প্রিয় পপি
পপি যখন আমাদের বাড়িতে এল তখন তার বয়স তিন-চার মাস। আমার বয়স চোদ্দো বা পনেরো বছর। তখন আমরা আলিপুরদুয়ার জংশনে। রেল-শহরের শেষ প্রান্তে আমাদের বাংলো। তার পর ধু ধু সবুজ মাঠ আর ও-প্রান্তে দফাপুরের জঙ্গল।
বরাবর আমার কুকুর পোষার শখ। একেবারে গুড়গুড়ি বয়স থেকেই কুকুরছানা ঘেঁটে বড় হয়েছি। ময়মনসিংহের বাড়ি থেকেই দেখে আসছি, কুকুর, বেড়াল, কাক, বেজি, শালিখ, গরু, ঘোড়া আর হাতি আমাদের জীবনের অঙ্গীভূত। মনে রাখতে হবে, তখন ঘোড়ার গাড়িই ছিল সবেধন যানবাহন। হাতিতে সওয়ার হতে হত প্রায়ই।
বাবার বদলির চাকরি বলে আমাদের এক পরিযায়ী জীবন ছিল ছেলেবেলায়। সে বড় যন্ত্রণার জীবন। এক জায়গায় সবে থিতু হয়েছি, নতুন বন্ধুবান্ধব হয়েছে, অমনি বদলির হুকুম এল আর আমাদের ‘চলো মুসাফির, বাঁধো গাঁঠোরি’ অবস্থা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হত বন্ধুবান্ধব আর পোষা কুকুরদের ছেড়ে আসতে। সে সব অবশ্য নেড়ি কুকুর। তবু ভালবাসা তো ছিল। মায়ের কাছে কত বায়না করতাম, ‘ভুলুটাকেও নিয়ে যাই না মা।’ মা রাজি হত না। বলত, ‘গাড়িতে হেগেমুতে ছিষ্টি করবে বাবা। নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন করে কুকুর পুষিস’। আর সেটাই হত। কিন্তু পুষে কী লাভ! দু’দিন পর ফের স্থানত্যাগ এবং পোষ্যকে ছেড়ে আমার কষ্ট।
পপি দিশি নয়। আবার খুব বেশি বিদেশিও নয়। দেওয়ানজি নামে এক রেলকাকু ছিলেন। তাঁরই পোষা ভুটিয়া কুকুরের বাচ্চা। আমার কুকুরের খুব শখ দেখে একটা ছানা উপহার দিয়েছিলেন। ছোট্ট, রোমশ, তুলতুলে, ভারী সুন্দর। গায়ের রংটা ছিল ভুশকো মতো। অনেকটা শেয়ালের রং। তাকে মুহূর্তের মধ্যে ভালবেসে ফেললাম। সেও আমাকে। কোলে নিয়ে আদর করতাম, চান করাতাম, খাওয়াতাম। সেই ছানা বয়সেই সে আমার আধিপত্য মেনে নিয়েছিল। আমি যেখানে, সেও সেখানে। ঝুড়িতে বস্তা পেতে তার শোওয়ার জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসে চুপটি করে শুয়ে থাকত আমার খাটের নীচটিতে।
বাবার বদলির ধাক্কায় আমার পড়াশোনা শিকেয় ওঠার জোগাড়। তাই মা আর বাবা মিলে পরামর্শ করে আমাকে হোস্টেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত করলেন। সেই মতো কাছাকাছি কুচবিহারে নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। পপির সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ির সেই শুরু। তবে, সপ্তাহান্তে শনিবার বিকেলে চলে আসতাম, সোমবার সকালের গাড়ি ধরে ফিরে যেতাম।
শনিবার যখন বিকেলে বাড়ি আসতাম, তখন পপির আহ্লাদ ছিল দেখার মতো। ছুটে এসে সে প্রথম আমার পায়ের ওপর পড়ে গড়াগড়ি খেত। তার পর ‘ভুক ভুক’ করে লাফিয়ে লাফিয়ে আমার হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে কত যে অবোধ ভাব প্রকাশ করত, তা বলার নয়। ওই মিনিট পাঁচেক সে আমাকে পুরোপুরি দখল করে থাকত। কিন্তু ভারী সভ্য কুকুর ছিল সে। আবেগের প্রকাশ সাঙ্গ হলে সে আর বিরক্ত করত না। শান্ত হয়ে নিজের জায়গায় চলে যেত।
পপি আকারে খুব একটা বড়সড় ছিল না। বরং একটু ছোটর দিকেই। আর তার স্বভাবটি ছিল শিষ্ট ভদ্রলোকের মতো। কখনও রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করতে যেত না। আমরা কখনও তাকে অকারণে ঘেউ ঘেউ করতে শুনিনি। একটুআধটু যে ডাক ছাড়ত, তাও ছিল মিষ্টি ও মোলায়েম। তা বলে তাকে ভিতু মনে করলে ভুল হবে। সে নির্ভয়ে রাস্তায় বেরোত। অন্য কুকুররা তেড়ে এলেও পালাত না। মুখোমুখি হত। কিন্তু মারামারি করতে দেখিনি কখনও। তার শিষ্টতা ও সৌজন্যেরও বোধহয় একটা জোর ছিল। অন্য কুকুরেরা তার সঙ্গে শত্রুতা বজায় রাখত না।
আমি কুচবিহারে পড়ে রইলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন কাছাড়ের বদরপুর। এ বার কী হল কে জানে, মা-বাবা পপিকে ফেলে গেলেন না। সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আমার কী আনন্দ! পুজোর ছুটিতে যখন বদরপুর যাচ্ছি, তখন বাড়ি গিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোন, বা দিদির সঙ্গে দেখা হবে বলে যেমন আনন্দ, তেমনই পপির সঙ্গে দেখা হবে বলেও আনন্দ হচ্ছিল।
পপির অভ্যর্থনা সেই একই রকম। প্রথমে পায়ের ওপর গড়াগড়ি, তার পর হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে কিছু ক্ষণ আদর। তার পর আর একটুও বিরক্ত করত না আমাকে। তবে আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতে চাইত। আমি বারণ করলে লক্ষ্মীছেলের মতো নিরস্ত হত। মা বলত, ‘তুই চলে গেলে পপি তিন-চার দিন খুব মনমরা হয়ে থাকে।’
আরও কয়েক জায়গা ঘুরে বাবা বদলি হয়ে শিলিগুড়িতে যখন, বাবাকে কেউ একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর উপহার দেয়। তার নাম ছিল রেনি। মাদি কুকুর। প্রচণ্ড রাগী, জঙ্গি। বাড়ির বাগানে গরু-ছাগল ঢুকলে তেড়ে গিয়ে কামড়ে দিত। শিকলে না বেঁধে উপায় ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, রেনির সঙ্গে পপির কখনও কোনও বিবাদ বিসংবাদ ছিল না। আমি রেনিকে একটু-আধটু আদর করলে অবশ্য পপি কাছে এসে ঘুরঘুর করত।
রেনি বেশি দিন বাঁচেনি। আমাদের বাড়িতে বছর দুই থাকার পর সে মারা যায়। কিছু দিন পরে আরও একটি অ্যালসেশিয়ান কেউ উপহার দেয়। তার নাম রাখা হয় ডিউক। ডিউক মদ্দা কুকুর এবং যথেষ্ট আক্রমণাত্মক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কারও সঙ্গেই সহাবস্থানে পপির কোনও অসুবিধে হয়নি। ডিউক বড়সড় রাগী কুকুর। বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগত-আগন্তুক-ভিখিরি-কুকুর-বেড়াল-কাক-পক্ষী এলেই চেঁচামেচি করত। বেঁধে না রাখলে হয়তো কামড়েও দিত। অবশ্য আমরা ধমক দিলে আত্মসংবরণও করে নিত। কিন্তু পপি ছিল বিচক্ষণ। কে এলে জানান দিতে হবে এবং কে এলে কোনও বিপদ নেই, এটা সে নিজের বুদ্ধি দিয়েই বুঝে নিত। ভিখিরিদের তাড়াত না। অতিথি-অভ্যাগত এলে একটু মেপে নিত এবং লক্ষ করত বাড়ির লোক তাকে কেমন ভাবে নিচ্ছে। ভদ্রলোক আর কাকে বলে!
পপির কোনও বায়নাক্কা ছিল না। এঁটোকাঁটা খেয়েই সে দিব্যি ছিল। বাইরে গিয়ে কখনও অখাদ্যকুখাদ্য খেয়ে আসত না। কখনও ঠাকুরঘর বা রান্নাঘরে ঢুকত না। রেল-বাংলো ছেড়ে কিছু দিন আমরা এক ভাড়াবাড়িতে ছিলাম। সেখানে শৌচালয়টি ছিল একটু দূরে। আমার এক বৃদ্ধা ঠাকুমা যখনই শৌচালয় যেতেন, পপি সতর্ক অভিভাবকের মতো তাঁকে পৌঁছে দিয়ে আসত।
তখন আমি কলকাতায়। লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের লেখা একটা পোস্টকার্ডে পপির মৃত্যুসংবাদ এল। বুকের ভিতরটা ধু ধু করে উঠেছিল। বন্ধুবিয়োগ তো বটেই, আজও মনে হয় পৃথিবী থেকে এক জন সত্যিকারের ভদ্রলোক চলে গিয়েছিল সে দিন। আমি আর কোনও কুকুর পুষিনি।