প্রেমিক-প্রেমিকা
একদা এক ঈর্ষাপরায়ণ প্রেমিক তার প্রেমিকাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার আগে, আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে ভালবেসেছে।’
সবাই জানেন, বিশেষত পাঠিকা ঠাকুরানিরা জানেন, এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, সহজে উত্তরে দেয়া যায় না।
কিন্তু এক্ষেত্রে প্রেমিক নাছোড়বান্দা, তাকে জানতেই হবে সে তার প্রেমিকার প্রথম প্রেমিক কি না। অবশেষে বাধ্য হয়ে প্রেমিকা কবুল করল, খুবই সংক্ষিপ্ত সেই কবুলিয়ত, ‘হ্যাঁ।’
এবার প্রেমিকবাবু উত্তেজিত হয়ে লম্ফঝম্ফ শুরু করল, প্রেমিকার কাছে দাবি করল, ‘তুমি তার নাম-ঠিকানা বলো, আমি তাকে দেখে নেব।’
প্রেমিকের এবম্বিধ অবস্থা দেখে প্রেমিকা বেচারিনি কম্প্রকণ্ঠে জানাল, ‘সে যে অনেকজন, কম পক্ষে দশ-পনেরো হবে, তুমি একা এতজনের সঙ্গে লড়বে কী করে?’
হিন্দি ফিল্মে অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র এবং অনুরূপ আরও অনেকে একা খালি হাতে এমন দশ-পনেরো জনের সঙ্গে লড়েছেন এবং জিতেছেন। আমাদের এই হাঁটুঝুল পাঞ্জাবি, আলিগড়ি পাজামার প্রেমিক যুবকটি মারদাঙ্গায় চিত্রতারকাদের মতো সব্যসাচী নন, তিনি কিঞ্চিৎ দ্বিধার পর পুরুষোচিত ক্ষোভে দাঁত কড়মড় করে ঘোষণা করলেন, ‘একেকটাকে হাতের কাছে পাব আর তক্তা করে দেব।’
আর-এক প্রেমকাহিনী একটু অন্য জাতের।
ঘটনাটি অতি সাম্প্রতিককালের, তাই কিঞ্চিৎ রয়েসয়ে, রেখে ঢেকে বলতে হচ্ছে।
সূর্য আর চন্দ্র দু’জনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আজ কিছুদিন হল চন্দ্র রোহিণী নামের একটি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। দুঃখের বিষয় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকায় এর মধ্যে সূর্যের সঙ্গে রোহিণীর পরিচয় হয়নি। তবে চন্দ্রের কাছে রোহিণীর কথা শুনেছে। ক্লাবের টেবিলে অথবা অসময়ে টেলিফোনে গদগদ গলায় চন্দ্র রোহিণীর রূপগুণের ব্যাখ্যান করেছে বন্ধু সূর্যের কাছে।
অবশেষে এই বড়দিনের সন্ধ্যায় এক টইটুম্বুর পার্টিতে সূর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল চন্দ্রের প্রেমিকা রোহিণীর। চন্দ্রের পছন্দ দেখে খুব খুশি হল সূর্য, চমৎকার মেয়ে রোহিণী, ঝকমকে, ঝলমলে। বিদ্যাবুদ্ধিও আছে।
খুব আলাপ জমে গেল সূর্যের বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে। এই পর্বও ভালই চলছিল কিন্তু বড়দিনের পরের দিন সকালে হ্যাংওভার-ক্লিষ্ট সূর্য একটা ফোন পেল সাতসকালে, ‘হ্যালো, সূর্য আমি রোহিণী বলছি, খুব ভাল লাগল কালকে। তা আজ সন্ধ্যাবেলা কী করছ?’
একটু ইতস্তত করে সূর্য বলল, ‘তেমন কিছু নয়।’
রোহিণী বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে চলে এসো।’
কী আর বলবে সূর্য, রাজি হয়ে গেল। তারপর বন্ধু চন্দ্রকে নিমন্ত্রণের ব্যাপারটা বলল। চন্দ্র আকাশ থেকে পড়ল, সেকী, আমি তো কিছু জানি না।
সন্ধ্যাবেলা রোহিণীদের বাসায় গিয়ে সূর্য অবাক। আর কেউ নেই। সুসজ্জিতা, সুরভিময়ী একা তার জন্যে অপেক্ষা করছে। এমন একটা মোহময়ী সন্ধ্যা সুর্যের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না।
এই রকম চলল কয়েক সপ্তাহ। প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় রোহিণীর ডাক আসে। এদিকে চন্দ্রের সঙ্গে সূর্যের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, প্রতিদিনই বাড়ছে।
চন্দ্র আজকাল কদাচিৎ ফোন করে সূর্যকে। সূর্য ফোন করলে ফোন নামিয়ে রাখে। ক্লাবে দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
সূর্য কিন্তু বন্ধুত্বের অবমাননা করেনি। গল্পগুজব হাসিঠাট্টার বেশি রোহিণীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা এগোয়নি, অবশ্য রোহিণীও খুব একটা বাড়াবাড়ি করেনি।
যবনিকা উত্তোলন হল দেড় মাসের মাথায়। একদিন সকালে চন্দ্র ফোন করে বলল, ‘আজ সন্ধ্যাবেলা রোহিণীদের বাসায় আসিস।’ বিস্ময়ের পর বিস্ময়, একটু পরেই ফোনে রোহিণী একই অনুরোধ করল।
সেদিন সন্ধ্যায় রোহিণীদের বাড়িতে গিয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতা হল সুর্যের। শুধু সূর্যের নয়, সূর্য-চন্দ্র দু’জনারই। রোহিণী জানাল এ দেড়মাস সে চন্দ্রের প্রেমের গভীরতা, সূর্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় চন্দ্র কতখানি ধৈর্যহারা, ঈর্ষাপরায়ণ, এসব বিচার করছিল। চন্দ্র সসম্মানে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, সুতরাং এ খেলার আর প্রয়োজন নেই। সুতরাং ‘ধন্যবাদ’, রোহিণী উঠে গিয়ে সূর্যের ললাটে, এই প্রথম, একটি স্নেহচুম্বন নিবেদন করল।
পুনশ্চ:
চন্দ্র-সূর্যের ব্যাপারই আলাদা। এবার ঘরের কাছে আসি। ঘরের কাছে মানে গঙ্গারাম। গঙ্গারাম তখন চুটিয়ে প্রেম করছে আর কবিতা লিখছে। প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় ঠিকঠাক। গঙ্গারাম তখন প্রেমিকাকে বলল, ‘মানসী, আমি যে কবিতা লিখি সেকথা বাড়িতে বলেছ?’ মানসী বলল, ‘তুমি যে আধা বেকার, তুমি যে মাঝেমধ্যে মদ খাও, রেসের মাঠে যাও এসব কথাই বাড়িতে জানিয়েছি। কিন্তু কবিতা লেখার কথাটা বলিনি। তা হলে কিন্তু বিয়ে ভেঙে যাবে। বাবা-মা এতটা সহ্য করবেন না।’