প্রায়শ্চিত
ফোনটা যখন এসেছিল, রাত তখন ঠিক পৌনে একটা। সময়টা এত সঠিকভাবে মনে থাকার কারণ তার ঠিক আড়াই মিনিট আগে অনুষ্ঠানের চতুর্থ অ্যাড ব্রেক শুরু হয়েছিল আর আমি সবে এক কাপ কফি খেয়ে আমার চেয়ারে বসে পা ছড়িয়ে হাত দুটো পিছনদিকে টানটান করে আড়মোড়া ভাঙার মুহূর্তে মুখ উঁচু হয়ে যাওয়ায় পাশের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে চোখ গিয়েছিল। ঠিক তখনই অ্যাড শেষ হল আর আমি ‘এখন রাত ঠিক পৌনে একটা। আমি ঋতম ফিরে এলাম আপনাদের প্রিয় মিডনাইট চিলস নিয়ে। আমাদের জন্য ফোনে অপেক্ষা করছেন এক বন্ধু।’ বলে অপেক্ষায় থাকা ফোন কলটা রিসিভ করার জন্য সবুজ বোতামটা টিপলাম। “হ্যালো, শুভসন্ধ্যা বন্ধু। কে আছেন আমাদের সঙ্গে আপনার নামটা বলুন। হ্যালো… হ্যালো।”
একটা ঘস ঘস শব্দের সঙ্গে মনে হল যেন লাইনটা কেটে গেছে। আমি আরও দুয়েকবার ‘হ্যালো… হ্যালো’ করে সবে বলতে যাচ্ছিলাম ‘মনে হয় যান্ত্রিক কারণে লাইনটা কেটে গেছে’ ঠিক তখনই একটা খসখসে গলা ভেসে এল।
“হ্যালো… শোনা যাচ্ছে?”
রেডিও স্টেশনের কাচে ঘেরা ফাঁকা ঘরে এত রাতে গলার স্বরটা একটু অস্বস্তিকর যে লাগছিল, তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বরে তা ফুটে উঠতে না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আপনার নাম বলুন প্লিজ।”
“আমি ত্রৈলোক্য বিশ্বাস।”
ত্রৈলোক্য বিশ্বাস; নামটা আমার মস্তিষ্কের কোনও এক প্রাচীন কোষে এসে ধাক্কা দিল। খুব চেনা… কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। চিন্তা করার সময় নেই এই মুহূর্তে। অনুষ্ঠান শেষ হতে আর মিনিট দশেক বাকি। এটাই সম্ভবত আজকের মতো শেষ ফোন কল। তাই বলে উঠলাম, “স্বাগত ত্রৈলোক্যবাবু। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের আজকের টপিক ব্ল্যাক ম্যাজিক। আপনার আগে আটজন ফোনে আমাদের তাদের জীবনের ঘটনা শুনিয়েছেন। আশা করছি আপনিও এমন কিছু শোনাবেন যাতে আমাদের শ্রোতাদের বাকি রাতটুকু ভয়ে ঘুম না আসে। মনে রাখবেন, আপনি আমাদের আজকের শেষ কলার। তাই শুরু করুন আপনার কাহিনি। সময় হাতে খুব কম।”
“আমি কোনও গল্প শোনাবো না। আমি যা বলব সব সত্যি। আর আমার বলা শেষ হলে আমি আপনাকে একটা চ্যালেঞ্জ দেব। যদি সাহস থাকে, নিয়ে দেখান।”
মুহূর্তে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল আমার। লাইভ প্রোগ্রাম চালাতে গিয়ে এরকম ত্যাঁদড় লোকজনের পাল্লায় এর আগে পড়িনি তা নয়। কিন্তু আমার জন্মগত স্মার্টনেস আর উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে অসুবিধে হয়নি। চ্যানেল আমাকে শুধু শুধু টাকা দেয় না। আমার এই লাইভ সাসপেন্স প্রোগ্রাম ‘মিডনাইট চিলস’ প্রায় দেড় বছরের ওপর চলছে। আরএএম বা রেডিও অডিয়েন্স মেজারমেন্ট এ ‘মিডনাইট চিলস’ এর রেটিং যে যথেষ্ট হাই, তার পিছনে চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি যদি আর কারো কোনও ভূমিকা থেকে থাকে, তবে তা এই শর্মার। কাজেই একটুও না ঘাবড়ে উত্তর দিলাম “শিওর। তবে তা ডিপেনড করছে আপনার গল্পটা কতটা ইন্টারেস্টিং তার উপরে। বলতে পারেন এটা আমার দিক থেকে একটা কন্ডিশন।”
“বেশ। শুনুন তাহলে। এখন আমার বয়স পঁয়ষট্টি বছর তিন মাস সতেরো দিন। আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। আমি তখন কলকাতার একটা সওদাগরী অফিসে কাজ করি। মাইনে যা পাই, তাতে মাসের কুড়ি তারিখের মধ্যেই টানাটানি পড়ে যায়। বাড়িতে তিন ছেলেমেয়ে, গিন্নিকে নিয়ে পাঁচটা পেট। তিন ছেলেমেয়েই তখন পড়াশুনা করছে। অথচ রোজগার বাড়ানোর কোনও দ্বিতীয় পথ আমার জানা নেই। ওভাবেই ঘষে ঘষে দিন চলছে কোনওরকমে। একদিন গিন্নির সঙ্গে খুব অশান্তি হল। আমাকে ছেলেমেয়েদের সামনেই যা নয় তাই বলে অপমান করল সে। অবশ্য এখন ভাবলে মনে হয়, তার পক্ষেও অসহিষ্ণু হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু তখন খুব রাগ হয়েছিল। ঠিক করে ফেললাম, এই পোকামাকড়ের জীবন আর রাখব না। ভাবলাম রাতে অফিস থেকে আর বাড়ি ফিরব না। ছুটির পর বাস ধরে সোজা চলে যাব বাবুঘাট। সেখানেই মা গঙ্গার কোলে নিজের সব যন্ত্রণা জুড়বো। রাতের দিকে গঙ্গার ঘাট ফাঁকা হয়ে আসবে। কাজেই কেউ আমাকে বাধা দিতে আসবে না। এ কথা ভেবে মনে মনে প্রস্তুত হয়েই অফিসে গেলাম। যতই মনস্থির করি না কেন, সারাদিন অফিসে খুব মনমরা হয়ে রইলাম। খুব বেশি লোক খেয়াল করল না। সাধারণ একজন কেরানির মন খারাপ হোক, বা শরীর খারাপ… কার কী আসে যায়? কিন্তু যখন অফিস থেকে বেরচ্ছি রাত আটটা নাগাদ, তখন পিছন থেকে হাত টেনে ধরল একজন। মৃগাঙ্ক, মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী। বয়সে আমার থেকে বছর কয়েকের ছোটই হবে, তবে কাজ করে আমার চেয়ে উঁচু পোস্টে। তা হলে কী হয়, আমাকে দাদা দাদা করে সম্মান দিয়ে কথা বলত। মৃগাঙ্ক বড়োলোকের একমাত্র ছেলে। চাকরির প্রয়োজন খুব একটা ছিল না। তবু কিছু করতে হয় বলেই হয়তো চাকরি করত। আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল আমার কী হয়েছে। আর পারলাম না। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। মৃগাঙ্ক আমাকে নিয়ে গেল অফিসের পাশের মৈত্রী কেবিনে। সেখানে নিজের পয়সায় দুটো চা আর ডিমটোস্ট অর্ডার দিয়ে বসল আমার পাশে। আমার কাছে সব শুনে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “চিন্তা করো না দাদা। আমার কাছে একটা উপায় আছে। যদিও এসব কথা আমি কাউকে বলি না, তবে তোমার ব্যাপারটা আলাদা। কাল তোমাকে একজায়গায় নিয়ে যাব। একটা দিন অপেক্ষা করো।’
হাজারবার জিজ্ঞেস করার পরেও এর বেশি কিছু বলতে চাইল না মৃগাঙ্ক। কিন্তু ওর গলার প্রত্যয় হয়তো আমাকে একটু আশার আলো দেখাল। তাই সেদিনের মতো আত্মহত্যা মুলতুবি রেখে বাড়িতে গেলাম। পরদিন সন্ধেবেলায় দু’জনে বেরোলাম অফিস থেকে। মৃগাঙ্ক ট্যাক্সি নিয়ে মধ্যমগ্রামের একটা ঠিকানা বলল। আমি তখনও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যেতে যেতে মুখ খুলল মৃগাঙ্ক। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে নাকি একজন প্রেতসিদ্ধ তান্ত্রিক থাকেন। প্রেতসিদ্ধ ব্যাপারটা কি, সেটা আমি আগে জানতাম না। মৃগাঙ্কই জানাল। খুব কম তান্ত্রিক প্রেতসাধনা করে সাফল্যলাভ করতে পারেন। যারা সফল হন, তারা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রেত এক পরম বন্ধুর রূপ ধরে এসে সাধকের সব নির্দেশ পালন করে। যার হয়ে প্রেত কাজ করে, এমন সব অকল্পনীয় সৌভাগ্য আসে তার জীবনে, যা হয়তো সে কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মৃগাঙ্কর এইসব কথা আমাকে আশা দেওয়ার পরিবর্তে আরও দমিয়ে দিচ্ছিল। সত্যিই যে এসব সম্ভব, কিছুতেই তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না।
যাই হোক, অবশেষে পৌঁছলাম। একটা এক কামরার ঘর, মাথায় টিনের চাল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে গোটা পাঁচ সাতেক মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির ভৌতিক আলোয় ঘরের ভেতরটা কেমন অপার্থিব দেখাচ্ছে। ঘরের একপাশের দেয়ালের সামনে একটা ফুট তিনেকের বিকটদর্শন কিম্ভূত মূর্তি। দেখলাম সেটাকে ধূপধুনো দিয়ে পুজো করা হয়েছে। মূর্তিটার দেহ কুচকুচে কালো রঙের, করাল দংষ্ট্রা বের করা মুখে বিস্ফারিত দুই চোখ ঘরের চালের দিকে নিবদ্ধ। মেঝেতেও কিছু উপচার ছড়ানো যার বেশিরভাগই আমার কাছে অপরিচিত। আর তার সামনে মেঝের ওপর আঁকা একটা আলপনার ওপরে পদ্মাসনে বসে রয়েছেন এক ব্যক্তি। মৃগাঙ্ক নাম বলেছিল নিহারি বাবা। লোকটিকে দেখলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা মনে হতে বাধ্য। যেন মূর্তিমান দুর্ভিক্ষ আমাদের চোখের সামনে বসে রয়েছে। কেউ যে এত রুগ্ন শীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে। পুরো দেহের কাঠামোটার উপর দিয়ে কেবল যেন চামড়ার আবরণ। শুধু সরু পিঠের ওপরে একটা বিরাট মাংসপিণ্ড যেটাকে সাধারণভাবে আমরা কুঁজ বলি। মোটের ওপর এমন কদাকার চেহারা খুব কম দেখা যায়। আমরা ঘরে ঢুকতেই পিছন ফিরল লোকটা। কোটরের মধ্যে থেকে পলকহীন জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি যেন আমাদের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মৃগাঙ্ককে ভক্তিভরে প্রণাম করতে দেখে আমিও হাত জোড় করলাম। হাতের ইশারায় আমাদের বসতে বললেন উনি। আমরা মেঝের উপরে বসার পর মৃগাঙ্কর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী প্রয়োজন? “ মনে হল, মৃগাঙ্ক এর আগেও এখানে এসেছে। সে সব খুলে বলল। এ কথাও লুকাল না যে আমি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি।
শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ভদ্রলোক। তারপর আমার দিকে তাঁর শীর্ণ ডানহাতের তর্জনী তুলে ধরলেন। বললেন, ‘উৎসর্গ করতে পারবি? উৎসর্গ? বলি চাই।’
আমি ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। মৃগাঙ্ক আমাকে কনুই দিয়ে একটা ঠেলা মেরে আমার হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কীরকম বলি বাবা? পাঁঠাবলি?”
তীব্রদৃষ্টিতে তাকালেন তান্ত্রিক, ‘এত সামান্য বলিতে এ কাজ হবে না। আপনজনের বলি চাই। আজ নয়। আগামী পরশু অমাবস্যা, ওই দিন আসবি। রাত ঠিক দুটোয়। আগেও না, পরেও না।’ কথাটা বলেই তেড়েবেঁকে উঠে কোথায় যেন চলে গেলেন। বুঝলাম আজ আর তাঁর দেখা পাওয়া যাবে না।
দু’জনে ফিরতে ফিরতে গুম মেরে গিয়েছিলাম। মৃগাঙ্ক আমার কাছে ক্ষমা চাইছিল। ও নাকি ওর কোনও একজন আত্মীয়ের সঙ্গে প্রথম এখানে আসে। সেই আত্মীয় তার যে সমস্যা নিয়ে এসেছিল, কিছুদিনের মধ্যেই তা থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। তবে তাকে এত কঠিন কোনও পথ বাতলাননি বাবা। তাই আমাকে সে এখানে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু বাবার কথা শুনে সে বুঝতে পেরেছে উনি যা বলছেন তা অসম্ভব… ইত্যাদি। আমিও খুব হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। আমার আপনজন বলতে আমার স্ত্রী পুত্রকন্যারা। পুত্রকন্যাদের তো প্রশ্নই নেই, স্ত্রীও যতই মুখরা হোক তাকে বলি দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না আমি। অনেক ভেবেও আর কোনও আপনজনের কথা মনে করতে পারলাম না।
এর পরের দিন নাওয়া-খাওয়া উঠে গেল আমার। অফিসে গেলাম না। সারাদিন ভাবলাম। রাতে বেরিয়ে ঘুরলাম রাস্তায় রাস্তায়। একবার ভাবি এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করব? পরমুহূর্তে বউ ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মত পরিবর্তন করি। সারারাত ভেবে সেদিন একটা সিদ্ধান্তে এলাম। জীবন সুযোগ একবারই দেয়। একবার ফস্কে গেলে আর এ সুযোগ পাব না। পরদিন অফিসে গিয়ে মৃগাঙ্ককে বললাম, ‘আমি আজ একবার গিয়ে দেখতে চাই উনি কী করেন। তারপর দরকার হলে আর যাব না। কিন্তু কৌতূহল বাগ মানাতে পারছি না।’
মৃগাঙ্ক একটু অবাক হলেও আমার কথায় রাজি হয়ে গেল। ওরও বোধহয় কৌতূহলটা একটু বেশি। ঠিক হল, আজ রাত ঠিক দুটোয় আমরা যাব তান্ত্রিকের ডেরায়। তবে লুকিয়ে। দেখব উনি ঠিক কীরকম সাধনা করেন।
সেইমতো রাত দুটোর কিছু আগে দু’জনে পৌঁছে গেলাম। থমথমে চতুর্দিক, শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক কানে আসছে। তান্ত্রিকের ডেরার বন্ধ ঘরের সামনে পৌঁছে দরজায় কান পাতলাম দু’জনে। ঘর শুনশান। তবে অন্য কোথাও থেকে একটানা মন্ত্র পড়ার গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। রাত দুটো বাজতে তখন ঠিক কয়েক মিনিট বাকি। হঠাৎ একটা চাপা হাসির শব্দে বুকটা কেমন দুলে উঠল। হাসির শব্দটা আসছে ঘরের পিছনের ফাঁকা জমির দিক থেকে। আমরা এগিয়ে গেলাম সেদিকে। একটা কুয়ো, তার সামনে দাঁড়ানো তান্ত্রিক দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। মনে হল হাসির শব্দটা আসছে কুয়োর ভিতর থেকে। একটা দলাপাকানো কালো কুয়াশা কুয়োর মুখের ঠিক ওপরে খুব ধীরে ধীরে ঘুরছে। হাসির শব্দটাও ক্রমশ বাড়ছে। আস্তে আস্তে কর্ণবিদারক অট্টহাসিতে পরিণত হতেই মৃগাঙ্ক আমার হাতটা চেপে ধরল। ওর হাত বরফের মতো ঠান্ডা। ‘দাদা চলো এখান থেকে।’ বলে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই আমি ওর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলাম। টাল সামলাতে না পেরে ও হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল কুয়োর ওপরে। ঠিক তক্ষুনি ভেতর থেকে একটা কালো কুচকুচে হাত বেরিয়ে এসে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে মৃগাঙ্ককে টেনে নিয়ে গেল কুয়োর মধ্যে। মৃগাঙ্কর চিৎকারটা ঢাকা পড়ে গেল সেই রক্ত জল করা হাসির আড়ালে।”
.
ঘড়ি বলছে আর মিনিট তিনেক সময় আছে। আজকে আর নতুন কোনও ফোন কল নেওয়া যাবে না। কাজেই এই সময়টা এই ত্রৈলোক্য বিশ্বাসকে নিয়েই কাটাতে হবে। আমি বললাম, “কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হল না। আপনি ওঁকে হঠাৎ ঠেলে দিলেন কেন? উনি তো আপনার আপনজন ছিলেন না। ওঁকে দিয়ে আপনার কার্যসিদ্ধি হওয়ার কথা নয়।”
একটা খুকখুক শব্দ ভেসে এল ফোনের তরঙ্গ বেয়ে। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক হাসছেন। তারপর বললেন, “আগেরদিন রাতে আমি সারারাত বাড়ি ফিরিনি। একাই গিয়েছিলাম তান্ত্রিকের কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনজন কাকে বলে? উনি ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘যে তোর ভালো চায়, সেই তোর আপনজন।’ তাই তখনই মন ঠিক করে ফেলেছিলাম। বউ ছেলেমেয়ে বাদ দিলে মৃগাঙ্কের চেয়ে বড়ো আপনজন আর কে ছিল আমার?”
.
আমি লোকটাকে সহ্য করতে পারছিলাম না। কী করেই বা পারব? আমার বয়স যখন তেরো, তখন থেকে আমার বাবা নিখোঁজ। আজ দশ বছর তাঁর কোনও হদিশ নেই। একরাতে বাড়ি থেকেই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর আজ এতদিন পর আমারই লাইভ প্রোগ্রামে একজন এসে বলছে সে নাকি বড়োলোক হওয়ার জন্য আমার বাবাকে সিঁড়ি বানিয়েছে। হ্যাঁ মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী আমার বাবা। কিন্তু আমি এখনও খুব কনফিউজড। এসব পাগলের প্রলাপ নয় তো? তবে সত্যি মিথ্যে যাই হোক, একে হাতছাড়া করা যাবে না। ইতিমধ্যে আমাদের অফিশিয়াল মোবাইল নম্বরে অজস্র মেসেজ ঢুকতে শুরু করেছে। এই অনুষ্ঠানের নিয়মটাই এরকম যে, লাইভে কারো গল্প শুনে ভালো লাগলে বা কোনও বক্তব্য থাকলে এই মোবাইল নম্বরে মেসেজ করে জানাতে হয়। নির্বাচিত কিছু মেসেজ আমি পড়ে দিই। সময় প্রায় শেষ। এবার ভদ্রলোককে তাঁর চ্যালেঞ্জের কথা জিজ্ঞেস করলাম।
উনি বললেন, “প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের শুরুতে আপনি বলেন, কোনোরকম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া আপনার উদ্দেশ্য নয়। আপনি কি সত্যিই এসবে বিশ্বাস করেন না?”
আমি দৃঢ়কণ্ঠে বললাম, “অবশ্যই না।”
এখানেই রইল আমার চ্যালেঞ্জ। কাল বিকেলে আমার বাড়িতে আসুন। আপনাকে যদি বিশ্বাস না করাতে পারি তবে আমি এই অনুষ্ঠানে সকলের সামনে ক্ষমা চেয়ে নেব। অবিশ্যি আপনি হারলে আপনাকে এই অনুষ্ঠান ছেড়ে দিতে হবে। রাজি?”
কেমন যেন জেদ চেপে গেল। রাজি হয়ে গেলাম। ত্রৈলোক্য বিশ্বাস মেসেজ করে নিজের ঠিকানা জানিয়ে দিলেন।
*****
বিকেলে সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম ভদ্রলোকের বলে দেওয়া ঠিকানায়। একটু মফঃস্বলের দিকে বাড়ি। এখানে আসার আগে গিয়েছিলাম স্থানীয় থানায়। সব ঘটনা বলে সাহায্য চাইলাম। কিন্তু অফিসার ভদ্রলোক বলেন কিনা, “ও, তা উনি তো বদ্ধ পাগল। ওঁর কথায় কান দেবেন না। কয়েক বছর আগে ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বাইরে থাকে। এখানে উনি একাই থাকেন। প্রতিবেশিরা বলে একা একাই নাকি চেঁচামেচি কান্নাকাটি করেন। কথাও বলেন। কারো সঙ্গে মেশেন না। আপনার বাবার ঘটনা হয়তো শুনেছেন কোথাও, বাকিটা কল্পনা করে নিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, পয়সাওলা লোক। শুনেছি অনেক জমিজমা আছে।”
ত্রৈলোক্যবাবুর বাড়ির দরজা ভেজানোই ছিল। কলিং বেলের হদিশ না পেয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই দেখি ঘরের মাঝখানে একটা ইজিচেয়ারে বসে আছেন একজন ব্যক্তি। চেনা খসখসে গলার স্বরে বুঝলাম আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি।
“এসো ঋতম। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। আজকে যেজন্য তোমাকে ডেকেছি, তার একটা বড়ো কারণ তোমার বাবা। না, চমকে উঠো না। আমি জানি মৃগাঙ্ক তোমার বাবা। তোমার বাবাকে প্রেতের কাছে উৎসর্গ করে আমি বিত্ত অর্জন করেছিলাম বটে, কিন্তু তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে জানবে, প্রতি মাসে আমি তোমার বাবার বন্ধুর পরিচয়ে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তোমাদের মানি অর্ডার পাঠিয়েছি। আমি বরাবর তোমাদের খোঁজ রেখেছি।”
এবার আমার মনে পড়ল কেন ত্রৈলোক্য বিশ্বাস নামটা চেনা লেগেছিল। কিন্তু লোকটা ভেবেছে কি? টাকা পাঠিয়ে নিজের পাপ ধুয়ে ফেলতে পেরেছে? যেন আমার মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর দিলেন ত্রৈলোক্য।
“কিন্তু জানো, আমিও শাস্তি পেয়েছি। মৃগাঙ্ককে মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিলাম যে রাতে, তারপর থেকে নানাভাবে টাকা এসেছে আমার কাছে। লটারি জিতেছি, প্রায় অচেনা দূরসম্পর্কের খুড়শ্বশুর মারা যাওয়ার পর ওয়ারিশের অভাবে বিশাল সম্পত্তি এসেছে আমার কাছে, এরকম আরও অনেককিছু। আমার এত রমরমা দেখে তান্ত্রিকের মাথা গেল ঘুরে। মৃগাঙ্কর মৃত্যুরহস্য ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করল আমাকে। আমি বেশ কিছুদিন ভয় পেয়েছি, টাকা দিয়েছি। কিন্তু একসময় বিরক্ত হয়ে এর থেকে মুক্তির উপায় ভাবতে বসেছি।”
আমি ত্রৈলোক্য বিশ্বাসকে বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, “কিন্তু তান্ত্রিক তো প্রেতসিদ্ধ, তিনি তো ইচ্ছে করলে তন্ত্রবলে নিজেই ব্যবস্থা করতে পারতেন টাকা রোজগারের। তা না করে…”
মৃদু হেসে ত্রৈলোক্য বললেন, “তুমি বোধহয় আমার গল্পটা খেয়াল করোনি। প্রেতকে কাজে লাগিয়ে রোজগার করতে আপনজনকে উৎসর্গ করতে হয় প্রেতের কাছে। সেরকম আপনজন বোধহয় ছিল না তান্ত্রিকের। যাই হোক, মনে মনে ঠিক করে ফেললাম সরিয়ে ফেলতে হবে তান্ত্রিককে। এই ভেবে এক রাতে রওনা দিলাম তার ডেরার উদ্দেশ্যে। তান্ত্রিক ধ্যানে বসেছিল। মোটেই এসময় কাউকে আশা করেনি। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পিছনে। এর আগে কখনো নিজের হাতে কাউকে খুন করিনি। তাই কোমরে গোঁজা ছুরিটা বের করতে কয়েক সেকেন্ড দেরি করে ফেলেছিলাম। এরমধ্যেই টের পেয়ে যায় তান্ত্রিক। সে অসময়ে আমাকে দেখে কিছু একটা আঁচ করেছিল। কিন্তু কুঁজের জন্য তাড়াতাড়ি ওঠাবসা করতে পারত না সে। ছুরিটা কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় হাতের কাছে সেই বিকটদর্শন মূর্তিটা পেয়ে সেটাকেই তুলে ধরে চালিয়ে দিলাম তার মাথা লক্ষ্য করে। নিরেট পাথরের মূর্তিটার আঘাতে ঘিলু বেরিয়ে গেল লোকটার। তার মধ্যেও অবাক হয়ে দেখলাম নিজের গলায় পরা একটা পাথরের মালা আমার দিকে তুলে ধরে বিড়বিড় করে কীসব বলে যাচ্ছে তান্ত্রিক। কী বীভৎস সেই দৃশ্য! থেঁতলে যাওয়া মাথা ও মুখের ওপর রক্তে ঘিলুতে মেশানো থকথকে পদার্থ চোখ ঢেকে ফেলেছে অথচ ঠোঁটদুটো নড়ে চলেছে অনবরত। আমি হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। তারপর আবার মূর্তিটাকে মাথার উপর তুলে ধরলাম লোকটাকে শেষ করে দেব বলে। কিন্তু তার আর দরকার হল না। থেমে যাওয়া ঠোঁট আর মালা জড়ানো স্থির হয়ে যাওয়া তর্জনী দেখেই বুঝলাম সে মারা গেছে। মূর্তিটা হাত থেকে নামিয়ে রাখার সময় খেয়াল করলাম ওটার মাথাটা নেই। মানে ঝাঁকুনিতে খসে কোথাও পড়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও দেখতে পেলাম না। খুব একটা মাথাও ঘামাইনি। শারীরিক ধকলে তখন আমার ঘাড় পিঠ ব্যথা করছে। কবন্ধ মূর্তিটাকে ফেরার সময় তান্ত্রিকের বাড়ির কুয়োতে বিসর্জন দিয়ে এলাম।”
এই ত্রৈলোক্য লোকটার ওপর একদিকে রাগ হচ্ছিল, অন্যদিকে মনে হচ্ছিল একটা পরিস্থিতির শিকার সে। আমি বললাম, “বুঝলাম, কিন্তু আমাকে সব খুলে বলার ইচ্ছে হল কেন আপনার?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ত্রৈলোক্য। তারপর চোখ তুলে বললেন, “বয়স বাড়ছে তো, বলতে পারো পাপস্খলন। তান্ত্রিককে আমি নিজের হাতে খুন করেছি। এতে আমার কোনও অনুতাপ নেই। কিন্তু মৃগাঙ্কর মৃত্যুর জন্য যে আমি দায়ী, এ কথা আমি একমুহূর্তের জন্যও ভুলিনি। নিজের মুখে তোমার কাছে এ কথা স্বীকার করার তাগিদ তো ছিলই। আর তার ওপরে ছিল এটা দেখানোর ইচ্ছে যে, শাস্তি আমিও কম পাইনি।”
হঠাৎ আমার মাথাটা খুব গরম হয়ে গেল।
“কি, কি শাস্তি? আপনি তখন থেকে এই একটা কথা বলে যাচ্ছেন। কি শাস্তি হয়েছে আপনার? টাকার গদির উপর বসে আছেন। খাচ্ছেন দাচ্ছেন, ভুলভাল বকছেন। কোথাও কোনও অভাব নেই। আর আমার মাকে টাকা পাঠিয়ে ভেবে নিয়েছেন বিরাট কোনও উপকার করেছেন?”
মাথা নীচু করে আমার অভিযোগ শুনলেন ত্রৈলোক্য। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “সেদিন তান্ত্রিককে খুন করে ফেরার পর থেকে প্রচণ্ড ঘাড় পিঠ ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছিলাম। তিনদিন বিছানায় শুয়ে ছিলাম। তারপর যখন উঠতে গেলাম… দেখতে চান, ঋতমবাবু, কী শাস্তি আমি ভোগ করে চলেছি বছরের পর বছর ধরে?”
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন ত্রৈলোক্য। নিজের গায়ে ঢাকা দেওয়া চাদরটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। তারপর আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন। খালি গা। কুচকুচে কালো রং তাঁর শরীরের। এত কালো মানুষ এর আগে দেখিনি আমি। কিন্তু ত্রৈলোক্যর মুখ তো এত কালো নয়! তাহলে? শুধু তাই না, সেই কুচকুচে কালো পিঠের ঠিক মধ্যিখানে উঁচু হয়ে রয়েছে একটা বিরাট কুঁজ। আর সামান্য নীচের দিকে ঝুলে পড়া কুঁজটার মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে একটা মুখের অবয়ব। চামড়ার ভাঁজে ফুটে উঠেছে মুখব্যাদান করা একটা ভয়ংকর মুখ আর দুটো বিস্ফারিত উপরদিকে চেয়ে থাকা চোখ।
“দেখেছেন? কী নারকীয় শাস্তি ভোগ করছি আমি? মরার আগে শাপ দিয়েছিল তান্ত্রিক। আর সেই শাপ সত্যি করতে তার উপাস্য দেবতার মূর্তি থেকে তার মাথাটা খুলে জুড়ে গিয়েছিল আমার শরীরের সঙ্গে। এর চেয়ে বড়ো শাস্তি কী আইন আমাকে দিতে পারত?”
কয়েকমাস পরের কথা। অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতে এফএমটা অন করতেই শুনতে পেলাম চেনা মিউজিকটা। আমার স্বপ্নের ‘মিডনাইট চিলস’ শুরু হচ্ছে। ‘হাই বন্ধুরা, এসে গেছি তোমাদের কাছে আবার তোমাদের প্রিয় আর জে সুমন্ত। শুরু করছি মিডনাইট চিলস। আবার বলে রাখি, কোনোরকম কুসংস্কারকে আমরা প্রশ্রয় দিই না।’ নবটা ঘুরিয়ে চ্যানেলটা পালটে ফেললাম। তারপর অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। মা অপেক্ষা করছে।