প্রেম ও যুদ্ধ
আমার সামনে এই যে আদিগন্ত মরুর বিস্তৃতি, আমার চারপাশে তরঙ্গায়িত বালির সমুদ্র, এটাই আমার দুনিয়া। এটাই আমার জীবন। এই ধূলির বিছানাতেই আমার মৃত্যু। এই বালির দুনিয়া আমার খুনের পিয়াসী নয়। কিন্তু আমি একে আমার রক্ত পান করাবো।
বালিময় এ মরু আমার-আমাদের। ফ্রান্সের নয়।
নিজ দেশের ধূলিকণা অন্য দেশের সোনার চেয়ে দামী-পবিত্র।
আমি এসব কথা জানতাম না। শুধু জানতাম, আলজাযায়ের আমার দেশ। ফ্রান্সীরা তা অন্যায়ভাবে দখল করে আমাদের মাথার ওপর রাজত্ব করছে। তারা আমাদের ভূমির উৎপন্ন ফসলের মালিক বনে যাচ্ছে জোর জবরদস্তি করে। মালিক আমাদের ইজ্জত সম্মানের; শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের লালিত ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের।
আমি এও জানি, আমাদের নেতারা, যুবক ভাইয়েরা ফ্রান্সীদের এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছেন। এ হলো পরাধীনতা থেকে মুক্তির যুদ্ধ, যুদ্ধ স্বাধীনতার। কিন্তু দখলদারদের মতে এ হলো বিদ্রোহ। দেশদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ। এর জন্য এরা যে শাস্তি বরাদ্দ রেখেছে তা শুনলে সারা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠবে।
আরেকটা রহস্যের কথা জানি আমি। আড়াই বছর ধরে আমার বাবা আমাদের বাড়ি থেকে গায়েব। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- এজন্য আমার মা মোটেও চিন্তিত ছিলেন না। মা আমাকে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন, ফ্রান্সীদের বিরুদ্ধে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে আমার বাবা সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি এই পুলিশের ওপর হামলা করছেন তো আবার কয়েদও হচ্ছেন। কৌশলে আবার ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছেন। গ্রেফতার হলে আবার জেল থেকে পালিয়ে আসছেন। এসে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন উদ্যম নিয়ে রণাঙ্গণে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। সয়ে যাচ্ছেন ফ্রান্সী পুলিশের অমানবিক নির্যাতন।
যার ভেতরে তার দেশের শুধু ভালোবাসা নয় বরং ভালোবাসার উন্মত্ততা আছে এবং নিজের রক্তাক্ত মাথায় প্রিয় মাতৃভূমির পতাকাটি সমুন্নত রাখার সংকল্পে শক্তিমান দৃঢ়চেতা একটি মন আছে; তারাই পায়ে সব নির্যাতন অত্যাচার হাসিমুখে বরণ করে নিতে।
অনেক কথা আমার বাবাও আমাকে বলেছেন। আমার কাছে মনে হতো এসব স্বপ্নযোগে পাওয়া কোন দৈব বাণী। যেন স্বপ্নে আমার বাবা এসেছিলেন এবং আমার রক্তে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে চলে গেছেন। ঘুম থেকে জাগার পর মা জানাতেন, হ্যাঁ সত্যিই গত রাতে তোমার বাবা এসেছিলেন।
এটা দুবছর আগের কথা। আমার বয়স তখন উনিশ। কয়েক মাস বেশিও হতে পারে। আমি ছিলাম গভীর ঘুমে। বাবা আমাকে জাগালেন। বড় কষ্টে আমার চোখের পাতা খুললো। মা ঋজু ভঙ্গিতে বাবার বাহু পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেক দিন পর বাবাকে দেখছিলাম আমি। কিন্তু আমার চোখ ঘুমে ভারী হয়ে আসছিলো। বাবার ভ্রূক্ষেপ ছিলো না সেদিকে। তিনি বলে যাচ্ছিলেন বড় দ্রুত। সব কথা মনে থাকার কথা নয়। পরে মা অবশ্য আমাকে বলে দিয়েছিলেন। সেদিন বাবার মধ্যে আমি কী যে এক অপার্থিব তেজ দেখেছিলাম।
সে রাতেই আমি জানতে পেরেছিলাম, বাবা গ্রেফতার হয়ে গিয়ে ছিলেন। একটা কথা বলা উচিত এখানে যে, বাবা কোন মামুলি লোক ছিলেন না। কাষ্টমূস প্রশাসনের অফিসার ছিলেন তিনি। আরবীর মতো ফ্রান্সও বলতে পারতেন চমৎকার। যে স্কুলে আমাকে ভর্তি করানো হয়েছিলো সেখানে বড় বড় অফিসার ও আমীর ঘরনার ছেলে মেয়েরা পড়তো। ফোর্থগ্রেড গভর্নিং বডির ছেলে মেয়েরাও আমাদের সঙ্গে পড়তো। ফ্রান্সী ছাড়াও ইতালি, জার্মানি, স্পেনিশ ও ইংলন্ডের ছেলে মেয়েরাও পড়তো এখানে। অর্থাৎ আমিও আমীর ঘরনার সন্তান ছিলাম। ছিলাম এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছেলে।
আমি আসলে বলতে চাই, জাতির নেতৃস্থানীয় ও বুদ্ধিজীবীরা যদি মনে করতে থাকে, ত্যাগ, সগ্রাম ও অত্যাচার সহ্য করা শুধু গরিবদের কাজ তাহলে সে জাতির অন্য জাতির বর্বর শ্রেণীর গোলাম বনে গিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু আলজাযায়েরের মুসলমানরা সে রকম ছিলো না। আমরা আমাদের ভূখণ্ড একদিন না একদিন ঠিকই স্বাধীন করে নেবো। কারণ, আমাদের আমীর, ফকির, অফিসার, কেরানী, দুর্বল, সবল সব এক ঝাণ্ডা তলে সমবেত হয়েছে।
চাকুরিতে থাকতেই বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা শুরু করেন। বাবার কাজ ছিলো, ফ্রান্সীদের অস্ত্র গোলাবারুদ ও যুদ্ধের অন্যান্য রসদপত্র যেসব গাড়িতে বহন করে নিয়ে যেতো সেগুলোর খবর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। অনেক ফৌজি তথ্যও সরবরাহ করতেন। গেরিলা মুজাহিদদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। মা আমাকে বলেছেন, ফ্রান্সের গোয়েন্দা পুলিশের সন্দেহভাজন তালিকায় বাবার নাম উঠে যায়। তারপর একদিন বাবা গ্রেফতার হয়ে যান।
এর ছয় মাস পর। এক রাতে বাবা আমাদের বাড়িতে এলেন। তিনি জাগালেন আমাকে। খুব তাড়াহুড়া করছিলেন। ঘরের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম, তার স্বাস্থ্য অনেকটা ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু চোখ দুটো হয়েছে আরো তীক্ষ্ম, ক্ষুরধার। মুখের পেশীগুলো আরো দৃঢ়। সমস্ত অবয়ব থেকে যেন কঠিন কোন অঙ্গীকারের দীপ্তি ঠিকরে বেরোচ্ছিলো।
আমার প্রিয় বেটা! কোন ভূমিকা ছাড়াই তিনি আমাকে বলতে লাগলেন আমাকে ভুলে যেয়ো। কিন্তু আমার কথাগুলো ভুলো না। আমাদের আর মিলন নাও হতে পারে। জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছি আমি তাই এখন আর প্রকাশ্যে এদিকে আসতে পারবো না।…
আমি মারা যাই বা জীবিত থাকি তোমার দায়িত্ব হলো এদেশ স্বাধীন করা। তোমাকে কি করতে হবে তোমার মা তোমাকে বলে দেবে। আমার ওসিয়ত মনে রেখো। আর মাথা থেকে বের করে দাও, তুমি কোন অফিসারের ছেলে। তোমাদেরকে আমি যে সুখের জীবন দিয়েছিলাম তাও ভুলে যাও।…
তোমাকে হয়তো মরুর তপ্ত বালিতে কোন ফ্রান্সীর গুলিতে বা ক্ষুৎ পিপাসায় মরতে হতে পারে। কিন্তু মরাটা কোন বাহুদুরী বিষয় নয়। মেরে মরার মধ্যে বীরত্ব আছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরে শত্রুকে ঘায়েল করে জীবিত ফিরে আসাকেই বীরত্ব বলে … আমি দেরী করতে পারবো না। পুলিশ আমার পিছু নিয়েছে- মনে আছে আমার বাবা আমাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে উঠেন- জেগে উঠো আমার বেটা! জেগে উঠো। যে কওমের নওজোয়ানরা ঘুমিয়ে পড়ে সে কওমের ভাগ্যের চাকাও থেমে যায়।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর আমার মাকে বললাম, মা! কাল রাতে স্বপ্নে বাবাকে দেখেছি। বাবা আমাকে এই এই বলেছেন স্বপ্নে। মা মুচকি হেসে বললেন, স্বপ্নে নয় বাস্তবেই তুমি তাকে দেখেছে।
তিনি কাল রাতে এসেছিলেন- মা বললেন, তিনি যা বলে গেছেন তা ভুলবে না কখনো। তোমার বাবাকে গতকাল রাতে এক জেল থেকে স্থানান্তর করে আরেক জেলে নিয়ে যাচ্ছিলো ফ্রান্সীরা। কয়েদীদেরকে রাতেই জেল বদল করা হয়। কারণ, দিনে মুক্তিযোদ্ধারা তা জেনে ফেলে এবং গাড়িতে হামলা করে কয়েদীদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু রাতের বেলা হলে মুক্তিযোদ্ধারা আর টের পায় না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা এখন এটা জেনে ফেলেছে। তোমার বাবাকে নিয়ে গাড়ি যখন অতি নির্জন এক জায়গায় দিয়ে যাচ্ছিলো তখন গাড়িতে আচমকা হামলা হয়। কয়েকজন কয়েদী মারা যায়। মারা যায় কয়েজন পুলিশও। হামলাকারীদের একজন শহীদ হয়। তোমার বাবা অক্ষত অবস্থাতেই পালাতে সক্ষম হন। তারপর লুকিয়ে ছাপিয়ে এখানে এসে তোমাকে ওসিয়ত করে যান।
বাবার লাগেনি তো? আমি পেরেশান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
না, সামান্য আচড়ও লাগেনি। লাগলে কি এখানে আসতে পারেন- মা বললেন সামান্য হেসে।
মার কথায় ও চেহারায় আফসোস বা চিন্তার সামান্য লক্ষণও ছিলো না। তার পর বাবা রাতে আমাকে যা বলেছিলেন মা সেগুলো আবার আমাকে মনে করিয়ে দিলেন।
***
তোমার বাবার পথ ধরে তোমাকে যেতে হবে- মা বললেন, তিনি শহীদী জীবন ও মুক্তিযোদ্ধাদের পথে তার স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছেন গতকাল রাতে। এই চিহ্ন তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যেখানে এই পদচিহ্ন শেষ হয়ে যাবে সেখান থেকে শুরু হবে রক্ত ফোঁটার পিচ্ছিল পথ। এটা হবে তোমার বাবার রক্ত। জাতির সন্তানদের পথ নির্দেশ করে তাদের পিতার রক্তমাখা পদচিহ্ন।
আমার জন্মের পূর্বেই ফ্রান্সীরা আল জাযায়ের দখল করে বসে। কিন্তু তখন সেসব বীর যোদ্ধা মহিয়সী নারীরা কোথায় ছিলো যারা দেশের মুক্তির জন্য নিজের স্বামী, প্রিয়জন, গর্ভের সন্তানকে উৎসর্গ করে দিতো। আসলে যে ধর্ম যে ইসলাম তাদের প্রাণের আদর্শ ছিলো, অস্তিত্বের ভিত্তি ছিলো তা তারা বিক্রি করে দিয়ে ছিলো। বিধর্মীদের রঙ-সজ্জায় তাদের জীবনকে রঞ্জিত করতে চেয়েছিলো। তাদের আদর্শহীন ও নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিষাক্ত শরাব আকণ্ঠপান করতে শুরু করলো।
অবশেষে জাতির পিতাদের অন্তরের সুপ্ত ঈমানের প্রায় নিভে যাওয়া প্রদীপ পূর্ণমাত্রায় প্রজ্জলিত হয়। জেগে উঠে দেশের সন্তানরা। মায়ের বুকের সন্তানকে উত্সর্গ করে দেয় গোলাবারুদের ছায়াতলে। স্ত্রীরা নিজেদের ভালোবাসা অর্পণ করে কওমের রক্তাক্ত কদমে।
এর পরের রাতের ঘটনা। মা আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাড়ির বাইরে গাড়ির ব্রেক করার শব্দ হলো। আম্মার চেহারায় ভয়ের ছায়া নেমে এলো। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিস ফিস করে বললেন- ঐ যে এসে গেছে।
কে? আব্বা? আমি খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
না …।
পুলিশ … মনে হয় ফৌজ।
দরজার শুধু কড়া নড়ে উঠলো না; যেন দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করলো। কেউ চিৎকার করে বললো- দরজা খুলে দাও, না হয় আমরা ভেতরে ঢুকে গুলি করব।
মা ক্রুদ্ধ হয়ে বড় দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি তার পেছন পেছন গেলাম। মা দরজা খুলতেই চারজান আর্মি এক ঝটকায় ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। ঢুকেই সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো। প্লেট গ্লাস, কাপ পিরিচ, ফানির্চার রাইফেলের বাট দিয়ে গুড়ো করতে লাগলো। সারা বাড়িতে ছয়টি কামরা ছিলো। প্রতিটি কামরার আসবাবপত্র ছিন্নভিন্ন করে ফেললো। ছাদেও গেলো। কোথাও তাদের কাংখিত কোন কিছু পেলো না।
নিচে এসে মাকে ও আমাকে আসামীর মতো তাদের সামনে দাঁড় করালো। আমার দেহের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগলো তখন। ফ্রান্সীরা তো আমার আজন্ম শত্রু। কিন্তু সেদিন আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, এই ঘৃণ্য শত্রুরা আমাদের আত্মসম্মান ও জাতীয় ইজ্জত আবরুর ওপর নোংরা পা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মহান এক ধর্মের অনুসারী হয়েও ঐ কাফেরদের চোখে আমরা অতি নিকৃষ্ট প্রাণীরও অধম।
সে কোথায়? এক সার্জেন্ট আমার মাকে ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো।
কে।
তোমার স্বামী। সে এখানে এসেছিলো।
ও তো ছয় মাস ধরে লাপাত্তা। আমি কি করে বলবো সে কোথায়?
এর মধ্যে আমাদের পাশের বাড়ির এক লোক তার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। তার মেয়ের নাম মারকোনী। বয়স পনের ষোল। ওদের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো। ওরা ইতালির লোক। মারকোনী আর আমি এক সঙ্গে পড়তাম। দুজনে দুজনার বেশ ঘনিষ্ঠও ছিলাম। অবশ্য ইতালি বা ইউরোপের অন্যান্য দেশের ছেলে মেয়েরা এ স্কুলে পড়তো। কিন্তু মারকোনীর মতো অন্য কারো সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো না। মারকোনী ক্লাসে আমার সঙ্গে বসতো, খেলা করতো, এমনকি একই স্কুল কোচে করে আমরা স্কুলে আসা যাওয়া করতাম।
মারকোনীর বাবা ছিলেন খাদ্য ভবনের অফিসার। আমার বাবার খুব বন্ধু। আর মারকোনীর মা ছিলেন আমার মার বান্ধবী।
আপনারা কেন এসেছেন? সার্জেন্ট মারকোনীর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো। ইউরোপীয় মনে করে উনার সঙ্গে সমীহ করেই বললো।
আমি এই ভদ্র মহিলা (আমার মা) ও তার ছেলের জামিন হচ্ছি মারকোনীর বাবা বললেন- এই মহিলার স্বামী আসামী বা দেশদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু উনাকে আমরা পনের-শোল বছর ধরে চিনি। তিনি আপনাদের ওয়াফাদার নাগরিক। তাছাড়া উনি নিজেও তো তার স্বামীর অত্যাচারে জরিত। তার ব্যাপারে আপনাদের কোন আশংকা থাকা উচিত নয়। ইনি তো শিক্ষিতও নন, সাধারণ গ্রাম্য মহিলা।
মারকোনীর বাবাকে মিথ্যা বলতে হলো। আমার মা আমার বাবার কাছে থেকে কোন দিন কোন কটু কথাও শুনেননি। অশিক্ষিত বা বুন্ধু-গ্রাম্যও নন আমার মা। উনি হায়ার সেকেন্ডারী পাশ। তবে মারকোনীর বাবার আমাদেরকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টার কৌশল মা বুঝে ফেললেন। তাই আমার মাও বুন্ধু বনে গেলেন তখন।
আপনি ইউরোপীয় বলে আপনার জামানত গ্রহণ করছি- সার্জেন্ট মারকোনীর বাবাকে বললো- আপনি মুসলমান হলে এদের সঙ্গে আপনাকেও গ্রেফতার করতাম- সার্জেন্ট বড় ঘৃণা ভরে আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো- এটা সাপের বাচ্চা। এই বয়সের ছেলেরা আমাদেরকে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। কয়েদীদের গাড়িতে যারা হামলা করে এদের মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচজন মারা গেছে। এই পাঁচজনের বয়সই সতের থেকে আঠার এর মধ্যে। আমি ওদের লাশ দেখেছি। সবার আগে ঐ হারামী বদ মুসলমানদের ছেলেগুলোকে আমাদের খতম করতে হবে।
আমার মা আমাকে ছো মেরে কাছে টেনে নিয়ে চেপে ধরলেন। বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বুন্ধু আর মজলুম মায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন—
আমার বাচ্চা এমন নয়। সে তার বাবার পথে যাবে না কখনোই। ওর বাবা চলে যাওয়াতে আমি অনেক খুশি।
ও আমার ক্লাস মেট- মারকোনীও আমার পক্ষে বললো এবং আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি গভীর করে যেন বললো, চুপ থাকো। কথা বললেই বিপদে পড়ে যাবে।
আমি দাঁত দিয়ে আমার ঠোঁট কাটতে লাগলাম। ফ্রান্সীরা আজ আমাদেরকে মানুষই মনে করছে না। এমন ব্যবহার করছে যেন আমরা কোন ইতর প্রাণী। আমি সার্জেন্টের দিকে তাকালাম। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের সুদর্শন যুবক। সে মারকোনীর দিকে তাকিয়ে হাসছিলো মুচকি মুচকি। মারকোনী অত্যন্ত রূপসী ছিলো। লম্বাটে শারীরিক গঠন ওর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছিলো।
মারকোনীর সুপারিশ কাজে লাগলো। সার্জেন্ট মাকে ও আমাকে আরো কিছুক্ষণ ধমকিয়ে মারকোনীর বাবার সঙ্গে বাড়ির বাইরে চলে গেলো। আমি বাইরে বের হয়ে দেখলাম, সার্জেন্ট মারকোনীদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সিপাহীরা বাইরে গাড়িতে উঠে বসছে। সার্জেন্টের চোখ দেখেই আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে ছিলাম যে, সে এখন মারকোনীর পিছু নেবে। অবশ্য মারকোনীর তাকে অপছন্দ করারও কিছু নেই। একে তো ধর্মে বর্ণে মিশে গেছে ওরা। তারপর এই বয়সেই ছেলেটি সার্জেন্ট পদে উন্নীত করেছে। এমন পাত্র কেই বা হাতছাড়া করতে চায়।
থাক এজন্য আমার কোন আফসোস ছিলো না। আমি বা মারকোনী আমরা কেউ তো কখনো কাউকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তাহলে এক সার্জেন্ট ওদের ঘরে যাওয়াতে আমার তো কোন কিছুর ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা চেপে বসলো, আমি আমার বাবার পথে কি করে চলবো? কে আমাকে ট্রেনিং দেবে? কার সঙ্গে আমি দেখা করবো? আমি কোথায় যাবো, কে আমাকে নিয়ে যাবে?
***
এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছ থেকে পেয়ে গেলাম। মা আমাকে প্রথম সবক দিলেন
যদি আচমকা এভাবে পুলিশ এসে পড়ে তুমিও সঙ্গে সঙ্গে ভিখিরী বিড়াল বনে যাবে। পুলিশরা গালিগালাজ করলে মাথা নামিয়ে ফেলবে। আবেগ ও জযবার আগুন তখন বুকের মধ্যে চেপে রাখবে …
আমি দেখছিলাম, ঐ পুলিশদের সামনে তোমার চেহারা রাগে লাল হয়ে যাচ্ছিলো। তুমি যদি রাগের সামান্য প্রকাশও ঘটাতে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতো। এতে কি লাভ হতো? জাতির এক সম্ভাবনাময়ী যুবক ধ্বংস হয়ে যেতো। তোমাকে তোমার বাবার মতো দক্ষ গেরিলাদের মতো যমিনের নিচ থেকে হামলা করতে হবে। মনে রেখো, ফ্রান্সীদের পা টলে উঠেছে। ইনশাআল্লাহ বিজয় আমাদেরই হবে।
এরপর আরো কয়েক দিন সার্জেন্টকে মারকোনীদের ঘরে আসতে দেখেছি আমি। কিন্তু আমার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। আমি জানতাম, আলজাযায়েরের কোন যুবক যদি কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ে যায় তাহলে তার আর রেহায় মেলে না। আমি আরো আগ থেকেই বুঝতে পারতাম, ফ্রান্সীরা মুসলমানদেরকে বিলাসী জীবনে ডুবিয়ে দিতে চাচ্ছে। কোথাও যাতে ভালো-মন্দ, শালীন ও অশালীনতার ভেদাভেদ না থাকে; তারা সে চেষ্টাই করছে। মারকোনীকেও আমি তাদেরই কোন ইন্ধন মনে করতে লাগলাম।
আমার মা আমার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।
এর তিন মাস পরের কথা। একদিন মারকোনী আমাদের ঘরে এলো। সার্জেন্টের আনাগোনার পর থেকে মারকোনী আমাদের বাড়িতে খুব কমই আসতো। আগে তো তার দিন রাত আমাদের এখানেই কাটতো। মারকোনী এসে আমাকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো
তোমাদের ঘরে বিপদজনক কিছু নেই তো? … মানে কোন অস্ত্রট বা ইমোনেশন?
আমাদের বাড়িতে এসব কোত্থেকে আসবে? আমি কিছুটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললাম।
শামস! মারকোনী যেন অনুনয় করলো- আমার কাছে কোন কিছু গোপন করার চেষ্টা করো না। আমি যা বলছি সত্য বলছি এবং তোমার ভালো চাই বলেই বলছি। এতে তোমার মারও সম্মান নিহিত রয়েছে। আমি জানি তুমি কি করছো?
মনে হচ্ছে ফ্রান্সী সার্জেন্ট তোমার আপাদ মস্তকই পাল্টে ফেলেছে আমি বিদ্রূপ করে বললাম- শেষ পর্যন্ত তুমি গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছে।
শামস! সে আমাকে একটা ঝটকা দিয়ে বললো- আমি সত্যিই গোয়েন্দাগিরি করছি। আমি গোপন একটি তথ্য দিতে এসেছি। আজ রাতে তোমাদের বাড়িতে পুলিশ রেড করবে। ঘরে যদি এমন কিছু থেকে থাকে তা মাটির নিচে দাবিয়ে দাও। অথবা আমার কাছে দিয়ে দাও। না হয় কোথাও গায়েব করে দাও।
মারকোনী চলে গেলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মারকোনীর কথা বিশ্বাস করা উচিত কি না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মাকে জানালাম। মা বললেন, কোন অমুসলিম মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। ইউরোপের কোন লোকের ওপরই ভরসা করা যায় না। আসলে মারকোনী জানতে এসেছিলো আমাদের বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে কিনা।
তবুও আমাদের ঘরে দুটি খঞ্জর ছিলো। ফ্রান্সীদের আইনে এটা রাখাও অপরাধ। এছাড়া ছিলো ৩২ কিলোবোর এর একটি পিস্তল। যার মেগাজিনে এক সঙ্গে এগারটি গুলি ভরা যেতো। দশ-বার দিন আগে পিস্তলটি আমাদের ঘরে আসে। আমার মার জানাশোনা এক লোক এটি নিয়ে এসে ছিলো। এটা না কি আমার বাবা আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন। বাবার জীবন কাটছে এখন মরুর ধূলিকণার মধ্যে।
***
মারকোনী যেদিন আমাকে সতর্ক করতে এসেছিলো সেদিন সন্ধ্যাতেই অতি নোংরা কাপড়ের এক ভিখিরী আমাদের দরজায় এসে হাক ছাড়লো। আমি দরজা খুলতেই তিনি আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। তার লম্বা দাড়ি ও চুল থেকে বিকট গন্ধ আসছিলো। কাপড়ও দুর্গন্ধযুক্ত এবং শত স্নি। আমি তাকে বাধা দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ভেতরের কামরায় ঢুকে পড়লেন এবং হো হো করে হেসে উঠলেন।
যদি নিজের ছেলেও আমাকে চিনতে না পারে তাহলে ফ্রান্সী পুলিশের বাপেরও সাধ্য নেই যে আমাকে চিনবে- হাসতে হাসতে বললেন তিনি তাহলে আমার ছদ্মবেশ ভালোই হয়েছে।
আপনার এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়- আমি বাবাকে বললাম।
ফ্রান্সী সার্জেন্টের ঘটনা ও মারকোনীর সঙ্গে তার নতুন পরিনয়ের সম্পর্ক, সর্বশেষ আজ মারকোনী কি বলে গেছে বাবাকে সব খুলে বললাম।
বাবা আমাকে কিছু টাকা দিলেন। তারপর বললেন- ঐ মেয়ের উদ্দেশ্য যাই থাক, তবে সে মিথ্যা বলেনি। এই আমার এখানে আর থাকা উচিত হবে না। আমি আবার আসবো ইনশাআল্লাহ। ঘরে যাই আছে লুকিয়ে ফেলে।
বাবা চলে গেলেন। এর এক ঘণ্টা পরই আমাদের বাড়ির দরজায় কি যেন ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছাদের ওপর কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। মা দরজা খুললেন। চারজন পুলিশ চোখ ধাধনো টর্চের আলো জ্বেলে ভেতরে ঢুকলো। আরো দুজন ছাদ থেকে নেমে এলো। তারপর সবাই এক যোগে বাড়ির ভেতর তল্লাশি শুরু করলো।
আমি খঞ্জর ও পিস্তলটি বাড়ির বাগানের এক কোণে মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ঘরের আসবাবপত্রের এমন হাল করলো যেন ডাকাত দল ডাকাতি করে গেছে। পুলিশের এই দলের সঙ্গে অন্য একজন সার্জেন্ট ছিলো। সার্জেন্ট আমাকে ও মাকে তার সামনে এনে দাঁড় করালো। যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
তুমি স্কুলে যাওয়া কেন বন্ধ করলো সার্জেন্ট আমাকে রূঢ় কণেষ্ঠ জিজ্ঞেস কলো।
ওকে আমিই স্কুল থেকে ফিরিয়ে এনেছি- মা জবাব দিলেন, আপনি নিশ্চয় জানেন, ওর বাবা জেলখানায় পড়ে আছে। আয় রোজগার সব বন্ধ। ওকে কি দিয়ে পড়াবো আমি? তা ছাড়া বাইরের অবস্থা খুব খারাপ। আমি চাই না, আমার একমাত্র ছেলে এই জটিল পরিস্থিতির শিকার হোক।
তোমার স্বামী জেল থেকে পালিয়েছে- সার্জেন্ট বড় তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো- তুমি ভালো করেই জানো সে কোথায় আছে এখন। তার এই ছেলে বিদ্রোহীদের কাছে যাতায়াত করে। যদি তোমার স্বামীর সন্ধান দিয়ে দাও তাহলে শান্তিতে কাটাতে পারবে বাকি জীবন। আর এই ছেলের ওপর নজর রেখো। যদি সে ধরা পড়ে তাহলে সারা জীবনেও ওকে ফিরে পাবে না।
ফেরাউনি দম্ভ দেখিয়ে ওরা চলে গেলো। মা অনেক্ষণ পর্যন্ত দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিড় বিড় করে বললেন,
আমি আমার একমাত্র ছেলেকে আমি আল জাযায়েরের মাটিতে উৎসর্গ করে দিলাম।
একটু পর মারকোনী এসে উপন্থি হলো।
এখন তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে শামস! আমি ফ্রান্সী না, ইতালিয়ান মারকোনী বললো।
তাহলে ঐ সার্জেন্ট তোমাদের ঘরে কেন আসে? তুমি ওর সঙ্গে বাইরে বাইরে ঘোড় ফেরা করো কেন? আমি সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
বাবা আমাকে উনার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন… এ বিয়ে ফেরানো যাবে না- হঠাৎ করেই তার গলা ধরে এলো- কিন্তু আমি তোমাকে ধোঁকা দেব না। তুমি আমার শৈশবের সঙ্গী। অতীত স্মৃতিগুলো ভুলে যাও… আর হ্যাঁ, তুমি সত্য পথেই আছে। আমার বিয়ে হচ্ছে এক ফ্রান্সী সার্জেন্টের সঙ্গে। ফ্রান্সের হুকুমমতের সঙ্গ নয়- এবার কেঁদেই ফেললো- আমাকে ভুলে যাও… আমার যে এছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না- একথা বলে মারকোনি ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
***
এর মাসখানেক পর ঐ সার্জেন্টের সঙ্গে মারকোনীর বিয়ে হয়ে গেলো। তত দিনে আমি লুকিয়ে ছাপিয়ে মোটামুটি ফৌজি প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়েছি। আরো সপ্তাখানেক পর মারকোনী তার স্বামীর সংসারে চলে গেলো।
এক রাতে আমার বাবা আবার সেই ভিখিরীর বেশে এলেন। তিনি মাকে বললেন,
আমি তোমার শাসকে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে খোদা হাফেজ বলল। কখনো কখনো আমার মতোই এসে দেখা করে যাবে।
মার দুচোখ ভরে অশ্রু নেমে এলো। ফুপানির অস্ফুট শব্দ শুনতে পেলাম। আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। আমার মুখে গালে চুমো খেলেন। তারপর কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন
তুমি যদি শুধু আমার সন্তান হতে তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিতাম না। কিন্তু তুমি মহান এক জাতির সন্তান। মুসলমান মেয়েরা তাদের সন্তানদের নিজেদের অধিকারভুক্ত কোন সম্পত্তি মনে করে না। তাদের সন্তানরা তো আল্লাহ তাআলার আমানত… যা বেটা! আল্লাহর দরবারে আমি আমার সন্তানকে সোপর্দ করছি।
চেষ্টা সত্ত্বেও চোখের অশ্রু আমি আড়াল করতে পারলাম না। বাবাও ধরা গলায় আমার মাকে বললেন
কোন পুলিশ এসে ওর কথা জিজ্ঞেস করলে তুমি কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। আর বলবে আমার ছেলে পালিয়ে গেছে।
বাবার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম। শহর থেকে বের হলাম লুকিয়ে ছাপিয়ে। শহর থেকে মাইল খানেক দূরে অন্ধকারের মধ্যে এক লোক দুটি উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তিনি ছিলেন আমার বাবার কোন এক সহযোদ্ধা। একটি উটে বাবা ও আমি সওয়ার হলাম। আরেক উটে সে লোক সওয়ার হলো। তারপর আমরা সেই মনযিলের দিকে রওয়ানা হলাম আজ যেদিকে আমি আশ্রয় গ্রহণ করেছি।
মাঝ রাতের পর আমরা এমন এলাকায় পৌঁছলাম যেখানে মাটি ও বালির উঁচু উঁচু বেশ কিছু টিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছু টিলা মোটা স্তম্ভের মতো চৌকোণা। কিছু মোটা দেয়ালের মতো। আবার অনেকগুলোর আকৃতি এমন যেন প্রাচীন কোন মহলের ধ্বংসাবশেষ। উট এগুলোর মাঝখান দিয়ে ঘুরে ঘুরে, ঘন ঘন মোড় বদল করে এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। সেখানে দুটো ল্যাম্প জ্বলছে। অনেকগুলো মানুষ বসে গল্প গুজব করছে।
আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের পর এক লোক আমার হাতে কুরআন শরীফ দিয়ে এই শপথ নিলো
আমি মহান আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে কসম করছি, আমার মাতৃভূমি আলজাযায়েরের জন্য কোন ধরনের আত্মত্যাগ থেকে পিছপা হবো না। হোক এই ত্যাগ আমার প্রাণের।… আর আমি এই পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে কসম করছি যে, আমি শত্রুদের অত্যাচারের চাপে কোন তথ্য ফাঁস করবো না। কয়েদী হলে সব রকম কষ্ট নির্যাতন সহ্য করবো; কিন্তু নিজের সঙ্গীদের কোন সন্ধান দেবো না।
এ ছিলো এমন এক অঙ্গীকার যা আমার বয়সের চেয়ে আমাকে আরো পরিণত করে তুললো। আমি যে এক অফিসারের ছেলে ছিলাম। ফ্রান্সী স্কুলে লেখাপড়া করেছি এসব আমি ভুলে গেলাম। নিজের প্রতি আমি নিজে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠলাম।
দুতিন দিন পর থেকে আমাকে দুশমনের গুপ্ত বাহিনীর ওপর হামলা করার ট্রেনিং দেয়া হতে থাকে এমনভাবে, যেমন বাঘ তার বাচ্চাকে শিকার ধরার টেনিং দিয়ে থাকে। ফ্রান্সীরা মরুর কোথাও কোথাও চৌকি বানিয়ে রেখেছে। যেগুলো মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট ছোট কেল্লার মতো। আমরা সেগুলোর ওপর ফায়ার করতাম। ঐ সব চৌকিতে আমরা ফায়ারিং করতাম। চৌকিগুলোতে সৈন্যদের রেশনবাহী ট্রাক যেতো। আমরা ট্রাকে হামলা করে রসদ পৌঁছানোতে বিঘ্ন ঘটাতাম।
এ পর্যন্ত আমি বেশ কয়েকটি নৈশ হামলায় অংশ নিয়েছি। তিনবার ভিখিরীর বেশে মার সঙ্গে সাক্ষাত করে এসেছি। শহরে উপশহরে এবং গ্রামে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি থাকলেও আমাদের কেউ মারা গেলে আমরা শহীদদের তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে পাঠাতাম না। মরু ভূমিতেই দাফন করে দিতাম। কারণ, আত্মীয়স্বজনের কাছে লাশ পাঠালে ফ্রান্সী পুলিশ তাদেরকে হয়রানীর মধ্যে ফেলতো।
কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছি। একদিন গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর এলো, কিছু কয়েদীকে জেল থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কয়েদীদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কমপক্ষে তিনটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হবে কয়েদীদের। জেল থেকে গাড়িগুলো রওয়ানা হবে সন্ধ্যার আগে।
আমাদের লিডার সেই গাড়ির ওপর হামলা করার জন্য আমাকেও তালিকাভুক্ত করেছেন। জানতে পারলাম আমার বাবাও এই কমাণ্ডে দলে আছেন। তিনিই আমাকে দলে নিয়েছেন। পনের জনের ছোট একটি গেরিলা দল। যে পথ দিয়ে কয়েদী গাড়িগুলো যাবে তার দুপাশে ছোট পাহাড়। কাছেই ছিলো দুটি গ্রাম।
সময় মতোই আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেলাম। কমাণ্ডার আমাদেরকে পজিশনে বসিয়ে দিলো। এম্বুশের জন্য এলাকাটি দারুণ ছিলো। টিলার চড়াই উত্রাই এবং চূড়া খুব চমৎকার ছিলো লুকানোর জন্য। তবে গাছ ছিলো না একটাও। আমার বাবা আমাকে এমন পজিশনে বসিয়ে দিলেন যেখান থেকে সড়ক খুব নিকট থেকে দেখা যায়। আমার কাজ ছিলো, সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে গুলি করা। গুলি লক্ষভ্রষ্ট হলে গাড়ির টায়ারে ফায়ার করতে হবে। আমার কাছে ছিলো দূরপাল্লার রাইফেল। অন্যদেরও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়া হয়ে গিয়েছিলো।
মরু অঞ্চলের এই সড়কটি টিলার ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। পনের বিশ মিনিট পর দূর থেকে গুরু গম্ভীর গুঞ্জন শোনা গেলো। আওয়াজটি খুব দ্রুত কাছে চলে আসছে। এটা যুদ্ধ বিমানের আওয়াজ। দূর থেকে দেখা গেলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটা বোম্বার বিমান খুব নিচু দিয়ে আসছে। আমাদের কমাণ্ডারের চিৎকার শোনা গেলো- লুকিয়ে পড়ো।
আমরা যে যেখানে ছিলাম উপযুক্ত আড়াল দিয়ে লুকিয়ে পড়লাম। বোম্বারটি এত নিচ দিয়ে উড়ে গেলো যে, আমরা রাইফেলের গুলিতে বিমানটি ফেলে দিতে পারতাম। বিমানটি আবার ফিরে এলো। তারপর আমাদের পজিশনের ওপর দিয়ে কয়েকবার চক্কর কেটে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে ফিরে গেলো। বিমানটি আসলে এসেছিলো কয়েদী গাড়িগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত কিনা তা দেখার জন্য। আমাদের জন্য এটা ছিলো দুঃসংবাদ। আমাদের নড়াচড়ার কারণে আমাদেরকে যদি দেখে ফেলে তাহলে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
ইদানিং ফ্রান্সীদের চৌকিগুলোর ওপর মুক্তিযোদ্ধা- মুজাহিদদের হামলা এত বেড়ে গেছে যে ফ্রান্সীরা সৈন্যদের হেফাজতে যুদ্ধ বিমান ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে।
বিমান ফেলার মতো কোন অস্ত্র আমাদের ছিলো না। এ ক্ষেত্রে আমরা নিরস্ত্র ছিলাম। কিন্তু আমাদের অস্ত্র ছাড়াই লড়তে হবে। আমাদের কমাণ্ডার বলতেন, মুসলমান লড়াই করে ঈমানের জযবায়। আর এতো কুফর ও ইসলামের লড়াই।
আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে এক মাইল দূর পর্যন্ত সড়ক দেখা যায়। আমি সেদিক তাকিয়ে রইলাম। কয়েদীদের প্রথম গাড়িটি আমার নজরে পড়লো। টিলায় অবস্থিত আমাদের ঘাটি থেকে আমার বাবার চিৎকার শোনা গেলো, খবরদার … গাড়ি অনেকগুলো।
অর্থাৎ কয়েদীদের গাড়ির সংখ্যা বেশি। কয়েদী গাড়ি আমরা দেখলেই চিনতে পারতাম। এগুলো লোহার গ্রিল দেয়া থাকতো। এতে ফায়ার করার সময় আমাদের সাবধানে থাকতে হতো। না হয় কয়েদীদের গায়ে গুলি লাগার সম্ভাবনা ছিলো।
খবরদার ওপরে জঙ্গি বিমান- আমাদের কমাণ্ডারের সতর্কবাণী শোনা গেলো। গাড়িগুলো কমপক্ষে ষাট মাইল স্পিডে আমাদের পজিশনের কাছাকাছি এসে গিয়েছিলো। এর মধ্যে একটি বোম্বার গাড়িগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে গেলো। আমি সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে টার্গেট করা শুরু করে দিলাম। একশ গজ দূরত্বে থাকতেই আমি ট্রিগারে আঙ্গুলের চাপ বাড়ালাম। গাড়ির স্ক্রীন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেতে দেখলাম আমি। গাড়ি এগিয়ে গেলো। আমি ক্ষিপ্রগতিতে গুলি করে টায়ার দুটি ফাটিয়ে দিলাম। এর সঙ্গে সঙ্গেই আমার অন্য সঙ্গীরাও ফায়ারিং শুরু করে দিলো।
সামনের গাড়িটি হঠাৎ ডান দিকে ঘুরলো এবং উল্টে গেলো। গাড়িটি সড়কের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে পড়াতে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলো। কয়েদীদের গাড়ি শুধু দুটি। আর বাকী চারটি ছিলো গার্ডদের। গার্ডরা সংখ্যায় ছিলো আশি নব্বই জন। প্রত্যেকের কাছে মেশিনগান ছিলো। আর আমরা মাত্র পনের জন। উল্টানো গাড়িটি ছিলো গার্ডদের। গাড়ি উল্টাতেই ওপর থেকে আমাদের ষ্টেনগানগুলো গাড়ির ওপর গুলি বৃষ্টি শুরু করে দিলো। একজন গার্ডকেও উঠতে দিলো না।
অন্য গাড়ির গার্ডরা এবার জবাব দিতে লাগলো। পজিশন আমাদের সুবিধাজনক হলেও জঙ্গি বিমান আমাদের পজিশনের সুবিধা নিতে দিলো না। গার্ডরা হয়তো ওয়ার্লেস দিয়ে বিমানের পাইলটকে জানিয়ে দিয়েছিলো তারা আক্রান্ত হয়েছে। বোমার বিমানটি গোত্তা খেয়ে আমাদের পজিশনের কাছাকাছি এসে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে গেলো। বিমান এসেছিলো দুটি। দুটোই কোন বিরতি না দিয়ে ফায়ার করে গেলো। আমাদের মনোযোগ তখন ছিলো নিচের দিকে। কিন্তু বোম্বারের বার বার ফায়ারের কারণে আমাদের পজিশন দুর্বল হয়ে গেলো। বিমান আসলেই আমরা লুকিয়ে পড়তাম। এই সুযোগে পুলিশরা সুবিধাজনক পজিশন বেছে নিতে পারতো। এ ভাবে অনেক ফ্রান্সী পুলিশ টিলার ভেতর ঢুকে পড়লো।
আমি আমার পজিশন পাল্টে একটু ওপরে চলে গেলাম। দুই টিলার মাঝখানে দুই ফ্রান্সীকে দেখতে পেলাম। আমার পজিশন ওদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো না। অস্তমিত সূর্যের ক্ষীণ আলোতেই ওদের একজনকে আমি চিনতে পারলাম। সে হলো মারকোনীর স্বামী সার্জেন্ট। তার হাতে স্টেনগান। টিলার গা ঘেষে আসছিলো। আমি সহজেই রাইফেল দিয়ে টার্গেট করতে পারলাম।
আমি তোমাকে ধোকা দেবো না- আচমকা মারকোনীর আওয়াজ আমার কানে ভেসে এলো- তুমি সত্য পথেই আছে। তাই তোমাকে আমি ধোকা দিতে চাই না।
আমার আঙ্গুল রাইফেলের ট্রিগার থেকে সরে গেলো। মারকোনী সত্যিই আমাকে ধোকা দেয়নি। সে রাতে যদি ও আমাকে আমাদের বাড়িতে পুলিশি রেডের কথা না জানাতো, তাহলে আমার বাবা ধরা পড়ে যেতেন। আমাদের বাড়ি থেকে একটি পিস্তল ও দুটি খঞ্জর উদ্ধারের অভিযোগে আমাকেও জেলের ভয়ংকর কারেন্ট সেলে নিয়ে ভরতো।
আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, আমি কি মারকোনীকে বিধবা বানিয়ে দেবো, না তার অনুগ্রহের বদলা দেবো। সহসাই আমার মনে পড়ে গেলো আমার প্রিয় দেশবাসীর হতভাগা বিধবাদের কথা। যাদের স্বামীদেরকে ফ্রান্সীরা নির্বিচারে শহীদ করছে। অবশ্য আলজাযায়েরের প্রতিটি ঘরের প্রত্যেক বধূই বিধবা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে।
আমরা আঙ্গুল ট্রিগারের ওপর চলে গেলো। আমি আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে ট্রিগার টিপে দিলাম। মারকোনীর স্বামী সার্জেন্ট তীরের মতো হয়ে গেলো। তারপর একদিকে পড়ে গেলো। দেরী না করে সার্জেন্টের সঙ্গীকেও আমি জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলাম।
কয়েদীদেরকে আমরা ছাড়াতে না পারলেও ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ফ্রান্সীকে মারতে পেরেছি। বাকিরা কয়েদীদের গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছে। বোম্বার বিমান চলে গিয়েছিলো। কিন্তু আবার উড়ে আসতে দেখা গেলো। তবে সাঝের আঁধার আমাদেরকে লুকিয়ে ফেললো। টার্গেট করার মতো কাউকে না পেয়ে বিমান চলে গেলো।
আমার পনের জন সঙ্গীর মধ্যে শহীদ হলো আট জন। কয়েকজন যখমী হলো। এর মধ্যে আমার বাবাও ছিলেন। রাতে আমরা লাশ উঠিয়ে আমাদের আস্তানায় ফিরে গেলাম। গনীমত হিসেবে ফ্রান্সীদের কিছু অস্ত্র আমরা পেলাম।
***
সাত আট দিন পর ভিখিরীর বেশে আমার মাকে দেখতে গেলাম, মা আমাকে জানালেন, মারকোনীর স্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেছে। সে খুবই শোকাহত। মাকে জানালাম না যে মারকোনী আমার হাতেই বিধবা হয়েছে। মাকে বললাম, তিনি যেন যে কোন ছুতোয় মারকোনীকে এখানে নিয়ে আসেন।
কোন ছুতো বা বাহানা লাগলো না। আমার আমার কথা শুনতেই মারকোনী আমাদের বাড়িতে চলে এলো। মারকোনীকে আমি অন্য এক কামরায় নিয়ে গেলাম। মারকোনী খুবই বেদনাহত ছিলো। চোখ দুটি ছিলো ফোলা ফোলা।
মারকোনী! আমি ওকে বললাম- আমার জাতির দেয়া দায়িত্ব আমি পালন করেছি। যার কারণে তুমি বিধবা হয়ে গেছে। তোমার স্বামী আমার গুলির নিশানা বনে গেলো। না … কিছুই করার ছিলো না … এছিলো আমার দেশের প্রতি দায়িত্ব বোধের প্রতিফলন। এখন আমি ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের ঋণ আদায় করতে চাই- আমি আমার কাপড়ের ভেতরে লুকানো পিস্তলটি বের করলাম এবং সেটা মারকোনীর দিকে বাড়িয়ে দিলাম- এই নাও। তোমার স্বামীর খুনের বদলা নাও। তোমাকে আমি এজন্যই ডেকেছি। তোমার অনুগ্রহের বদলা তো আমি দিতে পারবো না। অবশ্য আমার জানটা দিয়ে দিতে পারবো।
পিস্তল নিয়ে মারকোনী যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। শূন্য চোখে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। মারকোনীর এ দৃষ্টির সামনে আমি যেন হতবাক হয়ে গেলাম। কতক্ষণ এ অবস্থায় রইলো মনে নেই। হঠাৎ মারকোনী আমার চুলির মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিলো। তারপর কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
হায় শামস্! কাঁদতে কাঁদকে বললো মারকোনী- আমি কত বড় ত্যাগ স্বীকার করলাম আর তুমি? অবশ্য আমার ব্যাপার তো ব্যক্তিগত। আর তোমার? তোমার জাতীয় ব্যাপার, দেশের ব্যাপার।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, মারকোনী কি বলতে চায়।
মারকোনী! তুমি কি বলছো, আমি বুঝতে পারছি না- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
শামস! তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি আজ সত্য বলতেই এখানে এসেছি। মারকোনী কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে গেলো, শামস! তুমি আমার খেলার সাথী, স্কুলের সাথী, সুখে দুঃখে সবসময় আমরা পরস্পরের একান্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিলাম। তোমাদের বাড়ির বারান্দা মনে হতো আমাদের। তোমারও হয়তো এমনই অনুভূতি ছিলো। এমন ঘনিষ্ঠতার মধ্যে যে দুটি ছেলে মেয়ে বড় হলো তাদের মধ্যে কি হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক আরো পাকাপোক্ত হয় না। অর্থাৎ, বুঝার মতো বয়স হবার পর অনুভব করলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি …।
তুমিও কি আমাকে ভালোবাসনি তুমি মুসলমান আমি খ্রিস্টান ধর্মের দেয়ালের এ বাঁধা আমার কাছে তেমন কিছু ছিলো না। তোমাকে নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখা শুরু করি তখনোই সিদ্ধান্ত নিই, যে কোন সময় আমি মুসলমান হয়ে তোমার ঘরে চলে আসবো …।
কিন্তু বিধি বাম। তোমার আব্বা এর মধ্যে বিদ্রোহী হিসেবে ধরা পড়ে গেলেন। তার পর হলেন ফেরারী। এর পরই তোমাদের বাড়ি রেইড হলো। আমার স্বামী সার্জেন্ট ডোনাল্ড তোমাকে গ্রেফতার করার সব রকম প্রমাণাদি নিয়েই এসেছিলো। আমার বাবাও আমার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে সেদিন তাকে নিরস্ত্র করা গেলেও তার আসল মিশন কিন্তু ছিলো তোমাকে গ্রেফতার …।
তুমি নিশ্চয় ডোনাল্ডকে আমাদের বাড়িতে যেতে দেখেছিলে। সে তোমার প্রতি আমার মনোভাব বুঝতে পারে এবং আমাকে একা পেয়ে বলে, কোন মেয়ে এমন ছেলেকে ভালোবাসতে পারে যে নাকি এক দেশদ্রোহীর ছেলে, ঐ ছেলে নিজেও দেশদ্রোহী। সবরকম প্রমাণ আমার হাতে দিয়েই তাকে গ্রেফতার করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমরা যতই ছাফাই গাওনা কেন জাত সাপ আমরা চিনি। তাকে গ্রেফতার করা মানেই হলো, মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া … তবে আমি তাকে বাঁচাতে পারি এক শর্তে।
বলুন কী শর্ত আমি বলে উঠি।
আমাকে বিয়ে করতে হবে, না হলে তোমার বাবাকেও বিদ্রোহী হিসেবে জেলে পুরা হবে এবং তোমাকে এখন জোর করে আমি বিয়ে করবো।
সত্যি বিশ্বাস করো শাম! মারকোনী আবার ফুঁপিয়ে উঠলো- আমার রাজি হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। ডোনান্ডের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হওয়ার বিনিময়ে যদি তোমাকে ও বাবাকে বাঁচানো যায় তাহলে বিয়েই তো আমার শেষ ও তোমাদের বাঁচার পথ। কিন্তু ডোনাল্ড আমাকে সত্যিই ভালো বেসেছিলো। প্রথম দিকে ওকে আমি ঘৃণাই করতাম। ওর নিখাদ ভালোবাসার কারণে আমি ক্রমেই ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম …।
শামস! আমি সেটাই বলছিলাম। তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে পারলাম। আর তুমি আমার বিধবা হওয়ার কথাটাও চিন্তা করতে পারলে না! মারকোনী! আমি বললাম- তুমি জানো, যুদ্ধের ময়দানে পিতা পুত্রও যদি মুখোমুখি হয় তখন আর পিতা পুত্রের সম্পর্কের কথা মনে থাকে না বা থাকতে নেই। যদি সেই সম্পর্ক বা সূত্র বড় হয়ে দাঁড়ায় তখন সে হয় তার স্বজাতির সঙ্গে বেইমানী করা এক মুনাফিক।…
হ্যাঁ, আমি জানি শামস্! তোমার করার কিছুই ছিলো না।
এ সময় আমার মা কামরার ভেতরে ঢুকে মারকোনীকে জড়িয়ে ধরলেন। মারকোনী মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ফুপাতে লাগলো।
মা! আমি শুনেছি তোমরা যা বলছিলে- আমার মা বললেন, তুমি যদি আমাকে আপন মনে করে থাকো তাহলে তোমাকে আমি একটা পরামর্শ দেবো।
জি খালাম্মা বলুন আপনার পরামর্শ আমি মেনে নেবো- মারকোনী বললো।
তাহলো মা তোমার মনে যেহেতু একবার মুসলমান হওয়ার বাসনা জেগেছিলো তাই সেই কল্যাণময়, বাসনাটি পূরণ করে ফেলল। মনে রেখো, শামসের সঙ্গে তোমার ভালোবাসা উপলক্ষ ছিলো, কিন্তু তোমার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তোমার মধ্যে তার মহান মায়ের প্রতিচ্ছবি অংকিত করে দিয়েছেন। যে মা কওমের জন্য গর্বিত এক মা উপহার দেবে।…
মারকোনী মা! তোমাকে আমি বিধবা থাকতে দেবো না। তোমাকে শামসের বউ করে আমার ঘরে নিয়ে আসবো। তুমি শামসের সংগ্রামী জীবনের সহযোদ্ধা হতে রাজী? মারকোনী এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। পরম আবেগে আবার মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।