প্রেমাস্পদ গুপ্ত সমিতি

প্রেমাস্পদ গুপ্ত সমিতি

‘দেখুন এই বিয়েটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷’

‘সে কী আপনি নিজেকে এতটা অযোগ্য মনে করেন!’

কটমট করে একবার বাচস্পতির দিকে তাকায় পাঞ্চালী, ‘ইয়ার্কি মারছেন? বুঝুন ব্যাপারটা৷ আমি আপনাকে রিজেক্ট করছি৷’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকায় প্রবুদ্ধ, ‘সেক্ষেত্রে বলব আপনি শুধু অযোগ্যই নয়, বেয়াক্কেলেও…’

‘মানে?’

‘মানে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শেখেননি৷ শেক্সপিয়র পড়েননি নাকি? ওই যে, There is a tide in the affairs of men– Which taken at the flood– leads on the fortune– Omitted– all the voyage of their life is bound in shallows and in miseries.

কথাগুলো উচ্চারণ করেই মুখ ফিরিয়ে নেয় প্রবুদ্ধ, ‘সে যাক গে, আপনি আবার ইংরেজিতে ওই যাকে বলে…’

‘এই… ঠিক এই জন্যেই…’ গনগনে গলায় বলে পাঞ্চালী, ‘আপনাকে পছন্দ হয়নি আমার… শুধু মুখেনং মারিতং জগত৷ কথায় কথায় অন্যকে খোঁচা মারা৷ একটা মেয়ে ইন ইয়োর ফেস রিজেক্ট করছে আপনাকে আর এতটুকু লজ্জাপিত্তি বলে নেই আপনার৷ উলটে বেকুবের মতো মুখ করে শেক্সপিয়র আউড়াচ্ছেন!’

‘আমি ভীষণ স্বপ্ন দেখি জানেন…’ প্রবুদ্ধ আবার ভাবুক হয়ে যায়৷ ‘কী রকম স্বপ্ন?’

হাত দিয়ে একটা আঁতেল গোছের ভঙ্গি করে প্রবুদ্ধ, মনে হয় একটা অদৃশ্য ফুটবল দু-পাশ থেকে ধরার চেষ্টা করছে, ‘এই ধরুন এমন একটা সমাজের যেখানে মানুষ কথায় কথায় শেক্সপিয়র, কাফকা, নেরুদা আউড়াবে, প্রেমে ল্যাং খেয়ে, কন্সটিপেশনের চাপ নিতে নিতে, কিংবা প্রেমিকার ঠোঁটে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে…’ কী যেন ভেবে থেমে যায় প্রবুদ্ধ, ‘আচ্ছা আপনার কখনও মনে হয়নি যে চুমু খেলে আদৌ চকাস করে আওয়াজ হওয়া সম্ভব নয়… মানে ওই ‘ছক’ আর ‘স্কচ’ এর মাঝামাঝি একটা শব্দ…’

‘জানি না আমি৷’ ছাদের পাঁচিলের উপরে হাত দিয়ে একটা ঘুসি মারে পাঞ্চালী, ‘একটা মানুষ এত বাজে বকতে পারে ভাবা যায় না৷’

‘আপনার ভাবনার পরিধি ভারী সীমিত দেখছি৷ একটু আগেই তো আপনার বাবার সঙ্গে কথা হল৷’

‘আপনি আমার বাবাকে…’

‘আহা তা বলিনি…’ নরম একটা হাসিকে ড্যামেজ কন্ট্রোলে মাঠে নামায় বাচস্পতি, ‘বলছিলাম উনি তো বললেন আমাকে বেশ পছন্দ হয়েছে৷ আপনার এত বেঁকে বসার কী আছে বলুন তো?’

পাঞ্চালির গলকণ্ঠটা ওঠানামা করে, ইতস্তত করে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবে সে, তারপর ধরা গলায় বলে, ‘আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি৷ তাকেই বিয়ে করতে চাই৷’

প্রবুদ্ধ আর কিছু বলে না, দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবনায় ডুবে যায়৷ পাঞ্চালী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর হালকা একটা ঠেলা দিয়ে বলে, ‘কিছু বললেন না যে…’

‘আঃ… ডিস্টার্ব করবেন না৷’ ধমকে ওঠে প্রবুদ্ধ বাচস্পতি, ‘ভাবছি৷’

‘কী ভাবছেন?’

‘শেক্সপিয়র… হ্যাঁ মনে পড়েছে…’

মনটা খারাপই হয়ে যায় পাঞ্চালির৷ ছেলেটার সঙ্গে সপ্তাহ খানেক হল মেলামেশা করছে ও৷ এর মধ্যে এটুকু বুঝতে পেরেছে প্রবুদ্ধ বাচস্পতির মাথায় খানিকটা ছিট থাকলেও সে মানুষটা খারাপ নয়৷ কেউ ইংরেজি কম জানলে তাকে একটা খোঁচাটোচা মেরে থাকে বটে৷ তবে হামবড়া ভাব নেই তেমন৷

কী যেন একটা ভজকট লাইন আউড়ে চলেছে এখন৷ পাঞ্চালির কানে ঢকুছে না সেসব৷ থামিয়ে দিয়ে সে বলে, ‘দেখুন, আমি আপনাকে আগেই সব বলতে চেয়েছিলাম… কিন্তু সাহস হয়নি৷’

‘কেন?’

‘আপনি যদি গিয়ে বাবাকে বলে দেন…’

ভুরু কুঁচকায় প্রবুদ্ধ, ‘মানে আমার কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? এমনিতেই লোকটা…’ নিজেকে সামলে নেয় প্রবুদ্ধ, ‘তা বাড়িতে বলেননি আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘বলেছিলাম৷ মানতে রাজি হয়নি৷’

‘কেন?’

‘ও ভালো চাকরি বাকরি করে না৷ ছবি আঁকা নিয়ে থাকে সারাদিন৷ টিউশনি পড়ায়৷ বাবা বলেছে সরকারি চাকরি না হলে বিয়ে হবে না৷’

‘আপনার বাবা মেয়ে দেবে না লোন দেবে?’ প্রবুদ্ধ একটু বাঁকা হাসি হেসে বলে, ‘অবশ্য হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে ব্যাঙ্ক লোনের তেমন তফাত নেই৷ দুটোই লায়াবিলিটি…’

‘আপনি তখন থেকে আমাকে অপমান করে চলেছেন৷’

হঠাৎ করে প্রবুদ্ধের চোখমুখ বদলে যায়৷ মুখ দেখে মনে হয় এতক্ষণের বেপরোয়া ভাবুক ভঙ্গিটা একটা খোলস ছিল৷ চারদিকটা দেখে নিয়ে সন্তর্পণে সে বলে, ‘ইয়ে আপনি সত্যি বলছেন তো?’

পাঞ্চালী চমকে যায়, ‘খামোখা মিথ্যে বলব কেন?’

‘মানে ধরুন আপনার এই মুহূর্তে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই, জাস্ট কাটানোর জন্য এইসব বাহানা দিচ্ছেন, কিংবা কোনও জটিল গুপ্তরোগ-টোগ… কিংবা বিয়েতে লোক খাওয়ানোর ভয়ে…’

খেপে ওঠে পাঞ্চালী, ফোনটা হাতে নিতে নিতে বলে, ‘দাঁড়ান এক্ষুনি বিতানের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি৷’

হাঁ হাঁ করে ওঠে প্রবুদ্ধ, ‘না না ওসবের দরকার নেই৷ বরঞ্চ আপনি আমার কথাটা মন দিয়ে শুনুন৷ তবে খবরদার—কাক-পক্ষী অবধি যেন টের না পায়৷’

ছেলেটার হাবভাব দেখে কেমন সন্দেহ হয় পাঞ্চালির৷ কী যেন একটা রহস্য করছে প্রবুদ্ধ বাচস্পতি৷ কাধটা ঝুঁকে এসেছে, গলার স্বর খাদে নেমে এসেছে৷ ব্যাপার কী? পাঞ্চালীর কানের পাশ লাল হয়ে ওঠে৷

‘তবে শুনুন…’ গুপ্তধনের সন্ধান দিতে চলেছে এখন ভঙ্গি করে প্রবুদ্ধ বলে, ‘আমি প্রেমাস্পদ সোসাইটির মেম্বার৷’

পাঞ্চালী ভালো শুনতে পায় না, পেলেও ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, বলে, ‘কী আপদ বললেন?’

‘আঃ, আপদ নয়৷ প্রেমাস্পদ সোসাইটি… দি সিক্রেট ব্রাদারহুড৷ নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

‘না তো৷ কী সেটা?’ অবাক হয়ে বলে পাঞ্চালী৷

জিভ দিয়ে চুক চুক করে একটা শব্দ করে প্রবুদ্ধ, ‘এঃ আপনি দেখছি শেক্সপিয়ার কাফকা দূরের কথা, ড্যান ব্রাউন অবধি খুলে দেখেননি৷’ আবার সেই অদৃশ্য ফুটবলটা ধরার চেষ্টা করে প্রবুদ্ধ, ‘এই যে ধরুন প্রাচীনকালে সমাজের মঙ্গলের জন্য কিছু জ্ঞানীগুনী লোকজন মিলে একটা গুপ্ত সমিতি তৈরি করত৷ রাজা বা ধর্মের চোখরাঙানি এড়িয়ে তলে তলে সমাজের মঙ্গল চিন্তায় লড়ে যেত এরা৷

প্রিয়রি অফ সিওন, নাইটস টেমপ্লার, আমাদের দেশি নাইন আননোন মেন, শোনেননি?’

‘কিন্তু এসবের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?’

‘আমাদের প্রেমাস্পদ সোসাইটিও এরকমই কলকাতার হোমগ্রোন এক গুপ্ত সমিতি৷’ বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় প্রবুদ্ধ৷ মুখে স্বর্গীয় হাসি খেলতে তার৷ বিকেলের নরম আলো তার মুখে এসে পড়ে৷৷

মাসখানেক আগে প্রবুদ্ধ বাচস্পতি ও তার পরিবার দেখতে আসে পাঞ্চালীকে৷ ছেলেটা দেখতে শুনতে খারাপ না৷ সরকারি চাকরিও করে, তবে প্রথম থেকেই পাঞ্চালীর মনে হয়েছিল তার মাথায় খানিক ছিট আছে৷ মুখে দাড়ি কিংবা গোঁফের ছিটেফোঁটা নেই৷ হাফ রিমের একটা চশমা ঝোলে চোখে৷ মুখের মধ্যে নাকটা ভয়ানক রকমে খাঁড়া৷ চরিত্রের সঙ্গে মুখের এমন মিল আগে দেখনি পাঞ্চালী৷

পাঞ্চালী পছন্দ-অপছন্দ কোনওটাই বাড়িতে খোলসা করে কিছু বলেনি৷ তবে অনলাইনে টুকটাক কথাবার্তা শুরু হয়৷ বাচস্পতি সারাদিনই ইংরেজি সাহিত্যের বুলি কপচে যায়৷ পাঞ্চালীর বানান ভুল পয়েন্ট আউট করে দেয়৷ সে নিজে স্কুলে থাকতে কত নম্বর পেয়েছিল, কঠিন ক্যালকুলাসের অঙ্ক দিয়ে কী করে প্রাইভেট টিউটরকে নাস্তানাবুদ করেছিল সেইসব ইতিহাস বর্ণনা করে যায়৷ পাঞ্চালীর ঘুম পেয়ে যায়৷

তবে এই ক-দিনে এটুকু সে বুঝেছে, বাবা-মাকে আটকে রাখার জন্য এর থেকে ভালো পাত্র আর হয় না৷ ফিরিস্তি নেই৷ বায়নাক্কা নেই৷ খালি কান খুলে তার জ্ঞান-বুদ্ধির বড়াই শুনলেই সে খুশ৷

‘প্রেমে পড়ুন, কেটে পড়ুন…’

‘অ্যাঁ কী বললেন?’ পাঞ্চালী থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘আমাদের ট্যাগলাইন৷ টেটিয়া বাবা-মার হাত থেকে যুগলকে ভাগলবা করে দেওয়াই আমাদের লক্ষ, সামান্য কিছু টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের বিনিময়ে আমরা প্রেমিক যুগলকে বেড়া পার করে দিই৷’

মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল পাঞ্চালীর৷ বুকের উপরে একটা হাত রেখে নিজেকে শান্ত করল সে, জিজ্ঞেস করল, ‘মানে আপনার বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না৷ তাহলে আমাকে দেখতে এসেছিলেন কেন?’

‘বিয়ে! খেপেছেন নাকি? আমাদের পেশায় বিয়েফিয়ে অসম্ভব৷ বারনার্ড শ বলেছিলেন বিয়ে হল একপ্রকার আইনসিদ্ধ বেশ্যাবৃত্তি৷ আমি এসেছিলাম ক্লায়েন্ট ধরতে৷’

‘ক্লায়েন্ট!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ কার বিয়েতে বাবা-মা বেঁকে বসেছেন সেটা বের করতে এর থেকে ভালো উপায় কিছু আছে, বলুন?’

ছাদের একটা পাঁচিলে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিল পাঞ্চালী৷ এসব কী হয়ে চলেছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ সাধারণত ছেলেদেরকে এভাবে বিয়ের জন্য রিজেক্ট করলে হয় তারা দেবদাস জাতীয় মুখ করে সরে পড়ে নাহয় ধমক ধামক দিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে শান্ত হয়ে যায়৷ কিন্তু এ ছেলে তো রীতিমতো সমাধান নিয়েই হাজির হয়েছে৷

পকেট থেকে একটা নোটবই আর একটা হার্ট সাইনমার্কা ভিজিটিং কার্ড বের করে৷ ভিজিটিং কার্ডটা পাঞ্চালীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই হল আমার কার্ড৷ যে কোনও দরকারে…’

কার্ডটা উলটে পালটে কিন্তু কোনও লেখাই চোখে পড়ল না পাঞ্চালীর, ‘একী এতে তো কিছুই লেখা নেই৷’

‘আঃ… এত বোকামি নিয়ে কী করে যে প্রেম করেছেন কে জানে! বললাম যে আমরা সিক্রেট সোসাইটি৷ এমনি এমনি দেখা যায় নাকি? রক্ত হবে একটু?’

‘রক্ত কোথায় পাব?’

‘চোখের জল?’

‘এসব দিয়ে কী হবে?’

বাচস্পতি কুরকুর করে নোটবুকে কী যেন লিখতে লিখতে বলে, ‘ও দুটো তরল কাগজের উপরে ঘষলেই লেখা ফুটে উঠবে৷ আসলে কী জানেন’ একটা বাহু মাথার উপরে রাখে প্রবুদ্ধ, ‘প্রেমে পড়লে চোখ ফেটে জল আর হাত কেটে রক্ত বেরোবেই৷ ফলে ওই… ইয়ে আপনাদের প্রেমটা কতদিনের?’

‘সাত মাস৷’

‘বাবা! এই ক-দিন তো ববি দেওলের সিনেমাও হল ছেড়ে বেরোয় না…’ কিসে যেন টিক দেয় বাচস্পতি, ‘কী কী অ্যানিভারসারি পালন করেছেন? পনেরো দিন, তিন মাস, সাড়ে ছ-মাস?’ ‘সব ক-টা…’

‘নিবি…’

পাঞ্চালী বিদ্রোহ করে, ‘একী! আপনি তুইতোকারি করছেন কেন?’

‘উঁচু… বললাম এই আধদামড়া বয়সে আপনি আমাদের ‘ন্যাকানিবি’ ক্যাটেগরিতে বিলং করছেন, যাই হোক এবার দরকারি কথায় আসি…’

‘প্লিজ আসুন৷’

‘কী নিয়ে ভাগবেন ঠিক করেছেন?’

‘আপনি কী ভাবছেন বলুন তো আমাকে?’

বাচস্পতি ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে, ‘আপনার বাবার মুখ দেখে মনে হয় ওনার কালো ধন আছে…’

আঁতকে ওঠে পাঞ্চালী, ‘কী বলতে চাইছেনটা কী?’

‘ব্ল্যাক মানি৷ সোনার বিস্কুট… সেসব সঙ্গে নিতে পারেন… চোরের উপর বাটপারিতে কোনও দোষ নেই…’

পাঞ্চালী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ‘আমার একদম এসব ভাগাভাগি করতে ইচ্ছা করে না৷’ মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার, ‘আমি চাই একদিন বিতান নিজে এসে বাবাকে কনভিন্স করে…’

‘এই দাঁড়ান দাঁড়ান…’ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় বাচস্পতি, ‘মন দিয়ে শুনুন তো৷ কিছু শুনতে পাচ্ছেন?’

পাঞ্চালী হাওয়ায় কান পাতার চেষ্টা করে, ‘কই না তো…’

‘ভালো করে শুনুন… একটা ম্যান্ডোলিনের আওয়াজ আসছে না?’

আরও ভালো করে শোনার চেষ্টা করে পাঞ্চালী, ‘উঁহু… না…’

‘এলিমেন্টারি ওয়াটসন৷’ বাচস্পতির মুখে বাঁকা হাসিটা ফিরে আসে, ‘আপনাদের এই জেনারেশনটা না, কেবল শাহরুখ খানের সিনেমা দেখে দেখে ফুঁকে গেল৷ আপনার জন্য কেউ সর্ষে খেতে বসে ম্যান্ডলিন বাজাচ্ছে না৷ এবার বাস্তবে আসুন দেখি… তা ভেগে কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন?’

‘মহা মুশকিল তো…’ পাঞ্চালী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আমি এতদিন পালানোর প্ল্যান করে বসেছিলাম নাকি?’

অপরাধী মুখ করে বাচস্পতি, ‘হুম, তাও কিছু তো ভেবে রেখেছেন৷ মানে বাবা-মাকে ম্যানেজ তো করতে হবে৷’

‘ওকে একরকম জোর করেই আবার পড়াশোনা করাচ্ছি৷ চাকরির পরীক্ষাগুলো দিচ্ছে… তবে ওই ইংরেজিতেই…’

‘গাড্ডা খেয়ে যাচ্ছে…’ দাঁতের ফাঁকে হাসে প্রবুদ্ধ, ‘একেবারে কাঠে কপাটে পড়েছে যাকে বলে, আপনাদের চারহাত এক হওয়া আটকায় কে… চারহাতে ইংরেজি বানানের গলা টিপে দেবেন…’ একটু থেমে বলে, ‘ওসব করে হবে না৷’

‘আপনি কী করে জানলেন হবে না?’

‘দেখুন আমাদের নাকের তলা দিয়ে ওরকম অনেক চাকরি খোঁজা প্রেম রোজ গলে যায়… যতদিনে সে চাকরি পাবে ততদিনে আপনার ছেলেমেয়ের চাকরি খোঁজার বয়স হয়ে যাবে৷ ভালো চান এইবেলা ভেগে যান…’

‘আপনি ভেবে দেখেছেন তারপর আমার বাবা-মায়ের কী হবে?’

‘কী হবে?’

‘সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন ওঁরা?’

‘কেন আপনি ওঁদের মুখের চামড়া তুলে নিয়ে পালাবেন নাকি? আরে একবস্ত্রে বেরিয়ে আসবেন, একান্ন খাবেন, সাড়ে চারহাজার টাকা ভাড়ায় ঘর আমরা দেখে দেব৷’

ছাদের অন্যদিকে সরে আসে পাঞ্চালী৷ একবার দরজার দিকে দেখে নেয়, ‘ধুর, আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না৷ বাবা-মা এতদিন ধরে বড়ো করল আমাকে৷ আর আজ একটা ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে বলে ওদের ছোটো করে দিয়ে চলে যাব৷’

বিকেল নামতে শুরু করেছে এবার৷ দূরে কয়েকটা পাখি বাড়িঘরের মাথা দিয়ে ঢিমে তালে উড়ে যাচ্ছে উঁচু নারকেল গাছগুলোর দিকে৷ বাসায় ফিরছে মনে হয়৷ সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বাচস্পতির ভুরু কেঁপে ওঠে একবার, ‘আমার বাবা-মা খুব ঝগড়া করে জানেন৷ প্রতিবার কিছু একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়, তারপর মা ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে, তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে৷ কী পেয়েছি বিয়ে করে? গয়না, বাড়ি, বছর বছর ঘুরতে যাওয়া, কোন শখটা পূরণ হয়েছে? কিন্তু সত্যি কথা কী জানেন, টাইম ট্রাভেল করে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে নিয়ে গেলে আমার মা জেনে শুনে আবার এই ভুলটাই করতেন৷’

‘তাতে কী যায় আসে?’

‘আপনার মা-বাবার কাছে আপনার এই মুহূর্তটুকুনির ভালো-খারাপ বিচার করার ক্ষমতা আছে৷ পরের তিরিশটা বছর কেমন হতে পারে তার কোনও আইডিয়া নেই৷ সেটা কেবল আপনার কাছে আছে৷ তাই তাদের থেকে ভালো সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারবেন৷’

কী যেন ভাবে পাঞ্চালী৷ চোখ দুটো ছলছল করতে শুরু করেছে তার, একটা ঢোঁক গিলে গলায় জোর এনে সে বলে, ‘আপনি লোককে কাঠি করা ছাড়া এসবও বলতে পারেন?’

‘ক্লাস করতে হয় রীতিমতো আমাদের৷’ পাঞ্চালীর কাছে এগিয়ে আসে প্রবুদ্ধ, ‘দেখুন আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার অবর্তমানে আপনার বাবা-মাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার৷ ক-দিন একটু গোঁসা করে থাকবেন তারপর কাছে টেনে নেবেন…’

একটুক্ষণ থম মেরে থাকে পাঞ্চালী৷ তারপর মুখ তুলে বলে, ‘আচ্ছা সে ভেবে দেখব না হয়৷ কিন্তু আপনি ইয়ারকি মারছেন না তো?’

‘পি বাচস্পতি আজ অবধি ইয়ার্কি মারেনি, মারবেও না৷ সেই যে নিয়েতসে বলেছিলেন না—’

‘ধুর আপনি থামুন তো…’

একটু হাসে প্রবুদ্ধ৷ তারপর পাঞ্চালীর চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলের একটা ফোঁটা তুলে নিয়ে লাভ সাইনের উপরে বোলাতে থাকে৷ সেটা পাঞ্চালীর হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘আজকের পর থেকে দরকার হলে যোগাযোগ করবেন৷ যদি সবুজ সংকেত দেন তাহলে শর্ত একটাই৷ মাঝপথে পিছিয়ে যাওয়া চলবে না৷ আজ আসি, কেমন?’

পাঞ্চালী ভিজিটিং কার্ডটা মুখের সামনে ধরে দেখে তাতে সোনালি রঙে লেখা ফুটে উঠছে—পি বাচস্পতি৷ ফিল্ড অপারেশন স্পেশালিস্ট৷ প্রেমাস্পদ সোসাইটি—প্রেমে পড়ুন, কেটে পড়ুন৷’

এরপর পাঁচটা দিন কেটে যায়৷ পাঞ্চালী এর মধ্যে বিস্তর ভেবেছে৷ ভেবেছে আর কেঁদেছে৷ রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছে, দুপুরে ছাদে উঠে কেঁদেছে, এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা একটা সম্পর্ক বাচস্পতির কথাও ফেলে দেবার মতো নয়৷

এর মধ্যে ওর বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা চাপা প্রবাহ বইতে শুরু করেছে৷ এই পাঁচটা দিন সারারাত বাচস্পতির সঙ্গে কথা বলে গেছে ও৷ বাচস্পতি রোসালিনের কাছে দাগা খেয়ে কীভাবে রোমিও আশিক আওয়ারা হয়ে পড়েছিল সেসব ব্যাখ্যা করেছে, আমেরিকার সিভিল ওয়ার বুঝিয়েছে, ব্রেখতের নাটক বিশ্লেষণ করেছে, এইসব হাবিজাবি শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুম জুড়িয়ে এসেছে পাঞ্চালীর চোখে৷

ব্যাপারটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল এই ক-দিনে৷ রাতে উলিসিস থেকে দুর্বোধ্য কিছু লাইন না শুনলে তার ঘুমই হয় না, প্রাচীন হিব্রুর সঙ্গে প্রাচীন ইংলিশ ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে ঘুটুমুটু করে মিলে গেছে সেসব বর্ণনাই যেন একসময় ওর চোখের পাতা ভারী করে দেয়৷ বাচস্পতিকে ভারী ভালো লাগতে শুরু করেছে পাঞ্চালীর৷ কিন্তু এবার কী হবে? সব কিছু আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে যে৷

পাঞ্চালী বুঝতে পারে যত দেরি করবে তত দেরি হয়ে যাবে৷ এই মুহূর্তেই কিছু একটা করতে হবে৷ যেতে আসতে রোজ বাবা-মা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকায়৷

থমথমে মুখ করে বাবা বলেন, ‘আজকালকার বাজারে কি সরকারি চাকরি এমন হুট বলতে মেলে?’

‘তুমি জানো না বাবা ও কী বলেছে তোমাকে…’

‘কী বলেছে?’

‘বলেছে তোমার ইয়ে আছে… ব্ল্যাক মানি…’

বাবা ক্ষমাসুন্দর মুখ করে বলেছেন, ‘বাঙালি বাড়িতে ওরকম একটু আধটু কালো ধন থাকে৷ ওতে কিছু মনে করতে নেই৷ তুই আর না করিস না মা৷’

অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে পাঞ্চালী৷ ছেলেটাকে তার খানিকটা ভালো লেগেছে ঠিকই কিন্তু বাচস্পতিকে কোনও মতেই পতি বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ অন্য কাউকে তো আরওই না৷

একদিন রাতে বাচস্পতিকে ফোন করে হুট করেই জানিয়ে দেয়৷

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি৷ তুমি যা বলেছিলে তাই হবে৷’

‘ভেগে যাবে? সত্যি?’

‘কালই যাব৷ আমি ওকে নিয়ে কাল সন্ধেয় দেখা করছি তোমার সঙ্গে৷ তোমার সব রেডি তো?’

প্রবুদ্ধ বাচস্পতি কিছুটা অবাকই হয়ে যায়৷ মেয়েটা কেমন যেন হুট করেই রাজি হয়ে গেল৷

তবে ভালোই হল, আর একটা ক্লায়েন্ট ফুলফিল হবে৷ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম হয় তার৷

ঢাকুরিয়া ব্রিজ পেরিয়ে যে ছোটো ছোটো রেস্টোরেন্টগুলো পড়ে, তারই একটার দোতলায় একটা কাচে ঢাকা ব্যালকনিতে তিনটে চেয়ার পাতা আছে৷ মাঝে একটা টেবিল৷ এতক্ষণ বাচস্পতি একাই একটা বই হাতে বসেছিল সেখানে৷ এন্ট্রান্সের দিকে চেয়ে দু-জনকে হেঁটে আসতে দেখে মিষ্টি হেসে সে উঠে দাঁড়ায়৷

একটা অপরিচিত ছেলে আর পাঞ্চালী এগিয়ে আসে ওর দিকে৷ ছেলেটার হাতে একটা বড়ো ব্রিফকেস৷ আজ পাঞ্চালীর মুখে কোনও প্রসাধন নেই৷ চোখের কোণে কাজল শুকিয়ে যাওয়া দাগ৷ ঠোঁটদুটো শুকিয়ে গেছে৷ চামড়ার উপর মাঝে মাঝে একটা লালচে ভাব ফুটে উঠছে৷ সেদিকে একবার নজর পড়তেই বাচস্পতির মনে পড়ে যায় থমাস হার্ডির কোন একটা নভেলের কথা৷

পাঞ্চালী চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘তোমার সোসাইটিতে তুমি একাই নাকি? বাকিরা কই?’

ডান পায়ের উপর বাঁ পা তুলে বসে বাচস্পতি, ‘সিক্রেট সোসাইটি তো, যতজনকে না চিনলেই নয় তার বাইরে কেউ সামনে আসে না৷’

টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বাচস্পতি, ‘ভালো করে শোনো আমার কথা… তোমরা এখান থেকে বেরোলে লাল টিশার্ট পরা আর হাতে খয়েরি বাজারের থলে ঝোলানো একটা লোককে দেখতে পাবে৷ এরপর থেকে তোমাদের বাকি কোর্স অফ অ্যাকশনের দায়িত্ব ওর৷ আমাকে রাস্তায় দেখলেও চিনতে পারবে না৷ মনে থাকে যেন…’

‘সেকি তুমি আসবে না আমাদের সঙ্গে?’ পাঞ্চালী হতাশ গলায় বলে৷

‘আমার কাজ ক্লায়েন্ট ধরা৷ ক্লায়েন্টকে রাজি করিয়ে পরবর্তী ধাপে পাঠিয়ে দেওয়া৷ ব্যস শেষ…’

বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাঞ্চালী৷ পাশের ছেলেটিকে আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘বিতান… আমার…’

‘বয়ফ্রেন্ড৷’ একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দেয় প্রবুদ্ধ৷ ছেলেটার হাতটা নরম৷ ছবি ছাবড়া আঁকার চেয়ে ভারী কিছু করায় সে দৃঢ় নয় বেশ বোঝা যায়৷

‘আপনাকে সত্যি ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই আমাদের.. মানে আমি ঠিক কী যে বলব…’

প্রশংসায় গলে পড়ে বাচস্পতি, ‘কী যে বলো ভাই, এতো আমাদের সামাজিক দায়িত্ব… আসলে কি জানো, ছোটো থেকেই আমার মধ্যে এই পরোপকারের ব্যাপারটা…’

পাঞ্চালীর চোখের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য ছোটো করে নেয় বাচস্পতি, ‘আছে আর কী…’

বিতান ছেলেটি বেশ গোলগাল৷ গলার স্বরটিও মিনমিনে৷ থেকে থেকে ভয় ভয় চোখে পাঞ্চালীর দিকে তাকাচ্ছে সে৷ মুখ দেখে মনে হয় কী হতে চলেছে সেই ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে আছে বেচারা৷

‘আচ্ছা বেশ, আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি তাহলে৷ তোমার কথা মনে থাকবে আমার৷’

‘আমারও…’

বিতান এতক্ষণ চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে কী যেন দেখছিল৷ হঠাৎ দরজার কাছে কী দেখতে পেয়ে উৎসাহিত গলায় বলে, ‘ওই যে লাল শার্ট, উনি?’

সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বাচস্পতি মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ উনিই তোমাদের ভাড়ার ঘর দেখিয়ে দেবেন৷ উকিলের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেবেন৷ চিন্তার কিছু নেই৷’

বিতানের দিকে চেয়ে পাঞ্চালী বলে, ‘তুমি যাও৷ আমি একটু কথা বলে নিয়ে যাচ্ছি৷’

মাথা নেড়ে সেদিকে এগিয়ে যায় বিতান৷ সে চলে যেতেই টেবিল পেরিয়ে বাচস্পতির কাছে পৌঁছে যায় পাঞ্চালী, ‘তুমি মানুষ না অন্য কিছু বল তো?

বুকের ভিতরে মন বলে কিছু নেই?’

টেবিলের উপরে তবলা বাজায় বাচস্পতি, ‘মন জিনিসটার সঙ্গে বুকের কোনও সম্পর্ক নেই৷ স্পাইনাল কর্ড আর ব্রেইনের খেল৷ বলতে পারেন পিঠের ভিতরে মন বলে কিছু আছে কি না, আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে…’

রাগত গলায় বলে পাঞ্চালী, ‘যদি থেকেই থাকে তাহলে কিছু যায়-আসে না কেন তোমার?’

‘কীসের যায়-আসবে?’

‘এই যে রোজ আমার সঙ্গে কথা বললে, আমার সুখে-দুঃখে পাশে থাকলে, আটভাট বকে আমাকে লিটারেলি ঘুম পাড়িয়ে দিলে৷ একটুও কি প্রেম টেম জাগে না মনে?’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না ম্যাডাম…’ একটা হাত তুলে বলে প্রবুদ্ধ, ‘সেই যে সুকান্ত ভটচাজের কবিতা মনে নেই আপনার, পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া…’

‘অনেক হয়েছে এসব…’ হুমড়ি খেয়ে প্রায় বাচস্পতির গলা চেপে ধরতে যায় পাঞ্চালী, ‘সত্যি করে বলো তো আমাকে এতটুকু ভালোবেসে ফেলোনি এতদিন? একটা সফট কর্নার জন্মায়নি?’

বাচস্পতির মুখ নেমে আসে৷ চোখের পাতা কেঁপে যায় কয়েকবার৷ উষ্ণ গলায় উত্তর দেয়, ‘বেসেছি… কিন্তু সেটা অন্যায়৷ সোসাইটির চেয়ে বড়ো কিছু হতে পারে না৷’

কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে পাঞ্চালী৷ তারপর ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসে পড়ে৷

বাচস্পতি তখন বলে চলেছে, ‘সত্যি খুব ভালো বেসে ফেলেছি৷ আপনি ইংরেজি জানেন না, বানান ভুল লেখেন তাতেও আমার কিছু এসে-যায় না৷ আমার বকবক মন দিয়ে শোনেন আপনি, যেমন করে কেউ শোনেনি ছোটো থেকে, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো থাকি… আমি…’ হঠাৎ করেই বিতানের দিকে চোখ পড়ে যায় তার, ‘ইয়ে… উনি দাঁড়িয়ে আছেন…’

মাথায় হাত রেখে বসেছিল পাঞ্চালী৷ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ সেভাবেই প্রশ্ন করে পাঞ্চালী, ‘তুমি যে এভাবে ফিল্ড অপারেশনে গিয়ে ক্লায়েন্টের প্রেমে পড়ে গেছ সেটা জানলে কী হবে বুঝতে পারছ?’

উপরে নীচে মাথা নাড়ে বাচস্পতি, ‘জানি, সোসাইটি থেকে বের করে দেবে আমাকে৷’

‘ভয় করছে না? আমি যদি ওই লাল শার্টকে বলে দিই?’

‘দিলে দেবে…’ মুখ দিয়ে ফুঁ জাতীয় একটা আওয়াজ করে বাচস্পতি, ‘আমার আর এমনিতেও ওখানে থাকার যোগ্যতা নেই৷’

দু-জনেই থম হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ৷ বিতান ওদিকে একটু অস্থির হয়ে উঠেছে৷ লাল শার্ট পরা লোকটা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে৷

পাঞ্চালী নীচু গলায় বলে, ‘সে তো আমারও নেই…’

বাচস্পতি মুখ তোলে, ‘কী নেই?’

‘যোগ্যতা… সোসাইটিতে থাকার…’

‘মানে তুমি…’

স্থির হাতে একটা কার্ড পকেট থেকে বের করে এগিয়ে দেয় পাঞ্চালী৷ আবার সেই লাভ সাইন৷ বাচস্পতি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে৷ তারপর নিজের ছলছল চোখ থেকেই জল নিয়ে লেখা ফুটিয়ে তোলে, ‘পাঞ্চালী শর্মা… প্রেমাস্পদ সোসাইটি, হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট৷ প্রেমে পড়ুন, কেটে পড়ুন৷’ কয়েকটা ঢোঁক গিলে বাচস্পতি বলে, ‘তার মানে আপনার কাজ ছিল…’

‘আপনি ঠিকঠাক কাজ করছেন কি না, সুন্দরী ক্লায়েন্টের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ছেন কি না সেটা তদন্ত করা… এইচ আর ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি কি না…’ বাচস্পতির মুখে কথা সরে না৷ বিতানের দিকে তাকায় সে৷ পাঞ্চালী মাথা নামিয়ে রেখেই বলে, ‘বিতান ফেক৷ সোসাইটিরই লোক৷’

বাচস্পতি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলে, ‘তার মানে আমি একবারে…’

‘গাড্ডা খেয়েছেন.. সোসাইটিতে আপনার আর কোনও জায়গা থাকতে পারে না৷ কিক আউট না হতে চাইলে নিজে থেকেই রেজিগনেশনটা জমা করে দেবেন৷’ গলার গনগনে রাগী ভাবটা প্রবুদ্ধ বাচস্পতির বুক ছুঁয়ে যায়৷ মাথা ঝুঁকে আসে তার৷

‘বেশ…’ কথাটা বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যাচ্ছিল বাচস্পতি৷ হঠাৎ একটা হাত এসে চেপে ধরল ওর হাতখানা৷ পাঞ্চালী মাথা নামিয়ে রেখেই ওর হাত ধরেছে৷

‘শুনুন…’ গভীর গলায় উচ্চারণ করে মেয়েটা৷

‘কী?’

ডানহাতে ব্যাগ থেকে একটা সই করা কাগজ বের করে এগিয়ে দেয় সে, ‘সঙ্গে আমারটাও জমা করে দেবেন৷ আমিও ডাহা ফেল করেছি৷’

বাচস্পতির কবজির উপর পাঞ্চালীর হাতের চাপ বেড়ে ওঠে৷ কী একটা যেন মনে আসছিল বাচস্পতির, কাফকা না হাইঞ্জ কে যেন… যাই হোক, সে সব গুলিয়ে গিয়ে ওর মুখ থেকে ভারী সেকেলে, ইংরেজিতে ব্যাক খাওয়া ছাত্রদের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে যায়—‘যাঃ শালা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *