প্রেতিনী

প্রেতিনী

সেবার ভোটের সময় বরদাবার প্রাইমারি স্কুলে ইলেকশন ডিউটি পড়েছিল আমার। উলুবেড়িয়া থেকে ভোটের সরঞ্জামাদি বুঝে নিয়ে লরি চেপে চললাম বরদাবার। তখন গ্রীষ্মকাল। বেশ আনন্দে কয়েকটি বুথের লোকজনসহ হইচই করতে করতে চললাম। বাগনান পার হয়ে বরদাবারের দিকে যত এগোচ্ছি আশপাশের লোকেরা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ততই হাত নেড়ে আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। কী সুন্দর গ্রাম সব, ঝকঝকে তকতকে উঠোন। লেপা-মোছা ঘরদোর। ফুলে ফলে শোভিত বাগান। চোখ যেন জুড়িয়ে গেল।

যাই হোক, সন্ধের সময় আমরা বরদাবার পৌঁছলাম। সেখানকার লোকজন আমাদের সুবিধার জন্য মালপত্তরগুলো বয়ে নিয়ে চলল। একজন প্রিসাইডিং অফিসার, তিনজন পোলিং অফিসার, একজন চৌকিদার ও একটি অস্থিচর্মসার তালপাতার সিপাইকে নিয়ে আমরা মোট ছ’জন।

গ্রামের প্রান্তে বড় একটি পুকুরের ধারে মুখোমুখি দুটি চালাঘর। এ দুটোই স্কুল। তারপরে ধু-ধু করছে শুধু মাঠ আর বন। এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মেও খেতগুলি সবুজ বোরো ধানে ভরে আছে। বাতাসের আন্দোলনে মাঝে মাঝে ঢেউ খেলছে ধানের শিষে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। আমার মন ভরে উঠল।

দূরের পথ বলে ভোটের আগেই আমাদের যেতে হয়েছিল। এতে কেউ কেউ বিরক্ত হলেও আমার কিন্তু আনন্দ হয়েছিল খুব। কেননা আমি শহুরে মানুষ। গ্রাম ভালবাসি। পরশু তো সময় পাব না। কাল সারাদিনে গ্রামটা একটু ঘুরে নিতে পারব।

নির্দিষ্ট স্থানে মালপত্তর রেখে আমরা প্রথমেই আলোচনায় বসলাম আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে। কেননা এইসব কাজে এসে কোনও প্রার্থী বা অপর কারও বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করা যায় না। অথচ এমন এক জায়গায় এসেছি যেখানে না আছে কোনও হোটেল, না আছে দোকান। আমাদের সঙ্গে যে চৌকিদারটি ছিল তার নাম শ্যামল। সে এ অঞ্চলেরই ছেলে। তাকে বললাম, “ভাই শ্যামল, তুমি যেখান থেকে হোক একটি লোককে জোগাড় করে আনো। সে এই দু’দিন সকাল-বিকেল একটু রেঁধেবেড়ে দেবে। না হলে মহা মুশকিলে পড়ে যাব আমরা।

শ্যামল মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বলল, “আচ্ছা দেখছি কতদূর কী করতে পারি।” আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন শ্যামপুরের এ-ই-ও। সুদর্শন যুবক। বললেন, “দেখছি নয়, আনতে হবে।”

শ্যামল চলে গেল। খুব করিৎকর্মা ছেলে। কিছু সময়ের মধ্যেই একজন বয়স্কা স্ত্রীলোককে ধরে আনল সে। বলল, “এই মাসি আপনাদের কাজ করতে রাজি আছেন।”

আমি বললাম, “আপনাদের মানে? তুমি কি আমাদের ছাড়া?”

শ্যামল বলল, “না, তা নয়। পাশের গ্রামেই আমার বাড়ি। আমি সেখানে গিয়েই খেয়ে আসব।”

প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, “না, তা হবে না। তোমাকেও আমাদের সঙ্গে এইখানেই খেতে হবে।”

শ্যামল বলল, “যা আপনারা বলবেন।”

আমি মাসিকে বললাম, “তা মাসি, তুমি রাজি আছ তো?”

মাসি লাজুক মুখে বলল, “ক্যান্ থাকবুনি। কিন্তু আপনারা কীরকম কী দেবে বলো দিকিনি?”

তুমি কী চাও বলো?

আপনাদের সঙ্গে দু’ বেলা পেটভরে খাওয়া আর দশ টাকা নগদ।

বললাম, “পাবে। এবার কোমর বেঁধে লেগে পড়ো তা হলে।” বলে নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে শ্যামলের হাতে টাকা দিয়ে বললাম, “এবার ভাই যেখানে যা পাওয়া যায় তুমি কিনেকেটে নিয়ে এসে আমাদের ব্যবস্থা করে দাও, কেমন?”

শ্যামল টাকা নিয়ে চলে গেল।

আমরা অনেক রাত পর্যন্ত দাওয়ায় বসে গল্প করে আলাপ-আলোচনা করে কাটালাম। তারপর রান্না হলে গরম ভাত, আলু-কুমড়ো ভাজা, ডিমের ঝোল ও আমের অম্বল দিয়ে উদরপূর্তি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে যে যার মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙল শেষ রাতে। ঘুম ভাঙতেই শয্যাত্যাগ করলাম। প্রাতঃকৃত্যটা মাঠেই সারতে হবে। অতএব দেরি না করাই ভাল। আমি উঠে ঘড়ি দেখে টর্চটা হাতে নিয়ে আর কারও ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেজন্য পা টিপে টিপে বাইরে এলাম। আকাশ নক্ষত্রে গিজগিজ করছে। রাত তখন সাড়ে তিনটে। একেবারে শেষরাত। চারদিক ফাঁকা। একা চললাম ধানখেতের কাছে নাবাল জমিতে। জমিতে বসে-বসেই দেখলাম আমাদের স্কুলঘরের চালায় যেন কার একটা গামছা শুকোচ্ছে। দেখে একটু অবাক হলাম। এমন অসময়ে গামছাটা ওখানে কে শুকোতে দিল? যতদূর জানি আমাদের যার যার জিনিস তার তার কাছেই আছে। আবার ভাবলাম, চোখের ভুল নয় তো?

কেননা এই মুক্ত প্রান্তরে এত হাওয়া যেখানে বইছে সেখানে গামছাটা একটুও উড়ছে না কেন? অথচ শেষ রাতের ফিনফিনে আলোয় গামছাটা বেশ ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, মাঠ থেকে উঠে কাছে এসে আর একবার গামছাটাকে ভাল করে দেখলাম। না, কোনও ভুল নেই দেখার। ভাবলাম, নিশ্চয়ই কেউ এখানে গামছা রেখে মাঠে গেছে। কিন্তু কোথায় কে? যতদূর চোখ যায় কেউ কোথাও নেই। যাই হোক, যারই গামছা হোক না কেন, এ নিয়ে আমারও কোনও মাথাব্যথা নেই। পাশের পুকুর থেকে মুখহাত ধুয়ে কাপড় কেচে উঠে এলাম। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। উঠে এসে দেখলাম গামছাটা যেন ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেছে। আশপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। চারদিক এত ফাঁকা যে, এইটুকু সময়ের মধ্যে গামছাটা নিয়ে চলে যাওয়াও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মনটা কীরকম খারাপ হয়ে গেল। ভয়ও পেলাম একটু। গা-টাও ছমছম করে উঠল। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মশারি খুলে নিজের বিছানাপত্তর গুটিয়ে রাখলাম। অনেক পরে ভোর হল।

সকালবেলা সহকর্মীদের কাছে ঘটনাটা বলে জানতে চাইলাম, আমাদেরই ভেতর থেকে কেউ গামছাটা ওখানে রেখেছিল কিনা। কিন্তু না। একবাক্যে সকলেই না করল। সবাই যে যার পুরনো গামছা বের করে দেখাল। ও গামছাটা তো নতুন। তা ছাড়া কাল রাতে শয্যাগ্রহণের পর কেউ ওঠেওনি।

কথাটা প্রচার হতে গ্রামের অনেকেরই মুখ দেখলাম শুকিয়ে গেল। এক ভদ্রলোক বললেন, “আপনাদের বলে দেওয়া হয়নি জায়গাটা একটু দোষাস্ত। শুধু আপনি নয়, আমাদেরও অনেকেই ওইরকম নতুন গামছা বা লালপাড় শাড়ি শুকোতে দেওয়া অবস্থায় দেখেছে। কিন্তু যার জিনিস আজ পর্যন্ত তাকে কেউ দেখেনি। যাই হোক, রাতভিত একা কেউ বেরোবেন না ঘর থেকে।”

যে মাসি আমাদের রান্না করে দিচ্ছিল সে তো শুনেই চোখ বড় বড় করে বলল, “ওমা! ই কি কাণ্ড গো। তবে শোনো বাছা। আপনারা যদি ভয় না পাও তা হলে বলি”, বলেই সে নানারকম উদ্ভট গল্প শোনাতে লাগল। এসব নাকি ভুতুড়ে ব্যাপার। এমনকী এও বলল, যে ঘরটায় আমাদের রান্না খাওয়া হচ্ছে সে ঘরটায় এত ভূতের উপদ্রব যে, রাত্তির বেলা কেউ ও-ঘরে টিকতে পারে না। এবং সেই কারণেই আমাদের থাকার জন্য এই ঘরখানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এর পর সারাদিন ধরে চলল আমাদের মধ্যে নানারকম বিশ্বাস অবিশ্বাসের পালা। ঝড়টা বেশি বইল আমার ওপর দিয়ে। সবাই বলল, “দুর মশাই। সাত সকালবেলায় আপনি এমন মেজাজটা খেঁচড়ে দিলেন যে সারাদিনের সব কাজ মাটি।”

আমাদের প্রিসাইডিং অফিসার অত্যন্ত স্মার্ট ও একরোখা যুবক, ভূত-টুত তো বিশ্বাসই করেন না। কাজেই এসব ব্যাপার তাঁর কাছে স্রেফ একটা হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বারবার আমাকে বলতে লাগলেন, “ওই দেখুন বরুণবাবু, কে আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।”

চৌকিদার শ্যামল বলল, “আজ রাতে শোওয়ার সময় আপনাকে বেশি করে জল খাওয়াব। যাতে মাঝরাতে একা উঠতে হয়।”

তালপাতার সেপাই বলল, “আমার হাতে মশাই এই বন্দুকের নলটা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আমি কাউকে পরোয়া করি না। ভূতের হিম্মত থাকে আমার সঙ্গে এসে লড়ে যাক।”

শুধু এই নয়। আরও অনেক টিটকিরি, অনেক হাসাহাসি চলল সারাদিন ধরে। আমি অবশ্য চুপচাপ রইলাম। তা ছাড়া উপায়ও নেই। কেননা এটা তো ঠিক, আজকের দিনে এইসব উদ্ভট ব্যাপার কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না। যাই হোক সারাদিনে আমরা ঠাট্টা তামাশা ও হাসাহাসির মাঝে বুথটাকে বেশ ভালভাবেই সাজিয়ে রাখলাম। কাল ভোট। যাতে সকালবেলা কোনওরকম অসুবিধা না হয় সেইভাবে সব ঠিকঠাক করে ব্যালট পেপারগুলো বিছানায় নিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে-শুয়েও অনেকক্ষণ ভূত ভূত করে কাটল।

শ্যামল বলল, “ওই দেখুন, চালার ওপর কীসের শব্দ হচ্ছে।”

তালপাতার সেপাইটা বলল, “আমার বেঞ্চিটা যেন কীরকম দুলছে ভাই।”

কে যেন একজন বলল, “বরুণবাবু, একবার উঠে দেখুন তো। মনে হল আপনার নাম ধরে বাইরে কে যেন ডাকল।”

এ সবই রসিকতা।

প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, “কী মশাই, আপনারা কি একটু ঘুমোতে দেবেন, না কী? কাল কিন্তু ভোর ভোর উঠতে হবে। তারপর সারাদিনে নিশ্বাস ফেলবারও সময় পাবেন না। ভোট শেষ হলেও রেহাই নেই। লরির আশায় হাঁ করে বসে থাকতে হবে। উলুবেড়িয়ায় গিয়ে মালপত্তর জমা দিতে হবে। চুপচাপ শুয়ে পড়ুন সব।”

কথাটা ঠিকই। রসিকতা ছেড়ে সবাই চুপ করল। একটু পরে দু-একজনের নাক ডাকার শব্দও শোনা গেল। তারও পরে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে হঠাৎ একটা চিৎকার ও গোঙানির শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। কী ব্যাপার? ব্যাপার কী? আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপছে তখন। সবাই ‘কী হল, কী হল’ বলে মশারি গুটিয়ে টর্চ জ্বেলে উঠে দাঁড়ালাম। আমাদেরই ভেতর থেকে কে যেন একজন হারিকেন জ্বালল। সেই আলোয় দেখলাম সেপাই ও চৌকিদারটি দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বিছানা মশারি সমেত ড্যালা পাকিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমরা তাদের মুক্ত করে চোখেমুখে জল দিয়ে পাখার বাতাস করতে লাগলাম। অনেক পরে একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে তারা যা বলল তা হল এই—মধ্যরাত্রে সেপাই ও চৌকিদারটি হঠাৎ অনুভব করল কে যেন ওদের পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে ওরা ভেবেছিল আমাদেরই ভেতর থেকে কেউ নিশ্চয়ই ওদের ভয় দেখাবার জন্য ওইরকম করছে। তাই ওরা টর্চ জ্বেলে খুব ভালভাবে যখন দেখল আমরা সবাই নিদ্রামগ্ন তখন ওরা সজাগ হয়ে রইল। খানিক শুয়ে থাকার পরই ওরা অনুভব করল কে যেন ওদের দু’জনের পা দুটো বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত দিয়ে আবার টিপে দিচ্ছে। ওরা টর্চ জ্বেলে দেখল কোথায় কে? আবার দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শুয়ে পড়ল। ঘুম তো এলই না, উপরন্তু পাছে বিরক্ত হয় সেই ভয়ে কেউ ডাকতেও পারল না আমাদের। ওরা দু’জনে তখন যুক্তি করে দু’জনের শয্যা এক করে নিয়ে একই মশারির ভেতর জেগে শুয়ে রইল। একটু পরেই আবার পা টেপা। যে হাত ওদের পা টিপে দিচ্ছে সে হাতের শাঁখা, নোয়া, চুড়ি ইত্যাদির স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা এবার টর্চ না জ্বেলে উঠে বসতে গিয়েই দেখল মশারির কোণে এক বীভৎস চেহারার মহিলা ওদের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বসে আছে। তার সেই চাউনির মধ্যে ক্রোধের আগুন যেন ছিটকে বেরোচ্ছে। এর পরের কথা ওদের মনে নেই। ওরা চিৎকার করে জ্ঞান হারায়।

ওদের কথা শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমাদের প্রত্যেকেরই গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন একটা। সে রাত্রে আমরা আর কেউ ঘুমোলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *