প্রেমে ওঠা
প্রেমে পড়লেন পতিতপাবন পাল। সহকর্মীরা ডাকত ট্রিপল পি বলে। সেই ডাকগুলো বছর কয়েক আগে শেষ হয়েছে। এখন উনসত্তর। উনসত্তরে কোনও বঙ্গসন্তান প্রেমে পড়েন কি না। তাঁর জানা নেই। অবশ্য ব্যাপারটা ঠিক প্রেমে পড়া কি না তাও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। পার্কে ইদানীং এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয় বিকেলে গেলে। ওপাড়ার জটাবাবু। পুরো নাম জটিলেশ্বর কাঞ্জিলাল। একাশি বছর বয়স। জানেন না–এমন কোনও বিষয় পৃথিবীতে নেই। পতিতপাবনের মনে হল এ ব্যাপারে জটাবাবু তাঁকে জ্ঞানী করতে পারেন। বাস্তবে, বাংলা উপন্যাসে কেউ ঊনসত্তর বছরে প্রেমে পড়েছেন কি না জানা দরকার। তিনি আজ পর্যন্ত মেরে কেটে গোটা কুড়ি উপন্যাস পাঠ করছেন। বাংলা সাহিত্যে নিশ্চয়ই কুড়ি হাজার উপন্যাস আছে। বাকিগুলো খুঁটিয়ে পড়া এ জীবনে সম্ভব নয়।
বিকেল পাঁচটায় জটাবাবু একাই পার্কের ঈশানকোণের বেঞ্চিতে বসেছিলেন। সুযোগ পেয়ে প্রসঙ্গটা তুললেন পতিতপাবনবাবু। চোখ বন্ধ করলেন জটাবাবু–প্রথমেই আপত্তি জানাচ্ছি। জটাবাবু বললেন,–আপনি বলবেন প্রেমে পড়ার কথা। হোয়াই নট প্রেমে ওঠা? বাঙালির একটা টেন্ডেন্সি আছে পতনের দিকে। প্রেমে পড়া, সিনেমায় নামা, অলওয়েজ নিম্নমুখি। কথাটা হবে–প্রেমে ওঠা।
তা চিরকাল পড়া শব্দটাই শুনেছেন, আজ ওঠা-তে উঠতে একটু অস্বস্তি হল পতিতপাবনের।
জটাবাবু বললেন,–এই যে প্রেম, এ আপনাকে উজ্জীবিত করবে, রোমাঞ্চিত করবে, উদার করবে। এই ঘটনা আপনাকে জীবন সম্পর্কে আগ্রহী করবে। এতকাল বদ্ধ জলে আটকে ছিলেন, এখন ঢেউ-এর দোলায় দুলবেন। এ পতন নয়, এ উত্থান। তাই প্রেমে ওঠা বলবেন। কত বয়স?
–ঊনসত্তর।
–এঃ। একেবারে হাঁটুর বয়সি! কি জানতে চান, ঊনসত্তরে প্রেমে ওঠা যায় কিনা? রবিশংকর বিয়ে করেছিলেন ঊনসত্তর বছর বয়সে। বিয়ের আগে অনেক অসুখের খবর পেতাম, এখন দিব্যি আছেন বউ-এর সান্নিধ্যে। রবীন্দ্রনাথ প্রেমে, মানে ভিক্টোরিয়ার প্রেমে উঠেছিলেন চৌষট্টিতে। তারপরের ওই নাবালিকার কেসটা ধরলে সত্তরে।হাত নাড়ালেন জটাবাবু।
–বাংলা উপন্যাসে–
–দূর! বিভূতিভূষণ টু সমরেশ বসু, মারা গিয়েছেন ঊনসত্তরের অনেক আগে। কি করে নায়ককে ওই বয়সে নিয়ে যাবেন? তা ছাড়া তখনকার বাঙালি লেখকরা ছিলেন বিমল করের নায়কের। মতো। কফ, কাশি, মাফলার, হাঁপানি, অজীর্ণরোগ আর বাঁদুরে টুপি। ওদের যৌবন তিরিশেই শেষ হয়ে যেত। এই যে রবীন্দ্রনাথ, নষ্টনীড়-এর নায়ক কে? ভূপতি না অমল? ওঁর ইচ্ছে ছিল ভূপতিকে নায়ক বানানোর, কিন্তু যেহেতু তার বয়স তিরিশ পেরিয়েছে তাই অমল ক্রিম খেয়ে গেল। বিদেশে যান, আশি-পঁচাশিতেও লেখক-অভিনেতারা প্রেমে উঠছেন। বিয়ে করছেন। একই পৃথিবীর মানুষ তো আপনি। তাই না?–জটাবাবু পতিতপাবনকে উৎসাহিত করলেন।
পতিতপাবন পাল এখনও পর্যন্ত বিয়ে-থা করেননি। বাড়িতে একজনই আছেন যাঁর শাসন এখনও মান্য করতে হয় তাঁকে, তিনি তাঁর গর্ভধারিণী। ষোলোয় বিয়ে হয়েছিল, সতেরোতে তাঁকে জন্ম দিয়েছেন। ছত্রিশ বছরে বিধবা হন। এখন এই ছিয়াশিতেও কোনও হেলদোল নেই। বাড়ির বাইরে যান না বটে কিন্তু বাড়ির সব কাজ তাঁর নির্দেশেই কাজের লোক করে। মাঝে-মাঝে। রান্নাঘরেও ঢোকেন। পঞ্চাশ বছরের বৈধব্যজীবন সত্বেও দীক্ষা নেননি, বাড়িতে ঠাকুরঘর তৈরি করেননি। এককালের বড় চাকুরে পতিতপাবন নির্জীব হয়ে পড়েন জননীর সামনে গেলে। তা। এই মহিলাকে প্রেমে ওঠার কথা না নিবেদন করলে তাঁর প্রেম পূর্ণতা পাবে না। কিন্তু এই কর্মটি করার হিম্মত পতিতপাবনের নেই।
বাড়ি ফিরে শুনলেন সন্ধ্যা মুখার্জির গান বাজছে মিউজিক সিস্টেমে। এই সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে। প্রত্যেক সন্ধ্যায় এক-একজন পুরোনো শিল্পীর গান এক ঘণ্টা শোনেন জননী। সাত দিনে সাতজন। আবার রিপিট হয়। এই সময় উনি কথা খরচ করেন না। ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকেন চোখ বন্ধ করে। পরদার ফাঁক দিয়ে আজও একই দৃশ্য দেখলেন পতিতপাবন। হচ্ছে তো প্রেমের গান অথচ প্রেমে ওঠার কথা ওঁকে বলতে পারছেন না।
এক ঘণ্টার গান শোনা শেষ হলে ডাক এল–পতিত, ফিরেছিস?
পতিতপাবন ঘরে ঢুকলেন,–হ্যাঁ মা।
–তুই নাকি সকালে হেঁটে এসে বাড়ির চা খাস না?
ধক করল বুকটা,না, মানে, খেতে ভালো লাগে না।
–উঁহু, লক্ষণ ভালো নয়। খাবারে অরুচি হলেই বুঝবি শরীর খারাপ হতে যাচ্ছে। তার চেয়ে সকালে না হেঁটে বিকেলে আর একটু আগে বেরিয়ে হেঁটে নিস। জননী রায় দিলেন।
–না-না। সকালে হাঁটলেই শরীরের উপকার হয়। এ নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না। –পতিতপাবন পালিয়ে বাঁচলেন।
ভোর পাঁচটায় তৈরি হয়ে নিলেন। বাইরের দরজা খুলে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলে আপনা থেকেই সেটা এঁটে যায়। কিন্তু এই সময় জননী উঠবেনই।
–হাঁটতে যাচ্ছিস?
–হ্যাঁ।
–তুই ফিরলে তবে চা খাব।
–আচ্ছা।
জননী দরজা বন্ধ করলেন। বাড়ি থেকে পার্ক মিনিট পনেরোর হাঁটাপথ। সাদা কেডস, সাদা ফুলপ্যান্ট, সাদা জামা পরে ঊনসত্তরেও বেশ জোরেই হেঁটে এলেন পতিতপাবন। পার্কে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, প্রচুর লোক হাঁটা শুরু করেছে। মাঝখানের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। মাঠের ধার দিয়ে ডিমের মতো রাস্তা। হাঁটতে শুরু করলেন পতিতপাবন। আজ উলটোদিক দিয়ে।
আধাআধি যেতেই, যেখানে বড়-বড় দেবদারু গাছগুলো দাঁড়িয়ে, গলা কানে এল–এই যে, আমি এখানে।
তাকালেন। যাজ্ঞসেনী বসে আছেন বেঞ্চিতে। কিছুদূরে তাঁর পরিচারিকা দাঁড়িয়ে। তার কাঁধে ফ্লাস্ক, হাতে বাস্কেট।
–গুডমর্নিং। কাছে গিয়ে বললেন পতিতপাবন।
–মর্নিং। বেলা, সাহেবকে চা দে।
পতিতপাবন আপত্তি করলেন।
–সে কি? আমি মকাইবাড়ির চা নিয়ে এসেছি। লিকার, এক চামচ মধু দিয়ে তৈরি। না খেলে খুব দু:খ পাব! ঠোঁট ফোলালেন যাজ্ঞসেনী।
–মকাই বাড়ি–বিড়বিড় করলেন পতিতপাবন।
–হ্যাঁ। দে বেলা।
বেলা নামের পরিচারিকা সঙ্গে-সঙ্গে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল।
–আপনি?
–এখন না, এর পরের বার। চিকেন স্যান্ডউইচ আছে আজ।
পতিতপাবন হাসলেন–বাব্বা! বেড়াতে এসে এত সময় পান?
–আগে তো করতাম না, এখন করি। যাজ্ঞসেনী বললেন,–আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না, কত জায়গা পড়ে আছে। বেলা, যা একটু ঘুরে আয়। আধঘণ্টার মধ্যে আসবি। যা।
যাজ্ঞসেনী হাত নাড়তেই বেলা উধাও হল।
আলাপ মাত্র দশদিনের। এই ভোরে হাঁটতে-হাঁটতে একটু জিরোচ্ছিলেন, পরিচারিকাকে নিয়ে যাজ্ঞসেনী এখানে এলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,–আপনি সঙ্গীতার স্বামী, না?
–না-না। আমি অবিবাহিত।
–ইয়ে, কিছু মনে করবেন না। কি ভুলটাই না করেছি।
–তাতে কি হয়েছে? আমি পতিতপাবন পাল।
–আমি যাজ্ঞসেনী দত্ত। উইডো। বিয়ের আগে বোস ছিলাম।
–ও। খুব স্যাড।–পতিতপাবন বললেন।
–স্যাড কেন?
–না, আপনার উনি চলে গেছেন।
–ভালোই হয়েছে। ক্যান্সারে ভুলছিল। যন্ত্রণা পাচ্ছিল খুব। আমার তখন অল্প বয়েস। এই ঊনচল্লিশ কি চল্লিশ। কুড়ি বছর হয়ে গেল।
–তাহলে অবশ্য ভালোই।
–চা খাবেন?
–চা?
–বেলা, সাহেবকে চা দে।
সেই আলাপ। তারপর প্রতিটি সকালে এক ঘণ্টার জন্যে দেখা, হাঁটা মাথায় উঠল। জানলেন যাজ্ঞদেবীর বয়স ঊনষাট। ছেলে-মেয়ে হয়নি। নিজের বাড়ি। অর্থাভাব নেই। গান শোনা আর বই পড়া ওঁর হবি। আর খাওয়াতে ভালোবাসেন। কিন্তু ভালোবাসলেই তো হল না, ভালো লোক চাই, যাকে খাওয়ানো যায়।
তাই ভোর না হতে-হতেই মন আনচান করে আজকাল। কখন যাজ্ঞসেনীর দেখা পাওয়া যাবে। এককালে যে সুন্দরী ছিলেন তা এখনও বোঝা যায়; স্লিভলেস পরেন। সেকালে হয়তো শাঁখের মতো ছিল হাত দুটো, এখন গজদাঁতের মতো। তাই বা কম কি!
–আমি আর পারছি না।–যাজ্ঞসেনী বললেন।
-কি ব্যাপার?–পতিতপাবন বুঝতে পারলেন না।
–দুষ্টু। কিছু বোঝেন না যেন!
–ও।
–আজই বাড়িতে আসতে হবে।
–বাড়িতে?
–হু। কোনও ভয় নেই। একতলায় বাবা থাকেন। বাতের ব্যথায় সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না, তাই দোতলায় আমি একা। কি একা!যাজ্ঞসেনী বললেন।
–বাবা বেঁচে আছেন? কি ভালো?
–নাইন্টি! বাবা মানে আমার শ্বশুমশাই। মাইডিয়ার মানুষ। ওঁকে বলেছি আপনার কথা। খুব খুশি হয়েছেন।
–খুশি হলেন কেন?
–বললেন, যাক, তবু তুমি সঙ্গী পেলে। শুনুন মশাই, আপনি আমার বাড়িতে না গেলে বাবা আপনার বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে প্রস্তাব দেবেন।
আঁতকে উঠলেন পতিতপাবন–অসম্ভব!
–কেন? অসম্ভব কেন?
–আমার মা যে কি, মানে কত কড়া তা তো জানেন না!
–আশ্চর্য! ঊনসত্তর বছরেও আপনি শিশু হয়ে আছেন নাকি?
–না তা নয়–
–তার মানে মায়ের ভয়ে আপনি এগোবেন না?
–তা নয়–
–তা-নয় তা-নয় করছেন, ভয়টা কি?বলুন?
পতিতপাবন চুপ করে থাকলেন। সেটা দেখে যাজ্ঞসেনী সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন,সব খুলে বলুন তো। আপনি আমার প্রেমে পড়েননি?
–না, প্রেমে উঠেছি।
-মানে?
জটাদার কথা বললেন পতিতপাবন। শুনে হেসে গড়িয়ে পড়লেন যাজ্ঞসেনী, একবার পতিতপাবনের গায়েও ছোঁয়া লাগল। সেইসঙ্গে ভালো সেন্ট নাকে এল। পতিতপাবন বললেন,–ভাবছি আমি নিজেই মাকে বলব।
–গুড! এই তো চাই। আজ বিকেলে আমার বাড়িতে আসতে হবে, বাবা আলাপ করার জন্যে মুখিয়ে আছেন। যাজ্ঞসেনী ঘোষণা করলেন।
দরজা খুলল বেলা। দেখেই চ্যাঁচাল–এসে গেছেন! এসে গেছেন! মা এখন বাথরুমে। বসুন।
–কে রে বেলা? বৃদ্ধের গলা কানে এল।
–ওই যে, সে!
–বেলা কান পর্যন্ত হাসল। বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলেন। পাকা আমের মতো দেখতে।
–পতিতপাবন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–বউমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ?
–না, মানে–
–আবার না কীসের? বসো। বে-থা করোনি শুনলাম।
–হ্যাঁ। করা হয়ে ওঠেনি।
–এই কুড়ি বছরে অন্তত পনেরো জনকে দেখলাম। ম্যাক্সিমাম আয়ু যার ছিল, সে তিন সপ্তাহ এসেছিল। ব্যস।
-কেন?
–বউমা তো সতী-সাবিত্রী মহিলা। খাবার খাওয়াবে, গল্প করবে, যত্ন নেবে কিন্তু নিজের ঘরে একা শোবে আমার ছেলের ছবি নিয়ে। বিয়ের পর কোন পুরুষ সেটা সহ্য করবে বলো! আমার মতো বুড়োও করবে না। –ফিকফিক করে হাসলেন বৃদ্ধ।
পতিতপাবন আর দাঁড়ালেন না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে পা বাড়ালেন। প্রেমে পড়লে গড়াগড়ি খেতে হয়, কিন্তু প্রেমে উঠলে তো উড়ে যাওয়া যায়। আর যাই হোক প্রেমে ওঠা তো ওলাওঠা নয়!