প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প
অটোচালক জামিলের সেই ব্যাগ পাওয়ার পাঁচ বছর আগের কথা।
কেন্দ্রীয় কারাগার। ক্লিন শেভড এক ভদ্রলোক কারাগারের সাক্ষাৎকক্ষে বসে আছেন। ইন্দ্রলুপ্ত, অভিব্যক্তিহীন চেহারা। হাতে একটা কালো রঙের সাইড ব্যাগ। ব্যাগটা কোলের ওপরে আড় করে রাখা। চট করে দেখলে মনে হবে কোন শোরুমের ডামিকে জামা কাপড় পরিয়ে এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এটা বিশেষ সাক্ষাৎকক্ষ। ভিআইপি বন্দীদের জন্য বরাদ্দ এটি। তবে জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন বছর চলছে বলে এখন ভিড় কম। দুটো টেবিল আর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু তিনটে চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। নির্বাচনের সময় এখানে একটা সোফা আর প্লাস্টিকের ওয়ারড্রোব থাকে। এখন নেই। ক্লিন শেভড ভদ্রলোক সেই চেয়ারেরই একটায় বসে আছেন। দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা বাজছে। সম্পূর্ণ রুমটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাই বাইরে থেকে আলো আসছে না। পুরনো একটা ফ্লুরোসেন্ট লাইট জ্বলছে টিম টিম করে। তাতে রুম আলোকিত হওয়ার থেকে অন্ধকারই বেশি হয়েছে।
দেয়ালঘড়িতে এগারোটা এগারো বাজার সাথে সাথে ধড়াম করে সাক্ষাৎকক্ষের লোহার দরজাটা খুলে গেল। এক বিশেষ পোষাক পরিহিত মাঝারী গড়নের একজন ভদ্রলোক ঢুকলেন।
“খুব সরি। দেরি হয়ে গেল একটু।” ভদ্রলোক চেয়ার টেনে বসলেন। প্রথম দেখাতেই মনে হল ভদ্রলোক সজ্জন এবং মিশুক। মুখে একটা মৃদু হাসি সবসময় লেগেই আছে। সারাক্ষণ জেলখানার কয়েদীদের সাথে থাকা একজন মানুষের কাছে এটা অপ্রত্যাশিত। ভদ্রলোক হাসি মুখে বললেন, “সকালে এসেই সারারাতের জমা ঝামেলা মেটাতে হয়। কিছু দিয়েছে আপনাকে? চা টা?”
ভদ্রলোকের মনে হল, তিনি একটা মুর্তিমান রোবটের সামনে বসে আছেন। অভিব্যক্তিহীন নির্লিপ্ত চাহনি। সেই দৃষ্টি যেন বরফের ছুরির মত তার ভেতরটা চিরতে শুরু করল। এক উষ্ণ সৌজন্যের বদলে এমন শীতলতা আশা করেননি। খানিকটা গুটিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
“না না ঠিক আছে।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় ক্লিন শেভড ভদ্রলোক কাঠ কাঠ গলায় বললেন। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে জানালেন, “আমি ডঃ বশির জামান।” পুলিশের পোষাক পরিহিত ভদ্রলোকের মনে হল, তিনি একটা মৃতদেহের সাথে করমর্দন করলেন। কঠিন আর বরফ শীতল হাত। উষ্ণতার বদলে একটা শীতলতা দিয়েই যেন পরিচয় পর্বটা শেষ হল। তিনি বললেন, “আমি এখানকার জেল সুপার, শংকর সাহা। কাল রাতে ফিরোজ স্যার আমাকে ফোন করে আপনার কথা বলেছেন। বলেন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
ডঃ বশির জামান কথা বাড়ালেন না। কালো সাইড ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
—এই তেরোজন আসামীদের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই।
ডঃ বশির জামান তার কালো সাইড ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের ফাইল বের করে টেবিলের ওপরে রাখলেন। জেলার সাহেব শংকর সাহা ফাইলটা হাতে নিয়ে খুলতেই তার সারা শরীরের মাংসপেশী শক্ত হয়ে গেল। এই ফাইল কিভাবে এই লোকের হাতে গেল!
এই ফাইলে দেশের সবথেকে ভয়ংকর তেরোজন আসামীর তথ্য আছে। এদেরকে যেখানে রাখা হয় সেটা মাত্র তিনজন মানুষ ছাড়া কারও জানার কথা না। প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, প্রধান বিচারপতি আর জেল সুপার। এখানকার কয়েদীদের বেশির ভাগই জনসাধারণের কাছে মৃত। সবাই জানে এদের অনেকের হয় ফাঁসি হয়েছে নয়ত এনকাউন্টারে মারা গিয়েছে। এদের কেউ ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা পিশাচ, কেউ ছিল নৃশংস ভাড়াটে খুনি, কেউ ছিল সুচতুর জোচ্চোর আর কেউ ছিল ব্যাংক ডাকাত। ভয়ংকর অপরাধী সংগঠন ‘কংসচক্রের’ মুল হোতা কায়জুদ্দিন, হিজড়াদের একটা সহিংস সংগঠনের মূল হোতা প্রমিত- এদের মধ্যে অন্যতম। এরা যতদিন জনসমক্ষে ছিল, ততদিন ছিল মুর্তিমান অভিশাপ।
আজ না হয় কাল এদের প্রত্যেককে পুলিশের গুলিতে মরতেই হত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মহোদয় সৈয়দ তফিসুল বারী এদের সাথে একটা চুক্তি করেন। এদেরকে আজীবন বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে। কেউ জানবে না এরা জীবিত। কিন্তু বদলে এদের প্রত্যেককে তার কথায় উঠতে বসতে হবে। বদলে এরা এদের জীবন ভিক্ষা পাবে, পেয়েও ছিল। ‘মিথ্যা মৃত্যুর’ মধ্যে দিয়ে এরা নতুন জীবন পেল। এদের নতুন জায়গা হল এক অজানা জেলখানায়।
জেলার শংকর সাহার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। সৌজন্য মুছে গেল। তিনি ফাইলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “এই ফাইল কোথায় পেলেন আপনি?”
বশির জামান কোন উত্তর দিলেন না। শংকর সাহার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত ইচ্ছা তার ভেতরে দেখা গেল না। শংকর সাহা আবার প্রশ্ন করলেন, “ফাইলটা কোথায় পেলেন বললে খুশি হব।”
বশির জামান চশমা পরলেন। তারপর বললেন, “সেটা আপনার না জানলেও চলবে। ভুলে যাবেন না মেজর জেনারেল ফিরোজ আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাকে যে কাজ দুটো দিয়ে গেলাম করে রাখবেন। আমি আগামী পরশু আসব। এসে এদের সাথে কথা বলব। এই ব্যাপারে তৃতীয় কারও সাথে কথা বলবেন না।”
বশির জামান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার জুতার সোলের গট গট শব্দ সাক্ষাক্রমে প্রতিধ্বনিত হল। তারপর লোহার গেট খোলার শব্দ। তারপর সব চুপচাপ।
শংকর সাহা পাথরের মত চেয়ারটাতে বসে থাকলেন। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। মেজর জেনারেল ফিরোজ হক প্রতিরক্ষা তো বটেই প্রশাসনেও যথেষ্ঠ প্রভাবশালী লোক। এত উচ্চযোগ্যতা সম্পন্ন লোক আর দ্বিতীয়টা নেই। কিন্তু তার এমন আবদার রাখা প্রায় অসম্ভব। এই অপরাধীদের সাথে কথা বলতে চাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগবে। মেজর ফিরোজ কি সেই অনুমতি নিয়েছেন? নাকি তিনি একবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন করে শুনবেন? কি করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। তাছাড়া কেন মেজর জেনারেল এই লোকগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে চাইবেন? কেন একজন লোক পাঠাবেন এই তেরোটা মূর্তিমান অভিশাপের সাথে যোগাযোগ করার জন্য?
তফিসুল বারীর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিন্তু তফিসুল বারীর সাথে কথা বলার মত সময়ও হাতে নেই। মাঝখানে মাত্র একদিন। আর এই বশির জামান কোথাকার কে তাও তো জানেন না ঠিক মত। সব মিলিয়ে শংকর সাহা এক চরম বিভ্রান্তির ভেতরে পড়লেন।
এই কাজটা করলে তার চাকরি তো যাবে নিশ্চিত। তাছাড়া দেশের মানুষের জীবন এই ফাইলের ভেতরে বন্দী আছে। এই ফাইল খোলা মানেই নরক গুলজার।
শংকর সাহা ফিরোজ সাহেবকেই ফোন করবেন বলে ঠিক করলেন। ফাইলটা হাতে নিয়ে উনি সাক্ষাৎকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
চেম্বারে গিয়ে ফিরোজকে উনার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে ফোন করলেন। ওপাশে কয়েকবার ডায়াল টোন শোনা গেল। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। তিনি আবার চেষ্টা করলেন। ফলাফল একই। এভাবে প্রায় চতুর্থতম চেষ্টার পর ওপাশ থেকে মেজর ফিরোজের গলা ভেসে এলো।
“বলেন শংকর সাহেব। বশির সাহেবের সাথে কথা হয়েছে?”
“জী হল। আচ্ছা। বলছিলাম কি……”
“বলেন?”
“স্যার, ডঃ বশির জামান যে কাজটা করতে বলছেন সেটা করা তো প্রায় অসম্ভব। এই ফাইলটা খুবই কন্ট্রোভার্শিয়াল। এরা…এরা এক একটা জানোয়ার। বেপরোয়া খুনি। আপনি সবটা জানেন না হয়ত। আপনি ফাইলটার সম্পর্কে সব জেনে আমাকে কাজটা করতে বলেছেন তো স্যার?”
“আপনার কি মনে হয় আমি ফাইলটা না পড়েই আপনার কাছে লোক পাঠিয়েছি?”
“না না স্যার, ছি ছি, আমি সেটা বলছি না। বলছি, আসলে, খুব রিস্কি কাজ হয়ে যায় স্যার। আপনি বলছেন বলে নাও করতে পারছি না, আবার কাজটা করারও সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু এই আসামীগুলো মানুষ না স্যার। এরা এক একটা জন্তু।”
“শংকর সাহেব, একটা জরুরী কাজেই এদের সাথে কথা বলতে হচ্ছে। একটা গবেষণার কাজে এদেরকে লাগবে। তাছাড়া মেজর জেনারেল হিসাবে যে কোন অপরাধীর সাথে আমার কথা বলার অধিকার আছে। বশির সাহেব পরশুদিন যাবেন, আপনি ব্যবস্থা করে রাখবেন।”
“প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগবে স্যার। কোন অথরাইজেশান ছাড়া ওদের সাথে দেখা করানো আমার পক্ষে সম্ভব না।”
ওপাশে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা।
“আপনি আমার কাছে অথরাইজেশান চাচ্ছেন শংকর সাহেব?”
“শুধু আমার দায়িত্বটা পালন করছি স্যার।”
“আচ্ছা। অথরাইজেশান যেন না লাগে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
ফিরোজ লাইনটা কেটে দিলেন। শংকর সাহেব ফাইলটা টেবিলের ওপরে ফেললেন। তারপর টেবিলের ওপরে রাখা কাঁচের গ্লাস থেকে পানি খেলেন। মেজর জেনারেলের ওপরে কথা বলতে পারাটা তার আয়ু যেন দুই বছর বাড়িয়ে দিল। সৎ সাহস আসলেই মানুষকে নতুন করে জন্ম দেয়। শংকর সাহার বুকটা অনেকখানি ফুলে গেল। দেশের স্বার্থে এতটুকু করা তার দায়িত্ব। কালকেই তিনি তফিসুল বারীর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।
সেইদিন রাতে জেলখানার মহিলা ইউনিটের চারশ সতেরো নম্বর সেলের মেয়েটার গায়ে আগুন লেগে পুড়ে মারা গেল। কেউ দেখল না। কেউ জানল না কিভাবে তার গায়ে আগুন লাগল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেল, হঠাৎ করেই মেয়েটির সেলে আগুন। মহিলা গার্ড আসতে আসতেই মেয়েটাকে আগুন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। অদ্ভুতভাবে আশে পাশের কেউ কোন চিৎকারও শুনতে পেল না।
মেয়েটির নাম ছিল জুঁই। জিনাতুল তাসমিয়া জুঁই। যার একমাত্র ভাই পাগলের মত ছোটাছুটি করে বোনের জামিনের কাগজ পত্র জোগাড় করছিলেন।
****
শংকর সাহা প্রায় আধ ঘণ্টা হল ফিরোজ হকের বসার ঘরে বসে আছেন। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তাকে ঘিরে মশাদের মহাভোেজ বসেছে। কিন্তু সেদিকে খুব একটা মনোযোগি মনে হচ্ছে না তাকে। আজ সারাদিন মিডিয়ার লোকজন তাকে শিকারী কুকুরের মত যেভাবে খুঁজেছে, তার কাছে এই মশার অত্যাচার কিছুই না। তিনি দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তার ওপরে থুতনিতে ভর দিয়ে বসে আছেন। দৃষ্টি মেঝের দিকে। দুপুরে ফিরোজ ফোন দিয়ে বললেন, “সন্ধ্যায় আমার এখানে ডাল ভাত খাবেন শংকর সাহেব। চলে আসবেন।” তাই এখানে আসা। দাওয়াত খাওয়ার মত মন মানসিকতা এই মুহূর্তে শংকর সাহেবের নেই। কিন্তু ফিরোজ হকের দাওয়াত অগ্রাহ্য করাটাও সম্ভব না। জুঁই নামের মেয়েটার আত্মহত্যার ব্যাপারে কারণ দর্শাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার কাছে চিঠি এসেছে বিকেলে। খুব শীঘ্রই তদন্তও শুরু হবে। চাকরিটা তো যাবেই, সাথে জেল সুপার হয়ে জেলের ভাতও খেতে হবে।
বসার ঘর থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন শংকর সাহেব। বৃদ্ধ ছোট ছোট পায়ে একবার বাম থেকে ডানে যাচ্ছে, আর একবার ডান থেকে বামে। বাম থেকে যখন ডানে যাচ্ছে তখন তার হাতে একটা বাটি থাকছে। আর যখন ডান থেকে বামে যাচ্ছে তখন তার হাত থাকছে খালি।
শংকর সাহেব দেয়ালঘড়ি খুঁজলেন। দেয়ালে কোন দেয়ালঘড়ি নেই। কোন ক্যালেন্ডার নেই। একটা অনাড়ম্বর বসার ঘর। যেখানে একটা টিভিও নেই। নেই কোন প্লাস্টিকের শোভাবর্ধক ফুল গাছ। পুরো ঘরে চোখে পড়ার মত কিছু থাকলে সেটা একটা অ্যাকুরিয়াম। অ্যাকুরিয়াম থেকে আসা গাঢ় নীল আলোতে শংকর সাহেবকেও নীল দেখাচ্ছে। অন্য সময় হলে শংকর সাহেব অবশ্যই মাছ দেখতেন। তিনি যথেষ্ট শৌখিন মানুষ। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি নিজেই অ্যাকুরিয়ামের মাছ হয়ে গিয়েছেন। যেদিকেই যান, শুধু কাঁচের দেয়াল।
“শংকর সাহেব?”
শংকর সাহা চমকে উঠলেন। ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে একটা সাদা পায়জামা আর হলুদ ফতুয়া। তিনি বললেন, “আসেন আসেন। ভেতরের ঘরে এসে বসতেন। রুস্তম কিছু বলে নাই?”
শংকর ফিরোজ সাহেবের পেছন পেছন ভেতরে গেলেন। তার ধারণা ভুল ছিল। ফিরোজের পরনের ফতুয়াটা আসলে নীল। নীল আলোতে হলুদ মনে হচ্ছিলো। মেজর জেনারেল ফিরোজকে কেমন ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ লাগছে ফতুয়া পরায়।
শংকর যেই ঘরটাতে ঢুকলেন সেটা ডাইনিং স্পেস। ডাইনিং স্পেস থেকে যতগুলো ঘর দেখা যাচ্ছে তার একটাতেও আলো জ্বালানো নেই, অন্ধকার। ডাইনিং স্পেসটার মাঝখানে ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলে মাত্র তিনটা চেয়ার। এতবড় ডাইনিং স্পেসে টেবিলটা অনেক বেশি ছোট মনে হচ্ছে।
“কি দেখছেন শংকর সাহেব?” ফিরোজ বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন।”টেবিলটা অনেক ছোট হয়েছে তাই না বলেন? একা থাকি তো। এই জন্য প্রান্তিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করি।” কথাটা বলেই মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “বসেন শংকর সাহেব। কি হল? রুস্তম? ভাত নিয়ে আসো।”
টেবিলে বেশ কয়েক রকমের পদ আছে। সবগুলোই নিরামিষ পদ। ডালও আছে, ভর্তা দুই রকমের দেখা যাচ্ছে। কলাইয়ের ডালের সাথে পালং শাকের তরকারি। রুস্তম নামের বৃদ্ধ লোকটা ভাত নিয়ে আসল। একটা বয়োবৃদ্ধ লোক এভাবে কাজ করছে দেখে শংকরের খারাপ লাগল। রুস্তম চলে গেল না। একটু দুরেই একটা ছোট টুল পেতে বসে থাকল।
শংকর প্লেটে ভাত তুলে নিলেন। একটা তরকারী তুলে নিলেন। শংকর খেয়াল করলেন, ফিরোজ খুব ছোট ছোট লোকমা মুখে দিচ্ছেন। খুব আস্তে আস্তে খাচ্ছেন। হঠাৎ ফিরোজ সাহেবের চোখে চোখ পড়াতেই শংকর চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
ফিরোজ এক চামচ ডাল নিতে নিতে বললেন, “সব মানুষ নিজের অজান্তেই একটা সাধারণ ব্যাপার মেনে চলেন এটা জানেন শংকর সাহেব? সুখ সর্বোচ্চকরণ আর দুঃখ সর্বনিম্নকরণ।”
শংকর সাহেব মাথা নিচু করে ভাত খেতে লাগলেন। গত রাতের ঘটনা তাকে অনেক বেশি ছোট করে ফেলেছে। এই মুহূর্তে কিছু বলার মত মন মানসিকতা নেই তার।
“আমাদের বিশ্বাস বলেন, আমাদের কাজ বলেন, আমাদের বেঁচে থাকার সব কিছুই এই একটা উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে। আপনি স্বর্গে যেতে চান, কারণ আপনি শুধু সুখই সর্বোচ্চ করতে চান না, আপনি নরকের দুঃখ থেকেও বাঁচতে চান। নাকি?”
শংকর একটু আলু ভর্তা তুলে নিলেন। ভর্তা দিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে দিতেই বুঝলেন, এমন চমৎকার ভর্তা তিনি আজ পর্যন্ত খাননি। মুখে দিতেই মাখনের মত গলে গেল।
ফিরোজ সাহেব আধ চামচ ভাত তুলতে তুলতে বললেন, “আমরা এই সুখ সর্বোচ্চ করতে গিয়ে কত পাপ যে করে ফেলি। কিন্তু পাপ করলে পাপের প্রায়শ্চিত্তও করতে হয়। পাপ যেমন মানুষ জন্য অবধারিত, প্রায়শ্চিত্তও তাই।”
শংকর ফিরোজ সাহেবের দিকে তাকালেন। ফিরোজ হক তাকে কি বলছেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। অথবা বুঝেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছেন যেন যেটা তিনি মনে মনে ভাবছেন সেটা না বলা হয়। ফিরোজ সাহেব তাকে শুধু শুধু জ্ঞান দেওয়ার জন্য ডেকে আনবেন সেটা সম্ভব না। এই কথাগুলো আসল কথার পূর্বাভাস মাত্ৰ।
“শংকর সাহেব, পরশু আপনার ওখানে তদন্ত শুরু হবে। চার সদস্যের কমিটি। কমিটিতে কে কে থাকবে সেটা আমি জানি। আপনি থাকা সত্ত্বেও কি করে একজন কয়েদী জেলের ভেতরে কেরোসিন জোগাড় করল? কি করে আগুন জোগাড় করল? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আপনাকে যেগুলোর উত্তর সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই।”
শংকর এই প্রথম মুখ খুললেন, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত বের করে ফেলতে পারব স্যার। আমার বিশ্বাস আমাকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
ফিরোজ সাহেব মুচকি হাসলেন। কথার ভেতরে ‘হয়ত’ চলে এসেছে। শংকর ভয় পেতে শুরু করেছে। ভয় আর লোভ দেখিয়ে যে কাউকে বশ করা যায়। প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে যেতে হবে।
“বের করতে করতে দেখবেন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে শংকর সাহেব। এই মেয়েটাকে আপনি কতটা নোংরাভাবে ব্যবহার করেছেন সেটারও রঙিন কিছু গল্প বের হয়ে যাবে। ছয় সাতজন সাক্ষীও জুটে যাবে। আদালতে একটা কল্পকাহিনী লেখা হয়ে যাবে এক সপ্তাহের ভেতরে। শেষমেশ কি হবে জানেন?”
শংকর খাওয়া থামিয়ে দিলেন। তার গলা দিয়ে ভাত নামছে না। তার আঙুলগুলো এলোমেলোভাবে ভাতের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ফিরোজ খাওয়া শেষ করে শূন্য প্লেট রেখে উঠে পড়লেন। এই প্রশ্নের উত্তর না শংকর শুনতে চান না ফিরোজও বলতে চান। তিনি হাত ধুয়ে টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে বললেন, “ওই তেরোজনের ফাইলটা আপনার আর দরকার নেই শংকর সাহেব। মনে হচ্ছে এক সপ্তাহের ভেতরেই নতুন জেলসুপার চলে আসবে। আর আপনি থাকলেও ওটা এখন আমাদেরকে হ্যান্ডেল করতে হবে, আপনার কিছু হয়ে গেলে, মানে আপনি না থাকলেও আমাদেরকেই হ্যান্ডেল করতে হবে।”
কিছুক্ষণ বিরতি। রুস্তম এসে এঁটো প্লেটটা তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর ফিরোজ আবার বললেন, “কিন্তু আমি চাই আপনি থাকেন। আমি আপনার মত একজন বন্ধুকে হারাতে চাচ্ছি না।”
তারপর শংকরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “মন খারাপ করে থাকবেন না। বাড়ি যান। বৌদিকে বলেন আমি কাল আপনার বাড়িতে দুটো ডাল ভাত খাব। খাওয়া দাওয়াও হল, ফাইলটাও নেওয়া হল। সুতপা কোন ক্লাসে উঠল যেন?”
শংকর সাহা হাতের ভাতগুলো ঝেড়ে ফেলে বললেন, “ক্লাস নাইনে।” সুতপার প্রসঙ্গ উঠতেই হঠাৎ খুব অস্থিরতা কাজ করল শংকরের ভেতরে। উনি পেছন ঘুরে বললেন, “প্রধানমন্ত্রী জানতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে স্যার। কেন বুঝছেন না? আপনি জানেন, কে ওই গোপন জেলখানায় যায় না যায় সব কিছু প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। ওখানে ঢোকার জন্য উনার অনুমতি নিতে হয়। নাহলে ওই জেলখানার দেয়াল পার হওয়া অসম্ভব। স্পেশাল ফোর্সের সব থেকে দক্ষ গার্ডরা ওটা পাহারা দেয়। ওরা জিজ্ঞাসা করবে না কিছু। অথরাইজেশান ছাড়া গেলে গুলি করবে। আমার একার ওপরে এইটা নেই। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি?”
ফিরোজ সাহেব চেয়ার টেনে আবার খাবার টেবিলে বসলেন। চেয়ারটা শংকর সাহার খুব কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “সব কিছু ঠিক করা আছে। আপনি শুধু বশির জামানকে ওই জেল পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। উনাকে চিনিয়ে দেবেন। জেলখানাটার লোকেশন কোনভাবেই বের করতে পারিনি আমরা। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ছাড়া একমাত্র আপনিই আছেন যে ওই জেল চেনে। ওখানে যেসব গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয় তাদেরকেও ওটার ঠিকানা জানানো হয় না, আপনি তো জানেন। আপনি বশিরকে চিনিয়ে দেবেন, বাকিটা উনিই করবেন। কোন অথরাইজেশান লাগবে না।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। ফিরোজ খাবার টেবিলে দুই হাত রেখে কি যেন ভাবলেন। শংকরের চোখে মুখে এখনও বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তিটা কাটাতে হবে। তিনি বললেন, “দেখেন শংকর সাহেব, এই যে তেরোজন আসামী, এদের কিন্তু বেঁচে থাকার কথা না। আপনার কি মনে হয়? এদেরকে কেন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে কখনও একবারও ভেবেছেন?”
শংকর মাথা নিচু করে থাকলেন। তিনি এরকম কিছু ভাবেননি। ফিরোজ আবার বললেন, “এখানে যা কিছু হোক না কেন, কেউ প্রকাশ করতে চাইবে না শংকর সাহেব। এ কথা মিডিয়াতেও ফ্ল্যাশ হবে না। হলেই প্ৰশ্ন উঠবে, এদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে কেন? এরা যদি কোন কারণে এখন মারাও যায় তাও প্রশ্ন উঠবে যে এত দিন পরে এদের মেরে ফেলা হল কেন? কেন এদেরকে মিডিয়ার সামনে আনা হল না? সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ফিরোজ সাহেব শংকরের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “তাছাড়া, এমন কিছুই করা হবে না যাতে করে বাজে ঘটনার জন্ম হয়। আপনার আর আপনার পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”
শংকর বললেন, “এই তেরোজন বাইরে ছাড়া পেলে কি হবে ভেবেছেন?”
ফিরোজ সাহেব বললেন, “ওদের বাইরে আনা হবে কে বলেছে? বশির জামান শুধু দুটো কথা বলবেন ওদের সঙ্গে। ব্যাস, এছাড়া আর কিচ্ছু না। কথা বলা শেষ হলেই আপনারা বেরিয়ে আসবেন। আর কি হবে না হবে সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দেন। যা কিছু হোক না কেন, তার ফলাফল ভালোই হবে।”
“আমার জীবনমরণের ব্যাপার স্যার। এর সাথে আমার পরিবারও জড়িয়ে যাবে।” শংকর বললেন।
“আহ হা। আপনার পরিবারের কিচ্ছু হবে না শংকর সাহেব। কাজ শেষ হয়ে গেলে আপনাকে আমি নিজে আপনার বাসায় ড্রাইভ করে নামিয়ে দিয়ে আসব।” ফিরোজ শংকরের বাম হাতে হাত রেখে বললেন।
“ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই শংকর সাহেব। আমি আছি না? আপনি শুধু জেলখানাটা চিনিয়ে দেবেন। ব্যাস। বললামই তো। তারপর আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। বাকিটা অন্যরা করবে, আপনি দেখবেন।”
শংকর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। হাতের এঁটো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছে। বেসিনে হাত ধুলেন তিনি। ভেতরের কোন একটা ঘরে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের ঘণ্টা বাজল। এগারোটা ঘণ্টা পড়ল।
তোয়ালেতে হাত মুখ মুছলেন শংকর। তার মনে হল, এক্ষুনি সব বমি হয়ে যাবে।
ফিরোজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “রান্না কেমন হয়েছে শংকর সাহেব?”
শংকর সাহেব ভদ্রতাসূচক কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, “ভালো।”
“রুস্তম রান্না করেছে। রুস্তমের রান্নার হাত চমৎকার। আরেকটা কাজে ওর হাত আরও চমৎকার। রুস্তম?” ফিরোজ সাহেব রুস্তমকে ডাকলেন।
রুস্তম নামের কুঁজো বুড়োটা ছোট ছোট পায়ে ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে আসল। এই প্রথম শংকর খেয়াল করলেন, লোকটা অন্ধ। জরাজীর্ণ কুঁচকে যাওয়া মুখমন্ডলে সাদা দুজোড়া আধবোজা চোখে শূন্য দৃষ্টি। ফিরোজ হক হঠাৎ একটা শিস বাজালেন। সাথে সাথে রুস্তমের বাম হাত শরীরের পেছনে চলে গেল। বিদ্যুৎ গতিতে বের করে আনল একটা রিভলভার। শংকরের দিকে রিভলভারটা তুলে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জিটা ধরেই রুস্তম ট্রিগারে চাপ দিল।
ক্লিচ ক্লিচ করে চারবার শব্দ হল। পুরো ঘটনাটা ঘটল মাত্র এক সেকেন্ডে!
ফিরোজ সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “অন্যান্য দিন লোডেড ম্যাগজিনই থাকে। আজ অতিথি আসবে বলে খালি ম্যাগজিন দিয়ে রেখেছি।” শংকর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। তার শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি যেন জমে গেল। এই কয়েক সেকেন্ডেই ঘামে তার শার্ট ভিজে গিয়েছে। উনি স্থির দৃষ্টিতে পিস্তল ধরে থাকা অন্ধ রুস্তমের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এত ধীর গতির এই মানুষটা বিদ্যুৎগতিতে পিস্তল চালাতে পারে- এটা তখনও বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না তার।
ফিরোজ ‘রিল্যাক্স’ বলতেই রুস্তম ঠিক একই ভাবে পিস্তলটা আবার আগের জায়গায় গুঁজে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বললেন, “রুস্তমের খুব কালো একটা অতীত আছে। শুনবেন শংকর সাহেব? ওর গল্প বলতে গেলে আরেকটা বই লেখা হয়ে যাবে বুঝলেন। ও যেখান থেকে এসেছে, সেখানে থেকে আর কেউ ফিরে আসে না।”
শংকর সাহেব শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে তার। তিনি প্রাণপনে চেষ্টা করছেন সেই কাঁপুনি থামানোর জন্য। গল্প শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। এটা পিস্তল না। রিভলভার। একটাও যদি গুলি থাকত, কি হত তাহলে? কাঁপা কাঁপা গলাতে তিনি বললেন, “আমি আজ আসি স্যার।”
ফিরোজ সাহেব বললেন, “আমার গাড়ি আপনাকে রেখে আসবে। আরেকটু বসে যান। কফি খাবেন?”
শংকর সাহেব কফি খেলেন না। এলোমেলো পায়ে দরজা পর্যন্ত গেলেন। জুতা পরলেন। তারপর ফিরোজ সাহেবের দিকে ঘুরে বললেন, “আমি গতকাল সকালে রাজি হয়ে গেলে হয়ত আজ মেয়েটাকে মরতে হত না তাই না স্যার? মানুষ যা চায় তাকে সেটা না দিলে তাকে অনেকখানি চেনা হয়ে যায়। আমি আপনাকে আজ অনেকটা চিনে গেলাম।”
ফিরোজ সাহেব শংকরের চোখে চোখ রেখে বললেন, “যা করা হচ্ছে সেটা একটা ভালো উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে শংকর সাহেব। এতটুকু ভরসা আপনি রাখতে পারেন। পরশুদিন বশির সাহেব গিয়ে আপনার সাথে দেখা করবেন। ওকে নিয়ে আপনি জেলখানাটায় যাবেন।”
শংকর সাহেব আর কোন কথা বললেন না। বেরিয়ে যাবার জন্য দরজা খুললেন। হঠাৎ একজন যুবককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন শংকর। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ফিরোজ এগিয়ে এসে বললেন, “পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি আমাদের ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট। মেজর রঞ্জন মৈত্র আর রঞ্জন, ইনি হলেন আমাদের জেল সুপার, শংকর সাহা। আমার খুব কাছের একজন বন্ধু।” শংকর সাহেব যুবকের সাথে করমর্দন করলেন। মেজর রঞ্জন মৈত্র একটা মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, “নাইস টু সি ইউ স্যার।”
বাইরে একটা ল্যান্ডরোভার এসে দাঁড়ালো। শংকর নতমস্তকে গাড়িতে উঠলেন।
দেখলেন, ড্রাইভিং সিটে একজন টাকমাথার ভদ্রলোক বসে আছে। ডঃ বশির জামান।