প্রেতশক্তি

বিচারক

বড় একজন আমলা হবে, এটাই ওয়াঙফুর মনের একমাত্র বাসনা। প্রচুর সময় ব্যয় করে সে পড়াশোনার পেছনে। আশা-বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল করবে। কিন্তু মাথায় হলুদ পদার্থের পরিমাণ একটু কম থাকায় ঠিক পেরে ওঠে না। ঠিকমত একটা রচনা লেখার ক্ষমতাও আসলে ওর নেই। বহুকষ্টে খেটেখুটে একটা রচনা যাও দাঁড় করায়, দেখা যায় প্রচুর বানান ভুল এবং অশুদ্ধ বাক্যের কারণে সে-ই সবার চেয়ে ক্লাসে কম নাম্বার পেয়েছে। ঘটে বুদ্ধি কম বলে বন্ধুবান্ধব প্রায়ই খেপায় ওয়াঙফুকে। তাই বলে ওয়াঙ হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। উৎসাহে কমতি নেই তার। বন্ধুদের বিদ্রূপ গায়ে না মেখে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। জীবনের একমাত্র বাসনাকে চরিতার্থ করতে হবে যে। তার বিশ্বাস, লেগে থাকলে একদিন মোক্ষলাভ হবেই।

পড়াশোনার পালা সাঙ্গ করে ওয়াঙফু প্রতিদিন সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসে। মদ খেয়ে মাতাল হতে খুব পছন্দ করে সে। ‘ওয়াঙফুর মাথায় গোবর ভরা, একটা গাধা পরীক্ষায় পাস করতে পারে কিন্তু ও করবে না,’ ইত্যাদি বলে বন্ধুরা ঠাট্টা করলেও একটা ব্যাপারে সবাই তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে। ওয়াঙফু দারুণ সাহসী। বিশেষ করে পেটে কয়েক পেয়ালা মদ যাবার পর তার সাহসের মাত্রা এতই বেড়ে যায় যে অন্যরা যে কাজটি করার কথা কল্পনাও করতে পারে না, ওয়াঙফু হাসতে হাসতে সেই কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ফেলে। সেদিন সন্ধ্যায় এমনি এক জম্পেশ আড্ডা বসেছে। ওয়াঙফু ঢকঢক করে মদ গিলছে, হাসছে ঘর ফাটিয়ে। আড্ডার মধ্যমণি চুমিঙের মাথায় এমন সময় এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। ‘তোমার যে খুব সাহস এটা আমরা সবাই জানি, ওয়াঙ,’ বলল সে। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি যত সাহসীই হও না কেন, গভীর রাতে ভূতুড়ে মন্দিরের টর্চার চেম্বারে ঢোকার মত সাহস তোমার নিশ্চয়ই নেই।’ আড্ডার বাকিরা হৈ হৈ করে উঠল চুমিঙের কথা শুনে। ওরা সবাই ভূতুড়ে মন্দিরের টর্চার চেম্বারের কথা শুনেছে। জায়গাটা নাকি এতই ভয়ানক যে সবচেয়ে সাহসী লোকটিরও বুক শুকিয়ে আসে ওখানে যাওয়ার কথা শুনলে। ‘তুমি যদি এটা করে দেখাতে পারো, দোস্ত, তাহলে তোমার সম্মানে আমরা একটা পার্টি দেব,’ বলে চলল চুমিঙ, ‘তবে তুমি যে ওখানে গিয়েছ এটার প্রমাণ অবশ্যই তোমাকে দেখাতে হবে।’

প্রচুর মদ গেলার পর ওয়াঙফু এখন পুরো টাল। টর্চার চেম্বারে ঢুকতে পারলে বন্ধুরা তার সম্মানে পার্টি দেবে ভাবতেই রক্ত গরম হয়ে উঠল। চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দেরি করল না সে। ‘মন্দির থেকে আমাকে কি নিয়ে আসতে হবে, শুনি?’ জানতে চাইল ওয়াঙ।

বন্ধুরা সাথে সাথে আলোচনায় বসে গেল ওয়াঙকে টর্চার চেম্বার থেকে কি নিয়ে আসতে বলা যায় সেটা ঠিক করতে। প্রচুর তর্কবিতর্কের পর ঠিক হলো টর্চার চেম্বারের বিচারকের মূর্তিটি নিয়ে আসতে হবে ওকে।

শোনা যায় মন্দিরের করিডর অর্থাৎ টর্চার চেম্বারে অন্ধকার জগতের দেবতা এবং দানবদের খোদাই করা ভয়ানক সব মূর্তি দাঁড় করানো আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে ভয়াবহতার দিক থেকে বিচারকের চেহারা আর সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। তার সবুজ মুখ, গরম আগুন চোখের ভয়ঙ্কর দৃষ্টি, ঘন লাল ভ্রূ আর দাড়ি মিলে চেহারাটাকে এত বীভৎস করে তুলেছে যে তার দিকে চোখ তুলে তাকানোও নাকি সম্ভব নয়। ওই মন্দির থেকে বিচারকের প্রতিকৃতি নিয়ে আসার কথা কল্পনা করাই কেবল সম্ভব, কেউ অমন কাজ আজ পর্যন্ত করতে সাহস পায়নি। কিন্তু ওয়াঙফুর পেটে একবার মাল গেলে সে কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। তাই সাত পাঁচ না ভেবেই সে রাতেই একা একা চলল মন্দিরের উদ্দেশে।

টর্চার চেম্বারে আবছা আলো জ্বলছে। ওয়াঙের মনে হলো হাজার বছরের পুরানো মূর্তিগুলো বুঝি সব জেগে উঠে নিঃশ্বাস ফেলছে। অন্ধকার কোণ থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে তাদের ভারী নিঃশ্বাস। ওয়াঙ শুনেছে এখানে যে সব মূর্তি আছে তার বেশিরভাগ বিভিন্ন অপরাধীর। তাদের অনেককেই অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ মনে হলো, ও যেন সেই অন্তিম আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে ক্ষীণ চিৎকার।

আধো আলো আধো ছায়ায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে মূর্তিগুলো। ওয়াঙ ভুলেও কারও দিকে দ্বিতীয়বার তাকাচ্ছে না। ত্রস্ত চোখে বিচারককে খুঁজছে। নিজেকে যতই সাহসী বলে বড়াই করুক, ভয়ে আসলে কলজে শুকিয়ে গেছে ওর। শেষ পর্যন্ত তাকে দেখতে পেল। টর্চার চেম্বারের বাঁ দিকে, এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বিচারক। আটকে রাখা শ্বাস ফেলল ওয়াঙ সশব্দে, তারপর দ্বিধামাত্র না করে কাঠের মূর্তিটা কাঁধে তুলে নিল। সাথে সাথে একটা ঝাঁকুনি খেল। ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। মনে হলো মূর্তিটা জীবন্ত! যাহ্, তা কি করে হয়। এটা কাঠের মূর্তি বই কিছু নয়, জোর করে ভাবার চেষ্টা করছে ওয়াঙ। দ্রুত পায়ে এগোল রাস্তার দিকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দম বন্ধ করা জায়গাটা থেকে কেটে পড়তে চায়।

বন্ধুদের কাছে আসার পর ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ওয়াঙ। ভালয় ভালয় আসা গেছে। বন্ধুরা ওকে দেখে হাত নাড়তে শুরু করল। অভিনন্দন জানাচ্ছে। ওয়াঙ কাঁধ থেকে বিচারকের মূর্তিটা নামাল। ভয়ানক চেহারাটা দেখে ভিরতি খেল ওরা, হিম হয়ে গেল বুকের রক্ত। কারও চেহারা এমন ভয়ানক, অশুভ হতে পারে কল্পনাও করেনি কেউ। বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল ধাতস্থ হতে। তারপর উল্লাসে ফেটে পড়ল সবাই। ওয়াঙকে কাঁধে তুলে নাচানাচি শুরু করে দিল। একটু সুস্থির হয়ে বসার পর এক গ্লাস মদ ঢেলে নিল ওয়াঙ। আরেকটা গ্লাস এগিয়ে দিল বিচারকের দিকে। অনুরোধ করল বিচারক যেন তাদের এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। নিজেই সে মদটা ঢেলে দিল বিচারকের কাঠের মুখে। নিষ্প্রাণ মূর্তির শরীর গড়িয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ল লাল মদ। রক্তের মত লাগছে দেখতে।

উচ্ছ্বাসের মাত্রা কমে আসতে বন্ধুরা এবার ওয়াঙকে মূর্তিটা আবার মন্দিরে রেখে আসার অনুরোধ করতে লাগল। ‘প্রমাণ হয়ে গেছে যে সত্যিই খুব সাহস তোমার। এখন দয়া করে বিচারকের মূর্তি তার জায়গায় রেখে এসো। দেবতাদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা আসলে উচিত হয়নি আমাদের, বলল চুমিঙ।

কিন্তু ওয়াঙের যেন কোন তাড়া নেই। সে ধীরেসুস্থে নিজের গ্লাসটা বিচারকের দিকে নেড়ে বলল, ‘হে মহান বিচারক, আমি নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। পড়াশোনা করি। কিন্তু জ্ঞান বলতে কিছুই এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারিনি। লোকে বলে আমার মাথায় নাকি কিছু নেই। কিন্তু আপনি যদি দয়া করে আমার বাড়িতে একটিবার পায়ের ধুলো দেন, আমার সাথে এক পাত্তর মদ খান, নিজেকে সত্যিই ধন্য মনে করব, জনাব।’

ওয়াঙের এই উদ্ভট আচরণের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না বন্ধুরা। তাদের এখন একমাত্র চিন্তা বিচারককে নিয়ে। ওদের মনে ভয় বিচারককে মন্দিরে রেখে না এলে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে। ওরা ওয়াঙকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল।

ঢকঢক করে গ্লাসের মদ শেষ করল ওয়াঙ। তারপর বিচারককে কাঁধে তুলে টলতে টলতে এগোল মন্দিরের দিকে। এখন আর ভয় লাগছে না। সোজা চলে গেল টর্চার চেম্বারে। বিচারকের মূর্তিটা আগের জায়গায় রাখল সযত্নে, কায়দা করে স্যালুট ঠুকল, বেরিয়ে এল বাইরে।

পরদিন সন্ধ্যায় ওয়াঙের সম্মানে বড়সড় ভূরিভোজের আয়োজন করা হলো। সকলে এসে অভিনন্দন জানাল ওকে। বিনয়ে বিগলিত হয়ে ওয়াঙ তাদের প্রশংসা গ্রহণ করল। বিচারককে বাড়িতে গিয়ে মদ খাওয়ার আমন্ত্রণের ব্যাপারটাকে নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি করল বন্ধুরা। জানতে চাইল বিচারক যদি সত্যি ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বাড়িতে হাজির হয় তখন কি করবে সে।

‘আমি তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবেই আপ্যায়ন করব। কিন্তু এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটার অবকাশ আমি দেখতে পাচ্ছিনারে, ভাই,’ বলল ওয়াঙ।

সে রাতে ওয়াঙের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটল। শেষ গ্লাস মদ গিলে সে সবে ঘুমাতে যাওয়ার আয়োজন করছে, এমন সময় শোবার ঘরের দরজা খুলে গেল। ভেতরে এসে ঢুকল বিচারক। আগের চেয়েও ভয়ানক লাগছে দেখতে। তাকে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল ওয়াঙ। হাত জোড় করে বলল, ‘হে মহান বিচারক, আপনি যদি আমার গলা কাটতে এসে থাকেন, আপনাকে দোষ দিতে পারব না। কারণ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমি সত্যিই অন্যায় করে ফেলেছি। দয়া করে আমার দোষ নেবেন না। খুবই নগণ্য একজন মানুষ আমি। আপনি যদি আমার জীবন ভিক্ষা দেন, যতদিন বাঁচব, আপনাকে সম্মান করে যাব।’

হাঁটু মুড়ে, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল ওয়াঙ। কথা শেষ করে বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বিচারকের দিকে তাকাতেই ভয়ানক বিস্মিত হলো। বিচারক হাসছে ওর দিকে চেয়ে।

‘ভয় পেয়ো না, বন্ধু,’ বিচারক কর্কশ কণ্ঠে কথা বলে উঠল। ‘কোন মানুষ আজ পর্যন্ত আমাকে তাদের কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেনি। তুমিই প্রথম আমাকে দাওয়াত করলে। আমি খুব খুশি হয়েছি। এখন উঠে পড়ো দেখি। আমাকে মদ খাওয়াবে বলেছিলে না? দাও, এক গ্লাস মদ দাও।’

লাফ দিয়ে উঠল ওয়াঙ। ছুটোছুটি শুরু করে দিল তার সম্মানিত অতিথির আরাম আয়েশের জন্যে। দ্রুত হাতে আগুন জ্বালল মদ গরম করার জন্যে। চাকরদের নির্দেশ দিয়ে এল দ্রুত খাবার তৈরি করতে। রান্না হয়ে গেলে ওয়াঙ নিজেই তার মেহমানের জন্যে খাবার নিয়ে এল। বউকে আসতে বলেছিল। কিন্তু সে  বেচারি এমন ভয় পেল যে এলই না। অবশ্য বিচারকের বীভৎস চেহারা দেখে সবারই ভয় পাওয়ার কথা। তবে ওয়াঙফুর এই মুহূর্তে কোন ভয় লাগছে না। সে দিব্যি ভক্তি গদগদ দৃষ্টিতে তার অতিথির আগুনের মত লাল চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বিচারক একঘেয়ে কণ্ঠে বলে চলেছে বিভিন্ন ক্লাসিক গল্প আর বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি। যেন সব বুঝতে পারছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে ওয়াঙ। মাঝেমধ্যে ভেবেচিন্তে দু’একটা প্রশ্নও করছে। খুশি মনে উত্তর দিচ্ছে বিচারক। অন্ধকার জগতের বিখ্যাত কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে সে। ওয়াঙ মাথা দোলাতে দোলাতে স্বীকার করছে এই কবিতাগুলো পৃথিবীর মানুষদের লেখা কবিতার মতই ভাল।

অতিথির সম্মানে আরেক প্রস্থ খাবার আর মদ খাওয়ার পর ওয়াঙ যখন ঘুমে ঢলে ঢলে পড়ছে, বিচারক তখনও মদ গিলতে গিলতে অনর্গল কথা বলে চলেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না ওয়াঙ, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখল তার বিখ্যাত অতিথিটি চলে গেছে।

.

এই-ই শুরু। তারপর থেকে প্রতিরাতে বিচারক নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকল ওয়াঙফুর বাসায়। আর ওর স্ত্রী বেচারি প্রতিবারই ভয়ে আধমরা হতে লাগল। তার নিশ্চিত ধারণা ভূতের সাথে মানুষের বন্ধুত্বের পরিণাম কখনও ভাল হতে পারে না।

‘তুমি প্রতিদিনই শয়তানটার সাথে মদ খাও,’ বলে সে ওয়াঙকে। ‘আমার বাপু ব্যাপারটা মোটেই ভাল ঠেকছে না। ওকে এভাবে বাসায় আসতে উৎসাহ দেখিও না তো। ওর সাথে আর মদ খেতে বোসো না। দেখবে তাহলে নিজেই হয়তো আর আসবে না।’

কিন্তু ওয়াঙ বৌ-এর কথায় পাত্তা দেয় না। ‘আমি যদি ওকে এখন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে নির্ঘাত তার অভিশাপ এসে পড়বে আমাদের ওপর। জেনেশুনে কেন সর্বনাশ ডেকে আনি? তারচে’ বরং ওর সাথে আগের মত সম্পর্ক রেখে চলাই ভাল,’ বলে সে।

বিচারক একজন চীনা বুদ্ধিজীবী। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কিন্তু শিগগিরই সে আবিষ্কার করল তার বন্ধুটির ঘটে বুদ্ধিশুদ্ধি এতই কম যে কোন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তার সাথে আলোচনা করা মানে বৃথা সময় অপচয়। বুঝেছে এমন ভাব দেখালেও আসলে কিছুই বোঝেনি সে। বারবার ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করে বিচারক। জলের মত সহজ করে ব্যাখ্যা করে। একটা ছাগলও বিচারকের সংস্পর্শে এলে মানুষ হয়ে উঠত, কিন্তু ওয়াঙ বোধহয় ছাগলেরও অধম। ক্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে। ভয়ানক বিরক্ত হয় বিচারক।

এক রাতে খুব সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে বিচারক। প্রতিটি জিনিস ভেঙে ভেঙে বুঝিয়ে দিচ্ছে ওয়াঙফুকে। ওয়াঙ মাথা নাড়ছে, যেন বুঝতে পারছে সব। হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসল বিচারক। এমন ভুল জবাব দিল ওয়াঙ যে সে রেগেমেগে চলেই গেল গটগট করে। ওয়াঙ আর কি করে, চুপচাপ বসে মদ খেল আর ভাবতে লাগল আজ যেভাবে রেগেছে বিচারক তাতে ভবিষ্যতে আর কখনও ওর বাড়িতে আসে কিনা সন্দেহ। অবশ্য না এলে ওর স্ত্রী আর বন্ধুবান্ধবরা ভারি খুশি হবে। কারণ প্রেতলোকের এক বাসিন্দার সাথে ওয়াঙের ইদানীং দহরম মহরম চলছে শুনে বন্ধুবান্ধব ভুলেও পা দেয় না এদিকে। আর বউ তো বহু আগে থেকেই বিচারককে দুচোখে দেখতে পারে না।

রাত তখন অনেক। মদ খেয়ে ঢোল হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ওয়াঙফু। হঠাৎ বুকে দারুণ ব্যথা টের পেয়ে জেগে গেল সে। চোখ মেলেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। বিচারক দাঁড়িয়ে বিছানার পাশে। হাতে ভয়ঙ্কর-দর্শন একটা ধারালো ছোরা। ওয়াঙ জানে না এই ছোরা দিয়ে একটু আগে বুক চিরে ফেলা হয়েছে ওর। ভয়ে কাঠ হয়ে দেখল বিচারক তার বুকের মধ্যে থেকে কি যেন বের করে পাশের টেবিলে রাখছে। শরীরে এখন কোন ব্যথা লাগছে না। কিন্তু যে কাণ্ড ঘটতে দেখছে চোখের সামনে তাতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত জ্ঞান হারাল ওয়াঙ। তাই দেখতে পেল না ওর শরীরটা নিয়ে কি ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে বিচারক।

ওয়াঙের বুক থেকে হৃৎপিণ্ড বের করে আনল বিচারক। তারপর পকেট থেকে আরেকটা হৃৎপিণ্ড বের করে ওয়াঙের বুকে পুরে দিল। টেবিলের ওপর রাখা ওয়াঙের শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোও ঠিক ঠিক জায়গায় বসিয়ে ক্ষতটা সেলাই করে দিল সে। তারপর চমৎকার করে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ হতে তৃপ্তির হাসি হাসল বিচারক।

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এল ওয়াঙের। মাথাটা কেমন জানি হালকা ঠেকছে। শরীরে কোন ব্যথা নেই। কোথাও রক্তের চিহ্নও নেই। ‘আমি কি তবে দুঃস্বপ্ন দেখলাম।’ ভাবছে ও। হঠাৎ টেবিলের দিকে চোখ যেতে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল। টেবিলের ওপর একটা রক্তমাখা হৃৎপিণ্ড পড়ে আছে। জিনিসটা যে ওর সে ব্যাপারে ওয়াঙের কোন সন্দেহই নেই। আতঙ্কে আবারও জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা হলো তার। ঠিক এই সময় বিচারক এসে হাজির হলো সামনে। হাত বাড়িয়ে হৃৎপিণ্ডটা তুলে নিল সে, রেখে দিল পকেটে।

‘ভয়ের কিছু নেই,’ ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল বিচারক। ‘মরবে না তুমি। ছোট্ট একটা অপারেশন করেছি তোমার। তোমার স্থুল বুদ্ধির হৃৎপিণ্ড সরিয়ে ওখানে একজন পণ্ডিত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড বসিয়ে দিয়েছি তোমার জিনিসটা নিয়ে যাচ্ছি আমি। এটা ওই পণ্ডিতের বুকে শোভা পাবে। আর চিন্তা নেই, বন্ধু। এখন তুমি আগের চেয়ে জ্ঞানী আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। কেউ তোমাকে আর মোটাবুদ্ধি বলে ঠাট্টা করার সাহস পাবে না। আর আমিও এখন তোমার সাথে কথা বলে আরাম পাব। চলি।’ বলে অদৃশ্য হয়ে গেল বিচারক। নিজেকে বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত লাগল ওয়াঙফুর। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। ধীরে ধীরে চোখ বুজে এল ওর। ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে খুব ঝরঝরে ঠেকল শরীর। বিছানার ওপর উঠে বসল ওয়াঙফু। সাবধানে ব্যান্ডেজ খুলল। রক্তের কোন চিহ্ন নেই। শুধু একটা সরু, লাল দাগ পড়ে আছে বুকের কাছটায়। ক্ষতেরও চিহ্ন নেই কোথাও। ঘটনাটা খুলে বলল সে বৌকে। কিন্তু বৌ বিশ্বাস করল না ওর কথা। তার ধারণা মাতাল অবস্থায় বাথরূমে পড়ে গিয়ে চোট খেয়ে ওই লাল দাগটার সৃষ্টি হয়েছে। স্বামীর কথা গাঁজা বলে উড়িয়ে দিলেও, ক’দিন পরই অবাক হয়ে লক্ষ করল, স্বামী প্রবর তার পড়াশোনায় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে উন্নতি করেছে। আগে কোন পড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিলে বসে ‘অ্যা অ্যা’ করে মুখস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও যা পারত না, ইদানীং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই পড়া শিখে ফেলছে। যে কোন বই তার কাছে এখন ডালভাত। গোগ্রাসে গিলছে।

বিচারক একদিন রাতে ওয়াঙকে জানাল এবার সে তার বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। সময় এসেছে যোগ্যতা প্রমাণ করার। পরীক্ষা দিল ওয়াঙফু, সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রথম হয়ে বসল। এই অবিশ্বাস্য ফল সে কিভাবে করল জানতে চাইলে ওয়াঙফু অকপটে সবাইকে তার বিচারক বন্ধুর কথা বলে দিল। কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো না যে কেউ বিশ্বাস করেছে। সবাই এটাকে ‘আজগুবী গপ্পো’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বাঁকা হাসি হাসল।

.

একদিন হঠাৎ করেই চিন্তাটা মাথায় ঢুকল ওয়াঙের। এটা-সেটা অনেক ভেবে ঠিক করল একমাত্র বিচারকের পক্ষেই সম্ভব তার মনের এই ইচ্ছে পূরণ করা। কিন্তু এমনিতেই সে ঋণী হয়ে আছে পরীক্ষার ব্যাপারে, আবার নতুন একটা জিনিস চায় কি করে। সেদিন সন্ধ্যায় মদ খাওয়ার সময় ওয়াঙের মধ্যে ইতস্তত ভাব লক্ষ করে বিচারক জানতে চাইল সে কিছু বলতে চায় কিনা। অনেকক্ষণ দোনামোনা করে, মাথা চুলকে, গলা খাঁকারি দিয়ে ওয়াঙ মিনমিনে কণ্ঠে বলল, বিচারক যদি অভয় দেয় তবে একটা কথা বলতে চায় সে।

‘নির্ভয়ে তোমার মনের কথাটা আমাকে বলতে পারো, বন্ধু, বলল বিচারক। ‘আমি তোমার অনুরোধ রক্ষার জন্য যতটুকু সম্ভব করব।’

‘আমার বউয়ের কথা বলছিলাম, হুজুর,’ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল ওয়াঙ। ‘ওকে আমি খুব ভালবাসি। ও-ও আমাকে ভালবাসে। কিন্তু ওর ব্যাপারে একটা দুঃখ বুঝি চিরকাল থেকেই গেল। বৌয়ের আমার ফিগার সুন্দর, কিন্তু মুখটা দেখতে একটুও ভাল না। এই নিয়ে, হুজুর, আমার দুঃখের অন্ত নেই। ওর চেহারাটা সুন্দর হলে আমি কতই না সুখী হতে পারতাম। আপনি কি পারেন না ওর মুখটা সুন্দর করে দিতে?’

বিচারকের লাল চোখ জ্বলে উঠল। হেসে উঠল ভৌতিক কণ্ঠে। ‘হ্যাঁ, পারি।’ বলল সে। ‘তোমার বৌকে সুন্দর একটা মুখ আমি উপহার দিতে পারি। কিন্তু কাজটা করতে সময় লাগবে আমার। কারণ হুট করে একটা সুন্দর মুখ খুঁজে বের করা একটু সময়ের ব্যাপার। তবে ভেবো না। তোমার আশা পূরণ করব আমি।’

হপ্তা দুয়েক পর হাজির হলো বিচারক। বলল আজ রাতেই কাজটা করতে যাচ্ছে সে। তবে ওয়াঙকে আগেভাগে বৌকে গভীর ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ কাজটা সারতে হলে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া দরকার তাকে। ওয়াঙ বিচারককে আশ্বস্ত করে বলল, এ ব্যাপারে ভাবতে হবে না তাকে। বৌকে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা সে করবে। এখন ভালয় ভালয় কাজটা হলেই হলো।

মাঝরাতে বিচারক এল নিঃশব্দে। ওয়াঙফু এদিকে টেনশানের চোটে ঘেমে অস্থির। নার্ভাস চোখে লক্ষ করল বিচারকের কোটের পকেট ফুলে আছে বেঢপভাবে। ‘এটা জোগাড় করতে আমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে,’ খসখসে কণ্ঠে বলল সে। ‘কিন্তু আমার মনে হয় জিনিসটা দেখে তুমি খুশিই হবে।’ হাত ঢোকাল সে পকেটে। বের করে আনল ‘জিনিস’টা। আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠল ওয়াঙফু বিচারকের হাতে ঝুলন্ত গলাকাটা মাথা দেখে। একমাথা রেশমী চুল মেয়েটির। অসম্ভব সুন্দর একটি মুখ। পাখির ডানার মত বাঁকানো ভ্রূ, ভরাট গাল, কমলা কোয়ার মত ঠোঁট। একেবারে তাজা মুখ। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে এখনও কাটা জায়গা থেকে।

বিচারক তাড়া লাগাল ওয়াঙকে, তাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি কাজটা সেরে ফেলতে চায় সে। ওয়াঙ ভূতে পাওয়া মানুষের মত বিচারককে নিয়ে চলল স্ত্রীর কক্ষে। বিচারক ঘরে ঢুকেই সেই বিশাল ছুরিটা বের করল কোটের আড়াল থেকে। ওয়াঙ বুঝল এবার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ভয়ের চোটে সে তাকালই না স্ত্রীর দিকে। পেছন ফিরে রইল। বিচারক দ্রুত এবং দক্ষ হাতে অপারেশনের কাজটা সারল। ওয়াঙের ঘুমন্ত স্ত্রীর মাথাটা কেটে নিল সে ছুরির এক পোঁচে। সাবধানে নতুন মুণ্ডুটা কাটা ধড়ে বসাল। তারপর নিপুণ দক্ষতায় বাকি কাজটুকু সারল। কাজ শেষ হওয়ার পর ওয়াঙকে বলল এবার সে তার স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারে। ভয়ে ভয়ে ফিরল ওয়াঙ। মুগ্ধ হয়ে গেল স্ত্রীর ফুলের মত সুন্দর নতুন মুখটি দেখে। কমলা কোয়া অধর নড়ছে, অল্প অল্প কাঁপছে ঘন আঁখি পল্লব। বিচারক এবারও কাটা মুণ্ডুটা হাতে ধরিয়ে দিল ওয়াঙের। বাগানের মাটিতে ওটা গভীরভাবে পুঁতে ফেলতে বলল। ওয়াঙ কাঁপতে কাঁপতে কাজটা সারার পর সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল বিচারক। রাতে ঘুম প্রায় হলোই না ওয়াঙের। অনেক রাত অবধি জেগে মদ খেল সে। বারবার গিয়ে চুপিচুপি দেখে এল ঘুমন্ত স্ত্রীকে। সুন্দর এবং বিষণ্ণ মুখটি একরাশ কালো চুলের ফ্রেমে বন্দী হয়ে বালিশে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। দেখে যেন আশ মেটে না।

পরদিন সকালে ওয়াঙের ঘুম ভাঙল চাকরানীর চেঁচামেচিতে। ভয়ে আমসি মুখ। তোতলাতে তোতলাতে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, ওয়াঙের স্ত্রীর ঘরে এক অদ্ভুত মেয়েলোক মনিব-পত্নীর পোশাক পরে শুয়ে আছে। তার ঘাড়ে রক্ত! ওয়াঙ ব্যস্ততা দেখিয়ে বিছানা ছাড়ল, চলল স্ত্রীর ঘরের দিকে। ভেতরে ঢুকে দেখে তার সুন্দরী, নতুন স্ত্রী ঘাড়ের জমাট বাঁধা রক্ত ধুয়ে ফেলছে। রক্ত ধুয়ে ফেলার পর সে তাকাল আয়নার দিকে। জমে বরফ হয়ে গেল সাথে সাথে। নতুন মুখটার সাথে আদৌ পরিচয় নেই তার। নিজের অজান্তেই ঘাড়ে হাত চলে এসেছে ওর। সরু গোল একটা লাল দাগ ঘিরে আছে জায়গাটা। ঘাড়ের নিচের চামড়া আর মুখের চামড়ার রঙে কোনই মিল নেই। চাকরানী এদিকে ফিট হয়ে পড়ে গেছে। ওয়াঙ পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রীকে। নিজের নতুন, সুন্দর মুখটা দেখে খুশি না হয়ে পারেনি স্ত্রী। কিন্তু বিচারকের কথা মনে আসতেই মুখ শুকিয়ে চুন হয়ে গেছে তার। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। তার ভয়, ওরা দু’জনে যেভাবে এই বিচারকের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছে, হয়তো একদিন সে এর প্রতিদান চেয়ে বসবে। আর সেই প্রতিদান ভয়ঙ্কর কিছু হতে বাধ্য।

.

ওয়াঙফু ভেবেছিল স্ত্রী সুন্দর মুখটি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে, অবান্তর কোন প্রশ্ন করে তাকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু নারীজাতি যেমন হয়, সবকিছুতে উঁকি মারার স্বভাব। ওয়াঙের স্ত্রী প্রতিদিন তার কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করল। এই নতুন মুখের আসল পরিচয় কি না জানা পর্যন্ত নাকি সে একটুও শান্তি পাচ্ছে না। কিন্তু এ ধরনের আপত্তিকর প্রশ্ন বিচারককে করার কথা ভাবতেই পারে না ওয়াঙ। তবে কানের পাশে অনবরত মশার মত বিনবিন করলে কাঁহাতক সহ্য করা যায়। একদিন সাহসে বুক বাঁধল ওয়াঙ। ঠিক করল আজ প্রসঙ্গটা তুলবে। সেদিন প্রচুর মদ খেল সে। খাওয়াল বিচারককেও। বারবার বিচারকের কাছে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তারপর সুযোগ বুঝে আসল কথাটা পাড়ল। ‘আপনাকে এ ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইনি আমি, হুজুর। কিন্তু আমার স্ত্রীর জানার খুব ইচ্ছে, ওই মাথাটা আপনি কোত্থেকে জোগাড় করেছেন। মানে আমি বলতে চাইছি, ওটা কি কোন ‘জ্যান্ত মানুষের…নাকি মরা মানুষের মাথা ছিল?’

প্রশ্নটা করেই ওয়াঙ বুঝতে পারল ভুল হয়ে গেছে। বিচারকের সবুজ মুখ রাগে গনগনে হয়ে উঠেছে। লাল চোখ দুটোও যেন একটু বেশি রক্তিম ঠেকছে। বৌয়ের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনল কিনা ভেবে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল ওয়াঙ। কিন্তু না, বিচারকের চেহারা আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলল সে। ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে নির্ভয়ে জানাতে পারো আমার মত একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি কখনও কাঁচা কাজ করে না। সে কাউকে হত্যা করে তার মুণ্ডু নিয়ে আসেনি। মেয়েটির মৃত্যুর ব্যাপারে আমি কোনভাবেই জড়িত নই।’

বিচারকের আশ্বস্ততায় সাহস ফিরে পেল ওয়াঙ, জানতে চাইল, ‘কিন্তু মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিল এটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। আপনি অত তাজা মুণ্ডু জোগাড় করলেনই বা কোত্থেকে? ওকে যখন নিয়ে এলেন তখনও ওর গলা দিয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছিল।’

তাহলে তোমাকে আসল ঘটনাটা বলি, বন্ধু, শোনো,’ বলল বিচারক। ‘মেয়েটিকে আসলে খুন করা হয়। ওর বাগদত্তা ছেলেটি কয়েকদিন আগে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। ভীষণ ভেঙে পড়ে সে। প্রায়ই মন্দিরে এসে কাঁদত। এই সময় ও চোখে পড়ে খুনীর। মেয়েটিকে চিনত সে। কিন্তু কখনও সাহস পায়নি ভালবাসার কথা বলতে। যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন খুনী ওকে অনুসরণ করে ওর বাড়িতে যায়। বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না। মেয়েটি একা একটি ঘরে বসে মনমরা হয়ে প্রেমিকের কথা ভাবছিল। প্রেম নিবেদনের এই-ই মোক্ষম সময় ভেবে ঢুকে পড়ে তার ঘরে। মেয়েটি ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করলে মাথায় রক্ত চড়ে যায় তার। ধর্ষণ করতে উদ্যত হয় সে। কিন্তু মেয়েটি প্রাণপণে বাধা দিলে একসময় ক্ষিপ্ত হয়ে সে একটা ছোরা দিয়ে হত্যা করে মেয়েটিকে। এক কোপে কেটে ফেলে গলা।’

‘কি ভয়ঙ্কর কাণ্ড! কিন্তু আপনি তো সবই জানতেন কি হচ্ছে। জেনেশুনেও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটতে দিলেন?’

‘আমাকে আর প্রশ্ন কোরো না, ওয়াঙ,’ বলল বিচারক। ‘তোমার আর কোন প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। তুমি আমার কাছে সুন্দর একটি মেয়ের মুখ চেয়েছিলে। পেয়েছ। এ নিয়ে আর কিছু ভাববার কোন প্রয়োজন দেখছি না আমি। আর হ্যাঁ, তোমার স্ত্রীকেও আসল ঘটনা জানাবার কোন দরকার নেই। ঠিক আছে?’ ঘটনার আকস্মিকতায় কথা বলতে ভুলে গেছে ওয়াঙ। সে চুপ হয়ে থাকল। এই ঘটনা কারও কাছে যেন ফাঁস না করে এই ব্যাপারটা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে চলে গেল বিচারক।

ওয়াঙফুর সাদামাঠা চেহারার বৌটা এক রাত্তিরের তেলেসমাতিতে অপূর্ব সুন্দরী হয়ে উঠেছে, এ কথা চারদিকে রটতে বেশি সময় লাগল না। অনেকেই তাকে দেখতে এল। বুড়োরা প্রকাশ্যে বলাবলি শুরু করল, একমাত্র শয়তানের কারসাজিতেই এই অলৌকিক ঘটনা ঘটা সম্ভব। আর ওয়াঙফু যদি সে কাজটাই করে থাকে তবে ভাল করেনি। কারণ শয়তানের সাথে হাত মেলানোর পরিণতি কখনোই ভাল হয় না। ওয়াঙের সুন্দরী স্ত্রীর কথা শুনে একদিন উতাং নামে শহুরে এক উচ্চপদস্থ আমলা এল ওয়াঙদের বাড়িতে। সমাদর করে বসাল তাকে ওয়াঙ। পরিচয় করিয়ে দিল বৌয়ের সাথে। ওয়াঙের স্ত্রীকে দেখে উতাং-এর চোখের পলক আর পড়ে না। অভিভূত হয়ে সে বারবার বলতে লাগল, এ যেন তার মৃতা কন্যা স্বয়ং কবর থেকে উঠে এসেছে। ওয়াঙ বুঝতে পারল বৌ উতাং-এর অপলক দৃষ্টির সামনে খুবই অস্বস্তি অনুভব করছে। অন্দর মহলে পাঠিয়ে দিল সে স্ত্রীকে। প্রশ্ন করে জানতে পারল উতাং ওই খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটির বাপ। শুনে ওয়াঙ চেয়ার উল্টে পড়ে আর কি। উতাং যখন জানতে চাইল, ওয়াঙের স্ত্রীর চেহারা হুবহু তার মরা মেয়ের মত হলো কি করে, তখন ওয়াঙ মারাত্মক একটা ভুল করে বসল। বিচারকের নির্দেশ অমান্য করে আসল ঘটনা খুলে বলল সে। ফল হলো মারাত্মক। সাথে সাথে উতাং ওয়াঙকে দোষী সাব্যস্ত করে বসল। বলল, অন্য কেউ নয়, আসলে নিজের স্বার্থে ওয়াঙই তার মেয়েকে একলা পেয়ে সেদিন খুন করেছে। এখন দোষ চাপাতে চাইছে অন্যের ঘাড়ে। রেগে আগুন হয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে শাসিয়ে গেল ওয়াঙকে। বলল, উঁচু মহলের সাথে যোগাযোগ করতে যাচ্ছে সে। আদরের কন্যাকে খুন করার শাস্তি তাকে দিয়েই ছাড়বে।

ওয়াঙ বুঝতে পারল, বিচারকের নির্দেশ অমান্য করে কি ভুলটাই না করেছে। ওয়াঙ বিচারক সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছে তার একটাও বিশ্বাস করেনি উতাং। সন্দেহ নেই, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করবে না উতাং। এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কি? বিচারক কি তার এই বিপদে মাথা ঘামাতে আসবে? উঁহু, মনে হয় না। তার কি দায় পড়েছে ওয়াঙের সমস্যা বারবার নিজের কাঁধে তুলে নিতে? তাহলে কি করবে সে? কোথায় যাবে? বিচারকের কথা হয়তো কেউই বিশ্বাস করতে চাইবে না। বিশ্বাস করার কথাও নয়। কারণ আজ পর্যন্ত সে ছাড়া আর কেউ বিচারকের চেহারা পর্যন্ত দেখেনি। যাকে কেউ কখনও দেখেনি তার কথা কে বিশ্বাস করবে? দুশ্চিন্তায় মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে ওয়াঙের। চারদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করে।

ওয়াঙের সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সেদিন সন্ধ্যা নামার পরপর বাড়িতে এসে হাজির হলো বিচারক। কি ঘটছে না ঘটছে সবই জানে সে। তাই ভণিতা না করে ওয়াঙকে বলল, একটা চাকরকে দিয়ে উতাং-এর বাড়িতে একটা চিঠি পাঠাতে। ‘ওকে চিঠিতে লিখে জানাবে, সে যদি আসল খুনীর সন্ধান চায় তবে অবশ্যই যেন আজ রাতের মধ্যে তোমার বাড়িতে আসে। এখানে এলেই শুধু সে মূল খুনীর নাম জানতে পারবে, নচেৎ নয়। মনে রেখো, এই চিঠিটার ওপর তোমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। যাও, চিঠিটা এমনভাবে লেখো যাতে সে আসতে বাধ্য হয়।’ কোন রকম বিরতি ছাড়াই কথাগুলো বলল বিচারক। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে চিঠি লিখতে বসল ওয়াঙ। লেখা শেষ হতে চাকরকে হুকুম করল যত তাড়াতাড়ি পারে উতাং-এর বাড়িতে চিঠিটা পৌছে দিতে। বিচারক জানাল, উতাং আসার পরে আবার সে আসবে। আপাতত বিদায় নিচ্ছে সে।

ওয়াঙের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, উতাং আদৌ তার কথা বিশ্বাস করে বাড়িতে আসে কিনা। কিন্তু উতাং সকল সন্দেহের নিরসন ঘটিয়ে হাজির হলো। তবে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে এসেছে সে। উতাং আসতেই ওয়াঙ তাকে ওর সেরা মদ খেতে দিল। কয়েক গ্লাস মদ পেটে যেতেই মারমুখী ভাবটা অদৃশ্য হয়ে গেল উতাং-এর চেহারা থেকে। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল সে।

এই সময় রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটল বিচারকের। তার ভীষণ মূর্তি দেখে উতাং অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। মোমবাতির মৃদু আলোতে বিচারককে নরকের প্রেতাত্মার মত লাগছে।

‘মহান বিচারককে ভয়ের কিছু নেই, জনাব,’ ওয়াঙ তাকে আশ্বস্ত করে বলল। ‘ওঁর চেহারাটাই অমন। আপনি তো চাইলেই আর ঈশ্বরের দানকে অস্বীকার করতে পারেন না। দয়া করে সুস্থির হয়ে বসুন। নিন, আরেকটু মদ নিন। উনি আপনাকে আপনার কন্যার আসল খুনী সম্পর্কে বলতে এসেছেন।’

উতাং মদ খেতে খেতে পুরো গল্পটা শুনল। কিন্তু বিশ্বাস করল না। তার নিশ্চিত ধারণা, ওয়াঙই হচ্ছে আসল খুনী। অন্য লোককে ভাড়া করে এনে আজগুবী একটা গল্প শুনিয়ে দিয়েছে তাকে। ‘আমি একজন উচ্চপদস্থ বুদ্ধিমান অফিসার। আর কোন বুদ্ধিমান লোকই তোমার এই আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করবে না,’ বলল সে। ‘এই লোকটিকে আমার একটুও বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্য লোক আমার কন্যাকে হত্যা করেছে এটা একেবারে ভুয়া কথা। আসলে কাজটা ঘটিয়েছ তুমি। এই খুনের জন্য তুমিই একমাত্র দায়ী,’ বলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল সে। ওয়াঙ তাকে যতই বোঝাতে চায়, কোন কথাই কানে তুলতে চায় না সে। প্রচণ্ড মদ্যপান এবং তর্কাতর্কির চোটে এক সময় দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ল সোফায়। কয়েক সেকেন্ড পর দেখা গেল নাক ডাকার প্রতিযোগিতা চলছে দু’জনের মধ্যে। এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিল বিচারক। ওদের ঘুমাতে দেখে ভয়ঙ্কর এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। কাজটা করার এই-ই উপযুক্ত সময়। কারণ সে জানে, আর কয়েক ঘণ্টা পর ওয়াঙকে গ্রেফতার করতে আসবে পুলিশ। এখনই কাজটা না করলে বন্ধুকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না সে। যা করার এখনই করতে হবে। ভয়াল হাসি হেসে সে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত উতাং-এর দিকে।

.

দরজায় ধুমধাম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওয়াঙের। মদের নেশা এখনও কাটেনি, টলতে টলতে এগোল সে দরজার দিকে। কাঁপা হাতে খিড়কি খুলতেই কয়েকজন অফিসার ভেতরে ঢুকল। ‘খুনেটা গেল কই,’ বলতে বলতে ওরা বসার ঘরে চলে এল। সোফার ওপর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে উতাং। অফিসাররা সোজা গিয়ে চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তুলল, প্রায় ইঁদুর ঝোলা করে নিয়ে চলল বাইরে। উতাং-এর ঘুমের ঘোর এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে জড়ানো কণ্ঠে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওরা দরজা দিয়ে বেরুচ্ছে, এই সময় উতাং-এর দিকে চোখ পড়ল ওয়াঙের। বিস্ময়ের ধাক্কাটা অবশ করে দিল ওকে। এ তো উতাং নয়। এ কাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা! ওয়াঙ স্পষ্ট দেখল হতভাগ্য লোকটার ঘাড়ে সরু, লাল একটা গোলাকার দাগ। প্রায় বিস্ফোরণের মত ছিটকে গিয়ে বাথরুমে ঢুকল ওয়াঙ। তাকাল আয়নার দিকে। শিরশিরে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীরের মধ্যে দিয়ে। প্রচণ্ড শীত করছে ওর। প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে, গতরাতে তৃতীয়বারের মত সফল আরেকটা অপারেশন করেছে বিচারক। কারণ আয়নার মধ্য থেকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে যে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে সে উতাং…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *