পাইস ফাদার মাদার হয়ে ওঠেননি। অত্যন্ত দিলদরিয়া বন্ধুবৎসল লোক। আসলে, জমিদারী-রক্তটা এখনও রয়ে গেছে, পুরো শুকিয়ে যায়নি।’
‘পদ্মিনীর সঙ্গে বিয়ে হল কী করে? এমন লোকের সঙ্গে তো সাধারণত সম্বন্ধ করে বিয়ে হয় না? বিশেষত, যার তিনকূলে কেউ নেই।’
‘বললুম না, পদ্মিনী ছিল ভয়ানক রোমান্টিক, সম্বন্ধ করে বিয়ে করার টাইপই নয়। বুদ্ধদেবকে অনেক খেটে বিয়ে করেছিল, অনেক দিন পেছনে লেগে থাকতে হয়েছিল।’
‘ব্যাপারটা কি হয়েছিল?’
‘আজ থেকে বছর দশেক আগে পদ্মিনী থিয়েটারে নেমেছিল। সে পাড়ায় পুজোর সময়কার বঙ্গে বর্গী বা আলমগীর অভিনয় করা নয়, রীতিমত যাকে বলে অপেশাদার রঙ্গমঞ্চে ব্রেশট্, ওসবোর্ন বা অ্যালবীর নাটকে স্টেজে নামা। ভয়ানক হাইফাই ব্যাপার। কলকাতার তাবৎ ইন্টেলেকচুয়ালদের তীর্থক্ষেত্র এখানেই দুজনের দেখা হয়। পদ্মিনী তখন এম-এ দিচ্ছে আর বুদ্ধদেব কলেজে পড়াচ্ছেন। এই আলাপ থেকেই প্রেম, তারপর ভয়ানক প্রেম, তারপর বসাক বাড়িতে একটা মৃদু গণ্ডগোল, মনকষাকষি, কান্নাকাটির পর বিয়ে।
‘বিয়ের পর বীরেশ্বরের অনুরোধে বুদ্ধদেব প্রফেসারি ছেড়ে শ্বশুরের ব্যবসায় যোগ দিলেন। ব্যবসায় ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা কম নয়, কাজেই অল্প দিনেই তিনি শ্বশুরের আস্থাভাজন হয়ে পড়লেন। ব্ল্যাকউডের কলকাতার পরেই সবচেয়ে বড় ব্যবসা জামশেদপুরে। বীরেশ্বর জামাইয়ের কাজকর্ম বছর পাঁচেক দেখবার পর তাকে সেখানে পাঠালেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে। এইখানেই হল গোলমালের সূত্রপাত।
‘পদ্মিনী জামশেদপুরে যেতে অস্বীকার করল। কেন করল, সেটা বোঝা একটু কঠিন। কারণ, ওদের প্রতিবেশীরা প্রত্যেকেই বলেছেন যে, সে সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল এবং তাদের ভালবাসা এতই খোলাখুলি ছিল যে তা অনেক সময়েই ছিল অন্যান্যদের অস্বস্তি ও অসুবিধের কারণ। কিন্তু বুদ্ধদেববাবুর ধারণা, পদ্মিনী তার মাস ছয়েক আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। ভদ্রলোক সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার ফলে, তখন সেটা ঠিক বুঝতে পারেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর স্ত্রী যে ব্যাভিচারিণী, সেটা তিনি জানতে পেরেছেন সে নিহত হবার পর। অবশ্য, তাঁর এই ধারণাটা অভিমান প্রসূত হতে পারে, সত্যি না হওয়া অসম্ভব নয়। তবে একথা ঠিক, বুদ্ধদেববাবু জামশেদপুরে যাবার মাস আষ্টেক পর থেকেই তাঁর ভাই বাড়িতে আনাগোনা শুরু করেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিবেশীরা শঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, পদ্মিনী প্রকাশ্যেই তাঁর সঙ্গে উদ্দাম ঢলাঢলি শুরু করেছে। বুদ্ধদেবের ভাই দিনের পর দিন বাড়িতে থেকেছেন, হৈ হৈ করে বেলেল্লাপনা করেছেন, তারপর বুদ্ধদেব আসবার ঠিক আগে নিঃসাড়ে কেটে পড়েছেন। বুদ্ধদেব আসার পর বাড়ি থাকত শান্ত।’
‘এই দু’বছরেও বুদ্ধদেব পদ্মিনীর ব্যবহারে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেননি ?’
‘না। ওঁর বক্তব্য, পনেরো দিন বা একমাস অন্তর যখন আসতেন, তখন পদ্মিনীকে দেখবার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে থাকতেন যে, তেমন কোন পরিবর্তনই তাঁর চোখে পড়ত না। পদ্মিনী মারা যাওয়ার পর অনেকগুলো ঘটনা অ্যানালাইজ করে দেখেছেন, তখন যেন সেগুলো একটু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। আসলে, পদ্মিনীর স্বভাবটা ছিল নাকি এমনই বন্ধনহীন, এতই অস্থির যে, কোন পরিবর্তনই চট করে চোখে পড়ত না। তাছাড়া অভিনয়ও তো জানা ছিল। অল্প সময়ের জন্য অনেকদিন পর পর বাড়ি আসা স্বামীর চোখে নতুন প্রেমটা আড়াল করে রাখা পদ্মিনীর পক্ষে কঠিন হয়নি।’
‘প্রতিবেশীরা কেউ কোন ইঙ্গিত দেননি ?’
‘না। একি আর আমাদের মত বাঙালী পাড়া ?’ বড়লোকদের যাকে বলে কসমোপলিটান বাড়ি। সেখানে কেউ কারোর ব্যাপারে কদাচ নাক গলায় না। একমাত্র,ওঁদের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মিসেস বটব্যাল বর্ষিয়সী মহিলা, তিনিই আমাকে যা কিছু খবরাখবর দিলেন। বাকি কেউ তো মুখই খুলল না। মিসেস বটব্যাল অবশ্য চোস্ত ইংরিজীতেই তাঁর বিরক্তি, অস্বস্তি এবং বিব্রত অসন্তুষ্টির কথা জানালেন। তাঁর প্রতিবেশিনীর প্রকাশ্যে প্রেম করাটা, তা সে স্বামীর সঙ্গেই হোক বা প্রেমিকের সঙ্গেই হোক, যে তাঁর বাঙালী রুচিকে খুব আঘাত দিয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তা না হলে, অত রেখে-ঢেকে কথা বলেও, তার মধ্যে শেমলেস একজিবিশনিস্ট কথাটা ব্যবহার করতেন না।’
‘কিন্তু আপনি যে বললেন, বুদ্ধদেববাবুর তিনকূলে কেউ ছিল না, তাহলে এই দেবর লক্ষ্মণটি এলেন কোত্থেকে ?’
‘ইনি দেবর নন, ভাশুর। বুদ্ধদেবের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়, নাম শুকদেব। ইনিই সেই জাঠতুতো ভাই, যাঁর সঙ্গে উনি শিয়ালদায় এসেছিলেন। তবে মাসখানেক পরেই শুকদেব পালিয়ে যান ; তখন কোথায় থাকতেন, কী করতেন তার কিছুই বুদ্ধদেব জানতেন না। তবে ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়নি, কারণ দাদা মাঝে মাঝে উদয় হয়ে ভাইয়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। বুঝতেই পারছেন, ইনি আবার বুদ্ধদেবের ওপরেও এককাঠি রোমান্টিক। তার ওপর বছর পনের আগে ভদ্রলোক ভাইকে এসে বললেন যে আমি প্যারিস চললুম, শিল্পী হয়ে ফিরব। তারপর পার্মানেন্টলি অদৃশ্য হয়ে যান। তিনি যে ফিরেছেন, বুদ্ধদেব তা জানতেন না। আর, ভদ্রলোকের যে বর্ণনা পেয়েছি, তাতে তাঁকে শিল্পী বলেই মনে হয়, প্যারিসফেরতা কিনা সেটা পরের কথা। বিরাট লম্বা, মুখে একগাল দাড়ি, ছেঁড়া নোংরা জামাকাপড়, তবে চেহারাটি নাকি তার মধ্যেই কার্তিকের মত। যে মেয়ে জন্ম-রোমান্টিক, সে যে এমন একটি চরিত্র দেখলে হামলে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কি ?’
‘বর্ণনা পেয়েছেন মানে? তাঁকে এখনও ধরতে পারেননি ?’
‘না, কই আর পারলুম? তাঁর নামটি ছাড়া আর কিছুই তো আমাদের জানা নেই। তাঁর চেহারার যা বর্ণনা পেয়েছি, অমন চেহারার লোক কলকাতায় কয়েকশো আছে।’
‘শুধু চেহারা কেন? তাঁর আচার-ব্যবহার, চালচলন বা কোন বিশেষ লক্ষণ বৈশিষ্ট্য, তারও বর্ণনা পেয়েছেন নিশ্চয়ই? ভদ্রলোক তো কখনোই নিজেকে ঠিক গোপন রাখেননি।’
‘আচার-ব্যবহারের যা বর্ণনা পেয়েছি, তা এককথায় বলা চলে নির্লজ্জ বেহায়া। তিনি নাকি লিফট থেকে বেরিয়েই হাঁক মারতেন, আমার পদিরাণী কই গো! দরজার বেল-টেল বাজানোর ধারও ধারতেন না। ষাঁড়ের মত চিৎকার করতে করতে প্রেমালাপ করতেন। কখনো কখনো বারান্দায় প্রায় বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতেন অথবা তাঁর পদিরাণীকে ওই অবস্থায় ঘরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে তার ছবি আঁকতেন, জানলা বন্ধ করার বা পর্দা টানার কথা চিন্তাও করতেন না। আর চালচলন? অত্যন্ত নোংরা, তাঁকে কেউ কোনদিন পরিষ্কার জামা-কাপড় পরতে দেখেনি। এককথায়, ভদ্রলোক তাঁর ভাইয়ের ঠিক বিপরীত। ইনি যেমন পরিচ্ছন্ন, ভদ্র, বিনয়ী, মৃদুভাষী, উনি তেমনি নোংরা, অভদ্র, অশিষ্ট⋯’
‘কিন্তু শিল্পী।’
‘হ্যাঁ। তবে আজকাল শিল্পী হতে গেলে তো সবসময় প্রতিভা, সাধনা বা জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। একটা তিন কোণা মাথা আর পাঁচ কোণা নাক আঁকতে পারলে, কপালে থাকলে নিজেকে শিল্পী বলে জাহির করা যায়। ছোটবেলায় বুদ্ধদেববাবু যেমন নিজেকে উন্নত করার আকাঙক্ষায় অবিচলিত থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে গেছেন, ইনি যে তা করেননি, তাতে সন্দেহ থাকে না। সম্ভবত, ছোটবেলা থেকেই উচিত অনুচিত নানা ভাবেই পয়সা রোজগার করেছেন আর কোন রকমে হিজিবিজি ছবি এঁকে আর চেহারার জোরে শিল্পী সেজে ভদ্রসমাজে ঘোরাঘুরি করেছেন।’
‘পদ্মিনীকে খুন করলেন কি করে ?’
‘শ্বাসরুদ্ধ করে। বেলা বারোটা নাগাদ ফ্ল্যাটে আসেন, দুটো নাগাদ বেরিয়ে যান। দরোয়ান সেটা দেখে। তারপর, রাত্রি দশটায় একটা ঝড় ওঠে। তখন মিসেস বটব্যালের ঝি লক্ষ্য করে যে, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের দরজাটা হাওয়ায় দড়াম দড়াম করছে। সে সেটা বন্ধ করতে গিয়ে ভেতরে মেঝের ওপর পদ্মিনীকে নিহত অবস্থায় আবিষ্কার করে।’
‘সেদিন পদ্মিনীর ফ্ল্যাটে আর কি কেউ এসেছিল ?’
‘সকাল আটটায় এসেছিল একজন কার্পেটওয়ালা, সাড়ে নটায় প্রবাহ পত্রিকার সম্পাদক ইয়ুসুফ কয়াল, সাড়ে দশটায় সদানন্দ রায়। ব্যস, আর কেউ না।’
‘এঁদের সকলকেই জেরা করেছেন? প্রত্যেকেই কি পদ্মিনীকে স্বাভাবিক দেখেছিলেন ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সদানন্দ এসেছিলেন কেন ?’
‘উনি মাঝে মাঝে আসতেন। ব্ল্যাকউডের কিছু কিছু কাগজপত্রে পদ্মিনীর সই-এর দরকার হত। প্রবেটের দরখাস্ত এখনো বিবেচনাধীন আছে, তবু সদানন্দ তাঁর ভাগ্নীকে যথাসাধ্য—তার ব্যবসায়ে ওয়াকিবহাল রাখতে চেষ্টা করতেন। অবশ্য তাতে খুব ফল হত বলে মনে হয় না।’
‘যেদিন খুন হয়, সেদিন কি ফ্ল্যাটে কেউ কোন গোলমাল, ঝগড়া-ঝাঁটি বা অস্বাভাবিক শব্দ শোনেনি ?’
‘না। তবে আমার ধারণা, ঝগড়া-ঝাঁটি একটা নিশ্চয়ই হয়েছিল। তবে শুকদেব এলেই এমন চেল্লাচেল্লি শুরু করে দিতেন যে, সেটা ঝগড়া না প্রেমালাপ, তা নিয়ে পরে আর কেউ মাথা ঘামাত না বা কর্ণপাতও করত না। কাজেই, সেদিনের ঝগড়াটা সকলেই মিস করে গেছেন।’
‘শুকদেব পদ্মিনীকে খুন করলেন কেন ?’
‘দেখুন, আমাদের পুলিশী শাস্ত্রে বলে যে, যখন একটি পুরুষ ও একটি নারীর মধ্যে কেবলমাত্র তীব্র জৈবিক আকর্ষণে একটা প্রেমহীন, দেহসর্বস্ব সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেখানে এ হেন ভয়াবহ পরিণতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যখন দুজনের একজন ধরা পড়েছে, তখন সে অম্লানবদনে সমস্ত দোষ অন্যজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে বা তাকে ফ্যাসাদে ফেলে নিজে কেটে পড়বার চেষ্টা করেছে। বাহ্যত, এ ধরণের সম্পর্কগুলো যতই নিবিড় দেখাক না কেন, আসলে অত্যন্ত ঠুনকো। সামান্য চাপেই ভেঙে পড়ে এবং অনেক সময়েই এই ভেঙে পড়াটা একটা ভয়ঙ্কর সমাপ্তিতে পর্যবসিত হয়। আপনি রহস্যসন্ধানী ঠিকই, কিন্তু আদতে তো ইতিহাসের অধ্যাপিকা। এ ধরণের কত ঘটনা ইতিহাসে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে।’
এতক্ষণে সমরেশ কথা কইল। বলল, ‘তোদের শাস্ত্রে যাই বলুক, আমাদের সাধারণ লোকের শাস্ত্রে বলে, অধর্মবিষবৃক্ষস্য পচ্যতে স্বাদু কিং ফলম্ ? অর্থাৎ অধর্ম হইতে জাত বিষবৃক্ষে কি কখনও স্বাদু ফল ফলিতে পারে ?’
শিবেন বলল, ‘তুই চুপ কর। ব্যাটা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার, সমসকৃত আওড়াচ্ছেন যেন ভাটপাড়ার ন্যায়রত্ন ভশচায্যিমশায় এলেন !’
দময়ন্তী বলল, ‘অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন যে, সামান্য ঝগড়া-ঝাঁটি থেকেও একটা হত্যাকাণ্ড হয়ে যেতে পারে? কোন জোরাল মোটিভের দরকার হয় না ?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। প্রেমহীন ব্যাভিচারের যে গরল মনের মধ্যে জমা হয়ে ওঠে, তা একটু নাড়া পেলেই বাইরে বেরিয়ে আসে, মানুষকে অন্ধ করে দেয়।’
‘আপনারা কি করে একেবারে নিশ্চিত হচ্ছেন যে, শুকদেবই হত্যাকারী ?’
‘তার কারণ, ডাক্তারী পরীক্ষায় দেখা গেছে যে বারোটা থেকে দুটোর মধ্যেই পদ্মিনী নিহত হয়। তা হলে হয়তো সদানন্দকেও সন্দেহ করা যেত। কোন বাধা না থাকলে, তাঁর মত ঘড়েল লোকের ব্ল্যাকউডের মালিক হয়ে বসার ইচ্ছে বা চেষ্টা, কোনটাই অসম্ভব নয়। ভাগ্নী সেদিকে বাধা ছিল। আর ভাগ্নী-জামাইকে হটানো তাঁর পক্ষে কঠিন হত না।’
‘আপনারা যখন পদ্মিনীর ফ্ল্যাটে গেলেন, তখন কি সব কিছুই যথাস্থানে ছিল ?’
‘না। পদ্মিনীর হাজার পঞ্চাশ টাকার গয়না আর হাজার তিরিশেক টাকা পাওয়া যায়নি।’
‘আপনারা কি করে বুঝলেন ?’
‘না, মানে আমরা ঠিক বুঝিনি। স্টিলের আলমারিটা খোলা ছিল, এটা দেখেছিলুম। হারানো জিনিসগুলোর ফিরিস্তি দেন বুদ্ধদেববাবু।’
‘এছাড়া আর কিছু ?’
‘না, বাকি সব দামী জিনিসই মোটামুটি যথাস্থানে ছিল।’
‘কোন ছুরি বেঁধান ইস্কাবনের বিবি পাসনি ?’ সমরেশের প্রশ্ন।
‘ইস্কাবনের বিবি তো দূরস্থান, কোন আঙুলের ছাপও পাইনি। ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র সযত্নে মোছা হয়েছে, তার চিহ্ন পেয়েছি।’
‘কোন চিঠি বা ডায়েরী বা ছেঁড়া ফটো, এসব কিছুও পাননি ?’ দময়ন্তী প্রশ্নের সূত্রটা তুলে নিল।
‘চিঠি একটা পেয়েছি পদ্মিনীর লেখা। তবে সেটা ড্রাফট, দলা পাকানো অবস্থায় পড়ে ছিল কাচড়ার ড্রামের মধ্যে। কাজেই, তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। এছাড়া, আর কোন চিঠিই পাইনি সারা বাড়িতে। একটা রাইটিং ডেস্কের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে মনে হল, সেখানে এক বাণ্ডিল চিঠি সম্ভবত ছিল।’
‘পদ্মিনীর চিঠিটা কি ?’
‘কি আবার? প্রেমপত্র। নির্লজ্জ, অসভ্য প্রেমপত্র, উদ্দাম লিবিডো বলতে পারেন। পড়তে পড়তে লজ্জায় আমারই কান লাল হয়ে উঠছিল।’
‘কি লেখা ছিল ?’
‘পড়বেন? আমার কাছে একটা কপি আছে। দাও তো রমলা, আমার ব্যাগ থেকে বের করে।’
রমলা চিঠিটা বের করে দময়ন্তীর হাতে দিল। হেসে বলল, ‘এই নে। এরকম অশ্লীল চিঠি আমি সত্যি জীবনে কখনও পড়িনি। আমরা যদি কোনদিন বরকেও এরকম চিঠি লিখতুম, তাহলে বোধ হয় তদ্দণ্ডেই আমাদের কেটে কুচি কুচি করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসত।’
চিঠিটা পড়তে পড়তে দময়ন্তীর সমস্ত শরীর কঠিন হয়ে উঠল, কানদুটো টকটকে লাল। পড়া শেষ করে আরক্ত চোখে শিবেনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘চিঠিটা পড়ে কি বুঝলেন ?’
হাত নেড়ে শিবেন বলল, ‘কি আর বুঝব? বুঝলুম, পদ্মিনী ছিল একটি, যাকে বলে, নির্ভেজাল নিমফোম্যানিয়্যাক। তার ধারণা হয়েছিল যে, বিবাহিত জীবনের দৈনন্দিন টানাপোড়েনের মধ্যে তার প্রাকবিবাহ প্রেম শুকিয়ে লোপ পেয়েছিল। দেহসর্বস্ব মেয়েটার জানা ছিল না বোধ হয় যে, বিবাহোত্তর প্রেম, প্রাকবিবাহ প্রেমের মত বেনোজল নয়। তা সব কিছু দুর্বার অন্ধ বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না বরং অভ্রান্ত গতিতে অথচ শান্ত, নীরব ধারায় জীবনকে সরস করে তোলে। বন্যার জল সরে গেলে মাটিতে প্রাণের অঙ্কুর জাগে, বোদ ওঠে, পাখিরা গান গায়। জীবনের জন্য দরকার দুটোরই, কিন্তু পদ্মিনীর কাছে কেবল বন্যাটাই সত্য ছিল ?’
সমরেশ জনান্তিকে রমলাকে বলল, ‘আমি তো না হয় ভশচায্যিমশায়। ইনি কে? এস পি সি, আই ডি শিবেন সেন না আধুনিক কবি বাণীবিনোদ ভরদ্বাজ ?’
দময়ন্তী সমরেশের ফিসফিসানিতে কান দিল না। প্রশ্ন করল, ‘আর কি বুঝলেন ?’
শিবেন বলে চলল, ‘বুঝলুম, পদ্মিনীর সেই শুকিয়ে যাওয়া খাতে নতুন করে প্রেমের বান ডাকালেন তার প্রাণাধিক প্রিয় প্রাণেশ্বর শুকদেব। হ্যাঁ, প্রাণেশ্বর তো বটেই। প্রাণটি বগলদাবা করে নিয়ে গেছেন।’
‘আর?’
‘আর কি ?’
‘শেষ লাইনটায় ?’
‘ও হ্যাঁ। ওখানটায় বোঝা যাচ্ছে, শুকদেবের পদ্মিনীর শরীরের সঙ্গে মুখরোচক খাদ্যের প্রতিও যথেষ্ট লোভ ছিল। তা নাহলে, প্রচুর চুম্বনের সঙ্গে প্রচুরতর ক্ষীরের বরফি খাওয়ানোর লোভ দেখান থাকত না।’
‘বুদ্ধদেববাবু কি এখনও জামশেদপুরেই আছেন ?’
‘হ্যাঁ, দিন চার-পাঁচ আগে ফিরে গেছেন।’
‘আচ্ছা, ওনার কাজ বোধ হয়, সারাদিন অফিসে বসে নয়, তাই না? প্রায় সারাদিনই বোধ হয় বাইরে বাইরে অর্ডার সিকিওরের ধান্দায় ঘুরে গভীর রাত্রে বাড়ি ফেরেন ?’
শিবেন একটু অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘ঠিক তাই। তাতে কি ?’
‘কিছুই না। আচ্ছা, ঘটনার দিন রাত্রে যে তিনি বাড়িতেই ছিলেন, তার কোন অকাট্য প্রমাণ পেয়েছেন কি ?’
‘নিশ্চয়ই। রাত্রি সাড়ে এগারোটায় ট্রাঙ্ককলে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে আমরাই যোগাযোগ করি। কেন বলুন তো? আপনার সন্দেহ, দুই ভাই ষড়যন্ত্র করে খুন করেছেন ?’
‘না। খুন একভাই-ই করেছেন।’
‘হুঁ ! সে তো আমিও জানি। শুধু যদি ব্যাটাকে ধরতে পারতুম !’
‘ধরতে পারেন।’
শিবেন হাঁ করে তাকাল। বলল, ‘শুকদেব কোথায় আছেন, আপনি জানেন? কোথায় পেলেন তাঁর ঠিকানা ?’
‘ওই চিঠিটায়।’
শিবেন চিঠিটা একটু উল্টেপাল্টে দেখে হতাশ চোখে তাকাল। বলল, ‘দয়া করে একটু খোলসা করে বলুন।’
‘বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন, এই যে গল্পটা আপনি আমাদের শোনালেন, তার মধ্যে কতগুলো সাঙ্ঘাতিক অসঙ্গতি আছে, সেগুলো কি আপনার চোখে পড়েছে ?’
‘কিছু কিছু পড়েছে। তা হোক, তবু আপনিই বলুন শুনি।’
‘বেশ। প্রথমত ধরুন, শুকদেব। ধরা যাক, তিনি শিল্পী। ছেঁড়া, নোংরা জামা-কাপড়, একমুখ দাড়ি, পদ্মিনীকে ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে তার ছবি আঁকা ইত্যাদি সবই নির্দেশ করে যে তিনি শিল্পী। তাহলে, তিনি ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে ষাঁড়ের মত, কই গো আমার পদিরাণী, বলে চিৎকার করেন কেন? একজন শিল্পী, যত বাজে ক্যালিবারেরই হন না কেন, আর যতই না কেন ছোটবেলা কুসংসর্গে কাটিয়ে থাকুন, এতদূর গ্রাম্য ইতরতা প্রকাশ করতে পারেন না। বিশেষত, তাঁর পদিরাণী যেখানে একজন উচ্চবংশীয়া, শিক্ষিতা মহিলা। তাছাড়া, যে জমিদারীরক্ত তাঁর ছোটভাইকে সেলুনের চাকর বা ফুটপাথের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও মানুষ করতে সাহায্য করেছে, তা কি তাঁর মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল?
‘তাহলে ধরে নিতে হয় যে, তিনি আদৌ শিল্পীই ছিলেন না। ছোটবেলায় অসৎ সংসর্গে পড়ে একেবারে ইতরেই পরিণত হয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সেটা তিনি কী করে পদ্মিনীর চোখে আড়াল করে রেখেছিলেন? আর রেখেছিলেনই বা কেন? তাহলে বলতে হয়, গোড়া থেকেই তিনি পদ্মিনীর প্রতি একটা খারাপ মতলব পোষণ করছিলেন। পদ্মিনীর কাছে যে অনেক টাকা-পয়সা আছে, সেটা তাঁর জানা ছিল এবং প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেটা হাতানোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তাই যদি হবে, তাহলে তিনি চিৎকার করে এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে নিজেকে জাহির করতেন কেন? সেক্ষেত্রে নিজেকে যথাসাধ্য গোপন রাখার চেষ্টাই কি স্বাভাবিক ছিল না ?’
সমরেশ বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে, ভদ্রলোকের মাথায় ছিট ছিল।’
‘অর্থাৎ পাগল ছিলেন? মোটেই তা নয়। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার লোক। তা নাহলে হঠাৎ পাগলামীর বশে খুন করে থাকলে, সারা ফ্ল্যাটে তাঁর একটাও আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল না, তা কখনও হতে পারে? পদ্মিনীর রাইটিং ডেস্কের ভেতর থেকে উধাও চিঠির বাণ্ডিলটাও এ কথাই প্রমাণ করে। স্পষ্টতই, ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে খুন করা হয়েছে। কেন ?
‘দ্বিতীয়ত, পদ্মিনী। আপনার কথা ঠিক যে, সে নিমফোম্যানিয়্যাক ছিল। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে সে অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ে ছিল না। সে গুরুগম্ভীর নাটকে অভিনয় করত, আর যেসব কবিতা লিখত, লক্ষ্য করুন, সেগুলো সেন্টিমেন্টাল স্লপি। সে যে প্রকাশ্যে স্বামীর সঙ্গে ঢলাঢলি করত, তার কারণ খানিকটা হতে পারে এই জন্যে যে সে নিমফোম্যানিয়্যাক ছিল, আর খানিকটা বাইরের লোককে জাহির করে দেখানোর জন্যে যে সে কত সুখী। ছোটবেলায় তার মা মারা গিয়েছিলেন, তার বাবা তখন বড় হবার চেষ্টায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে ত্যাগ করেছেন, মামা রসকষহীন মানুষ, এ অবস্থায় তার ছেলেবেলা যে অসহনীয় একাকীত্বের মধ্যে কেটেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই একাকীত্বই তাকে করে তুলেছিল সেন্টিমেন্টাল এবং কিছুটা অস্থিরচিত্ত। কাজেই সে যখন সত্যিকারের সুখের দেখা পেয়েছে, তখন সে সেটা সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে চেয়েছে। বাচ্চারা যেমন, ভাল খাবার পেলে নির্লজ্জের মত হাততালি দিয়ে নেচে ওঠে।’
‘কিন্তু এটা তো পার্ভার্সনও হতে পারে, যাকে বলে বিকৃত মনোবৃত্তি ?’ শিবেন বলল।
‘হতে হয়তো পারে, তবে হওয়া কঠিন। লক্ষ্য করে দেখুন, যতদিন স্বামী ছিলেন, সে স্বামীর সঙ্গে ঢলাঢলি করেছে, যেই স্বামী চলে গেলেন তখন প্রেমিকের সঙ্গে আরম্ভ করল, তখন কিন্তু স্বামী বাড়ি এলে সব চুপচাপ। চিঠিটার সাক্ষ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রেমিক তার তথাকথিত প্রেমহীন জীবনে প্রেমের বান এনেছিলেন, আর স্বামীর সঙ্গে—গোড়ায় তো ছিলই। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, যেখানে প্রেম সেখানেই তার প্রদর্শন, যেখানে নেই সেখানে চুপচাপ। এর মধ্যে কিন্তু আমি একটা বরং সততারই চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি, বিকৃতির নয়। এটা অসুস্থ মনোবৃত্তি হতে পারে, কিন্তু বিকৃত সম্ভবত নয়। তার এই অসুস্থতাটা ছেলেবেলায়-না-পাওয়া ভালবাসার জন্য তীব্র ক্ষুধা থেকে সঞ্জাত, আর সেই জন্যেই প্রেমের তীব্র অনুভূতিটা তাকে নির্লজ্জ একজিবিশনিস্ট করে তুলেছিল। তার রুচিতে একটু গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল, মনোবৃত্তিতে নয়।
‘এর পরে দেখুন, এই চিঠিটা। কী অশ্লীল! অশ্লীলতা যেন প্রত্যেক ছত্রে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসছে। পদ্মিনীর মত মেয়ে কি কখনও এরকম চিঠি লিখতে পারে? আপনি হাসছেন কেন, আমি জানি। আপনি বলবেন, পুলিশ রেকর্ডে শিক্ষিতা ভদ্রমহিলার লেখা এর চেয়েও অশ্লীল চিঠি আপনি দেখেছেন। ঠিক কথা। কিন্তু মনে করে দেখুন তো, তাঁরা কি কখনও স্যাঁতসেতে সেন্টিমেন্টাল কবিতা লিখতেন বা ব্রেখ্ট্ আর ও’নিলের নাটকে অভিনয় করতেন? চিঠিটা তাহলে কী জানাতে চাইছে ? সেটা যেন আপ্রাণ এ কথাই বলবার চেষ্টা করছে। চেয়ে দেখ, পদ্মিনী এখন একজন নতুন মানুষ, আগের পদ্মিনী আর নেই, এ একজন সম্পূর্ণ অন্য সত্তা। কেন?
‘আবার দেখুন, এরকম একটা সাংঘাতিক প্রেমপত্রের শেষ ছত্রে ক্ষীরের বরফি খাওয়ানোর প্রস্তাব আসছে। এটা কি অত্যন্ত অস্বাভাবিক নয়? আপনি কল্পনা করতে পারেন, একজন ভয়ানক রোমান্টিক মেয়ে, যার জীবনের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে মহব্বত, সে তার প্যারামূরকে ক্ষীরের বরফি খাওয়ানোর কথা প্রেমপত্রে লিখছে ?’
সমরেশ বলল, ‘এতে এত আশ্চর্য হবার কি আছে? ক্ষীরের বরফি তো খারাপ জিনিস নয় !’
এতক্ষণে সমরেশের সঙ্গে কথা বলল দময়ন্তী, ‘তোমার কথা বাদ দাও। তোমাকে কেউ এ হেন একটা চিঠি লিখলে, তার সবটাই অর্থহীন হত, সত্যি হত কেবল ওই ক্ষীরের বরফিটুকু।’ ওর গলায় তখনও রাগ।
একগাল হাসল সমরেশ। বলল, ‘তাতে আর আশ্চর্য কি? আমি হলুম গিয়ে পরমহংস শ্রেণীর লোক। নীরটি ত্যাজিয়া ক্ষীরটি খাইবে, ইহাই হইল আমার ইয়ে।’
শিবেন হাত নেড়ে বলল, ‘তোর ইয়ে এখন বাদ দে। বুঝলেন বৌদি, ওই অংশটা সত্যিই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, কোন পুরুষমানুষের কাছেই তা হয়তো মনে হত না। আসলে, প্রেম ব্যাপারটার প্রতি পুরুষ এবং নারীর দৃষ্টিভঙ্গিটাই আলাদা। আমাদের কাছে প্রেম এবং ক্ষীরের বরফি দুটোই একসঙ্গে চলতে পারে। ইংরেজীতে তো কথাই আছে যে, পুরুষের হৃদয়ের পথ তার পাকস্থলীর মধ্য দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের বেলায় নৈব নৈব চ।’
সমরেশ ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক, ঠিক। পৃথিবীতে অনেক মেয়েই ডাকাতিয়া বাঁশির ডাকে উদাস হয়ে ঘরসংসার ফেলে বেরিয়ে গেছে বটে, কিন্তু পোলাওয়ের গন্ধে মাতাল হয়ে রাঁধুনী বামুনের সঙ্গে ইলোপ করেছে, এ হেন নজির ইতিহাসে একেবারেই নেই।’
দময়ন্তী বলল, ‘বেশ, তাহলে দেখা যাচ্ছে, পদ্মিনীর চরিত্রে কতগুলো অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে, যার জন্য তাকে স্রেফ নিমফোম্যানিয়্যাক বলা যাচ্ছে না, আবার আহ্লাদে ন্যাকা মেয়েও বলা যাচ্ছে না।
‘এরপর আসছেন বুদ্ধদেববাবু।’
শিবেন বলল, ‘আশ্চর্য। বুদ্ধদেববাবুর চরিত্রেও অসঙ্গতি আছে নাকি ?’
‘আছে বৈকি। এবং তার প্রথম এবং প্রধান হল তাঁর পরিচয়হীনতা। তিনি ছ’বছর বয়েসে বাপ-মা হারিয়ে নাকি শিয়ালদায় আসেন। তাঁর একথা মনে আছে যে, তিনি ছিলেন জমিদার-বংশের সন্তান অথচ কোন আত্মীয়স্বজনকে তিনি বের করতে পারেননি। তিনি যে সেলুনে চাকরি করতেন, সেটা উঠে গেছে। প্রাইভেটে লেখাপড়া করেছেন ফুটপাথে বা রোয়াকে থেকে, কোন মেসে পর্যন্ত থাকেননি। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন যে, তাঁর অতীত বলে কিচ্ছু নেই, রেফারেন্স বলে কিচ্ছু নেই। এটা অবিশ্বাস্য বলা যেতে পারে। কারণ, এই আরবেন অ্যাননিমিটি বা নাগরিক নামহীনতা য়ুরোপে সম্ভব, আমাদের দেশে নয়। আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনও আধা-সামন্ততান্ত্রিক, ঘনবিন্যস্ত, য়ুরোপের শিল্পবিপ্লবের ফলস্বরূপ ছাড়াছাড়া নয়। মা, বাবা ছাড়াও, জ্যাঠা, মামা মাসী, পিসী, দিদির শ্বশুরবাড়ি, দাদার বন্ধুর বাড়িওলা—এঁরাও আমাদের কম আপনজন নন। সেক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ পরিচয়হীন হয়ে কারোর বড় হয়ে ওঠা অসম্ভব বলা চলে। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই পরিচয়হীনতা কেন ?’
শিবেন উদভ্রান্ত চোখ তুলে তাকাল। বলল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন ?’
দময়ন্তী বলে চলল, ‘আরও আছে। যতই একমাস পরে আসুন বা পনের দিন পরে আসুন, তাঁর স্ত্রীর উদ্দাম ব্যবহার যে শীতল হয়ে গেছে, তা কি তাঁর চোখে না পড়ে থাকতে পারে? তিনি ভালমানুষ সাজতে চাইছেন কি পুলিশের প্রতি স্বাভাবিক ভীতিবশত না অন্য কোন কারণ আছে?
‘তারপর, পদ্মিনী জামশেদপুরে যেতে চাইল না, আর বুদ্ধদেববাবুও চাপ দিলেন না? পদ্মিনীর না যেতে চাওয়ার কারণও জিজ্ঞেস করলেন না পর্যন্ত? যদি ছেলেমেয়ে থাকত, তাহলে বুঝতুম যে তাদের লেখাপড়ার জন্য মাকে থেকে যেতে হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো সেরকম কোন কারণ নেই।
‘এছাড়া কতগুলো সাধারণ অসঙ্গতি আছে। যেমন ধরুন, হারানো চিঠির বাণ্ডিলটা পদ্মিনীর রাইটিং ডেস্কের মধ্যে থাকা বা সারা ফ্ল্যাটে শুকদেবের কোনরকম কোন চিহ্ন না পাওয়া বা বীরেশ্বরবাবু বুদ্ধদেবাবুকে জামশেদপুরে পাঠানো, এগুলোও আমাদের মনে যথেষ্ট খটকা লাগায়।’
শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ !’ তারপর চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল। মিনিটখানেক বাদে চোখ খুলে বলল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি তা বুঝতে পারছি। আপনার বক্তব্য, শুকদেব এখন জামশেদপুরে, তাই না ?’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘ঠিক তাই !’
‘কিন্তু আমি যুক্তির পারম্পর্যটা গুলিয়ে ফেলছি, মানে ঠিক ফুলপ্রুফ হচ্ছে না। একটু পরিষ্কার করে দিতেন যদি, তাহলে⋯’
‘আপনি সমস্ত কাহিনীটা গোড়া থেকে আর একবার চিন্তা করুন, তাহলেই পারম্পর্যটা এসে যাবে। মনে রাখতে হবে, এই যে অপরাধটি সেদিন ঘটে গেল, তার সূত্রপাত মোটেই একটা হঠাৎ ঝগড়ার ফলে নয়, বরং তার বীজ উপ্ত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে একটা নাটকের মহড়ায়। মস্ত বড়লোকের একমাত্র মেয়েকে যখন বুদ্ধদেব চৌধুরী বিয়ে করেন, তখন থেকেই তাঁর নজর ছিল পদ্মিনীর প্রতি নয়, তার চেয়ে অনেক লাভজনক অন্য কিছুর ওপরে। সেজন্য, গোড়া থেকেই বুদ্ধদেব নামগোত্রহীন, রোমান্টিক ভবঘুরে ইনটেলেকচুয়াল। পদ্মিনীর সামনে ইচ্ছে করেই তিনি এই রূপটি তুলে ধরেন এবং তাঁর হিসেবে ভুল হয়নি, রোমান্টিক পদ্মিনী তার প্রতি আসক্ত হয়। তিনি কিছুদিন পদ্মিনীকে খেলালেন, যাতে করে সকলের ধারণা হল যে, পদ্মিনীই জোর করে তাঁকে বিয়ে করল, তিনি নাচার হয়ে ভালবাসার মর্যাদা রাখলেন।
‘এরপর নিতান্তই শ্বশুরের অনুরোধ এড়াতে না পেরে তাঁর ব্যবসায় যোগ দিলেন। এখানেই প্রথম আমাদের লাগল খটকা। ব্যাপারটা তো ইনটেলকচুয়ালসুলভ হল না। একথা ঠিকই যে এক সময় তিনি নানারকম ব্যবসা করেছেন, কিন্তু সে তো অতীতের কথা। এখন তো তিনি একজন পুরোদস্তুর যাকে বলে আঁতেল।
‘তারপর আবার খটকা। পাঁচ বছর বাদেই বীরেশ্বরবাবু জামাইকে পাঠিয়ে দিলেন জামশেদপুরে। তাঁর একমাত্র মেয়ে যেতে অস্বীকার করল, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ফিরিয়ে আনবার নামও করলেন না। যে জামাই তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যবসার কর্ণধার হবে, তাকে নিজের কাছে না রেখে দূরে পাঠিয়ে দিলেন, এমন কি মেয়ের কষ্টের কথা পর্যন্ত চিন্তা করলেন না, এটা বীরেশ্বরের মত ভদ্র, বিনয়ী, পরোপকারী লোকের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এর থেকে প্রায় নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে, বীরেশ্বর তাঁর জামাইয়ের স্বভাবচরিত্রের এমন কোন পরিচয় পেয়েছিলেন, যাতে তার নৈকট্য তাঁর অসহ্য বলে মনে হয়েছিল।’
সমরেশ বলল, ‘এমন তো হতে পারে যে, পদ্মিনীও সে কথা জানতে পেরেই জামশেদপুরে যায়নি এবং প্রতিশোধ হিসেবে শুকদেবের সঙ্গে প্রেম চালিয়েছে ?’
‘না, সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না। পদ্মিনীর যে রকম স্বভাব, তাতে সে প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে, এটা কল্পনা করা কঠিন। যদি সে তার স্বামীর প্রকৃত পরিচয় পেত, তাহলে হয়তো চিৎকার চেঁচামেচি করে একা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসত। ভালবাসা ছাড়া সে বাঁচতে পারে না বলে যে কথা বলত, সেটা নেহাৎ মিথ্যে নয়। তার ভালবাসার অমর্যাদা সে সহ্য করত না।
‘তাহলে শুকদেব আসে কোত্থেকে? ভালবাসার অমর্যাদা যদি না-ই হবে, তাহলে তার আসার তো কারণ দেখি না।
‘কারণ আছে, তাকে আমরা ইংরিজিতে বলি সাত বছরের চুলকুনি। বুদ্ধদেব খুব ভাল করেই জানতেন যে, বিয়ের সাত বছর পার হলে পদ্মিনীর দিক থেকে অভিযোগ আসবেই যে, দুজনের ভালবাসায় ভাঁটার টান লেগেছে। এটা প্রায় সর্বকালীন সর্বজনীন অভিযোগ এবং সন্দেহ নেই, পদ্মিনীর ক্ষেত্রে সেটা ছিল অনেক বেশি জোরাল।
‘এই অভিযোগের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন বুদ্ধদেব। জামশেদপুরে যাওয়াটা তাঁর শাপে বর হয়েছিল। সেখানে গিয়েও তিনি নিজেকে প্রস্তুতই রাখছিলেন। তা নাহলে কেউ কখনও শুনেছে যে, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নিজে সারা দিন ঘুরে ঘুরে অর্ডার সাপ্লাই করে?
‘এই জন্যেই তিনি পদ্মিনীকে জামশেদপুরে নিয়ে যাননি। তার যে অভিযোগ ছিল যে দুজনের ভালবাসায় ফাটল ধরেছে, সেটা মেরামত করার জন্যই আনান হল শুকদেবকে। তিনি একজন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের লোক, বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর কোনখানেই কোন মিল নেই। এই নতুন প্রেমিকের নতুন প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল পদ্মিনী। নিজেও আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল, তার পুরোন সত্তাটাকে ফেলে দিয়ে নতুন রূপে নতুন প্রেমিকের কাছে ধরা দিতে। সেই চেষ্টারই অন্যতম ফল এই চিঠিটা।
‘এদিকে শুকদেব চূড়ান্ত ইতরামো আর অসভ্যতা করে পাড়ার লোকের মন বিতৃষ্ণায় ভরিয়ে রেখেছেন। কাজেই, তিনি যখন খুন করলেন, তখন পাড়ার লোকসহ শিবেনবাবুরও মনে হল, এরকম নোংরা ব্যাভিচারের ফল এরকমই হয়। সকলেরই সহানুভূতি তখন বিশ্বাসঘাতিনীর স্বামী বুদ্ধদেবের ওপর। তার ফলে একটা ঘটনা কারোরই নজরে পড়ল না যে, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হলেন তিনিই এবং পয়সা রোজগারের ধান্দায় যিনি একসময়ে সর্বরকমের পেশা গ্রহণ করেছেন, তাঁর পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের কেন্দ্রস্থ নায়ক হওয়া অসম্ভব নয়।’
সমরেশ বলল, ‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, দুই ভাই ষড়যন্ত্র করে এই কাণ্ডটি করেছেন ?’
‘না, এই ষড়যন্ত্র একা বুদ্ধদেবের।’
‘আর বড়ভাইকে সম্পত্তির শেয়ারের লোভ দেখিয়ে কাজে লাগান হয়েছে ?’
‘না, তাও নয়।’
‘তাহলে শুকদেব কে ?’
‘শুকদেব কেউ নয়।’
উত্তেজিত গলায় শিবেন বলল, শুকদেব কেউ নেই, ছিল না। তুই বুঝতে পারিসনি, শুকদেব আর বুদ্ধদেব এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি? আমরা গোড়াতে কতগুলো জিনিসের ওপর জোর দিইনি। যেমন ধর, পদ্মিনী অভিনয় করত ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধদেবও অভিনেতাই ছিলেন। এই সূত্রেই তাঁদের পরিচয়। কাজেই ছদ্মবেশ ধারণ এবং অপর কোন চরিত্রের অভিনয় করা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল না। তারপর জামশেদপুরে তাঁর যে কাজের ধারা, সেটা যে কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক সেটা আমাদের খেয়াল করা উচিত ছিল। ওখান থেকে ভোরবেলা স্টিল এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে যদি আবার গভীর রাত্রে ফিরে আসা যায়, সেটা যাতে কারোর নজরে না আসে, সেই জন্যই তিনি ওই ধরণের ডিউটি তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজের জন্য।
‘পদ্মিনীর বন্ধু-বান্ধবেরা যখন আমাকে বলল যে ছোটবেলা থেকেই ও স্বপ্নজগতে বিচরণ করত, তখন আমি বুঝতে পারিনি যে, তারা তাদের অগোচরে আমাকে সঠিক পথেরই নির্দেশ দিচ্ছে। বুদ্ধদেব ওর জন্যে স্বপ্নজগতেরই সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি জানতেন পদ্মিনী তাঁকে তীব্রভাবে ভালবাসে, তিনি যেখানেই যান না কেন, সে তাঁর সঙ্গে আঠার মত সেঁটে থাকবে। তাহলে তো বীরেশ্বরের সম্পত্তির সামনে হিমালয় রূপ তাঁর মেয়েকে সরানো সহজ হয় না। তখন নিজের অভিনয় প্রতিভাকে পুঁজি করে, বুদ্ধদেব তৈরি করলেন এক অতি জটিল প্ল্যান।
‘আর পাঁচটা বিবাহিতা মেয়ের মতই পদ্মিনী যখনই বললে যে, তার মনে হচ্ছে যে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিতে ঘষা লেগে লেগে তাদের ভালবাসার ধার কমে এসেছে, তখন আর পাঁচটা স্বামীর মত বুদ্ধদেব তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন না। সে পথেই না গিয়ে ভদ্রলোক সেটা আরও বাড়িয়ে তুললেন। বললেন, সে তো বটেই। কিন্তু আমি তো তোমাকে ভীষণ ভালবাসি, আর তুমিও আমাকে ভালবাসো, সেক্ষেত্রে আমাদের পুরোন প্রেমকে কীভাবে চাগিয়ে তোলা যেতে পারে? এস, তার চেয়ে আমরা একটা নতুন পৃথিবী রচনা করি। সেখানে আমি একজন নতুন পুরুষ, তুমি একজন নতুন নারী। আমরা সম্পূর্ণ নতুন। আমরা আবার নতুন করে ভালবাসব আমাদের সমস্ত পুরোন সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে। সেই স্বর্গোদ্যানে আমরা প্রথম মানব-মানবী আদম আর হবা।
‘পদ্মিনী তো এই চায়। তার সমস্ত রোমান্টিক অস্তিত্ব এই জগতেরই কল্পনা করে। সে পরমানন্দে তার স্বর্গোদ্যানে প্রবেশ করল। হবার ভূমিকায় অভিনয়ও ভালই হচ্ছিল, শুধু সে জানত না যে, যাকে সে আদম বলে মনে করছে, সে আসলে শয়তান।’
‘তবে, বৌদি, আপনি যে ক্ষীরের বরফিটাতে বুদ্ধদেবকে সনাক্ত করলেন, সেটা আমরা পুরুষেরা কস্মিন কালেও পারতুম কিনা সন্দেহ। আসলে, পদ্মিনী যতই না কেন নতুন মানুষ হবার চেষ্টা করুক, যতই না কেন অশ্লীল চিঠি লিখুক, ওর অবচেতন মন সব সময়েই জানত যে, সে বুদ্ধদেবের বিবাহিতা স্ত্রী। আর আমার ধারণা, তা না হলে সে হয়তো এমন হৈ-হৈ করে, পাড়ার লোক দেখিয়ে, ব্যাভিচার চালাতে পারত না। কোন মেয়েই বোধ হয় তা পারে না, তাই না ?’
দময়ন্তী স্মিতমুখে মাথা নাড়ল। তারপর সমরেশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ চটুল গলায় হেসে উঠল।
সমরেশ খানিক কটমট করে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। বলল, ‘আমাদের শাস্ত্রে বলেছে, স্ত্রীবচঃ প্রত্যয়ো হন্তি বিচারং মহতামপি, অর্থাৎ স্ত্রীলোকের বাক্যে বিশ্বাস করিলে মহৎ লোকেরও বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। অতএব, হাস্যসংবরণ করতঃ কিঞ্চিৎ খাদ্যপানীয় আহরণ করহ।’