প্রিয় পশু
আপনার রাশি কি?
আপনার প্রিয় রঙ কি?
আপনার প্রিয় ফুল কি?
এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব আমাকে প্রায়ই দিতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি–আপনার প্রিয় পশু কি? সম্ভবত প্রশ্নকর্তাদের মনে। কখনো আসেনি যে পশুরাও প্রিয় হতে পারে। গালি দেয়ার জন্যে পশু ব্যবহার করা হয়—পশু প্রিয় হবে কিভাবে! মানুষ ভয়ংকর কোন কাণ্ড করলে আমরা বলি—ব্যাটা নরপশু।
তারপরও সবারই বোধহয় প্রিয় পশু আছে। টিপু সুলতানের ছিল বাঘ, নিউটনের ছিল বিড়াল, যে বিড়াল জ্বলন্ত ল্যাম্প ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছিল প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামের বিখ্যাত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। আমাদের দেশের বিখ্যাত এক ব্যক্তির প্রিয় পশু বানর। মাসে অন্তত একবার তিনি চিড়িয়াখানায় যান এবং হা করে বানরের খাচার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। কে জানে মনে মনে হয়তো ভাবেন–বানর থেকে মানুষে বিবর্তন হওয়ার প্রয়োজনটা কি ছিল! বানর হয়ে গাছে গাছে জীবনটা পার করে দিতে পারলে জীবনটা কত সুখময় হত!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষকের ছিল। ছাগলপ্রীতি। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারেই ছাগল পুষতেন। একটা-দুটা না–গোটা সাতেক। রাতে ঘুমুতেন ছাগলের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য এই ঘটনা শুনে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন–এগুলি ছাগল না, পাঠা। আমার একটা অসুখ আছে। পাঠার গায়ের গন্ধে সেই অসুখ সারে বলে আমি রাতে তাদের সঙ্গে। ঘুমাই।
আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি করি না করি তা আমার ব্যাপার। ব্যক্তি-স্বাধীনতা আমার সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের… ধারার উপধারায়…।
আমি বললাম, তা তো বটেই। আপনি অবশ্যই পাঁঠাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন।
প্রিয় পাঠক, আমি এই গল্প রসিকতার জন্যে ফাঁদিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় খোঁজ নিলেই ঘটনার সত্যতা জানতে পারবেন।
পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই–এমন কোন পশু কি আছে যা গোটা মানব সম্প্রদায়ের প্রিয়? বা বড় একটি মানবগোষ্ঠীর প্রিয়? আমার ধারণা আছে–সেই পশুর নাম হাতি, যাকে দেখামাত্র একসঙ্গে বিস্ময়, ভয় এবং করুণায় মন কেমন কেমন করে ওঠে। বিস্ময় এবং ভয়ের কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। করুণ কেন হয়। বলি। করুণা হয়–বিশাল একটা প্রাণী মানুষের মত ক্ষুদ্র প্রাণীর হাতের পুতুল হয়ে ঘুরছে, এই কারণে। একটা পিপড়া ছাগলের গলায় দড়ি বেঁধে তাকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে–এই দৃশ্যে যে করুণ রস আছে, হাতি এবং মানুষের ব্যাপারে তেমন করুণ রস আছে।
আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাতি খুবই পরিচিত প্রাণী। এইত সেদিন ঢাকা শহরে এক বিয়েতে দেখলাম হাতিতে চেপে বর যাচ্ছে। বেচারার উচিত এক হাতে। রুমাল নিয়ে রুমালে মুখ চেপে ধরে রাখা। সে তা করছে না। ভয়ে অস্থির হয়ে দুহাত দিয়ে জাপটে সামনের মানুষটির কোমর ধরে আছে।
ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে হাতি দেখার সৌভাগ্য হল নানার বাড়িতে। আমার এক দূর-সম্পকের নানা চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। তার মার্কা হল হাতি। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে এক হাতি নিয়ে এলেন। হাতির পিঠে চড়ে তিনি প্রচার-অভিযানে বের হন–গ্রামের অর্ধেক মানুষ সেই হাতির পেছনে পেছনে যায়। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ভোট দিবেন কিসে? হাতী মার্কা বাক্সে। শুধুমাত্র হাতির কল্যাণে আমার সেই দূর-সম্পর্কের নানা ইলেকশনে পাশ করে ফেলেন। সেই ইলেকশনের হাতিতে আমি অনেকবার চড়েছি। হাতির পিঠে চড়া সম্পর্কে যা যা জেনেছি তা হচ্ছে–
হাতির পিঠে চড়া এবং নৌকায় চড় এক রকম। দুটোতেই দুলুনি আছে। একই রকম দুলুনি।
নাক ভর্তি সর্দি না থাকলে হাতির পিঠে চড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাতির গায়ে একশ হর্স পাওয়ারের বিকট গন্ধ।
হাতির গায়ের লোম সাধারণ লোমের মতো না–সুইয়ের মত শক্ত। লোমের পেছনে ফুটো থাকলে অনায়াসে গ্রামের মেয়েরা হাতির লোম দিয়ে কথা সেলাই করতে পারত।
শৈশবে বেশ কিছুদিন হাতির কাছাকাছি থাকার কারণে আমার ধারণা হয়েছিল–হাতি সম্পর্কে আমি একজন নলেজেবল ব্যক্তি। এই বিরাট পশু সম্পর্কে যা জানার সবই জেনে ফেলেছি। আরো যে অনেক কিছু জানার বাকি তা টের পেলাম এই সেদিন। ঘটনাটা বলি–ঈদের আনন্দমেলা অনুষ্ঠান। আমার উপর দায়িত্ব একটা ছোট্ট তিন-চার মিনিটের হাসির অংশ তৈরি করা। আমি হাতি দিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলাম। হাতির পিঠে চড়ে অয়োময়ের ছোট মীর্জা এবং তার লাঠিয়াল হানিফ এসেছে গাউছিয়ায় ঈদের বাজার করতে।
দুটা হাতি আনানো হল। প্রথমটায় ছোট মীর্জার লোকজন। দ্বিতীয়টায় লাঠিয়ালসহ ছোট মীর্জা। প্রচণ্ড রোদের ভেতর শুটিং চলছে। হঠাৎ ছোট মীর্জা আসাদুজ্জামান নূর এবং লাঠিয়াল মোজাম্মেল হোসেনের বিকট চিৎকার—ভিজিয়ে ফেলেছে। ভিজিয়ে ফেলেছে।
ব্যাপার বিচিত্র। হাতি কিছুক্ষণ পর পর তার শুড় মুখে ঢুকিয়ে এক ধরনের জলীয় পদার্থ টেনে এনে তার সারা গায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতির মাহুত বলল, গরমের সময় হাতি এইটা করে। পেটের ভেতর থেকে পানি এনে শরীর ভিজিয়ে দেয়।
শ্যুটিং এগুচ্ছে। মহাপরাক্রমশালী ছোট মীর্জা এবং তার ভয়ংকর লাঠিয়াল কিছুক্ষণ পর পর চেঁচাচ্ছে–সর্বনাশ! আবার ভিজিয়ে দিয়েছে। পেটের ভিতর থেকে হাতি কি টেনে এনে আমাদের ভিজাচ্ছে–আল্লাহ জানেন!
হাতিকে আমরা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে জানি। অথচ মূখের উপমা দেবার সময় বলি–হস্তীমুর্খ। ব্যাপারটা মজার না? হস্তীমুর্খ কেন বলা হয় আমি বের করেছি। আপনাদের ব্যাখ্যা করে বলি।
কিছুদিন আগে আমার একজন প্রকাশক সময় প্রকাশন-এর ফরিদ আহমেদ আমাকে বলল, হুমায়ূন ভাই! শ্রীমঙ্গলে দুটা ছোট ছোট হাতির বাচ্চা আছে। হাতির ব্যাপারে আপনার তো খুব আগ্রহ, দেখতে যাবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই যাব।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে চললাম হস্তী-শাবকের সন্ধানে। পাহাড় থেকে কাঠ কেটে নামানোর জন্যে সেখানে প্রচুর হাতি ব্যবহার করা হয়। হাতি বেচা-কেনাও হয়। একটি পরিণত বয়সের হাতির দাম পাঁচ লাখ টাকা। অল্পবয়সী হাতি তিন লাখ টাকায় পাওয়া যায়। কাঠ-টানা হাতিগুলি অমানুষিক পরিশ্রম করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ টানে। কোন বিশ্রাম নেই। এক দিনের পরিশ্রম বাবদ হাতির মালিক পান দুহাজার টাকা। দিনের পর দিন এই কাঠ টানা চলতে থাকে। প্রচণ্ড শক্তিধর এই প্রাণী ইচ্ছা। করলেই মাহুতকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে বনে ফিরে যেতে পারে–তা সে করে না। মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে–সে যদি মুর্খ না হয়–মুর্খ কে?
হাতির বাচ্চা দেখার জন্যে এক ভোরবেলা শ্রীমঙ্গল থেকে মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম। বাচ্চারা কমলা কিনে নিল হাতির বাচ্চাকে খাওয়াবে। সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা নেয়া হল। হাতির বাচ্চার গলা জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা হবে। আমার বাচ্চাদের উৎসাহের সীমা নেই।
হাতির বাচ্চা দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। ছোটখাট একটা হাতি। সামনের দুটা পা এবং পেছনের দুপা শিকল দিয়ে বেঁধে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। তার নড়াচড়ার শক্তি নেই। তার ঊড় নানান জায়গায় কাটা। রক্ত পড়ছে। চোখ ভেজা। সে নিঃশব্দে কঁদছে। জানা গেল, বাচ্চাকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে সে বন থেকে কাঠ টেনে আনতে পারে এই ট্রেনিং। আমি বললাম, এর বয়স কত?
মাহুত বলল, তিন বছর।
একে আপনারা মারছেন?
না মারলে শিখবে কিভাবে?
এভাবে টানা দিয়ে কতক্ষণ রাখা হয়?
মাঝে মাঝে দুদিন-তিনদিনও রাখা হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। হাতির ট্রেনিং বড়ই কঠিন।
তিন বছর বয়েসী হাতির বাচ্চা হুংকারের মত করল। মাহুত সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তার গুঁড়ে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড বাড়ি বসাল। আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছবি হল না, ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করা হল না। মানুষ হয়ে জন্মেছি, এই লজ্জা ও এই অপমান সহ্য করে মাথা নিচু করে ফিরে চলে এলাম। মনে মনে বললাম, জগতের। সমস্ত পশু, তোমরা আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানোর এই অপরাধ ক্ষমা করে দাও।