প্রেতাত্মার ডাক
সেবার কলেরার মড়কে বাতাসপুর গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো হয়েছিল। সেকালে গ্রামে ঘরে এই রোগ একবার ঢুকলে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। বাতাসপুরের পাশের গ্রামে আমার এক মেসোমশাই থাকতেন। তিনি ছিলেন ডাক্তার। তাঁর মুখে গল্পটা যেমন শুনেছিলাম ঠিক তেমনি ভাবেই বলছি:
তখন শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই সেদিন প্রচণ্ড দুর্যোগ চলেছে। সেই দুর্যোগে সারাদিন রোগী দেখে রাত্রিবেলা ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘুম ভেঙে উঠে বসে কেরোসিনের কুপিটা জ্বেলে সাড়া দিলাম, “কে?”
বাইরে থেকে কোনও প্রত্যুত্তর এল না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কে ডাকে?” এবার উত্তর এল, “আমি সনাতন। একবার দরজাটা খুলুন না ডাক্তারবাবু?”
সনাতন বাতাসপুরে থাকে। কাল ওর স্ত্রী কলেরায় মারা গেছে। কিন্তু এত রাতে সনাতন আবার এসেছে কেন? তবে কি আবার নতুন করে কারও অসুখ করল? এ অঞ্চলে ডাক্তার বলতে একা আমিই। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, এই মহামারীতে একটি রোগীরও প্রাণ আমি রক্ষা করতে পারিনি। সেজন্য কারও বাড়ি যেতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। অথচ ডাক্তার হিসেবে রোগীর বাড়ি থেকে কল পেয়ে না গিয়েও থাকতে পারছি না। তাই ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় আমি চিকিৎসা চালাচ্ছি। আমি বিছানা থেকে উঠে এসে সনাতনকে দরজা খুলে দিতেই সনাতন অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল, “ডাক্তারবাবু গো, বাঁচান।”
“কী হল সনাতন! কার কী হল আবার?”
“আমার এই একটিমাত্র ছেলে ডাক্তারবাবু। তারও হয়েছে। যেমন করেই হোক, ওকে আপনি বাঁচান। বউটা গেছে, ছেলেটার মুখ চেয়ে বুক ধরে বেঁচে আছি। ও চলে গেলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে ডাক্তারবাবু। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।”
আমি সনাতনকে আশ্বাস দিয়ে আমার ডাক্তারির ব্যাগটা ওর হাতে দিলাম।
ব্যাগ নিয়ে সনাতন বলল, “আমি তা হলে এগোচ্ছি ডাক্তারবাবু। আপনি আসুন। ছেলেটা ঘরে একলা আছে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”
সনাতন এগোল।
আমি চালাঘর থেকে আমার শীর্ণকায় ঘোড়াটাকে বের করে আনলাম। তারপর ছাতা মাথায় দিয়ে তার পিঠে চেপে টর্চের আলোয় পথ দেখে বাতাসপুরে চললাম। রাত তখন দেড়টা। দুর্যোগ খুব বেশি না হলেও ঝিমঝিম অনবরতই চলছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গুড়গুড় করে মেঘও ডাকছে মাঝে মাঝে। আশশ্যাওড়া, বাবলা ও খেজুরগাছের গা ঘেঁষে আমি মেঠোপথে ঘোড়ায় চেপে চলেছি। কিছুটা পথ আসার পর হঠাৎ মনে হল, তাই তো, সনাতন গেল কোথায়? ও আমার আগে গেলেও পায়ে হেঁটে গেছে। কিন্তু আমি চলেছি ঘোড়ায় চেপে। এতক্ষণে তো ওকে ধরে ফেলবার কথা। যাই হোক, বাতাসপুরে ঢোকার মুখে একটা খাল আছে। সেই খালের ধারে এসে থামলাম আমি। এইখানে একটা পিটুলি গাছের গুঁড়িতে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে একটা অপলকা সাঁকো পার হয়ে ওপারে গেলাম। খালের দু’পাশে কালকাসুন্দে ও বেড়াকলমির ঝোপ। সাঁকো পেরোতেই শুনতে পেলাম অন্ধকারে ঝোপের ভেতর থেকে কে যেন ডুকরে কেঁদে উঠল, “ডাক্তারবাবু, ছেলেটা বাঁচবে তো?”
গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল আমার। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। এ যে সনাতনের বউ সৌদামিনীর গলা। যে সৌদামিনীকে আমি আমার ডাক্তারি বিদ্যা প্রয়োগ করেও বাঁচাতে পারিনি। কাল দুপুরে আমার চোখের সামনে সে মারা গেছে। গাঁয়ের লোকেরা মুখাগ্নি করে কাল যাকে খালের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই সৌদামিনী ছেলের অসুখের জন্য হাহাকার করে উঠল কী করে?
এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে সনাতনের দেখা না পেলে হার্টফেলই করে ফেলতাম। সনাতন একটা হারিকেন নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসুন ডাক্তারবাবু। ছেলেটা কেমন করছে।”
আমি ভীত হয়ে বললাম, “কিন্তু সনাতন, একটু আগে তোমার বউয়ের গলায় কে যেন—।”
“ওসবে কান দেবেন না ডাক্তারবাবু। ওরকম অনেক কান্নাই শুনতে পাবেন এবার থেকে। সারা গাঁ উজাড় হয়ে গেল। মানুষের আত্মাগুলো সব যাবে কোথায়? তাড়াতাড়ি আসুন।”
আমি মনে সাহস সঞ্চয় করে সনাতনের পিছু পিছু চললাম। কী জোরে জোরে হাঁটছে
সনাতন। তারপর এক সময় সনাতনকেও দেখতে পেলাম না। দেখলাম, শুধু হারিকেনটাই মাঠের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলেছে। আমার তখনকার অবস্থার কথা বলে বোঝাবার নয়! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই আলোকের অনুসরণ করলাম। এক সময় আলোটাও মিলিয়ে গেল। আমি তখন সনাতনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরটা অন্ধকার। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় ডাকলাম, “সনাতন! সনাতন!”
কোনও সাড়া নেই।
আবার ডাকলাম।
আমার ডাক শুনতে পেয়ে আশপাশের বাড়ি থেকে দু-একজন আলো নিয়ে এগিয়ে এল, “কে, ডাক্তারবাবু নাকি?”
“হ্যাঁ। সনাতন কোথায়? ওর ছেলের অসুখের খবর দিয়ে ডেকে আনল আমাকে, অথচ ওকেই দেখতে পাচ্ছি না।” পথের ঘটনার কথা অবশ্য বললাম না কাউকে।
আমার কথা শুনে সকলে অবাক হয়ে গেল। সকলেই বিস্মিত হয়ে বলল, “সনাতন আপনাকে ডেকে নিয়ে এল?”
“হ্যাঁ। আমার ব্যাগটাও যে বয়ে আনল সে।”
“সে কী! এই তো সন্ধের সময় খালের ধারে রেখে এলাম তাকে। এই প্রচণ্ড দুর্যোগে সন্ধেবেলাই অসুখে পড়ে শেষ হয়ে গেল বেচারা! আপনাকে একবার খবর দেওয়ারও সময় পেলাম না। তবে ওর ছেলের অসুখের কথা জানি না। চলুন তো দেখি?”
আমরা সকলে আলো নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখলাম, সনাতনের ছেলেটা বিছানাপত্তর নোংরা করে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আমার ব্যাগটা সযত্নে বসানো আছে ওর মাথার কাছে। আমি যতটা সম্ভব ওকে পরিষ্কার করে স্যালাইন দিলাম। কিন্তু না। আমার এ চেষ্টাও ব্যর্থ হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারা গেল ছেলেটা।
সে রাত্রিটা ওই গ্রামেই একজনদের বাড়ি কাটালাম আমি। পরদিন ভোরে সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথাটা স্মরণ করে স্বগ্রামে ফিরে এসে চলে এলাম কলকাতায়। সেই থেকে আমি এখানেই প্র্যাকটিস করছি। বাতাসপুরের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্কই নেই।