প্রায় জ্যান্ত মেশিন বনাম প্রায় মৃত মানুষ
রামকে ভক্তি না করলে নিমকহারামি হবে। রামই তো খোকন মান্নাকে বাঁচিয়েছে। খোকন কিছুদিন ধরেই চেষ্টা করছে একটা ঠিকঠাক রামভজন রচনা করার। গান্ধীজী রামধুন গাইতেন ‘জয় জয় রঘুপতি রাঘব রাজা রাম … সব কো সুমতি দে ভগবান’। খোকন এই টাইপের গান গাইতে চায় না। সবাইকে সুমতি দেবে না কুমতি দেবে সেটা রাম বুঝবে। দিনে গড়ে সাতশো টাকার মতো ব্যবস্থা করে দেবার মতো একটা প্রার্থনা গান। ‘…রঘুপতি রাঘব রাজা রাম …ডেলি সাতশো টাকা দে ভগবান’। খাতা-ডটপেন নিয়ে বসেছে কয়েকবার, কিন্তু পছন্দমতো একটাও রামভজন লিখতে পারেনি। খোকন যা হোক করে কয়েকটি রচনা করেছে। – যথা
হনুমানের গুরু তুমি দশরথের ছেলে।
কাকিমার চক্রান্তে তুমি বনবাসে গেলে।।
লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিলে আর গেল সীতা।
সীতা যদি না যাইত রামায়ণ বৃথা।। (পাঁচালী ছন্দে)
ধুর কিছু হচ্ছে না বলে এটা বাদ। এরকম আরও কিছু ধুর কিছু হচ্ছে না গুলো এরকম:
১. ভোটে যবে হেরে গেল যাবতীয় বাম
নবরূপে দেখা দিলে রঘুপতি রাম …
তোমারে লইয়া শিরে, ঘুরি ধাম ধাম
অগতির গতি তুমি পুরাও মনস্কাম৷ (রঘুপতি রাঘব সুরে)
২. এ আমার রাম দক্ষিণা রামকে জানাই প্রণাম
যার কৃপাতে আমি মোটরসাইকেল কিনলাম। (এ আমার গুরুদক্ষিণা সুরে)
৩. জয় রাম, হাম সেবক তোহারি
মাস মাস চলো কম খাও ব্যাটারি (মীরার ভজন সুরে)
শেষ রচনাটিকে নিয়ে পাঠকের একটু অসুবিধা হতে পারে। ব্যাটারি কী ব্যাপার, কেন লেখা হল ক্রমশ প্রকাশ্য।
খোকন মান্নার দাদা একটা ছোটোখাটো লেদমিস্ত্রি। দেশের বাড়ি হাওড়া জেলায়, কিন্তু কলকাতার গ্যালিফ স্ট্রিট অঞ্চলের খালপাড়ে যে সারিবদ্ধ লেদ কারখানাগুলি আছে, তার একটাতে খোকনের বড়দা কাজ করে। খোকনকেও ওই কাজে ঢুকিয়েছিল, কিন্তু খোকনের নজর বেশি ছিল অন্য দিকে। লেদ কারখানাগুলিতে যে ছাটগুলি হয়, সেগুলো কিনতে একজন আসত। মাসে একবার এসে একটা ছোটো মেটাডোর গাড়ি ভরে নিয়ে যেত। খোকন চেয়েছিল ব্যবসাটা নিজেই করবে। কিন্তু ছাঁট ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্কে ঢুকতে পারেনি। ব্যবসায় অনেক গাঁট। ছাঁট ছেড়ে গুঁড়ো ব্যবসার চেষ্টা করেছিল। লোহার গুঁড়োর একটা চাহিদা হয় কালীপুজোর আগে। লোহাচুর তুবড়িতে লাগে। আর লোহার ছোটো-ছোটো টুকরোরও একটা বাজার আছে। পেটোয় লাগে। শুধু ভোটের আগেই নয়, এর ডিমাণ্ড সারা বছরই আছে।
বোমার জরুরি উপকরণ হল ‘ইসপিলিন্টার’। পেরেক দিয়ে সবসময় কাজ হয় না। লোহার ছোটো ছোটো টুকরোও লাগে–যা বোমার ভিতর থেকে ‘হাই ইস্পিডে’ ঠিকরে গিয়ে পেরায় পেরায় বুলেটের মতো কাজ করবে। এই ব্যবসাটায় মন দিয়েছিল এবং মোটামুটি ভালো করছিল। লক্ষ্মীও আসছিল। তারপর একটা পেটোর ঠেকে পুলিশের রেইড হয়, কয়েক জন ধরা পড়ে, ইসপিলিন্টার সাপ্লায়ার হিসেবে খোকনকেও পুলিশ ধরে। এগারো দিন জেল-হাজতে থেকে জামিন পায়।
খোকনের বাবার গলায় তুলসীর মালা। খোকনের বাবা বলেছিল তোর ব্যবসায় মন গেছে, ভালো কথা তবে বাপ, অধর্ম করে ব্যবসা করিস নে। খোকন বাপের কথার অমান্যি করেনি, ও ধর্ম নিয়েই ব্যবসা করছে। ব্যবসার আইডিয়াটা পেয়েছিল ওর প্রাইমারি বন্ধু ভণ্ডুলের কাছ থেকে। ও জন্মাষ্টমীর আগে কৃষ্ণ সাজত, চৈত্রসংক্রান্তির আগে শিব, কখনো কালী। কালী সাজাটা বেশ ঝামেলার, কিন্তু কালীতে পয়সা আছে–ভণ্ডুল বলেছিল। কালী ঝামেলার কারণ রংটা করতে হয়, জিভটা করতে হয়, বুকটা করতে হয়। টাইট জুতো পায়ে পরার একটা জিনিস পাওয়া যায়, ওটা লাল রং করে নিলে ভালো জিভ হয়। নইলে সুপুরির খোল আলতায় ভিজিয়ে। মাথায় কালো রং করা পাটের চুল, হাতে ছোবড়াসুদ্ধু নারকোল, চোখ-মুখ এঁকে নরমুণ্ড। একটা অন্তত নরমুণ্ড দরকার, নইলে পাবলিক ভয় পায় না, ভয় না পেলে পয়সা দেয় না।
খোকন ইস্কুলে যেমন ইচ্ছা সেজে প্রাইজ পেয়েছিল। ভণ্ডুল যদি সিক্স অব্দি পড়ত, তবে ওটা ভণ্ডুলই পেত। ভণ্ডুল ফোরের পর আর পড়েনি। খোকন ছাই-টাই মেখে সন্ন্যাসী হয়েছিল। পরের বার মাতাল। মাতাল হয়ে ও সামান্য গালাগালও দিচ্ছিল। ও মাতাল হয়ে বলেছিল আমি হলদিয়ার সব চে’ বড়ো শেঠ। আমি হলাম মনতিরি। এটা না বললে বোধ হয় ঝামেলাটা হত না। তখন হলদিয়ার শেঠ বলতে একজনকেই বোঝাত। তেনাকে নিয়ে এ-সব ইয়ারকি ফাজলামি চলে না। ওকে বের করে দেয়া হয়। বের করে দেয়া নিয়ে বিতর্ক হয়। একদল বলে, ও কোনও অন্যায় করেনি। আইটেমটার নাম যেমন ইচ্ছা সাজো। ইংরিজিতে যাকে বলে গো অ্যাজ ইউ লাইক। সুতরাং খোকনের দোষ নেই। অন্যরা বলল–তাহলে কেউ হেডস্যার হয়ে আমাদের হেডমাস্টার মশাইকে মিমিক্রি করবে। হেডমাস্টারের মতো বগল চুলকোবে, আর বলবে পেটে বড্ড গ্যাস হয়েছে গা…সেটা ভালো হবে? তার চে’ এটা তুলেই দাও। এটা কোনও খেলাধূলোই না। তারপর খোকন আর কিছু সাজেনি, তবে সন্ন্যাসী সেজে দেখেছে ছাই মাখলে বড্ড গা চুলকোয় আর আঠা দিয়ে চুলদাড়ি আটাকলেও বড্ড চিড়িক-চিড়িক করে। সঙ সাজাতে ঝামেলা আছে।
ভণ্ডুলের বাবা ঘর ছাওয়ার কাজ জানত, ভণ্ডুল শিখেছিল কিন্তু ঘর ছাওয়ার কাজ এখন কম। খড়ের ঘর প্রায় উঠেই গেছে। ও রাজমিস্ত্রিদের জোগাড়ের কাজ করে, আর মেলা-পরব-পার্বণে ঠাকুরদেবতা সাজে। ও বলেছে ঠাকুরদেবতাতেই পয়সা বেশি।
খোকনের বাবা যখন বলেছিল ব্যবসা ভালো, কিন্তু ব্যবসায় যেন ধর্ম থাকে, তখনই ধর্ম সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে এই আইডিয়াটা মাথায় আসে। খোকন ওর দাদাকে বলে–দাদা, লেদের কাজ আমার পোষাবে না, আমার ধর্মে মতি হয়েছে। আমায় একটা দ্যাবতা বানিয়ে দাও। বডি থাকবে, হাত-পা থাকবে। আমি কুমুরটুলি থে’ কয়েকটা দ্যাবতার মাথা কিনে রেখে দেব। আর প্যাটের ভিতরে একটা ম্যাশিনের ব্যবস্থা করে দিও, সেই ম্যাশিনে হাত-পা নড়বে। খোকনের দাদা হতভম্ব। কি চায় ছোটোভাই ঠিক বুঝতে পারল না। খোকন বলল, শোন তবে, বুঝায়ে বলি।
এই যে আমাদের হাত, এই হাতের মর্মটা বুঝোতো? সেই ছোটোবেলায় পিসিমা বলত হাত ঘুরালে নাড়ু দিব নইলে নাড়ু কুথায় পাব? বলত কিনা? শোলে সিনিমার ডায়লগটা মনে কর। ইয়ে হাত নেহি ফাঁসি কা ফান্দা হ্যায়। এই হাত চিহ্নে ভোট দে’ছ–আচ্ছা দাও নাই। কিন্তু কালো হাত ভেঙে দ্যাও ক’ছো কিনা? এই হাত দে খেলা, ঘুড়ি উড়ান যাবতীয় কাজকম্মো সে সব সবাই জানি। কিন্তু এই হাতটা, দ্যাবতাদের জন্য খুব ইমপটেন। দেখবা সব দ্যাবতাদের হাতের কায়দা আলাদা আলাদা। কার্তিক এইরকম, গণেশ এইরকম, দুর্গা এইরকম, দশ হাতের মধ্যে দুই হাতটা ত্রিশূল মরার কায়দায়, কৃষ্ণর এইরকম বাঁশি বাজানোর কায়দায়… খোকন তার নিজের হস্তসজ্জায় বিভিন্ন দেবতার হাতের কায়দা দেখাতে থাকে। এবার শুন দাদা। বেশিরভাগ দ্যাবতাদের একটা হাত এইরকম।
ভোট চিহ্নের হাতের মতো সংলগ্ন করে হাতটা এগিয়ে দেখায় খোকন। এর কী মানে বুঝলা। এর মানে হল কুন ভয় নাই, আমি আছি।
দেবতাদের আমরা হাতে বুঝি, সিটা বুঝালাম, এবার বুঝাই মনীষীদিগকে আমরা কীভাবে বুঝি। যেমন দেখ শ্রীগৌরাঙ্গ। হাত দুটা উপরে এইভাবে তোলা, যিশুখ্রিস্ট হলে হাত দুটা তোলা থাকবে কিন্তু হাতের পাতা দুটা বেঁকা থাকবে। কিংবা দু’হাত কাঁধের সঙ্গে লম্বা। সোজা। এরকম। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের একটা হাত মাথার উপরে এইরকম, আর একটা হাত বুকের কাছে এইরকম। উপর থেকে হাত ইবার নিচে নামাচ্ছি। কবি সুকান্তর হাতখানা গালে। স্বামী বিবেকানন্দর হাতদুটো বুকে, একটার উপর একটা। এইভাবে। নেতাজী একখানা সামনের দিকে বাড়ায়ে রেখেছেন। গান্ধীজীর একটা হাত বাড়ানো। কিন্তু লাঠি ধরার মতো। রবীন্দ্রনাথের হাত দুটো পিছনে। কেমন কিনা? বলে–বৃক্ষ তোমার নাম কী? –না ফলেই পরিচয়।তেমন মনীষী তোমার নাম কী–না হাতেই পরিচয়।
এইবার আসল কথাটা বলি। একটা পারমেন বডি বানাতে হবে। আর হাত দুটো দু পাশে। পা নিয়া অত ভাবনা নাই। প্যাটের মধ্যে ম্যাশিন থাকবে। তার সঙ্গে সুতো থাকবে। বা তার। সেটা হাতের সঙ্গে ফিট। হাতদুটো আলগা, উটা কান্ধের সঙ্গে ফিট। হ্যাণ্ডেল থাকবে, কিংবা সুইচ থাকবে। কারেন্টে ম্যাশিন চলবে। যেমন মহিষাদলের রাজবাড়ির ঝুলনে হয়। কংসরাজা পেল্লাদকে ছুঁড়ে দেয়, কেষ্টঠাকুর কদমগাছে গোপিনীদের কাপড় চুরি করে ঝুলিয়ে রেখেছে, গোপীগণ হাত নেড়ে বলছে অমন কোরোনি, কাপড় ফিরায়ে দাও।রামচন্দ্র হরধনু উঠায়ে দিল,নারায়ণ সুদর্শন চক্র ঘুরায়ে দিল, কিষ্টঠাকুর গোবর্ধন পাহাড় উঠায়ে দিল,সবই একটা মোটর আর সুতার খেলা। কতগুলি গাঁট আর ঘাট করতে হবে, ব্যাস। আর ঘাড়ের উপর একটা চাকতি থাকবে সেখানে একটা স্লট করতে হবে, যেন মুণ্ডুখানা বসিয়ে দেয়া যায়। একদম খাপে খাপ। দরকারমতো মুণ্ডু চেঞ্জ করে দেব। শিব, কৃষ্ণ, রাম, হনুমান। কালী-মনসাও। ফিমেলদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে পোশাকের ভিতরে। পোশাক তো লাগবেই। মহাদেবের জন্য বাঘছাল ছিটের কাপড়, কৃষ্ণের জন্য ইলিক-ঝিলিক কাপড়, হনুমানের জন্য রোঁয়া ওঠার কম্বলের ড্রেস–সে-সব পরে হবেখনে। গলার চাকতিখানা নড়বে এধার-ওধার, আর মুণ্ডুখানাও ঘুরবে ডান দিক বাঁ দিক। উপর নিচ।
হ্যাঁ, আর একটা জিনিস ফিট করতে হবে। একটা ইসপিকার, সেটা মুখে রাখা যাবে না, কারণ মুখ তো পালটাবে।পেটে জালি কেটে দিয়ো, তার পিছনে স্পিকার ফিট, আর পেনড্রাইভটা পোঁ–পেছনে গুঁজে দেব। ওখানে ওঁ স্বস্তি, দীর্ঘজীবী হও বেটা, জয় শ্রীরাম সব ঠিক হো যায়গা, হরি-ই বোল, এসব কথা থাকবে। একটু অনুপ জালোটাজীর ভজনও পুরে রাখব, হনুমানের পেট থেকে রামভজন বেরুবে।
খোকনের দাদা তপন মান্না বলল যা ফিরিস্তি দিলি, খরচা আছে কিন্তু…
খোকন বলল, সে আমি দিয়ে দেব। একবার না পারি কিস্তিতে দেব। ধম্মপথে থাকলে পয়সা আসবে।
ভগবান মানুষ তৈরি করেছিল। ধর্মপথে থাকবার জন্য মানুষ ভগবান বানালো। সেমিটিক ধারণায় ঈশ্বর মাটি দিয়ে মানুষ বানিয়েছিল আর শয়তানকে আগুন দিয়ে। এরা লোহা দিয়ে বানালো। লোহার পাত। আগুনও লেগেছে বৈকি। ওয়েল্ডিং করতে হয়েছে তো।
দশ নম্বর গ্যালিফ স্ট্রিটের সম্মুখবর্তী ফুটপাতে দেবতার জন্ম হল। তিনি একের মধ্যে বহু। তিনি বহুরূপে বিদ্যমান, আদতে এক–এই শাস্ত্রবচন সত্য প্রমাণ করে দেখালেন লেদমিস্ত্রি তপন কুমার মান্নার নেতৃত্বে তিন-চার জনের একটি দল। এরমধ্যে ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি আছে, পেটাই কারিগর আছে, মোটর গ্যারেজের ‘ইলেকট্রিক মাস্টার’ ব্যাটারিআখতারও ছিল। গাড়ির সাউণ্ড সিস্টেমের ব্যাপারটা আখতার খুব ভালো বোঝে।
দেবতার পেটে ইসপিকার ফিট্ করা, পেছনে পেনড্রাইভ পয়েন্ট। ভিতরে ব্যাটারি রাখার খুপরি আর চার্জ দেবার ব্যবস্থা–সব এই টিমটা সাফল্যের সঙ্গে করল। এইজন্যই তো বলে বাঙালির প্রতিভা বিশ্বসেরা। এই যে দেবতাটির জন্ম হল, এর বুকের মধ্যে অনায়াসে একটা ‘ব’ লোগো বসিয়ে দেয়া যেত।
খোকন মান্না এবার ধর্মপথে নেমে পড়ল। হাত-পা আলাদা করে একটা বাক্সে ভরে মেলায় মেলায় ঘুরতে লাগল।
শুরু করেছিল গঙ্গাসাগর মেলা দিয়ে। জটাওলা মহাদেবের মুখ ঘাড়ে বসানো ছিল, কাঁধে রবারের সাপ, পেনড্রাইভের বোম বোম বোম বোম পেটের স্পিকার থেকে বের হচ্ছে। মাঝে মাঝে ডান হাতটা তুলে সামনের দিকে, ওঁ তৎসৎ শব্দ বেরুচ্ছে। মানুষ পয়সা দিচ্ছে। সাধু বাবাৱাও অবাক হয়ে দেখছে। যন্ত্রের মহাদেব যখন ওঁ তৎসৎ বলছে, সাধুবাবারাও জয় জয় মহাদেও, জয় শিবশংকর এই সব বলছে। খুব মজা লেগেছিল একটা জ্যান্ত মহাদেবকে দেখে। মানে, ভণ্ডুলের মতোই কেউ মহাদেব সেজেছে, সে অবাক হয়ে মেশিন মহাদেবকে দেখলে। হাতজোড় করে প্রণাম করল, আবার একটাকার কয়েনও ফেলে দিল। মেলা থেকে মেলা ধর্মপরিক্রমায় খোকন দেখেছে, একেকটা মেলাতে একেকটা দেবতার ক্রিয়া বেশি হয়। রাস-জন্মাষ্টমীর মেলায় মহাদেব চলে না, কৃষ্ণ। চড়ক মেলায় শিব, তারাপীঠে কালী বানিয়েছিল, পাণ্ডারা সরিয়ে দিয়েছে। পাণ্ডারা তারামায়ের কোনও শরিক বরদাস্ত করে না। অগত্যা রাম লাগিয়েছিল। রাম এখন সর্বত্র চলে। কাজ শুরু করার পর পর শোনপুর, পূর্ণিয়া, বক্তিয়ারপুর, ধানবাদ এ-সব মেলায় গিয়ে দেখত রাম আর হনুমান বেশি কৃপা করে। মানে, ওরাই বেশি পয়সা দেয় আর কি। আজকাল রাম আর হনুমান এধারেও ভালো কৃপা করছে। জয়দেবের মেলা, উদ্ধারনপুরের মেলা, মহিষাদলের রথের মেলা, পরকুলের মকর মেলা, এমনকি শান্তিনিকেতনের পৌষমেলাতেও রাম এবং হনুমান ভালো খাচ্ছে। খোকন ভাবল এতগুলো মুণ্ডু, এতরকম পোশাক বইবার দরকার নেই। মিছিমিছি বোঝা বাড়িয়ে লাভ কি। রামেই যখন পয়সা হচ্ছে, রামটাই ভালো করে করা যাক। গায়ে একটা বেশ সবুজ কালার পেন্ট করিয়ে, গলায় রত্নহার দিয়ে, কাঁধে ধনু, পিঠে একটা বেতের লম্বাপানা ঝুড়িতে তির। পেটের স্পিকার থেকে সব সময় ওঁ ধ্বনি, মাঝে মাঝে হাতটা সামনের দিকে উঠে গেলে দীর্ঘজীবী ভব, কিংবা হরি তৎসৎ, আর মাঝে মাঝে ভারতমাতা কী জয় লাগিয়ে দিয়ে দারুণ রেজান্ট পেল খোকন। বিশেষ করে বিহার আর ওড়িষ্যার মেলাগুলিতে। কপালে তিলক পরা লোকগুলি রামের মুখে ভারত মাতা কী জয় শুনে কেয়া বাত কেয়া বাত করে ওঠে। দশ-বিশ পঞ্চাশ এমনকি একশো টাকার নোটও ছুঁড়ে দেয়। মুখে সবুজ রং মেখে সঙ সাজা মানুষ রাম এত রোজগার করতে পারে না। মানুষ মানুষের চাইতে মেশিনকেই ভালোবাসে। মানুষ রামের চেয়ে মেশিন রামই বেশি রোজগার করতে পারে, এটা খোকন মান্নার অভিজ্ঞতালন্ধ জ্ঞান।
অল্পদিনের মধ্যেই মেশিন-রামের কৃপায় খোকন মান্নার বেশ ভালো রোজগারপাতি হল। খোকন রামভক্ত হয়ে পড়ল। রামের নানা রূপ। বোতল রামও একটা। খোকন রামসেবা করতে লাগল, এবং প্রথম যে রামভজন গুলির উল্লেখ করা হয়েছে, সে সবই ভক্তিবোধের ফসল। খোকন মান্নার সুরজ্ঞান ভালো নয়। কিন্তু রামরসে ভক্তিভাব প্রবল হলে খোকন গেয়েও ওঠে –রাম তেরা বিন দিন মেরা না গুজরে। তখন ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা মেশিন রাম বলে–বহোত বহোত আচ্ছা। বহোত খুশ হুয়া ম্যায়। সে কী গো রাম, তুমি কথা বললে? আমি তো ভাবতেই পারছি না। আরও দুটো কথা বলো। খাঁটি বাংলায় মিনতি জানায় খোকন। কিন্তু রাম আর কথা বলে না। রাম বোধ হয় বাংলাটা বুঝতে পারছে না।অযোধ্যায় জন্ম কিনা…। কিন্তু এই রামের জন্ম তো বাগবাজারে। এতো বাগবাজারি রাম। বাংলা তো বোঝা উচিত। হে রামজী, আপ বাংলা নেহি সমঝাতে? বাংলা বহোত আচ্ছা ভাষা হ্যায়, মিঠি ভাষা হ্যায়। কবিগুরু রবীন্দরনাথ কা বাংলা, নজরুল কা বাংলা। আপ বাংলা নেহি জানতে? আপ কেতনা বড়া দেবতা হ্যায়। কেতনা পাওয়ার হ্যায়। রাবণজীকা ভাই বিভীষণ শ্রীলঙ্কা ল্যাংগুয়েজ সমঝ লিয়া, লেকিন বাংলা কাঁহে নেহি…। মেরা হিন্দি আচ্ছা নেহি হ্যায় রামজী। আপনি দয়াময়। আমাকে দুটো পয়সার মুখ দেখাচ্ছেন। আমি তো ফুল বেকার ছিলাম রামজী, ছাঁট লোহার একটা ছোটো বিজনেসে ফেঁসে গেলাম, তারপর তুমিই তো আমাকে বাঁচালে।
চোখ দিয়ে জল গড়ায় খোকনের। রামভক্তি সুধারস। রামের পায়ের তলায় শুয়ে পড়ে খোকন। পাটা জড়িয়ে ধরে।
কী হল? পাটা সরিয়ে নিলেন নাকি শ্রীরাম? খোকনের তো তাই মনে হল।
খোকন বলল, হে রামচন্দ্র, কেন বঞ্চিত করো চরণে…। রেডিওর গানটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ এক্কেবারে খাপেখাপ টাইমে। রামচন্দ্র বলল–লজ্জা দিও না বস, তুমি আমার সখা। তুমি তো বন্ধু। পা ধরছ কেন?
তা বললে কি হয়? তুমি যখন জাগ্রত হয়েই গেছ,আমি প্রণাম করবই। খোকা পা আঁকড়ে ধরতে চায়। আবার পা সরিয়ে নেয় রাম।
অবশেষে জয়রাম জয়রাম করতে করতে রামের পায়ের কাছেই ঘুষিয়ে পড়ে। পরদিন আবার রামকে নিয়ে হাটে যায়। হিন্দু-মুসলমান সবাই পয়সা দেয়। মোসলমানরা কি ভক্তির পয়সা দিয়েছে? রগড়ের পয়সা। কিন্তু বিনে পয়সায় তো রগড় দেখতে পারত। কিন্তু দিয়ে দিয়েছে। খোকন বাড়ি ফিরে রামভজনা করেছে। একবাক্স লাড্ডু কিনে ডালা খুলে রামের সামনে রেখেছে, তারপর শুয়ে পড়েছে। সকালে উঠে দেখল–দুটে লাড্ডু নেই। লাড্ডুর গুঁড়ো ছড়ানো-ছিটোনো।
খোকন বাড়ির লোক, প্রতিবেশী সবাইকে দেখাল। কেউ কেউ বলল বটে ইঁদুরের কাজ, কিন্তু অনেকেই বলল–এখন রামের হাওয়া চলছে, সেই হাওয়ায় রামও চলে আসতে পারে। দেব-দেবী-অবতার-মন্ত্রীরা অনেক কিছু করতে পারতে পারে।
এতে করে খোকন মান্নার রাম বিখ্যাত হয়ে গেল। ভালোই পয়সা পিটতে লাগল। আজ এ-হাটে কাল ও-হাটে ঘুরছে। রামের সেবা করছে হনুমানের মতোই। শ্রীরামের পেটের ব্যাটারিতে নিয়মিত চার্জ দিচ্ছে, ব্যাটারিতে জল দিচ্ছে, পুলি-লিভারে তেল দিচ্ছে। ড্রেস পালটে দিচ্ছে এবং গায়ত্রী মন্ত্রর পেনড্রাইভ রামের পশ্চাতে গর্তে গুঁজে দিচ্ছে, ওর ঘরে এখন সর্বক্ষণ রামচরিতমানসের সিডি বাজে। চাইনিজ খায়, কোক খায়। রামের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়। সীতার বাপারে রাম যে একটু ভুল ডিসিশন নিয়েছিল, সেটাও একদিন বলে। রামের প্রসাদী রাম নিয়মিতই খায়।
এবার একটা বিয়ে করতেই পারে।রামই আদেশ দিয়েছেন।তবে বিয়ে করে ঘরে থাকাটাই উচিত। বাক্সপেটরা নিয়ে মেলা থেকে মেলায় ঘুরলে নববধূ কি একা থাকবে?
খোকন ঠিক করে লাইন পালটাবে।
একদিন রাতে একটু ভাবসমাধি হলে খোকন মান্না হাতজোড় করে নিবেদন করল
(রামপ্রসাদীর সুরে )
হে রঘুপতি রাঘব
আমার মনের কথা কব
বলি এবার গৃহস্তি হব
বল আমাকে ঘুরাবি কত–
মোটরের চাক্কির মতো
তোমার অনুমতি যদি পাই হে রাম,
হব সংসার ধর্মে রত।
শ্রীরামচন্দ্র বললেন–তাতা বটেই। তোমার বিয়ের বয়েস কবেই হয়ে গেছে। গৃহস্তি ধর্ম বড়ো ধর্ম। তুমি বিবাহের পুষ্প প্রস্ফুটিত করো।
খোকন আবার গাইল:
বড়ো দয়াময় তুমি হে রাম
তোমাকে থ্যাংকিউ দিলাম
তোমার অনুমতি পেলে পরে
তোমায় আমি বেচে দিয়ে
দীঘায় গিয়ে হোটেল দিতাম।
শ্রীরামচন্দ্র তখন ছড়া কেটেই বললেন–
আপনি আমার মালিক
আর আমি হলাম মাল
আমায় রাখবেন না বেচবেন
তার আমি কি বলব বাল?
খোকন বুঝলে রামচন্দ্র রেগে গেছেন।খোকন বলল, হে রাম মুখ খারাপ করছেন কেন? আপনি তো সত্ত্বগুণের লোক। আমি ভাবছিলাম–যদি একটা হোটেল দি,আপনার যত্ন হবে না।যে নেবে তাকে বলব রোজ রামচরিত মানসের সিডি বাজাতে, ভোগ দিতে, মালা দিতে। ও যদি আপনাকে নিয়ে মেলাতেও যায় আমার মতো, সে তো আপনারই ভালো।কত জনসংযোগ…।
শ্রীরামচন্দ্র বললেন–
অভিমান হঁঞেছিল ক্ষণিকের তরে,
চেক করে লইয়াছি অতি ত্বরা করে।
তোমার কার্য্যসিদ্ধি হইয়াছে এবে।
নিজস্বার্থ প্রত্যেকেই বুঝে লয় ভবে।
কি আর বলার আছে। কী-বা কব আর
তোমাদেরই হস্তে গড়া রাম অবতার
মোরে বেচিবে না মন্দিরিবে তূমি করো ঠিক
আমি রাম, মাল মাত্র তুমিই মালিক।
সামান্য নিবেদন করি করজোড়ে
সের দরে বেচিও না কালোয়ার ঘরে।
হাতুড়ি পিটানি আমি সহিব কেমনে
নাকি গলাইয়া দিবে মোরে তাই বা কে জানে!
খোকন বুঝল এই রাম সত্যিই জাগ্রত।নইলে ব্যথালাগার কথা বলছেন কেন? একবার মনে হল–শাস্ত্রে দেহ কিছু নয়, সামান্য ভাণ্ড মাত্র। রাম দেহ নিয়ে এত ভাবছেন কেন? আচ্ছা, মুণ্ডুটা চেঞ্জ করে যদি কার্তিক করে দেয়া যায়। যদিও কার্তিক ওর স্টকে ছিল না, কৃষ্ণ ছিল।কৃষ্ণর মুণ্ডু বসিয়ে দিলে কি হয় দেখতে ইচ্ছে করল।
কিন্তু ঘাড়ে রামের মালা এঁটে বসে আছে। সরানো যাচ্ছে না।
তবে কোনও সন্দেহ নেই এই রাম মহিমাবান।
খোকন মল্লিক বাইরে বলতে লাগলো এটা কথা-বলা রাম। লোকে বলে জানি তো পেটে ইসপিকার পিছনে পেনডেরাইভ। খোকন বলতে চেয়েছে–তা নয়,অন্য কথাও রামের সঙ্গে হয়। লোকে বিশ্বাস করেনি। একজনই বিশ্বাস করল, ওর নাম হারুন শেখ। ছেলেটা বেকার। টুকটাক ব্যবসাপাতি করে। আনাজপাতি, গুড়, মাছ যখন যা হয়। হারুনের ডাকনাম হারু। খোকনের গাঁয়ের ছেলে। খোকনের চেয়ে বয়সে একটু ছোটো। বে-থা করেনি। অবস্থা আর একটু ফিরলে ও-সব করবে। তবে এই মেশিনরাম যে খোকনকে কৃপা করে খোকনের অবস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে, ও শুনেছে। খোকনদা এটা বেচে দিয়ে হোটেল করে থিতু হতে চায়। হারুন ভাবে ওকেও তো হাটেবাজারে ঘুরতে হয়, ও না হয় লাউ-কচু-কুমড়ো না নিয়ে রাম নিয়েই ঘুরবে। কচু-কুমড়োর চেয়ে রামেই পয়সা বেশি হবে সেটা হারুন ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে।
হারুন খোকনকে বলে–তোমার রাম অন্য কারার কাছে বেচো না, আমি বলে রাখলাম বেচলে আমাকেই বেচবে।
খোকন বলল, দাম দিতে পারবি?
হারুন, মানে হারুও তো বেচাকেনা করে খায়। ও দরাদরি জানে। ও বলে কত আর দাম হবে? সলিড লোহা তো নয়, ভিতরটা ফাঁপা। পাতলা চাদরে বানানো। পনেরো কেজির বেশি হবে না। যন্ত্রপাতির দামও ধরে নাও। কত আর হবে? খোকন বলে শুধু লোহা আর যন্ত্রপাতি, ব্যাস?
হারু সংশোধন করে হ্যাঁ হ্যাঁ। মেকিং চার্জও আছে।
খোকন বলে–হয়ে গেল? মহিমার দাম নেই? দেবত্বর দাম নেই?
হারু বলে–সে আর কত।
খোকন বলে–আরে তুই দেবত্বর কী বুঝবি! এই রাম খুব জাগ্রত হয়ে গেছে। অনেক টাকা দাম হয়ে গেছে এখন। খোকন আর-এক ধাপ উপরে উঠলে হয়তো বলত ভ্যালু অ্যাডিশন হয়ে গেছে।
হারু বলল–বুঝেছি। গুডউইলের কথা বলছ, সে জন্য না হয় কিছু ধরে দেয়া যাবে।
খোকন বলল, গুডউইল নয় রে, দেবত্ব। দেবত্ব। তুই এর মর্ম বুঝবি না৷ তোদের ধর্মে এসব থাকে না।
হারু বলে–ধর্মের কথা আসে কেন? মোসলমানের ছেলে বলে আমার কাছে যদি রাম বেচতে না চাও তবে আমার বলার কিছু নেই। তবে যদি…
খোকন খেঁকিয়ে উঠল।–বিজনেসে ধর্মের কথা আসে কেন? ধর্ম নিয়ে বিভেদ আমার পছন্দ নয়। যে আমাকে উপযুক্ত দাম দেবে, আমি রাম তাকে দেব। বিজনেসে ধর্ম ঢোকাতে আমি রাজি নই।
খোকন রামের মহিমার কথা প্রচার করেছিল, এটা করে দুটো পয়সা করেছে খোকন, সেটা নিয়ে কিছু বলার নেই। ম্যাজিক দেখিয়ে বা পুতুল খেলা দেখিয়ে যে-কেউ পয়সা করতেই পারে।
যে দু-এক জন কিনতে চেয়েছিল, তারা মহিমার জন্য বেশি পয়সা যোগ করেনি। বলেছে এটা বানাতে তোমার যা খরচ হয়েছে সেটা দুব আর না হয় দুশো বেশি ল্যাও। তার চেয়ে হারুর কাছেই বেশি টাকা পাওয়া গেল। তাই হারুকেই বেচে দিল।
একজন পড়শি বলল,এটা কিন্তু ঠিক হল না। একজন মোসলমানের কাছে রামকে বিক্কির করা ঠিক হল নি। খোকন বলতেই পারত–এই রামকে যারা তৈরি করেছিল সেইটি যে একটা মুসলমান ছিল। কিন্তু বলল–রাম কোন যুগে জন্মেছিল? ত্রেতা যুগে। আর মোসলমান ধর্ম হয়েছে কলিযুগে। রামের সময় মোসলমান ধর্মই ছিল না। সুতরাং রাম মোসলমান কি ব্যাপার কী বৃত্তান্ত জানেই না। তাছাড়া তুমি যখন কিছু বিক্কির করো কারো কী ধম্মো জেনে বিক্কির করো?
এবার হারুন শেখ ধর্মপথের পথিক হল। মানুষ দেখে তো ধর্ম বোঝা যায় না। গাঁয়ের লোকজন হারুর ধর্ম জানে, কিন্তু বাইরের লোক তো জানে না তা। খোকনের পথেই হারু ওই মেশিনে রামের লীলা দেখাতে লাগল। এবং সত্যিই কচু-কুমড়োর চেয়ে বেশি পয়সাই দিতে লাগল। হাতে দুটো পয়সা আসায় একটু শখ আহ্লাদ গজাতে লাগল। একটু বিলিতি-টিলিতি…।
বিলিতির মধ্যে আবার রামটাই সস্তা। খোকনও বলেছিল–রামচন্দ্রর সঙ্গে কথা বলতে গেলে একটু রামপ্রসাদ খাস। তাছাড়া খোকন যা-যা বলেছিল তাই-তাই করার চেষ্টা করেছে। রামধুন, ধূপকাঠি, সব। আর রামশরণ নেবার পর থেকে বিবেকের আহ্বানে বড়ো গোস্ত খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছে হারু। তবে রামকে–মানে রামের শরীরটা একটু অন্যভাবেও ব্যবহার করে হারু। যখন অরিজিত সিং, শ্রেয়া ঘোষাল, কুমার শানু শুনতে ইচ্ছে হয়, তখন রামের পিছনের সকেট আর পেটের স্পিকারটা ব্যবহার করতেই হয়। তাতে রাম কিছু মনে করেন না। সেটা বলেও দিয়েছেন তিনি। শরীরটা কিছু নয়। হস্ত পদং শরীরং কীসব বলেও ছিলেন শ্রীরাম, অত মনে নেই। হ্যাঁ, রামের সঙ্গে হারুর একটা কথা হয় বৈকি। খোকনদা মিথ্যে বলেনি। রাম তো বলেছে হারুকে–পারতিস তোরা, তাদের নবিকে নিয়ে এসব করতে! দেহের ছাল ছাড়িয়ে নুন লাগিয়ে দিত। হারু বলেছে– একদম ঠিক কথা বলেছেন স্যার।
কাছাকাছি মেলাস্থলগুলি ঘোরা হয়ে গেল।কয়েকটি অঞ্চল বাকি আছে। মুসলমান-প্রধান হাটগুলিতে শতকরা ৭০-৮০ জনই মুসলমান।ওসব জায়গায় একদম যাওয়া হয়নি। ওখান থেকে ভালো রোজগারপাতির সম্ভাবনা আছে।
হারু ভাবল ওসব জায়গায় যাবে।
প্রথমে করিমপুর।
পেনড্রাইভে নতুন কয়েকটি কথা সংযোজন করল। দোকানে বললেই পেনড্রাইভে ভরে দেয়। যেমন কলেমা। লা-এলাহা ইলাল্লাহো মোহম্মাদুর রাসুলউল্লাহ। কয়েকটা দোয়া। সোভানাকা আল্লা হোম্মা অ বেহামদেকা…। তাছাড়া আর একটা কাজও করেছে হারুন।এক গ্রাম্যকবির মুখে শোনা দুটো লাইন ও পেনড্রাইভে দুঃসাহসিক ভাবে ঢুকিয়ে নিয়েছে।
সীতারে তালাক দিয়া বড় মনস্তাপ
হে আল্লা হে আল্লা তুমি করো মোরে মাপ।
এইসব হাটে যখন রামকে নিয়ে যায়,রামের মাথায় একটা টুপি পরিয়ে দেয়। রামের পেট থেকে দোয়াদরূদ, কলেমা বের হয়। আবার মাঝেমাঝে সীতারে তালাক দিয়া বড়ো মনস্তাপও শোনা যায়। আবার তৎসৎ কিংবা গায়ত্রী মন্ত্রও পুরো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
বেশ সুখে আছে হারুন শেখ।
আহা রামরাজ্য এমনই।
একদিন খোকন মান্না রাত্রিবেলা হারুন শেখের বাড়ি এল। একটু টলছিল।
প্রসাদ নিয়েছে।খোকন বলল–আমার শ্রীশ্রী রামচন্দ্রকে দেখতে এলাম।
হারুন বলল–ভালো কথা। দেখবে এসো।
জয় শ্রীরাম।
ভেতরে যায়।
প্রসাদ পায়।
খোকন রামের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে সে কী? মাথায় টুপি, মুখেতে দাড়ি? রামের থুতনিতে দাড়ি গজালো কী করে? তুই শালা দাড়ি পরিয়েছিস নাকি?
হারুন বলল রাম বড় দয়ালু। কোনরকম আপত্তি করেনি। ভক্তের ভালো চান তিনি। ব্যবসা করি দুটো খাই। রামচন্দর সেডা বোঝেন কিনা।