প্রাপ্তিযোগ – লীলা মজুমদার

প্রাপ্তিযোগ – লীলা মজুমদার

গুপির ছোটোমামা বললেন, গোপালপুর বহরমপুর এসব জায়গায় গেছিস কখনো? ‘একবার’—পানু বলল ‘হ্যাঁ, সেবার দাদুরা মুরশিদাবাদ বহরম’— ছোটোমামা হাসলেন, ‘কীসে আর কীসে।’ এ সেবহরমপুর নয়। দক্ষিণ ভারতের রেল ধরে গঞ্জামের দিকে যেতে হয়। শেষ রাতে দাঁড়িয়ে আছিস। যদি কপাল ভালো থাকে এক-আধটা মেছো ট্রাক পেলেও পেতে পারিস। নয়তো সেই ভোরের বাস ছাড়া গতি নেই। আগে চল সেখানে, তারপর বাকিটা বলব।’

এতো মহা গেরো। গুপি পানুকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে দেখে, ছোটোমামা আরো বললেন, কবে আমার কোন কথাটা শুনে, কার এতটুকু ক্ষতি হয়েছে তাই বল। বরং আমার অনেক সুবিধাই হয়ে গেছে। জানিস-ই তো ছেলেবেলায় অন্ধকার রাতে বাদুড়ের ডানার ঝাপটানি খেতে অবধি আমি আর সে-আমি নেই। তাই তোদের ডাকা! নইলে নিজেই তো পরম সুখে জীবন কাটাতে পারতাম। যাগ গে, যার যেমন কপাল।’ এই বলে ছোটোমামা এত জোরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন যে টেবিলের ওপরকার কাগজ চাপাটা সরে গেল। পানু বলল ‘কোথায় থাকা হবে?’ ছোটোমামা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ওমা, তোদের বুঝি আসল কথাটাই বলিনি প্রাপ্তিযোগ আছে।’ শুনে গুপি-পানু অবাক। প্রাপ্তিযোগ আবার কী?

‘কীসের প্রাপ্তি?’ ছোটোমামা রেগে গেলেন কীসের প্রাপ্তি কী করে বলব? সেটা কিছু একটা সমস্যাই নয়—।’ গুপি বলল, ‘এক যদি না পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়।’ ছোটোমামা কটমট করে একবার তাকিয়ে বলে যেতে লাগলেন, এখন মুশকিল হয়েছে যে বড়োদাদু আমার মাসতুতো ভাই নাদুকেও ঠিক ওই কথাই বলেছেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের মধ্যে যে আগে গিয়ে জিনিসটা খুঁজে বের করবে, প্রাপ্তিযোগটা তারই হবে। অতএব আর সময় নষ্ট করা নয়, আমরা আজই গাড়িতে রওনা হচ্ছি।’ হল-ও তাই। পরদিন থেকেই পুজোর ছুটি, কাজেই কারো বাড়ি থেকে কোনো আপত্তির কথা উঠল না। বরং এত কম খরচে এত দিনের জন্য ছেলে দুটো বাড়ি ছাড়া হচ্ছে জেনে বাড়ির সকলে যেন একটু খুশিই হল।

থার্ড ক্লাসে যাওয়া হল। যেখানে শত্রুপক্ষের প্রতিযোগিতা ভয় আছে, সেখানে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকাই ভালো। ছোটোমামা বললেন, আর শুধু নাদু কেন আরো কতজনকে ওই কথা বলেছেন কে জানে। এককালে সারা পৃথিবী জাহাজে করে চষে বেড়িয়েছেন, নানান জায়গা থেকে জানান জিনিস সংগ্রহ করেছেন। মাঝে মাঝে দেশে ফিরে, আমার মার কাছে পরম আদরে দু-তিন মাস কাটিয়ে আবার একদিন কাকেও কিছু না বলে হাওয়া হয়ে গেছেন। তা মা আদর করবেন নাই বা কেন? ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি বড়োদাদুকে বেচে ওঁর নিজের ওজনের সোনা পাওয়া যাবে। বুড়ো হয়ে অবধি গোপালপুরের ওই টিলার মাথায় দূরবিন হাতে দিন কাটিয়েছেন, নাকি সমুদ্রের গন্ধ না পেলে ওঁর ঘুম হয় না!’

পানু বলল, ‘এখন তিনি কোথায় আছেন? নাকি মরে গেছেন?’ ছোটোমামা চটে কাঁই। মরবেন কেন? পঁচাশি বছর বয়স হলেই মরতে হবে, এমন কোনো আইনের কথা তো শুনিনি। আছেন আমার মায়ের কাছেই। নাদুর মা-ও কম চেষ্টা করেননি ভাঙিয়ে নিতে। তা মা ছাড়লে তবে তো যাবেন। রোজ মাসি গিয়ে তাই বড়োদাদুর পায়ের কাছে বসে থাকেন, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না!’ পানু বলল, পায়ের কাছে কেন?’ আহা, মাথার কাছটি আমার মা ছাড়লে তবে তো সেখানে বসবেন। সেযাই হোক, নাদুর আগেই হয়তো আমরা গিয়ে পৌঁছব। কারণ মা কাকে দিয়ে ওর বড়ো সায়েবকে ধরিয়ে ওকে ট্যুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন।’ এই বলে ছোটোমামা একটু হেসে চুপ করলেন। গুপি একবার ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রকাশ্যে এত কথা বলা তোমার ঠিক হয়নি, ছোটোমামা।’ ছোটোমামা বললেন, আরে তাতে হয়েছেটা কী? সেব্যাটা এতক্ষণে হয়তো পান্ডুয়ার জন-পরিসংখ্যান করছে!’ শেষ রাতে ওরা বহরমপুরে নামল। সেখান থেকে মাইল পনেরো ষোলো দূরে সেই টিলার উপরে বাড়ি। ভাগ্য ভালো একটা মেছো লরি সত্যিই পাওয়া গেল। মাথা পিছু এক টাকা দিয়ে তাতে চেপে ওরা রওনা দিল। নামল যখন পূর্ব আকাশ তখন ফিকে হয়ে এসেছে। কানে এল একটা শোঁ শোঁ শব্দ। এই শব্দ না শুনলে হয়তো ছোটোমামার বড়োদাদুর মন খারাপ হয়। ছোটোমামা কেবলি তাড়া দেন, চল, চল, সবার আগে পৌঁছন দরকার। গিয়েই খোঁজ শুরু করে দেব। একটা ইংরিজি বইও এনেছি, তাতে গুপ্তধন পাবার একশো একান্নটা উপায় লেখা আছে। তবে একটা অসুবিধা হল যে সদর দরজার চাবি নাদুর কাছে, বড়োদাদুর শোবার ঘরের চাবি আমার কাছে। এই রকম ভাগাভাগি করেছে বুড়ো। এখন ঢুকবটা কী করে তাই ভাবছি।’

গুপি বলল, ‘সেআবার একটা কথা হল ছোটোমামা। আমি ঢুকিয়ে দেব।’ যতই তাড়াতাড়ি করার দরকার হোক না কেন, এইখানে একটা শেয়ালের বাচ্চা হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে নাক ফুলিয়ে ছোটোমামার দিকে শুঁকতে থাকাতে, তিনি অমনি আঁউ আঁউ করে হাত পা এলিয়ে মূর্চ্ছা গেলেন। পানুর জলের বোতল থেকে মাথায় জল ছিটিয়ে মুখে রেলের টামিমটেবলের হাওয়া দিয়েও কিছুতেই তাঁকে খাড়া করা যেত না যদি না গুপি হঠাৎ বলে বসত, এই রে আামাদের আগেই কেউ এ পথে এসেছে। গেটটা দেখছি খোলা।

বলামাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছোটোমামা হাঁচড় পাঁজড় করে করে, খোলা গেট দিয়ে ঢুকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে, ওপর দিকে দৌড়তে লাগলেন। গুপি-পানুও পেছন পেছন ছুটল। ছোটো টিলা, কিন্তু বড়ো বড়ো ঝাউ গাছে ঢাকা থাকাতে ওপরের দোতলা বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল না। ওপরে উঠে ওদের চক্ষু স্থির। দরজা জানলা সব খোলা। ঘরের আসবাবপত্র তছনছ। তারি মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেরাজ টেনে, টেবিলের টানা ডলটে দেয়ালের ছবি নামিয়ে রান্নাঘরের বাসনপত্র বাইরে এনে ছড়াছড়ি করে দুটো লোক সেযা কান্ড বাধিয়েছে তা আর কহতব্য নয়। তার ওপর লোক দুটো সমানে পরস্পরকে যা-নয় তাই বলে যাচ্ছে। পানু তো অবাক। আর ছোটোমামা থপ করে সিঁড়ির ধাপে চোখ উলটে বসে পড়লেন। গুপি বলল, এ কী নাদুমামা হাঁদুমামা, এ কী কান্ড?’ তারা তখনি ঝগড়া থামিয়ে উঠে এল। বুড়ো বুঝি তোদেরও পাঠিয়েছে? চাঁদুমাস্টারেরও কি প্রাপ্তিযোগ আছে নাকি? ভালো চাস তো উপরের ঘরের চাবি বের কর চাঁদু।’ ছোটোমামা পকেট থেকে একটা চাবি বের করে ছুঁড়ে দিতেই, গুপি সেটা ধরে ফেলে দোতলায় চলল। ছোটোমামা আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। নাদু হাঁদু চটে কাঁই। বুড়োর চালাকি দেখে বলিহারি। আমাদের দিয়ে সারা বাড়ি খুঁজিয়ে, পেয়ারের নাতি চাঁদু মাস্টারকে শোবার ঘরের চাবি দিয়েছে।’ দোতলায় একটি মাত্র ঘর। গুপি তার দরজা খুলে, চারটে জানলাও খুলে দিল। ভোরের ফিকে আলোয় অমনি ঘর ভরে গেল। নাকে এল সোঁদা সোঁদা সাগরের গন্ধ, কানে এল সমুদ্রের গর্জন। ঘরে কিন্তু একটি তক্তাপোষ কাগজপত্রে বোঝাই একটি লেখার টেবিল, তাকের উপর একটি লম্ফ আর একটি হাতবাক্স, খাটের পাশে একটি মোড়া আর খাটের তলায় সমুদ্রের শামুক ঝিনুক ভরা ডালাশূন্য একটা পুরোনো তোরঙ্গ ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর সব জায়গায় রাশি রাশি বালি।

বালি দেখেই ছোটোমামার হাঁচি উঠল। নাকে রুমাল চেপে তিনি তক্তাপোষে বসে পড়লেন। নাদু টেবিলের কাগজপত্র মাটিতে নামিয়ে, আসন পিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল। হাঁদু একটা তার দিয়ে হাত বাক্সটা খুলে ফেলেই পেয়েছি, পেয়েছি বড়োদাদুর ভল্টের চাবি! ‘ইউরেকা!’ এই বলে ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে, ধূপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

নাদু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আরো কতকগুলো কাগজ একপাশে সরিয়ে বলল, পেয়েছে না আরো কিছু! ভল্টের গয়না-গাঁটি কোনকালে বুড়ো একে ওকে দান করেছে না। কিন্তু-কিন্তু এটার কথা আলাদা। এই বলে নাদুমামা একটা ছোটো হলদে কাগজের কুচি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই লটারির টিকিটেই আমার প্রাপ্তিযোগ। ঘরদোর গুছিয়ে রাখিস চাঁদু, বুড়ো নইলে চটে গিয়ে, উইল ছিঁড়ে ফেলে দেবে, ছোটোমামার হাতে-পায়ে খিল ধরে থাকবে, তাই তক্তাপোষে, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললেন, যা হয় কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে, তোরা দু-জন ঘরদোর গুছিয়ে ফেলিস। আমার বেজায় দুর্বল লাগছে।’ গুপি রেগেমেগে ভাঙা তোরঙ্গটাকে উলটে ফেলল। হুড়মুড় করে শামুক-ঝিনুক আর আঁসটে গন্ধে ঘর ভরে গেল। শামুকের ভিতর মরা পোকার গন্ধ। পানু সঙ্গে আনা পুঁটলি খুলে লুচি, বেগুন ভাজা, মাংসের বড়া, সন্দেশ আর ক্ষীরের বরফি বের করল। ছোটোমামা অমনি উঠে বসলেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর হাই তুলে বললেন, দাদুর বাড়িটা যখন আমিই পাব, নাদু যখন বলছে তখন এটাকে তো এভাবে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। তোরা উঠে সব গুছিয়ে ফেল। আমি শামুক-ঝিনুকগুলো তুলে রাখি। গুপি-পানুর এখানে ক-দিন থাকার মতলব। তারা তাই ছোটোমামাকে চটাতে চাইল না। খুব বেশি জিনিসও ছিল না। সব যথাস্থানে তুলতে ঘণ্টা দুই লাগল। স্টোভ ছিল, তেল ছিল, ডাল-চাল ছিল, মসলা ছিল, একটা কালো রোগা লোক মাত্র এক টাকায় এই বড়ো একটা চিংড়িমাছ নিয়ে এসে, কেটে কুটে দিয়ে গেল। টিলার নীচে একটু দূরে ছোট্ট দোকান থেকে আলু পেঁয়াজ কেনা হল। তখন ছোটোমামা উঠে বললেন, যা, তোরা সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আয়, আমি চিংড়ি দিয়ে খিঁচুড়ি রাঁধব।

সমুদ্রের ধারটা উঁচু-নীচু, ঢেউগুলোও তখন অনেক শান্ত। গুপি সমুদ্রের ঘোড়া পেল। কুড়িয়ে নিতেই সেটা কিলবিল করে উঠল। অমনি গুপি সেটাকে ছুঁড়ে ভাটার জলে ফেলে দিয়ে, ধপ করে বালির উপর বসে পড়ল, ‘ছোটোমামার কপালটাই মন্দ। নাকের ডগা দিয়ে নাদুমামার প্রাপ্তি-যোগ ঘটে গেল আর ও বেচারা কিচ্ছু পেল না আবার কী? ও বাড়ির একটা কাঁঠাল গাছ, ঝাউ গাছের শব্দ আর সমুদ্রের গন্ধ আছে। গুপি কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘আর আছে এক বাক্স বোঝাই শামুক-ঝিনুক।’ তাই শুনে পানু হঠাৎ লাফিয়ে উঠল, ‘গুপি চল, ছোটোমামার প্রাপ্তিযোগটা বোধহয় হয়ে গেল!’ আর কিছু না বলে পানু হনহনিয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়িময় ভুরভুর খিচুড়ি আর চিংড়ি মাছের গন্ধ। সেদিকে ভ্রূপেক্ষ না করে পানু সটাং দোতলার ঘরে ঢুকে, শামুক-ঝিনুকের বাক্স আবার উল্টে ফেলল। আবার এক ঝলক দুর্গন্ধ নাকে এল। পানু বড়ো বড়ো গোল গোল কালোপানা ঝিনুকগুলোকে আলাদা করতে লাগল। গুপি অবাক হয়ে দেখল ঝিনুকগুলো আস্ত রয়েছে। কালো পচা পোকা শুকিয়ে ঘুঁটে। তারই বুকে নিটোল মুক্তো জ্বলজ্বল করছে। চল্লিশটা ঝিনুক খুলে সাঁইত্রিশটা মুক্তো পাওয়া গেল। কোনটা বড়ো, কোনটা সাদা, কোনটাতে একটু গোলাপি ভাব। গুপী আর পানু পা ছড়িয়ে হাঁ করে তাই দেখতে লাগল। নীচে থেকে ছোটোমামার হাঁকডাকে কেউ কোনো সাড়া দিল না দেখে, শেষ পর্যন্ত ছোটোমামা ছুটতে ছুটতে ওপরে এসে দরজার কাছ থেকে ঝিনুকের খোলার স্তূপ আর মুক্তোর খুদে টিপি নামাল, আর এক ঘটি জল এনে ছোটোমামার মাথায় ঢালতে বাধ্য হল। ছোটোমামা চোখ খুলতে গুপি বলল, তোমার প্রাপ্তিযোগ হয়েছে, এই কি মুচ্ছো যাবার সময় নাকি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *