প্রেম-পাগলিনী

প্রেম-পাগলিনী

প্রথম পরিচ্ছেদ 

পশ্চিম গগনে সাঁঝের তারা দেখা দিয়াছে। সেই উজ্জ্বল প্রদীপ্ত আভা দেখিয়াই যেন অপরাপর ক্ষুদ্র তারকানিচয় ক্রমশই ক্ষীণপ্রভ হইয়াছে। সান্ধ্য-সমীরণ গাছের পাতা কাঁপাইয়া, গৃহস্থের গবাক্ষ-পথ দিয়া প্রকোষ্ঠ মধ্যে প্রবেশ করতঃ সদ্য প্রদীপ্ত প্রদীপ নির্ব্বাণ করিতেছে। কখনও বা প্রসুপ্ত শিশুর কুন্তলকলাপ দোলাইয়া তাহার অনিন্দ্যসুন্দর ফুল্ল নলিনী সম মুখখানি চুম্বন করিয়া অপরের অগোচরে পলায়ন করিতেছে। আমি থানার প্রশস্ত প্রাঙ্গণ মধ্যে পায়চারি করিতেছি, এমন সময়ে সাহেবের আরদালি আসিয়া আমার হাতে একখানি পত্র দিল। 

পত্রখানি পাঠ করিয়া জানিতে পারিলাম, মলঙ্গায় কোন মুসলমানের বাড়ীতে খুন হইয়াছে; আমাকে তখনই তাহার অনুসন্ধানে যাইতে হইবে। 

পত্র পাঠ করিয়া আমি একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। শকট আনীত হইলে আমি সত্বর তাহাতে আরোহণ করিলাম এবং কোচম্যানকে মলঙ্গায় যাইতে আদেশ করিলাম। 

 অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই আমি মলঙ্গায় উপস্থিত হইলাম। বাড়ীখানি খুঁজিয়া লইতে আমার বিশেষ কষ্টও পাইতে হইল না।

কাৰ্য্যস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, মুসলমানের বাড়ীখানি কাঁচা – খোলার চাল। বাড়ীর সদর দরজায় দুইজন কনেষ্টবল দণ্ডায়মান ছিল, আমাকে দেখিয়া উভয়েই সেলাম করিয়া পথ ছাড়িয়া দিল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ভিতরে তিনখানি ঘর। একজন কনেষ্টবলও সেখানে মোতায়েন আছে। 

তিনখানি ঘরের মধ্যে একখানি শয়ন-ঘর, একখানা রান্নাঘর এবং অপরখানিতে সংসারের যাবতীয় দ্রব্য সঞ্চিত থাকে। আমি প্রথমেই শয়ন-গৃহে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় আট হাতের কম নহে। ঘরের একটি দরজা এবং তিনটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জানালা ছিল। ঘরের মেঝেয় বিলাতী মাটী (সিমেণ্ট) দেওয়া। ভিতরে একখানি কাঁঠাল কাঠের তক্তাপোষ, তাহার উপর একটা ছিন্ন মাদুর, তদুপরি দুইখানি ময়লা কাঁথা, সর্ব্বোপরি একখানা চাদর। বিছানার চারিদিকে চারিটি বালিস ছিল বটে, কিন্তু তাহার মধ্যে তিনটি ক্ষুদ্র। শয্যার দক্ষিণ দিকে মেঝের উপর কাঁঠাল কাঠের একটা সিন্দুক—উপরে আলকাতরা মাখান। সিন্দুকের উপর একখানি ময়লা আসন, তাহার উপর একটা বৈঠকে দস্তাবাঁধান হুকা। সিন্দুকের পার্শ্বে একখানি জলচৌকির উপর কতকগুলি বাসন সজ্জিত। ঘরে অপর দিকে একটা সেগুন কাষ্ঠের বস্ত্রাধার, তাহাতে তিন চারিখানি ময়লা কাপড়, একটা জামা ও একখানা বৃন্দাবনের চাদর। অপর পার্শ্বে কতকগুলি কড়ির সিকা। এক একটি সিকায় এক একটি রঙ্গিল হাঁড়ী। 

শয্যার উপর এক বৃদ্ধের মৃতদেহ। সর্ব্বাঙ্গে একখানি ছেমাটা চাদর দিয়া আবৃত। বৃদ্ধের মুখে তখনও ফেনা; চক্ষু রক্তবর্ণ এবং উন্মীলিত মুখভঙ্গি অতি বিকট। তাহাকে দেখিয়া বোধ হয়, তাহার বয়স প্রায় ষাইট বৎসর। দেখিতে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণ কিন্তু জরাগ্রস্ত বলিয়া বোধ হইল না। 

গৃহ মধ্যে আরও দুইজন লোক ছিল, উভয়েই রমণী। একজনকে যুবতী বলিয়া বোধ হইল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত, মুখে ঘোমটা। অপরা প্রৌঢ়া, বয়স প্রায়য় পঞ্চাশ বৎসর। 

যে পুলিস-কর্মচারী বাড়ীর ভিতরে ছিল, তাহার মুখে শুনিলাম, যে বৃদ্ধের মৃত্যু হইয়াছে, তাহার নাম মহম্মদ, — সেই বাড়ীর মালিক। সে আতসবাজী বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। মেছুয়াবাজারে তাহার একখানি বাজীর দোকান আছে এবং কাঁকুড়গাছিতে একখানি বাগানও জমা আছে। সরকার বাহাদুরের আদেশমত সেই বাগানেই মহম্মদ আতসবাজী প্রস্তুত করিত। সে নিতান্ত দরিদ্র নহে, আপনারও পরিবারের ভরণ-পোষণ সংগ্রহ করিতে তাহাকে পরের দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে হইত না। বরং সে অপরকে মধ্যে মধ্যে দুই চারি টাকা কর্জ্জ দিয়া উপকার করিত। সেইদিন বেলা দশটার সময় মহম্মদ ভগ্নীর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিল। যখন বাড়ী ফিরিয়া আসিল, তখন বেলা প্রায় চারিটা। বাড়ীতে আসিয়াই স্ত্রীর সহিত দুই একটা কথাবার্তার পর সে শয়ন করিয়াছিল; প্রায় একঘণ্টার পর হঠাৎ সে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে আরম্ভ করে; তাহার স্ত্রী সেই শব্দ শুনিয়া দৌড়িয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার বড়ই ভয় হইল। সে দেখিল, তাহার স্বামী গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে, তাহার মুখ দিয়া ফেনা নির্গত হইতেছে, তাঁহার চক্ষু ঘোর রক্তবর্ণ হইয়াছে, তাহার দৃষ্টি উপরে উঠিয়াছে, চক্ষুর তারা যেন সদাই ঘুরিতেছে। ভয় পাইলেও সে দুই একবার ডাকিয়াছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পায় নাই। তাহার ভয় আরও বাড়িয়া উঠিল, সে এক প্রতিবেশিনী—সেই প্রৌঢ়ারমণীকে ডাকিয়া আনিল। উভয়ে মিলিয়া মহম্মদের জ্ঞান উৎপাদনের জন্য বিধিমতে চেষ্টা করিল কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। তখন প্রৌঢ়ার পরামর্শে পুলিসে সংবাদ দেওয়া হইল; কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহম্মদ অধিকক্ষণ জীবিত ছিল না। পুলিসের লোক আসিবার পূর্ব্বেই সে ইহধাম ত্যাগ করিয়াছিল। 

পুলিস-কৰ্ম্মচারীর নিকট হইতে এই সকল কথা শুনিবার পর, স্বয়ং লাস পরীক্ষা করিবার জন্য অগ্রসর হইলাম এবং সেই প্রৌঢ়াকে মহম্মদের গাত্রবস্ত্রখানি ধীরে ধীরে তুলিয়া লইতে বলিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

রাত্রি প্রায় আটটা। আকাশে চন্দ্র নাই, ঘরের মধ্যে সেই জলচৌকির উপর একটি পিত্তলের পিলসুজে মৃত্তিকার প্রদীপ হইতে অতি ক্ষীণ আলোক বাহির হইয়াছিল। সেই আলোকে পরীক্ষার সুবিধা হইবে না জানিয়ে একজন কনেষ্টবলকে একটা আলোক সংগ্রহ করিতে আদেশ করিলাম। কিছুক্ষণ পরেই সে একটা প্রকাণ্ড মশাল লইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। ঘরটি আলোকিত হইল। 

মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া কোন স্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। গলদেশ কোনরূপ স্ফীত বলিয়া বোধ হইল না। চক্ষুদ্বয় ঘোর রক্তবর্ণ ও দৃষ্টি ঊর্দ্ধ হইলেও চক্ষু কোটর হইতে বহির্গত হয় নাই। মুখে তখনও সামান্য ফেনা লাগিয়া ছিল; মুখের ভঙ্গি অতি ভয়ানক। অল্পবয়স্ক বালকবালিকাগণ সে মুখ দেখিয়া আতঙ্কে চীৎকার করিয়া পলায়ন করিবে। 

পরীক্ষা দ্বারা যতদূর বুঝিতে পারিলাম, তাহাতে বিষপানে মৃত্যু বলিয়াই বোধ হইল। এখন কোন্ বিষে তাহার মৃত্যু তাহাই দেখিতে হইবে। উহা আমার অসাধ্য; লাস সরকারী ডাক্তারের নিকট পাঠাইতে হইবে। কিন্তু তাহার পূৰ্ব্বেই আমাকে কতকগুলি বিষয় জানিতে হইয়াছিল। 

পুলিস-কর্ম্মচারীর মুখে শুনিয়াছিলাম, যুবতী সেই বৃদ্ধের স্ত্রী। আমার কেমন সন্দেহ হইল; — বৃদ্ধের বয়স যাই বৎসর, যুবতীর বয়স পনর বৎসরের অধিক নহে, বৃদ্ধের বয়সের সিকি অর্থাৎ তাহার পৌত্রীর বয়সের সমান; বড়ই বিসদৃশ বলিয়া বোধ হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, বৃদ্ধের কয় বিবাহ? উত্তরে প্রৌঢ়ার মুখে শুনিলাম, শত্রুর মুখে ছাই দিয়া বৃদ্ধ উপর্যুপরি চারিটি বিবাহ করিয়াছে। বর্তমান যুবতী তাহার চতুর্থ স্ত্রী। সৌভাগ্য বশতই বলুন, আর দুর্ভাগ্য বশতই বলুন, মহম্মদের একটিও সন্তান জন্মে নাই। 

এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি প্রৌঢ়ার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, যাঁহার বাড়ীতে মহম্মদ আজ নিমন্ত্রণে গিয়াছিল, তিনি মহম্মদের কে? 

প্রৌ! ভগ্নী। 

আ। কেমন ভগ্নী? সহোদরা? 

প্রৌঢ়া আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। কিন্তু যুবতী ঘোটার ভিতর হইতে অতি মৃদুস্বরে উত্তর দিল “হাঁ—মার পেটের বোন।” 

যদিও কথাগুলি মৃদুস্বরে উচ্চারিত হইয়াছিল, তথাপি আমি শুনিতে পাইলাম। প্রৌঢ়াও তখন তাহার কথায় সায় দিয়া বলিল “হাঁ হাঁ, রমজানী মহম্মদের মার পেটের বোন।” 

আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “সেখানে কি উপলক্ষে এই নিমন্ত্রণ?”

প্রৌঢ়া এবার আমার কথা বুঝিতে পারিল। সে তখনই উত্তর করিল “ভাগ্নীর বিবাহ।” 

আ। কবে? হইয়া গিয়াছে? 

প্রৌ। না, –এখনও হয় নাই; কার্ত্তিক মাসের আজ চার তারিখ, মাসের দশ দিনে বিবাহ। আজ হইতে আমোদ-আহ্লাদ খাওয়া ইত্যাদি আরম্ভ। কিন্তু হায়, মহম্মদের অদৃষ্টে নাই; বেচারার কেন যে এমন হইল, কে বলিতে পারে? 

আ। আজ কখন মহম্মদ সেখানে গিয়াছিল? 

প্রৌ। ইনি বলিতেছেন, বেলা প্রায় দশটার সময়। 

আ। তুমি কে? তুমি কি এ বাড়ীর লোক নও? 

প্রৌ। আজ্ঞে না—আমি এই পাড়াতেই বাস করি বটে কিন্তু এ বাড়ীর লোক নহি। 

আ। তবে তুমি এখানে কেন? 

প্রৌ। যখন মহম্মদের মুখ দিয়া ফেনা বাহির হইতেছিল এবং সে গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছিল, তখন‍ই মাল্‌ল্কা ভয়ে আমাকে ডাকিয়া আনিল, আমি সেই সময় হইতেই এখানে আছি। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মাল্‌ল্কা কে?” 

প্রৌ। মহম্মদের এই স্ত্রীর নাম মালকা। 

আ। তুমি এখানে আসিয়া কি দেখিলে? 

প্রৌঢ়া যে যে কথা বলিল, পাঠক মহাশয় তাহা পূৰ্ব্বেই অবগত আছেন। 

প্রৌঢ়ার শেষ কথা শুনিয়া আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। মৃতদেহ সত্বর সরকারী ডাক্তারখানায় পাঠাইয়া দিয়া আমি থানায় ফিরিয়া গেলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

যখন আমি থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছে। প্রৌঢ়ার মুখে পূর্ব্বেই মহম্মদের ভগ্নিপতির নাম ধাম শুনিয়াছিলাম। কিন্তু সেই রাত্রে বরাহনগরে গিয়া বিবাহ-বাড়ীতে উৎপাত করা যুক্তিসিদ্ধ নহে মনে করিয়া, আমি বিশ্রাম করিতে গেলাম। 

পরদিন প্রত্যূষে প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলাম। গাড়ি আনীত হইলে তাহাতে আরোহণ করিয়া কোচম্যানকে যথাস্থানে যাইতে বলিলাম। 

বেলা ৯টার কিছু পূৰ্ব্বে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। মহম্মদের অবস্থা ভাল না হইলেও তাহার ভগ্নিপতিকে ধনবান বলিয়া বোধ হইল। তাহার বাড়ীখানি পাকা – নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে এবং দ্বিতল। সম্ভবতঃ সেই বিবাহ উপলক্ষে বাড়ীখানি ভাল করিয়া সংস্কার করা হইয়াছিল। দূর হইতে বাড়ীখানিকে দেখিলে একখানি ছবি বলিয়া বোধ হয়। 

বাড়ীর সদর দরজায় দুইজন দরোয়ান উত্তম বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল, আমাকে দেখিয়া দুইজন সেলাম করিল। প্রতি-নমস্কার করিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “মুনসী আবদুল সাদেক কোথায় আছেন?”

আবদুল সাদেকের নামটি উচ্চারিত হইবামাত্র একজন দরোয়ান শশব্যস্তে আমাকে লইয়া উপরের বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল এবং একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোককে প্রদর্শন করিয়া আমাকে সেই স্থানে উপবেশন করিতে অনুরোধ করতঃ তথা হইতে প্রস্থান করিল। 

আমি দেখিলাম, ঘরটি ক্ষুদ্র হইলেও বাদসাহী ধরণে সজ্জিত। ঘরের মধ্যে ঢালা বিছানা। বিছানার চারিপার্শ্বে আটটি মোটাসোটা তাকিয়া। চারিটি দেওয়ালে কতকগুলি দেয়ালগিরি, উপরে তিনটি বড় বেলোয়ারী ঝাড়। ঘরের একপার্শ্বে একখানা বড় আয়না আয়নার উপরে একটা প্রকাণ্ড ঘড়ী। অপর পার্শ্বে একটা দেরাজ, একটা আলমারি ও গোটাকতক সেল্ফ ছিল। 

আমি যখন বৈঠকখানার ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন দুইজন লোক গোপনে কি কথাবার্তা কহিতেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে যখন তাহাদের মধ্যে একজন অপরের নিকট বিদায় লইয়া প্রস্থান করিলেন, তখন অপর ব্যক্তি আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়, এখানে কাহার অন্বেষণে আসিয়াছেন?” 

পরে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “এ বিবাহ বাড়ী – আমোদ-প্রমোদের জায়গা; এখানে আপনি কেন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “মুনসী আবদুল সাদেক কোথায় আছেন? আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।” আমার কথা শুনিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন। পরে উত্তর করিলেন “আমারই নাম আবদুল সাদেক। কন্যার বিবাহ দিতে বসিয়াছি—এমন কোন অন্যায় কার্য্য করি নাই, যাহাতে আমার বাড়ীতে আপনাদের মত লোকের শুভাগমন হইতে পারে। 

আ। মলঙ্গায় মহম্মদ নামে আপনার কোন আত্মীয় বাস করেন? 

আব। আজ্ঞে হাঁ—আমার শ্যালক। 

আ। তাহার অবস্থা কেমন? 

আব। বড় ভাল নয়। 

আ। কাল তিনি আপনার বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থ আসিয়াছিলেন কি? 

আব। আজ্ঞে হাঁ– কেন? 

আ। খুব সম্ভব তাঁহার বিষপানে মৃত্যু হইয়াছে। 

মুখ হইতে কথাগুলি নির্গত হইবামাত্র আবদুল সাদেক স্তম্ভিত হইলেন। তিনি চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সে কি! কাল বেলা তিনটার সময় তিনি আহারাদি করিয়া বাড়ীর দিকে গিয়াছিলেন। কি রকমে তাঁহার মৃত্যু হইল?” 

আ। প্রকৃত ব্যাপার এখনও জানা যায় নাই। তবে বোধ হয়, তিনি বিষপানে মারা পড়িয়াছেন। 

আব। কে বিষ দিল? 

আ। কেমন করিয়া জানিব? তাহারই সন্ধান করিতেছি। আপনার বাড়ীতে কল্য কত লোক আহার করিয়াছিল? আব। প্রায় চারিশত 

আ। সকলেই কি একই প্রকার খাদ্যদ্রব্য ভোজ করিয়াছিলেন? 

আব। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। আপনার পরিচিত আর কোন লোকের কোন প্রকার অসুখের কথা শুনিয়াছেন? 

আব। আজ্ঞে না। ইচ্ছা করেন আপনি স্বয়ং তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের মধ্যে প্রায় সিকি লোক আমাদের পল্লীতেই বাস করেন। 

আবদুল সাদেকের কথা শুনিয়া আমি কোন উত্তর করিবার পূর্ব্বেই উপস্থিত কয়েকজন লোক হাসিয়া উঠিলেন । তাহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, “বলেন কি মহাশয়! আবদুল ধনবান নহে বটে কিন্তু গতকল্য যে সকল খাদ্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা অনেক রাজা মহারাজার বাড়ীতেও হয় কি না সন্দেহ।” 

আর একজন বলিলেন “এই ত ঘৃত আজ-কাল অত্যন্ত মহার্ঘ্য্য, কিন্তু তাহা হইলেও ইনি যে ঘৃত ব্যবহার করিয়াছেন, তাহার মূল্য প্রতি মণ ষাইট টাকা। যিনিই বলুন, আজ-কালের বাজারে দেড় টাকা সেরের ঘৃত দিয়া দ্রব্যাদি প্রস্তুত করিতে পারেন না।”

আর একজন বলিলেন “আরে রেখে দাও বড়লোক। ঘৃতের গন্ধে বাড়ীতে প্রবেশ করা দায়। এ সে জায়গা নয়।” শেষোক্ত তিন ব্যক্তি যেরূপ ব্যগ্রতা সহকারে কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, তাঁহারাও পূর্ব্বদিন সেই স্থানে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন এবং নিশ্চয়ই পরম পরিতৃপ্তির সহিত আহার করিয়াছেন। কিন্তু তাহা হইলেও জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারাও ত সেই সকল দ্রব্য ভোজন করিয়াছেন?” 

প্রথমোক্ত ব্যক্তি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন “সে কথা কি আর জিজ্ঞাসা করিতে হয়? যখন খাবারের এত সুখ্যাতি করিতেছি, তখন আমরা যে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম এবং পরিতোষ সহকারে ভক্ষণ করিয়াছি, তাহা বলা বাহুল্যমাত্র।” 

আমি বলিলাম “হাসি তামাসার কথা নয়। বাস্তবিকই মহম্মদের মৃত্যু হইয়াছে এবং আমি তাহারই তদ্বির করিতে আসিয়াছি।” 

আমার কথায় সকলেই মলিন হইয়া গেলেন দেখিয়া, আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “সত্য করিয়া বলুন দেখি, আপনারা কোনপ্রকার অসুখ বোধ করিতেছেন কি না?” 

সকলেই গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না মহাশয়। যদি তাহা হইত, তাহা হইলে কি আজ আবার আহার করিতে আসিতে পারিতাম?” 

কথাটা যুক্তিসিদ্ধ। শারীরিক ব্যাধি থাকিলে, শরীর অসুস্থ হইলে রাজভোগও ভাল লাগে না। আবার ক্ষুধা থাকিলে শাকান্নও সুধাসম জ্ঞান হইয়া থাকে। কি করিব কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া আমি সেই স্থানে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে মুনসী আবদুল সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম ‘মহাশয়! কাল যে সকল পদার্থ আপনার নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ আহার করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে যেগুলি এ বাড়ীতে প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহার কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে কি?” 

আব। কেন? থাকিতে পারে বোধ হয় 

আ। সেগুলি পরীক্ষা করিব। 

আব। এতগুলি নিমন্ত্রিত লোকের কথায়ও বিশ্বাস হইল না? 

আমি কোন উত্তর করিলাম না। আবদুল আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন “খাবারগুলি পরীক্ষা না করিলে আর আপনার সন্দেহ ঘুচিবে না?”

আমি গম্ভীর অথচ কর্কশ ভাবে বলিলাম “আমার কার্য্য আমি বুঝি। যদি আমার কথার উত্তর দিতে আপনাদের কষ্ট হয়, পরিষ্কার বলুন, আমি অন্য উপায়ে সকল সংবাদ সংগ্রহ করিব।” 

আমার কথায় উপস্থিত ব্যক্তিগণের অত্যন্ত ভয় হইল। তাঁহারা তখন সকলেই আমার তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু আমি সহজে ভুলিবার পাত্র নয়। কাৰ্য্যসিদ্ধ হইয়াছে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কাল যে যে খাবার আপনার বাড়ীতে প্রস্তুত হইয়াছিল, এবং যাহা নিমন্ত্রিত লোকমাত্রেই আহার করিয়াছিলেন, তাহার কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে কি?” 

আবদুল সাদেক শশব্যস্তে আমার নিকট আসিয়া বলিলেন “ঠিক বলিতে পারিলাম না – যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া আসি।” 

আমি সানন্দে তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম। তিনিও তখনই বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন এবং সত্বর ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ—কিছু কিছু সকলেরই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?” 

আ। কেন? খাবারগুলি সরকারী ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষা করাইতে হইবে। 

আব। তাহাতে কি হইবে? 

আ। উহাতে কোনপ্রকার দূষিত পদার্থ মিশ্রিত আছে কি না জানিতে পারা যাইবে। যদি কিছু থাকে, তাহা হইলে বোঝা যাইবে যে, মহম্মদ সেই বিষমিশ্রিত দ্রব্য ভক্ষণ করিয়াই ইহধাম ত্যাগ করিয়াছে। 

আমার শেষ কথাগুলি আবদুলের বড় ভাল লাগিল না। তিনি আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। কিন্তু তখন সাহস করিয়া কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ পরে আত্মসংবরণ করিয়া অতি বিনীত ভাবে বলিলেন, “তাহাই বা কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? যদি মহম্মদ আহার করিবার পর কোন দ্রব্যে সর্প বা কোন বিষাক্ত জীব মুখ দিয়া থাকে, তাহা হইলে আপনারা কেমন করিয়া জানিবেন, কোন্ বিষে মহম্মদের মৃত্যু হইয়াছে?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, আপনার কথা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু ইহাও বেশ জানি যে, বক্রী খাদ্য নিশ্চয়ই উত্তমরূপে আবৃত রাখা হইয়াছিল। বিশেষতঃ আপনি যখন মুসলমান, তখন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। 

মুনসী আবদুল সাদেক আমার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন? হিন্দু হইলে সন্দেহ হইত কেন?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “কথায় বলে, আপনারা নবাবের জাতি; অতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আপনাদের সকল কাৰ্য্যই অতি সুশৃঙ্খল ভাবে সম্পাদিত হইয়া থাকে।” 

আমার কথায় তিনি বিশেষ প্রীত হইলেন, পরে ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য। খাবারগুলি নিশ্চয়ই আবৃত ছিল। পরীক্ষা করিয়া যে কোনপ্রকার অস্বাস্থ্যকর পদার্থ বাহির করিতে পারিবেন, এমত বোধ হয় না।” 

আমিও হাসিয়া বলিলাম, না পারিলেই ভাল। আমার এমন ইচ্ছা নহে যে সকল খাবারের ভিতরেই বিষ আছে ইহা প্রমাণিত হয়। যে কার্য্যের সন্ধানের ভার আমাদের হস্তে পতিত হয়—আমরা সেই কার্য্যের জন্যই দায়ী। সেই জন্যই সকল দিক দেখিয়া আমাদিগকে কার্য্য করিতে হয়। আপনার শ্যালক মহম্মদ যে ভাবে কাল এখান হইতে বাড়ী ফিরিয়া গিয়াছিল এবং অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই যেরূপ গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছিল,—মুখ দিয়া ফেনা নির্গত হইতেছিল, তাহাতে সে যে বিষপানে মারা পড়িয়াছে, তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়। আর যখন সে এখানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া গিয়াই ওইরূপ করিতে করিতে মারা পড়িয়াছে, তখন আপনার বাড়ীর খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করিয়াই যে তাহার দশা ঘটিয়াছে, এ কথা কে না বলিবে? আপনার মনে যাহাই কেন হউক না, আমাদের কর্তব্য আমরা করিবই।” 

আবদুল জিজ্ঞাসা করিলেন “কিছু খাদ্য আনিয়া দিব কি?” 

আমি হৃষ্টচিত্তে সম্মতিসূচক উত্তর প্রদান করিলাম। তিনি পুনরায় ভিতরে প্রস্থান করিলেন, এবং কিছুক্ষণ পরে একজন ভৃত্যের সহিত আমার নিকট আগমন করিলেন। ভৃত্য একখানি বড় থালে করিয়া কতকগুলি উপাদেয় খাদ্য-সামগ্রী লইয়া আসিল। 

ভৃত্য খাদ্যদ্রব্যপূর্ণ সেই থালখানি আমার সম্মুখে রাখিয়া প্রস্থান করিলে পর, আবদুল সাদেক অতি বিনীত ভাবে বলিলেন, “একটি অনুরোধ করিব কি?” 

আ। কি বলুন? 

আব। যদি খাবারের ভিতর বিষ না থাকে, তাহা হইলে ওইগুলি আপনাদের সাহেবকে ভোজন করিতে দিবেন কি? আপনি হিন্দু-অবশ্য এ সকল খাদ্য-সামগ্রী আপনার অখাদ্য, হয়ত অস্পৃশ্য। 

আমি হাসিয়া বলিলাম “আজ্ঞে না, অখাদ্য বলিবেন না। এ সকল অতি উপাদেয় খাদ্য-কথায় বলে, নবাবী খানা। তবে আমরা হিন্দু–সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতি, সেই কারণেই আপনাদের সৃষ্ট খাবার আমরা ভক্ষণ করি না। বোধ হয়, আপনারাও আমাদের স্পষ্টদ্রব্য ভোজন করেন না।” 

এইরূপ আরও দুই চারিটা কথাবার্তার পর আমি সেখান হইতে বিদায় লইলাম। কিন্তু যতক্ষণ না আমি সেই খাদ্যদ্রব্যগুলি আমাদের সাহেবকে দিতে স্বীকৃত হইলাম, ততক্ষণ তিনি আমাকে ছাড়িয়া দিলেন না। 

আবদুল সাদেক অতি ভদ্রলোক। পাছে আমার কষ্ট হয়, এই জন্য তিনি একখানি গাড়ি যোগাড় করিয়া দিলেন। আমি অগ্রে খাদ্য-সামগ্রীগুলি তাহাতে রাখাইয়া নিজে শকটারোহণ করিলাম এবং যথাসময়ে সরকারী ডাক্তারখানায় উপস্থিত হইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সরকারী ডাক্তারখানায় সেই খাদ্যদ্রব্যগুলি পরীক্ষার জন্য রাখিয়া এবং মহম্মদের মৃতদেহ পরীক্ষার রিপোর্টের একখানি নকল লইয়া আমি থানায় ফিরিয়া আসিলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর স্নানাহার সমাপন করিলাম, পরে এক নিভৃতস্থানে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম। 

ডাক্তারের রিপোর্টে প্রকাশ যে, জল বা জলীয় কোন খাদ্যদ্রব্যে তীব্র সেঁকোবিষ মিশ্রিত থাকায় মহম্মদের অকাল-মৃত্যু হইয়াছে। কোথায় এবং কাহার দ্বারা সে বিষ মিশ্রিত হইল? যেখানে মহম্মদ নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিল, সেখানে সে যে সকল খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করিয়াছে, তাহাতে নিশ্চয়ই বিষ নাই, যদি থাকিত, তাহা হইলে আরও অনেকেরই তাহার দশা প্রাপ্ত হইত। যখন তাহা হয় নাই, তখন মহম্মদের ভগ্নীর বাড়ীতে কেবল যে তাহারই খাদ্যে বিষ মিশ্রিত হইয়াছিল, এমন কোন কথা নাই। তবে যদি তাহাকে আদর করিয়া স্বতন্ত্র বসাইয়া কোন লোক খাওয়াইয়া থাকেন, তাহা হইলে সন্দেহের কথা বটে। কিন্তু আবদুল সাদেকের মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাতে মহম্মদের সেরূপ আদর হয় নাই; সে অপরাপর নিমন্ত্রিত লোকদিগের সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া আহার করিয়াছিল, এইরূপই বোধ হইয়াছিল। সুতরাং যদি আবদুল-প্রদত্ত খাবারগুলিতে বিষ না থাকে, যাহা খুব সম্ভব নাই, তাহা হইলে যে সেঁকোবিষ দ্বারা মহম্মদের মৃত্যু হইয়াছে, সে বিষ কোথা হইতে আসিল? বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া সে কিছু ভক্ষণ করিয়াছিল কি না, তাহা জানা আবশ্যক। 

সময়মত সরকারী ডাক্তারখানা হইতে একখানি পত্র আসিল। পত্রখানি আমারই, খুলিয়া পাঠ করতঃ জানিতে পারিলাম, আবদুল যে খাদ্য-সামগ্রী আমার সহিত পাঠাইয়া দিয়াছেন, সেগুলি বিষশূন্য। মহম্মদের বাড়ীতে পুনরায় গমন করার আবশ্যক বিবেচনায় অগ্রসর হইলাম। একবার ভাবিলাম, ছদ্মবেশে যাওয়াই উচিত, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে পুলিসের পোষাক পরিয়াই গমন করিলাম। 

মলঙ্গা লেন নামক গলির শেষপ্রান্তে মহম্মদের বাড়ী। জমীদারের নিকট হইতে জমী খাজনা লইয়া নিজ ব্যয়ে সে সেই খোলার বাড়ী প্রস্তুত করাইয়াছিল। উৎকৃষ্ট আতসবাজী প্রস্তুত করিতে পারিত বলিয়া অনেক সৌখিন লোকের সে পরিচিত ছিল এবং নূতন নূতন বাজী প্রস্তুত করিয়া তাঁহাদিগকে দেখাইয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জ্জন করিত। মহম্মদের কখনও অর্থের অভাব হয় নাই। 

মলঙ্গা লেনে প্রবেশ করিলেই মহম্মদের বাড়ীখানি দেখিতে পাওয়া যায়। আমি দূর হইতে দেখিলাম, এক যুবতী তাহার বাড়ীর সদর দরজায় দাঁড়াইয়া অপরের সহিত হাস্য পরিহাস করিতেছে। আমার কেমন সন্দেহ হইল, আমি আর অগ্রসর না হইয়া নিকটস্থ এক বাড়ীর দরজার সম্মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। দেখিলাম, একজন যুবক তাহার নিকট গিয়া কি কথা কহিতে লাগিল। 

ঠিক সেই সময় আর একজন লোক সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিল। লোকটা যেন পরিচিত বলিয়া বোধ হইল। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “বাপু! মহম্মদ বাজীওয়ালার বাড়ীর দরজায় স্ত্রীলোকটিকে চেন?” 

সে একবারমাত্র নির্দ্দিষ্ট দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল “উনিই মহম্মদের চতুর্থ পত্নী।” 

আ। মহম্মদ ত মারা পড়িয়াছে, তাহার স্ত্রীর এত আনন্দ? 

লো। উনি আদরের স্ত্রী ছিলেন। স্বামীর ভাল মন্দের সঙ্গে উহার বড় একটা সম্পর্ক নাই। 

আ। চরিত্র কেমন? 

লো। আপনি স্বচক্ষেই দেখুন। কাল যাহার স্বামী-বিয়োগ হইয়াছে, সে যখন আজ অপর পুরুষের সহিত হাসি তামাসা করিতেছে, তখন আর আমার বলিবার প্রয়োজন নাই। 

এই বলিয়া সে হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। আমিও আর সেখানে অপেক্ষা না করিয়া মহম্মদের বাড়ীর দিকে গমন করিলাম। 

বাড়ীর দরজার নিকটে যাইবামাত্র সেই যুবক দৌড়িয়া পলায়ন করিল। যুবতীও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। আমি একা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। 

কিছুক্ষণ পরে মহম্মদের স্ত্রী এক প্রৌঢ়াকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় তথায় আগমন করিল। আমি তখন প্রৌঢ়াকে জিজ্ঞাসা করিলাম “মহম্মদের স্ত্রী এইমাত্র কোথায় গিয়াছিল? এ বাড়ীতে যখন একটা হত্যাকাণ্ড হইয়াছে, তখন সকল সময় একজন লোক এখানে থাকা নিতান্ত আবশ্যক।” 

প্রৌঢ়া গম্ভীর ভাবে উত্তর করিল “মাল্কা এতক্ষণ এখানেই ছিল। আপনাকে দেখিবামাত্র দৌড়িয়া আমাকে ডাকিতে গিয়াছিল।” 

আ। কেন? আমি ত আর বাঘ নহি? 

প্রৌ। আপনার সহিত কথা কহিতে উহার লজ্জা করে। 

আ। কেন? অপরের সহিত কথা কহিতে লজ্জা হয় না? 

প্রৌ। মাল্‌ল্কা যুবতী—সে কেমন করিয়া একা আপনার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কথা কহিবে? 

আ। সত্য। কিন্তু আমি যে এইমাত্র উহাকে অপর একজন যুবকের সহিত কথা কহিতে দেখিলাম। 

প্রৌঢ়া সহসা কোন উত্তর দিল না। সে মাল্কার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল “বাবু কি বলিতেছেন, শুনিতেছ? কাহার সহিত কথা কহিতেছিলে?” 

মাল্‌ল্কা কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া তখনই উত্তর দিল “কই—আমি আবার কাহার সহিত কথা কহিয়াছি? আমি ত সেই অবধি কাঁদিয়াই বেড়াইতেছি। আমার কি এখন কথা কহিবার সময়? আমার দশা কি হইবে বল দেখি? আমার ভরণ-পোষণ কোথা হইতে সংগ্রহ করিব, ভাবিয়া দেখ দেখি? বাবুকে দেখিয়াই আমি তোমার কাছে দৌড়িয়া গিয়াছিলাম।” 

মাল্‌ল্কা এই কথাগুলি এমন ভাবে বলিয়াছিল যে, আমি তাহার সকল কথাই শুনিতে পাইলাম। প্রৌঢ়াকে আর কষ্ট না দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তবে এখানে যে যুবক দাঁড়াইয়াছিল, সে কে?” 

মাল্কা নিজেই উত্তর করিল “তাহার নাম হোসেন। সে আমাদের কর্তাকে “মামা” বলিয়া ডাকিত। সম্বন্ধে আমি তাহার মামী। সে এই বাড়ীর দরজায় দাঁড়াইয়া হাসিতেছিল বটে। কিন্তু সে আমায় দেখিয়া হাসে নাই।” 

আ। তবে কাহাকে দেখিয়া হাসিয়াছিল? সেখানে তখন ত আর কোন লোক ছিল না? 

মা। ছিল-আমাদের পার্শ্বের বাড়ীর ছাদে মতিবিবি দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি হোসেনকে বড় ভালবাসেন। আ। মতিবিবি কে? সধবা কি বিধবা? 

মা। সধবা। 

আ। বয়স কত? 

মা। প্রায় ত্রিশ বৎসর। 

আ। হোসেনের বয়স ও ত প্রায় ওইরূপ? 

মা। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। মতিবিবির স্বামী কি কার্য্য করেন? 

মা। কিছুই নয়। তিনি বড়লোক, পয়সার অভাব নাই। 

আমি আর কোন কথা না বলিয়া তখনই তথা হইতে বাহির হইলাম এবং মতিবিবির বাড়ীতে গমন করিলাম। প্রৌঢ়ার নিকট হইতে মতিবিবির স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তাঁহার নাম হাফেজ আলি। 

বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র একজন ভৃত্য আমার নিকট আসিয়া আমার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল। আমি তাহাকে হাফেজ আলি বাড়ীতে আছেন কি না জিজ্ঞাসা করিলাম। 

ভৃত্যের মুখে শুনিলাম, তিনি বাড়ীতে আছেন। ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারে?” 

আমার পুলিসের বেশ দেখিয়াই হউক বা যে কোন কারণে হউক, ভৃত্য তখনই বাড়ীর ভিতর গেল এবং সত্বরে ফিরিয়া আসিয়া আমাকে পরম সমাদরে উপরে লইয়া গেল। 

উপরে উঠিয়াই দেখিলাম, এক প্রকাণ্ড দালান। তাহারই মধ্যস্থলে একখানা প্রকাণ্ড সতরঞ্চের উপর একটা বড় টেবিল। টেবিলের চারিদিকে দশ বারখানি ভাল ভাল চেয়ার। টেবিলের উপর তিন চারিখানি সংবাদপত্র ও পাঁচ ছয়খানি পুস্তক ছিল। তিনজন লোক সেই স্থানে বসিয়া সংবাদপত্র পাঠে নিযুক্ত ছিলেন। ভৃত্য আমাকে একেবারে সেইখানে লইয়া গেল এবং একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের দিকে চাহিয়া বলিল “ইনি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।” 

ভৃত্যের কথা শেষ হইতে না হইতে উপস্থিত সকলেই চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং অতি যত্ন করিয়া আমাকে একখানি চেয়ারে বসিতে অনুরোধ করিলেন। আমি অগ্রে অতি বিনীত ভাবে সকলকে বসিতে বলিয়া স্বয়ং নির্দিষ্ট চেয়ারে উপবেশন করিলাম। 

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলে পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনাদের মধ্যে মুনসী হাফেজ আলি কে?” 

ভৃত্য যাঁহার দিকে চাহিয়া আমাকে দেখাইয়াছিল, তিনি অতি নম্র ভাবে উত্তর করিলেন “এই হতভাগ্যের নামই হাফেজ আলি। বলুন, আপনার কোন্ কার্য্য করিতে হহবে?” 

হাফেজ আলি কেবল ধনবান নহেন, তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনিও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন “অর্থই একমাত্র সৌভাগ্যের কারণ নহে। স্বীকার করি, আমার অর্থ আছে, চাকরী করিয়া উদরান্নের সংস্থান করিতে হয় না, প্রকাণ্ড বাড়ীতে বাস করিতেছি, উৎকৃষ্ট উপাদেয় খাদ্য ভক্ষণ করিতেছি, কিন্তু তত্রাপিও আমি হতভাগ্য। অর্থ হইলেই যে লোক সৌভাগ্যবান হয় না, আমিই তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।” 

হাফেজ আলির কথাগুলি সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু কেন যে তিনি একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত বিশেষ পুলিস-কৰ্ম্মচারীর নিকট এত কথা বলিলেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তিনি যে আন্তরিক অসুখী, তাঁহার মনে যে কোন ভয়ানক দুঃখের আগুন জ্বলিতেছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি সাহস করিয়া সে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। 

কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “মনের প্রকৃত অসুখ নিবারণ করিবার জন্য অনেক সময় কৃত্রিম আমোদে মত্ত থাকিতে হয়। আমি যে বন্ধু-বান্ধব লইয়া সদাই এইরূপ আনন্দে মত্ত থাকি, সে কেবল আমার মনের অসুখ দূর করিবার জন্য, আমি এ সকল আমোদের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করিতেছি তাহা মনেও করিবেন না।” 

হাফেজ আলি যে সত্য সত্যই বড়ই ব্যথিত তাহা তাঁহার কথাতেই বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু কেন তিনি এমন কথা বলেন, কেন এত দুঃখ করিতেছেন, তাঁহার এত কষ্ট কি জন্য? এই সকল কথা জানিবার জন্য আমার বড়ই কৌতূহল জন্মিল। আমি অতি বিনীত ভাবে বলিলাম “আপনার সহিত আমার কিছু প্রয়োজন আছে। যদি বিরক্ত না হন, তাহা হইলে কিছুক্ষণ নিৰ্জ্জনে আপনার সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করি।” 

আমার কথায় অপর দুইজন লোক যেন বিরক্ত হইলেন; তাঁহারা আমার দিকে রাগান্বিত ভাবে চাহিয়া রহিলেন। কিন্তু হাফেজ আলি সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করিলেন না। তিনি আমার দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া গাত্রোত্থান করিলেন; পরে বলিলেন “আসুন, আমরা পার্শ্বের ঘরে যাই।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যে প্রকোষ্ঠে হাফেজ আলি আমাকে লইয়া গেলেন, সে ঘরটি ছোট, কিন্তু এমন সুন্দররূপে সজ্জিত, যেন একখানা ছবি বলিয়া বোধ হয়। ঘরের ভিতর দুইখানি মাত্র বসিবার আসন ছিল, একখানিতে আমাকে বসিতে বলিয়া অপরখানিতে স্বয়ং উপবেশন করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে আমি বলিলাম “আপনার কথা শুনিয়া আপনাকে বড়ই দুঃখিত বলিয়া বোধ হয়। আমিও একটা দুঃসংবাদ লইয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। এ সময়ে সে কথা আপনাকে জানান উচিত নয়। কিন্তু কি করিব, নিতান্ত প্রয়োজন বলিয়াই সে কথা বলিতে বাধ্য হইলাম।” 

বাধা দিয়া হাফেজ আলি বলিলেন “আমি যে ভয়ানক অসুখী, আমার ন্যায় হতভাগ্য যে এ জগতে অতি অল্প, তাহা আমার বেশ জানা আছে, কিন্তু কি করিব? কেবল দুঃখ করিয়া নিজের জীবনের ক্ষতি করি কেন? আপনি যাহা বলিতে আসিয়াছেন, স্বচ্ছন্দে বলুন, আমার কোন আপত্তি নাই।”

আমি বলিলাম “আপনার কোন প্রতিবেশীর মুখে শুনিলাম, আপনার স্ত্রী ছাদে উঠিয়া অপর এক যুবকের দিকে চাহিয়া হাসিতেছিলেন। কথাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি। আমার অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন।” 

হাফেজ আলি হাসিয়া উঠিলেন। তিনি বলিলেন “এই জন্য আপনি এত কিন্তু হইতেছেন? যাহা শুনিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। আমি না দেখিলেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।” 

হাফেজ আলির কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। কিছুক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে নির্নিমেষ, নয়নে চাইয়া রহিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি স্বামী হইয়া জানিয়া শুনিয়াও যে নিশ্চিন্ত রহিয়াছেন?” 

হাসিতে হাসিতে তিনি উত্তর করিলেন “কি করিব, উপায় নাই।” 

আ। সে কি! উপায় নাই? 

হা। আজ্ঞে হাঁ—আমার স্ত্রী উন্মাদ পাগলিনী। কত ডাক্তার, কবিরাজ, হাকিম দেখান হইল, কিছুতেই কিছু হইল না। 

আ। কোনপ্রকার উৎপাত করেন? 

হা। কই, বিশেষ কোন উপদ্রব নাই। কেবল যথা ইচ্ছা গতিবিধি, লজ্জা-সরম কিছুমাত্র নাই, আহার নিদ্রা প্রায় নাই, সদাই মুখে হাসি, কখনও কখনও নানাপ্রকার মুখভঙ্গি, এই সকল উপদ্রব আছে। 

আ। বাধা দিলে কি করেন? 

হা। সৰ্ব্বনাশ! বাধা দিলেই উপদ্রব। এমন কি আত্যহত্যা করিতেও কুণ্ঠিত হইবে না। 

আ। তবে আর তাঁহার চরিত্র-দোষ কোথায়? তিনি ত সতী লক্ষ্মী। 

হাফেজ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “যেদিন আমার মন হইতে সে বিশ্বাস যাইবে, সেইদিনই যেন আমার মৃত্যু হয়।” 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “তবে আপনি সৌভাগ্যবান নয় কিসে?”

পরে বলিলাম “তেরল নামে এক গ্রাম আছে। সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালীর স্বপ্নাদ্য এক বালা আছে। সেখানে গিয়া সেই বালা পরাইয়া আনিলে পাগল ভাল হয়। অনেকেই সেই বালা পরিয়া আরোগ্য হইয়াছে। আপনি সেই বালা আনিবার চেষ্টা করুন, আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই আরোগ্য হইবেন, তাহা হইলেই আপনারও বৈরাগ্য শেষ হইবে।” হাফেজ আলি বড় সরল প্রকৃতির লোক, তিনি হাসিয়া আমার কথায় সম্মত হইলেন। আমিও কিছুক্ষণ পরে বিদায় প্রার্থনা করিলাম। তিনি কিন্তু সম্মত হইলেন না; বলিলেন “আমার একটি জিজ্ঞাস্য আছে-যদি অভয় দেন বলিতে পারি।” 

আমি বলিলাম “স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করুন।” 

তিনি বলিলেন “আমার স্ত্রীর কথা জানিয়া আপনার লাভ কি? কোন্ অভিপ্রায় সিদ্ধির জন্য আপনি এখানে আসিয়াছেন?” 

আ। আপনার বাড়ীর নিকটেই মহম্মদ নামে একজন লোক বাস করিত জানেন? 

হা। সে হঠাৎ কাল মারা পড়িয়াছে? 

আ। আজ্ঞে হাঁ। 

হা। বেশ জানি। লোকটার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়ও ছিল। 

আ। তাহার স্ত্রীর মুখে কথা শুনিয়া সত্য মিথ্যা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি। 

হাফেজ আলি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; পরে বলিলেন “আপনার কথা বুঝিতে পারিলাম না। একজন সামান্য চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিয়া আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তি কেন যে এ কষ্ট স্বীকার করিলেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম না।” 

আ। সকল কথা না শুনিলে না বুঝিবারই কথা। আমি যখন এই গলির মোড়ে আসিয়া উপস্থিত হই, তখন মহম্মদের বাড়ীর দরজার সম্মুখে এক রমণীকে অপর এক পুরুষের দিকে চাহিয়া হাসিতে দেখিয়াছিলাম। মহম্মদের স্ত্রীর উপরেই আমার সন্দেহ। কিন্তু সে নিজ দোষ ক্ষালনের জন্য আপনার স্ত্রীর স্কন্ধে উহা চাপাইতে চেষ্টা করিয়াছিল। 

হাফেজ আলি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, তিনি বলিলেন “কি সর্বনাশ! বিনা অপরাধে একজনের বিরুদ্ধে অপর লোক এমন করিয়াও বলিতে পারে জানিতাম না।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন? তবে কি আপনার স্ত্রী আজ ছাদে যান নাই?” 

হা। আজ্ঞে না–সে আজ এখানে নাই। 

আ। কোথায়? 

হা। পিত্রালয়ে। অন্ধই হউক আর খঞ্জই হউক, সকলেই পিতামাতার আদরের ধন। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম; পরে বলিলাম “এ কথা ত আপনি পূর্ব্বে বলেন নাই। তাহা হইলে আমাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করিতে হইত না। এখন দেখিতেছি, এ সমস্তই সেই মহম্মদের স্ত্রীর চাতুরী। নতুবা সে কেন আপনার স্ত্রীর উপর মিথ্যা দোষারোপ করিবে। সে যাহা হউক, আপনি কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে মহম্মদের স্ত্রীকে চরিত্রহীনা বলিয়া উল্লেখ করিলেন কেন? তাহার চরিত্রের বিষয় আপনার কিছু জানা আছে কি?” 

হা। আমি নিজে কিছুই জানিতাম না। তবে আমার বন্ধুগণের মুখে ওই প্রকার কথাই শুনিতে পাই। 

আ। আপনার সেই বন্ধু কি এখন এখানে উপস্থিত আছেন? 

হা। সকলে নাই—তাঁহাদের মধ্যে একজন আছেন। 

আ। একবার তাঁহাকে এইখানে ডাকিতে পারেন? এ সকল বড়ই গোপনীয় কথা, সকলের সমক্ষে প্রকাশ করিলে কার্য্যহানি হইবার সম্ভাবনা। 

হাফেজ আলি একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া সেই বাবুকে সেখানে আনয়ন করিতে আদেশ করিলেন। ভৃত্য চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে আর একজনের সহিত পুনরায় সেই ঘরে উপস্থিত হইল। 

হাফেজ আলি অগ্রে ভৃত্যকে সেখান হইতে প্রস্থান করিতে ইঙ্গিত করিয়া আমার দিকে চাহিলেন। পরে বলিলেন “আমার এই বন্ধুর নাম আমেদ আলি। ইনিই আমাকে সেই কথা বলিয়াছিলেন।” 

ভৃত্য সেখান হইতে প্রস্থান করিলে পর, আমি আমেদ আলির দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার বাড়ী কি এই পাড়ায়?” 

আমে। আজ্ঞে না—এখান হইতে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টার পথ। তবে আমি অধিকাংশ সময়ই এখানে থাকি। এ পাড়ার সকলেই আমার বেশ পরিচিত। 

আমি। আপনি মহম্মদ বাজীওয়ালাকে নিশ্চয়ই চেনেন? 

আমে। আজ্ঞে হাঁ—আমি কেন অনেকেই তাহার পরিচিত ছিল। বেচারি কাল হঠাৎ মারা পড়িয়াছে। 

আমি। আপনি তাহার স্ত্রী মালকাকে জানেন? 

আমে। বেশ জানি—তাহার মত ধূর্তা রমণী আজ-কালের বাজারে অতি অল্প। 

আমি। কেমন করিয়া আপনি তাহার ধূর্ততা জানিতে পারিলেন? 

আমে। তাহারই স্বামীর মুখে শুনিয়াছি। 

আমি। মহম্মদ কি বলিয়াছিল? সে কি তাহার স্ত্রীর চরিত্র জানিত? 

আমে। বেশ জানিত—কিন্তু একে চতুর্থ পক্ষের স্ত্রী, তাহাতে যুবতী; কিছুতেই মহম্মদ বশীভূত করিতে পারে নাই। 

আমি। আপনি স্বচক্ষে কিছু দেখিয়াছেন? 

আমে। না দেখিলে কি আপনার মত সম্ভ্রান্ত পুলিস-কর্মচারীর নিকট সাহস করিয়া বলিতে পারিতাম?

আমি। কি দেখিয়াছেন? 

আমে। পাড়ার অনেক যুবকের সহিত তাহার গুপ্তপ্রেম আছে। আমি স্বচক্ষে তাহাদিগের সহিত মাল্‌ল্কাকে প্রেমালাপ করিতে দেখিয়াছি। 

আমি। তবে কি এখানকার সকলেই তাহার প্রেমাকাঙ্ক্ষী? 

আমে। আজ্ঞে হাঁ—অনেকেই বটে। তবে দুই একজন কিছু বেশী। 

আমি। তাহাদিগকে জানেন? 

আমে। আজ্ঞে-একজনকে বেশ চিনি। 

আমি। কে সে? তাহার নাম কি? 

আমে। হোসেন আলি। 

আমি। বাড়ী কোথায়? 

আমে। ঠিক জানি না-সে এ পাড়ার লোক নয়। 

আমি। হোসেন আলির সহিত মহম্মদের কোন সম্বন্ধ ছিল? 

আমেদ আলি হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন কোনই সম্পর্ক ছিল না। সাধ করিয়া সে মহম্মদকে মামা বলিয়া ডাকিত।” 

আমি আর কোন প্রশ্ন করিলাম না। আমেদ আলিকে বিদায় দিয়া হাফেজ আলির নিকট বিদায় লইলাম এবং নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে পুনরায় মাল্কার বাড়ীতে গমন করিলাম। 

যখন মহম্মদের বাড়ী দ্বিতীয়বার গমন করিলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, হোসেন আলি সেই প্রৌঢ়ার সহিত কথা কহিতেছে। আমাকে দেখিয়া সকলেই নিস্তব্ধ হইল, দেখিয়া আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। 

কিছুক্ষণ পরেই হোসেন আলি সেখান হইতে প্রস্থান করিল দেখিয়া, আমি আরও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করিলাম। পরে প্রৌঢ়াকে দুই একটা কথা বলিয়া সত্বর সেখান হইতে বাহির হইলাম। 

হোসেন কোথায় যায়, তাহাই আমার জ্ঞাতব্য ছিল। ভাবিয়াছিলাম, পথের বাহির হইয়া তাহাকে দেখিতে পাইব না, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কিছুদূর অগ্রসর হইবার পরই তাহাকে দেখিতে পাইলাম এবং তাহার অগোচরে পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। 

হোসেন আলি ক্রমাগত গমন করিয়া শিয়ালদহে একটা অট্টালিকায় প্রবেশ করিল। আমি বাড়ীটা বিশেষ লক্ষ্য করিয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম এবং সত্বর ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া পুনরায় সিয়ালদহে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

হোসেন আলি যে বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, সে বাড়ীটী ক্ষুদ্র বটে কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ীর দক্ষিণ দিকে একটি প্রশস্ত বৈঠকখানা। পথ হইতেই সেই বৈঠকখানা দেখিতে পাওয়া যায়। 

আমি পথ হইতেই সেই ঘরের ভিতর লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, দুইজন লোক গোপনে কি কথাবার্তা কহিতেছেন। 

কিন্তু কথাগুলি এমন ভাবে উচ্চারিত হইতেছিল যে, আমি পথ হইতেই তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছিলাম। কথাগুলি শুনিয়া আমার কৌতূহল এত বৃদ্ধি হইল যে, আমি তখন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ না করিয়া গোপনে সেই সকল বিষয় শুনিতে মনস্থ করিলাম। 

যে দুইজন কথা কহিতেছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে একজনকে হোসেন আলি বলিয়াই বোধ হইল। অপর ব্যক্তি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। হোসেন আলিকে আমি বলিতে শুনিলাম, “বড় বিষম বিপদেই পড়িলাম। কেমন করিয়া আমি বিশ্বাস করিয়া তাহাকে বিবাহ করিব? স্বামী বর্তমানে যাহার এমন চরিত্র, তাহাকে কেমন করিয়া বিশ্বাস করিব?” 

অপর ব্যক্তি হাসিয়া উঠিলেন, তিনি বলিলেন “তোমার মত পাগল ত আর কখনও দেখি নাই। যে কাজ সে করিয়াছে, তাহাতে কোন ভদ্র পরিবার তাহাকে গৃহে লইবে? তুমি নিকা করিলেও তাহাকে এ বাড়ীতে আনিতে পারিবে না।” 

হো। কেন? 

অ। আমরা এ বাড়ীতে তাহার মত স্ত্রীলোককে স্থান দিব না। কুসংসর্গে থাকিয়া শেষে কি আমাদের বাড়ীর মহিলারা পৰ্য্যন্ত নষ্ট হইবে? 

হো। তবে আমি মুখ দেখাইব কেমন করিয়া? 

অ। কাহার নিকট তোমার মুখ দেখাইতে ভয়? হো। যাহার কথা বলিতেছি। 

অপরিচিত ব্যক্তি উচ্চহাস্য করিলেন। পরে বলিলেন “কুলটার সহিত যত সম্বন্ধ না রাখিবে, ততই মঙ্গল। তাহার নিকট তোমার আর মুখ দেখাইবার প্রয়োজন কি?” 

হো। সে কি কথা? মরদ কি বাত, হাতী কি দাঁত, নিজের মান নিজের নিকট। একবার দেখা করিয়া মনের কথা ব্যক্ত না করিলে আমি কিছুতেই সন্তুষ্ট হইব না। 

অ। তোমাদের কি প্রকার কথা হইয়াছিল বল দেখি? তাহার পর কি কর্তব্য আমি বলিয়া দিতেছি। 

হোসেন বলিল, “একদিন মাল্‌ল্কা কথায় কথায় বলিয়াছিল, তাহার স্বামী বৃদ্ধ, নিশ্চয়ই শীঘ্র মারা পড়িবে। অল্প বয়সেই তাহাকে বিধবা হইতে হইবে। যখন সে দিন উপস্থিত হইবে, আমি তাহাকে নিকা করিব কি? আমি তাহাকে বড়ই ভালবাসি। সেও আমাকে অত্যন্ত ভালবাসে। যে ভাবে সে কথাগুলি বলিল, তাহাতে আমি সম্মত হইলাম, বলিলাম, যদি সে দিন উপস্থিত হয়, নিশ্চয়ই নিকা করিব। এখন সে দিন উপস্থিত, আমি কথামত ও কার্য্য না করিলে তাহার নিকট হেয় হইতে হইবে।” 

অপর ব্যক্তি হোসেনর কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন “তোমার মত মূর্খ আর কয়জন আছে? যখন রমণী পূর্ব্বেই কথা বলিয়াছে, তখন তাহার স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর উপর তোমার কি কোনরূপ সন্দেহ হয় না? কতদিন পূর্ব্বে সে এ সকল কথা বলিয়াছিল মনে আছে?” 

হোসেন কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল “প্রায় মাসখানেক পূৰ্ব্বে।” 

অ। তবে? তোমার ঘটে কি এই সামান্য বুদ্ধিও নাই? 

বৈঠকখানার ভিতর একটি কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। তাহারই আলোকে দেখিলাম, হোসেন তাহার বন্ধুর কথা শুনিয়া চমকিত হইল। কিছুক্ষণ পরে বলিয়া উঠিল “কি সৰ্ব্বনাশ তাহাও কি সম্ভব? না না খোদাবক্স, তুমি অন্যায় সন্দেহ করিতেছ?” 

খোদাবক্স বলিলেন, তোমার মনে ত সেইরূপই হইবে। প্রেম তোমায় অন্ধ করিয়াছে। প্রেমিক কি প্রেমিকার অপরাধ দেখিতে পায়? কিন্তু যদি এ সকল পুলিসে জানিতে পারে, তাহা হইলে এখনই তোমার একটা সুবিধা হইয়া যায়। 

হোসেন সাগ্রহে বলিয়া উঠিল “কি সুবিধা?” 

খো। মাল্কার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার সুবিধা। 

হো। মাল্‌ল্কা আর আমি ছাড়া সকল কথা আর কেহ জানে না। 

খো। এইবার আমি জানিলাম। 

হো। তুমি কিছু পুলিসে বলিতেছ না। 

খো। তোমায় রক্ষা করিবার প্রয়োজন হইলে করিতে হইবে। 

হো। আমায় রক্ষা করিবার প্রয়োজন হইবে না। আমি মাল্কাকে বিবাহ করিব না। 

খোদাবক্স স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। পরে হোসেন আলির দিকে চাহিয়া বলিলেন “কেন 

ভাই! সহসা এ পরিবর্তন কেন?” 

হোসেন খোদাবক্সের নিকট সরিয়া গেল, পরে কাণে কাণে কি কথা বলিল; আমি বাহিরে থাকিয়া সে কথা শুনিতে পাইলাম না। কিন্তু সে কথা শুনিয়া খোদাবক্স বলিয়া উঠিলেন “তবে? এ যে বিষম কথা, আমার সন্দেহ যে ক্রমেই বাড়িতে লাগিল।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

হোসেন আলি সে কথার উত্তর না দিয়া অন্য কথার অবতারণা করিল। তাহার বন্ধুও সেই কথায় যোগ দিলেন। কাজেই মাল্কার কথা আর কিছুই শুনিতে পাইলাম না। 

প্রায় দশ মিনিট আন্দাজ একটি জানালার পার্শ্বে লুকাইয়া যখন পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি শুনিলাম, তখন ভাবিলাম, এতক্ষণে বোধ হয় প্রকৃত সূত্র পাইবার আশা হইল। 

সুযোগ বুঝিয়া আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম এবং সেই বৈঠকখানার দ্বার সমীপে দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মহাশয়, হোসেন আলি কাহার নাম? শুনিলাম, তিনি এই বাড়ীতেই বাস করেন।” 

হোসেন আলি স্বয়ং দাঁড়াইয়া আমায় অভ্যর্থনা করিলেন এবং অতি যত্নের সহিত নিকটে বসিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমার দিকে চাহিয়া অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়! আপনার কোন্ কার্য্য করিব বলুন?” আমি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মলঙ্গায় মহম্মদ নামে আপনার না কি এক মাতুল বাস করেন। গত কল্য তাহার সহসা মৃত্যু হইয়াছে শুনিয়াছেন বোধ হয়?” 

হোসেন আলি সায় দিয়া বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, শুনিয়াছি বটে, মহম্মদ নামে আমাদের এক মুসলমান সহসা মারা পড়িয়াছেন। কিন্তু তিনি আমার মাতুল নহেন।”

আ। তবে মহম্মদের প্রতিবেশিগণ সে কথা বলে কেন? আপনি নিশ্চয়ই মাতুল সম্বোধন করিতেন। হোসেন আলি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ, করিতাম বটে।” 

আ। তবে আপনার সহিত সে বাড়ীর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে? 

হো। সে কি? 

আ। সেখানে যাতায়াত, আলাপ-পরিচয় ইত্যাদি আছে? 

হোসেন আলি আমার দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিলেন। পরে বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, মধ্যে মধ্যে সেখানে যাই বটে।” 

আ। আপনার সহিত আপনার মাতুলানীরও সদ্ভাব আছে? 

হোসেন আলি রাগান্বিত হইলেন। খোদাবক্স আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে হোসেন আলি জিজ্ঞাসা করিলেন “সে সকল কথায় আপনার প্রয়োজন কি? আপনি কে? কেনই বা এরূপ অযাচিত ভাবে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?” 

আমি আর থাকিতে পারিলাম না। বলিয়া উঠিলাম “আমি একজন পুলিসের লোক। আপনারা এই কতক্ষণ ওই সম্বন্ধে যে সকল কথা বলিতেছিলেন, আমি সেই সমস্ত কথা শুনিতে পাইয়াছি, যদি সকল কথা পুনরায় না বলেন, তাহা হইলে আমায় অন্য অবলম্বন করিতে হইবে।” 

আমার কথা শুনিয়া উভয়েই স্তম্ভিত হইলেন। উভয়েরই মুখ মলিন হইয়া গেল। মুখ দিয়া কোন কথা বহির্গত হইল না। 

কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আপনারা সহজে সকল কথা বলিবেন কি না তাহা ব্যক্ত করুন।” হোসেন আলি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “যদি গোপনে আমার সকল কথাই শুনিয়া থাকেন, তবে আবার শুনিতে চাহিতেছেন কেন?” 

আ। কারণ আছে—মাল্কাকে আপনি বিবাহ করিবেন না কেন? 

হো। সে কথা আপনাকে বলিব কেন? 

আ। আপনারই উপকারের জন্য। আপনি জানেন না যে, মহম্মদের মৃত্যুর জন্য অনেকে আপনার উপরই সন্দেহ করিতেছে। 

হোসেন আলি চমকিত হইলেন। তিনি শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন? তাহাদের এ অন্যায় সন্দেহের কারণ কি? 

আ। অন্যায় কিসে? মহম্মদ না মরিলে যখন আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না, তখন তাহাকে হত্যা করিয়া কণ্টক যে একেবারে দূর করেন নাই, সে কথা কে বলিবে? 

হোসেন আলি আমার কথার মর্ম্ম বুঝিতে পারিলেন। তিনি অসহায় ভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে আপনাকে ও সকল কথা বলিল?” 

আমি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলাম “সে কথার আপনার প্রয়োজন কি? যদি আপনার দোষ না থাকে, তাহা হইলে আপনার এরূপ ভয়েরই বা কারণ কি? 

হো। ভয়? যথেষ্ট আছে। আপনারা পুলিসের লোক, সামান্য সূত্র পাইলে এখনই একটা ভয়ানক কাণ্ড বাধাইবেন।

আ। আপনার কোন ভয় নাই। যদি আপনি প্রকৃত নির্দোষী হন, তাহা হইলে আমার দ্বারা আপনার কোনপ্রকার অনিষ্টের আশঙ্কা নাই। 

হো। আপনি কি জানিতে চান বলুন, আমি যথাসাধ্য উত্তর দিব। আমি ঈশ্বরের শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, মহম্মদের মৃত্যুর বিষয় আমি কিছুই জানি না। 

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি মাল্‌ল্কাকে বিবাহ করিতে কি স্বীকার করিয়াছিলেন?

হো। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। এখনও রাজী আছেন? 

হো। না। 

আ। কেন? 

হো। তাহার চরিত্র ভাল নয়। যে আপনার স্বামীর উপর সন্তুষ্ট না হইয়া পরপুরুষের উপর নজর দেয়, তাহাকে বিবাহ করিয়া সুখী হইতে পারিব না। 

আ। মাল্‌ল্কা আপনাকেই ভালবাসে। আপনার জন্যই কুলটা বলিয়া তাহার অখ্যাতি হইয়াছে। 

হোসেন হাসিয়া উঠিলেন। পরে বলিলেন আমিও পূর্ব্বে সেইরূপ ভাবিতাম। কিন্তু এখন আমার চক্ষু ফুটিয়াছে। সে আরও একজনকে আমা অপেক্ষাও ভালবাসে।” 

আ। তবে কি মাল্‌ল্কা আপনার সহিত বিবাহ করিয়া অপরের সহিত গোপনে প্রণয় করিতে অভিলাষ করিয়ছিলেন?

হো। আজ্ঞে হাঁ—আমি ত এখন সেইরূপই বুঝিয়াছি। 

আ। মাল্কা কাহাকে এত ভালবাসে বলিতে পারেন? 

হো। আব্বাস আলি নামে মহম্মদের একজন কারিকরের সহিত তাহার গুপ্ত প্রেম আছে। 

আ। আব্বাস আলি থাকে কোথায়? 

হো। কাঁকুড়গাছিতে মহম্মদের যে বাগান আছে, সেই বাগানে থাকে। 

আমি কিছুক্ষণ ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আমাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারেন?” 

হোসেন আলি সম্মত হইলেন। তিনি বলিলেন “চলুন, এই সময়ে সে নিশ্চয়ই সেখানে আছে।” আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া গাত্রোত্থান করিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

পথে আসিয়া সৌভাগ্যক্রমে একখানা গাড়ি দেখিতে পাইলাম। বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা উভয়ে তাহাতে আরোহণ করিলাম, পথে কোচম্যানকে কাঁকুড়গাছি যাইতে বলিয়া দিলাম। 

মানিকতলার পোল পার হইয়া গাড়িখানি ক্রমাগত পূৰ্ব্বমুখে অন্ধকারময় পথ দিয়া যাইতে লাগিল এবং প্রায় একঘণ্টার পর একখানি প্রকাণ্ড বাগানের ফটকে আসিয়া থামিল। হোসেন আলি আমাকে সেই স্থানে অবতরণ করিতে অনুরোধ করিলেন এবং স্বয়ং ধীরে ধীরে সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও গাড়ি হইতে সত্ত্বর অবতরণ করিয়া তাঁহার অনুসরণ করিলাম। 

কিছুদূর যাইলে পর একটি আলোক আমার দৃষ্টি গোচর হইল। আমরা অন্ধকারময় পথের উপর দিয়া সেই আলোক লক্ষ্য করতঃ গমন করিতে লাগিলাম। 

যখন সেই আলোকের নিকটবর্ত্তী হইলাম, তখন দেখিলাম, বাগানের ভিতর একখানি ক্ষুদ্র কুটীর হইতেই আলোক বাহির হইতেছিল। তখন অতি সন্তর্পণে উভয়ে সেই কুটীরের দ্বারে উপস্থিত হইলাম। সৌভাগ্যক্রমে কুটীরের সেইদিকে একটি ক্ষুদ্র জানালা খোলা ছিল। আমি সেই জানালার নিকট দাঁড়াইয়া উঁকি মারিয়া ভিতরে দেখিলাম। যাহা আমার দৃষ্টি গোচর হইল, তাহাতে মাল্‌ল্কাই যে মহম্মদকে খুন করিয়াছে তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম; এবং আর সেখানে অপেক্ষা না করিয়া হোসেন আলিকে তথায় রাখিয়া আমি একাই ভিতরে প্রবেশ করিলাম। 

ভিতরে চাহিয়া দেখিলাম, মাল্কা একজন অপর পুরুষের সহিত কথা কহিতেছে। মাল্কা যদিও অনেকবার আমাকে দেখিয়াছিল, তত্রাপি ছদ্মবেশে ছিলাম বলিয়া সে তখন আমাকে চিনিতে পারিল না, কিন্তু আমিও আত্ম পরিচয় না দিয়া থাকিতে পারিলাম না। অতি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম, মাল্‌ল্কা? তুমি এই রাত্রে এখানে কেন? 

আমার চীৎকার ধ্বনি শুনিয়া হোসেন আলি বেগে সেই গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং সত্য সত্যই মাল্‌ল্কাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন “কি সর্ব্বনাশ! এই রাত্রে এতদূরে আসিয়া কি কার্য্য করিতেছ? কাল তোমার স্বামীর সহসা মৃত্যু হইল, আর আজ কি না এই রাত্রিকালে স্বচ্ছন্দে এতদূরে আসিয়া একজন পরপুরুষের সহিত হাস্য পরিহাস করিতেছ? এই জন্যেই বুঝি তুমি আমাকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলে? এখন তোমাদের সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছি।” 

মাল্‌ল্কা কোন উত্তর করিল না। সে অবনতমস্তকে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। তখন আমি সেই যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার নাম কি বাপু? এই কুটীরখানি কাহার?” 

যুবককে বলবান বলিয়া বোধ হইল। কিন্তু আমার কর্কশ কথায় সে কোন উচ্চবাচ্য করিল না। অতি ধীরে ধীরে বলিল “আমার নাম আব্বাস আলি–আমি মহম্মদের একজন কারিকর। এই কুটীরে আমি বাস করি।” 

আ। এ বাগান কার? 

আব্বাস। মহম্মদেরই জমা আছে। এই বাগানেই আতসবাজী প্ৰস্তুত হইত। 

আ। এখানে কেন? 

আব্বাস। সহরের ভিতর আতসবাজী প্রস্তুত করিবার হুকুম নাই। আমি যদিও সে কথা জানিতাম, তথাপি বলিলাম “সত্য না কি?” 

আব্বাস। আজ্ঞে হ্যাঁ। 

আ। এখন বল দেখি, মাল্কার সহিত গোপনে কি পরামর্শ করিতেছ? কোন কথা গোপন করিও না—আমি বাহিরে দাঁড়াইয়া তোমাদের সকল কথাই শুনিয়াছি। 

এই কথা আমার মুখ হইতে বহির্গত হইবামাত্র মাল্ল্কা আমার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। পরে আমার পদতলে পড়িয়া, দুই হস্তে আমার পদদ্বয় জড়াইয়া বলিল “এ যাত্রা আমায় রক্ষা করুন। আপনারা যে সন্ধান করিয়া এতদূর আসিবেন, তাহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই।”

আমি রাগান্বিত হইয়া অতি কর্কশভাবে পুনরায় বলিলাম “রক্ষার কথা এখন ছাড়িয়া দাও। যদি মঙ্গল চাও, পরিষ্কার করিয়া সকল কথা বল। সেঁকোবিষ কোথায় পাইলে?” 

মাল্‌ল্কা প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করিল না, অবশেষে অনেক ভয় দেখাইবার পর বলিল “এই আব্বাসই আমাকে বিষ দিয়াছিল এবং ইহারই পরামর্শে আমি জলের সহিত সেই বিষ মিশাইয়া আমার স্বামীকে পান করিতে দিয়াছিলাম।” আব্বাসকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে হইল না। সে মান্কার সকল কথাই স্বীকার করিল। পরে বলিল, “কখনও কখনও উৎকৃষ্ট রঙমশাল প্রস্তুত করিবার জন্য সেঁকোবিষের আবশ্যক হয়, মহম্মদের নিকট বিষ থাকিত। আমি তাহার কিয়দংশ একদিন চুরি করিয়াছিলাম। তাহার পর মাল্কার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তাহাকে পরামর্শ দিয়ছিলাম। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মাল্‌ল্কার দুঃখ কি?” 

আব্বাস আলি বলিল “বৃদ্ধের স্ত্রী বলিয়াই মাল্‌ল্কার দুঃখ।” 

আ। তোমার সহিত মান্কার সম্বন্ধ কি? 

আব্বাস। কিছুই নয়। আমি তাহার স্বামীর চাকর এই সম্বন্ধ। 

আ। আর কিছুই নয়? তোমাদের ভিতর কি গুপ্ত প্রণয় নাই? মাল্‌ল্কা বড় সামান্যা স্ত্রীলোক নয়। মহম্মদের মৃত্যুর পর সে হোসেনকে বিবাহ করিবে বলিয়াছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আবার তোমার সহিতও গুপ্তপ্রেমে মগ্ন ছিল।” এই বলিয়া আমি পুনরায় মাল্কার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মহম্মদকে তবে তুমিই বিষ-মিশ্ৰিত জল পান করিতে দিয়াছিলে?” 

মাল্‌ল্কা যখন দেখিল যে, আমি সকল কথাই জানিতে পারিয়াছি, তখন সে আর কোন কথা লুকাইতে চেষ্টা করিল না। সে স্পষ্ট করিয়া বলিল “হাঁ-আমিই দিয়াছিলাম, এখন আর আমার যন্ত্রণা সহ্য হইতেছে না। আপনারা আমায় ফাঁসী দিন।” 

আর ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া তখনই মাল্‌ল্কা, আব্বাস আলি ও হোসেন আলিকে লইয়া রাত্রি প্রায় দশটার সময় থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

সময়মত এই মোকদ্দমার বিচার হইয়া গেল। বিচারে মাল্কা ও আব্বাস আলি উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইল। 

সম্পূর্ণ 

[ আশ্বিন, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *