প্রেম-পাপী পীর
চারদিকে আতংক, অস্থিরতা, অসহায়ত্ব। বাবা, ভাই আপনজন হারানোর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে প্রায় ঘরেই মাতম আর বিষাদ মাখা পরিবেশ।
এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। বিশেষ করে যেসব এলাকা বা প্রদেশের অধিকাংশ জোয়ানরা ফৌজে চাকুরি করতে সেখানে তো এই অসহ্য চিত্র ছিলো প্রতিদিনের মামুলি ঘটনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের পক্ষে উপমহাদেশের মধ্যে পাঞ্জাব ও সীমান্তবর্তী এলাকার লোকেরা বেশির ভাগ ফৌজে ভর্তি হয়েছিলো। এজন্য ইংরেজরাও এসব এলাকাকে পছন্দও করতে বিশেষভাবে।
এই অশান্ত অনিশ্চিত সময়ের মধ্যেও এমন কিছু লোক মাথা চারা দেয়, যারা হাসতে হাসতে মানুষের আতংকিত মন ও অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে ব্যবসা ফেঁদে বসে। ফৌজি এলাকাতেই এ ধরনের লোকদের আনাগোনা বেশি ছিলো। সহজ শিকার ধরার জন্য তাদের কাছেও এই এলাকাগুলো বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে দারুণ পছন্দের ছিলো।
গ্রামাঞ্চলের এক থানার ইনচার্জে ছিলাম আমি। একেও ফৌজি এলাকা বলতো।
একদিন এক গ্রাম্য এলাকা থেকে পাঁচজন লোকএলো থানায়। এর মধ্যে একজনকে বেশ অভিজাত মনে হলো। মধ্যবয়সী হবে। পাঁচ চল্লিশ কি সাতচল্লিশ হবে বয়স। সে লোক নিজেকে আর্মির ক্যাপ্টেন বলে পরিচয় দিলো।
পনের দিনের ছুটিতে এসেছে। পচিয়টা এমন উঁচু গলায় দিলো যেমন ফৌজির অফিসার তার অধীনস্তদের হুকুম দিয়ে থাকে।
সেনাবাহিনী সম্পর্কে ওয়াকিফ হাল ব্যক্তিরা জানেন, আর্মির ক্যাপ্টেন সাধারণত অল্প বয়স্ক হয়ে থাকে। কিন্তু এ লোক এই বয়সেও ক্যাপ্টেন!
আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেল সময় সৈন্য সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যাওয়াতে সেনা অফিসারের সংখ্যা কমে যায়। তখন শিক্ষিত অনেক সুবেদার ক্যাপ্টেনের পদাধিকার লাভ করে। সন্দেহ নেই এ লোকও সুবেদারি থেকে ক্যাপ্টেনের পদ পেয়েছে।
ক্যাপ্টেন আমাকে জানালেন, এবার ছুটিতে আসার পর তাকে জানানো হলো, তার ছোট ভাইয়ের কাছে এক পীর সাহেব আসে। পীর সাহেব দাবী করে, তাদের ঘরে নাকি প্রাচীন এক ধণভাণ্ডার মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। এটা বের করতে হলে পীরকে তিন রাত এখানে রাত জাগতে হবে।
ঘরের সবাই তো খুব খুশি। কয়েক রাত কাটালো সে পীর। এক রাতে একটি ঘরের মেঝে খুড়তে শুরু করলো। একবার কোদাল দিয়ে কোপ বসাতেই কোন ধাতব পদার্থের ওপর কোপ পড়লো। জিনিসটাকে চকচকে মনে হলো। পীর বাড়ির সবাইকে বললো, এখন আর সামনে খনন করা যাবে না। দুদিন পর আবার শুরু করতে হবে।
এই বাড়ির মানুষ আর কোন দিন এত খুশি হয়নি। রাতের বেলা পীর সেই ঘর থেকে সবাইকে বের দিয়ে আবার সাধনায় বসলো। পরদিন সকালে বাড়ির লোকেরা দেখলো, পীর গায়েব।
ক্যাপ্টেনের ভাই বললো, পীর সাহেব ধণভাণ্ডার আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। দুদিনপর ধণভাণ্ডার নিজেই বেরিয়ে আসবে।
দুদিন চলে যাওয়ার পর ছোট ভাই পীরের খোদাই করা গর্ত কোদাল দিয়ে আরেকটু খুঁড়তেই একটি থালা বের হলো। এর নিচে কিছুই নেই। গর্ত থেকে আরো অনেকখানি মাটি তোলা হলো। কিন্তু মাটি ছাড়া আর কিছুই আবিস্কার করতে পারলো না তারা।
ক্যপ্টেরেন ছোট ভাই থালাটি ভালো করে দেখে আরেকটি ধাক্কা খেলো। আরে এই থালাটি তো ঐ পীরেরই ছিলো। ক্যপ্টেন জানালো, ঐ পীর তার ভাইয়ের কাছ থেকে এক রাতে পাঁচশত টাকা (তদানিন্তন পাঁচশ টাকা বর্তমানে অনেক টাকা) নিয়েছে।
যতদিন সেখানে ছিলো বাড়ির লোকদের কাছ থেকে নানান ছুতো দিয়ে আরো অনেক পয়সা নিয়েছে। গ্রামের আরো দুটি বাড়ি থেকেও এভাবে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
যে দিন আমি গ্রামের বাড়ি পৌঁছি- ক্যপ্টেন বললো- আমার ভাই অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে আমাকে এ ঘটনা জানিয়েছে। পরদিন অন্য গ্রামের এক লোক আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য বাড়ির দাওয়ায় এসে বসলো। কথায় কথায় লোকটি বললো, তাদের গ্রামে এক পীর এসেছে। কারামত ওয়ালা এক ওয়ালিআল্লাহ তিনি। গায়েবের খবরও দেন তিনি….. লোকটি পীরের কিছু কারামত শুনিয়ে গেলো……
পীরের আকার আকৃতি কেমন জিজ্ঞেস করলাম তাকে। সে ঐ পীরের বর্ণনাই দিলো। এখন সে ঐ লোকের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে গেছে। আমাদের ঘোড়া আছে কয়েকটি।
আমার ভাইসহ আমাদের গ্রামের তিনজন লোক নিয়ে আমরা ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। যে গ্রামের কথা বলা হয়েছিলো সে গ্রামে পীরকে পাওয়া গেলো না। পীর আরো অনেক দূরের গ্রামে চলে গেছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলো আমাদের।
পরদিন সকালে আমরা যে গ্রামে পৌঁছলাম, জানা গেলো পীর সাহেব এখানেই আছেন। গ্রামের একটি খোলা জায়গায় নতুন একটি কুপ খনন করা হয়েছে। কিন্তু পানি বের হচ্ছে না……..
কুপের কাছে গিয়ে দেখলাম, সেখানে বহু লোকের জমায়েত। পীর সাহেব কোথায় জিজ্ঞেস করতেই কয়েকজন চোখমুখ গম্ভীর করে শোনালো, আরে মিয়া! পীরকে তো খোদা আসমান থেকে পাঠিয়েছেন। মোল গজ খননের পরও কুপে পানির দেখা নেই। অথচ এ এলাকার দশ বার গজ খোদলেই পানির ঢের উঠতে থাকে। যমিনের এই আজব অংশের মাটি কেন এমন হয়ে গেলো……
পীর পৌঁছে গেলো। গ্রামবাসীরা দৌড়ে দিয়ে আরজ করলো, ইয়া সরকার কুঁয়া যে পানি দিচ্ছে না। পীর কুপের সামনে গিয়ে একবার নিচের দিকে তাকালো, তারপর আকাশের দিকে। তারপর বলতে লাগলো, কুপের মধ্যে তাকে নামিয়ে দেয়া হোক।
কূপের মধ্যে পীরকে নামানো হলো। নিচে গিয়ে ওপর দিকে মুখ করে বললো, সবাই কূপ থেকে গুনে গুনে সাত কদম দূরে সরে যাও। লোকজন দূরে সরে গেলো।
দশ পনের মিনিট পর পীরের আওয়াজ শোনা গেলো। এসো লোকেরা! দেখে যাও! লোকেরা এগিয়ে গেলো কূপের দিকে।
***
কূপ থেকে পানি বের হচ্ছে এই বলে যখন পীর কূপের নিচ থেকে আওয়াজ দিলো এই ক্যপ্টেন তখনই সেখানে গিয়ে পৌঁছলো। কূপ খননের সময় প্রথম যখন সামান্য পানি দেখা দেয় লোকেরা তখন ওপর থেকে মোবারক মোবারক বলে নিচে পয়সা ফেলে। তখন খননকারীরা তাদের বাকী খনন কাজ শেষ করে।
এখানেও লোকেরা পীরের আওয়াজ পেয়ে কূপের কাছে দৌড়ে গেলো। ওপর থেকে দেখলো, বিস্ময় আর আনন্দে সবাই শ্লোগান দিতে শুরু করলো।
ক্যপ্টেনও একটু ঝুঁকে তীক্ষ্ম চোখে তাকালো। সামান্য একটু জায়গায় পানি চকচক করছে। যাদের কূপ তারা এবং অন্যরাও নিচে পয়সা ছুঁড়ে দিতে লাগলো।
এখানে ক্যপ্টেনের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। কূপ সম্পর্কে লোকদের কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়েছিলো। কূপের মালিকদেরকে বললো, পীরকে বাইরে বের করে আনন।
পীরকে ওপরে টেনে তোলা হলো- ক্যপ্টেন বলে গেলো- আমার ভাই ও সঙ্গে আসা গ্রামের লোকেরা তাকে চিনে ফেললো।
লোকদেরকে বললাম, এই লোককে এদিক ওদিক যেতে দিবে না। আমার লোকেরা তাকে ঘিরে রাখলো। এসব মূর্খরা পীরকে নবীদের মতো মানে। লোকেরা তাই আমার বিরুদ্ধে হৈচৈ শুরু করলো। তর্ক করে সময় নষ্ট করলাম না। শুধু বললাম, মেহেরবানী করে আমাকে কূপে নামিয়ে দিন। তারপর যা ইচ্ছা বলবেন আমাকে……।
লোকেরা আমাকে রশি ও বালতিস সাহায্যে কূপের মধ্যে নামিয়ে দিলো। ষোলগজ গর্ত কম নয় কিন্তু। ধীরে ধীরে নামতে সময় লাগলো। নিচে নামতেই প্রস্রাবের কূটগন্ধ লাগলো নাকে।
ওপর থেকে যেটা পানি বলে ভ্রম হয়েছিলো। নিচে এসে দেখি সেটা প্রস্রাব। দূর্গন্ধে আমার নাড়িভূড়ি উল্টে আসার যোগাড় হলো। শক্ত বেলে মাটি হওয়াতে প্রস্রাবও মাটি চুষে নিচ্ছিলো না……..
কূপের এক মালিককেও বলে কয়ে ওপর থেকে নামালাম। নিচে নেমেই সে চোখ মুখ ফুচকে বললো, গন্ধ কিসের এখানে?
আমি তাকে বললাম, তোমাদের পীর যে পানি বের করেছে সে পানি শুঁকে দেখো।
লোকটি হাটু মুড়ে বসে পানির ওপর পুরোপুরি শুঁকতেও পারলো না। এক ঝটকায় পেছনে ফিরে এলো। তাকে বললাম, এখানে কোদাল চালাও। সে কোদাল চালালো। নিচ থেকে শুকনো মাটি ছাড়া আর কিছুই বের হলো না।
মালিক বুঝতে পারলো, আকাশ থেকে নেমে আসা তাদের পীর সাহেব প্রস্রাবের চমক দেখিয়ে অনেক পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে……।
ওপরে এসে দেখলাম, পীর সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে, তার সাথে এই বেয়াদবির পরিনাম খুব খারাপ হবে। গ্রামের ওপর গজব পড়বে। পীরকে বালতির মা দিয়ে বেঁধে কূপের ভেতরের দিকে ঝুলিয়ে দিলাম। পীর বদদুআ দিয়ে চললো। লোকেরা যখন তার এই ধোকাবাজি সম্পর্কে জানতে পারলো, তারা পীরকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো….
এবার পীর বাঁচার জন্য চিৎকার শুরু করে দিলো। আমি লোকদেরকে ঢিল ছুঁড়তে বারণ করলাম। আর পীরকে বাধনমুক্ত করে জিজ্ঞেস করলাম সে কে?
সে হাতজোড় করে বললো, আমার কাছ থেকে সব পয়সা নিয়ে নাও আর আমাকে ছেড়ে দাও।
আমার ভাইতো ওকে জানে মেরে ফেলতে চাইলো। আমি তাকে থামিয়ে বললাম, একে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। একজন জানালো, পীরের সঙ্গে আরো দুজন লোক ছিলো। ওদেরকে খোঁজা হলো, কিন্তু ততক্ষণে ওরা কেটে পড়েছে…….
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। তাই রাত করে থানায় যাওয়াটা কষ্টকর। এজন্য আমাদের গ্রামে নিয় এলাম পীরকে। যে ঘরে সে ধনভাণ্ডার আছে বলে গায়েবী খবর দিয়েছিলো সে ঘরেই তাকে বন্দি করে রাখা হলো। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিলো।
কিন্তু সকালে উঠে গিয়ে দেখা গেলো, পীর গায়েব! ঐ ঘরের আরেকটি দরজা ছিলো, সেটা বন্ধ করার কথা কারো মনে ছিলো না। দরজা ভেতরের দিকে, এটা দিয়ে লাগানো অন্যান্য কামরাতেও যাওয়া যায়। কামরায় শিকবিহীন একটি জানালা আছে। ঐ ভণ্ড ঐখান দিয়েই পালিয়েছে …….
পীরের বর্ণনা দেয়া হলো। ছয় ফুট দীর্ঘ। বয়স ত্রিশ বত্রিশ। রং বাদামী এবং কিছুটা গৌর। স্বাস্থ খুব চমৎকার। চেহারা গোলাকার। যে কারো কাছে ভালো লাগবে। চোখের দৃষ্টি গাঢ়। প্রভাব বিস্তারের মতো কিছু একটা আছে তার দৃষ্টিতে, ঘন কালো দাড়ি, সুন্দর করে ছাটা। মাথার কুচকুচে কালো চুল কাঠ অবদি নেমে এসেছে। তার ওপর পাগড়ি বাধা উঁচু করে। গাঢ় সবুজ রঙ্গের আলখেল্লা।
ধোকাবাজ পীর যাকে এখন আমি আসামী বলবো। তাকে সনাক্ত করার সবচেয়ে বড় আলামত আমাকে জানা হলো যে, তার বাম চোখটি নষ্ট। সে চোখের ওপর সাদা কাপড়ের লম্বা চৌড়া পট্রি বাঁধা।
তথ্যটা আমাকে আশান্বিত করে তুললো। কারণ, আসামীর জন্য এটা এমন এক আলামত যেটা সে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তার সঙ্গে যে দুজন লোক ছিলো তাদের দাড়ি ছিলো বেশ লম্বা। তবে একজন মধ্যবয়সী আর একজন যুবক।
***
অন্য কেউ হলে আমি এ কেস নিতাম না। বলতাম তোমরা জেনে শুনে বেওকুফী করবে আর ভণ্ডদেরকে নাচানাচি করে সর্বস্ব হারাবে আর থানায় এসে আমাদেরকে উটকো ঝামেলায় জড়াবে।
কিন্তু বাদী বা বিচারপ্রার্থী ছিলো এক ফৌজি ক্যাপ্টেন। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পুলিশরা ফৌজকে অনেক ভয় পেতাম। আসল ব্যাপার হলো, তখন চলছিলো বিশ্বযুদ্ধ। এজন্য ইংরেজ শাসক সেনাবাহিনীর লোকদের বেশ খাতির যত্ন করতো।
এমনকি সমস্ত পুলিশ বিভাগে লিখিত এই আদেশনামা জারী করা হয় যে, তোমাদের কাছে কোন সেনা যদি কোন অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে তার অভিযোগ দূর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। প্রতিটি জেলার ডিপুটি পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে সবাই এ হুকুম দিয়ে যায়।
এই এক কারণে এই মামলা আমি গ্রহণ করি। আরেকটা কারণ হলো, আমার এলাকায় প্রতারণার এই ঘটনা ঘটার অর্থ হলো, এ এলাকার অপরাধ জগতের লোকেরা অবাধে অপরাধ করে চলেছে। এখনি এর লাগাম টেনে না ধরলে বড় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে সময় লাগবে না।
তাছাড়া আসামী কোন এলাকার তাও জানা নেই। জানা থাকলেও ছদ্মবেশী আসামী শনাক্ত করে তাকে ধরা খুবই মুশকিলের কাজ। অবশ্য আসামী অন্য এলাকার হলে আমার এলাকার পেশাদার আসামীদের সহযোগিতা নিতে হবে আমাকে।
অপরাধীদের মধ্যে একটা নীতি আছে। সেটা হলো, প্রত্যেক অপরাধী নির্ধারিত এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে অপরাধ কর্ম করে না।
আমি ক্যাপ্টেনের রিপোর্ট অনুযায়ি এফআই.আর. লিখালাম। তারপর কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে তাদের গ্রামে চলে গেলাম। থানা থেকে চার মাইলেরও অধিক দূরত্বে তাদের গ্রাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন যারা ফৌজে চাকুরি পছন্দ করতো না তাদের ঘর থেকেও জোয়ানরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে লাগলো। এমন কোন বাড়ি ছিলো না যেখান থেকে একাধিক জোয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়নি। এমন ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দুনিয়াতে আর কয়টা হয়েছে।
গ্রাম্য এলাকার এসব জেয়ানরা কোন না কোন ফ্রন্টে লড়াইয়ে শামিল ছিলো। তাই আহত নিহত হওয়ার খবর প্রতিদিনই আসতে লাগলো। প্রতিদিনই কোন না কোন বাড়িতে সরকারি কর্মকর্তারা এসে জানাতো, তোমাদের ছেলে বা ভাই যুদ্ধবন্দি হয়েছে বা মারা গেছে। শোক, আতংক আর হতাশার গাঢ় এক কুয়াশার চাদর এসব ফৌজি এলাকাকে ঘিরে রেখেছিলো।
ফৌজের মা বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী, শ্বশুর শাশুড়ি আত্মীয় স্বজন সবার শেষ ভরসা তখন নতুন নতুন গজে উঠা পীর, মুরশিদ। তাবিজ আর ঝাড় ফুক করে পীরেরা তাদের দুশ্চিন্তা দূর করে দিতো।
কোন বাড়ির কেউ ফৌজ থেকে ছুটি নিয়ে এলে বা ভালোমন্দ কোন সংবাদ এলে পীরের কাছে কাড়ি কাড়ি নযরানা চলে যেতো।
অনেক পীর নিজেদের কিছু লোক বিভিন্ন গ্রামে চর নিয়োগ করে রাখতে। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুর বিভিন্ন বাড়ির ভেতর বাইরের সংবাদ জেনে আসতো। কোন বাড়ির কতজন জোয়ান কোন ফ্রন্টে আছে এটা জেনে নিতে পারলেই পীরদের কেল্লা ফতে।
তারপর তারা যে কোন এক গ্রামে গিয়ে ডেরা ফেলতো। কোন উদ্দেশ্যে কেউ এলেই তাদের বলার আগেই পীর বলে দিতো যে, তোমার ছেলে বা ভাই বার্মা ফ্রন্টে বড় বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। তারপর তাদের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ দিতে এবং কিছু তাবিজ কবজও ধরিয়ে দিতো। কয়েক মুহূর্তেই পীরের পকেট ভরে যেতো কাঁচা পয়সায়। আর পেট পুড়ে উদর পূর্তির পর্ব তো আছেই।
***
ক্যাপ্টেনের বাড়িটি বিশাল। তাদের বিস্তর জায়গা জমি আছে। এদের পূর্বপুরুষরাও সরকারি ফৌজের সদস্য ছিলো। ইংরেজ সরকার তাদেরকে নদী এলাকায় আবাদযোগ্য বিস্তৃত এলাকা দান করে। পুরো বাড়িটাই বিভিন্ন আয়তনের দালান কোঠায় বিন্যস্ত।
ভণ্ডপীর যে ঘরে ধনভাণ্ডার আছে বলে ধোকা দিয়েছিলো সে ঘরে গেলাম আমি। ঘরের এক দিকে একটি গর্ত দেখা গেলো, গর্তটি দুই ফুট এবং ততটুকুই গভীর। এর পাশে একটি কোদাল ও একটি থলে পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে অব্যবহৃত একটি খাট, পুরনো সুটকেস ও কিছু আসবাবপত্র দেয়াল ঘেষে রাখা আছে।
পাশের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দরজাটি খুলে আমি পাশের ঘরে গেলাম। এই ঘরটি খাট পালংক ও নানান আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো। যে জানালা দিয়ে পীর পালিয়েছে সেটা দেখানো হলো আমাকে।
দৈর্ঘ্যে জানালাটি আড়াই ফুট, প্রস্থ্যে দুই ফুট। জানালার চৌকাঠটি মেপে দেখলাম ১৩ ইঞ্চি। জানালার চারপাশের ফ্রেমটি নোংরা ঝুল আর মাকড়সার জালে নোংরা হয়ে আছে।
পীরের দৈহিক যে বর্ণনা আমাকে দেয়া হয়েছে এতে নিশ্চিত করে বলা যায় এত বড় দেহ দুই ফুট প্রশস্ত জানালা গলে বের হওয়া একেবারেই অসম্ভব। হতে পারে সে কাত হয়ে জানালা পার হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে জানালার সমস্ত ঝুলি ময়লা তার দেহের ঘষায় পরিষ্কার হয়ে যেতো। কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জানালা পরিষ্কার করা হয় না অনেক দিন। অর্থাৎ এখান দিয়ে যে কেউ বের হয়নি এটা নিশ্চিত।
আসামী যে এই জানালা গলে বের হয়নি ঘরের কাউকে এর প্রমাণ দিলাম আমি। জানালার ওপাশে গোয়াল ঘর এবং প্রশস্ত আঙ্গিনা। জানালার নিচের মাটি কাঁচা। আমি গভীরভাবে পরখ করলাম। না এখানে কারো পায়ের ছাপ নেই। এমন কাঁচা মাটিতে পায়ের ছাপ পড়লে সেটা মুছে ফেলাও অসম্ভব।
ক্যপ্টেন সাহেব! আমি জিজ্ঞেস করলাম- আসামী এই জানালা পথে বের হয়েছে এটা কি আপনি নিশ্চিত?
হ্যাঁ অবশ্যই। ঘরের ভেতরের দরজা খুলে আসামী এই কামরায় আসে এবং তার চোখে জানালাটি নজড়ে পড়ে। এটা দিয়ে সে গোয়াল ঘরের আঙ্গিনায় আসে এবং বড় দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। এছাড়া তো আর কোন পথ ছিলো না।
বাড়ির মূল অংশে চলে গেলাম আমি। এ অংশটি বেশ ঝকঝকে তকতকে। বাড়ির লোকেরা কে কোথায় ঘুমোয় এটাও জেনে নিলাম এক ফাঁকে।
আমি আসলে বের করতে চাচ্ছিলাম ভণ্ড পীর বের হয়েছে কোন দিক দিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে থাকে সে যেখান দিয়ে বের হোক তো হয়েই গেছে। কিন্তু আমার সন্দেহ বরং এই নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হয় যে, আসামী নিজের চেষ্টাতে বের হতে পারেনি। কেউ তাকে বের হতে সাহায্য করেছে। ঐ জানালা দিয়ে সে বের হয়নি।
আমার ধারণা সঠিক হলে তার সাহায্যকারী বাড়ির চাকর বাকর হতে পারে অথবা বাড়িরই অন্য কেউ হতে পারে। এবং এদের কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকাটাও আশ্চর্যের কিছু হবে না তখন।
আরেকটা ব্যপার হতে পারে, যেটা এখনই বলতে চাই না। সেটা হলো সেই রহস্যময় পীর কোন নিগুঢ় রহস্যের এই বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারে। এমন হলে কাহিনীর প্রতিটি বাক্যই যে চমকের পর চমক সৃষ্টি করে যাবে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এবার ঘরের মহিলাদের প্রতি নজর দিলাম। এখানে ক্যপ্টেনের বৃদ্ধা মা আছেন। ছোট ছেলের ঘরে থাকেন তিনি। আরেকজন হলো ক্যাপ্টেনের বোন। ত্রিশোর্ধ নরী। তার একটি বাচ্চা আছে। স্বামীর সঙ্গে বনাবনি হচ্ছে না বলে বছর খানেক ধরে বাপের বাড়ি পড়ে আছে। মোটামুটি ধরেনর চেহারা, তবে স্বাস্থ্যটি বেশ অটুট–লাবন্যময়ী। সব মিলিয়ে আকর্ষণীয় নারী।
তৃতীয় নারী হলো, ক্যাপ্টেনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। ননদের চেয়ে অনেক সুন্দরী। বয়স সাতাস আঠাশ হবে। এদের সবার কাছ থেকেই ঘটনার জবানবন্দি নেবো আমি। শুরু করলাম ক্যাপ্টেনের ভাইকে দিয়ে।
***
অনেক দিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে কথা ছড়াচ্ছে, আল্লাহর এক বিশেষ বান্দা এখান দিয়ে যাবেন- ক্যাপ্টেনের ভাই বলতে শুরু করলো- কেউ বললো, তিনি পায়ে হেঁটে হজ্জে যাচ্ছেন এবং পথে যে কেউ তার মনোবাসনার কথা আরয করে সেটা তিনি পূরণ করে দেন।
কেউ বললো, আল্লাহর দরবার থেকে হুকুম করা হয়েছে তাকে যে, বিভিন্ন নগরে শহরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের মনোবাসনা পূরণ করে। তাকে কিছু না জানালেও তিনি মনের ভেদ এমনিই জেনে নিতে পারেন। তার অলৌকিক কারামতের কাহিনী কেউ শোনালে মানুষের বিশাল জটলা বেঁধে যেতো।
ভণ্ড পীর ফকিরের দাসত্ব মানুষের মধ্য থেকে আজো কমেনি, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির রাজত্ব চলছে। সহীহ পীর ফকীর যে নেই এমন নয়, তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। ভণ্ড পীরের মুরিদরা তাদের পীরের ক্ষমতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এমন গাঁজাখুরি বাহিনী ফেঁদে বসে, শুনলে মনে হবে সে কোন নবীর চেয়েও বড় কারামতওয়ালা। (নাউযুবিল্লাহ)।
আসলে এসব অতিরঞ্জনের কারণ হলো, নিজেকে নিজের প্রবোধ দেয়া যে, সে যাকে পীর মেনেছে সে লোক আসলেই কামেল লোক। ক্যাপ্টেনের ভাইয়ের অবস্থাও ছিলো এমনই। প্রথমত তার বোনের স্বামী-বিচ্ছেদের সমস্যা। দ্বিতীয়ত: তার বিয়ে হয়েছে সাত আট বছর। এখনো বাচ্চার মুখ দেখতে পারেনি। সে আগেই ঠিক করে রেখেছিলো, পীরের পবিত্র পদধূলি এ গ্রামে পড়লেই সে তার কাছে ছুটে যাবে এবং বলবে, তার বোনকে যেন তার স্বামী নিয়ে যায় এবং তাকে একটি সন্তানের ভাগ্য দান করে।
এর মধ্যে একদিন পীরের পদধূলি ঐ গ্রামে পড়লো। এক বাড়িতে তার আস্তানা জমে উঠলো। সে বাড়ি ও বাড়ির আশপাশের রাস্তাঘাট ভক্ত মুরিদদের আনা গোনায় সব সময় সরব হয়ে থাকে।
একদিন এক মহিলা এসে সালাম জানালো। তার দুই ছেলে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে গিয়েছে। পীর তাকে দেখতেই বলে উঠলো
তোমার দুই ছেলে একেবারে সুস্থ আছে। চিন্তা করো না। ওদের জানের সদকা দিয়ে দাও। ওরা যে বার্মা ফ্রন্টে আছে। একটু বিপদজনক অবস্থায় ছিলো তারা। এখন ভয় কেটে গেছে। আমি একটা তাবিজ দিয়ে দেবো। বাড়ির প্রথম দরজায় লাগিয় দেবে।
সেখানে যারা ছিলেন সবাই হয়রান হয়ে গেলো। সুবহানাল্লাহ, পীর সাহেব নিজেই তার মনোবাসনা বুঝে নিয়েছেন। আরো কয়েকজন সৈনিকের মা পীরের কাছে আসে। পীর প্রত্যেকের ব্যাপারেই ঠিকঠাক বলে ঝুলি দেয় যে, তার ছেলে অমুক ফ্রন্টে আছে। নগদ নজরানায় পীরের বলে কয়েক ঘন্টাতেই ভরে যায়।
পীরের সঙ্গে তার দুই শাগরেদও ছিলো। পীর এক ঘরে ধ্যান করে বসে। আর সেই দুজন পাশের কামরায় অবস্থান নেয়। পীরের সাক্ষাতে কেউ আসলে ঐ দুজন প্রথমে তার মনোবাসনার কথা জেনে নেয় এবং নির্ধারিত কোন ইংগিতে পীরকে জানিয়ে দেয় যে এই মক্কেল এই এই সমস্যা নিয়ে এসছে। পীর মক্কেলকে দেখেই তার মনের সব কথা তার সামনে তুলে ধরে। মক্কেলের তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
ক্যাপ্টেনের যার নাম আমি সুবিধার জন রেখেছি আদালত। আদালত এসব কারামত দেখে ভাই পীরকে তার বাড়িতে নিয়ে এলো।
পীর এত বিশাল হাবেলি দেখে বুঝে ফেললো, এদের অনেক পয়সা আছে। কিছু হাতিয়ে না নিয়ে মনে শান্তি পাবো না।
তুমি তো খুব সামান্যই চেয়েছে- পীর তাচ্ছিল্য করে বললো- এখানে শাহে সুলাইমান (আ) এর ধণভাণ্ডার চাপা পড়ে আছে। তোমরা এর ওপর দিয়ে চলাফেরা করছো…… তোমার সন্তান কেন হবে না। অবশ্যই হবে….. আর তোমার বোনের চিন্তা মন থেকে দূর করে দাও। এই চাঁদের পূর্ণিমাতেই ওর স্বামী এসে ওকে নিয়ে যাবে। এমনিতে ওর স্বামীকে খেপাটে মনে হলেও ভেতর ভেতর সে খুবই অনুতপ্ত। আজ রাতে তোমার বোন ও স্ত্রীকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তবে ওদের দেহ যেন সম্পূর্ণ পবিত্র হয়। উভয়েরই অযু করে আসতে হবে।
শাহে সুলাইমানের খাযানার কথা কী বললেন যেন সরকার!- আদালত চরম হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
অনেক পুরনো খাযানা- পীর রহস্যভরা গলায় বললো- শত শত বছর পেরিয়ে গেছে। খানা কোথায় আছে এটা আমাদের দেখতে হবে। পুরনো খাযানা বা ধণভাণ্ডার মাটির নিচে দাফন করা থাকলে সেটা আপনাআপনি চলা ফেরা করে। জিন বা কালনাগের প্রহরা এর ওপর অবশ্যই থাকে। এ অবস্থায় এর ওপর হাত দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অনেক কিছু করতে হবে। এই বাড়ির মাটি আমাকে বলছে, তার পেটে সোনার ভাণ্ডার আছে।
***
ধণ ভাণ্ডার বা গুপ্তধনের গল্প কাহিনীতে মানুষের আগ্রহ খুব বেশি। এর অর্থ হলো অধিকাংশ মানুষই হাস্যকর হলেও মনের গোপন কোনে এ স্বপ্ন লালন করে যে, একদিন যদি কোন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যেতাম তাহলে ভাগ্য ফিরে আসতো।
মানুষের আরেকটি বিশ্বাস আছে, এসব খানা বা গুপ্তধনের সন্ধান একমাত্র জাদুকর বা কামেল পীররাই দিতে পারে। তাই খাযানার কথা শুনে আদালতের ভেতরও হাজারো রঙ্গীন স্বপ্ন মাথা চারা দিয়ে উঠে। পীরকে তার মনে হয় আকাশ থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা।
গুপ্তধনের কথা শুনে তুমি তো বেশ খুশি হয়েছে- পীর আদালতকে বললো- কিন্তু তুমি তো এটা জানো না যে, এই খাযানা যতদিন তোমাদের বাড়ির মাটির নিচে থাকবে ততদিন তোমাদের ঘর থেকে অশুভতা দূর হবে না। তোমার বোন ঘরে পড়ে আছে আর তোমার স্ত্রীর কোল খালি। এটাও একটা কুলক্ষণ।
ঐ খাযানা যদি বের হয়ে আসে তাহলে কি সেটা উদ্ধার করে কোথাও নিয়ে গিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে?- আদালত জিজ্ঞেস করলো।
না, খাযানা বের হয়ে এলে এর অশুভতা দূর হয়ে যাবে এবং এর মালিক হবে তখন তুমি- পীর বললো।
আদালত, আদালতের বউ ও তার বোন তো আগ থেকেই পীরের নানান উড়ো উড়ো কারামতের কথা শুনে তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। যখন খানা এর আওয়াজ পৌঁছলো ওদের কানে, তখন তো সবাই পীরের দরবারে এসে মাথা ঠুকতে লাগলো।
পীর জানিয়ে দিলো, এ ঘরে তাকে ছয় সাত রাত চিল্লা করতে হবে। রাত জাগতে হবে। তবে শর্ত হলো কোন কিছুর প্রয়োজন হলে সে মুখ থেকে শব্দ বের করতে পারবে না। শুধু তালি বাজাবে। তখন ভেতরে শুধু নারীরাই আসতে পারবে। তবে অযু করে সম্পূর্ণ পবিত্র অবস্থায়।
একথা বলে পীর ধ্যান করে কি একটা হিসাব নিকাশ করলো। তারপর বললো, এ বাড়িতে যার নাম তা অক্ষ্যর দিয়ে শুরু সেই ভেতরে আসতে পারবে।
আদালনের স্ত্রীর নাম ছিলো তাজ বেগম। তাজ দরুণ খুশি হলো। এত বড় আল্লাহর পিয়ারা বুযুর্গের খেদমতের জন্য তাকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সে রাতেই চিল্লা শুরু হয়ে গেলো। তাজকে পাশের কামরার দরজায় পৌঁছে দেয়া হলো।
আদালতকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। পীর সাহেব তাজকে প্রতি রাতে কতবার করে ডাকতো। আদালত জানালো, সে শুয়ে পড়তো, সকালে তাজ তাকে বলতো, পীর ওকে রাতে দুতিনবার ডেকেছিলো।
পীর ঘোষণা করে দিয়েছিলো, চিল্লা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন সাক্ষাপ্রার্থী কোন উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য তার কাছে আসতে পারবে না। দিনের বেলা তার শাগরেদ দুজন কেবল ভেতরে আসতে পারতো। রাতে ওদেরও ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না।
এভাবে চলতে লাগলো। পীর ও দুই শাগরেদকে প্রতিদিন রসালো খাবার দেয়া হতে লাগলো। প্রতিদিন তিন কেজি দুধ, ঘিয়ে ডুবিয়ে পরটা ভাজা এবং আস্ত একটা মুরগি পীরকে খাওয়ানো হতো।
ঐ বাড়ির সামনে বহু সাক্ষাতপ্রার্থী প্রতিদিন ভিড় করতো। পীরের সাক্ষাতের জন্য আদালত ও পীরের শাগরেদের কাছে মিনতি করতো। শিশু বাচ্চা নিয়ে অনেক মহিলাও বাড়ির বাইরে সারাদিন কাটিয়ে দিতো। কিন্তু পীরের দৃষ্টি কারো ভাগ্যে জুটলো না।
পুরো আটটি রাত সে চিল্লা করলো- আদালত জানালো- সত্য কথা বলতে কি আমিও খুব উফুল্ল ছিলাম যে, আমার বাড়ি থেকে গুপ্তধন উদ্ধার করা হচ্ছে। চিল্লা শেষ করে পীর আমাকে বললো, সে গুপ্তধনে হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ, শাহ সুলাময়ানের এক জিন গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে।
আদালত তখন পীরের হাতে পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করলো, যেভাবেই হোক তাকে এই খানা উদ্ধার করে দিতে হবে। সে তাকে হাতভরে ন্যরানা দিবে। যে করেই হোক জিন এখান থেকে হটিয়ে দিন।
জিন আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, খাযানার কাছে না যেতে- পীর আদালতেক বলে- আমি তাকে রাজি করতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাকে রাজী করা এত সোজা নয়। আমি তাকে অন্ধ করতে পারি, শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু এতে আমাদের প্রাণের আশংকা রয়েছে- একথা বলে সে দুবার বললো–আমি অবশ্যই পারবো, পারতেই হবে আমাকে।
যা হোক আদালত ও তার স্ত্রী তাজ, পীরকে খানা উদ্ধারের ব্যপারে বাজী ধরলো পাঁচশ টাকার বিনিময়ে। তখনকার পাঁচশ এখনকার বিশ হাজার টাকার চেয়ে বেশি। সঙ্গে ছিলো দুটি ঘোড়া, আরো দামী দামী কাপড় ও সোনার জরি দিয়ে তৈরী নাগরা জুতো।
পীর জানালো, আরো কয়েক রাত চিল্লা করতে হবে। আদালতের কাছ থেকে সে আরো শখানেক টাকা নিয়ে তার দুই শাগরেদকে দিয়ে শহরে পাঠালো। তারা প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র আনবে। তারা তখনই রওয়ানা হয়ে গেলো এবং সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলো।
আদালত জানলোও না তারা কি কিনে নিয়ে এসেছে।
পীর আদালতকে নির্দেশ দিলো, সন্ধ্যায় তার স্ত্রীকে গোসল করিয়ে লালপাড়ের লাল কাপড় পরিয়ে তার কামরায় পাঠিয়ে দেবে। তবে সমসময় তাকে অযু অবস্থায় থাকতে হবে।
এই মহিলা আমার কাছ থেকে সাত কদম দূরে বসে থাকবে। আর তার মনে শুধু আল্লাহর নামই থাকবে- পীর বলেছিলো।
***
আদালত বড় আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে তার স্ত্রীকে পীরের কামরায় পাঠিয়ে দিলো। পীর তাকে সঙ্গে নিয়ে তিন রাত চিল্লা করলো। সকালের সূর্যোদয়ের আগেই তাজ তার কামরা থেকে বের হয়ে যেতো।
চতুর্থ দিন পীর কোদাল চাইলো। আদালত ঘটনা বর্ণনার সময় জানালো, ভেতর থেকে কোদাল চালানোর আওয়াজ আসতে লাগলো। তারপর এই আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। প্রায় এক ঘন্টা পর দরজা খুললো। ঘরের সবাইকে সে কামরায় ডেকে আনলো। এক জায়গায় মাটি খোদাই করা দেখা গেলো। আদালতকে বললো, এখানে আরা কোদাল চালাও।
আদালত তিনবার কোদাল মারলো। চতুর্থবার এমন আওয়াজ পাওয়া গেলো যেন কোন ধাতব কিছুর ওপর কোদাল পড়েছে।
থামো!- পীর বললো তখন- এখন হাতে মাটি সরাও।
আদালত হাতে মাটি সরালে ইস্পাত বা লোহার চকচকে কিছু দেখতে পেলো। আদালত হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো বিস্ময়ে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো
ইয়া সরকার! এতো কোন বাক্সের তালা মনে হচ্ছে!
ভালো করে দেখো, পীর বললো।
আদালত আরো মাটি সারালো।
এটা একটা ঢাকনা- পীর বললো- একটা ডেকের ওপর রাখা আছে। এটা……. সবাই ভালো করে দেখো।
আদালতের মা বোন স্ত্রী সবাই ঝুঁলে দেখলো। ডেগের ঢাকনা মাটির সাথে আটকে আছে। পীর কোদাল নিয়ে তার ওপর আস্তে আস্তে টোকা দিলো। শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছিলো, এর নিচে কিছু এটা আছে।
এখন আর এর চেয়ে বেশি খনন করতে পারবে না- পীর বললো আগামীকাল রাতে গ্রামের সবাই যখন শুয়ে পড়বে তখন তোমরা খনন শুরু করবে। আজ রাতে ঐ ঘরে প্রদীপ জালিয়ে রাখো। আজ রাতে আমি এখানে থাকবো না। শাহে সুলাইমানের দরবারে আমাকে হাজিরা দিতে হবে। তোমরা আমাকে দিয়ে একটি পাপ করিয়েছে। খানায় যে জিন প্রহরায় ছিলো তাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। এখন আমার জন্য জরুরী কাজ হলো, শাহে সুলাইমানের দরবারে গিয়ে মাফ চাওয়া। না হলে সবার অপঘাতে মৃত্যুর আংশকা রয়েছে।
শাহে সুলাইমানের দরবার কত দূর হুজুর?- আদালত জিজ্ঞেস করলো।
এ ভেদ তুমি সহ্য করতে পারবে না- পীর চোখ বড় বড় করে বললো আমি যা দেখতে পাই তুমি তো তা দেখতে পারো না। এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমাদের কাছে চলে আসবো- পীর এমনভাবে কথা বলছিলো যেন স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছে।
পীর বলতে লাগলো, এই খানার ব্যপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। আল্লাহ তাআলা আমাকে যে খাযানা দিয়েছেন তোমরা কখনো তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। তোমাদের খানার দরকার ছিলো আমি তা বের করে দিয়েছি…… এখন তা বের করে ভোগ করো।
পীর চলে গেলো। আদালত তখনই সে ঘরে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো…. সে দিনটি এবং রাতটিও কেটে গেলো। পরদিনও চলে গেলো। পীর ফিরে এলো না। তার দুই শাগরেদ পীরের সঙ্গেই চলে গিয়েছিলো।
সেদিন সন্ধ্যায়ই আদালতের ক্যাপ্টন ভাই ছুটিতে বাড়িতে আসলো। বাড়ি এক হলেও ক্যাপ্টনের হিসসা প্রাচীর দিয়ে পৃথক করা। আদালত খবর পেয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলো। এর আগেই ক্যাপ্টেনের স্ত্রী ক্যাপ্টেনকে পীরের কহিনী যতটুকু জানে বলে দিয়েছিলো।
ক্যপ্টেন আদালতকে দেখে পীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। আদালত পীরের কারামতের কিছু কাহিনী শুনিয়ে বললো, পীর তো তার ঘরে গুপ্ত ধনের মুখ খুলে দিয়ে গেছে। আজ রাতে গুপ্তধন বের করা হবে।
রাতে ক্যাপ্টেনও আদালতের ঘরে গেলো। আদালত তাকে খাযানার ঘরে নিয়ে গেলো। ক্যাপ্টেন আদালতকে খনন কাজ শুরু করতে বললো। আদালত ঢাকনার ওপর থেকে মাটি সরালো এবং ঢাকানাও উঠিয়ে নিলো। কিন্তু এর নিচে কিছুই ছিলো না। আদালত পাগলের মতো কোদাল চালাতে লাগলো। কিন্তু কাদা মাটি ছাড়া আর কিছুই বের হলো না।
ক্যপ্টেন বুঝে ফেললো, তার ছোট ভাই প্রতারণার শিকার হয়েছে। ঢাকনাটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে সবাইকে বললো, এতো এ যুগের বানানো হলে বা ঢাকনা।
আদালতের মায়ের হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়লো। ঘরের এক দিকে রাখা বড় একটি ডেগচি দেখিয়ে বললো, এই ঢাকনা তো ঐ ডেগচির।
আদালতের বোন ও স্ত্রীও থালাটা চিনতে পারলো। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছাড়া কিছুই করার ছিলো না তাদের।
***
আমার মাথায় একটা সম্ভাবনা উদয় হলো যে, আদালতের গ্রামে নিশ্চয় পীরের সহমর্মী কেউ আছে। কিন্তু এ সন্দেহটা পোষণ করতে মনে সায় দিচ্ছিলো না। কারণ এ পরিবার প্রতারণার শিকার হয়েছে। তবে চাকর বাকর হয়তো পীরকে পালাতে সাহায্য করেছে।
ক্যাপ্টেন সাহেব! আদালতের বড় ভাইকে বললাম- আসামী মনে হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ংকর। একে তাড়াতাড়ি ধরতে না পারলে এ এলাকায় প্রতরণাসহ আরো অনেক বিপদজনক অপরাধকৰ্ম সংঘটিত হতে পারে। শুধু আপনার ভাই-ই নয় পুরো এলাকার প্রতি আমি সহমর্মী। আমার দায়িত্ব পালন করার জন্য আপনার ভাইয়ের পরিবারের মেয়েদেরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন পড়বে। এরা সবাই আমার মা বোনের মতোই। এটা আমার পেশা ও আত্ম মর্যাদাবোধের প্রশ্ন। আপনি সেনা অফিসার। পেশাগত দায়িত্ব কি জিনিস আপনি সেটা জানেন।
জনাব, আপনার জন্য সম্পূর্ণ অনুমতি আছে- ক্যপ্টেন বললো- শুধু অনুরোধ করবো, জিজ্ঞাসাবাদ আমার ঘরে বা আমার ভাইয়ের ঘরে করবেন। আরেকটা অনুরোধ, খাবার খেতে হবে কিন্তু আমার ঘরে।
ঘরের চাকর নওকরদের আমার কাছে সোপর্দ করুন।
দুই নওকরকে পাঠানো হলো আমার কাছে। রাতে ওরা কোথায় ঘুমোয় ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম। একজন বললো, নিজের বাড়িতে ঘুমোয়। আরেকজন এ বাড়ির উঠোনের মথায় ছোট একটি ঠাকুরীতে ঘুমোয়। যে রাতে পীর পালিয়েছে সে রাতেও সে ওখানেই শুয়েছিলো।
নওকরকে নিয়ে আমি তার থাকার জায়গাটি দেখতে গেলাম। গরু মহিষের গোয়ালের কাছে একটি নিম গাছের তলায় তার ঘর। তার ঘর থেকে বাড়ির প্রধান দরজা আট কদম দূর। সে প্রতিদিন ফজরের আযানের আওয়াজ শুনে জেগে উঠে এবং মহিষগুলোকে দানা পানি দেয়।
প্রধান দরজা রাতে ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। সকাল বেলা সেই দরজা খুলে দেয়।
প্রধান দরজাটি বেশ প্রশস্ত ও অনেক উঁচু। বড় মোটা শিকল দিয়ে লাগানো হয়। ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, সকাল বেলা উঠে দেখেন ঐ জানালা এবং দরজার শিকল খোলা।
ভালো করে মনে করে দেখো- নওকরকে বললাম- আজ সকালে কি দরজা তুমি খুলে ছিলে না নাকি জেগে উঠে দেখেছো দরজার শিকল খোলা?
আমার ভালো করেই মনে আছে হুজুর! শিকল আমি নিজ হাতে খুলেছি।
এ বাড়িতে একজন পীর এসেছিলো সেটা কি জানো তুমি?
জানি হুজুর! অনেক দিন ছিলেন এখানে। কাল উনাকে এখানে ধরে এনেছিলো। তাকে নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে গ্রামে। কাপ্তান সাব ও তার ভাই সাব আরো অনেকে মিলে উনাকে অনেক মারপিট করেছিলো। আজ সকালে মহিষগুলোকে দানা পানি দিচ্ছিলাম। তখন চৌধুরী সাব (আদালত) এদিকে এলেন।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে আমি কোথায় শুয়েছিলাম। আমি বললাম এখানেই। আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না আমাকে। তবে কয়েকটি গাল দিয় চলে গেলেন। এরপর কাপ্তান সাবও এলেন। আমি তাকে বললাম, দরজার শিকল তো লাগানো ছিলো, পীর এখান দিয়ে কি করে যাবে……. হুজুর! আমরা গরীব আদমী! গালি খাওয়াই আমাদের কাজ। আমি উনাকে আর কিছু বললাম না। তিনি চলে গেলেন।
***
নওকরকে ওখানেই রেখে বাইরে এসে ক্যপ্টেন ও আদালতকে একদিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
সকালে উঠে বড় দরজার দিকে গিয়ে কি দরজা খোলা দেখেছে তারা? নাকি নওকারকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করেছে যে, সকালে উঠে সে দরজার শিকল খোলা পেয়েছে না বন্ধ পেয়েছে?
এক ভাই আরেক ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। তারা হয়রান হয়ে উঠলো।
শিকল লাগানো ছিলো, নওকর কি আপনাদেরকে একথা বলেছে?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ জনাব!- আদালত বললো।
আচ্ছা আপনাদের নওকার কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?
ষোলআনা জনাব! কেন সে কি কিছু করেছে?- আদালত পেরেশান হয়ে গেলো।
এটা সময়মতো জানা যাবে। সে কিছু করে থাকলেও সেটা জরুরী কিছু হবে না। আমি শুধু বলতে চাই আসামী ঐ জানালা পথে বের হয়নি। সে তো পেছনের উঠোনেই যায়নি।
জনাব; সকালে তো আমরা জানালা খোলা দেখেছি। সবসময় তো সেটা বন্ধই থাকতো- আদালত বললো।
এছাড়া তো অন্যকোন পথও ছিলো না ইনস্পেক্টর সাহেব!- ক্যাপ্টেন বললো- বড় কামরার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিলো। আর বাইরের দরজা ভেতর থেকে ছিলো বন্ধ। সে জানালা দিয়েই পালিয়েছে।
আসামীর শারীরিক আকৃতি আপনাদের দুজনের মধ্যে কার সঙ্গে মিলে? আমি অযথা তর্কে না জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
আমার সঙ্গে মিলে সে আমার চেয়ে একটু মোটাও বেশি হবে। কম হবে না- আদালত বললো।
দুজনকে জানালাওয়ালা কামরায় নিয়ে গেলাম। দেখলাম, জানালার ফ্রেম জুড়ে ঝোল কালি লেগে আছে। তারপর আদালতকে বললাম, জানালা দিয়ে সে যেন ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আদালত মাথাটুকুই কেবল ঢোকাতে পারলো, কাঁধ জানালার ফাঁকে ফেসে গেলো। সে কাঁধ ওপর নিচ করলো। বহু কষ্টে কাঁধ বেরও হয়ে গেলো, কিন্তু শরীর? কেটে বের করতে হবে। আদালতকে নেমে আসতে বললাম। সে অনেক কসরত করে জানালা থেকে নেমে এলো।
এখন দেখুন, জানালার আশেপাশের ঝোল ময়লা দেখিয়ে বললাম- দেখুন তো ময়লাগুলো আছে কি? আপনার জামা দেখুন….. আসামী এদিক দিয়ে গেলে ধুল ঝোল পরিষ্কর হয়ে যেতো। আপনার কাপড় নোংরা হতো না। কাপ্তান সাহেব! সে এদিক দিয়ে যায়নি। এজন্য আপনার নওকরের ওপরও সন্দেহ জাগে না যে, সে আসামীকে এদিক দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
আমাদের তো জনাব সৈনিকের মাথা!- ক্যপ্টেন বললো- এত সুক্ষ্ম বিষয় ভাই আমরা বুঝবো কি করে।
কিন্তু আদালত ও ঘরের মহিলাদেরও বক্তব্য, বড় কামরার দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিলো। তাহলে সে গেলে কোন দিক দিয়ে?
আমাদের ব্যবস্থা এত পাকা ছিলো যে, রশি দিয়ে তার হাত পা বাধার প্রয়োজন বোধ করিনি- আদালত বললো।
সোজা কথা হলো- ক্যপ্টেন বললো- রশি দিয়ে হাত পা বাধার কথা মনেই আসেনি। এমন রাগ ছিলো যে, মাথা বিগড়ে যাবার মত অবস্থা। আদালত তো চেয়েছিলে ওকে হত্যা করে লাশ দাফন করে আসবে কোথাও। আমি ওকে এথেকে বাধা দিই যে, একাজ করলে তোমারও ফাঁসি হয়ে যাবে।
জনাব, আদালত অন্য সুরে বললো- পীর আমাদেরকে অনেক বড় ধোকা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে তার কাছে এমন কোন বিদ্যা আছে, যার জোরে সে এখান থেকে অনায়াসেই বের হয়ে গিয়েছে। আমরা তাকে বেঁধে ফেললেও সে বাঁধন খুলে ফেলতো।
হ্যাঁ, এছাড়া তো তার পলানোর আর কোন পথ নেই- ক্যপ্টেনও সায় দিলো।
তার কাছে কোন বিদ্যা আছে কিনা, এটা আবার এখন জানার বিষয় নয়, পরে দেখার দরকার হতে পারে। একথা বলে আমি আমার নওকরের কাছে গেলাম।
আমি নওকরকে আরো অনেক কথা জিজ্ঞেস করলাম। তবে তার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম, বাড়ির ভেতরগত কথা তার খুব একটা জানা নেই। তাকে এটাও জিজ্ঞেস করলাম। আদালতের বোনের তার স্বামীর সঙ্গে কিসের ঝগড়া?
আমরা চাকর নওকররা তো এটাই জানি যে, বিবি সাহেব নিজের দেমাগ দেখিয়ে চলতো, কিন্তু তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বলতো, তাদের দেমাগই উঁচু। অন্যকান কারণ নেই- নওকর বললো।
ওর চালচলনে ওর স্বামীর সন্দেহ ছিলো?
হুজুর! আমরা এখনো এমন কোন কথা শুনতে পাইনি। উনার স্বামী উনাকে মনে প্রাণে চান। আমার মা আমাকে বলেছে, উনার শাশুড়ি সুবিধার মহিলা নয়। গ্রামের গরীব লোকদের ওপর এমন জোরজবস্তি করে যেন সেই দেশের রানী-নওকর বললো।
তুমি এত নিশ্চিত করে কি ভাবে বলছো যে, চৌধুরীর বোনের চালচলন ঠিক আছে?
খারাপ হলে তো জানতেই পারতাম- নওকর বললো- বিবি তো কখনো বেরই হয় না।
আর ঘরেও তো ভিন্ন পুরুষের আসা যাওয়া নেই।
চৌধুরী (আদালত) সাহেবের স্ত্রী কেমন?
জ্বি হুজুর! ইনিও ঠিক আছেন।
আসামী সম্পর্কেও কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু নওকর কিছুই বলতে পারলো না। তার সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। অন্য নওকরও কোন কিছু বলতে পারলো না?
***
রাত হয়ে গিয়েছিলো। গ্রামেই রয়ে গেলাম। তবে ঘুমুনোর সুযোগ হয়নি। এ ধরনের কেসে পুলিশের নিজস্ব ঝামেলাও মেলা। অন্যান্য থানায় আসামীর সনাক্তকরণ রিপোর্ট পাঠাতে হয়। যাতে যেকোন এলাকা থেকে আসামীকে সহজে ধরা যায়। আমি আই.এস.আই-কে থানায় খবর পাঠিয়ে দিলাম। এ কাজগুলো যেন দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।
রাতে বাড়ির বৈঠকখানায় আদালতের বোনকে নিয়ে বসলাম। আদালতের বোনকে বললাম,
তুমি আমাকে থানাদার মনে করো না। ওর ভয় দূর করার জন্য বেশ সহানুভূতির গলায় তার স্বামী ও সংসারের খুটিনাটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। ইচ্ছে করেই তার স্বামীর বিরুদ্ধে বলতে লাগলাম।
সে আমাকে দুদন্তও এগুতে দিলো না। নিজের স্বামীর প্রশংসা শুরু করে দিলো। যত আপত্তি তার শাশুড়িকে নিয়ে। আদালতের বোনের দাবী, তার শাশুড়ি হলো সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে আনন্দ পাওয়া এক বিকৃতি রুচির মহিলা।
আমার চোখে মুখে সহমর্মিতা, আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে তার কথা শুনতে লাগলাম। সেও সহজ ভঙ্গিতে অসংকোচে তার ভেতরে জমে থাকা কথার স্তূপ উগড়ে দিতে লাগলো। আশা করছিলাম, কথায় কথায় সে পীর সম্পর্কে এমন কিছু কিছু বলে বসবে, যা আমার জন্য বেশ কাজের হবে।
স্বামীর ব্যপারে ও আজো অন্ত-প্রাণ। দুজনে দুজনকে তীব্রভাবে চায়। একবছর হলো সে বাপের বাড়ি আছে। এর মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সাত আটবার মিলন হয়ে গেছে। তবে স্বামী স্ত্রীর মতো নয়। গোপন প্রেমিক প্রেমিকার মতো। যেন অভিসারিকায় পাওয়া দুই নারী পুরুষ।
রাতের অন্ধকার গ্রামের বাইরে ঘন বন বৃক্ষ এলাকায় ওদের অভিসার হয়েছে। এ থেকেই আমি বুঝতে পারি যে, তার স্বামী নিজের মায়ের ঝগড়াটে স্বভাবকে ভীষণ ভয় পায়। নিজের স্ত্রীকে এত ভালোবেসেও মুখ ফোটে মাকে বলতে পারে না।
তোমাদের ঘরে যে পীর এসেছিলো তাকে নিশ্চয় তোমার শাশুড়ির কথা বলেছে- আমি বললাম।
পীর নিজেই একথা বলে দিয়েছিলো- সে বললো- আমি তো হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মুখ দেখেই আমার মনের কথা বুঝে নিয়েছিলো। গায়েব সম্পর্কে জানতো কিভাবে? বলেছিলো তাবিজ দেবে আমাকে।
তাবিজ দিয়েছিলো?
না এখন তো সবাই জেনে ফেলেছে পীর আসলে ধোকাবাজ ছিলো। প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো- সে থেমে গেলো এবং তার মাথা আনত হয়ে গেলো।
এ এলাকায় পীরদের পীরানীর ঘটনা ও মামলা আমার হাতে আরো কয়েকটি পড়েছিলো। আমার মনে আছে, তাদের মুরিদদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একটা পর্যায়ে এসে মুরিদের মাথা এভাবে ঝুঁকে পড়তে দেখেছি।
মমতাময়ী হাতে আমি তখন তাদের পড়ন্ত মাথাটি উঠিয়েছি এবং মুখ থেকে সে কথা বের করে এনেছি যা তাদের মাথা নত করে দিয়েছে। আদালতের বোনের তমুখী অবস্থা তাই আমার জন্য নিরর্থক বিষয় ছিলো না।
আমার কাছে কিছু লুকিয়ো না বিবি- আমি তার মাথাটি উঁচু করে নরম গলায় বললাম- আমি জানি, কোন কথাটা মুখে উচ্চরণ করতে তুমি লজ্জা পাচ্ছো। আমাকে ভাই বন্ধু যা ইচ্ছে তাই ভাবতে পারো। পুলিশ অফিসার মনে করো না। এসব কথা আমার রিপোর্টে যাবে না। আমার অন্তরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
আমি সে পর্যন্ত যেতে দেয়নি- সে ফিস ফিস করে বললো- সে আমাকে একলা নিয়ে বসেছিলো এবং আমার মাথায় হাত রেখে পুরো শরীরে হাত বুলিয়েছিলো।
পীরের কাছে বসার দুদিন আগেও নাকি তার স্বামীর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাত হয়েছিলো। সেদিন বাকি রাত সে কেঁদে কেঁদে কাটায়। তার মাথায় পেরেকের মতো একটা বিদ্ধ হতে থাকে, তুমি তোমার স্বামী ও নিঃস্পাপ সন্তানের ইযযত।
আমি পীরকে বললাম, আপনি তো গায়েবী শক্তির অধিকারী, আল্লাহর ওলী। এক মিহলার ব্যপারে আপনার এমন অপবিত্র মনোভাব থাকা উচিত নয় আদালতের বোন আমাকে বলল- আমি পীরকে এ কথাও বলেছি।
আপনার যদি দুনিয়ার প্রতি এতই লোভ থাকে তাহলে আমার কাছে পয়সা চান, অলংকার চান। আপনি আমার ইযযত নিতে চান, এতো আমার স্বামীর সংরক্ষিত ইযযত। যান আপনি তার কাছে চান।
আচ্ছা! আমাকে একটা কথা বলো তো, আমি বললাম- পীরকে মানুষ এমনভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করে যে, মহিলারা নিজেদের ইযযত ন্যরানা দেয়াটাও পাপ মনে করে না। তাহলে তোমার মনে কি করে আসলো যে, পীরের চেয়ে তোমার স্বামীই অনেক ভালো?
আপনি ভালো মন্দের কথা বলছেন- সে বললো- আমার তো একটা কথা বুঝে আসে না। যিনিই পীর হবেন তার সম্পর্ক সবসময় আল্লাহর সঙ্গে থাকবে। খোদার নিকটজন হলো পীরেরা।
যদি একথা ঠিক হয়ে থাকে তাহলে নারীদের প্রতি পীরদের অবৈধ দৃষ্টি কিভাবে পড়ে? অন্য কেউ নারীদের ওপর নজর দিলে সবাই তাকে বদ চরিত্র বলে; কিন্তু পীরের বেলায় কেন তা সচ্চরিত্র হয়ে যায়?
গ্রাম্য নিরক্ষর এক মেয়ে, শিক্ষার কোন শব্দ ছিলো না তার কাছে। এজন্য সে গুছিয়ে বলতে পারছিলো না যে, পীরকে কেন সে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার সাফ কথা হলো, তার ভেতর থেকে এক আওয়াজ আসে, এ লোক কমপক্ষে এ মুহূর্তে ওয়ালি জাতীয় কোন কিছু না; যৌন লিপসায় আক্রান্ত এক ব্যক্তি।
পীরকে সে আর কিছু বললো না। কামরা থেকে বের হয়ে এলো।
এবার আমার ভাইকে বলতে চেয়েছিলাম- সে বললো- কিন্তু আমার ভাই, ভাবী ও আমার মার ওপর পীরের জাদু বিদ্যা এমনভাবে চেপে বসেছিলো যে, তারা আল্লাহ ও রাসূলকেও ভুলে গিয়েছিলো। পীর গুপ্তধনের কথা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে পাগল করে দিয়েছিলো। যদি নালিশ করতাম, পীর বদকার লোক, ভাই আমাকে মেরেই ফেলতো।
অন্যরা আমাকে অভিশাপ দিতো, পীরের কৃপা দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছি। আমি তাই মুখ বুঝে দেখতে থাকলাম কি হয় না হয়। তারপর তো দুধ থেকে পানি পৃথকই হয়ে গেলো।
***
আদালতের বোনটিকে এক কথায় সুন্দরী বলা যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার কাছে মনে হলো, এই মেয়ের ভেতর আল্লাহর গায়েবী নূর আছে। যার কদীপ্তিত্তে তার চোখে মুখে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার কথাগুলো আমার গভীরে গেঁথে যাচ্ছিলো।
তোমার ভাই আদালত বলেছে, তার স্ত্রী পীরের খেদমতের জন্য রতে পীরের সঙ্গে থাকতো- আমি বললাম- এ ব্যাপারে তুমি কিছু বলতে পারো?…… তোমাকে আরেকবার বলছি, তুমি আমাকে যা বলবে তা আমার অন্তরেই থাকবে। এটাও শুনে রেখো, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে। তার পাঁচশ টাকারও বেশি মেরে দিয়েছে।
এক হাজার টাকারও বেশি জনাব; সে বললো- ভাইকে সবচেয়ে বড় থোকা তো দেয় সে। ভাবী তাজকে পীরকে নিজের সঙ্গে রাখতে দেয় ভাই পীরের কথায় থোকায় পড়ে। আপনাকে আমি আর কি বলবো? এক মেয়ে আরেক মেয়ের মুখ দেখেই তার মনের কথা পড়ে নিতে পারে।
তুমি তাকে বাধা দিলে না?
সে তো আমাকে এমনিই ভালো চোখে দেখে না- সে বললো- এ ধরনের কিছু আমি তাকে বলতে গেলে ঘর থেকেই বের করে দিতো আমাকে সে।
একটা কথা আমাকে ভেবে চিন্তে বলো তো- আমি বললাম- তোমার ভাইয়েরা যে বলে পীর জানালা পথে পালিয়েছে, তোমার কাছে কি সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
এ ব্যাপারে মোটেও ভাবিনি আমি। ঐ কাফের ভণ্ড ধরা পড়েছে। তাকে আচ্ছামতো শায়েস্তা করা হচ্ছে–এই আনন্দেই তো ডুবেছিলাম আমি।
তাজও কি খুশি ছিলো? প্রশ্নটি মাথায় আচমকা আসলো।
তার অবস্থা তো প্রায় মরে যাওয়ার মতো হলো- সে জবাব দিলো- চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো, শুধু ঐ ভণ্ডকেই নয় তাকেও তার সঙ্গে পাকড়াও করা হয়েছে। তবে খুশি হয়েছিল ভাইজান।
আদালতের বোনকে বিদায় করে দিলাম। এলাকার চৌকিদারকে ডাকলাম। চৌকিদার এই বংশেরই লোক। এজন্য আমি আশাও করিনি সে এদের বিরুদ্ধে কিছু বলবে। চৌকিদার নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক কিছুই বললো। ফাঁকে ফাঁকে দু চারটা মিথ্যাও বললো। বুঝতে পারলাম সেও পীরের জাদুতে আক্রান্ত হয়েছিলো।
আজ হোক কাল হোক আমাকে একটা কথা বলতে হবে তোমার- কঠিন সুরে বললাম চৌকিদারকে আসামী যখন এ গ্রামে পীর হয়ে আসে অন্য গ্রামের লোকেরাও প্রতিদিন এখানে আসা যাওয়া করতো। তুমি কি তাদের মধ্যে পেশাদার অপরাধীদের দেখেছো? যারা আসামীর সঙ্গে বা তার লোকের সঙ্গে কথা বলছিলো বা বসেছিলো?
সে চিন্তায় পড়ে গেলো। কোন উত্তর দিতে পারলো না। তাকে আমি বললাম, ভালো করে মনে করে দেখো। দরকার হলে গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করে আমাকে জানাবে।
অর্ধ রাত হয়ে গিয়েছিলো। আমি শুয়ে পড়লাম।
***
খুব সকালেই আদালতের স্ত্রী তাজকে ডাকলাম। আমি তার ভীত অবস্থা দূর করার চেষ্টা করলাম না। নিশ্চিত ছিলাম, আসামীর সঙ্গে এ রাত কাটিয়েছে এবং সে পবিত্র মেয়ে নয়। এরপরও সে আসামীকে সত্য পীর মনে করে।
তোমাকে একটি কথা বলে দিচ্ছি তাজ!- গম্ভীর কণ্ঠে বললাম- তুমি আমার কাছে কিছুই লুকোতে পারবে না। ঐ পীর অনেক বড় অপরাধী আর শয়তান ছিলো। আর আমি সব অপরাধীর পীর। সবচেয়ে বেশি থোকা দিয়েছে সে তোমাকে। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে।……….
তোমার গোপন কথা আমার ভেতর গোপন থাকবে। তোমার স্বামী তোমাকে পবিত্র মনে করে। আমি ওকে একথাই বলবো যে, তুমি পবিত্র। কিন্তু আমার কাছে মিথ্যা বলবে না। তোমার বিরুদ্ধে আমি কিছুই করবো না। কিন্তু আমাকে উল্টো বুঝানোর চেষ্টা করলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার মুখের বর্ণের নানা ধরনের রূপান্তর ঘটলো। তারপর তার মাথা নুয়ে পড়লো। না, অভিযোগ ও তিরষ্কারের ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম না। তবে তার ভয়ও দূর করলাম না। যাতে সে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে না পায়।
হ্যাঁ, এবার সে ভেঙ্গে পড়লো। চোখ ভরে পানি এলো। আমার কথার সুর ধীরে ধীরে মমতার সুরে রূপান্তর করতে লাগলাম।
আমার শুধু একটি কথা শুনুন- কান্নাভারী গলায় মিনতি করলো।
শুধু একটা নয়, তোমার সব কথা শুনবো। তুমি তো আসামী নয়। তোমার সামান্য অপরাধ থাকলেও আমি এর ওপর পর্দা চড়িয়ে দেবো।
হ্যাঁ, আমি এটাই বলতে চাচ্ছিলাম যে, আমার সব কথা আমানত হিসেবে গোপন রাখবেন। আমি ধোকায় পড়ে গিয়েছিলাম। একটা ছিলো সন্তানের লোভ, আরেকটা ছিলো খানার প্রলোভন। আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো এ দুটো।
নকল পীরকে আমি সত্য পীর বলে মনে করলাম এবং আমাকে সে যে খেদমতের কথাই বললো, আমি বিনা বাক্যে করে দিলাম। হায় আমার স্বামী যদি এটা জানতে পারে আমাকে জীবিত রাখবে না। আর যদি আমার প্রতি দয়া করে তাহলে তালাক দিয়ে দেবে।
আমি ওয়াদা করেছি আগেই, সব আমার ভেতর গোপন থাকবে, বরং আমার মনে সব দাফন হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পীরকে ঘরেরই কেউ না কেউ পালাতে সাহায্য করেছে। সেটা কে হতে পারে?……. তোমাদের নওকর কেমন?
নওকরের এত সাহস নেই- তাজ জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- আপনার কার প্রতি সন্দেহ হয়?
সন্দেহ নয়, আমি নিশ্চিত, আসামীকে ফেরার করানো হয়েছে, ……. তোমার ননদ সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? পীরের সঙ্গে কি ওর সখ্যতা হয়েছিলো?…..
আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে মাথায় এটা রেখে নাও। এ ব্যাপারে আমি আরো অসংখ্য নারী পুরুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। আমি সব জেনে নেবো। তারপর আসামী পাকড়াও করা হবে। তখন কিন্তু সব স্বীকার করবে। আর তোমার কোন কথা মিথ্যা প্রমাণিত হলে বড় বেইযযতী হবে তোমার। এখনও সময় আছে, সত্য বলে দাও আমাকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বললাম আমি।
আপনি যা চাইবেন আমি তা দেবো….. শুধু বলুন, যদি এটা জানা যায় তাহলে কি তাকে আপনি গ্রেপ্তার করবেন? ভয় ও আশার মিশ্রিত সুর তার কণ্ঠে।
না, যে ফেরার করেছে সে নিজের ঘর থেকে ফেরার করিয়েছে। তাই তার জন্য এটা অপরাধ নয়। কারণ এ ঘর বা বাড়ি থানার জেলখানা নয়। জেলখানা থেকে পালানো এবং পালাতে সাহায্য করা অনেক বড় অপরাধ।……
তবে আসামীকে গ্রেফতার করার পর যদি সে জানিয়ে দেয় এ বাড়ির অমুকে তাকে পালাতে সাহায্য করেছে তাহলে তাকে এ সন্দেহে গ্রেফতার করা হবে যে, পীরের ধোকাবাজি ও বদমায়েশী কাজে এও জড়িত। তোমার কথায় মনে হচ্ছে, তুমি কিছু একটা বলতে চাও। কিন্তু ভয় পাচ্ছো, তোমার ভেতর যে কথাটা গুমরে মরছে সেটা খোলাসা করো। আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই নেবো না।
তখন তো আমি ভরা যৌবনের যুবক। লোকে আমাকে সুপুরুষও বলতো। তাজ আমার কথা শুনে আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালো আমি এর অর্থ না বোঝার মতো বোকা ছিলাম না।
আমার যৌবনকে সে আমার দূর্বলতা মনে করতে লাগলো, এমনকি আমার একটি হাত সে গাঢ়ভাবে চেপে ধরলো। আমি হাত সরালাম না। তার চোখ আমার অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠলো। বুঝলাম, বেচারী বড় অসহায় বোধ করছে। আমারও একটি হাত তখন তার হাতের ওপর মৃদুভাবে রাখলাম।
তাজ! তার চোখে চোখ রেখে বললাম- আমি নকল পীরও নয়, ধোকাবাজও নয়। আমি সম্মানিত এক ব্যক্তি। সম্মান প্রাপ্যকে আমি সম্মান করি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো। তোমার মনের কথা নিঃসন্দেহে বলে যাও।
তাকে আমিই ঘরে থেকে বের করেছি- তাজ খুব চাপা গলায় বললো।
কেন?
আপনার হাতে আমার ইযযত- সে বললো- আপনি তো জানেন, তার সঙ্গে আমি রাত কাটিয়েছি। এও জানেন, কিসের লোভে কিসের আশায় আমি আমার ইযযত দিয়েছি
তারপর যখন তাকে এক গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এলো, তখন আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাকে মারপিট করে পুলিশের কাছে হাওলা করা হবে তখন তো সে বলবে, তোমরা কোথাকার এত ভদ্রলোক হলে? তোমাদের ঘরের অমুক মেয়ে রাতে আমার কাছে আসতো। আসলে আমার স্বামী আদালতকে ভীষণ ভয় পাই আমি।
তোমার স্বামী মান ইযযত আর ভদ্রলোকি তখন কোথায় গিয়েছিলো যখন তোমাকে সেই ভণ্ডপীরের কাছে এক বদ্ধ কামরায় পাঠিয়েছিলো?
কিন্তু দোষ তো সব মেয়েদের মুখে মলে দেয়া হয়। আমার স্বামী না বললে আমি হয়তো এ কাজ করতাম না।
আমি তোমার স্বামীর মতো কাপুরুষ নই। তোমার ইযযত নিয়ে খেলতে দেবো না কাউকে- গলাটা কিছুটা আবেগী হয়ে গেলো আমার।
আমি সারা জীবন আপনার অনুগ্রহ শোধ করতে পারবো না- তাজ ধরা গলায় বললো- আমি আমার ইযযত বাঁচানোর জন্যই একাজ করেছি। ওরা তো পীরকে ঐ কুঠরীতে বন্দী করে রাখলো। আমি মাঝ রাতে উঠলাম। আমার স্বামী গভীর ঘুমে অচেতন। আমার শাশুড়ী ও ননদ অন্য আরেক কামরায় ঘুমিয়ে। আমার জানা ছিলো, অনেক বড় ঝুঁকি নিচ্ছি আমি। ধরা পড়লে চৌধুরী আমাকে কতল করে দেবে। কিন্তু আমার ওপর কি যেন ভর করেছিলো। চোরের মতো খালি পায়ে প্রথমে দেউরীর প্রধান দরজার কাছে গেলোম এবং দেউরীর শিকল। আলগা করে দিলাম………
তারপর আমি ঐ কামরার দরজা খুললাম যার সঙ্গে কুঠুরী আছে। কুঠুরীর বাইরে কোন দরজা নেই। বড় কামরা ও কুঠুরীর মাঝখানে শুধু একটি দরজাই আছে। আমি ভেতরে গেলাম। ঘোর অন্ধকারে নিঃশব্দ পায়ে মাঝখানের দরজায় গিয়ে দরজার শিকল খুললাম। আমি ওকে আওয়াজ দিলাম। সে আমার কাছে ছুটে এলো। তাকে বললাম, দেউরীর দরজার শিকল খুলে এসেছি। কোন শব্দ না করে বেরিয়ে পড়ো……..
সে কৃতজ্ঞতায় কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমি বেঁচে থাকলে তোমার ঐই ঋণ আমি শোধ করবো।
আমি বললাম, তুমি শুধু এতটুকু করো আমার জন্য যে, কখনো ধরা পড়লে আমার নামে বদনাম দিয়ো না। তোমার মুখ থেকে যেন এ শব্দ বের না হয় যে, তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক আছে। সে বললো, সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব আমি। তোমার দুর্নাম হতে দেবো না আমি,
সে চলে গেলো। আমার কাছে মনে হলো, দম আটকে আমি মারা যাবো। ভয়ে আমার পা জমে গিয়েছিলো। আমি কুঠরীর সঙ্গের দরজা খুলে সে কামরার জানালাটি খুলে দিলাম। তারপর অন্য কামরায় গিয়ে দরজার শিকল তুলে দিলাম। তারপর বাইরে এসে বড় কামরার দরজাও লাগিয়ে দিলাম। এরপর কোন ক্রমে দেউরীর দরজা বন্ধ করে দিলাম। যখন আমি আমার খাটে ফিরে এলাম তখন দু চোখ জুড়ে শান্তির ঘুম নেমে এলো। কিন্তু আমি কেঁদে ফেললাম……
সকালে সর্বপ্রথম চৌধুরী বললো, কাফেরটা পালিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে গেলাম। বললাম, কোন জায়গা দিয়ে পালিয়েছে। খাটের নিচে বা এদিক ওদিক দেখো। কোথাও লুকিয়ে আছে হয়তো। ওদিক থেকে ক্যপ্টেন সাহেবও এসে গেলেন। তিনি যখন দেখলেন, জানালার পাট খোলা তখন ঘোষণা করলেন, এই জানালা খুলে পালিয়েছে।……….
খোদা আমার স্বামী ও কাপ্তান সাহেবের চোখে এমন পর্দা ফেলে দিলেন যে, তার মনে এই খেয়ালই এলো না যে, ঐ দিকের দরজা সকালে খোলা ছিলো, না বন্ধ ছিলো….. আমি স্বস্তি পেলাম যে, আমার সব গোপনীয়তা ঐ লোকের সঙ্গে চলে গিয়েছে। কিন্তু এখন আমার ইযযত আপনার হাতে।
চিন্তা করো না তাজ!- অভয় দিলাম আমি।
আপনি কি আমার একটি অনুরোধ রাখবেন? তাকে আপনি গ্রেপ্তার করবেন না। আল্লাহ তাআলা তো তাকে অবশ্যই শাস্তি দেবেন। সে যদি ধরা পড়ে আমার দুর্নাম করে ছাড়বে।
সে কত জনের দুর্নাম করবে? এ ধরনের পীর তাদের জাদুর ভেল্কি সেসব ঘরে চালায় যে ঘরে পয়সা আছে বা সুন্দরী মেয়ে আছে। জানি না এ পর্যন্ত কতজনকে সে নাপাক করেছে। তোমার সঙ্গে তো ওর শত্রুতা ছিলো না….. সে ধরা পড়লে কি পড়লো না- এটা তোমার ভাবনার বিষয় নয়। তবে আমি তোমার দুর্নাম হতে দেবো না।
***
আমার একটা সন্দেহ তো ঠিক হলো। পীরকে ফেরার করা হয়েছে। আমার মনে সন্দেহ আরেকটা জাগলো, তাজ হয়তো আগ থেকেই জানতো, আসামী নকল পীর। তার যৌন ক্ষুধা মেটানোর জন্য সে এই নাটকের ব্যবস্থা করেছে। আমি এ সন্দেহটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। কিন্তু এ সন্দেহের কোন সন্তোষজনক ভিত্তি না পেয়ে মন থেকে তা তাড়িয়ে দিলাম।
সেদিনও আমি গ্রামে কাটালাম। আরো যেসব ঘরে পীর হানা দিয়েছিলো তাদের কাহিনী শোনলাম। কাহিনী একেকটার চেয়ে একেকটা চমপ্রমদ। সেটা অন্য আরেক সময় বলবো।
রাতে থানায় চলে এলাম।
পরদিন চৌকিদার থেকে জানতে পারলাম, পীর সাত আটটি গ্রামে তার পীরগিরি খাঁটিয়েছে। প্রত্যেক গ্রামের তিন চার বাড়িতে হানা দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, এসব বাড়ি থেকে দুএকজন সদস্য ফৌজে যোগ দিয়েছে।
আমার এখন জানার ছিলো, এসব এলাকার গুণ্ডা বদমায়েশরা কি পীরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো কিনা। এ ধরনের কোন ইংগিত পাচ্ছিলাম না। অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠছিলো এই মামলা। এলাকার রেজিষ্টার্ড গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। কিন্তু জানা গেলো না কিছুই।
এসময় চৌকিদার এমন কয়েকজনকে ধরে নিয়ে এলো, যারা পীরের প্রতারণা সম্পর্কে এক একটি কাহিনী শুনিয়ে গেলো। আরো অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছে ঠিক; কিন্তু লজ্জার কারণে তারা থানায় আসছে না।
এসব শুনতে শুনতে বিরক্তি এসে গেলো আমার। চৌকিদারকে বলে দিলাম, প্রতারণার শিকার হয়েছে এ ধরনের কোন বেকুবকে আর থানায় আনবে না। কেউ পীরের কোন খোঁজ দিতে পারলে তাকে নিয়ে এসো।
তখনকার পুলিশি গোয়েন্দা মাধ্যম এত তৎপর ছিলো যে, মাটির নিচের ভেদও গোয়েন্দা চোখে পর্যবেক্ষণ করতো। আর তখন আজকের মতো অপরাধমূলক কাজ এত বেশি সংঘটিত হতো না। এ কারণে গুপ্তচরা বৃত্তির কাজ শান্ত মাথায় করা যেতো। তাছাড়া হুকুমত ছিলে ইংরেজদের। ইংরেজরা পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলা সহ্য করতে পারতো না।
তারপরও আসামী ও তার সঙ্গীদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমার মনে হলো আসামী অনেক দূরের কোন এলাকার। আমার কাছে শুধু একটাই আলামত আছে, আসামীর এক চোখ নষ্ট। সে তার বেশ-ভূষা যতই পরিবর্তন করুক, নষ্ট চোখ বদলাতে পারবে না। ঠিক করলাম, এই কেসকে লাপাত্তা রিপোর্ট করে খতম করে দেবো।
ক্যাপ্টেনের ছুটি শেষ হওয়ায় একদিন আগে তিনি থানায় এলেন। এর আগে আরো দুবার এসে জানতে চেয়েছিলেন, আসামীর খোঁজ পাওয়া গেছে কিনা। কিন্তু এবার এলো জবাবদিহি তলব করতে।
এখনো কেন আসামীকে খুঁজে পাওয়া গেলো না? ক্যপ্টেন জানতে চাইলেন।
এ ধরনের আসামীদের খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়- সৌজন্যতা দেখিয়ে বললাম।
তাহলে আপনারা বেতন নেন কি দিয়ে? খোঁজ পাওয়া সহজ নয় কেন? ফৌজি দাপট দেখিয়ে বললেন কাপ্তান।
এজন্য সহজ নয় যে, এ ধরনের আসামীকে আপনারা নিজ ঘরে রেখে খোদাকে ভুলে তাদের ইবাদত করেন- শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বললাম- তাদেরকে খুশি করার জন্য নিজেদের মা বোনদের তাদের কাছে বসিয়ে রাখেন। তারপর লজ্জার মুখে পুলিশের কাছে আসল কথা এড়িয়ে যান। আপনি কি আপনার ভাইয়ের ঘরে খোঁজ নিয়েছেন, ঐ পীরকে কে ঘর থেকে ফেরার করেছে?
তার ফৌজি দাপট- দম্ভ এক নিমিষেই উড়ে গেলো। তারপরও যখন তার ভাঙ্গা অহংকার নিয়ে আবার ফুঁসে উঠতে চাইলো আমি আরেকটি অস্ত্র ব্যবহার করলাম।
আপনারা সবাই এই অপরাধীদের সঙ্গে ছিলেন- আমি বললাম- হিন্দু মালাউনদের মতো যাকেই দেখেন মনে করেন তার কাছে বুঝি গায়েবি শক্তি আছে। তাকে নবীর মতো মানতে শুরু করেন।
কাপ্তানের ঘাড় বাকা করে দিয়েছি ঠিক। কিন্তু এ কেসকে লাপাত্তা হিসেবে মুলতবি করার জন্যও মজবুত ও উপযুক্ত কারণ হাজির করতে হবে। এটা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিলো।
***
এক মাস হয়ে গেলো। থানায় প্রতিদিন আরো কত মামলা আসে। ধীরে ধীরে পীরের বিষয়ে আমার আগ্রহ কমে গেলো।
একটা ব্যাপারে আমি খুব বিস্মিত হলাম যে, বড় বড় ডাকাত সন্ত্রাসীরা যেভাবে পরস্পরে বিভিন্ন এলাকা বন্টন করে নেয়, তেমনিভাবে পীরদের হালকা বা গ্রুপও বিভিন্ন গ্রামে শহরে ভাগ ভাগ হয়ে যদি কায়েম করতো।
নিজের এলাকাকে পীরেরা বলতো ওলায়েত। এক পীর আরেক পীরের ওলায়েতে বা অধীনে যেতো না।
আমি হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম, এক ভণ্ড পীর যখন কোন এলাকায় এভাবে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায় অন্য পীরেরা তার বিরুদ্ধে কিছুই বলে না।
আমাকে জানো হয়েছিলো, আসামী যে গ্রামে গিয়েছিলো সে গ্রামের কাছে বড় কোন পীর নেই। তবে ছোট ছোট শাহ্ আছে।
দশ বার দিন পর আমার এলাকার এক গ্রামে একটি পারিবারিক লড়াই ঝগড়া হলো। দুজন খুব বেশি যখমী ছিলো। আর তিন চারজন মামুলি যখমী ছিলো। উভয় পক্ষই নিকটাত্মীয়। দুপক্ষই থানায় এসে মামলা করলো।
এসব ক্ষেত্রে থানাদাররা উভয় পক্ষের মধ্যে রাজিনামা করে দেয়। এদেরকেও সেভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। পরস্পরের বিরুদ্ধে এরা মামলা করবেই।
আমি যখমীদেরকে হাসপাতাল পাঠিয়ে দিলাম। সেখান থেকে ডাক্তারি রিপোর্টও তলব করলাম।
এরা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর আবার ওদেরকে বোঝালাম। তাদের ক্রোধ তখনো ঠাণ্ডা হয়নি। তারা আগের মতেই অটল রইলো। আমি তাদেরকে বললাম, একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে ঘরের মেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় থাকতে হবে।
ঝগড়া ছিলো পারিবারিক। এক মেয়ের বাচ্চা হচ্ছে না বলে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে সব সময় যন্ত্রণা দিতো। মেয়ে তার ভাইকে সব বলে দেয়। ভাই বোনের স্বামীর ওপর চড়াও হয়। এভাবে উভয় পক্ষ লাঠি বল্লম নিয়ে হামলে পড়ে নিজেদের ওপরেই।
তাদেরকে জানিয়ে দিলাম, যে মেয়েকে নিয়ে ঝগড়া সে মেয়ে, তার মা ও শাশুড়ীকে থানায় হাজির করতে হবে। তাদেরকে জেরা করতে হবে।
এ ধরনের মামলা আমাদের জন্য কোন মামলাই নয়। আমাদের এলাকায় এসব কেসের হিড়িক বলা যায়।
ভোজন রসিক থানাদাররা এসব কেস পেলে খুশিই হয়। কারণ উভয় পক্ষই খায় খাতিরও করে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে। কিন্তু আমি এ বিষয়টা মামলার রূপ দিতে চাইনি। মেয়েদের থানায় ডাকাও একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
কিন্তু আমার জানার ছিলো না, এ কেস আমার আরেক অতি গুরুত্বপূর্ণ কেসের জটবদ্ধতা খুলে দেবে।
সন্ধ্যার দিকে মেয়েদেরকে থানায় আনা হলো। ইচ্ছে করেই ওদেরকে অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। যাতে থানায় মামলা করার ঝামেলা বুঝতে পারে।
রাত আটটার দিকে প্রথমেই ডাকলাম ঐ মেয়েকে, যাকে নিয়ে এই ঝগড়ার সূত্রপাত। মেয়ের নাম পারভীন। অতি সুন্দরী না হলেও দৈহিক গঠন তার চমৎকার।
এই লড়াইয়ের কারণ কি পারভীন! আমি অলস গলায় জিজ্ঞেস করলাম তোমার শ্বশুর এতই যন্ত্রণা দেয় তোমাকে যে, রক্ত ঝরার ঘটনা ঘটে গেলো?
না জনাব! পারভীন বললো- শ্বশুর নয়, শাশুড়ী, পুত্রবধূকে অযথাই বিরক্ত করে। আমার সতের বছরের সময় বিয়ে হয়েছে। পাঁচ বছর হয়ে গেলো সন্তানের মুখ দেখিনি এখনো।
স্বামীর কোন রোগ টোগ?
না না। এটা ভাগ্যের দোষ। স্বামীর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। সবদিক থেকেই আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট। এক বছল ধরে পীর ফকিরদের কাছে আমার মা শাশুড়িরা দৌড়ঝাঁপ করছে। আমাকে মাজার ও কবরস্থানের মাটি খাওয়াচ্ছে ….
আমাদের গ্রামের কাছে এক শাহ থাকেন। প্রথম তো ঐ শাহ মামুলি কিছু ঝাড়ফুক করতো। সাপ বিচ্ছুতে কাটলে চিকিৎসা করতেন। রোগ ব্যথায় দম করতেন, তাবিজ দিতেন। কয়েক মাসের মধ্যে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো। তখনই তার কব্জায় জিন এসে গেলো। তারপর এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, তার দম ও তাবিজে ত্রিশোর্ধ সন্তানহীন মেয়েরাও সন্তান লাভ করে…..
ঐ শাহকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লাগেনি। কারণ জানি না। তিন মাস আগে আমার শাশুড়ি শাহের কাছে নিয়ে গেলো আমাকে। তাকে এক টাকা নজরানা দিয়ে বললো এর বাচ্চা হয় না।
শাহ দুহাতে আমার চেহারা ঝাপটে ধরে তার মুখের কাছে নিয়ে গেলেন। তার মুখ থেকে এমন পঁচা দুর্গন্ধ এলো যে, আমার মাথা ঘুরে উঠলো…….
সেদিন শাহ-এর চেয়ে বেশি আর কিছুই করলেন না। একটি তাবিজ দিয়ে বললেন, পানিতে মিলিয়ে খাবে। আর দুদিন পর আসবে। …..
তিন দিন পর শাশুড়ি আমাকে শাহের কাছে নিয়ে গেলো। আশ্চর্য, প্রথম দেখায় শাহকে যেমন খারাপ লেগেছিলো আজ ভালো লাগতে শুরু করলো। সন্তানের তীব্র বাসনা তো আমার ছিলো। এজন্য শাহের তাবিজ স্বপ্ন জাগিয়ে দিলো যে, আল্লাহ এর বরকতে আমাকে সন্তান দেবে……..
এবার শাহ আমার চেহারা ধরে আমার চোখে ফুক দিয়ে বললেন, এই মেয়ের ওপর এক ছায়া ঘুরছে। এবার দুটি তাবিজ দিলেন, একটা গলায় ঝুলানোর জন্য আরেকটা পান করার জন্য।
***
এত কাঁচা বয়সেও পারভীনের কথায় দারুন আস্থা ছিলো। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, মনে অসত্য, অপবিত্র কোন প্রবণতা না থাকলে, নির্মল আর পবিত্রতায় সজীবতা থাকলে আস্থা ও দৃঢ়তা জেগে উঠে এমনিই।
পারভীনের মধ্যেও দৃঢ়তার এই উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সে কথা বলছিলো অসংকোচে। তার বর্ণনা ছিলো দীর্ঘ। পুলিশ অফিসারের এত দীর্ঘ বয়ান শোনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি আগ্রহ নিয়ে শুনেছি তার কথা। যদিও এখানে এত লম্বা কথার প্রয়োজন নেই।
ওর স্বামী শাহকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মানতো। ওকে সবসময় শাহের কাছে যাওয়ার জন্য তাগিদ করতে থাকে। প্রথমে প্রথমে শাহের কাছে পারভীনকে নিয়ে যেতো শাশুড়ি। কিন্তু শাহের বলার পর পারভীন একাই যেতো। শাহ তার ওপর নানান আমল করতো।
এক মাসেরও অধিক হয়ে গেলো এভাবে। এমনিতেই শাহ হাসিখুশি মানুষ ছিলো। পারভীনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক সহজ হয়ে গেলো। একদিন পারভীন শাহকে জিজ্ঞেস করলো,
তার আশা কবে পূরণ হবে?
আমি তোমাকে পরিস্কার বলে দিচ্ছি- শাহ উত্তরে বললো- তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। এজন্য তোমাকে আমি ধোকার মধ্যে রাখতে চাই না। এমন কোন পীর নেই, যে ঝারফুক আর তাবিজ দিয়ে সন্তান দিতে পারে। এমন খোদায়ী কারবার কারোই নেই।
তোমার স্বামী তোমাকে দৈহিক আনন্দ দিতে পারে ঠিক, কিন্তু বাচ্চা দিতে পারবে না। আর বাচ্চা না হলে তোমার শাশুড়ি তোমাকে তালাক দেয়াবে। সন্তান না হওয়ার অপরাধ মেয়েদেরই হয়ে থাকে……..
পুরুষ কখনো মানতে চাইবে না তার মধ্যে কোন দোষ আছে। আর তোমাকে তালাক দিলে কেউ বিয়েও করবে না তোমাকে। বয়স দেখো তোমার। সেই কচি যৌবনও তো নেই তোমার।
শাহজী! পারভীন বললো- আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। অথচ আপনি আমার পীর ও উস্তাদ। বিশেষ কিছু কি বলতে চাচ্ছেন?
হ্যাঁ পারভীন! শাহ বললো- কিছুই বলতে চাই। সেটা হলো, আমি তোমাকে সন্তান দেবো। সে সন্তান হবে আমার। তোমার স্বামী একে নিজের সন্তান মনে করবে।
পারভীনের হৃদয়টা ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে কাটা হয়ে গেলো। সব স্বপ্ন রক্তাক্ত হয়ে গেলো। শাহের প্রতি ঘৃণায় ভরে উঠলো তার মন।
আমার স্বামীর আমানতের খেয়ানত করতে পারবো না কখনো- পারভীন ঘৃণায় উছলে উঠা কণ্ঠে বললো।
যে মেয়েরা বলে, অমুক পীরের তাবিজ তাকে বাচ্চা দিয়েছে মনে রেখো, সেটা পীরের ঔরষের বাচ্চা! শাহ বললো।
বিষ খেয়ে মরে যাবো আমি তবুও আমার দেহ নাপাক হতে দিব না।
আমার কথা না মানলে তোমার স্বামী ও শাশুড়িকে বলব, কোন গায়েবী পীরের বদ দুআ আছে এই মেয়ের ওপর। এজন্য পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
পাবীনের আত্মসম্মান বোধ জেগে উঠলো। সে ঘরে ফিরে এলো। এরপর শাহের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।
তার স্বামী ও শাশুড়ি নিয়মিতই আসা যাওয়া করতে শাহের কাছে। পারভীনকে যাওয়ার জন্য দুজন চাপও দিতো। কিন্তু পারভীন পীরের আসল রূপ এ কারণে প্রকাশ করতে চাইতো না যে, তারা কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। সে এমনিই মুখ বুজে চুপ করে রইলো।
এর ফলে তারা নানান অপবাদ কুৎসা রটাতে লাগলো তার নামে। তালাক দেয়ার হুমকিও দিলো। স্বামীও জোর জবস্তি শুরু করে দিলো।
একদিন পারভীন তার স্বামীকে পীরের আসল রূপের কথা জানিয়ে দিলো। প্রতি উত্তরে পারভীন স্বামীর হাতের প্রচণ্ড একটি চড় খেলো।
বললো, শাহজী ঠিকই বলেন, এই মেয়ের ওপর বদ দুআ আছে। স্বামী হুকুম দিলো আজই শাহের কাছে যেতে হবে।
পারভীনের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো। সে পাগলের মতো হয়ে গলো। সিদ্ধান্ত নিলো, আজ রাতেই শাহের কাছে গিয়ে বলবে, তার পেটে বাচ্চা জন্ম দিতে।
স্বামীকে জানলো, সে রাতে শাহের কাছে যাবে। স্বামী জিজ্ঞেস করলো, রাতে কেন? দিনে যাও।
পারভীন বললো, এখন আমার ওপর যে আমল করবে সেটা রাতেই করতে হবে। দিনে কোন কাজ করবে না।
স্বামী সানন্দে তাকে অনুমতি দিয়ে দিলো।
***
শাহের বাড়ি বা আস্তানা বেশি দুরে ছিলো না- পারভীন আমাকে শোনাচ্ছিলো- কাঁদতে কাঁদতে আমি যাচ্ছিলাম। না, তালাকের ভয়ে শাহের খাহেশ পূরণ করতে নয়, আমার মনের প্রতিশোধের আগুন নেভাতে। আমার স্বামী যদি তার স্ত্রীর সতীত্বের পরিবর্তে সন্তান চায় আমি সন্তান দেবো।
যদি নিজ ইচ্ছায় এই পাপ করতে যেতাম তাহলে এমন কারো কাছে যেতাম যাকে আমার পছন্দ হবে। শাহ বদকার এক লোক- এটা তো আমার স্বামী মানতেই চাচ্ছিলো না…….
তাকে আমি বলেছিলাম, আমরা একে অপরকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। সন্তান হয় না, এতে আমার বা তোমার কোন দোষ নয়। এটা আল্লাহর ইচ্ছা। আমি স্বামীকে বলেছিলাম, যে পুরুষ বাপ হতে না পারে তার মধ্যে পৌরুষের সম্মান থাকে না……
শাহের আস্তানার কাছে গিয়ে আমার পা আটকে গেলো। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম আমি। অশ্রুতে ভরে গেলো আমার চোখ দুটি। ফরিয়াদ। বের হয়ে এলো আমার মুখ থেকে
হে নীল আকাশের মালিক! আমার ভাগ্যে তুমি এ কি লিখে রেখেলে? তোমার গুনাহগার বান্দি কি করছে? ক্ষমা করো গো খোদা! জানো, আমি কেমন বাধ্য হয়ে এই পাপের জগতে যাচ্ছি…
বলতে বলতে শাহের দরজায় গিয়ে পৌঁছলাম। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিলো, আস্তে আস্তে দুবার টোকা দিলাম। দরজা খুলে গেলো।
কে? এসময় কি নিতে এসেছো?- শাহের রাগত স্বর।
শাহজী! আমি এসেছি- আমি বললাম।
আমি জানতাম তুমি অবশ্যই আসবে- আমাকে দেখে শাহ বেশ খুশি হলো।
সে আমার হাত ধরে ভেতরে গেলো এবং উঁচু আওয়াজে বললো, আমারই এক বান্দা। ভেতরে একটি খোলা কামরা থেকে আগুন বাতির আলো আসছিলো। শাহ আমাকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে বললো, তোমাকে একটি কামরায় এখন বসাবো। সেখানে একটু অপেক্ষা করতে হবে ……
শাহ বাইরের দরজার শিকল চড়াচ্ছিলো, এই ফাঁকে আমি সেই আলোকিত কামরার দিকে তাকালাম। এক লোক মাটিতে বসা ছিলো। আর এক বৃদ্ধ নাপিত আমাদের গ্রামের তার চুল কাটছিলো। প্রথমে লোকটিকে মহিলা ভেবেছিলাম। কারণ তার চুল মহিলাদের মতো লম্বা। আবার লম্বা দাড়িও আছে…..
শাহ আমাকে ভেতরের আরেকটি কামরায় নিয়ে গেলো। ম্যাচ দিয়ে আগুন বাতি জ্বালালো। কামরায় একটি খাট সাজানো ছিলো। আমাকে খাটে বসিয়ে বললো, নির্ভয়ে বসে থাকো। আমি আসছি। কামরা থেকে এই বলে বেরিয়ে গেলো।
একলা ঘরে মনে হলো, আমার নিঃশ্বাস এমনভাবে চেপে আসছে যেন আমার স্বামী কোন অন্ধকার কূপে আমাকে ফেলে দিয়েছে। একবার মনে হলো, শাহ আমাকে আমাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে এনেছে…..
আমি আরেকবার আল্লাহকে স্মরণ করলাম। কাঁদতে থাকলাম। তারপর হঠাৎ আমার আত্মার ভেতর আলো জ্বলে উঠলো। কে যেন ধাক্কিয়ে আমাকে খাট থেকে নামিয়ে দিলো। আমি বাইরে বের হয়ে এলাম। বাইরের কামরাটি তখন বন্ধ। আমি দেউরীর দরজার শিখল খুলছিলাম।
এ সময় ঐ কামরাটি খুলে গেলো। শাহ বেরিয়ে এলো। আমাকে দেখে হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাও? আমি হালকা সুরে বললাম, এই একটু আসছি, দরজা খোলা রাখবেন। শাহ আমাকে বিশ্বাস করে কাঁধ ঝাঁকালো। আমি পথে নেমে পড়লাম।
পারভীনের ভেতর যেমন খোদাতাআলা আলো জালিয়ে দিয়েছেন, আমার ভেতরও পারভীন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার মনোযোগ পারভীনের গল্পের এক জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেলো।
পারভীন! আমি জিজ্ঞেস করলাম তখনই- বলো তো, তুমি যখন দেউরী থেকে বের হচ্ছিলে এবং শাহ দরজা খুলেছিলো তখন কি ঐ লোকটিকে দেখেছিলে, নাপিত যার চুল কাটছিলো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ পারভীন মাথা ঝাঁকিয়ে বললো- জানিনা সে কে? নাপিত তখন তার চুল কেটে আপনার চুলের সমান করে দিয়েছে। নাপিত তার দাড়ি কামাচ্ছিলো। এত দিনের দাড়ি পরিষ্কার করে ফেলছিলো।
তার এক চোখ কি কোন কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিলো?
এত সুক্ষ্মভাবে দেখতে পারিনি। কেন সে কি বিশেষ কেউ ছিলো?
জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কতদিন আগের ঘটনা এটা? সে হিসাব করে বললো, এক মাসের চেয়ে তিন চারদিন বেশি হয়ে গেছে।
আমি হিসাব করে দেখলাম, ঐ ভণ্ডপীর ক্যপ্টেনের ভাই আদালতের বাড়ি থেকে তখনই পালিয়েছিলো।
এরপর আর পারভীনের কথার প্রতি মনোযোগ রাখতে পারলাম না। শুধু এতটুকু মনে আছে, পরে তার স্বামী ও শাশুড়ীকে শাহ নালিশ করলো এবং তারা পারভীনের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিলো। বাধ্য হয়ে পারভীন শাহের কথা, তার স্বামী ও শাশুড়ির শাহের প্রতি অন্ধ ভক্তির কথা জানিয়ে দিলো।
পারভীনের ভাই তখনই তার ভগ্নিপতিকে ধরলো। কথায় কথায় তাকে কাপুরুষও বলে ফেললো। আর যায় কোথায়? হাতাহাতি হয়ে গেলো এবং তা বড় ধরনের মারামারি রূপ নিলো।
যা হোক তাদের মধ্যে আমি রাজীনামা করিয়ে দিলাম। পারভীনের স্বামী অন্যদের চেয়ে বেশি যখমী হয়েছিলো। তাকে ডেকে কিছু কটু কথা বলে লজ্জা দিলাম। আর বললাম ঐ ভণ্ড শাহের আসল রূপ তোমাদেরকে দেখিয়ে ছাড়বো।
তার পরদিন আসার কথা বলে সবাইকে বিদায় করে দিলাম।
***
রাত তখন সাড়ে দশটা। আমার মাথায় ঘুরছিলো একটা কথাই, ঐ প্রতারক পীরের চুলও মেয়েদের মতো কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো এবং দীর্ঘ দাড়ি ছিলো। শাহের এক কামরায় রাতের বেলা আগুন বাতি জ্বালিয়ে চুল দাড়ি কাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো না। আর দিনটাও ছিলো পীরের পালানোর দিন।
ঐ বৃদ্ধ নাপিতের নাম জেনে নিয়েছিলাম পারভীনের কাছ থেকে। হেড কনস্টেবলসহ আরো চারজন কনস্টেবল নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হলাম। রওয়ানা দিলাম শাহের গ্রামের দিকে। এক মাসের চেয়েও অধিক সময় কেটে গেছে। তাকে যে পাওয়া যাবে না জানতাম আমি। তাছাড়া তাকে ধরার যে আলামত (একটি চোখ নষ্ট) সেটাও পারভীন দেখেনি। তারপরও আমার অন্তর থেকে আওয়াজ উঠছিলো, এই-ই লোকই সেই প্রতারক পীর।
শাহের গ্রাম বেশি দূরে নয়। সেখানে পৌঁছলে রাত জাগা কুকুর আমাদেরকে স্বাগত জানালো। আমি চৌকিদারকে ডেকে নাপিতের নাম বলে বললাম, তাকে জাগিয়ে নিয়ে এসো। আমাদের পেছন পেছন ততক্ষণে মারপিট ওয়ালা মামলাকারী দলও গ্রামে পৌঁছলো।
এক বৃদ্ধ নাপিত চৌকিদারের সঙ্গে দৌড়ে এসে হাত জোর সালাম করলো আমাকে। তাকে বললাম, এক মাস আগে যে এক রাতে তুমি শাহের আস্তানায় এক লোকের চুল দাড়ি কামিয়ে ছিলে তার নাম কি?
না হুজুর! আমি তো কারো চুল…….
আমার আচমকা এক চড় বুডোর মিথ্যে কথা কেড়ে নিলো। সে একদিকে গড়িয়ে পড়লো। চৌকিদারও আমাকে খুশি করার জন্য কয়েকটি ঘা লগিয়ে বললো,
মিথ্যা কেন বলছিস অ্যাঁ?
ওকে উঠাও, আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দাও- আমি বললাম।
তাকে আমার সামনে দাঁড় করানো হলো।
প্রথমে বল্ আমার সঙ্গে মিথ্যা বললি কেন? দেখ আমি এখন কিভাবে তোর হাড় গুড়ো করি।
হুজুর! নাপিত হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো- শাহজি আমার মুরশিদ। আমি উনার বদ দুআকে ভয় পাই। আমাকে এক রুপিয়া দিয়া বলেছিলেন কাউকে বলবে না যে, আমার বাড়িতে তুমি কারো চুল কেটেছিলে। তিনি আমার ঘর থেকে আমাকে ডেকে এনেছিলেন। আমার তো অস্বীকার করার শক্তি ছিলো না।
নাপিতকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, ঐ লোকের দুচোখই সুস্থ। পরনে তার ছিলো সাদা কাপড়।
তুমি যখন তার চুল কাটছিলে তখন তার ও শাহের মধ্যে কি কথা হয়েছিলো?
বেশির ভাগ সময়ই তো সে চুপ ছিলো- বুড়ো জবাব দিলো, কথা বললেও এমন ইংগিতে বলেছিলো যে, আমি এর মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি। শাহজি তাকে বলেছিলেন, ফজরের আযানের আগে বেরিয়ে পড়বে। সে তোক বলেছিলো, বিপদ কেটে গেছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই।
তার চুল ও দাড়ি কোথায় ফেলেছিলে?
আমি সেগুলো একটি কাপড়ে জমিয়ে রেখেছিলাম, শাহজি বললেন, কাপড়টি বেঁধে আমাকে দিয়ে দাও।
বুড়ো বললো- আমি চুল শুদ্ধ পুটলিটা তাঁকে দিয়ে দিলোম। শাহজি তখন আমার কাছ থেকে কসম নিলেন। আমি যেন কখনো একথা কাউকে না বলি।
আমি আমার লোকজনসহ শাহ-এর আস্তানায় গিয়ে হাজির হলাম। চৌকিদারকে বললাম, দরজা টোকা দাও। দরজায় টোকা দেয়ার পর শাহ নিজে দরজা খুলে দিলো। রাগে গজর গজর করতে লাগলো। কারণ, তাকে ঘুম থেকে জাগানো হয়েছে।
চৌকিদার শাহকে হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে এলো। আমি তখন এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে শাহের সঙ্গে হাত মেলালাম। আমার হাত ধরে সে ভেতরে নিয়ে গেলো আমাকে। ভেতরে গেলাম আমি একলাই।
শাহজি! আমি বললাম মৃদু স্বরে চেষ্টা করবেন আমার হাতে যেন আপনার বেইজ্জতি না হয়। প্রায় মাসাধিক আগে যে আপনার আস্তানায় এক লোকের চুল দাড়ি কাটানো হয়েছিলো সে কে ছিলো? সে এখন কোথায় আছে?
শাহ আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন তার সঙ্গে আমি মশকরা করছি।
তাড়াতাড়ি বলুন শাহজি
আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না- বিস্ময়ের ভাব তার কণ্ঠে আমার বাড়িতে কারোই চুল কাটানো হয়নি।
ভেবে চিন্তে জবাব দেবেন শাহজি!- শান্ত সুরে বললাম- এই মাঝ রাতে আপনার এখানে এমনি আসিনি। যে চুল কেটেছিলো তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আর যে চুল কাটতে দেখেছে সেও আমার হাতে..
আমি আপনাকে বলেছি আমার হাতে আপনার বেইজ্জতি করাবেন না। গার্ড নিয়ে এসেছি আমি। পুরো বাড়ি তল্লাশি হবে। আর জনাবকে হাত কড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।
তারপরও সে আমাকে বেকুব বানানোর চেষ্টা করলো।
তার নাম ঠিকানা বলে দাও আমার সুর ভয়ংকর করে বললাম- আর তার চুল দাড়ি যেখানে চাপা দিয়ে রেখেছিলে নিজেই তা বের করে দাও……… এখনি……. আর সময় দেবো না আমি।
তার মাথা দুলে উঠলো।
কোন সুযোগ কি দেয়া যায় না? সে মাথা ওভাবে রেখেই জিজ্ঞেস করলো।
যেটা জানতে চেয়েছি আগে সেটা বলে নাও- আমি বললাম আগের সুরে সে কে?
আমার মান সম্মানের দিকে লক্ষ্য রাখবেন- মিনতি করলো শাহ- আমি সবকিছু বলে দেবে এবং আপনার খেদমতও করবো। আল্লাহকে বহুত ইয়াদ করেছি।
আরো কিছু বক বক করে সে এক গ্রামের কথা বললো, এখান থেকে আট নয় মাইল দূরে। তার বাড়ি সেখানেই।
তাকে ভণ্ড পীর কি তুমিই বানিয়েছো?
শাহ মাথা দোলালো। তার নাম বললো, সারমুদ।
***
তার অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক বর্ণনা শোনার আগে বললাম, তার বাড়ির ভেতর সার্চ করবো আমি। সে মিনতি করলো যে, তার জবানবন্দি নিয়েই যেন আমি তাকে ছেড়ে দিই। এতে আমার সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো।
আমার লোকদের ডেকে বললাম, বাড়ি তল্লাশি শুরু করে দাও। শাহ হাতজোড় করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, তল্লাশি চালাবেন না। আমি তাকে বললাম, সারমুদের চুল দাড়ি দিয়ে দাও এবং তার বাম চোখে যে কাপড় বাঁধতে সেটা যদি নকল হয় সেটা এখন কার কাছে? তোমার কাছে হলে আমাকে দিয়ে দাও।
আমার জানা ছিলো, এই শাহ অভিজ্ঞ এক ফ্রড। ঐ নফল পীরও আনাড়ি নয়। তাই এত লম্বা চুল ও দাড়ির স্তূপ কোন ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার মতো বেকুব নয় এরা।
শাহ এক কামরায় নিয়ে গেলো আমাকে। একটা বাক্স থেকে সবুজ এক টুকরো কাপড় বের করলো। সারমুদ এটা তার বাম চোখে বাধতো।
এ সময় হেড কনস্টেবল এসে বললো, এক কামরা থেকে দুই লোক গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা পালানোর পায়তারা করছিলো।
শাহ জানালো, এরা তার চ্যলা। শাহ আমাকে বাইরে নিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে বললো, এখানে দাবানো হয়েছিলো চুল দাড়ি। তাকে মাটি খুড়ে বের করতে বললাম।
কয়েকজন সাক্ষীর সামনে সে চুল ও দাড়ি বের করলো। তারপর সারা বাড়ি তল্লাশি চালালাম। দুটি খঞ্জর ও একটা সুটকেসের ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেলো। আজকের হিসেবে কয়েক লাখ টাকারও বেশি। শাহ এবং তার দুই চ্যলা ও বুড়ো নাপিতসহ থানায় ফিরে এলাম।
থানায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় শেষ প্রহরে গিয়ে পৌঁছলো।
শাস্তির দাগা দেয়ার লোহার শিক উত্তপ্ত ছিলো তখন। এজন্য কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয়াটা সমীচিন মনে করলাম। প্রথমে দুই চ্যালাকে মুখোমুখি করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, শাহের ঘরে কি করছিলে?
হুজুর! সে বললো- জানি আপনি শাহজি ও আমাদেরকে কেন পাকড়াও করেছেন। কিন্তু আমি এ অপরাধে জড়িত ছিলাম না। আমার সঙ্গের ঐ লোকটা সারমুদের সঙ্গে গিয়েছিলো। সে ওখান থেকে পালিয়ে আবার শাহের কাছে ফিরে আসে। সারমুদের সঙ্গে যে আরেকজন ছিলো, সে সারমুদের এলাকাতেই থাকে।
তাকে যা জিজ্ঞেস করলাম সে সব বলে দিলো।
আরেক চ্যালাকে ডেকে বললাম, মিথ্যা বলার মতো বেকুবি করবে না। যা জিজ্ঞেস করবো, সঠিক উত্তর দিবে।
সেও সিয়ানা লোক। স্বীকার করলো, সে সারমুদের সঙ্গে ছিলো। আমি বললাম, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। সব বলে দিলে এবং আসামীরা ধরা পড়লে তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করবো। সে জবানবন্দি দিয়ে দিলো।
তারপর শাহকে ডাকলাম। সে ঘুষ দিতে চাইলো। তবে জবানবন্দিও দিলো। সারমুদ ও তার দুই সঙ্গীর অপরজনের ঠিকানা বলে দিলো। তখনই আইএসআইকে তিনজন কনস্টেবল দিয়ে তাদের দুজনকে গ্রেপ্তারের জন্য শহরে পাঠিয়ে দিলাম।
এরপর শাহ ও তার এক চলা যে সারমুদের সঙ্গী ছিলো তাদেরকে বন্দি করে হাজতে বন্দি করে রাখলাম।
অন্য চ্যলাকে সন্দেহ ভাজনের তালিকায় রাখলাম। সারা রাত নিঘুম কাটিয়েছি। কিন্তু থানা থেকেও অনুপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। তাই থানার কনস্টেবল ব্যারাকে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
***
শহর থেকে নকল পীর সারমুদ ও তার অপর সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করতে তেমন বেগ পেতে হলো না। সেখানকার থানাদার (ওসি) আমার আই.আস.আই এর কাজ সহজ করে দিয়েছেন। তিনি থানার রেকর্ড কোট দেখেছেন। সামুদের নাম নেই কোথাও। তার সঙ্গীরা শহরের মন্দ লোকদের সঙ্গে চলাফেরা করলেও চুরি চামারি করার মতো বদমায়েশ ছিলো না।
সেখানকার থানা অফিসার সারমুদের পরিচিতি দুজন লোককে ডেকে তার সম্পর্কে খুটি নাটি জেনে রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করেন।
তারা জানালো, সারমুদের মাথায় কোন গণ্ডগোল থাকতে পারে। তার নিকটাত্মীয়রা শহরে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সারমুদ নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে। বয়স একত্রিশ বত্রিশ। এখনো বিয়ে করেনি। ছ ফিটের ওপর লম্বা দেখতে দারুন সুদর্শন। অনেক অভিজাত ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু সম্মতি দেয়নি কোথাও। তবে চালচলনে দুর্নামও ছিলো কিছু।
তার বাবার বিশাল সম্পত্তির সেই একমাত্র ওয়ারিশ। মা বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। শহরে বড় বড় তিনটি বাড়ি রেখে যায় তার বাবা। শহরের প্রান্তে শত বিঘা ধানি জমিও আছে তার। একটি বাড়ি তো অনেক বড়। হিন্দু জমিদাররা ভাড়া নিয়ে সেখানে বড়সড় এক স্কুল খুলেছে। তার যমিনের আয়ও বেশ ভালো।
কিন্তু সে অদ্ভুত সব কাজ করতো। কখনো আলগা দাড়ি ও শিখদের পাগড়ি লাগিয়ে শিখ পণ্ডিত সেজে শহরে ঘুরে বেড়াতো। কখনো চৌধুরী জমিদারদের মতো কলিদার জামা-সেলওয়ার ও পাগড়ি মাথায় দিয়ে কয়েক দিন শহরে শহরে ঘুরে বেড়াতো।
আবার একবার জটধারী হিন্দু সন্যাসী সেজে বিভিন্ন জায়গার হিন্দুদের ঘর থেকে বেশ পয়সা কামিয়ে নেয়। সেগুলো দিয়ে বন্ধু বান্ধবদের কয়েক দিন মৌজ করে। গলার সুর ছিলো তার অসাধারণ। যে কোন লোককে পাগল করে দেয়ার মতো। এছাড়া তার বিরুদ্ধে থানায় কোন রিপোর্ট নেই। কেউ তার বিরুদ্ধে কোন নালিশও জানায়নি কোন দিন।
আই.এস.আই, সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট দিয়ে আসামীকে আমার সামনে হাজির করলো।
আশ্চর্য। আসামীর মুখে মুচকি মুচকি হাসি। যেন আমাকে বিদ্রূপ করছে। তার চোখ দুটিও সুস্থ-উজ্জল দৃষ্টি।
তার মৃদু হাসির প্রভাবেই না অন্যকোন কারণে জানি না। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো
ওর হাত কড়া খুলে দাও……… আর তুমি বসো সারমুদ।
তার হাতকড়া খুলে দেয়া হলো, আমার সামনের চেয়ারে সে সহজ হয়ে বসে পড়লো।
এটা কেমন ড্রামা খেললে সমুদ?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আপনিই বলুন, এখনও কি ড্রামা রয়েছে?- সে হাসিমুখে বললো।
ওর যেন এই অনুভূতিটুকুও নেই যে, তার এই নাটক খেলা কোন পরিণতিতে নিয়ে যাবে।
নাটক আর ড্রামা খেলা তো ছিলো চমৎকার। আমি বললাম- আচ্ছা! এসব কি তুমি টাকা পয়সার লোভে করেছো না নারী শিকারের জন্য?
শিকার তো অনেক খেলেছি- এমনভাবে বললো যেন সে আমার বন্ধু পয়সার কোন লোভ নেই আমার। মারদান শাহ ও তার এক চ্যলাকে হাজতে দেখেছি আমি। তাদেরকে এখানে নিয়ে আসুন। যত টাকা পয়সা কামিয়েছি আমি সব দিয়ে দিয়েছে মারদান শাহকে।
আসামী শাহের নাম মারদান। মারদান শাহ বলে ডাকে তাকে তার চ্যলারা।
সারমুদ! মনে হচ্ছে তুমি জানো না যে, জেল খানায় যাচ্ছো তুমি?
ফাঁসি তো আর দেবেন না। কাউকে আমি হত্যা করিনি। চুরি ডাকাতিও করিনি। কারো পকেটও কাটিনি। লোকেরা নিজেরা এসে পয়সা দিয়ে যায় কণ্ঠে তার নির্বিকার ভাব।
আর যেসব মেয়েদের তুমি নষ্ট করেছো?
এমন একজন মেয়েকে আমার সামনে নিয়ে আসুন, যে নালিশ করবে তার ওপর আমি জোর খাঁটিয়েছি। তার হাসি আরো বিস্তৃত এলো- আমি আপনাকে অসন্তুষ্ট করবো না। যা জানতে চাইবেন সব বলে দেবো। এতে আপনার পেশাগত দায়িত্ব …….
আমি একজন মুসাফিরের মতো ছিলাম হুজুর! এই দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে বিদায় নিতে এসেছি। আমাকে শাস্তি দিয়ে যদি আপনি খুশী হন তাহলে শাস্তি দেন। আমি আপনার মন খুশি করে দেবো।
আমার দীর্ঘ পুলিশি জীবনে এ ধরনের আসামী এই প্রথম এবং শেষ দেখলাম।
তোমার নাকি মাথায় গণ্ডগোল আছে? আমি বললাম- তুমি কি নিজেকে সুস্থ মনে করো?
এ ব্যপারে আপনার কি ধারণা?
আমি তোমাকে সুস্থ বুদ্ধিমানই মনে করি। তুমি যে দারুন সফলতায় মানুষকে ধোকা দিয়েছে। অসুস্থ মাথার কেউ এমনটি করতে পারতো না।
আমি হয়রান হয়ে গেলাম, তার হাসি হঠাৎ করেই মুছে গেলো। উজ্জ্বল মুখটি বিবর্ণ হয়ে গেলো। চোখ দুটো লাল হয়ে গেলো।
আমি কাউকে থোকা দেয়নি- বেদনাহত কণ্ঠে বললো- আমি নিজেকে নিজে থোকা দিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে নিজের সঙ্গে নিজে প্রতারণা করেছি- বিমর্ষ হেসে বললো
আপনি থানার পুলিশ অফিসার। আমার ব্যপারে আপনার সহমর্মী হওয়া উচিত হবে না। আমি মানুষকে ধোকা দিয়েছি বলেই তো আমাকে পাকড়াও করেছেন……… শুধু একটা কথা বলবো। মানুষ আসলে অসহায়, কিছুই বুঝে না। প্রতারিত হলে তারা খুশি হয়ে যায়। আমার মতো বা মারদান শাহের মতো ছদ্মবেশী পীর যখন কাগজে কিছু এঁকে তাবিজ হিসেবে তাদেরকে দেয়, আশায় তাদের বুক ভরে যায়……..
আমার ব্যপারে আপনি কি কি রিপোর্ট পেয়েছেন জানি না। দেখুন যে বাড়ি থেকে আমি পালিয়েছি সে বাড়ির এত সুন্দরী যুবতী বধূকে আমার সঙ্গে রাত কাটাতে পাঠিয়ে দিয়েছে, গুপ্তধন আর সন্তানের আশায়। অথচ এদের আত্মমর্যাদাবোধ এত টনটনে যে, কেউ তাদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকালে তাকে কতল পর্যন্ত করে দেয়।
কিন্তু তুমি নিজেকে নিজে থোকা দিয়েছে। এ কথার অর্থ কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
শুনবেন সব?- তার গলায় আকুতি।
সারমুদ! সারা রাত সামনে পড়ে আছে। আগ্রহভরে শুনবো। তবে মনে রেখো, এ থেকে আমাকে কেসও তৈরী করতে হবে। আমি তোমাকে চাপাচাপি করবো না। তুমিও আমাকে পেরেশান করবে না।
মিথ্যা বলবো না আমি একটা কথাও। তবে আপনি কোন অপ্রয়োজনীয় কথা জানতে চাইলেও আমি বলবো।
***
সারমুদের পূর্ণ কাহিনী শোনাতে গেলে সেটা একটা বিশাল বই হয়ে যাবে। কাহিনীর বিরাটাংশ এই মামলার সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিলো না। তবুও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে তার কাহিনী শুনেছি আমি। এখানে সংক্ষেপ করা ছাড়া তাই উপায়ও নেই।
সারমুদ এক আমীর ঘরনার পিতার ছেলে। তার চার বছর বয়সের সময় তার তের চৌদ্দ বছরের বড় বোন মারা যায়। এর দুবছর পর সারমুদের আরেক বোন মারা যায়। বোন হারানোর দুঃখ সারমুদকে খুব কষ্ট দেয়। তার বয়স ১৩ কি ১৪ যখন হয় তখন মারা যায় তার মা। সারমুদের জন্য তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। সারমুদের আঠারো বছর বয়সে তার বাপও মারা যায়।
শোক তাকে এমনভাবে ক্ষত বিক্ষত করে যে, তার বাবার মৃত্যুর এক বছরের মাথায় সে প্রায় পাগল হয়ে যায়। কান্না ছাড়া সে আর কিছুই ভাবতে পারতো না। ঘুম আর ক্ষুধার অনুভূতি খতম হয়ে গিয়েছিলো। ঘরের ভেতর ভয়ের জমকালো মূর্তি তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। আত্মীয় স্বজনদের নিয়মিত সঙ্গও তাকে স্বাভাবিক করতে পারলো না।
অবশেষে তার বন্ধুরা দিন রাত পালা করে তাকে সঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।
তার এক বন্ধুর এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম ছিলো। তাদের মিলনের নিরাপদ কোন জায়গা ছিলো না। সারমুদের বাড়িই হয়ে উঠে তাদের প্রেম কানন।
সারমুদের মনোযোগ তখনো প্রেম ভালোবাসার দিকে যায়নি। যাহোক ওদের প্রেমে কোন ধরনের অশ্লীলতা ছিলো না। অত্যন্ত পবিত্র ছিলো। মেয়েটি মুসলমান হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেললো।
এর মধ্যে সারমুদের সেই বন্ধুর কয়েকশ মাইল দূরে এক সরকারি চাকুরি হয়ে যায়। বন্ধু চাকুরিতে চলে যায়। চার পাঁচ দিন পর সেই হিন্দু মেয়ে এক রাতে সারমুদের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। এসে সরাসরি সারমুদকে প্রেম নিবেদন করে। সারমুদের ভেতরটা তখনো পর্যন্ত পরিষ্কার ছিলো। কিন্তু মেয়েটি পবিত্র থাকতে দিলো না।
সে রাত থেকেই সারমুদের জীবন সফর পাল্টে গেলো। যে সফরের শেষ মনযিল হলো থানা পুলিশ।
মেয়েটির অন্য এক ছেলের সঙ্গে আট মাস পর বিয়ে হয়। এই আট মাস সে সারমুদের ঘরে অনেক রাত কাটিয়েছে। তার চলে যাওয়ার পর আরো মেয়ে আসে তার জীবনে। তার জীবন বড়ই আমোদে হয়ে উঠে।
এরপর শুরু হয় তার বিয়ের পালা বা কনে পক্ষদের তাকে নিয়ে টানাটানি। তার এক মামা তার মেয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় তাকে এবং তাকে বিয়ের কাজ দ্রুত সেরে ফেলার জন্য চাপ দিতে থাকে।
সারমুদ অসহায়বোধ করতে থাকে। এ অবস্থা দেখে আরো দুই মেয়ের মা তার সমব্যাথী হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। এটা ওটা পাকিয়ে তার ঘরে পাঠাতে থাকে। ওদিকে আরেক মেয়ের বাপও তার হামদর্দ বনে যায়। কখনো কখনো তাকে টেনে হেচড়ে তাদের ঘরে নিয়ে যায়।
এভাবে সারমুদের বিয়ের জন্য চার পাত্রীর মা বাব উঠে পড়ে লাগে। প্রতিদিনই কোন না কোন এক পাত্রীর মা বা বাবা এসে তার বাড়িতে হানা দিতো। আর গল্পে গল্পে বাকী তিনজনের বদনাম রটাতো। এসব বদনামের সারংশ একটাই। কেউ সারমুদকে আসলে চায় না। চায় তার সম্পত্তি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তার মন তাদের প্রতি চরমভাবে বিঘিয়ে উঠে।
আমার মার এক পুরনো বান্ধবী একদিন আমাকে সতর্ক করে দেয় সারমুদ আমাকে জানায়- অমুক অমুক মেয়ের মা মহিলাদের বৈঠকে স্বীকার করেছে যে, সারমুদ ভদ্র ছেলে না হলে কি হবে, আল্লাহ তো তাকে সম্পত্তি দিয়েছে…….
এক মেয়ের মার বক্তব্য হলো। সে আমাকে মেয়ে দিচ্ছে শুধু এ কারণে যে, তার মেয়ের কোন শাশুড়িও হবে না; ননদও থাকবে না। ঘরের একলা মালিক তার মেয়েই হবে …..
আমার মায়ের সেই বান্ধবী শৈশব থেকেই আমাকে আদর যত্ন করতেন এবং তার কোন মেয়ে ছিলো না। সব সময় তিনি আমার মঙ্গল চাইতেন। এজন্য তার কথা আমি শুধু বিশ্বাসই করলাম না; ঐ পাত্রীদের মায়েদের প্রতি আমার এমন ঘৃণার সৃষ্টি হলো যে, বিয়ের ইচ্ছেই মন থেকে মুছে ফেললাম।
বিয়ের চিন্তা বাদ দিলেও নিজের ভেতরে সবসময় এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করতো সারমুদ। এই তৃষ্ণা চেপে রাখার জন্য প্রতিদিনই নিজের ঘরে বন্ধুদের আড্ডা জমাতো। ধুমধাম করে রান্না বান্না খাওয়া দাওয়া চলতো। এক এক দিন এক এক বন্ধু এর খরচ যোগাতো।
তার চমৎকার গান গাওয়ার গলা। স্বভাবগত অভিনয় ক্ষমতা। কৌতুক প্রবণতা এসব গুনের কারণে তার বন্ধু মহল দিন দিন বিস্তৃত হলো।
***
এক সময় তালিকাভূক্ত অপরাধীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলো। অবশ্য সে জুয়া খেলা ছাড়া আর কোন অপরাধে জড়াতো না। তার এই দ্বিতীয় শ্রেনীর বন্ধুরা তাকে এক সময় মারদান শাহের ডেরায় নিয়ে গেলো। সেখানেও জুয়ার আড্ডা চলতো। মদের আসর বসতো। মারদান শাহের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলো।
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
সারমুদ শখের বসে দাড়ি আর বাবরি রেখেছিলো। মারদান শাহ তার লম্বা দাড়ি চুলকে কাজে লাগাতে চাইলো। মারদান শাহ তাকে একদিন বললো, গ্রামের যেসব ঘরের ছেলেরা ফৌজে যোগ দিয়েছে তাদের মা বাবার একটাই মাকসাদ- তাদের সন্তান যেন সেনা ছাউনিতে থাকে, যুদ্ধে তাদেরকে পাঠানো না হয়। তাহলে যেকোন সময় আহত বা নিহত হওয়ার খবর আসতে পারে।
মজার কারবার হলো এসব ঘরে যদি কোন ফালতু লোকও গিয়ে বলে, তার কাছে এমন বিদ্যা আছে যা তাদের সন্তানদের বা বন্ধুদের গুলির আচর থেকে মুক্ত রাখবে; তারা তখন তার পায়ে সিজদায় পড়ে যেতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
মারদান শাহ সারমুদকে পীর বানিয়ে দিলো। মানুষকে আকর্ষণ করার মতো কিছু বুলি শিখিয়ে দিলো। নিজের একজন চ্যলাও দিয়ে দিলো তাকে। ওদিকে সারমুদও তার এলাকার এক ফ্রডকে শিখিয়ে পরিয়ে নিলো। মারদান শাহ এভাবে মোট চারজনকে নকল পীর বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দিলো।
সারমুদ নিজের বাড়ি থেকে তিন মাস গা ঢাকা দিয়ে থাকে। মারদান শাহের আস্তানায় থেকে এর মধ্যে ফ্রডবাজির চূড়ান্ত সবক নেয়।
তার চুল দাড়িও ইতিমধ্যে বিশেষ লম্বা হয়ে যায়। সেই বৃদ্ধ নাপিতও তার চুল দাড়িতে কিছু অদলবদল করে দেয়। তাকে যেন চেনা না যায় এজন্য তার বাম চোখে পট্টি বেঁধে দেয় মারদান শাহ।
সারমুদ যেদিকেই যেতো তার চ্যলারা এগিয়ে গিয়ে তার নামে গুজব ছড়াতো যে, এক গায়েবি পীর এখান দিয়ে যাবে। অমুক গ্রামে তার মোবারক কদম পড়তে পারে। বানিয়ে বানিয়ে তার অনেক আজব কারামত শোনাতো। যে গ্রামেই হানা দিতো সে গ্রামের কয়েক বাড়ির ভেতরের অবস্থা তার চ্যলারা আগ থেকেই জেনে নিতো। সারমুদ সেসব ঘরেই যেতো।
যেমন আদালতের বোনকে দেখেই সারমুদ বলে দেয়, শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাপের বাড়ি বসে আছে সে। অবশ্য আদালতের বাড়ি থেকে গুপ্তধনের আবিস্কারের পরিকল্পনা তার নিজের ছিলো।
আমি জানতাম, মানুষ পীর পূজারী- সারমুদ জবানবন্দিতে বললো- কোন বিপদে পড়লেই লোকজন খোদার দরবারে না গিয়ে পীরের সামনে সিজদা করে। কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে, পীরের ইশারায় তারা নাচতেও পারে এবং নিজেদের যুবতী মেয়েদেরকে পীরের কাছে হাওলা করে দেয়।…..
অবশ্য এটা আমার বোকামি ছিলো যে, আমি খাযানার বুজরুকি ও কূপ থেকে পানি উঠানোর ধোকা দিয়ে বসলাম। এটা না করলে সারা দেশ ঘুরে আমি এত টাকা কামাতাম, যা রাখার জায়গা পেতাম না কোথাও। খোদার কসম! যে মেয়ের প্রতিই আমার দৃষ্টি গিয়েছে সেই আমার বুকে লুটে পড়েছে।
আদালতের স্ত্রী তাজের কাছ থেকে যে আমি জবানবন্দি নিয়েছি এটা ওকে বললাম না। আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম। আদালতের ঘরেও কি মেয়ে শিকার করেছো?
ইনস্পেক্টর সাহেব! সে গম্ভীর সুরে বললো- আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছি। আমার আরজ হলো, যেখানে সব কথাই আপনি পরম ধৈর্য নিয়ে শুনেছেন, এটাও তাই গোপন রাখবো না……. আদালতের ঘরের মেয়ে দুটিকেই আমার ভালো লেগেছে। প্রথমে আমি আদালতের বোনকে পটাতে চাইলাম। কিন্তু ঐ মেয়ের আত্মসম্মান বোধ এত প্রখর যে, আমাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলো…….
আদালতের স্ত্রীকে আমার বেশি ভালো লাগলো। আদালতের অনুমতি ক্রমে তাজ আমার সঙ্গে তিন রাত কাটালো। প্রথম রাতে ইশারা করতেই সে নিজেকে আমার কাছে সপে দিলো……. এই তিন রাত আমার ও তাজের মধ্যে কি কথা হয়েছে সেটা শুনিয়ে বিরক্ত করবো না আপনাকে……….
আমি আপনাকে শুধু বলতে চাই, সুন্দরী মেয়েদের সবসময় আমি খেলনা মনে করেছি। একটি খেলনা ভেঙ্গে গেলে আরেকটা হাতে চলে আসতো। আপনি তো জানেন, শয়তানের জগতে প্রেমে ভালোবাসা নেই। স্বার্থপরতা আর যৌন ক্ষুধা মেটানোই এখানকার প্রধান কাজ। কিন্তু তাজের ব্যাপার ছিলো ভিন্ন।
এই সুন্দরী মেয়ে আমার ওপর জাদুর মতো সওয়ার হলো। মনে মনে ভালো লাগা এক জিনিস। যে মেয়ের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিলো তাকে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু মনের ওপর কেউ আধিপত্য বিস্তার করেনি। তাজ যেন আমার মন-আত্মার ভেতর বাসা বেঁধে ফেললো..
কখনো মনে হতো, কত জনম আগ থেকে আমরা পরস্পরকে চিনি। হারিয়ে গিয়েছিলাম। আবার মিলন হয়েছে। তার সামনেও অবশ্য আমি চিল্লা কাশির অভিনয় করেছি। তবে এও বলেছি, তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও আমার জীবন কিভাবে কাটবে আমি জানি না। তারপও সে আমাকে অনেক বড় পীর মনে করতে থাকে। আবার আবেগ ভরেও আমার সঙ্গে কথা বলে যায়। আমি বুঝতাম এসব কথা তার অন্তর থেকেই বেরোচ্ছে ……
ওকে আমি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিই। সে তখন বলে, ভয় লাগে। পুরো খানের বেইজ্জতি হবে………
জনাব! তাজ আমার সামনে বসার পর আমার মনে হলো, আমার ভেতর যে তৃষ্ণার জ্বালা ছিলো সেটা ধুয়ে মুছে গেছে। কোন মেয়ের সঙ্গ আমাকে এভাবে আত্মিক প্রশান্তি দেয়নি।
এক রাতে কি হলো, ওর মুখটি আমার দু হাতের মাঝখানে নিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। সে চোখ আমার শৈশবে মনে করিয়ে দিলো। ভেসে উঠলো আমার মা বোনের ছবি। আমার চোখে পানি এসে গেলো। তাজ জিজ্ঞেস করলো, আমার চোখে পানি কেন। মৃদু হেসে উত্তর এড়িয়ে গেলাম। সে চুপ করে গেলো। সে হয়তো ভেবেছে, এই পানি পীর ফকিরীর কোন রহস্য হবে……..
জানি না, তাজকে ওখানে রেখে আমি কি করে পালালাম। ওতো আমার পায়ের শিকল বনে গিয়েছিলো। আমার দেহই সেখান থেকে পালিয়েছে, মনটি রয়ে গেলো তাজদের গ্রামে। এর পরের গ্রামে যখন গেলাম তখন স্পষ্ট অনুভব করলাম, আমার উস্তাদি খতম হয়ে গিয়েছে। ভাবতে লাগলাম, এ খেলা এখন ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু কূপের কাহিনী হয়ে গেলো……
***
যা হোক, আদালতের ক্যপ্টেন ভাই আমার জারিজুরি ধরে ফেললো এবং পাকড়াও করলো আমাকে।
ভাগ্যের খেলা দেখুন- সারমুদ বলে গেলো- তাজের ঘরেই আমাকে পৌঁছে দিলো। লোকেরা সেখানে আমাকে মনের ঝাল মিটিয়ে মেরেছে। আদালতের বোন ও মা আমাকে গালি দিতে দিতে লোকদের বলতে থাকে, মারো, ঐ কাফেরকে মারো। ওর হাড়গোড় ভেঙ্গে দাও।
শুধু তাজ এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আমাকে গুপ্তধন আবিষ্কারের কুঠুরীতে বন্দি করে। ওদের বেকুবির অবস্থা দেখুন। আমাকে না। বেঁধে এমনিই ছেড়ে রাখে। আমিও আমার সর্বশেষ উস্তাদি খাঁটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে মারদান শাহের ওখানে পৌঁছি। পরদিন সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকি। রাতে নাপিত ডেকে চুল দাড়ি সাফ করা হয়।
কিভাবে বের হলে?
সে আমাকে পুরোনো কাহিনীই শোনালো। কুঠুরীর দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বড় কামরায়, তারপর জানালা খুলে উঠোন পেরিয়ে প্রধান দরজা খুলে……
…….. আমি তাকে বললাম, ঐ জানালা দিয়ে যদি সে বের হয়ে দেখাতে পারে তাহলে নগদ পাঁচশ টাকা দেবো।
মিথ্যা বলছো কেন সারমুদ? তুমি সেখান থেকে কিভাবে বের হয়েছিলে আমি সব জানি।
কিভাবে?
তোমাকে কি তাজ বের করেনি?- সে কাহিনী তাকে শোনালাম।
সে আমার দু হাত জাপ্টে ধরে বড় অনুনা করে বললো, এই কেসে যেন তাজের নাম দেয়া না হয়।
সেখান থেকে পলানোর অপরাধে আমাকে যদি ফাঁসিও দেয়া হয় তবুও তাজের নাম আমি নেবো না। আপনি দয়া করুন- সে বললো।
তাজের সব কথা শুনে আমিও তাজের সঙ্গে ওয়াদা করেছি, তার কথা কাউকে বলবো না।
সে কি বলেছিলো, আমার ভালোবাসার বিনিময়ে আমাকে ওখান থেকে বের করেছে?- সারমুদ জিজ্ঞেস করলো।
তার ইযযত রক্ষার্থে- আমি বললাম।
যাহোক সারমুদ নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করার ব্যপারে আমাকে বেশ সাহায্য করলো। ও দিকে মারদানশাহ ও তার দুই চ্যলাও নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তবে কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন ছিলো।
তাছাড়া আমার রিপোর্ট সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো, সারমুদকে ছদ্মবেশ ধারণ অবস্থায় ধরা যায়নি। তার প্রকৃত চেহারায় কেউ তাকে চিনতো না। তবুও নিজের বানানো কয়েকজন সাক্ষী দ্বারা এই অভাবটা দূর করে নিলাম।
মজার ব্যাপার হলো, আদালতে সারমুদ তার থানার জবানবন্দি থেকে মোটেও সরে যায়নি। সব স্বীকার করে সে। একটু অস্বীকার করলেই জেল থেকে রেহাই পেতো।
তবে মারদানশাহ ও তার এক চ্যলা থানার জবানবন্দি অস্বীকার করে বসে। তাদেরকে জব্দ করার জন্য তখন কোন সাক্ষী পাওয়া গেলো না, যে এসে বলবে, এই লোক অমুক নারীর ইযযত লুটেছে।
তারপরও প্রত্যেকের দু বছর করে জেল হলো। রায় শেষে তাদেরকে যখন কোর্টের বাইরে আনা হলো, সারমুদের হাতে তখন হাত কড়া। কিন্তু তার ঠোঁটে বেপরোয়া হাসি। সে আমাকে কাছে ডেকে নিজের হাত বাড়িয়ে আমার এক হাত টেনে নিয়ে বললো,
আমি সহজেই মুক্ত হতে পারতাম। উকিল আমাকে বারবার বলেছে, তুমি মাত্র একবার অস্বীকার করো। বলল, আমাকে মেরে মেরে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। আমি শুধু দেখছিলাম, আপনি আপনার ওয়াদা পূরণ করেন কিনা। আপনি সাক্ষীতে যেই তাজের নাম উচ্চারণ করতেন আমি আমার জবানবন্দি অস্বীকার করে বসতাম। আপনি তাজের সম্মান রেখেছেন আমিও আপনার সম্মান রেখেছি।
যে রাতে সারমুদ থানায় আমার কাছে জবানবন্দি দেয়, সে রাতে সে এক পর্যায়ে বড় হতাশ ও বেদনাহত কণ্ঠে বলে ছিলো
হায় তাজকে আমি সারা জীবন পাবো না। আর সারা জীবনই মানুষকে ধোকা দিয়ে যাবো।
তখন থেকেই আমার মনে এক গোপন প্রার্থনা ছিলো, কোনভাবে যদি সারমুদের স্বপ্ন পূরণ হতো!
***
এজন্যই বোধ হয়, এই মামলা তো শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু কাহিনী আরো নাটকীয়তার দিকে এগিয়ে গেলো। এই মামলার বেশ অনেক দিন পর বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে অন্য এক থানায় ইনচার্জ দেয়া হলো। সেখানে দু বছর কাটানোর পর জরুরী ভিত্তিতে আবার সারমুদ যে শহরে থাকতো সে শহরের থানায় পোস্টিং দেয়া হলো।
আগের থানায় থাকতেই আমি ততদিনে সারমুদের স্মৃতি প্রায় ভুলে গেছি। পৌনে তিন বছল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যে হাজারো মামলা আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। কতজনের কথা মনে রাখা যায়।
এই থানায় আসার পনের ষোল দিন পরের ঘটনা। থানার এক হেড কনস্টেবল ও আরেক কনেস্টবল মারামারির অভিযোগ তিনজনকে থানায় নিয়ে এলো। তাদেরকে বাইরে বসিয়ে হেড কনষ্টেবল এসে আমাকে জানালো, এদের একজন এই শহরেরই। দু জন্য দেহাতী অর্থাৎ গ্রামের দেহাতীরা শহরির ওপর প্রকাশ্যে বাজারে ছুড়ি দিয়ে হামলা করে।
শহরি এতে মোটামুটি যখমী হয়। শহরির হাতে সাইকেলের একটা হেন্ডেল ছিলো। আত্ম রক্ষার্থে শহরিও সে হেন্ডেল দিয়ে পাল্টা আঘাত করে। বাজারের লোকেরা তাদেরকে তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু দেহাতীরা নিয়ন্ত্রণে আসেছিলো না। দুই পুলিশ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। হাঙ্গামা দেখে সেই তিনজনকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসে।
তিনজনকে ভেতরে আনা হলে আমি শুধু চমকেই উঠলাম না। প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলাম ভেতর ভেতর। এক লহমায় চিনে ফেললাম।
তিনজনের একজন সারমুদ, আরেকজন আদালত, অন্যজন আদালতের এক আত্মীয়। আমি বুঝে ফেললাম, মারপিটের কারণ কি? কিন্তু তাদের কথা শোনার পর দেখা গেলো ব্যপার আরো অনেক সঙ্গিন।
আগে যখমগুলো দেখলাম। সারমুদের মাথার একটা জায়গায় চার পাঁচ ইঞ্চি হিড়ে গেছে। আর সারমুদের আঘাতে তারা শুধু ব্যথা পেয়েছে, যখমী হয়নি।
থানায় ফাষ্ট এইড-এর ব্যবস্থা ছিলো। সারমুদের মাথায় ব্যান্ডেজের কথা বলে ওদের চোটে ঔষধ লাগিয়ে দিতে বললাম।
প্রথমে আদালতকে জিজ্ঞেস করলাম, সারমুদকে সে কেন হত্যামূলক আক্রমণ করলো।
ওর কাণ্ড কারখানার কথা কি আপনার মনে নেই? আদালত আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
আমাকে প্রশ্ন করবে না। আমি রাগত কণ্ঠে বললাম- সব মনে আছে আমার। সে তোমাকে গুপ্তধন ও তোমার স্ত্রীকে সন্তান দেয়ার ধোকা দিয়েছিলো। আর তুমি ছয় সাত রাতের জন্য তোমার স্ত্রীকে তার কাছে হাওলা করে দিয়েছিলে। আইন তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। তুমি এখ কি চাও? তুমি ওকে হত্যার জন্য যে হামলা করেছে এর শাস্তি সাত বছরের জেল। দশ বছরও হতে পারে।
জনাব!–আওয়াজ তার মৃত প্রায়- আসল কথা হলো, আমার স্ত্রীকে সে বিয়ে করে ফেলেছে।
আমি অত্যন্ত হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
সে কি তোমার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে? যদি অপহরণ করে থাকে তুমি থানায় রিপোর্ট করলে না কেন?
আমি রিপোর্ট করবো কিভাবে জনাব?- আদালত বলে গেলো। আমি তো আমার স্ত্রীকে আগেই তালাক দিয়ে দিয়েছি।
ঘটনা পুরোটা খুলে বলতে বললাম।
জনাব!- আদালত বলতে লাগলো- সে অপরাধী হিসেবে ধরা পড়ার পর যখন পালিয়ে গেলো এর কিছু দিন পরই আমার স্ত্রীর মধ্যে মা হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলো। তিন মাস অপেক্ষার পর নিশ্চিত হলাম, আমার স্ত্রীর সত্যি মা হতে যাচ্ছে।
যদি এই লোক সত্য পীর হতো তাহলে বুঝতাম এটা তার দুআর বরকত, কিন্তু এতো বড় বাটপার। আমার সন্তান জন্ম দেয়ার মতো ক্ষমতা নেই। এই গর্ভ ঐ থোকাবাজের। স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম তালাকনামাও। তারা ঝামেলা করলেও টিকতে পারলো না………
সেই বাচ্চার বয়স এখন দুই বছর। বাচ্চা হওয়ার পর তাদের গ্রামের কোন নারী পুরুষ তার দিকে মুখ ফেরাতেও ঘৃণাবোধ করতো। ওর মা বাবা ভাই বোনও তাকে গলা ধাক্কা দিতো। সবাই বলতো, হারাম সন্তানের মা হয়েছে। বাচ্চার বয়স ছয় মাস হওয়ার পর সে বাচ্চা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেলো। দেড় দুই মাস পর জানা গেলো, সে ঐ বদ পীরের কাছে আছে। তাকে বিয়ে করে ফেলেছে……..
আজ আমি কোন এক কাজে শহরে এসে একে পেয়ে গেলাম। জেল খেটে এসেছে জানতাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বদ মায়েশির ফল তো ভোগ করে এসেছো তাই না? এ বদকারনি কি এখন তোমার কাছে? উত্তরে সে এমন কথা বললো, আমার আত্মমর্যাদা বোধে বড় আঘাত লাগলো। আমি উত্তেজিত না হয়ে পারলাম না
তোমার মধ্যে আবার আত্ম মর্যাদা আর উত্তেজনাও আছে?- আমার রক্ত টগবগ করে উঠলো- ছিঃ। গুপ্তধনের লোভে নিজে বউকে ভণ্ড পীরের কাছে সপে দিয়েছে। আর এখন অপবাদ দিচ্ছো, সে হারাম বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। আমার তো সন্দেহ হয় তুমিও এমনই কোন পীরের ছেলে
আমি আরো আশ্রাব্য কিছু বলে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর বললাম
তোমাকে ৩০৭ ধারা মোতাবেক গ্রেফতার করে সাত বছরের জেল দেবো।
এ কথা বলে তাকে হাজতে ভরে ফেললাম। অবশ্য এর উদ্দেশ্য ছিলো তাকে ভয় দেখানো। তারপর আদালতের গ্রামে খবর পাঠিয়ে দিলাম, কেউ এসে তাদের ভালো হয়ে চলার জামানত দিয়ে আদালতকে ছুটিয়ে নিয়ে যাও।
***
এরপর সারমুদের কাছে জানতে চাইলাম এসব কি হচ্ছে? তার কাহিনী খুব দীর্ঘ। তবে সংক্ষেপে একরম :
সারমুদের জেল ছিলো দুই বছরের। কয়েদখানায় তার সদাচরণের জন্য চার মাসের শাস্তি মাফ করে দেয়া হয়। তাজ তার মন থেকে মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হয়নি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তাজের জন্য সে ব্যকুল হয়ে উঠলো। কিন্তু কিভাবে সম্ভব তাজকে এক নজর দেখা।
এক মাস পর মারদান শাহের এক চ্যলার সঙ্গে তার দেখা হলো। সে জানালো, তোমার প্রতারণা তাকে তালাক দিয়ে দেয়। আর তাজের জীবন হয়ে গেছে অচ্ছতের জীবন।
তাজের এ অবস্থার কথা শুনে তো সারমুদের পাগল হওয়ার অবস্থা। সে মারদান শাহের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তাকে বললো, সে তাজের খবরাখবর জেনে তাজ এর কাছে একটা প্রস্তাব পাঠাতে চায়।
মারদান শাহের হাত অনেক লম্বা ছিলো। জেল খেটে আসার পরও তার তাবিজের কদর একটুও কমেনি। এক মহিলাকে তাজের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য ঠিক করলো সে।
পরদিনই তাজ এর খবর জানা গেলো। বাচ্চা নিয়ে তাজ মা বাবার সঙ্গেই থাকে।
কিন্তু সে ঘরে নওকরদেরও ইযযত আছে। তাজ-এর কোন ইযযত নেই। ওর বাচ্চাকে নানা নানী ছুঁয়েও দেখে না। তাজ-এর মতো এমন সুন্দরী মেয়েকে যে কেউ বিনা শর্তে বিয়ে করতে রাজি হবে। কিন্তু সেখানকার মেথরও তাজ-এর নাম শুনলে নাক ছিটকায়।
তোমার ঝুলি পয়সায় ভরে দিবো- সারমুদ ঐ মহিলাকে বললো- কাল মাঝ রাতে যেন তাজ তাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে চলে আসে। তার বাচ্চাটিকেও সাবধানে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আমি সেখানে থাকবো। তাকে বলবে, সারমুদ এখন ভদ্র জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু তাজ যদি তার কাছে না আসে তাহলে সে গুণ্ডা বদমায়েশেরও অধম হয়ে যাবে।
খবর পেয়ে তাজ সারমুদের প্রস্তাব মনে প্রানে গ্রহণ করলো। মহিলার কাছে খবর পাঠিয়ে দিলো, সে সঠিক সময়ে বেরিয়ে আসবে।
সারমুদ মারদান শাহের একটি ঘোড়া নিয়ে তাজদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাইলো।
তাজ আসতেই সারমুদ বাচ্চা সমেত তাজকে জড়িয়ে ধরলো। তাজও গাঢ়ভাবে সাড়া দিলো। দুজনের চোখের মিলনের অশ্রুতে ভরে গেলো। সারমুদ তাজকে ঘোড়ায় উঠালো। বাচ্চা তাজ-এর কোলেই ছিলো।
এখন আর তোমাকে ধোকা দেবো না- সারমুদ আশ্বাসের গলায় বললো।
এর চেয়ে বড় থোকা আর কি হতে পারে?- তাজ ফুঁপিয়ে উঠলো- যে জাহান্নামে গত দুবছর জ্বলে পুড়ে মরেছি এর চেয়ে বড় ধোকা আর কি হতে পারে?
সারমুদ তাকে শান্ত করলো। ফোলা ফোলা চোখের তাজকে সারমুদের মনে হলো, সদ্য কলি ফোঁটা বিশ বছরের অপসরা যুবতী। শত ঝড়ঝাঁপটা তাকে মমিন করতে পারেনি। ধুয়ে মুছে তার রূপকে আরো বিকাশিত করেছে।
সারমুদ নিজের বাড়ির দিকে ঘোড়া ছুটালো। ঘোড়া যেন পংখিরাজের মতো উড়ে চললো।
পথে তাজ ওকে বললো, মা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতেই তার স্বামী আদালত তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। তারপর তাকে তালাক দিয়ে দেয়।
যে গ্রামে যে বাড়িতে আমার দাপট চলতো- তাজ বললো- সে গ্রামের দাসী বাদীর শ্রেনীর মেয়েরাও আমার সঙ্গে কথা বলতো না।
ফজরের আযানের পূর্বেই ওরা পৌঁছে গেলো সারমুদদের বাড়িতে। ফজরের নামাযের পর পাশের মসজিদের ইমাম সাহেবকে বাড়িতে নিয়ে এলো সারমুদ। ইমাম সাহেব তাজ ও সারমুদের বিয়ে পরিয়ে দিলেন।
তারপর দুপুরের আগে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তাদের বিয়ের রেজিষ্ট্রিও সেরে ফেললো।
রাতের বেলা সারমুদের বন্ধুরা মিলে বড়সড় এক পার্টির আয়োজন করলো। বন্ধুরাই সারমুদের ঘরে বাসর সাজালো। এবং দুজনকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সবাই বিদায় নিলো।
যা হোক, সারমুদ ভয়ে ভয়ে ছিলো। তাজ এর পরিবারের কেউ প্রতিশোধমূলক কোন ক্ষতি বা তার ওপর হামলা করতে পারে। হামলা ঠিকই করলো, তবে তাজ এর পরিবারের কেউ না। বরং তাজ এর পূর্ব স্বামী আদালত। তবে সারমুদ বেঁচে গেলো।
আমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিলাম। রাতের মধ্যেই আদলত ও তার আত্মীয়ের জামিন হওয়ার জন্য লোকজন চলে এলো। তাদের গ্রামের চৌকিদার ও মেম্বরও আসলো।
আমি আদালত ও তার লোকদের কাছ থেকে লিখিত জামানত নিলাম, এখন থেকে তারা সারমুদ ও তার স্ত্রীকে কোন ধরনের বিরক্ত করবে না। কেউ যদি সারমুদের ওপর হামলা করে আর হামলাকারীকে ধরা না যায় তখন আদালত ও তার সঙ্গীরাই গ্রেপ্তার হবে। তাদের জামিনদাররাও সন্দেহ ভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হবে।
সারমুদকেও সতর্ক করে দিলাম, সে যেন এখন থেকে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হয়। তাহলে তার কপালেও খারাবি আছে।
আমার ভেতরের সেই অপ্রাপ্তি আর শূণ্যতার আগুন নিভে গেছে। সেই আগুনই আমাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে গিয়েছিলো
সারমুদ সতেজ গলায় বললো
আমার জীবন থেকে যা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো সেই মহান সত্তা তাজ ও তার সন্তানের রূপে আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। খোদার দরবারে আমি এখন সত্যিকারের তওবা নিয়ে হাজির হবো। তবে এর জন্য এখন প্রকৃত আল্লাহ ওয়ালা এক পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবো। শুনেছি তিনি থাকেন ইউপির সাহারানপুরের দেওবন্দে।