প্রেতপুরী

প্রেতপুরী

সূর্যাস্তের পর শ্রাবণের বৃষ্টি আরো চাপিয়া আসিয়াছিল। আমরা কয়জনে ক্লাবের একটা ঘরে জড়সড় হইয়া বসিয়াছিলাম। আলোটা টেবিলের উপর নিস্তেজভাবে জ্বলিতেছিল। এমন সময় ছাতা মাথায় দিয়া প্রায় ভিজিতে ভিজিতে বরদা আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাদের মধ্যে একজন তাহাকে সম্ভাষণ করিল, আয়াহি বরদাবাবু!

বরদা ছাতাটা মুড়িয়া এককোণে দাঁড় করাইয়া দিয়া কোঁচা দিয়া মাথা মুছিতে মুছিতে একটা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিল। একটি দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, ‘এ ভরা বাদর মাহ “শাঙন” শূন্য মন্দির মোর। গিন্নী বুঝে-সুঝে আজই বাপের বাড়ি গেলেন।’

অমূল্য এককোণে গুড়িসুড়ি পাকাইয়া বসিয়াছিল; বলিল, ‘তাই আমাদের জ্বালাতে এসেছ?’

বরদা ওদিকে কর্ণপাত না করিয়া বলিল, ‘বাড়িটা ভারি ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকতে লাগল, তাই—’

মিনিট দুই নীরব থাকিয়া বুক-পকেটের ভিতর হইতে সিগারেটের বাক্স বাহির করিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, ‘আজকের বৃষ্টি দেখে একটা পুরনো গল্প মনে পড়ছে—’

‘এই সারলে!’ অমূল্য উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘একটু যে নিশ্চিন্দি হয়ে ক্লাবে বসব তার যো নেই। আমি বাড়ি চললুম; হৃষী, তোমার ছাতাটা যদি দাও—’

হৃষী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘উহুঁ, আমাকেও তো বাড়ি যেতে হবে। বৃষ্টি আজ রাত্রে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।’

অমূল্য ব্যাকুলচক্ষে ঘরের চারিদিকে একবার তাকাইয়া দেখিল, কিন্তু ছাতার স্বত্বাধিকারী কাহারও মুখে করুণার কণামাত্র না দেখিয়া হতাশভাবে আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িল।

পৃথ্বী জোরে হাসিয়া উঠিল, ‘অমূল্য, কপালে লিখিতং ঝাঁটা, কোন শালা কিং করিষ্যতি। বরদার গল্পটা শুনেই যাও।’

অমূল্য জবাব দিল না।

বরদা আরম্ভ করিল:

বছর কয়েক আগেকার কথা। সেবারও এমনি নিদারুণ বর্ষা; ভাসছে বিলখাল, ভাসছে বিলকুল, ঝাপসা ঝাপটায় হাসছে জুঁইফুল। আমার মাসতুতো ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছি।

দাদা বিয়ে করলেন বাংলাদেশের এক অতি পুরনো পচা পাড়াগাঁয়ে। আমাদের কারুর মত ছিল না কিন্তু প্রজাপতি শুনলেন না, অগত্যা সেইখানেই যেতে হল।

একে পল্লীগ্রাম, তায় বর্ষাকাল। সে-দৃশ্য বর্ণনা করা আমার সাধ্য নয়। সুবিধের মধ্যে রেলের স্টেশন ক্রোশখানেকের মধ্যেই ছিল।

স্টেশনে নেমে সকলে পদব্রজে কনের বাড়ির দিকে যাত্রা করলুম; কারণ, জানা গেল যে মধ্যে একটা পুল ভেঙে গিয়ে পথ গরুর-গাড়ির পক্ষেও দুর্গম হয়ে উঠেছে। পুরোহিত ন্যায়রত্ন মশায় সঙ্গে ছিলেন, কাদার মধ্যে তাঁর একপাটি খড়ম অন্তর্হিত হল দেখে আমরা আপন আপন জুতো খুলে বগলে নিলুম। তারপর অনেক বাধা-বিঘ্নের ফাঁড়া কাটিয়ে যখন মেয়ের বাড়ি উপস্থিত হলুম, তখন বর থেকে নাপিত পর্যন্ত কাউকে চেনা গেল না। কেবল, মেসোমশায় গোঁফ থেকে কাদা নিঙড়োতে নিঙড়োতে কাকে খিঁচোচ্ছিলেন, গলার আওয়াজে তাঁকে ধরে ফেললুম।

এই একক্রোশ পথ পায়েসের মতো কাদার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেশ পরিশ্রম হয়েছিল। তাই কন্যাপক্ষ যখন মুগের ডালের খিচুড়ি আর হাঁসের ডিম ভাজা দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, তখন কিছু অতিরিক্ত মাত্রায় খেয়ে ফেললুম।

আহারান্তে কিন্তু বড় কষ্ট পেতে হল। আমরা সংখ্যায় বরযাত্রী প্রায় কুড়িজন ছিলাম। যে ঘরটিতে আমাদের বিশ্রাম করতে দেয়া হল, তাতে শোয়া নয়, ঠাসাঠাসি করে কোনরকমে কুড়িজন বসতে পারে। গুরুভোজনের পর সকলের মনেই একটু গড়াবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা আর ঘটে উঠল না। শুধু শীর্ণদেহ ন্যায়রত্ন মশায় কোনমতে একটা কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লেন।

আর সকলে পান-তামাক খেয়ে গল্প-গুজবে সময় কাটাতে লাগল, একদিকে জনকয়েক ছোকরা তাস নিয়ে বসে গেল; আমার কিন্তু বড় বিরক্তি বোধ হতে লাগল। জানলার ধারে বসে মন-খারাপ করে ভাবতে লাগলুম— দিনের বেলা তো যা হোক হল, রাত্রেও কি ঐ ব্যবস্থা নাকি?

গোধূলি-লগ্নে বিয়ে, সুতরাং রাত্রে ঘুমোবার কোন বাধা নেই। দাদা না হয় বাসরঘর আলো করে শ্যালী আর দিদিশাশুড়ির সঙ্গে রসিকতা করে রাত কাটাবেন, কিন্তু সেজন্যে আমার সারারাত জেগে পাহারা দেবার তো কোন দরকার নেই। তাই বাড়ির একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, রাত্রে শোবার ব্যবস্থা কি রকম?

তিনি বললেন, পাড়াগাঁয়ে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না, অতিকষ্টে এই বাড়িটি সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আর একটি ঘরে জিনিসপত্র আছে, রাত্রে খালি করে দেয়া হবে।

শুনে বড় ভরসা হল না, কুড়িজনের শোবার জন্য মাত্র দুটি ঘর! অন্যমনস্কভাবে বাইরের অবিশ্রাম বারিধারার দিকে চেয়ে চেয়ে কিছুদূরে একটি অন্ধকারদর্শন ছোট পাকা বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়িতে কেউ আছে বলে বোধ হয় না, দরজা-জানলাগুলো সব বন্ধ। আগে বোধ হয় বাড়িখানার হলদে রঙ ছিল, এখন সবুজবর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালের স্থানে স্থানে চুন-বালি খসে গিয়ে ঘায়ের মতো দেখাচ্ছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ও বাড়িটি কার?

ভদ্রলোকটি হেসে বললেন, আপাতত ভূতের।

একটু বিস্মিত হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে তিনি যা বললেন তার মর্ম এই: কিছুকাল পূর্বে ঐ বাড়িটি এক ভদ্রলোকের ছিল, অবশ্য তাঁর নিজের তৈরি নয়, পৈতৃক-সম্পত্তি। তিনি গ্রাম থেকে ক্রোশ দুই দূরে জমিদারের কাছারিতে পনেরো টাকা বেতনে গোমস্তা ছিলেন। সংসারে কেবল স্ত্রী আর এক মেয়ে ছিল। বাবুটি মদ খেতেন, অনেক সময় মাতাল হয়ে স্ত্রীকে প্রহারাদি করতেন, কিন্তু মেয়েটি তাঁর বড় আদরের ছিল। জীবনে একবার ছাড়া আর কখনো তার গায়ে হাত তোলেননি।

তাঁর স্ত্রী সতীসাধ্বী ছিলেন, তাই বছর তিনেক আগে তিনি একদিন স্বর্গে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে স্বামীর প্রাণে দারুণ আঘাত লাগল। এই আঘাত সত্যি কি ভণ্ডামী বলা যায় না– কিন্তু তাঁর মাতলামি ভারি বেড়ে উঠল। একদিন তিনি জমিদারের নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া করে তার গালে একটি চপেটাঘাত করে বাড়ি ফিরে এলেন। পরদিন সকালে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না, তার বদলে তাঁর ছ’বছরের মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেল। পুলিস তাঁকেই কন্যাঘাতী বলে সন্দেহ করে; কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর কোন সন্ধান পায়নি।

মাঝে মাঝে কানাঘুষো শোনা যায় যে, তিনি কাছেপিঠেই কোথাও লুকিয়ে আছেন; গ্রামের কেউ কেউ তাঁকে অন্ধকার রাত্রে মাঠে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে… কিন্তু সেসব গুজব নিতান্তই বাজে কথা। বাড়িখানা সেই অবধি খালি পড়ে আছে, কেউ ব্যবহার করে না। গ্রামের দু’-একজন সাহসী লোক একবার রাত্রে ঐ বাড়িতে শোবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেইরাত্রেই ভয় পেয়ে পালিয়ে আসে— তারা বলে বাড়িতে ভূত আছে।

গল্পটার শেষ শুনে বললুম, আমরা কয়েকজন যদি রাত্রে ওখানে শুই, কারুর আপত্তি হবে কি?

ভদ্রলোকটি বললেন, না মশায়, আমাদের সাহস হয় না।

আমি বললুম, আমাদের যদি সাহস হয়, তাহলে আপনাদের হতেই বা বাধা কি? আর সকলের দিকে ফিরে বললুম, ওহে, তোমরা কেউ ভূতের বাড়িতে শুতে রাজী আছো?

সকলেই ব্যাপার কি জানতে চাইলে— কিন্তু সমস্ত শুনে, আমার মতো দু’-তিনজন ছাড়া আর কেউ রাজী হল না। যা হোক, সন্ধ্যার আগে বৃষ্টি একটু ধরেছে— আমরা বাড়িখানা দেখতে গেলুম। বাড়িতে তালা লাগানো ছিল— সেই ভদ্রলোকটি তার চাবি জোগাড় করে আনলেন।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই ভিতরকার বদ্ধ অন্ধকার যেন বন্যজন্তুর মতো আমাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। স্যাঁতসেঁতে ভিজা একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। তাড়াতাড়ি পাশের একটা জানলা খুলে দিতেই বাইরের মলিন আলো ম্রিয়মাণভাবে ঘরে ঢুকল। দেখলুম, মেঝের ওপর প্রায় এক ইঞ্চি পুরু ধুলো পড়েছে— কোণে কোণে ঝুল আর মাকড়সার জাল। মোটের ওপর যতদূর নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।

বাড়িতে মাত্র দুটি ঘর, তার মধ্যে একটি শয়নকক্ষ। আসবাবের মধ্যে একটি পুরনো কীটদষ্ট খাট আর তার মাথার কাছে একটি কপাটযুক্ত দেওয়াল-আলমারি। ঘরটি নেহাত ছোট নয়, খিড়কির দিকে একটা জানলাও আছে।

দেখে-শুনে সঙ্গীদের মধ্যে একজন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, না হে, আজ রাত্রে আর শোবার দরকার হবে না, তাস-পাশা খেলে কাটিয়ে দেয়া যাবে। কাজ কি বাবা!

ভদ্রলোকটি সঙ্গে ছিলেন, তিনি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আমি বললুম, বেশ, তোমরা তাস-পাশাই খেলো, আমার কিন্তু না ঘুমোলে চলে না।

ভদ্রলোকটিকে বললুম, আপনি দয়া করে একটা চাকর পাঠিয়ে দেবেন, ঘরটা ঝাঁট দিয়ে বিছানা করে দেবে।

ভদ্রলোকটি এবং সঙ্গীরা ক্ষীণভাবে একবার বাধা দিলেন, কিন্তু আমার জিদ চেপে গেছে দেখে আর কিছু বললেন না।

রাত্রে শুভকর্ম যথাসময়ে শেষ হয়ে গেল। সাড়ে দশটার পর খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে লণ্ঠন হাতে একলা শুতে গেলুম। সন্ধ্যার পর আবার বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল; এখনও সমভাবে চলেছে।

বাড়িতে ঢুকে ভিতর থেকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলুম, তারপর লণ্ঠন হাতে শোবার ঘরে গেলুম। চাকর বিছানা পেতে মশারি ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, খিড়কির দিকে জানলাটা পূর্ববৎ বন্ধই ছিল। আলো ধরে ঘরখানাকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম।

ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতেই ঘরটা অত্যন্ত নিস্তব্ধ বোধ হতে লাগল, বায়ু অভাবে একটু গরমও বোধ হল। জানলাটা ধরে দু’-তিনবার টানাটানি করবার পর সেটা খুলে গেল, তখন আবার ব্যাঙ ও ঝিঁঝি-পোকার কনসার্ট শুনতে পেলুম।

জানলা খুলে ফিরে আসতে পাশে দেয়াল-আলমারিটা পড়ে; কৌতূহল হল, সেটাকেও খুলতে গেলুম— দেখি, মরচে পড়ে সেটাও এঁটে গেছে। জোরে এক টান মারতেই ঝন্‌ঝন্‌ শব্দে খুলে গেল। ভেতরে দরকারী জিনিস কিছুই নেই, কেবল গোটা পাঁচ-ছয় খালি মদের বোতল গৃহস্বামীর সুরাসক্তির ঐতিহাসিক স্তম্ভের মতো ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে।

শরীর বেশ ক্লান্ত হয়েছিল, তাই আলোটা কমিয়ে খাটের পায়ার কাছে রেখে শুয়ে পড়লুম। শুয়ে শুয়ে রবিবাবুর একটা গল্প বারবার মনে পড়তে লাগল, দু’-একবার গায়ে কাঁটাও দিলে। কিন্তু বেশি ক্লান্ত হয়েছিলুম বলেই হোক বা ভয় বস্তুটা আমার শরীরে কম আছে বলেই হোক, এই ভূতুড়ে বাড়িতে একলা শুয়েও অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লুম।

রাত্রি বোধ করি তখন দুটো কি আড়াইটে হবে, হঠাৎ কানের খুব কাছে একটা ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ শুনে একেবারে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলুম। দেখি দেয়াল-আলমারি থেকে শব্দটা আসছে।

নিমেষের মধ্যে দারুণ ভয়ে আমার সমস্ত যুক্তি-তর্ক-বুদ্ধি-বিবেচনা একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। এই শব্দটার যে কোন স্বাভাবিক কারণ থাকতে পারে, সেকথা আমার মনের ধার ঘেঁষেও গেল না। সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করতে লাগলুম, সেই শূন্য মদের বোতলগুলো সজীব হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কপাটে ঘা দিচ্ছে। সে-শব্দ আর থামে না। নিশাচর প্রেতযোনির এই নিশীথ উল্লাস ঝন্‌ঝন্‌ শব্দে সমভাবে সমব্যবধানে চলতেই লাগল। আমি মশারির মধ্যে একটা বালিশ আঁকড়ে ধরে কাঠ হয়ে বসে রইলুম।

আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ, বাইরে অজস্র বারিপাত— ভিতরে অশরীরীর নৃত্য! আমি আর বিছানার মধ্যে থাকতে পারলুম না, মশারি ছিঁড়ে বাইরে এসে পড়লুম। আলোটা বাড়িয়ে দিতেই ঘরের নিরাভরণ শূন্যতা যেন। আমার চারদিকে দাঁত বার করে হেসে উঠল। অন্ধকার এর চেয়ে ছিল ভাল। মনে হতে লাগল ঐ বোতলগুলো এখনি নাচতে নাচতে আলমারি থেকে বেরিয়ে আসবে। এবং তারপর যে কি কাণ্ড শুরু হবে তা আমার বিধ্বস্ত মস্তিষ্ক দিয়ে কল্পনা করতে পারলুম না।

আমি ছুটে জানলার কাছে গিয়ে সজোরে গরাদ চেপে ধরলুম।

ঠিক এই সময় আকাশের মাঝখানে বিদ্যুৎ চমকালো।

বাইরের সমস্ত দৃশ্যটা এক মুহূর্তে চোখের ওপর মুদ্রিত হয়ে গেল। জানলা থেকে হাত পঁচিশেক দূরে একটা প্রকাণ্ড গাছ ছিল— নিম কিংবা তেঁতুল ঠিক ধরা গেল না— সেই গাছের গোড়ায় একটা ভীষণাকৃতি লোক কোদাল দিয়ে প্রাণপণে কোপাচ্ছে। সর্বাঙ্গ বেয়ে জল পড়ছে, পরনে কাপড় আছে কি উলঙ্গ, ঠিক ধরা গেল না।

কৌতূহলে ভয় অনেকটা চাপা পড়ে গেল। আমি আর একবার বিদ্যুতের আশায় বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলুম।

আবার বিদ্যুৎ! দেখলুম ক্লান্তি নেই, বিশ্রাম নেই, বৃষ্টির দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, লোকটা সমভাবে গাছের গোড়ায় কোদাল চালাচ্ছে, আর সেই কোদালের তালে তালে ঘরের মধ্যে আলমারির ভিতর থেকে শব্দ আসছে— ঝন্‌ঝন্‌, ঝন্‌ঝন্‌। আমার ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল— একবার ভাবলুম ডাকি, কিন্তু যদি চোর হয়! কিংবা হয়তো পাগল!

কোন কিছু স্থির করবার আগেই না বুঝে-সুঝে লণ্ঠনটা জানলার সুমুখে তুলে ধরলুম। বাইরের লোকটাকে সে-আলোতে দেখা গেল না। কিন্তু হঠাৎ আলমারির ঝন্‌ঝনানি বন্ধ হয়ে গেল। শব্দটা এতক্ষণ সয়ে গিয়েছিল, থামতেই বুকের ভিতরটা ধড়াস্ করে উঠল। আবার থামে কেন?

শব্দ থামতেই দেয়াল-আলমারির দিকে তাকিয়ে ছিলুম, সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জানলার দিকে চাইতেই ভয়ে আমার গায়ের রক্ত প্রায় জল হয়ে গেল। লণ্ঠনের ঘোলাটে আলোতে দেখলুম, ঠিক জানলার ওপারে একটা মস্ত ঝাঁকড়া মাথা, আর তারই ভিতর থেকে দুটো বড় বড় লাল চোখ আমার মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে।

আমার হাঁটু দুটো এবং গলার আওয়াজ তখন একেবারে শাসনের বাইরে চলে গেছে। চেঁচামেচি কিংবা পলায়ন দুই সমান অসম্ভব। তাই কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কেবল ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপতে লাগলুম।

হঠাৎ বাঘের থাবার মতো একজোড়া হাত বাইরের অন্ধকার থেকে উঠে এসে জানলার দুটো গরাদ ধরে টান দিলে। জানলার ঘুণধরা পচা কাঠ অকস্মাৎ ভেঙে গিয়ে গরাদ দুটো বার হয়ে গেল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্লেদাক্ত গিরগিটির মতো সেই ফাঁক দিয়ে লোকটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমার দিকে কট্‌মট্‌ করে তাকিয়ে বললে, তুমি কে?

নিজের নামটা পর্যন্ত সাফ ভুলে গিয়েছিলুম, তাই উত্তর দেওয়া হয়ে উঠল না। লোকটা নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর তার মাথার চুলগুলো শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল। সে ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠল, তুমি পুলিস!

আমি প্রবল বেগে ঘাড় নেড়ে জানালুম যে আমি পুলিস নই।

আশ্চর্য, লোকটা তখনই অকপটে তাই বিশ্বাস করে মাটিতে বসে পড়ল। কোমরে একটা শতচ্ছিন্ন ন্যাকড়া জড়ানো ছিল মাত্র। একবার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বললে, তিন মাস মদ খাইনি। বুক ফেটে যাচ্ছে। আমাকে একটু মদ দিতে পারো? বেশি নয়, একটি গ্লাস!

এমন বুকফাটা মিনতি আর কখনো শুনেছি বলে মনে হয় না। বোধ হল, মদের দুর্নিবার পিপাসা লোকটাকে পাগল করে দিয়েছে। একটা সন্দেহ গোড়া থেকেই আমার মনে উঁকি মারছিল; আমি বললুম, মদ তো নেই, কিন্তু আপনিই কি—?

লোকটা দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, শেষে মাথা তুলে বললে, এই বাড়ির মালিক আমি, নিজের মেয়েকে খুন করে পালিয়ে যাই। গোমস্তাগিরি করতুম, একদিন ঝগড়া করে চলে এলুম। তখন স্ত্রী বেঁচে নেই— শুধু মেয়ে। বাড়ি আসতেই মেয়েটা বললে, বাবা, খেলা করতে করতে পায়ের মল গাছতলায় কোথায় পুঁতে রেখেছিলুম, আর খুঁজে পাচ্ছি না।— মাথায় রাগ চড়েই ছিল, মারলুম মেয়েটার রগে এক চড়, মেয়েটা সেইখানে পড়েই মরে গেল।… সেই থেকে পুলিসের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।— মেয়েটা মরেছে— যাকগে! কিন্তু তার মল ক’গাছা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।

এই বলে লোকটা লাফিয়ে উঠে একবার আলমারির দিকে ছুটে গেল। খালি বোতলগুলো পেড়ে পেড়ে মাটিতে আছড়ে ভাঙতে লাগল। তারপর উন্মত্ত একটা চিৎকার করে, যে-পথে এসেছিল সেই পথেই বেরিয়ে গেল। মিনিট দুই ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। তারপর আলমারির কাচের কপাট দুটো সজোরে শব্দ করে উঠল—ঝন্ ঝন্ ঝন্!

বরদা নীরব রইল।

অমূল্য শ্লেষ করিয়া বলিল, ‘ব্যাস, এই গল্প? খালি ঝন্ ঝন্ ঝন্!’

বরদা বলিল, ‘আর একটু বাকি আছে। শেষ রাত্রে একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ চমক ভেঙে গেল। দেখলুম ঘর একেবারে অন্ধকার, আলোটা কখন নিভে গেছে।

‘অনেকক্ষণ কান খাড়া করে শুয়ে রইলুম। কিন্তু খোলা জানলা দিয়ে ঝিঁঝির শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে এলো না। শেষ রাত্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লুম।

‘সকালবেলা উঠে দেখি, বালিশের তলা থেকে সোনার ঘড়ি আর মনিব্যাগটা চুরি গেছে।’

১৯১৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *