প্রিয়তম সে
অশোক সকালবেলা রকে বসেছিল ওর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, যেমন অন্যান্য দিনও বসে থাকে। কলকাতা থেকে মাইল ত্রিশেক দুরে, ছোট মফস্বল শহরে, অশোকদের বাড়ি ঠাকুরবাড়ি বলেই পরিচিত; এবং মন্দিরসংলগ্ন ঠাকুরবাড়ির রকে, একশো বছর আগেও আড্ডা বসত। তবে সে সব আড্ডা ছিল ন্যায়তীর্থ, তর্কচূড়ামণি, স্মৃতিশাস্ত্রবিদ পণ্ডিতদের। ঠাকুরবাড়ির বর্তমান বংশে, এখন আর সেরকম কোনও পণ্ডিত নেই।
অশোক এক বংশধর। ট্রাউজার-শার্ট পরে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে, দামি সিগারেট খায়। ওর দুই দাদা, বাইরের দিকে দুই ঘরে, ধ্রুপদ সংগীত চর্চা আর জ্যোতিষী শাস্ত্র চর্চা করে এবং তা এতই সোচ্চার, দরজা বন্ধ ঘর থেকেও তার প্রবল চিৎকার ভেসে আসছে!
অশোকদের আড্ডায় ইতিমধ্যেই, রাস্তার মোড় থেকে কয়েক প্রস্থ মাটির ভাঁড়ে চা এসেছে। খাওয়া-পরার দিক থেকে, তিন ভাইয়েরই নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবন। পূর্বপুরুষেরা যা রেখে গিয়েছেন, অবিবাহিত তিন ভাইয়ের পক্ষে তা শেষ করা সম্ভব হবে না, কারণ কারোর বাতিকই এমন ধরনের না যাতে প্রচুর অর্থব্যয়ের দরকার করে।
অশোকদের আড্ডায় এখন শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এই সময়ে, অশোকদেরই বয়সি, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি যুবক রকের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে চশমা, উশকো-খুশকো চুল, সাধারণ ট্রাউজার-শার্ট পরা। চোখেমুখে বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য আছে, দৃষ্টিতে গভীরতা। তার দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়েই অশোক অবাক হয়ে বলে উঠল, এ কী রে চিত্ত, তুই কোথা থেকে?
চিত্ত যার নাম, সে একটু হেসে বলল, কোথা থেকে আবার, কলকাতা থেকেই এবং তোর কাছেই।
অশোকের চোখে বিস্মিত জিজ্ঞাসা। ও বন্ধুকে অভ্যর্থনা করল, উঠে আয়। এখানেই বসবি, না ঘরে যাব?
চিত্ত বলল, এখন এখানেই বসি, পরে ঘরে যাওয়া যাবে।
অশোক বলল, সেরকম জরুরি দরকার থাকলে কলকাতা থেকে একটা টেলিফোন করতে পারতিস!
চিত্ত রকে উঠে বাঁধানো পরিচ্ছন্ন শানে বসে বলল, তা পারতাম। একবার ভেবেছিলাম, তাই করব। কিন্তু ভেবে দেখলাম, আমার কথা জরুরি হলেও, টেলিফোনে বলা সম্ভব না। অবিশ্যি এ কথাও ভেবেছিলাম, টেলিফোন করে তোকে কলকাতায় ডাকি। পরে মনে হল, কী অবস্থায় আছিস না আছিস?
অশোক হেসে বলল, আমি আবার কী অবস্থায় থাকব। খাচ্ছি দাচ্ছি কাঁসি বাজাচ্ছি।
কথাটা বলেও, অশোক চিত্তের দিকে তাকিয়ে ঠিক নিশ্চিন্ত বোধ করল না। চিন্তিত অনুসন্ধিৎসু চোখে, চিত্তর দিকে একবার দেখে, ও বলল, আমরা তো এমনি আড্ডা দিচ্ছি। এরা বাড়ি চলে যাক, আমি বরং তোর কথাই আগে শুনি!
চিত্ত একটু বিব্রত অস্বস্তিতে অশোকের পাড়ার বন্ধুদের দিকে তাকাল। বন্ধুরা সবাই বলে উঠল, তাতে কী হয়েছে। আমরা এখন চলি।
সকলেই চলে গেল।
অশোক যখন কলকাতার কলেজে পড়ত, চিত্ত তখন ওর সহপাঠী ছিল। অশোক কলেজ ছেড়ে এলেও, চিত্তর সঙ্গে যোগাযোগটা বরাবরই রয়েছে। টেলিফোনে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হয়। অশোক কলকাতায় গেলে, চিত্তদের বাড়িতে যায়। বর্তমানে চিত্ত একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করছে, এবং আইন ও সি.এ. পড়ছে, অশোক তাও জানে।
অশোক বলল, চল, বাড়ির ভেতরে যাই।
চিত্ত বলল, তার কী দরকার। এখন তো আমরা এখানেই কথা বলতে পারি।
অশোক বলল, তা হলে আমি পিসিমাকে তোর খাওয়ার কথা বলে আসি।
চিত্ত বাধা দিয়ে বলল, তার কোনও দরকার নেই অশোক, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চাই, আর তোকে নিয়েই ফিরে যেতে চাই। তার আগে কিছু কথা সেরে নেওয়া দরকার।
অশোক বলল, কথা সারতে সারতেও তো সময় লাগবে। তারপর একটু খেয়ে নিয়ে কলকাতায় যাওয়া যাবে। তুই বোস, আমি পিসিমাকে বলে আসছি।
অশোক চিত্তর আর কোনও কথা না শুনে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। পিসিমাকে জানিয়েই, আবার ফিরে এল। কিন্তু অশোক কিছুমাত্র অনুমান করতে পারছে না, চিত্ত কী কারণে আসতে পারে। সেজন্য কৌতূহলবশত আগেই জিজ্ঞেস করল, এবার বল তো কী ব্যাপার? তোদের বাড়ির সবাই ভাল তো? ৬৫৬
চিত্ত চিন্তিত এবং একটু গম্ভীর। বলল, আমাদের বাড়ির সবাই মোটামুটি ভাল। তবে পরশু রাত্রে আমার ছোটপিসিমা মারা গেছেন, সেই নিয়ে সকলেরই মন খারাপ।
অশোক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তোর ছোটপিসিমা? তাঁকে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না তো?
চিত্ত বলল, তুই ছোটপিসিমাকে কখনও দেখিসনি। উনি আলাদা থাকতেন, মাঝে-মধ্যে আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁর কথা বোধহয় তোকে আমি বলেছি, তোর মনে নেই।
অশোক একমুহূর্ত মনে করবার চেষ্টা করল, তারপরেই বলে উঠল, ও, তোর যে পিসিমা সন্ন্যাসিনী ছিলেন?
চিত্ত ওর দুঃখের মধ্যেও একটু হেসে বলল, ঠিক সন্ন্যাসিনী ছিলেন না, তবে চিরকুমারী এবং খুব ধর্মপ্রাণা ছিলেন। একলা থাকতেন, একটা ভাল চাকরি করতেন।
অশোক বলল, মনে পড়েছে। তোর মুখ থেকেই শুনেছি, উনি কোনও আশ্রমে যেতেন, আর তা থেকেই আমার সন্ন্যাসিনীর কথা মনে হয়েছে। আসলে তোর ছোটপিসিমাকে আমি মনে মনে সন্ন্যাসিনীই ভাবতাম। তা কী হয়েছিল, হঠাৎ মারা গেল?
চিত্ত বলল, সে কথা বলতেই তোর কাছে এসেছি।
অশোক সব কথা না শুনেই, এবার চিত্তর আগমনের হেতু অনুমান করতে পারল, এবং মনে মনে অস্বস্তি ও বিব্রত বোধ করল। চিত্ত বলল, তুই যেন কেমন গুটিয়ে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে?
অশোক একটি সিগারেট ধরাল। চিত্তকে দিল না, জানে চিত্ত ধূমপান করে না। বলল, এর জন্য আবার আমার কাছে এলি কেন? আমার অস্বস্তি হচ্ছে। সেরকম গুরুতর কিছুই আমি সমাধান করতে পারি না।
চিত্ত বলল, তা বললে হয় না, তোর রিসেন্ট জিনা তরফদার মার্ডারের রহস্য-উদঘাটন রীতিমতো একটা আলোড়ন। তোর কথাই আমার আগে মনে পড়ল। অবিশ্যি কিছুই করার নেই হয়তো, তবু আমি তোকে সব কথা বলতে চাই।
অশোক জিজ্ঞেস করল, তোর ছোটপিসিমা কি খুন হয়েছেন?
চিত্ত বলল, সে কথা কেউ বলেনি। পুলিশের মনে যা-ও বা একটু সাসপিশন ছিল, আত্মীয়-স্বজনরা কেউই সে সব ঝামেলায় যেতে চাননি। তা ছাড়া খুনের কোনও কারণও নেই, ঘর থেকে কিছু খোয়াও যায়নি। অথচ এটাও ঠিক, আত্মীয়রা ঝামেলা এড়াতে চাইলেও, সকলের মনেই কেমন যেন একটা কাঁটা বিধে আছে, সেটা আমি জানি।
অশোক একটু হেসে বলল, অন্তত আর কারোর মনে না থাকুক, তোর মনে যে বিধে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
চিত্ত স্বীকার করল, যথার্থ বলেছিস।
অশোক জিজ্ঞেস করল, পোস্টমর্টেম হয়েছিল?
না, সে সব কিছুই হয়নি। পুলিশ আমার বাবার আর মেজো পিসেমশায়ের কথার ওপরে নির্ভর করেই ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। সকলেই একবাক্যে বলেছেন ছোটপিসিমার কোনও শত্রু থাকতেই পারে না, ছিলও না, এবং তাঁর খুন হবার কোনও কারণই নেই, তিনি নিশ্চয়ই হার্টফেল করে মারা গেছেন। পরশু রাত্রে মারা গেছেন, গতকাল দুপুরেই কেওড়াতলায় দাহ হয়েছে।
অশোক বলল, তবে আর কী, সব তো মিটেই গেল। তোর কি সন্দেহ আছে নাকি, ছোটপিসিমার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়?
স্বাভাবিক যে নয় তার প্রথম প্রমাণ, পুলিশ এল কেন? হার্টফেল করে মরলেই পুলিশ আসে না, তাদের খবর দিতে হয়। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছিল। ছোটপিসিমার ঘরের দরজা খোলা ছিল, তাঁকে মৃত অবস্থায় তাঁর খাটের নীচে ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখা যায়, এবং আরও দু-একটা জিনিস লক্ষ করবার মতো ছিল।
যথা?
যথা—, চিত্ত একটু ভাবল, তারপরে বলল, ছোটপিসিমার ব্লাউজটা গায়ের থেকে, গলার কাছে গোটানো ছিল, গলার কাছে ঘষটানো দাগ ছিল, তাতে যেন ছাল উঠে গিয়ে, একটু রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল। ঠোঁটের বাইরে কোনওরকম রক্ত না দেখা গেলেও, দাঁতে মাড়িতে জিভে রক্তের দাগ ছিল।
অশোক ভুরু কুঁচকে অন্যমনস্ক হল, কিন্তু একটু পরেই আবার বলল, কিন্তু সত্যি যদি ওঁর কোনও শত্রু না থেকে থাকে—
চিত্ত বাধা দিয়ে বলল, কেউ তা জানত না, আমিও জানি না, কিন্তু তা থেকেই কি প্রমাণ হয় তাঁকে কেউ খুন করতে পারে না?
না, তা প্রমাণ হয় না। খুনের বিষয়ে এরকম কিছুই স্থির করে বলা যায় না।
বলে একটু থেমে, আবার জিজ্ঞেস করল, উনি কি একলা একটা বাড়িতে থাকতেন?
না, উনি যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা একটা মহিলাদের হোস্টেল বলা যায়। ওঁর মতো চাকুরিজীবী মহিলা, যাঁরা চিরকুমারী বা নিঃসন্তান বিধবা, তাঁরাই ও বাড়িতে থাকতেন। আমি সেখানে অনেকবার গেছি।
মহিলাদের সংখ্যা?
তা প্রায় বারো-চোদ্দোজন হবেন। সকলেরই আলাদা আলাদা ঘর। কমন বাথরুম, দোতলা বাড়ি।
তার মানে, তুই বলতে চাইছিস, সেইসব মহিলারা কেউ কিছু করে থাকতে পারেন?
সেটা আমি জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারছি না। আমার একমাত্র সন্দেহ, ছোটপিসিমার মৃত্যু স্বাভাবিক না।
কেন? দরজা খোলা ছিল বলে?
এবং মেঝেয় পড়ে ছিলেন, গায়ের জামা গলার কাছে গোটানো, ঘষটানো দাগের সঙ্গে রক্তের
অশোক বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু ঘর থেকে কিছুই খোয়া যায়নি!
চিত্ত একটু থতিয়ে গিয়ে বলল, না, তা অবিশ্যি যায়নি।
কী কী ছিল ঘরে, মানে মূল্যবান জিনিসপত্র?
চিত্ত একটু ভেবে বলল, যা কিছু সবই দেওয়াল-আলমারিতেই ছিল। প্রায় শতিনেক টাকার নতুন জামাকাপড়, প্রেজেন্টেশনের জন্য কিনেছিলেন। আটশো টাকার মতো ক্যাশ, ব্যাঙ্কের পাশবই দুটো চেকবই, আর ছোট একটা স্টিলের ক্যাশবাক্স, কুড়ি-একুশ ভরি সোনার গহনা।
সে সবে কোনও রকম হাত পড়েনি?
না।
আলমারি চাবি বন্ধ ছিল?
চাবি বন্ধ ছিল, কিন্তু চাবির ছিদ্রেই চাবি লাগানো অবস্থায় ছিল।
অশোক কপাল কুঁচকে একটু ভাবল, জিজ্ঞেস করল, উনি তো শুনেছি মোটেই সাজগোজ করতেন না, সাধারণ ভাবে থাকতেন, চাকরি আর ধর্ম, আশ্রম ইত্যাদি নিয়ে থাকতেন। কিন্তু এত গহনা গড়িয়েছিলেন কেন?
সে সব গড়িয়েছিলেন অনেক আগে। একুশ বছর বয়সে চাকরিতে ঢোকেন, মারা গেলেন একচল্লিশ বছর বয়সে। প্রথম দিকে কিছু শখ-টখ ছিল। তা ছাড়া, টাকাকে সোনা করে রাখা আমাদের সমাজে সংসারে একটা চালু ব্যাপার।
অশোক বলল, তা ঠিক। উনি বিয়ে করেননি কেন?
চিত্ত বলল, শুনেছি কী অসুখ-বিসুখ ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে সেরকম কিছু বোঝা যেত না।
দেখতে কেমন ছিলেন?
মোটামুটি। সুন্দরী বলা যায় না কোনওরকমেই। গায়ের রং ময়লাই বলতে হবে। তার মধ্যেই একরকম দেখতে ছিলেন, হতকুচ্ছিত বলা চলে না।
অশোক তথাপি জিজ্ঞেস করল, তবু, আর একটু পরিষ্কার করে বল।
চিত্ত অশোকের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। কী বুঝল, কে জানে, বলল, চোখমুখ ভাল ছিল, শার্প বলতে যা বোঝায়, শরীরের কাঠামো ভালই ছিল, যেটা আগেই বললাম, বাইরে থেকে দেখলে ছোটপিসিমার কোনও অসুখ ছিল বলে মনে হত না।
অশোক চুপ করে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপরে বলল, কোনও মূল্যবান জিনিস যখন খোয়া যায়নি, মনে হয়, কোনও চোরের কাজ এটা নয়; যদি আমরা ধরেই নিই, উনি খুন হয়েছেন। বয়স বলছিস একচল্লিশ হয়েছিল। তার ওপরে উনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলা। প্রেম-সংক্রান্ত ব্যাপারে, তিনি কারোর রাইভাল হতে পারেন না, বা কোনও পুরুষের বিরাগভাজন হবারও সম্ভাবনা নেই।
চিত্ত মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় না, ছোটপিসিমার জীবনে ও সব ছিল। একটা মানুষকে দেখলে তো বোঝা যায়।
অশোক বলল, ভাবতে গেলে অনেক কিছুই ভেবে নেওয়া যায়। হয়তো ব্ল্যাকমেল করতেন, অথবা কোনও একটা বিশেষ চক্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন–সে চক্র হয়তো ওঁর ধর্মীয় ব্যাপারের মধ্যেই হতে পারে। কিন্তু অন্ধের মতো সে সব হাতড়ে কোনও লাভ নেই। আপাতত খুনের কোনও মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে না। তবু জোর করে বলা যায় না, তিনি খুন হয়েছিলেন বা হননি। ওঁর ব্যাঙ্কে কত টাকা ছিল, শুনেছিস কিছু?
চিত্ত বলল, তা প্রায় বারো-তেরো হাজার টাকা, সবই সেভিংস অ্যাকাউন্ট।
বাড়িতে টাকা-পয়সা দিতেন?
কোনও প্রয়োজন ছিল না। নর্থ বেঙ্গলে আমাদের বাড়ির অবস্থা খুবই ভাল। তবে মেজোপিসিমাকে মাঝে-মধ্যে সাহায্য করতেন।
কেন?
মেজোপিসিমার অবস্থা ভাল না। তাঁর চারটি ছেলেমেয়ে, পিসেমশায়ের চাকরিটা খুবই সাধারণ।
তা হলে তোর একজন বড়পিসিমাও আছেন?
হ্যাঁ, এবং তিনিও ছোটপিসিমার মতোই চিরকুমারী, ধর্মপ্রাণা। থাকেন নর্থ বেঙ্গলেই, আমাদের বাড়িতে।
অশোক আবার একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। তিন বোনের মধ্যে একজন বিবাহিতা। বাকি দুজনের জীবন প্রায় একরকম, তফাত কেবল ছোটপিসিমা চাকরি করতেন, কলকাতায় একটা মহিলা আবাসিক ভবনে বাস করতেন। যদিও আপাত ঘটনার সঙ্গে এ সবের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। কেবল একটা কথা অনুমান করা যায়, একই পরিবারের দুই কন্যারই বিবাহে অনিচ্ছা এবং ধর্ম নিয়ে থাকায় বেশ মিল আছে। ব্যাধির কথা যদি সত্যি হয়, দুই বোনেরই কি একই ব্যাধি?
অশোক জিজ্ঞাসা করল, তোর মেজোপিসিমা কি সুখী? মানে বিবাহিত জীবনে সুখী?
চিত্ত বলল, সেটা বলা ভাই মুশকিল। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। তবে প্রায়ই অসুস্থ থাকেন, আর খিটখিটে মেজাজের মানুষ।
অশোক আবার জিজ্ঞেস করল, তোর কেন সন্দেহ হচ্ছে, তোর ছোটপিসিমা খুন হয়েছেন? যা বললি, শুধু সেই কারণেই?
হ্যাঁ।
কারোকে তুই সন্দেহ করিস?
চিত্ত একটু ভেবে বলল, একটা ছেলেকে আমার যেন কেমন সন্দেহ হয়।
যথা? সেই ছেলেটি কে?
একটি ছেলে ছোটপিসিমার কাজকর্ম করত, হাতে-পায়ে তেল মালিশ করে দিত।
কত বয়স তার?
কত আর, বারো-তেরো বছর। তবে ছেলেটা খুন করেছে বলে আমি মনে করি না। হয়তো কিছু জানতে পারে। কিন্তু ও পুলিশকে বলেছে, রোজকার মতোই ও রাত্রি নটায় নিজেদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। মা, অর্থাৎ ছোটপিসিমা তখন বেশ ভালই ছিলেন।
অশোক জিজ্ঞেস করল, ঘরের মেঝেয় মৃত অবস্থায় তুই ওঁকে দেখেছিলি?
দেখেছি।
কী অবস্থায় পড়েছিলেন?
চিত হয়ে, কিন্তু কোমরের কাছ থেকে একটু বাঁ পাশে কাত ফেরানো।
নীচের দিকে কাপড়-চোপড় ঠিক ছিল?
তা ছিল।
অশোক বলল, আর একটি কথা জিজ্ঞেস করি, তোর ছোটপিসিমা মারা গেলে, তাঁর নগদ টাকাকড়ি সোনা কে পাবে? কোনও লেখাপড়া আছে কিছু?
চিত্ত বলল, সে বিষয়ে কিছু জানি না।
ওঁর আলমারিতে কোনও কাগজপত্র বা দলিল, কিছু পাওয়া যায়নি?
না। থাকলেও তা চোখে পড়েনি।
কেন, পুলিশের সামনেই তো সে সব দেখা উচিত ছিল।
টাকা-পয়সা গহনা ইত্যাদি দেখা হয়েছিল, যাতে বোঝা যায়, কিছুই খোয়া যায়নি। দলিল-দস্তাবেজ কিছু ঘেঁটে দেখা হয়নি।
দেখা উচিত ছিল। আলমারির চাবি এখন কার কাছে?
বাবার কাছে। কিন্তু আলমারিতে এখন কিছুই নেই। এতক্ষণে বোধহয় সবই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সেরকমই কথা ছিল, আজ সকালে ছোটপিসিমার যাবতীয় আসবাব এবং জিনিসপত্র আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হবে।
অশোক খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করা যায়?
চিত্ত বলল, কেন যাবে না?
আর উনি যে হোস্টেলে থাকতেন, সেখানকার মহিলারা আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন?
আশা করি দেবেন। ওঁরা অনেকেই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
তবে চল, খেয়ে-দেয়ে কলকাতায় যাই। তোর মনে যখন একটা কাঁটা বিধেই আছে, দেখা যাক সেটা সত্যি, না তোর মনগড়া।
চিত্ত বলল, তা হলেই আমি খুশি।
.
অশোক চিত্তর সঙ্গে কলকাতায় এসে, আগে গেল সেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা করতে। উত্তর কলকাতায় একটি বস্তিবাড়িতে ছেলেটি থাকে। আবাসিক ভবনটিও উত্তর কলকাতাতেই, বস্তি থেকে বেশি দূরে না। ছেলেটিকে বাড়িতেই পাওয়া গেল।
ছেলেটির চেহারা সত্যি সুন্দর। একমাথা কালো চুল, শ্যামবর্ণ, ডাগর চোখ, চোখা নাক, কমনীয় আর মিষ্টি। চাহনি নিষ্পাপ, ময়লা হাফপ্যান্ট আর বুক-খোলা জামা গায়ে। চিত্ত তাকে নিয়ে চলে এল গলির মোড়ে, একটা চায়ের দোকানে। বলে দিল অশোক তার বন্ধু, যা জিজ্ঞেস করবে, সে যেন তার জবাব ঠিক ঠিক মতো দেয়। তার কোনও ভয়ের কিছু নেই।
অশোক প্রথমে ছেলেটির নাম জেনে নিল। নাম মাখন। চিত্তর ছোটপিসিমাকে মাখন মা বলে ডাকত। প্রায় দুবছর কাজ করেছে। সকালে গিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কার করা, বিছানা ঝাড়া, পাট করা, অল্প দু-একটি কাপ-ডিশ ধোয়া সেরে চলে আসত। উনি রান্না করে খেতেন না। সকলের জন্য ঠাকুর রান্না করত, ঝি বাসন মাজত। মাখন শুধু একজনের কাজ করত। আবার যেত সন্ধেবেলায়, উনি যখন অফিস থেকে আসতেন। টুকিটাকি সামান্য কাজের মধ্যে, বিশেষ কাজ ছিল হাতে পায়ে, কোনও কোনও সময় বুকেও, রসুনতেল মালিশ করে দেওয়া। তারপরে মাখনের ছুটি। পরশুদিন রাত্রেও মাখন রসুনতেল মালিশ করে দিয়েছিল। তখন অন্যান্য দিনের মতোই ভাল ছিলেন।
অশোক, মা তোমাকে ভালবাসতেন?
মাখন, তা আমি জানতাম না।
অশোক, তোমাকে আদর-টাদর করতেন না?
মাখন একটু অবাক হয়ে বলল, না তো।
অশোক বলল, পরশু যখন তেল মালিশ করেছিলে, তখন কি মা জামা খুলেছিলেন?
মাখন, হাঁ, তা না হলে জামায় তেল লেগে যাবে যে।
অশোক, তুমি জানতে, মায়ের আলমারিতে টাকা-পয়সা থাকত?
মাখন, জানতাম।
অশোক, তুমি কখনও আলমারি খুলতে?
মাখন, মা বললে খুলতাম।
অশোক, খুলতে বলতেন?
মাখন, হ্যাঁ এটা-সেটা বের করে দিতে বলতেন।
অশোক মাখনের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইল, তারপরে জিজ্ঞেস করল, তুমি পরশু রাত্রে যখন আস, তখন মা কোথায় শুয়ে ছিলেন?
মাখন, খাটের বিছানায়।
অশোক, তখন কি তুমি তাঁর গলায় কোনও দাগ দেখেছিলে?
মাখন যেন চুপ করে ভাবতে লাগল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, কীসের দাগ বলুন তো?
চিত্ত বলে উঠল, ঘষটানোর দাগ আর একটু একটু রক্ত, খুব ছাল উঠে গেলে যেমন হয়।
মাখন বলল, না। আমি ভেবেছিলাম তেলের দাগের কথা বলছেন।
চিত্ত অশোকের দিকে তাকাল। অশোক জিজ্ঞেস করল, তুমি যখন চলে আস, তখন কি দরজা খোলা ছিল?
মাখন, হ্যাঁ। আমি ভেজিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।
অশোক, রোজই কি তাই করতে?
মাখন, না। কোনও কোনওদিন, আমি বেরিয়ে গেলেই মা দরজা বন্ধ করে দিতেন।
অশোক, মা তোমাকে কখনও বুকের ব্যথার কথা বলতেন?
মাখন, হ্যাঁ, প্রায়ই মার বুকে ব্যথা হত। আমি হাত বুলিয়ে দিতাম।
অশোক বলল, আচ্ছা মাখন, একটু ভেবে বলো তো, তোমার মা যে বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়ির কারোর সঙ্গে কি তাঁর ঝগড়া-বিবাদ ছিল?
মাখন একটু ভেবে বলল, বেলামাসিমা ছাড়া কারোর সঙ্গে মায়ের ঝগড়া ছিল না।
অশোক একবার চিত্তর দিকে তাকাল। আবার মাখনকে জিজ্ঞেস করল, কী নিয়ে ঝগড়া ছিল জানো?
মাখন মাথা নেড়ে বলল, না, তা জানি না। মা আর বেলামাসিমা কথা বলতেন না, দুজনে খাবার ঘরে একসঙ্গে খেতে বসতেন না। দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল।
অশোক চুপ করে একটু ভেবে, আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার মায়ের কাছে কারা আসতেন, তুমি দেখেছ?
মাখ ঘাড় কাত করে, চিত্তকে দেখিয়ে বলল, দেখেছি। এই দাদা আসতেন। দাদার বাবা, বড়মামা আর মামিমা আসতেন। মেলোমশায়ও মাঝে মাঝে আসতেন, আর নূপুরঝুমুরেরা কখনও কখনও আসত।
অশোক চিত্তর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। চিত্ত বলল, মেজোপিসেমশায়ের কথা বলছে। মেয়েদের নাম নূপুর ঝুমুর।
অশোক ঘাড় নেড়ে বলল, মাসিমা আসতেন না?
মাখন বলল, খুব কম, দু-একবার দেখেছি।
চিত্ত বলল, মেজোপিসির শরীর তো ভাল থাকে না, কোথাও বেরোয় না। আমাদের বাড়িতেই আসেন না।
অশোক মাখনের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, মা মরে গেছে বলে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ, না?
মাখন কোনও জবাব না দিয়ে, চুপ করে রইল। তার মুখের অভিব্যক্তিতে দুঃখ-আনন্দ কিছুই বোঝা যায় না। সে যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন।
অশোক আবার কিছুক্ষণ মাখনের মুখের দিকে চোখ রেখে, শব্দ করল, হুম। চল চিত্ত, মাখনকে আর আমার কিছু জিজ্ঞেস করবার নেই।
.
সন্ধে ছটায় অশোক আর চিত্ত এল সেই আবাসিক ভবনে। মহিলারা সকলেই চাকুরিজীবী, তাই এই সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ সময়েই সকলের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা। এ আবাসের সব মহিলাই চিত্তর পিসিমা, যেহেতু সকলেই ওর পিসিমার বন্ধু। ইতিমধ্যে অশোক চিত্তর কাছে জেনে নিয়েছে, বেলা ধর নাম্নী মহিলার সঙ্গে এক সময়ে ওর ছোটপিসিমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে কী কারণে তাঁদের বিবাদ হয়, চিত্ত তা জানে না। কেবল ওর ছোটপিসির মুখে শুনেছে, বেলা ধরের মতো বাজে মেয়ের সঙ্গে আমার কথা বলতে প্রবৃত্তি হয় না। এর বেশি চিত্ত জানে না, কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। বেলা ধর, চিত্তর সঙ্গে দেখা হলে, শুকনো ভাবে কেবল জিজ্ঞেস করেন, ভাল তো? এর বেশি না।
চিত্ত অশোককে নিয়ে প্রথম যাঁর ঘরে এল, তাঁর নাম মায়া দাস। নিঃসন্তান বিধবা, বয়স প্রায় পঞ্চাশ, এবং এ আবাসের তিনিই সবথেকে বয়স্কা আবাসিক। চিত্তকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। মহিলা প্রসন্নমুখী, পান-জরদা খান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকুরে। চিত্ত ওঁকে সমস্ত কথা বলল। উনি মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে, কয়েকবারই অশোককে তাকিয়ে দেখলেন। সব শুনে অশোককে বললেন, এই বয়সেই তুমি বেশ গুণী ছেলে দেখছি।
অশোক লজ্জিত হেসে বলল, না না, সেরকম কিছু না। কিন্তু পিসিমা, একটা কথা বলি, কোনও পিসিমার যদি একটুও আপত্তি থাকে, তা হলে তাঁর সঙ্গে কথা বলে দরকার নেই। কেউ যেন রাগ না করেন, বা ভুল না বোঝেন। এটা হচ্ছে চিত্তর একটা বিশেষ কৌতূহল, ওর ছোটপিসিমার মৃত্যু ও কিছুতেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছে না। আমি অবিশ্যি সেরকম কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আপনি সব পিসিমাদের বুঝিয়ে বলবেন, এর সঙ্গে পুলিশের কোনও ব্যাপারই নেই। কেবল ছোটপিসিমার বিষয়ে একটু বিশদ ভাবে জানা।
মায়া দাস বললেন, আমি তো বাবা এর মধ্যে কোনও অন্যায় কিছু দেখছি না। আমার ভালই লাগছে, তোমাদের এই উৎসাহ খুবই ভাল। তা ছাড়া, আমি শুধু তোমাদের কথা শুনে বলছি না, সুধার মৃত্যুকে আমিও যেন স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারিনি। তোমরা বলেই এ কথা বলছি। পুলিশকে আমি তা বলিনি।
সুধা ছোটপিসির নাম। চিত্তর চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। সে অশোকের দিকে তাকাল। অশোকের চোখেমুখে সেরকম কোনও অভিব্যক্তি নেই। মায়া দাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন মায়া পিসিমা, আপনার কী মনে হয়েছে বলুন তো?
মায়া বললেন, মনে বাবা আমার সেরকম কিছুই হয়নি। কিন্তু সুধার হার্টফেল হবার কোনও কারণ ছিল না। সুধার একটু অসুখবিসুখের বাতিক ছিল। বুকে সামান্য ব্যথা হলেই ও কার্ডিওগ্রাফ করতে ছুটত। সামান্য মাথা ঘুরলেই, সঙ্গে সঙ্গে প্রেশার মাপাত। সে সব থেকেই জানতাম, ওর হার্ট বেশ ভালই ছিল। আজ পর্যন্ত প্রায় বার পাঁচ-ছয়েক ই-সি-জি করিয়েছে, প্রত্যেকবারই রিপোর্ট ভাল আর এক ছিল। প্রেশার একটু লো-এর দিকে ঝোঁক ছিল, তেমন মারাত্মক কিছুই না। তবে হ্যাঁ, ওর যেটা আসল রোগ ছিল, সেটা একটা ব্রংকিয়াল প্যাঁচ, আর বাত। সর্দি-কাশি লেগেই থাকত।
মায়া দাস কথা থামিয়ে একটু হাসলেন, আবার বললেন, তা তোমাদের আর কী বলব, এত বয়সের অবিবাহিতা মেয়েদের একটা রোগ-টোগ থাকেই, না থাকলেও তৈরি করে নিতে হয়। কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো।
অশোক হাসি-হাসি মুখে, মনে গভীর চিন্তার জট নিয়ে মায়া দাসের কথাগুলো শুনল, চিন্তা করল। রোগ তৈরি করে নিতে হয় কথাটা ওর কাছে বিচিত্র অর্থবহ মনে হল। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু মায়াপিসিমা, ছোটপিসিমার মৃত্যুটা কেন আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?
মায়া দাস বললেন, আমারও অনেকটা চিত্তর মতোই মনে হয়েছে। গলায় ওরকম দাগ কেন? যেন সুধার গলার কাছে ঠেকে থাকা ব্লাউজটা কেউ জোরে জোরে ওর গলায় ঘষেছে, তাতে ছাল উঠে গিয়ে রক্ত ফুটে বেরিয়েছে। সবাই বলেছে কোনও একটা যন্ত্রণায় সুধা নিজেই ব্লাউজটা টানাহ্যাঁচড়া করেছে। কী জানি, আমার যেন কেমন মন মানে না। তা ছাড়া ওর মুখেই বা রক্ত ছিল কেন? মুখের মধ্যে বেশ রক্ত ছিল। দরজা খোলা, সুধা মেঝেয় পড়েছিল, এ সব আমার ভাল লাগেনি।
অশোক বলল, কিন্তু কী মনে হয় আপনার? ছোটপিসিমাকে কেউ যদি খুন করেই থাকে, সে কে হতে পারে?
মায়া দাস একটু ভেবে বললেন, কিছু মাথায় আসছে না। মাখনকে সন্দেহ হয় না। ও যদি সুধাকে মারতই, তা হলে টাকা-গয়নার জন্যই মারত কিন্তু সে সব কিছুই খোয়া যায়নি।
অশোক জিজ্ঞেস করল, পরশু রাত্রে মাখন চলে যাবার পরে, আর কেউ এসেছিল?
মায়া দাস বললেন, এলেও, দেখিনি, জানতেও পারিনি।
অশোক ওর ডাগর চোখে, সরল ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এরকম কেউ আসত কি? রাত্রি নটার পরে?
মায়া দাস বললেন, হঠাৎ কেউ হয়তো এসে পড়তেন, সুধার আত্মীয়-স্বজনরা। চিত্তও তো অনেক সময় রাত্রি নটার পরে হঠাৎ এসেছে। অথবা শচীশবাবুও আসতেন।
শচীশবাবু কে?
চিত্ত জবাব দিল, মেজোপিসেমশাই।
অশোক জিজ্ঞেস করল, আর কেউ?
মায়া দাস একটু ভেবে বললেন, আর তো কারোকে মনে করতে পারছি না।
অশোক জিজ্ঞেস করল, ছোটপিসিমার কোনও শত্রু ছিল বলে মনে হয়?
মায়া বললেন, না, সুধার কোনও শত্রু ছিল বলে শুনিনি।
বিশেষ কোনও মিত্র?
মায়া দাস জিজ্ঞেস করলেন, সেটা কী রকম?
অশোক বলল, বিশেষ বন্ধু, যার সঙ্গে তাঁর খুব ভাল লাগত?
মায়া দাস একটু ঠোঁট টিপে হাসলেন, চিত্তকে একবার দেখলেন, বললেন, সেরকম বলতে ওর ভগ্নিপতি শচীশবাবুর সঙ্গেই যা একটু ছিল। শালি-ভগ্নিপতি বলতে যেরকম বোঝায়।
অশোক মায়া দাসের চোখের দিকে চেয়ে রইল। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অশোকের মনে হল, শচীশবাবুর কথা বলতে গিয়ে মায়া দাস যেন স্বচ্ছ হলেন না। কিন্তু ও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। অতঃপর তাঁকে অনুরোধ করা হল, বাকি মহিলাদের অনুরোধ জানাতে, এবং যাঁরা কথা বলতে চান, তাঁরা যেন এ ঘরেই আসেন।
মায়া দাস তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার দু মিনিট পরেই এক একজন মহিলা এসে উঁকি মেরে দেখে যেতে লাগলেন। একজন হেসে বলেই গেলেন, কী রে চিত্ত, তুই আবার ডিটেকটিভ হলি কবে থেকে?
তেরোজন মহিলার মধ্যে ন জনই একে একে এলেন। তিনজন এখনও ফেরেননি। একজন–বেলা ধর, ঘরেই আছেন, আসবার অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সকলেরই বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। নজনের মধ্যে দুজন ছাড়া সকলেরই অভিমত, সুধার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকি দুজনে মায়া দাসের মতোই সন্দেহ পোষণ করেন, যদিও কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবে শচীশবাবুর নামটা প্রত্যেকেই করলেন, যা থেকে মনে হয়, সুধার অন্য সব আত্মীয়দের তুলনায় তিনি বেশি আসতেন, গল্পগুজব করতেন। এবং শচীশবাবুর নামোল্লেখের সময়ে সকলেরই ঠোঁটে যেন একটু হাসি ফুটে উঠল।
শেষ পর্যন্ত বেলা ধর এলেন। বললেন, সুধা আমাদের ছেড়ে গেল। ভাবলাম, আর ও সব ভেবে কী হবে। তাই এলাম, আমার দ্বারা তোমাদের যদি কোনও উপকার হয়।
অশোক বলল, আপনার কাছে আমরা, কৃতজ্ঞ। আচ্ছা ছোটপিসিমার সঙ্গে কি আপনার মনোমালিন্য হয়েছিল?
বেলা বললেন, তা হয়েছিল।
কতদিন আগে?
তা প্রায় বছরখানেক।
কেন?
বেলা একটু থমকালেন, ওঁর মুখটা একটু গম্ভীর হল, তারপরে হঠাৎ বলে উঠলেন, আমি ভণ্ডামি একদম সহ্য করতে পারি না।
বেলা ধরের সঙ্গে অশোকের চোখে চোখ মিলল। কয়েক সেকেন্ড দুজনেই চুপ। তারপরে অশোক বলল, আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করবার নেই।
বেলা ধরের বয়স বোধহয় চল্লিশের নীচেই। তাঁর সাজগোজও একটু বেশি। হেসে বললেন, আর কিছু না?
অশোক হেসে বলল, আপনার নিজের যদি কিছু বলার থাকে, বলতে পারেন।
বেলা ধর একটু ভাবলেন, তারপরে হঠাৎ একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না, আর কী-ই বা বলব।
বলে তিনি উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। অশোক হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ছোটপিসিমা মারা গেলে তাঁর টাকাকড়ি কে পাবে, আপনি কিছু জানতেন?
বেলা ধর ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার সঙ্গে ঝগড়ার আগে, বছরখানেক আগে একবার বলেছিল, সবই ওর মেজোবোনের ছেলেমেয়েদের দেবে।
অশোক বলল, ও। আচ্ছা, ঠিক আছে, বেলাপিসিমা, আপনি যান।
অশোক চেয়ার ছেড়ে উঠল। ঘড়িতে দেখল, সাড়ে আটটা বেজেছে। মায়া দাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বাইরে এল।
চিত্ত জিজ্ঞেস করল, কী বুঝলি?
অশোক বলল, একটা জায়গাতেই খটকা লাগছে। উচিত হচ্ছে, তোদর বাড়ি গিয়ে, ছোটপিসির কাগজপত্র সব দেখা। কিন্তু আজ আর সময় হবে না। আমাকে ফিরতে হবে। চল, বরং তোর মেজোপিসেমশাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। দরকার হলে কাল আবার আসব।
চিত্ত বলল, তুই আজকের রাতটা থেকেই যা না।
অশোক একটু দ্বিধা করে বলল, বলছিস? তা হলে বাড়িতে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে। বলে আসিনি তো।
চিত্ত বলল, তাই দিবি। তবে চল এখন বাড়িতেই যাই। সারাদিন অনেক ঘোরা হয়েছে, কথা হয়েছে।
অশোক বলল, না, তোর মেজোপিসেমশাই সকালবেলাই তো কাজে চলে যাবেন। আজ রাত্রেই ওঁর সঙ্গে কথা বলে আসি।
চিত্ত বলল, তবে চল।
.
শচীশ মজুমদারের বাড়িতে ওরা যখন এল, তখন রাত্রি প্রায় নটা। তিনি চিত্তর কথা শুনে, অশোককে দেখে খুব হাসলেন, বললেন, ভেরি গুড, যাকে বলে একেবারে খাঁটি ডিটেকটিভ কাহিনী।
অশোক প্রথম থেকেই খুব লজ্জিতভাবে হাসছে আর শচীশবাবুকে দেখছে। শচীশবাবুর বয়স পঞ্চাশের মধ্যেই। বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারা, দাঁত পড়েনি, চুল সামান্য পাক ধরেছে। প্রথমে হাসলেও, পরে গম্ভীর হলেন, বললেন, সুধাটা যে এমন করে চলে যাবে, বুঝতে পারিনি।
অশোকও একটু গম্ভীর হল, তারপরে খুব সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই, ছোটপিসিমা কি তাঁর টাকাকড়ি ইত্যাদির ব্যাপারে কোনও দলিল করেছিলেন?
শচীশবাবু ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, বোধহয় করেছে, আমাকে তো বলছিল মাসখানেক আগে, শরীরটা নাকি খারাপ হয়ে পড়ছিল, তাই তাড়াতাড়ি কিছু করতে চাইছিল।
অশোক বলল, কাকে দেবেন, কিছু বলেছিলেন নাকি?
না, আমাকে সেরকম কিছু বলেনি।
অশোক শচীশবাবুকে দেখল। উনি টেবিলের ওপর হাতের তাল ঠুকে, পা নাচিয়ে কথা বলছিলেন। অশোক খুব লজ্জিতভাবে হেসে বলল, আপনার সঙ্গে ছোটপিসিমার সম্পর্ক কেমন ছিল?
বলেই অশোক যেন লজ্জায় একেবারে মাথা নিচু করে ফেলল, কিন্তু চোরা দৃষ্টি ও হাসি গোপন করল না। ওর ভাবভঙ্গি রীতিমতো আপত্তিকর, ইঙ্গিতমূলক।
শচীশবাবুর দুচোখ জ্বলে উঠল, ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, কী বলতে চাও তুমি? ছোটলোকের মতো কথা বলবার চেষ্টা কোরো না, আর এ সব নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি, তোমার কাছে আমি আশা করি না।
অশোক যেন সে কথা শুনতেই পেল না, শচীশের চোখের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, পরশুদিন রাত্রে আপনি কখন বাড়ি ফিরেছেন?
শচীশ প্রায় ধমকে উঠে বললেন, তার মানে?
অশোক বলল, তার মানে, আমি জানতে চাইছি। আমার মনে হয় আপনি রাত্রি দশটা থেকে সাড়ে দশটায় পরশু বাড়ি ফিরেছেন।
শচীশ আরও জোরে ধমকে উঠলেন, এর দ্বারা তুমি কী বোঝাতে চাও?
চিৎকার শুনে মেজোপিসিমা ছুটে এসে বললেন, কী হয়েছে?
অশোক তড়িৎগতিতে সেদিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, পিসিমা, পরশুদিন রাত্রে পিসেমশায় কত রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন?
মেজোপিসিমা হঠাৎ থমকে গেলেন। স্বামীর দিকে একবার দেখলেন। তারপরে শান্ত ভাবে বললেন, ও যে রাত্রে কখন বাড়ি ফেরে, আমি জানতে পারি না। আমার শরীর খারাপ, ওর ফিরতে দেরি হয়। আমি ওর খাবার ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ি।
মেজোপিসিমা ফিরতে উদ্যত হলেন। অশোক আবার জিজ্ঞেস করল, ওঁকে রাত্রে দরজা খুলে দেয় কে?
মেজোপিসিমা বললেন, আমিই। দরজা খুলে দিয়েই আমি শুতে চলে যাই। ঘড়ি দেখি না।
অশোক শচীশের দিকে তাকিয়ে দেখল, উনি অপলক দৃষ্টিতে ওঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। ওঁর চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক। মেজোপিসিমা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। শচীশবাবু চমকে অশোকের দিকে তাকালেন। সামান্য সময়ের মধ্যেই তাঁর মুখের রং বদলে গিয়েছে।
চিত্ত উত্তেজিত রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, তা হলে
অশোক হাত তুলে, চিত্তকে নিরস্ত করে শচীশকে জিজ্ঞেস করল, ছোটপিসিমা যে দলিল করেছেন, সেটা কোথায় আছে, আপনি জানেন?
শচীশের দৃষ্টি অন্যদিকে, নিষ্প্রভ গলায় বললেন, সুধার আলমারিতে অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যেই ছিল দেখেছিলাম।
অশোক আবার জিজ্ঞেস করল, কতদিন আগে সেই দলিল সইসাবুদ হয়েছিল?
শচীশ একবার অশোকের দিকে তাকালেন, কিন্তু চিত্তর দিকে না। বললেন, সাত-আট দিন আগে।
অশোক শান্ত গম্ভীর অথচ ব্যথিত স্বরে বলল, ছোটপিসিমার কপালে ওই দলিলের সঙ্গেই মৃত্যু লেখা ছিল। অথচ, পিসেমশাই আপনি জানতেন, আপনি চাইলে ছোটপিসিমা আপনাকে সবই দিতে পারতেন। আপনার ছেলেমেয়েদের থেকে, আপনি তাঁর অনেক প্রিয় প্রিয়তম ছিলেন।
শচীশ মজুমদার সহসা শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, দুহাতে মুখ ঢাকলেন।
অশোক বিভ্রান্ত বিস্মিত চিত্তের হাত ধরে টেনে বলল, চল।
চিত্ত আচ্ছন্নের মতো অশোকের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল। কয়েক পা চলবার পরেই, চিত্ত দুহাতে অশোকের হাত চেপে ধরে বলে উঠল, অশোক, আমি যে এখনও স্পষ্ট কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে সব বুঝিয়ে বল। তা হলে আমি যে ভেবেছিলাম ছোটপিসিমার মৃত্যু স্বাভাবিক না, তাই সত্যি?
অশোক সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, চিত্তর হাত টেনে বলল, চল, আমরা কোথাও বসে একটু চা খাই। খেতে খেতে তোকে ব্যাপারটা বলি।
শ্যামবাজারের মোড়ে একটা রেস্তোরাঁয় এক কোণের একটি টেবিলে কফির কাপ নিয়ে অশোক আর চিত্ত বসেছে। অশোক সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোর সন্দেহের মধ্যে যে সত্যি ছিল, আমি প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। মাখনের সঙ্গে কথা বলে, আমার কোনও সন্দেহ হয়নি, যদিও নিজের মনে আমি অনেক আঁক কষাকষি করছিলাম। যদি খুন হয়, তবে মোটিভটার কথা আগে ভাবতে হয়, এবং এক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত একটি মাত্র মোটিভই আমার মনে স্থির হয়ে উঠছিল, তা হল ছোটপিসিমার টাকাকড়ি গহনা ইত্যাদি কে পাবে, এবং কোনও লেখাপড়া হয়ে গিয়েছে কি না।
আর একটা কথাও আমার মনে জেগেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণা, আশ্রম-টাশ্রমে যেতেন, সে সব ভেবে, অন্য দিকটা ভাবিনি। ভাবতে হল মায়া দাসের কথা শুনে। মায়া দাসের কথা থেকেই প্রথম জানা গেল, ছোটপিসিমা মেজোপিসেমশাইকে ভালবাসতেন; দুজনের মধ্যে, বলতে গেলে সবরকমের সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপার হোস্টেলের সব মহিলারাই জানতেন। কিন্তু ছোটপিসিমা সেটা কখনও স্বীকার করতে চাইতেন না, যে কারণে বেলা ধরের সঙ্গে তাঁর বিবাদ। বেলা ধর এক কথাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ভণ্ডামি পছন্দ করেন না, বিশেষ করে যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
অশোক কফির পাত্রে চুমুক দিল। চিত্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। অশোক আবার বলতে লাগল, তুই সন্দেহ করে বলেছিলি, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি মায়া দাস শুধু সন্দেহ করেননি, স্থির জানতেন ছোটপিসিমার মৃত্যু স্বাভাবিক না। সম্ভবত তিনি নিজের চোখে শচীশবাবুকে পরশু রাত্রে ছোটপিসিমার ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি এ সব কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চাননি বলে, কিছুই বলেননি।
হোস্টেলের অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে, দুটো ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। এক, ছোটপিসিমা মেজোপিসেমশাই, প্রেমিক-প্রেমিকা, গোপনে দুজন দুজনকে ভালবাসেন। দুই শচীশবাবুর সন্তানেরাই ছোটপিসিমার নগদ টাকাকড়ি এবং সোনাদানা যা কিছু সব পাবে।
তারপরেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল, দলিল তৈরি হয়েছিল কি? সেটা সঠিক জানবার আগেই, আমরা গেলাম শচীশবাবুর কাছে। ওঁর সঙ্গে আমি কী ভাবে কথা বলব, সেটা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। দলিলের কথাটা উনি খুব নির্বিকার ভাবে বললেও, মুহূর্তেই বুঝে নিলাম, দলিল হয়ে গিয়েছে। আমার পরবর্তী প্রশ্নেই উনি রেগে উঠলেন। ওঠবারই কথা, সেই ভাবেই আমি কথাটা বলেছিলাম। ওঁর চেঁচামেচিতে মেজোপিসিমা ছুটে এলেন। এবং আমার প্রশ্ন শুনেই থমকে, শান্ত হয়ে গেলেন। তাঁর কথা শুনে, তাঁর স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি শুধু এইটুকুই বুঝিনি তিনি মিথ্যে কথা বলছেন, এও বুঝেছি, তিনি তাঁর ভগ্নির এবং স্বামীর গোপন প্রেমের কথা জানতেন, এবং তাঁর ভগ্নি যে স্বামীর দ্বারাই নিহত হয়েছেন, তাও বুঝেছিলেন। শচীশবাবু সেই জন্যই তাঁর স্ত্রীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন, তাঁর মনের শক্তি তৎক্ষণাৎ ভেঙে পড়েছিল।
অশোক আবার কফির পাত্রে চুমুক দিয়ে বলল, গরিব মানুষের অভাব একরকম, কিন্তু অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোকের চরিত্র আলাদা। লোভ তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিকৃত করে দেয়। তা না হলে শচীশবাবু এরকম হঠকারিতা করতেন না।
চিত্তর চোখমুখ এখন জ্বলছে। জিজ্ঞেস করল, হঠকারিতাটা কী?
অশোক বলল, ক্লিন কিলিং।
কী ভাবে?
সেটা ঠিকমতো বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে আমার ধারণা, ছোটপিসিমার সঙ্গে শচীশবাবুর নিয়মিত দৈহিক সম্পর্কও ছিল। কিন্তু ছোটপিসিমা বোধহয় শুচিবায়ুগ্রস্ত, শোবার বিছানায় তিনি প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতেন না। মেঝেয় শুতেন। পরশু রাত্রে তাঁরা বোধহয় মিলিতও হয়েছিলেন, এবং তারপরে
চিত্ত রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করল, তারপর?
সুখে ক্লান্ত আচ্ছন্ন প্রেমিকাকে অল্পায়াসেই মারা যায়, বিশেষত যাঁর ব্রংকিয়াল প্যাঁচ আছে, নিশ্বাসের কষ্ট আছে, সেই অবস্থায় তাঁর বুকের ওপর চেপে থেকে, গলায় অল্প মর্দনেই
অশোক কথাটা শেষ করল না। চিত্ত উত্তেজনায় কথা বলতে পারছে না। অশোক আবার বলল, তবু ছোটপিসিমার বুক খোলা রেখে শচীশবাবু মাখনের ওপর দোষ চাপাবার একটা চেষ্টা করেছিলেন, যেন তেল মালিশ করতে করতেই, একটা কিছু ঘটে গিয়েছে।
চিত্ত ফুঁসে উঠে বলল, শচীশ মজুমদারকে আমি ফাঁসিকাঠে তুলব।
অশোক একটু হেসে বলল, সে সুযোগ ছোটপিসিমার দাহ হবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, আমার মনে হয়, মেজোপিসিমা বা পিসেমশাই, দুজনের কেউ হয়তো আত্মহত্যা করতে পারেন।
চিত্ত চমকে উঠে শব্দ করল, অ্যাঁ!
অশোক বলল, হ্যাঁ, পাপের প্রতিক্রিয়ার এই তো সবে শুরু।
চিত্ত অশোকের মুখের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল।