প্রেম আর ভূত

প্রেম আর ভূত

অনেক শুকনো পাতা পড়ে আছে পার্কের বেনচে। বছরের এই সময়টায় গাছ পাতা ঝরায়, নতুন সাজে সাজবে বলে। জলের ধারে ধারে কচি কচি ঘাস গজিয়েছে। লেকের জলেও কিছু শুকনো পাতা আনমনে ভাসছে। দিব্যেন্দু বেনচে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার ওপরেই বসে পড়ল। দুপুরের রোদ হলুদ নেশার মতো ঝিমঝিম করছে চারপাশে। লেক এখন ফাঁকা। বাতাসে শীত শেষের গরম হল্কা। আজ তো আর ছুটির দিন নয়। কারা আর আসবে এখন, এই লেকে বেড়াতে! দূরে একটা গাছের তলায় একটা ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে গায়ে গা লাগিয়ে। নতুন প্রেম। দেখলেই বোঝা যায়। যা কথা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। হাতে হাত রেখে দু-জনে বসে আছে। বড় ক্লান্ত, বড় শ্রান্ত।

দিব্যেন্দু চোখ সরিয়ে নিল। ভাবতে লাগল, একটা বছর কোথা দিয়ে কীভাবে চলে গেল! এই সেই বেনচ। দিব্যেন্দু চিড় ধরা কাঠের দিকে তাকাল। কত দিন, কত কত দিন, সে আর স্মিতা এই আসনে পাশাপাশি বসে গেছে! আজ সে একা আর কিছু ঝরা পাতা। দিব্যেন্দু আজ এসেছে, পুরানো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যাবে। মাঝে মাঝেই আসে, হিসেব করে, যখন তেমন কেউ থাকেনা। কেউ বুঝতেও পারে না, কেন সে এসেছে! মানুষকে মানুষ দ্যাখে, তার মন তো কেউ পড়তে পারে না। একটা লোক বসে আছে, এইমাত্র। হয় বেকার! না হয় কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, সময়টা কাটিয়ে যাচ্ছে।

গতকালই দিব্যেন্দু উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছে কলকাতায় কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে! সেখানে দিব্যেন্দু একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে। এই চাকরিটা সে যদি আর কিছু দিন আগে পেত; তাহলে তার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত! সে ভীরু, না স্মিতা ভীরু! বহুবার চেষ্টা করেছে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে। খুঁজে পায়নি সমাধান। মেয়েরা প্রেম চায়, না নিরাপত্তা। একটা ভালো চাকরি, একটা ফ্ল্যাটে, নিটোল একটা সংসার!

‘ঝাল-মুড়ি আর চীনেবাদাম খেয়ে তো আর সারাজীবন কাটানো যায় না!’

এই বাঁ-পাশটিতে বসে ঠিক এই কথাই বলেছিল স্মিতা। সেই ছিল ওদের শেষ বসা।

‘তুমি এই কথা বলছ কেন স্মিতা! চাকরি আমি একটা পাবই।’

‘তিন বছরেও পেলে না। তোমার সে ক্যালিবার নেই। মুখচোরা, লাজুকরা এ-বাজারে চাকরি পায় না।’

‘তুমি আর ছ-টা মাস আমার জন্যে অপেক্ষা করো।’

‘আমি রাজি হলেও আমার বাড়ি রাজি হবে না।’

‘তুমি রাজি করাবে।’

‘আমি তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছি। আর কত রাখব! আর কতকাল খোলা আকাশের নীচে হাত ধরে বসে থাকব!’

‘আমরা দু-জনেই যদি বাড়ি ছেড়ে এসে একটা কিছু করি!’

‘দিব্যেন্দু, বিয়ে করতে সময় লাগে মাত্র পনেরো মিনিট; তারপর? কোথায় গিয়ে উঠবে! হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিং রুমে! খাবে কি! খাওয়াবে কি!’

‘কোথাও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব।’

‘ছ-শো টাকার কমে ভদ্রলোকের থাকার মতো আস্তানা হয় না। কোথায় পাবে অত টাকা!’ দিব্যেন্দু আপন মনে হেসে উঠল। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল স্মিতা তার পাশ থেকে উঠে চলে যাচ্ছে। নীল শিফন শাড়ি মোড়া অনিন্দ্য একটি শরীর। রেশমি চুলের আলগা খোঁপা নিটোল ঘাড়ের কাছে অল্প অল্প দুলছে। তীক্ষ্ণ নাক। টানা টানা চোখ, ধনুকের মতো ভুরু। শালুকের ডাঁটির মতো লতানো দু-টি বাহু। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে চুলে। আগুনের সুতোর মতো ঝিলমিল করছে। দিব্যেন্দু স্মিতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল স্মিতার দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া। তার হৃদয় থেকে একটা নরম পাখি যেন উড়ে চলে গেল। স্মিতার বাবা ডাক্তার। স্মিতার ঠাকুরদা ছিলেন হাইকোর্টের জজ সাহেব। বিলেতটিলেত ঘুরে বেড়াতেন। সাহেবি কেতার মানুষ ছিলেন। এই ধরনের নীল রক্ত যার শরীরে তার মনে বাঁধন ছেঁড়া বেদুইন-প্রেম থাকে কী করে, কী করে! দিব্যেন্দু হাত বাড়িয়ে ছিল কার দিকে! আজ দিব্যেন্দু যেভাবে বসে আছে একা, সেদিনও এইভাবেই বসেছিল স্থির সমাধি-ফলকের মতো। শেষ শীতের বাতাসে ঠাণ্ডার কামড়। সন্ধ্যে হয়ে গেল। ঝাপসা একটা চাঁদ ঠেলে উঠল পুব আকাশে। কুয়াশার অশরীরী আঁচল নেমে এল লেকের জলে।

স্কুল শিক্ষকের ছেলে দিব্যেন্দু স্কটিশচার্চের মেধাবী ছাত্র ভেবেছিল, লেখাপড়ায় ভালো হলেই বুঝি, ভালো একটা চাকরি হেঁটে এসে হাত ধরবে। পৃথিবীর সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের ঘষাঘষিতে দিব্যেন্দু বুঝে গেল দুটো জগৎ পাশাপাশি ঘুরছে, কল্পনার জগৎ আর বাস্তব জগৎ। বাস্তব জগতের চাঁদে কবিতা নেই, আছে অজস্র, অতল, অন্ধকার গহ্বর। সূর্য আলো না দেখালে চাঁদ পৃথিবীতে রাতের রূপালি আলো ঢালতে পারে না। সূর্য হল সোনার চাকতি। চাঁদির চাকতি ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ এক অচল পশু।

স্মিতা ছিল তার সহপাঠী। দিব্যেন্দু স্মিতাকে কবিতা লিখে শোনাত। কলেজ সোস্যালে কাঁপা কাঁপা গলায় আবৃত্তি করত। অত শ্রোতার মধ্যে একমাত্র মিতাকেই সে শোনাত। পড়াশোনার নড়বড়ে স্মিতাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লজিক আর ফিলজফি পড়াত। আর মনে মনে ভাবত, স্মিতাকে বউ করবে। ছোট্ট নিখুঁত একটা সংসার। দোতালার বারান্দায় অর্কিড দোল খাবে। ছাদের টবে গোলাপ হাসবে। জানালা দিয়ে ধপধপে চাঁদের আলো এসে পড়বে সাদা বিছানায়। আকাশে, চাঁদ, স্মিতার ছোট্ট কপালে রূপালি টিপ। ভিজে ভিজে গোলাপী ঠোঁট। শরীরে সমুদ্রের ঢেউ। দিব্যেন্দু একদিন স্মিতার কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল! সেইদিনই বুঝেছিল স্মিতা কত সাবধানী। দিব্যেন্দুকে দু-হাতে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ছি:, অমন করতে নেই।’ দিব্যেন্দু সেদিন ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিল। মনে হয়েছিল, সে এক কাঙাল। পরে ভেবেছিল স্মিতা ঠিকই করেছে। প্রবল আকর্ষণে মানুষ বোধবুদ্ধি হারায়। তৃতীয় একটি প্রাণ এসে গেলে কে সামলাতো!

স্মিতা চলে গেলেও পদচিহ্ন রেখে গেছে। মানুষের মন তো আর সমুদ্রের বেলাভূমি নয় যে, ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যাবে। মন হল কাঁচা সিমেন্টের মেঝে। দাগটা ছাঁচের মতো থেকেই যায়। যতই পালিশ করো অস্পষ্ট ফুটেই থাকে। আলোর বিপরীতে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। দিব্যেন্দুর মন সেই দাগ ধরা মেঝে।

স্মিতার খবর সে আর রাখার চেষ্টা করেনি; তবু খবর-তো উড়ে উড়ে আসবেই। খবর আর তুলোর ফুলে বিশেষ তফাৎ নেই। শিমুল যখন ফাটে বাতাসে পাখনা মেলে দেয় অজস্র বীজ। স্মিতা এক পাঞ্জাবী ধনকুবেরের ছেলেকে পাকড়েছে। কলকাতা, দিল্লি, বম্বে, তিনটে শহরে তাদের বড়ো বড়ো তিনটে হোটেল। মানালিতে বিশাল আপেল-বাগান। তাদের পরিবারের প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি আছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বাড়ি। এক উর্দু কবি বলেছিলেন, ‘প্রেমিকা যদি সুখে থাকে প্রকৃত প্রেমিকের তো তাইতেই আনন্দ। বিবাহ প্রেমের কবর রচনা করে; দিব্যেন্দু অতটা ওপরে উঠতে পারেনি। কবি বলেছিলেন, ‘প্রেমিকাকে বউ হিসেবে কাছে পাওয়ার চেয়ে তার স্মৃতি নিয়ে সারাজীবন অবিবাহিত থাকাই স্বর্গীয়।’ দিব্যেন্দু ভেবেছিল বিমলের মতো আত্মহত্যা করবে। বিমল তারই কলেজে সিনিয়ার ছিল। নামকরা ছাত্র, আবার ডিবেট চ্যাম্পিয়ান। বিমল ভালোবাসত মাধুরীকে। মাধুরী ভালোবাসত পার্থকে। মাধুরীর প্রেমের পাল্লা হঠাৎ পার্থর দিকে বেশি ঝুঁকে গেল। একদিন খুব ভোরে দেখা গেল, হেদুয়ার রেলিং-এ মাথা রেখে বিমল অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সে ঘুম আর ভাঙল না। পকেট থেকে বেরুলো সামান্য এক চিরকূট। একটিমাত্র লাইন—‘আমি হেরে গেছি।’ ডক্টর চ্যাটার্জির সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিল বিমল। তিনি খবর পেয়ে বলেছিলেন—‘প্রেম এক ধরনের পাগলামি। মরে বেঁচেছে।’ এই শেষ উক্তিটিই দিব্যেন্দুকে বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়েছে। দিব্যেন্দু তখন উর্দু কবির নির্দেশে স্মৃতি নিয়ে অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত আত্মস্থ করে ফেলেছে। উত্তরবঙ্গের ছবির মতো শহরে, ছবির মতো এক কাঠের বাড়িতে দিব্যেন্দুর বসবাস। মাইনেও পাচ্ছে ভালো। সম্মানের চাকরি। তবু চিউইংগামের মতো স্মিতা আটকে আছে স্মৃতির চুলে। রাতে বড়ো একা লাগে। উত্তরবঙ্গে গিয়ে দিব্যেন্দু আবিষ্কার করেছে তার ভূতের ভয় আছে। রাতে কোথাও একটু খুট করে আওয়াজ হলে, তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তারস্বরে রামনাম জপতে থাকে! এমনকী ছেলেবেলার ছড়াটাও—‘ভূত আমার পুত, শাঁকচুন্নি আমার ঝি, বুকে আছে রাম-লক্ষ্ণণ ভয়টা আমার কী?’ এই ভূতের জন্যেই তাকে না বিয়ে করতে হয়!

দিব্যেন্দু ঘড়ি দেখল। নারসিং হোমে বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। দিব্যেন্দু উঠে পড়ল। গাছের তলায় তলায় ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পথের দিকে। বেশ লোক চলাচল করছে। শহরের পথে বিকালের টান ধরেছে। দিব্যেন্দু হাঁটাতে হাঁটতে চলে এলো নারসিং হোমের সামনে। সম্প্রতি চশমা নিয়েছে। মুখটা বেশ ভারি দেখাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পরিষ্কার জলবাতাসে স্বাস্থ্যটাও বেশ ফিরে গেছে। স্মিতার স্মৃতি মনকে কাবু করলেও শরীরকে কাবু করতে পারেনি, শরীর শরীরের কাজ ঠিকই করে চলেছে। নারসিং হোমের বাগানমতো জায়গাটা পেরিয়ে দিব্যেন্দু দোতালায় ওঠার সিঁড়ির মুখে থমকে দাঁড়াল। তেমন গলগলে ভিড় নেই। বেশ নির্জন নির্জন একটা ভাব। এই হোমে সাধারণত বড়ো বড়ো অফিসের কর্মীরা কোম্পানির টাকায় চিকিৎসা করাতে আসেন।

দিব্যেন্দু তিনতলায় উঠে ঘরের নম্বর মিলিয়ে এগিয়ে গেল। চওড়া বারান্দা। ডানপাশে সব ঘর। পেতলের অক্ষরে নম্বর মারা। বারন্দায় শেষবেলায় আলো প্রবীণ মানুষের মতো পায়চারি করছে। হাহা, খোলা আকাশে গাছের পাতার ঝালর বাতাসে দোল খাচ্ছে। দিব্যেন্দু আপন মনে চওড়া প্রশস্ত বারান্দায় এ-পাশ থেকে ও-পাশ একবার ঘুরে এল। তারপর এগিয়ে গেল ষোলো নম্বর ঘরের দিকে। ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল। ওপাশেই বড়ো জানালা। দু-পাশে সরানো নেটের পর্দা। সেই আলোয় পাতা একটি খাট। ট্র্যাকসানে সটান শুয়ে আছে একটি মেয়ে। তার মাথার লম্বা চুল খাটের মাথার দিকে ঝুলছে। দিব্যেন্দু ভেবেছিল ঘরে কেউ-না-কেউ থাকবে। কেউই নেই। নেটের পর্দা মৃদু বাতাসে দুলছে। বসন্ত এসেছে শহরে।

দিব্যেন্দু সামান্য ইতস্তত করে ডাকল, ‘মৃণাল।’ মেয়েটি দরজার দিকে ঘাড় ফেরালো। তার দুটো পা-ই সামান্য উঁচুতে, ভারি ওজন ঝুলিয়ে টান করে রাখা।

দিব্যেন্দু ঘরে ঢুকতেই স্প্রিং লাগানো দরজা নি:শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। দিব্যেন্দু ঘরের মাঝখানে। বিব্রত ভাবটা কাটাবার জন্যে আবার বললে, ‘মৃণাল, আমি দিব্যেন্দু।’ বহুদূর থেকে যেন মৃণালের গলা ভেসে এল, ‘আসুন। আপনি কী করে এলেন! চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসুন।’ দিব্যেন্দু চেয়ারটা টেনে এনে বসতে বসতে বললে, ‘আমি তিন দিন হল এসেছি। মাসিমার কাছে শুনলুম তোমাকে গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। তাই দেখতে এলুম। কেমন আছ তুমি?’

মৃণাল দিব্যেন্দুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, ‘সারাজীবনের মতোই বোধহয় পঙ্গু হয়ে গেলুম। হাঁটবার আশা আর নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা! আপনি আসবেন আমি ভাবতেই পারিনি!’

মৃণাল একবার বাঁ-হাত, একবার ডান হাত দিয়ে মাথার পাতলা বালিশের তলায় কী একটা খুঁজতে লাগল। দিব্যেন্দু বললে, ‘কি খুঁজছো?’ উঠে গেল বিছানার কাছে। মৃণালের দু-চোখের পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। সে ফিসফিস করে বললে, ‘রুমালটা যে কোথায় গেল!’ বালিশের তলা থেকে পাতলা একটা রুমাল বের করে দিব্যেন্দু সাবধানে মৃণালের চোখ মুছতে গেল। যত মোছে ততই জল বেরোয়! মৃণালের চোখ দুটো ভারি সুন্দর। দীর্ঘ আঁখি পল্লব। মৃণালকে দিব্যেন্দু যখন পড়াত, তখন তার এই চোখ দুটো তাকে ভীষণ আকর্ষণ করত। সমুদ্রের মতো নীল আর গভীর। দিঘির মতো প্রশান্ত। দিব্যেন্দু বললে, ‘তুমি কাঁদছ কেন মৃণাল!’ ‘আমি কাঁদিনি তো? আমার চোখে ঠাণ্ডা লেগেছে।’

দিব্যেন্দু রুমালটা মৃণালের হাতে দিয়ে চেয়ারে এসে বসল। মৃণাল কেন কাঁদছে তার মাথায় এল না। দুঃখে না আনন্দে! দিব্যেন্দু জানে মৃণাল তাকে ভালোবাসত। পড়াতে পড়াতে সে বুঝতে পারত, সম্পর্কটা শিক্ষক আর ছাত্রীর মতো থাকতে চাইছে না, অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছে। দিব্যেন্দু সেই সময় স্মিতা ছাড়া আর কারোর কথাই ভাবতে রাজি নয়। মৃণাল কিন্তু স্মিতার চেয়েও দেখতে সুন্দরী। মুখটা ঠিক মা দুর্গার মতো। একটাই তফাৎ, দু-জনের ব্যক্তিত্ব দু-রকমের। মৃণাল শীতল, স্মিতা উত্তপ্ত। মৃণাল গিরি। স্মিতা আগ্নেয়গিরি। মৃণাল গভীর, স্মিতা চটুল।

দিব্যেন্দু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মৃণালের ছোট্ট কপালে হাত রাখল। কপালের কিনারায় মসৃণ চুলের সীমানা। মেয়েটাকে কেউ একটা টিপও পরিয়ে দেয়নি। কে দেবে! মৃণালের মা আরথ্রারাইটিসে প্রায় পঙ্গু। আত্মীয়স্বজনও বিশেষ কেউ নেই। দিব্যেন্দুর দিকে মৃণাল তাকিয়ে আছে এক নজরে। দু-চোখ জল টলটলে।

দিব্যেন্দু জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার টিপ কোথায় গেল মৃণাল! টিপ পরলে তোমাকে ভারি সুন্দর দেখায়।’

মৃণাল বললে, ‘টিপ? টিপ হারিয়ে গেছে দিবুদা।’

মৃণাল দু-হাত দিয়ে দিব্যেন্দুর হাতটা চেপে ধরল।

দিব্যেন্দু বললে, ‘তুমি ভেঙে পড়ছে কেন? আমি তো আছি!’

দিব্যেন্দুর হাতে মৃণালের হাতের চাপ বাড়ল।

দিব্যেন্দু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঘরের দরজা খুলে এক ঝলক দমকা বাতাসের মতো ঘরে এল একটি যুবক। সুন্দর চেহারা। দেখলেই মনে হয় খেলাধুলো করে। ছেলেটি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হয় ছুটতে ছুটতে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে বললে, ‘মৃণাল, আসতে আঠারো মিনিট দেরি হয়ে গেল। বিলিভ মি, এই জ্যামের জন্যে কলকাতা ছাড়তে হবে। জান তো, ফুট পাথে স্কুটার উঠিয়েছিলুম বলে পুলিশ আমার কান মলে দিয়েছে। তোমার জন্যে আমি ব্যাটাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’

ছেলেটি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নেবার জন্যে থামতেই দিব্যেন্দুর দিকে চোখ পড়ল। এতক্ষণ সে মৃণাল ছাড়া আর কারোকে দেখেনি। পাগলের মতো সাত মাইল স্কুটার চালিয়ে এসেছে। পড়ি কী মরি করে। দিব্যেন্দুকে দেখে সামান্য থতমত খেয়ে গেল ছেলেটি। আরও কিছু বলতে গিয়েও বলা হল না।

মৃণাল বিছানার পাশে একটা হাত ঝুলিয়ে দিয়ে বললে, ‘ভিক্টর! দিব্যেন্দুদা আমার মাস্টারমশাই ছিলেন।’ ভিক্টর হাতজোড় করে নমস্কার করলেও, দিব্যেন্দুর মাস্টারমশাই পরিচয়টা তেমন ভালো লাগল না। মনে মনে সে নিজেকে যতখানি তুলেছিল ঠিক তেমনিই নেমে এল নীচে। মাস্টারমশাই বলে মৃণাল তার প্রেমিক আমির পেটে ভোজালি মেরে দিয়েছে। মৃণালের শীতল কপালে হাত রেখে, তার পদ্ম-ভাসা, জল টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে দিব্যেন্দু তার জীবনের চরম কথাটি বলতে যাচ্ছিল—‘মৃণাল, তুমি পঙ্গু হয়ে গেলেও আমি তোমাকে বিয়ে করব। আর প্রেম নয় এবার সেবা। সারাজীবন তোমাকে সেবা করার অধিকার আমাকে দাও মৃণাল।’ ভেবেছিল খুব আবেগ দিয়ে, নাটক যে ভাবে করে, সেইভাবে বলবে। তার আবেগের বেলুন ফুটো করে দিয়েছে মৃণাল। মাস্টারমশাই! মাস্টারমশাই তো ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপের অধিকারী হতে পারে না। সে তো খুব নিন্দনীয় ব্যাপার। মৃণাল ততক্ষণে ভিক্টরের পরিচয় দিতে শুরু করেছে। সে পরিচয় দিব্যেন্দুর কানে গেল কী গেল না। ভিক্টর আচারিয়া মৃণালের সহকর্মী। দু-জনেই কম্পিউটার বিজ্ঞানী। দু’জনেরই ভীষণ ভালো মাইনে। ভিক্টর প্রাণোচ্ছল, মৃণালের বন্ধু। সবচেয়ে বড়ো কথা ভিক্টর মাস্টারমশাই নয়।

দিব্যেন্দু আর একটু হলেই মৃণালের কপালে ঠোঁট নামিয়ে ছোট্ট একটি চুমু খাবার আবেগ প্রকাশ করতে চলেছিল। সেই অবস্থায় ভিক্টর দেখে ফেললে লজ্জার একশেষ হত। সেই অপমান থেকে বেঁচে গেছে, সেইটাই তার পরম সৌভাগ্য। মৃণাল যখন তাকে শিক্ষক থেকে প্রেমিক করতে চেয়েছিল, তখন দিব্যেন্দু পাত্তা দেয়নি। প্রেম কী কারোর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে! প্রেম আর ট্রেন প্রায় এক জিনিস। আসা মাত্রই উঠে পড়তে হয়। ট্রেন যেমন কোনো স্টেশনে এক মিনিট কোথাও দু মিনিট থামে। থেমেই চলে যায়। ট্রেনের গুমটি যেমন ইয়ার্ড, প্রেমের গুমটি হল বিবাহ। দিব্যেন্দুর আর এক মিনিটও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। এই প্রথম সে অনুভব করল ঈর্ষা। ভিক্টর এখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রেম আর চাকরি প্রায় একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। দিব্যেন্দু যেখানেই ইন্টারভিউ দিতে গেছে, সেখানেই দেখেছে বিশ বাইশজন, পরস্পরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। কে? কে? তুমি? তুমি?

দিব্যেন্দু নীরস গলায় বললে, ‘মৃণাল, আমি তাহলে আজকে যাই।’

মৃণাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, ‘আসুন। সময় পেলে আবার আসবেন।’

দিব্যেন্দু নেমে এল পথে। খুব ইচ্ছে করছিল তার, তখনি একটা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। গোলমালটা কোথায়? চেহারায়? বোকা বোকা মুখ! মরামরা চোখ। না কী, মেয়েদের সে খেলাতে জানে না! মেয়ে আর মাছ কি এক জিনিস। প্রেমের চারে, কথার টোপে গাঁথতে হবে, তারপর হুইল থেকে লোভের সুতো ছেড়ে ছেড়ে, জীবনের জলে খেলিয়ে খেলিয়ে তুলতে হবে। দিব্যেন্দু একটা ট্যাকসিতে চড়ে বসল। কিছু দূর যাবার পর খেয়াল হল হাতের মুঠোয় কী একটা ধরা রয়েছে। মৃণালের রুমাল! ভুলে হাতের মুঠোয় রুমালটা নিয়ে চলে এসেছে। নরম, ফুলফুল, ছোট্ট একটা রুমাল।

পরের দিনই দিব্যেন্দু ফিরে গেল উত্তরবঙ্গে। বসন্ত ফেটে পড়েছে শহরতলির বনস্থলিতে। দূর আকাশের পাহাড়ে অভ্ররেখা। সারাদিন কাজে-কর্মে বেশ তবু কেটে যায়। রাতে, আটটার মধ্যে শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। তখন! তখনই দিব্যেন্দু তার নিরালা ঘরে বসে ভাবতে থাকে। দুটো প্রশ্ন—প্রেম আছে? না প্রেম নেই? পরক্ষণেই হু হু পাহাড়ী বাতাসে দুলে ওঠে জানালার পর্দা, সঙ্গেসঙ্গে জেগে ওঠে দ্বিতীয় প্রশ্ন—ভূত আছে? না নেই? কেউ বলে আছে, কেউ বলে নেই। মৃণালের ছোট্ট লেডিজ রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে, দিব্যেন্দু কারোকে একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করে। কাকে লিখবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *