প্রেত আতঙ্ক

প্রেত আতঙ্ক

তখন শীতকাল। কোনও এক ছুটির দুপুরে আমি নবনির্মিত দোতলার ঘরে শুয়ে পত্রপত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছি, এমন সময় আমার এক বন্ধু তারক এসে বলল, “এই দ্যাখ! এটা দেখেছিস? আজকের কাগজে বেরিয়েছে।”

আমি চেয়ে দেখলাম, খবরের কাগজে ‘সম্পত্তি বাড়ি জমি’ বিভাগে ছোট্ট একটি বাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের হেডিং হচ্ছে ‘ভুতুড়ে বাড়ি’। নীচে লেখা আছে : ‘ঘাটশিলায় কাশীদা অঞ্চলে আমাদের সাবেক কালের বাড়িটা ভূতের উপদ্রবের জন্য বেচে দিতে চাই। সম্পূর্ণ খালি বাড়ি। সামান্য আসবাবপত্র যা আছে তা সমেত বাড়িটার দাম পাঁচ হাজার টাকা। সব জেনেশুনে যদি কেউ কিনতে চান, নীচের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।’

আজ থেকে বছর তিরিশ আগে যে সময়কার কথা বলছি তখন পাঁচ হাজার টাকার দাম ছিল অনেক। কাজেই পাঁচ হাজারে যখন বাড়িটা বিক্রি হচ্ছে তখন নিশ্চয়ই বেশ বড় বাড়ি আমি কাগজটা রেখে উঠে বসে বললাম, “বেশ অভিনব বিজ্ঞাপন তো! আর বাড়ির মালিকও খুব সৎ লোক মনে হচ্ছে। কেননা তিনি যখন সবকিছু জানিয়েই বাড়িটা বিক্রি করছেন তখন নিশ্চয়ই কোনও জোচ্চুরি বুদ্ধি তাঁর নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, দেখে আমাদের লাভ কী? এত টাকা তো আমাদের নেই যে, এই বাড়ি আমরা কিনব। অতএব কিনবে কে?”

তারক বলল, “বাড়ি কেনার লোকের কি অভাব আছে রে! মোহনের জ্যাঠামশাই একবার ঘাটশিলায় বাড়ি কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এখন বিজ্ঞাপনটা তাঁকে দেখালে নিশ্চয়ই তিনি রাজি হয়ে যাবেন। আর ভৌতিক ব্যাপারস্যাপার যেগুলো, সেগুলো তাঁকে যুক্তিতর্ক দিয়ে নস্যাৎ করিয়ে দিলেই হবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই সুযোগে ঘাটশিলাটা একবার ঘুরে আসা।”

প্রস্তাবটা চানাচুরের মতোই মুখরোচক। বললাম, “আরে ব্বাঃ। বেশ বলছিস তো! চল তবে। এখুনি যাই।” আমরা দু’জনে তখন খবরের কাগজের ওই অংশটার ওপর লাল পেনসিলে দাগ দিয়ে শিবপুরে মোহনদের বাড়ির দিকে চললাম। ওদের বাড়িতে গিয়ে মোহনকেও পেয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিতভাবে। আসলে ছুটির দিন তো! এই সময়টা খেয়ে দেয়ে সবাই একটু বিশ্রাম করে। মোহনকে কাগজটা দেখাতে ও একটু অবাক হয়ে গেল। তারপর বলল, “বেশ মজার ব্যাপার! ভূতের বাড়ি এই কথা আগে থেকে জানিয়ে কেউ আবার বিজ্ঞাপন দেয় নাকি? লোকটার মাথাখারাপ নেই তো! না কি বিজ্ঞাপনটাই ফল্স?” তারক বলল, “দেখ মোহন, এটা যখন বিজ্ঞাপন তখন ফল্স এটা কিছুতেই নয়। কেননা কার এত টাকা আছে যে, খরচা করে এইসব ফাজলামি করতে যাবে?”

মোহন বলল, “তা ঠিক। তবে জ্যাঠামশাই যা ভিতু লোক, তাতে এ বাড়ি উনি কিনতেই চাইবেন না।”

তারক বলল, “আরে বাবা বুঝছিস না কেন, ভূতটুত ওসব বাজে। আসলে ভদ্রলোকের সম্পত্তি অনেক। বিক্রি করতে চাইছেন কিন্তু খদ্দের পাচ্ছেন না। কাজেই এই চমক লাগানো বিজ্ঞাপনে কিছু লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। অনেক লোক তো আছে ভূতের নামে হাড়ে চটা, তাদেরই ভেতর থেকে কেউ হয়তো জেদ করে বাড়িটা কিনেই ফেলল।”

“এটা অবশ্য মন্দ বলিসনি। ঠিক আছে, এসেছিস যখন বোস তোরা। জ্যাঠামশাই সবে শুয়েছেন। উঠলেই খবরটা দিচ্ছি। তারপর বাড়ি কেনা হোক না হোক দেখতে যাওয়ার ছলে দু-চারদিন ঘাটশিলা থেকে ঘুরে আসা যাবে’খন।”

তারক বলল, “আমিও তাই বলি। তোর জ্যাঠামশাইকে যেভাবেই হোক তুই রাজি করা। আমাদের তিনজনের তা হলে রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই হবে। আর যদি সম্ভব হয় তো এক রাত ভূতের বাড়িতে কাটিয়েও আসতে পারব আমরা। ভূত সম্বন্ধে একটা অভিজ্ঞতাও হবে আমাদের।”

সেই দুপুরটা আমরা তিনজনে এক নতুন আনন্দে চুটিয়ে গল্প করে কাটালাম। তারপর বিকেলবেলা খবরের কাগজটা মোহনের জ্যাঠামশাইকে দেখাতেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি, “না না। ও বাড়ি আমি কিনব না। আমি টাকা দিয়ে জিনিস কিনব, ওইসব ঝামেলার মধ্যে কেন যাব আমি? তা ছাড়া তোমরা আজকালকার ছেলেরা ভূতপ্রেত মানো না বটে, কিন্তু আমি মানি। কেননা আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সময় ভূতের অস্তিত্ব অনুভব করেছি। তাই বলি, কী দরকার বাবা, ওইসবের মধ্যে যাওয়ার? তবে ঘাটশিলায় একটা বাড়ি কেনবার ইচ্ছে আমার আছে। আমি বরং তোমাদের কিছু টাকা দিচ্ছি, তোমরা তিনজনে দিনকতক ঘাটশিলা থেকে ঘুরে এসো। আর যদি কোথাও ভাল কোনও বাড়ির খোঁজখবর পাও তো দেখে এসো। পরে দরদাম করে কেনা যাবে।”

আমরা তাতেই রাজি হয়ে মনের আনন্দে ঘাটশিলা যাওয়ার তোড়জোড় করতে লাগলাম।

পরদিন বেলা এগারোটায় নাগপুর প্যাসেঞ্জারে (বর্তমানে কুরলা এক্সপ্রেস) চেপে আমরা ঘাটশিলার দিকে রওনা হলাম। সন্ধের পর যখন স্টেশনে নামলাম তখন চারদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ঘাটশিলা তখন এখনকার মতো শহর নয়। একেবারে বুনো জায়গা ছিল। স্টেশনের কাছেই একটি চায়ের দোকানে খোঁজখবর নিয়ে চার-পাঁচদিনের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করে ফেললাম আমরা।

রাতটা ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা তিনজনে যুক্তি করে সেই ভূতের বাড়িটাই দেখতে চললাম। ঠিক হল বাড়ি যদি পছন্দ হয় তা হলে ওই বাড়িই জ্যাঠামশাইকে রাজি করিয়ে কেনাব আমরা। আর যদি না হয় তা হলে এক রাত ওই বাড়িতে থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে আসব।

খবরের কাগজে দেওয়া ঠিকানার খোঁজ করে আমরা রাজবাড়ির কাছে বিজ্ঞাপনদাতার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। ভদ্রলোকের নাম সিন্ধুবাবু। কৃপাসিন্ধু রায়। বেশ অভিজাত পরিবারের লোক বলে মনে হল। আমরা যখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম তখন সকাল ন’টা। বাড়ির চাকর এসে আমাদের বৈঠকখানার ঘরে বসতে বলল। আমরা বসলাম। একটু পরেই সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে মধ্যবয়সী সিন্ধুবাবু এসে বসলেন আমাদের সামনে। তারপর স্মিত হেসে বললেন, “কোথা থেকে আসছেন আপনারা? আপনাদের পরিচয়?”

তিনজনের হয়ে আমিই বললাম, “আমরা হাওড়া থেকে আসছি। আমার এই বন্ধুটি খবরের কাগজে আপনার দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখে ওই বাড়িটা কিনতে চান। অবশ্য বাড়িটা যদি পছন্দ হয়।”

“কিন্তু ওটা তো ভূতের বাড়ি। ও বাড়ি কিনে কী করবেন আপনারা?”

“ভূতের বাড়ি সেটা তো আমরা জেনেই আসছি। আর কিনতে চাই এই কারণে যে, ও বাড়িতে আমরা বরাবরের জন্য থাকতে আসছি না। ভূতের বাড়ি ভূতেরই থাকবে। আমরা শুধু মাঝেমধ্যে দিনকতকের জন্য এসে একটু উপদ্রব করে যাব।”

সিন্ধুবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, একটু বসুন আপনারা। আপনাদের চা জলখাবার আসছে। তারপর আমার একজন লোক গিয়ে আপনাদের দেখিয়ে আনবে বাড়িটা।”

খানিক বসবার পরই চাকর এসে এক প্লেট করে গরম হালুয়া এবং ধূমায়িত চা এক কাপ করে রেখে গেল আমাদের সামনে। আমরা তিনজনেই খেয়ে নিলাম সেগুলো। তারপর সিন্ধুবাবুর লোকের সঙ্গে চললাম বাড়ি দেখতে। কাশীদা এখান থেকে অনেক দূরে। তবুও আমরা পায়ে হেঁটেই দেখতে গেলাম বাড়িটা।

সিন্ধুবাবুর যে লোক আমাদের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর নাম রাখালদা। রাখালদা যেতে যেতে বললেন, “আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন তো? তা বলছিলাম কি—।”

মোহন বাধা দিয়ে বলল, “না রাখালদা। আমরা মোটেই কলকাতার লোক নই। আমরা হাওড়ার লোক। শিবপুরের বাসিন্দা। হাওড়া থেকেই আসছি।”

“সে যেখানকারই লোক হোন না কেন, হাওড়া আর কলকাতা একই ব্যাপার। তা বলছিলাম কি, এ বাড়ি আপনারা কিনবেন না। দারুণ উপদ্রব এ বাড়িতে। আজ পর্যন্ত কেউ এক রাতও টিকতে পারেনি এখানে।”

‘সে কী!”

“এসব বাড়ি দিনমানে ব্যবহারের জন্য অর্থাৎ অফিস কাছারি ইত্যাদির জন্যই ভাল। কিন্তু থাকার পক্ষে এ বাড়ি উপযুক্ত নয়।”

“কেন বলুন তো?”

“শুনুন তবে। সিন্ধুবাবুরা এই অঞ্চলের অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী লোক। ঘাটশিলা এবং এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি বাড়ি আছে এদের। কাশীদার এই বাড়িটি সিন্ধুবাবুদের সাবেককালের বাড়ি। ওঁর কাকা আর কাকিমার মধ্যে প্রায়ই খুব ঝগড়াঝাটি হত। এই বিবাদসূত্রেই সিন্ধুবাবুর কাকা এক রাতে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেন। সেই থেকেই উপদ্রব। তা উপদ্রব এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছল যে, কাকিমা ঠিক করলেন গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে আসবেন। কিন্তু সেখানেও নানা ঝামেলা। যাত্রাপথে ট্রেনের কামরাতেই কাকিমা স্বপ্ন দেখলেন, কাকাবাবু তাঁকে ভয় দেখিয়ে গয়ায় যেতে মানা করছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নকে তিনি আমল না দিয়েই গয়ায় নেমে পাণ্ডা ঠিক করে সর্বাগ্রে চললেন প্রেতশিলায় পিণ্ডি দিতে। আর সেই সময়েই টাঙ্গা গেল লরির ধাক্কায় উলটে। কাকিমা পায়ের হাড় ভেঙে হাসপাতালে গেলেন। পিণ্ডি দেওয়া তো হলই না, উলটে ছ’মাসের ওপর হাসপাতালে থেকে ভাঙা পা নিয়ে ফিরে এলেন ঘাটশিলায়। তারপর একদিন ছাদ থেকে পড়ে তিনিও মারা যান। সেই থেকে ওই বাড়িতে যে কেউ থাকতে গেছে সে-ই নানারকম ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে।”

“বলেন কী!”

“হ্যাঁ। রাতদুপুরে এমন সব কাণ্ডকারখানা হয় ও বাড়িতে যে, কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে তা চোখ মেলে দেখার ব্যাপার নয়। একবার টাটানগর থেকে একদল ছেলে জোর করে ওই বাড়িতে থাকবে বলে এসেছিল, কিন্তু পরদিন সকালে তাদের কাউকেই আর দেখা যায়নি এখানে।”

“সে কী! ভূতেরা খেয়ে ফেলল নাকি তাদের?”

“না। রাত শেষ হওয়ার আগেই তারা পালিয়ে বাঁচে। এবং পরে টাটানগর থেকে চিঠি দিয়ে পালিয়ে আসার কারণও জানায়।”

“কী কারণ?”

“তা বলতে পারব না। তাই বলছিলাম, কী দরকার ও বাড়ি নিতে যাওয়ার? এর চেয়ে বাড়ি যদি সত্যিই কেনেন তো আমি একটা বাড়ির সন্ধান দিই আপনাদের।”

মোহন বলল, “বেশ তো, আগে দেখিই না এ বাড়িটা। তারপর যদি পছন্দ না হয় তখন আপনার বাড়িটাও দেখে আসা যাবে।”

এইভাবে কথা বলতে-বলতেই আমরা সেই বাড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম। দূরে পাহাড়ের সারি। ছোট ছোট টিলা। ঘন শালবন। কী চমৎকার। তারই মধ্যে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি পাঁচিলঘেরা মস্ত দোতলা বাড়ি। বহুদিনের পুরনো। তবু আজও ব্যবহারযোগ্য।

তালা খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। বহুদিন ঘরে ঝাঁট পড়েনি। বাগানটা আগাছায় ভরা। এই বাড়ির পাঁচ হাজার টাকা দাম মানে জলের দাম। কেননা অনেক জায়গা। বড় বড় ঘর। ছোটখাটো প্রাসাদ একটা। বাড়িটার রিপেয়ারিং কস্টই পাঁচ হাজারের অনেক বেশি। এর আশপাশে অবশ্য কোনও বাড়ি নেই। যা আছে সবই দূরে দূরে। আমরা বাড়িতে এসে নীচে-ওপর করে সব ঘরগুলো ঘুরেফিরে দেখলাম। বসবাসের জন্যই হোক আর অবসর বিনোদনের জন্যই হোক, এর চেয়ে লোভনীয় বাড়ি সত্যিই হতে পারে না।

আমরা সবাই একমত হয়ে বললাম, “রাখালদা, আপনি যাই বলুন না কেন, এ বাড়ি আমরা কিনবই।”

মোহন বলল, “শুধু তাই নয়, আজ থেকে যে ক’দিন আমরা ঘাটশিলায় আছি সে ক’দিন এই বাড়িতেই থাকব আমরা।”

রাখালদা একটু মনমরা হয়ে বললেন, “যা আপনারা ভাল বোঝেন তাই করবেন। পরে যেন দোষ দেবেন না আমাদের। আর একটা কথা, এখানে আলোর কোনও কানেকশন নেই। দোকান থেকে একটা হারিকেন অথবা লণ্ঠন আনিয়ে রাখবেন।” এই বলে আমাদের হাতে চাবি দিয়ে চলে গেলেন রাখালদা।

এর পর এক সময় আমরাও আমাদের সেই ভাড়াকরা বাড়িতে গিয়ে মালপত্তর যা ছিল নিয়ে চলে এলাম এখানে। তারপর সারাদিন ধরে এ-ঘর সে-ঘর নীচে-ওপর এই করতে লাগলাম। সম্পূর্ণ বাড়িটা আমাদের দখলে পেয়ে মনের ভাব এমনই হল, যেন বাড়িটা আমাদের হয়েই গেছে।

ইতিমধ্যে আমাদের এই বাড়িতে আসতে দেখে কিছু কৌতূহলী মানুষও উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল এদিক-সেদিক থেকে। আমরাও সবার জন্যই বাড়িটার অবারিত দ্বার রাখলাম। সবাই যখন শুনল আমরা এই বাড়ি কিনতে চাই তখন যারপরনাই অবাক হয়ে গেল সকলে। সবাই একবাক্যে বারণ করতে লাগল এই বাড়িতে না থাকা বা এই বাড়ি না কেনার জন্য। সবাই বলল, “বাড়িটা সত্যিই উপদ্রবের বাড়ি। নাহলে কখনও এত কম দামে এতবড় একটা বাড়ি এখানে এতদিন খালি পড়ে থাকে?”

আমরা সব শুনলাম। শুনে বললাম, “তবুও আমরা নিজেরা একবার পরখ করে দেখতে চাই। যদি সেরকম খারাপ কিছু না ঘটে তা হলে এই বাড়িই আমরা কিনছি।”

অবশেষে আমাদের জেদ দেখে দু-একজন একটু অন্য সুরে কথা বলল, “তা একান্তই যখন কিনবেন আপনারা তখন দু-এক রাত এখানে থেকেই দেখুন, বাড়িটার বদনাম আছে ঠিকই। তবে সচরাচর কেউ তো থাকে না। এইভাবে মানুষজন সাহস করে এলে, থাকতে থাকতে কী হয় কে বলতে পারে? দেখাই যাক না, এতদিনে ভূতের উপদ্রব একটু কমেছে কিনা?”

কেউ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। সাহস করে থেকেই যান। তা ছাড়া আমরা যখন জেনে গেছি তখন আমরাও একটু সজাগ থাকব। যদি বেশি ভয়টয় পান তো ছাদে উঠে জোরে চেঁচাবেন। দলবেঁধে ছুটে আসব সবাই।”

আমরা জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে আলো জ্বেলে তিন বন্ধুতে এই নির্জন বাড়িতে সত্যিকারের ভূত এলে কীভাবে মোকাবিলা করব সেই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করে যখন দেখলাম সব ভোঁ ভাঁ তখন তক্তাপোশে পাতা বিছানায় মশারি খাটিয়ে আমরা তিনজনে জড়াজড়ি করে লেপচাপা দিয়ে শুলাম। শোওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুম।

রাত তখন কত তা কে জানে! হঠাৎ ঝনঝন করে দরজার শিকল নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। শিকল নাড়তে নাড়তে কে যেন একজন ভারিক্কি গলায় বলল, “এই যে, কে আছেন ভেতরে? দরজা খুলুন।”

আমরা তিনজনেই উঠে বসলাম।

মোহন বলল, “কে!”

“কে, তা দেখতেই পাবেন। দরজা খুলুন।”

আমরা উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোথায় কে? সব ফাঁকা। দালানের দরজাটাও খিল দেওয়া। যেমনকার তেমনই আছে। কে তা হলে কীভাবে এসে ঘুম ভাঙাল আমাদের?

ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে। আমরা আবার দরজা বন্ধ করে শুতে এলাম। কিন্তু এসে দেখি অসম্ভব ব্যাপার। এরই মধ্যে আমাদের তক্তাপোশটা ঘরের উলটোদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবং আমাদের বিছানাও দখল করেছে কারা। দেখলাম আমাদের লেপটা মুড়ি দিয়ে কারা যেন দু’জনে শুয়ে আছে। লেপটা এমনভাবে ঢাকা যে, মুখ দেখতে পাচ্ছি না তাদের। শুধু মাথা দুটো দেখা যাচ্ছে। আমরা যত জোরে লেপটা তাদের গা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, তারা তত বেশি আঁকড়ে ধরতে লাগল লেপটাকে।

অবশেষে অনেকক্ষণ টানাহেঁচড়ার পর লেপ আবার আলগা হয়ে গেল। বিছানা থেকে লেপটা উঠিয়ে নিয়ে দেখলাম কেউই নেই ভেতরে। আমরা তিনজনে আবার তক্তাে টাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে এনে ফের লেপের তলায় ঢুকলাম।

তারক বলল, “না ভাই, কাজটা ভাল করিনি। এতগুলো লোকের কথা ঠেলে এই বাড়িতে রাত কাটাতে এসে খুবই অন্যায় কাজ করেছি। এখন ভালয় ভালয় ফিরে যেতে পারলে বাঁচি। উঃ! কী সাংঘাতিক!”

আমি তো ভয়ে কোনও কথাই বলতে পারলাম না।

মোহন বলল, “সকালটা একবার হলে হয়! এর আগে সত্যি কথা বলতে কি, ভূতপ্রেত আমি বিশ্বাসই করতাম না। অথচ আজ যা দেখলাম একে মনের ভ্রম বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো মানসিকতাও আমার নেই। এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা উচিত নয়।”

আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে আরও কিছু ঘটে কিনা দেখবার আশায় জেগে রইলাম। ঘুম তো এলই না, ঘুমোতে সাহসও হল না। ঘুমিয়ে পড়লে আবার যদি শিকল ঝনঝন করে? বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর আমরা দালানে একটা খটখট শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল কে যেন চটি পরে পায়চারি করছে। দালানের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত একবার যাচ্ছে, একবার আসছে। তারপর আবার সেই ঝনঝন করে শিকল নাড়ার শব্দ। সভয়ে আমরা তিনজনে তিনজনকে জড়িয়ে ধরলাম। কেউ আর উঠলাম না দরজা খুলতে। শিকল ঝনঝন করে বেজেই চলল। তারপরই শোনা গেল আবার আগের মতোই ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, “কারা আছে ঘরের ভেতর? দরজাটা এত করে খুলতে বলছি যে, দরজা খোলো।”

কে খুলবে দরজা?

আমরা তখন আতঙ্কে নীল হয়ে উঠছি ক্রমশ।

কে-ই-বা যাবে দরজার কাছে? উঠে দাঁড়াবারও যে শক্তি নেই কারও!

ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, “দরজা না খুললে কিন্তু ভয়ানক ব্যাপার হবে। খোলো বলছি। না হলে ভেঙে ঢুকব।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় দমাদ্দম লাথি পড়তে লাগল। অগত্যা উঠতেই হল।

তিনজনে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে খিলটা খুলতেই দরজাটা সশব্দে দু’ হাট হয়ে খুলে গেল। মনে হল কেউ যেন ওদিক থেকে জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল দরজাটা। সে কী দারুণ শব্দ। গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠল বুঝি! কিন্তু তা না হয় হল। আবার তো সেই আগের মতোই ভোঁ ভাঁ। কেউ কোথাও নেই।

এই শীতেও গায়ে ঘাম দিল তখন। এর পরে আর বিছানায় ফিরে যাওয়ার মতো মন বা সাহস নেই। সেখানেও তো ওই আগের মতোই খারাপ ব্যাপার ঘটবে। অর্থাৎ কিনা লেপ নিয়ে টানাটানি। কী যে করি! পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি এমন সময় হঠাৎ আমাদের লণ্ঠনটা কে যেন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল ঘরের ভেতর। অন্ধকার, অন্ধকার—ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক।

আমরা সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ঘরে ঢুকে অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে যে যার জামা-প্যান্ট পরে নিলাম। মোহনের টর্চ ছিল। টর্চ জ্বেলে হাতঘড়িতে দেখে নিলাম রাত তখন আড়াইটে। এখনই পালাতে হবে এখান থেকে। নাহলে যে কোনও মুহূর্তে ভয়ানক একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।

ওদিকে বারান্দার দরজাতেও তখন দমাদ্দম লাথি পড়তে শুরু হয়েছে। লাথির পর লাথি, আর তার সঙ্গে সেই প্রচণ্ড ধমকানি, “খোলো বলছি, খোলো। নাহলে ভাল হবে না। শিগগির খুলে দাও।”

আমরা কোনওরকমে দরজা খুলেই এক লাফে বাইরের বাগানে এসে পড়লাম। তারপর পেছন ফিরে দেখি দালানের দরজার কাছে আগুনে পোড়া ঝলসানো চেহারার এক বিকট মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ তাকে বলব না। মানুষ কখনও অত কুৎসিত হয় না। মানুষ কখনও অত দীর্ঘ হয় না। মানুষের চোখ দিয়ে কখনও অত আগুন বেরোয় না। আমরা বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলাম না সেদিকে। বাগানের দরজার খিল খুলে বাইরে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অদূরে একটি আদিবাসী বস্তি ছিল। বাকি রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে ভোরের ট্রেনেই হাওড়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *