প্রিয় হক ভাই
হক ভাইকে প্রথম দেখি বাংলা একাডেমীতে। তখন তার মাথায় চুল ছিল, হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কাকে যেন কী বলছেন। আমি পেছনের দিকে রয়েছি, কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না। ইন্টারেস্টিং কিছু হবে–এই ভেবে কাছে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, হক ভাই বইয়ের ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দে জটিল সব বাক্য তৈরী করে রাগ ঝাড়ছেন। আমার মনে হলো, মানুষটা তো বেশ। রাগের সময়ও কথা ঠিক রাখছেন।
তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও ভাসা ভাসা পরিচয়। সমস্যাটা আমার–আমি চট করে সহজ হতে পারি না। আরে হক ভাই, এতোদিন কোথায় ছিলেন? বলে গায়ের উপর পড়ে যাওয়া আমার স্বভাবে নেই। সমস্যা কিছুটা হক ভাইয়েরও কথাবার্তা বলার সময় তিনি দূরত্ব তৈরি করে এমন ভাষা ব্যবহার করেন।
যাই হোক, প্রথম পরিচয়েই আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি তার রচনার ভক্ত পাঠক। আমার এই কথায় তিনি তেমন উল্লসিত হননি। শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা।
এতে আমি খানিকটা আহত হলাম। আমার মনে হলো, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কাজেই তার প্রচুর লেখা যে আমার পড়া সেই প্রমাণ দেবার চেষ্টা করলাম। এতেও তার তেমন উৎসাহ দেখলাম না। নিজের রচনা সম্পর্কে আলোচনা শুনতে সবাই উৎসাহী হয়, এ মানুষটা হচ্ছেন না কেন? না কি তিনি শুধু আমার প্রতিই এ ধরনের আচরণ করলেন? এই রহস্য এখনো ভেদ হয়নি।
আমি আমার অনেক লেখায় অনেক ইন্টারভ্যুতে বলেছি–সৈয়দ হক আমার প্রিয় লেখক। এ দেশের প্রধান ঔপন্যাসিক আমার মতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নন–সৈয়দ শামসুল হক। নানান কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমালোচকদের সুনজর পেয়েছেন–হক ভাইয়ের ভাগ্যে তা তেমন জোটেনি, বরং অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ টাইপদের কাছ থেকে পর্ণোগ্রাফিক লেখক আখ্যা পেয়েছেন। এই অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল না।
একজন বড়ো লেখকমাত্রই তার লক্ষ্য ঠিক করে নেন। তারপর সেই লক্ষ্যের দিকে খুব সাবধানে এগুতে থাকেন। অনেকটা বিড়ালের নিঃশব্দ যাত্রার মতো। পাঠক বুঝতেও পারেন না লেখক তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। যখন বুঝতে পারেন তখন আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। হক ভাই এই কাজটি অসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে করেন। একজন বড়ো লেখক চারপাশের জগৎ অগ্রাহ্য করে নিজের কল্পনার জগতে বাস করেন না। বড়ো লেখকের এসকেপিস্ট হওয়ার পথ নেই। হক ভাই এসকেপিস্টদের একজন না, তিনি কখনোই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। তার নিজের আনন্দের জন্য তিনি লেখেন না–পাঠকের আনন্দও তাঁর রচনার প্রধান বিষয় নয়…। তার রচনা পাঠ করে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন তাকে একটি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এই দায়িত্ব প্রিয় হোক অপ্রিয় হোক তাকে পালন করতেই হবে।
একজন বড়ো লেখককে মানুষ হিসেবেও বড়ো হতে হয়। হক ভাই মানুষ হিসেবে বড়ো কিনা আমি জানি না, তেমন ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে মেশার সুযোগ আমার হয়নি, তারপরেও দুটি ক্ষুদ্র ঘটনার উল্লেখ করছি–
কবি শামসুর রাহমান সাহেব তখন খুব অসুস্থ। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফুসফুসে পানি জমে গেছে। জীবন সঙ্কটাপন্ন। আমি দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছি। কবিকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন এলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি কবির কাছে দাঁড়ালেন। তার একটি হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর রাখলেন এবং বললেন, আমি সবার সামনে এই প্রার্থনা করছি–আমার আয়ুর বিনিময়ে হলেও আপনি যেন বেঁচে থাকেন।
বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি দেখলাম, সৈয়দ হক কাঁদছেন। আজ শুনতে পাই দুজনের সম্পর্কের খুব অবনতি হয়েছে। একে অন্যের নাম পর্যন্ত শুনতে পারেন না। তারপরেও আমি নিশ্চিত জানি, আবারো যদি কবি অসুস্থ হন–সৈয়দ হক ছুটে যাবেন এবং কবির রোগমুক্তি প্রার্থনা করবেন।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি–আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হলো। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। ভয়াবহ শারীরিক কষ্ট। হক ভাই কার কাছ থেকে আমার অসুখের খবর শুনলেন। শোনামাত্র ছুটে এলেন আমার বাসায়। বিছানায় আমার পাশে বসে কঠিন গলায় বললেন–হুমায়ূন, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে। তোমার হাতে ছয়টি আঙুল। এই ছটি আঙুলের একটি হলো কলম। ছআঙুলি মানুষের অসুস্থ হওয়া চলে না।
হক ভাইয়ের সুন্দর করে বলা এই বাক্য দুটি আমার অনেক সঞ্চয়ের একটি। মাঝে মাঝে সমালোচকদের কঠিন আক্রমণে যখন দিশেহারা হয়ে যাই তখন নিজের ডান হাত চোখের সামনে মেলে ধরে বলি–আমার হাতে ছটি আঙুল। ছ-আঙুলি মানুষদের দিশেহারা হলে চলে না।
ভোরের কাগজ হক ভাইয়ের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করছে শুনে খুব। ভালো লাগছে এই কারণে যে, আমি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।
হক ভাই, আপনি ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন–আপনার প্রতি এই আমার শুভ কামনা। আপনি অতি ভাগ্যবান। জীবন তার মঙ্গলময় হাতে আপনাকে স্পর্শ করেছে–এই বিরল সৌভাগ্য কজনের হয়?