প্রাপ্তি

প্রাপ্তি

চাতরার বাসটা একটু আগে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। এখন অনেকক্ষণের জন্যে চাঁদোয়া গ্রামে আর কোনো শোরগোল নেই। এখন সকাল ন-টা।

বর্ষার বেলা। আকাশে রাশ রাশ মেঘ জমেছে। পাশের বাড়ির রামনাথ সিং-এর বাড়ির কুয়োর লাটাখাম্বা উঠছে নামছে। তার ‘ক্যাঁচর-কোঁচর’ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সোমা ঘর থেকে বারান্দায় এল। উঠোনে শাড়ি শায়া সব ঝুলছিল। কাল বৃষ্টি হওয়ায় শুকোয়নি। সেগুলোতে হাত দিয়ে দেখল, শুকিয়েছে কি না। তারপর বারান্দায় বসে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে বলল, রুকমিনী, চায়ে লাও।

রুকমিনী চা বানিয়ে নিয়ে এল।

সমস্ত দিনে এই সময়টুকু, শুধু এই সময়টুকুই সোমার নিজের সময়। একান্ত নিজস্ব সময়। এ সময়ের ওপর আর কারওরই দাবি নেই। এই সময়টায় বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে ও অনেককিছু ভাবে। ভাবতে ভাবতে পেঁপে গাছে বসা অবাধ্য কাককে মাঝে মাঝে হুস হুস করে হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। সেই সময়ে ওর ইচ্ছে করে, ওর অলস মনের আলসেতে যে দুঃখের ভাবনার করুণ কাকটা বারে বারে মানা না শুনে উড়ে এসে বসে, তাকেও যদি সে এমনভাবে হুস হুস করে তাড়াতে পারত তাহলে বোধ হয় খুবই ভালো হত।

প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে প্রত্যেক মেয়ের জীবনের কিছু কিছু পুরোনো কথা থাকে, যা ভুলে যেতে ইচ্ছা করে। আবার কিছু কিছু বিস্মৃত, প্রায়-উষ্ণ কথাকে দু-হাতে বুকের মধ্যে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত করে রাখতে ইচ্ছা করে। দিনের এই সময়টাতে সোমা সেইসব বহুবর্ণ উলের লাছির মতো নরম কথাগুলি নিয়ে মনের আঙুলে নাড়াচাড়া করে।

ছোটুয়াকে মুদির দোকানে পাঠিয়েছিল।

দরজার শিকলে আওয়াজ তুলে ছোটুয়া দৌড়ে ঢুকল উঠোনে। ও হাঁপাচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মাইজি, কলকত্তাসে এক বাবু আয়া এহি বাসমে। সাহাবকা বারেমে পুছতেথে দুকানমে, হাম সাথমে লেতে আয়া।’

সোমা অবাক হল। বিরক্তও হল। ভাবল নিশ্চয়ই শ্যামল এসেছে। ওর মেজো ভাসুরের বড়োছেলে। চাকরির জন্যে লিখেছিল। কলকাতার লোকেরা ভাবে, বাইরে যেন চাকরি গড়াগড়ি যাচ্ছে। তার ওপর চাকরি দু-একটা থাকলেও এদিকে বাঙালির ছেলেকে ভয়ে কেউ নিতে চায় না। এমনই সুনাম হয়েছে এখন কলকাতার। ‘না’ করা সত্ত্বেও বলা নেই, কওয়া নেই এখানে একেবারে সশরীরে হাজির!

মনে মনে বিরক্ত হল সোমা।

ছোটুয়ার সঙ্গে উঠোনের প্রান্ত অবধি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা পুরো খুলল।

দরজা খুলতেই, অবাক হয়ে গেল।

বেদে, ডান হাতে ছোটো সুটকেসটা, আর বাঁ-হাতে একবাক্স মিষ্টি নিয়ে একটা সবুজ খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে গাছতলা দিয়ে হেঁটে আসছিল।

সোমা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। চুপ করে ওইদিকে চেয়ে রইল। ওর সমস্ত মেঘলা মনখারাপ সকালটা দারুণ এক অপ্রত্যাশিত ভালো লাগায় ভরে গেল।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ছোটুয়া বলল, ‘কা মাইজি? আপ ই বাবুকো পহচান্তে নেহি?’

সোমা হাসল। বলল, ‘কৌসিস তো কর রহা হ্যায়। আনে দো নজদিকমে। আভিতক পহচানা নেহি।’ বলে, নি:শব্দে হাসল।

বেদে দরজার কাছে আসতেই সোমা হাত বাড়িয়ে সুটকেসটা নিল, বলল, বাব্বা কী ভারী, যেন পাথর কী আছে এতে?

বেদে আস্তে আস্তে বলল….বড়ো ছটফট করছ। স্থির হয়ে বোসো তো।

বেদে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে হাসল। বলল, তোমার মন।

সোমাকে ভীষণ খুশি খুশি দেখাল।

বলল, আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।

বেদে শুধোল, সুনন্দ কোথায়?

—ও তো টুরে গেছে। পরশু ফিরবে।

—যা:। এত কষ্ট করে এত মাইল বাসে করে এলাম। বাড়িতে গৃহস্বামী না থাকলে অযাচিত অতিথি কী করে রাত্রিবাস করে? অতএব কষ্টই সার। থাকা হবে না!

খুব হতাশ দেখাল বেদেকে।

সোমা বলল, চলুন ভেতরে চলুন। বসুন। পরক্ষণেই গলা চড়িয়ে বলল, রুকমিনী জলদি চায়ে কা পানি বৈঠাও।

বসার ঘরে সব ক-টা জানলা-দরজা খুলে দিল সোমা। গোল টেবিলে একটা ক্রুশের কাজ করা টেবিল ক্লথ। দেওয়ালে দু-টি জলরঙা ছবি। একটা ছোটো বুক-কেস। তার ওপরে সুনন্দ আর সোমার বিয়ের সময়কার তোলা ছবি। এনলার্জ করা।

বেদে চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর সোমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি কিন্তু বেশ মোটা হয়ে গেছ।

হয়েছি বুঝি? হাসল সোমা। বলল, বিয়ের পর বেকার হয়ে গেছি তো। দুপুর বেলাটা কিছুই করার নেই। এখানে একটা বাচ্চাদের স্কুল আছে। একেবারে বাচ্চাদের। ভাবছি, এমনিই পড়াব ওদের। এখনও হিন্দিটা ভালো রপ্ত হয়নি। তাই শুরু করিনি।

বেদে কথা বলল না, একদৃষ্টে সোমার দিকে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে বলল, তুমিও একেবারে বাচ্চা। বড়ো ছটফট করছ। স্থির হয়ে বোসো তো। কতদিন তোমাকে দেখি না। একটু ভালো করে কাছ থেকে দেখি তোমাকে।

সোমা বসল উলটোদিকের চেয়ারে, স্থির হয়ে বসল কিন্তু মুখে বলল, থাক আর বেশি দেখতে হবে না। তারপরই বলল, অসভ্য। আমার চিঠির উত্তর দেননি কেন?

বেদে চুপ করে রইল।

সোমা আবার বলল, কী? কথা বলছেন না যে?

বেদে বলল, উত্তরে এতকিছু লেখার ছিল যে, অনেক রাতে ঘুম নষ্ট করেও উত্তরের খসড়াটা ঠিক হল না। তাই ভাবলাম, তোমার কাছে চলে আসি। নিজে গিয়েই উত্তরটা দিই!

সোমা বলল, একা এলেন যে। মিলুদিকে নিয়ে এলেন না কেন?

বেদে হঠাৎ শুকনো মুখ তুলে তাকাল।

বলল, একা এসেছি বলে বুঝি তুমি খুশি হওনি? ভয় নেই তোমার। তোমার মিলুদিও নেই সুনন্দও নেই, তখন তোমার কাছে, শুধু তোমার একার কাছে কি আমি থাকতে পারি? লোকে কী বলবে? একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভয় নেই। আমি বিকেলের বাসেই চলে যাব।

সোমা মুখ নীচু করে রইল। অস্ফুটে বলল, আহা! আমি যেন তাই বলেছি।

গলার স্বরে কেমন একটা বিষাদ ফুটল, কিন্তু গলার স্বর শুনে একথা মনে হল না যে, বেদে থাকলে ও খুশি হয়। অথচ বেদে আসাতে যে ও খুশি হয়েছে সেই খুশিতে কোনো ফাঁকি ছিল না।

বেদে মুখ নীচু করে সুটকেসটা খুলল। বলল, তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছি। আজ চান করে এটা পোরো, বুঝেছ? গতকাল তোমার জন্মদিন ছিল, তাই না? গতকাল আমি আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাঁচির কাজ শেষ হল না কিছুতেই।

সোমা মুখ নীচু করে শাড়িটা নিল। চাপা গলায় বলল, কেন আনলেন?

বেদে অনেকক্ষণ ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকল। বলল, কেন? তুমি জানো না?

—না।

—হ্যাঁ। তুমি জানো। তুমি সবই জানো। তবু বারে বারে নতুন করে পুরোনো কথাটা শুনতে ভালো লাগে বুঝি?

সোমা লজ্জা পেল। বলল, মোটেই না।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বেদে বলল, জানো সোমা, মাঝে মাঝে আমার ভারি অবাক লাগে। যা সত্যি, কেন তা স্বীকার করোনি তুমি কোনোদিন? স্বীকার করলে কি তুমি আমার কাছে ছোটো হয়ে যেতে?

সোমা মুখ নীচু করে বসে রইল।

বেদে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশ ও পাশের সবুজ শালবনে চেয়ে রইল। একটা শালিক পাখি জানলার কাছের সবুজ আগাছায় ভরা লাল মাটির ফালিটুকুতে সরে সরে বসতে লাগল। ওই দিকে চেয়ে বেদে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

একসময় সোমা বলল, আমি আপনার চা-টা নিয়ে আসি। আপনি বসুন।

বাইরের পাতায় পাতায় অলস হাওয়ার পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল।

বেদে বলল, না! আমি তো একটু পরেই চলে যাব। আমি যতক্ষণ থাকব তুমি আমার সামনে বসে থাকবে, একমুহূর্তের জন্যেও আমার চোখের সামনে থেকে সরবে না। আমি কি এতদূরে তোমার বাড়িতে চা খাবার জন্যে এসেছি?

—না। অনুরোধের গলায় সোমা বলল, আপনি এরকম করবেন না বেদেদা। আমি এক্ষুনি আসছি। আমারও তো ইচ্ছে করে আমি আপনার জন্যে একটু কিছু করি।

বেদে জবাবে কিছু বলল না।

সোমা উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে বেদের দিকে তাকাল।

দুপুর বেলা অনেক পদ দিয়ে, অনেক যত্ন করে, সামনে বসে পাখার হাওয়া করে সোমা বেদেকে খাইয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার পর ওরা বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল।

সোমা চান করে উঠেই বেদে যে শাড়িটা এনেছিল সেটা পরেছিল। একটা জরিপাড়ের, বাসন্তীরঙা টাঙ্গাইল।

বেদে বলল, এরকম গিন্নিদের মতো শাড়ি পরে তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু। মাথায় জ্বলজ্বলে সিঁথি, সিঁদুরের টিপ। ভাবা যায় না। ইচ্ছে করে, সারাজীবন সমস্ত কাজকর্ম ফেলে রেখে তোমার দিকে শুধু চেয়েই বসে থাকি।

সোমা হেসে ফেলল। বলল, থাক আর বেশি বেশি বলতে হবে না। মাঝে মাঝে বাড়িতে এরকম করে মা-পিসিদের মতো পরি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, আমি নই, অন্য কেউ।

তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। দু-জনে দু-জনের ভাবনা নিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

সোমা বলল, আপনি এই ঘরেই শোবেন, কেমন?

বেদে হাসল, বলল, তা জানি। তোমার ঘরে যে, এ জন্মে কোনোদিনও শুতে পারব না একথাটা বার বার মনে করিয়ে দাও কেন?

—অসভ্য। আপনি ভীষণ অসভ্য। সোমা বলল, তারপর বলল, রাতে কী খাবেন বলুন?

—আমি সত্যিই চলে যাব সোমা।

—সত্যিই? থাকবেন না? তারপর সোমা খুব জোর দিয়ে বলল, কেন?

সোমার গলা এবার বিষণ্ণ শোনাল। তা ছাড়া, সুনন্দ যে নেই!

বেদে বলল, এমনিই। কারণ নেই কোনো। কোনো কারণ নেই।

রাঁচির বাসের খোঁজ করতে পাঠিয়েছিল সোমা ছোটুয়াকে। ছোটুয়া এসে বলল, ডালটনগঞ্জ থেকে লাতেহার হয়ে সাড়ে ছ-টায় আসবে বাস এখানে। দশ মিনিট পর এখান থেকে রাঁচি রওনা হয়ে যাবে।

একথা—সেকথার পর বেদে হঠাৎ বলল, আজকের আবহাওয়াটা দারুণ, না?

সোমা উৎসাহের গলায় বলল, চলুন-না বেড়াতে যাবেন? কতদিন আমরা একসঙ্গে বেড়াই না। না?

—কোথায়?

—এই তো সামনের মহুয়াসিরির টাঁড়ে।

বেদে বলল, চলো।

সোমা রুকমিনী আর ছোটুয়াকে বাড়িতে থাকতে বলল। বিকেলে চা-এর সঙ্গে কী কী খাওয়াবে বেদেকে তার আলোচনা হল ওদের সঙ্গে ফিসফিস করে। তারপর একটা ছাতা নিয়ে সোমা বলল, চলুন।

—এ কী? তুমি খালি পায়ে যাবে? বেদে বলল।

—হ্যাঁ। এই বৃষ্টি-ভেজা শক্ত লাল মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে আমার দারুণ লাগে। এখন দারুণ একটা গন্ধ বেরোয় গাছপালা মাটি থেকে, না?

বেদে জবাব না দিয়ে, মাথা নাড়ল।

—চলো। বলে, বেদে দরজা দিয়ে বাইরে বেরোল। পেছনে পেছনে সোমা।

সোমা বলল, বেদেদা আসুন, এইদিক দিয়ে।

ওরা রাস্তা ছেড়ে ছোটো ছোটো শালের চারাগাছের কচি কলাপাতা সবুজ-জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

আকাশে মেঘ। একটা ভিজে হাওয়ায় মাটি থেকে গাছ পাতা থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠছে। দূরের গভীর বন থেকে কী-একটা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। কাছেই কোনো ঝোপ থেকে কালি-তিতির ডাকছে ‘টিঁউ-টিঁয়া, টিঁউ-টিঁয়া, টিঁউ-টিঁয়া’।

দেখতে দেখতে হাওয়াটা হঠাৎ বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। ফিসফিস করে বৃষ্টি হতে লাগল। পাতায় পাতায় জলপড়ার শব্দ হতে লাগল। কিন্তু শব্দবিন্দুদের কোনো পৃথক সত্তা রইল না। হাওয়ার শব্দ, জলের শব্দ, পাতার শব্দ, পাখির শব্দ, সব শব্দ একাকার হয়ে গেল। সেই ভেজা, নরম, উজ্জ্বল আকাশ থেকে এক ফিসফিসে শান্ত পরিপূর্ণতায় ওদের দু-জনের মন ভরে তুলল। ভারী করে তুলল।

সোমা বলল, এই ভিজে যাচ্ছি আমি, ছাতা খুলুন।

ছাতাটা খুলে বেদে বাঁ-হাত দিয়ে ধরল। সোমাকে বলল আমার দিকে সরে এসো। ভিজে যাচ্ছ, তবু আমার কাছে আসবে না। আমি কি বৃষ্টির চেয়েও খারাপ?

সোমা হঠাৎ বেদের একেবারে গায়ের সঙ্গে লেপটে এল। সোমার বাঁ-হাতের পাতা ওর ডান হাতের পাতার মধ্যে মুঠি করে ধরল। সোমা মুখটা নুইয়ে একবার বেদের বুকের কাছে নিল। তারপরই আবার মাথা উঁচু করে হাতে হাত রেখে গায়ে গায়ে মিশে ওরা হাঁটতে লাগল।

একটা মাছরাঙা পাখি, নীল-সাদা-লাল ও বেগনেতে মেশা; উড়ে এসে সামনের একটা চারাগাছে বসল। পাখিটার ভারে ভেজা চারাগাছটা দুলতে লাগল। পরক্ষণেই পাখিটা উড়ে গেল। অপস্রিয়মাণ পাখিটার ডানা অনুসরণ করে আকাশে চাইতেই ওরা দেখল যে, পাখিটা তার ডানার সব রং একটা দিগন্তজোড়া রামধনুর গায়ে মুছে দিয়ে শালের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে বেদে বলল, আমি এসেছি বলে তুমি খুশি হয়েছ কি না বললে না?

—উঁ?

—কথা বলবে না?

—কথা বলতে ভালো লাগছে না।

তারপর একটু চুপ করে থেকে সোমা বলল, বেদেদা, আপনি সবসময়ে খুব কষ্ট পান, না?

বেদে হাসবার চেষ্টা করল। বলল, শুধুই কষ্ট পেয়েছি ও পাই একথা বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। আনন্দও পেয়েছি অনেক। এই উজ্জ্বল বিকেলের মতো, তোমার হাতের নরম উষ্ণতার মতো, এসব আনন্দ তো চেয়ে পাওয়া যায় না, কখনো কখনো কোনো সুগন্ধি সুক্ষণে এমন আনন্দ হঠাৎ হঠাৎ এসে আমাদের সস্তা কামনা, সস্তা চাওয়াকে এক দারুণ দুর্লভ দম্ভে ভরে দিয়ে যায়। জানো সোমা, আমার কেবলই মনে হয়, যে-ভালোবাসা দাম্ভিক নয়, যে ভালোবাসা সহজেই পাওয়া যায়; তা বোধ হয় যে কেউই পেতে পারে। তাতে কোনো গর্ব নেই।

সোমা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। অনেক অনেকক্ষণ পরে সোমা বলল, বেদেদা, আপনাকে একটা কথা বলব বলব করে বলতে পারিনি কোনোদিন। তা ছাড়া আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারিও না।

বেদে বলল, বলো কী বলবে। অগোছালো করেই বলো, আমি গুছিয়ে নেব।

সোমা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

বেদে বলল, কী হল সোমা? বললে না?

সোমা বলল, বেদেদা, আমি সুনন্দকে যা দিই, যা দিয়েছি, প্রত্যেক স্ত্রী-ই তাদের স্বামীকে যা দেয়, তারসঙ্গে আপনাকে আমি যা দিয়েছি তার কিন্তু কোনো তুলনা চলে না। কোনো তুলনা হয় না। আপনাকে আমি এ জীবনে যা দিয়েছি, আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না; তা কেবল আপনাকে দিয়েই ফুরিয়ে গেছে। এ এমন কোনো দান, যা বার বার বা বিভিন্ন লোককে দেওয়া যায় না। তা কেবল একজনকে এক বারই দেওয়া যায়। একথাটা যদি আপনি কোনোদিনও বোঝেন, বুঝে থাকেন, তাহলে আমার নিজেকে খুব হালকা লাগত।

বেদে চুপ করে রইল।

সোমা বলল, গভীর রাতে কখনো-সখনো ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে অথবা জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের অসংখ্য তারাভরা আকাশে চেয়ে ভাবি, ভাবার চেষ্টা করি, আপনি তখন কলকাতায় কী করছেন। আমার তখন খুব কষ্ট হয় আপনার জন্যে। আমার মনে হয়, আপনি বোধ হয় অমনি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। আমার ভারি কষ্ট হয় এই ভেবে যে, জীবনে আপনাকে আমি দেওয়ার মতো জাগতিক কিছুই দিতে পারলাম না। তাই বলছিলাম, যা দিতে পারতাম তা দিইনি বলে, দিইনি কিছুই এমন নয়। শুধু ভয় হয়; যা দিয়েছি তার দাম বুঝতে বুঝি-বা ভুল করলেন।

বেদে সোমার হাতে নরম করে একটু চাপ দিল। কোনো কথা বলল না।

মাছরাঙা পাখিটা রামধনুর সমস্ত রং আবার নিজের ডানায় শুষে নিয়ে ওদের সামনে ভেজা হাওয়ায় গ্লাইডারের মতো ভেসে বেড়াতে লাগল।

সোমা বলল, চলুন, ফিরবেন না।

—চলো, বেদে বলল।

ওরা দু-জনে ছাতা মাথায় সুনন্দর কোয়ার্টারের দিকে ফিরে আসতে লাগল।

বড়োরাস্তায় পড়ে সোমা বলল, বেদেদা মনে আছে? এমনই এক খোলাদুপুরে আপনার সঙ্গে কলকাতার কাছে গঙ্গার পারে এক রাইস মিলে গেছিলাম। অনেক দিন হয়ে গেল না?

—সঙ্গে আরও কে কে যেন ছিল, তাই না?

—হ্যাঁ অনেকে ছিল। রুনা, জয়িতা, রুদ্র, রুদ্রর দাদা। খুব মজা হয়েছিল। যে-দিনগুলো চলে গেছে, চলে যায়; সে দিনগুলোর কথা ভাবলে ভারি কষ্ট হয়। আশ্চর্য। একটি দু-টি দিন কেমন মনের মধ্যে গেঁথে যায়! গেঁথে থাকে! না?

বেদে বলল, সেদিন বাড়ি ফিরে ডায়েরিতে আমি কী লিখেছিলাম আমার আজও মনে আছে পরিষ্কার।

সোমা মুখ ঘুরিয়ে বেদের দিকে চোখ তুলে বলল, কী লিখেছিলেন? বলুন-না?

বেদের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠল। বলল, কেন? তোমাকে তো তারপরে একটি চিঠি লিখেছিলাম, মনে পড়ে না? কিছুই মনে পড়ে না আর?

—কত চিঠিই তো লিখেছিলেন। সেরকম সুন্দর সুন্দর চিঠি আমাকে আর কেউ কখনো লিখবে না। আপনিও না।

বেদে মুখ নীচু করে রইল। বলল, হয়তো চেষ্টা করলেও সেরকম চিঠি লিখতে পারব না আর।

—কেন? পারবেন না কেন?

—পারব না, কেননা, যাকে চিঠি লেখা, সে আর আগের মতো নেই বলে।

—মোটেই না। আপনি তো সবই জানেন।

জানি। বলল বেদে। তারপর বলল, চিঠি যে লেখে, তার কৃতিত্বের চেয়ে অনেক বড়ো কৃতিত্ব, যে চিঠি লিখিয়ে নেয় তার।

—আপনাকে যে পুরোনো চিঠির প্যাকেটগুলো দিয়ে দিলাম সেগুলো কী করলেন?

—পুড়িয়ে ফেলেছি। অনেক বার, বার বার রাত জেগে পড়ে, তারপর পুড়িয়ে ফেলেছি।

—পুড়িয়ে ফেলেছেন? কেন? সোমাকে খুব আনন্দিত মনে হল, কিন্তু ভাব করল, যেন খুব বিষণ্ণ হয়েছে।

বেদে একবার মুখ ফিরিয়ে সোমার দিকে চাইল।

বেদের মুখ খুব গম্ভীর দেখাল। বেদে চুপ করে রইল।

সোমা আবার বলল, এবার আবদারের গলায় বলল, ওমা! কেন, পুড়িয়ে ফেললেন কেন?

বেদে বলল, এমনিই। কারণ নেই কোনো।

তারপর মুখ নীচু করে আস্তে আস্তে বলল, চিঠিতে মানুষ যেমন কাঙাল, যেমন অকৃত্রিম, যেমন শিশুর মতো অকপট, তেমন আর কিছুতেই নয়। যাকে লেখা, তার কাছেই যখন সেই অকপট চিঠিরা হঠাৎ একদিন মূল্যহীন হয়ে গেল, তখন যে লিখেছিল তার কাছে আর তাদের দাম কী থাকে বলো? থাকে কি কিছু?

সোমা চুপ করে রইল।

চা-এর সঙ্গে অনেরকম খাবার করেছিল সোমা। সুন্দর ট্রে-তে সাজিয়ে সুন্দর লেসের ম্যাটের ওপর দামি কাচের বাসনে সেসব খাবার সাজিয়ে দিয়েছিল।

বেদে বলেছিল, চা ঢালো। কতদিন তোমার হাতের বানানো চা খাই না। মাঝে মাঝে তোমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়ির খাবার ঘরটার কথা মনে পড়ে। তুমি পেয়ালায় আমার জন্যে চা ঢালতে, দুধ মেশাতে, চিনি মেশাতে, আর আমি উলটোদিকের চেয়ারে বসে অপলকে চেয়ে থাকতাম। তোমার চোখে কী দেখেছিলাম কী জানি! একজনের দু-টি চোখ আমার জীবনের সমস্ত চাওয়া, সমস্ত প্রাপ্তিকে কী মর্মান্তিকভাবে মিথ্যা করে দিল।

সোমা বলল, থাক-না ওসব কথা। আর একটু খান। এই শিঙাড়াটা খান, প্লিজ, খুব ভালো করে এখানকার টক্কনলালের দোকানে।

একসময় বাসের সময় হয়ে এল। ছোটুয়ার হাতে সুটকেস দিয়ে সোমা বেদেকে বাসে তুলে দিতে এল। বাসটা লাতেহার থেকে এসে দাঁড়িয়েছিল চাঁদোয়াটোড়ির মোড়ে। রাঁচি পৌঁছোতে বেশ রাত হয়ে যাবে।

কনডাক্টর হাঁক ছাড়ল।

চায়ের দোকানে বসে-থাকা খাকি হাফশার্ট আর পাজামা পরা ড্রাইভার পানটা মুখে পুরে, পানের বোঁটা থেকে চুনটাতে শেষ কামড় দিয়ে বোঁটাটা ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে উঠে পড়ল।

বেদে বলল, চলি সোমা।

সোমা মুখ নীচু করে রইল। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল।

বেদে বলল, কাল তোমার জন্মদিনে একটা চিঠি লিখেছিলাম রাঁচির হোটেলের ঘরে বসে। তোমাকে দিতে ভুলে গেছিলাম। নাও।

সোমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েই হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল।

বেদে গিয়ে বাসে উঠে জানলার পাশের সিটে বসল।

ইঞ্জিন স্টার্ট করার শব্দ হল। ড্রাইভার কড়মড় শব্দ করে গিয়ার দিল গাড়িতে। কনডাক্টর পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রায়ান্ধকার পথের দিকে অদৃশ্য যাত্রীদের উদ্দেশ্যে শেষহাঁক ছাড়ল, ‘আইয়ে আইয়ে, কুরু, মান্দার, রাঁচি; আইয়ে।’

সোমা হঠাৎ মুখ তুলল।

বেদে সেই প্রায়ান্ধকারে সোমার চোখ দু-টি ভালো দেখতে পেল না।

বাসটা ছেড়ে দিল।

তারপর বাসের লাল টেইল-লাইটটা একসময় কুরুর জঙ্গলময় পাহাড়ি পথে হারিয়ে গেল।

সোমা বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে গা ধুল। গা ধুয়ে, ঘরে এসে শাড়ি পড়ল। সিঁদুর-টিঁদুর সেদিন আর পরতে ভালো লাগল না। রুকমিনী চা বানিয়ে নিয়ে এল। সোমা বলল, রেখে যেতে। ছোটুয়াকে ডেকে বলল, ঘর থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে যেতে।

ও জানলার কাছে এসে দাঁড়াল।

বাইরে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফিকে-চাঁদ সরে যাচ্ছে। মোরব্বা খেত থেকে ঝিঁঝি ডাকছে। মহুয়াসিরির টাঁড়ের ওপরে একটা পেঁচা উড়ে উড়ে বড়ো অশ্বত্থ গাছটার চারধারে ঘুরে ঘুরে ডাকছে।

বাইরের সেই ভেজা রাতে চেয়ে, একটা জানলায় দাঁড়িয়ে সোমা ভাবছিল, কেউ যা চেয়েছিল, যাকে তা দেওয়া হয়নি, তার কাঙাল মুখের কথা মনে করে, ওর সমস্ত বুকটা, ওর সুখী-নির্লিপ্ত মনটা ঝড়ের নিম গাছের মতো হঠাৎ এমন উথালপাতাল করছে কেন?

রামনাথ সিং-এর বাড়ির কুঁয়োর লাটাখাম্বার ওঠা-নামার ‘ক্যাঁচ-কোঁচ’ শব্দের সঙ্গে ওর মন অন্ধকার রাতের ঝিঁঝি ডাকা জোনাকিজ্বলা টাঁড়ের দিকে ভেসে যেতে লাগল। সেখানে মাছরাঙা পাখি পৃথিবীর সব রং নিয়ে গ্লাইডারের মতো ভেসে বেড়ায়; সারাদিন ভেসে বেড়ায়।

বেদের চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে রেখেছিল।

ছোটুয়াকে লণ্ঠনটা নিয়ে আসতে বলল সোমা। ছোটুয়া লণ্ঠনটা নিয়ে আসতেই সোমা বলল, না:, ওটা নিয়েই যা।

ছোটুয়া চলে গেলে অন্ধকার ঘরে ওর খাটের ওপর উপুড় হয়ে বেদের চিঠিটা বুকে করে চুপ করে শুয়ে রইল সোমা।

সোমা ঠিক করল। ওই চিঠিটা ও কোনোদিনও খুলবে না। ওর আতরদানির মধ্যে এই খামটা রেখে দেবে ততদিন, যতদিন বেদের সঙ্গে ওর আবার দেখা না হয়!

অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সোমা ভাবল, তেমন তেমন চিঠি কখনোই খুলতে নেই। বন্ধ চিঠি যা বয়ে আনে, যা সঞ্চিত রাখে; খোলা চিঠি বুঝি তার কণামাত্রকেও ধরে রাখতে পারে না।

ও জানলায় তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, তোমাকে তোমার এই চিঠির সঙ্গে আমার মনের আতরদানিতে চিরদিনের জন্যে বন্দি করে রাখব। তোমার মনের সুগন্ধ আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত অস্তিত্ব এক দারুণ সুগন্ধে ভরে দেবে। আমি জানি, আমাদের এই আশ্চর্য দুঃখ অথবা আনন্দ; আমরা নিজেরা যা, তার চেয়ে আমাদের দু-জনকেই অনেক বড়ো করে দিয়েছে। অনেক বড়ো। যা আমরা অন্য কোনোভাবেই হতে পারতাম না বেদেদা!

ড্রেসিং টেবিলের সামনে লণ্ঠনটা বসিয়ে নিয়ে, ভালো করে সাজতে বসল সোমা।

আয়নার সামনে বসে ওর মুখে ভীষণ মিষ্টি একহাসি ফুটে উঠল।

একা ঘরের আলোকিত আয়নায় প্রতিফলিত ওর হাসিভরা মুখের দিকে চেয়ে ও বলল, বেদেদা, ওরা সকলেই কিন্তু হেরে গেল তোমার কাছে। সোমা চিরদিনের জন্যে, বরাবরের জন্যে তোমার, একমাত্র তোমার একারই থাকল। থাকবে চিরদিন। তোমার এই পরমপ্রাপ্তি কোনোদিনও দৈনন্দিনতার বা পৌনঃপুনিকতার গ্লানিতে ম্লান হবে না।

বিশ্বাস করো, তোমাকে কিন্তু আমি একটুও ঠকাইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *