প্রীতি-উপহার

প্রীতিউপহার

বাসায় হঠাৎ এক পালকি উপস্থিত। সুন্দর করে সাজানো কাগজের রঙিন পালকি। পালকির দরজা খুলে দাওয়াতের চিঠি উদ্ধার করলাম, অমুক আপুর গায়েহলুদ। আপনি সবাইকে নিয়ে আসবেন। ইত্যাদি।

সবকিছু বদলে দেবার জন্যে চারদিকে ভালো হৈচৈ শুরু হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকেও দেখলাম নিজেকে বদলানোর জন্যে কাগজপত্রে দস্তখত করছেন। লোকমুখে শুনেছি তার বাসার কাজের ছেলেকে তিনি এখন দুবেলা পড়ান। কাজের ছেলে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যাবার ধান্দায় আছে। তাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। গ্রাজুয়েট হয়ে বের হবে, তার আগে না।

দেশ অবশ্যি নিজের নিয়মেই বদলাচ্ছে। পালকির ভেতরে নিমন্ত্রণপত্র তার প্রমাণ। নিমন্ত্রণের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান পাল্টাচ্ছে। আমার ছোট ভাই আহসান হাবীবের কাছে শুনলাম, সে মাথায় টুপি পরে কোনো এক কুলখানিতে গিয়েছিল। সেখানে মিলাদের পরিবর্তে হঠাৎ করে মৃত ব্যক্তির প্রিয় গানের আসর বসল। আহসান হাবীব চট করে টুপি পাঞ্জাবির পকেটে লুকিয়ে ফেলল এবং গানের তালে তালে মাথা দোলাতে লাগল। আহসান হাবীব যেহেতু উন্মাদ নামক পত্রিকা চালায়, তার সব কথা বিশ্বাসযোগ্য না।

বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান কীভাবে বদলাচ্ছে সেই নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করি।

আমার শৈশবে বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অনুসঙ্গ ছিল প্রীতি-উপহার নামক এক যন্ত্রণা। কেন যন্ত্রণা বলছি তা ব্যাখ্যা করব, তবে তার আগে প্রীতি-উপহার বিষয়ে বলি। বর-কনেকে আশীর্বাদ এবং বরণসূচক ছড়ার সংকলনই প্রীতি-উপহার। সস্তা কোনো প্রেস থেকে এই জিনিস ছাপা হয়ে আসত। শুরুতে ছবি–মেহেদিপরা একটা হাত পুরুষের গরিলাটাইপ রোমশ হাতকে হ্যান্ডসেক করছে। কিংবা একটি কিশোরী পরী ফুলের মালা হাতে আকাশে উড়ছে। প্রীতি-উপহালের শুরুটা হয় এইভাবে–

দোয়া মাগি তোমার হাতে ওগো দয়াময়
 দুইটি প্রাণের মিলন যেন পরম সুখের হয়।

এখন বলি কেন প্রীতি-উপহারকে আমি যন্ত্রণা বলছি। আমার বাবা তাঁর সমস্ত আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে প্রীতি-উপহার দেয়া অবশ্যকর্তব্য মনে করতেন। রাত জেগে নিজেই লিখতেন। বিয়ের আসরে এই কাব্য আমাকেই পাঠ করে শুনাতে হতো। পাঠ শেষে জনে জনে তা বিলি করা হতো। তারপর আমাকে প্রীতি উপহার নিয়ে পাঠানো হলো মেয়েমহলে। কনেকে ঘিরে থাকত তার বান্ধবীরা। তারা তখন আমাকে নিয়ে নানান রঙ্গ-রসিকতা করত। আমি যথেষ্ট আবেগ দিয়ে প্রীতি-উপহার পড়ছি, এর মধ্যে কেউ একজন বলে বসল, এই বান্দর, চুপ কর। মেয়েরা সবাই হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়। আমি চোখ মুছতে মুছতে বিয়ের আসরে ফিরতাম।

এখনকার পাঠকরা কোট যেন ভুলেও মনে না করেন, প্রীতি-উপহার কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। আমাদের এক আত্মীয়ার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, কারণ বরপক্ষ প্রীতি-উপহার আনে নি।

আরেকবার বরপক্ষের সঙ্গে কনেপক্ষের হাতাহাতি শুরু হলো। কারণ প্রীতি উপহারে কনের বাবার নাম সালামের জায়গায় ছাপার ভুল লেখা হয়েছে শালাম। কনেপক্ষের ধারণা, ইচ্ছাকৃতভাবে কনের বাবাকে শালা ডাকা হয়েছে।

কবি শামসুর রাহমানের বিয়েতে প্রীতি-উপহার ছাপা হয়েছিল এবং দেশের কবিরা সবাই সেখানে লিখেছেন। এই তথ্য কি জানা আছে? যে সংকলনটি বের হয় তার নাম কবি শামসুর রাহমানই পেল। নাম ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন তাঁর প্রেসে ছেপে দেন। [সূত্র: বাংলাদেশের বিবাহ সাহিত্য। আবদুল গাফফার চৌধুরী।]

প্রাচীনকালে বিয়ে কীভাবে হতো তা বললে পরিষ্কার বুঝা যাবে আমরা কতটা বদলেছি। বৈদিক যুগে কোনো তরুণীর বিয়ে একজনের সঙ্গে হতো না। তার সমস্ত ভাইদের সঙ্গে হতো। ঋগ্বেদে এবং অথর্ববেদে এমন কিছু শ্লোক আছে যা থেকে বুঝা যায় বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনের অধিকার কনিষ্ঠ ভাইদেরও থাকত। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর ছোট ভাইকে বলা হয়েছে দেবৃ অর্থাৎ দেবর। দ্বিতীয় বর।

বেদের জ্ঞাতিত্ববাচক কয়েকটি শব্দ থেকে পরিক্ষার বুঝা যায় যে, স্ত্রীলোকের অনেক স্বামী থাকত।

এর কারণও কিন্তু আছে। আর্যরা যখন এই দেশে ঢুকল, এখন তাদের সঙ্গে মেয়ের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আর্যরা দেশি কৃষ্ণ রমণীদের প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে দেখত। কাজেই তাদের সঙ্গে করে আনা মেয়েদের ভাগাভাগি করে গ্রহণ করা ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প ছিল না। [সূত্র: ভারতের বিবাহের ইতিহাস। অতুল সুর।]

রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের বইতে পড়েছি, তিব্বতে সব ভাইরা মিলে একজন তরুণীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করত। তিব্বতে মেয়ের সংখ্যা কম না, তারপরও এই অদ্ভুত নিয়মের কারণ হলো তিব্বতে জমির খুব অভাব। সব ভাই যদি আলাদা হয়ে সংসার শুরু করে, তাহলে জমি ভাগাভাগি হয়ে কিছুই থাকবে না। তিব্বতে যেসব মেয়ের বিয়ে হবে না তাদের গতি কী হবে? তারা মন্দিরের সেবাদাসী হবে। অর্থাৎ বেশ্যাবৃত্তি করবে। একবার মন্দিরের দেবতার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলে অন্য পুরুষদের সঙ্গে আনন্দ করতে বাধা নেই।

কী ভয়ঙ্কর!

DFP থেকে প্রকাশিত সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় বিয়ের রীতিনীতি এবং ইতিহাস নিয়ে অনেকগুলি লেখা ছাপা হয়েছে। আমি পড়ে খুবই আনন্দ পেয়েছি। কৌতূহলী পাঠক সংখ্যাটি সংগ্রহ করে পড়লে আনন্দ পাবেন। সেখান থেকে উকিল বাপ বিষয়ে লেখাটি তুলে দিচ্ছি।

ইসলামি শরিয়ত

উকিল বাপ প্রসঙ্গ

আমাদের দেশে মুসলিম রীতির বিয়েতে ‘উকিল বাপ’ পদবিধারী একজন ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। যারা বিয়েতে মেয়ের কাছ থেকে অনুমতি আনে এবং বিয়ের মজলিশে এসে মেয়ের সম্মতির কথা জানায়। এই উকিল বাপকে এতই গুরুত্ব দেয়া হয় যে, এটা না হলে বিবাহ হবে না বলে মনে করা হয় এবং পরবর্তীতে এই উকিল বাবাকে মেয়েরা নিজের বাবার মতো শ্রদ্ধা করে থাকে। তার নাম বিয়ের রেজিস্ট্রেশন ফরমেও তোলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই উকিল বাপ ব্যক্তিটি এমন একজন ব্যক্তি হয়ে থাকেন যার সাথে পিত্রতুল্য সম্পর্ক হওয়া সম্ভব নয় বা মেয়ের সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ জায়েজ নয়। পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মেয়েরা পদবি বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন মনে করে না। এতে করে উভয়েই গোনাগার হয়ে থাকেন। মুসলিম রীতির বিয়েতে উকিল বাপ পদবিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রচলিত হলেও বিষয়টি শরীয়তবিরোধী একটি প্রথা। কারণ শরীয়তে উকিল বাপের কোনো ধারণা নেই।

ইসলাম ধর্ম মতে, প্রতিটি মেয়ের জন্য পর্দা করা ফরজ হওয়ায় উকিল বাপ সম্পর্কটি হারাম বলে বিবেচিত হয়। মেয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার জন্য তৃতীয় পক্ষ উকিল বাপের চেয়ে তার বাবা অথবা ভাইয়ের এ দায়িত্ব পালন করাই শ্রেয়।

[উপরিউক্ত ফতোয়া সংগ্রহ করা হয়েছে মুফতি মানসুরুল হকঃ ইসলামি বিবাহ, রাহমানিয়া পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৮-১৯।]

.

আমি অনেক মেয়ের উকিল বাপ হয়েছি। এখন ঠিক করেছি আর না। উকিল দাদু হবার বিধান থাকলে অবশ্যি সেকেন্ড থট দেব।

একটি সংশোধনী

বিয়ের গান হিসেবে লীলাবালি লীলাবালি গানটি প্রায়ই গীত হয়। আমাদের ছবি দুই দুয়ারীতেও গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। গানটি গাওয়া হয়—

লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই পো
কী দিয়া সাজাইমু তোরে?

গানের কথায় ভুল আচ্ছ। বড় যুবতী হবে না, হবে বর অযুবাতি। এর অর্থ–বর আসছে।

আমার ভুলের কারণে এখন অন্যরাও ভুল করছেন। শেষে দেখা যাবে। ভুলটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আদি ভুলের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *