প্রান্তিক

প্রান্তিক

মিস্টার হোড় বললেন, ব্রিলিয়ান্ট, সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট।

আসলে একা মিস্টার হোড়ই নন, ইনকাম ট্যাক্সেও এমন লোক নেই যিনি সুকল্যাণ সেনকে প্রশংসা না করেন। পন্ডিত অনেকে হতে পারেন; আছেনও হয়তো বা, কিন্তু ভালো অ্যাডভোকেট সকলে হতে পারেন না। ইচ্ছে করলেই ভালো অ্যাডভোকেট হওয়া যায় বলে অশোক জানে না। মানে তো নাই-ই।

নইলে, এত বড়ো একটা কুড়ি লাখ টাকার ক্যাশক্রেডিটের কেস কেমন সুন্দরভাবে গুছিয়ে আর্গুমেন্ট করছেন। অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনালের বাঘা-বাঘা মেম্বাররা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। যেমন সুন্দর চেহারা, মিষ্টি করে কথা বলা, তেমন ক্ষুরধার বুদ্ধি। একেবার রাজযোটক মিল হয়েছে একটি লোকের মধ্যে। সকলে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ এমনি এমনি বলে না।

দ্বিতীয় দিনের শুনানি যখন শেষ হল, তখন মিস্টার হোড় বললেন, ব্রিলিয়ান্ট। অশোক বলল, মুখে ব্রিলিয়ান্ট বললে হবে না, কেসে যদি সত্যিই জেতেন, তা হলে দশ হাজার টাকা ফি দিতে হবে সেনসাহেবকে।

দশ হাজার? চমকে উঠল হোড়।

অশোক কেটে কেটে বলল, হ্যাঁ। দশ হাজার। উনি তাই চেয়েছেন। কেন? কেস জিতলে আপনার মালিকের কত ট্যাক্স রিলিফ হবে? কত লাখ টাকা? তা তো জানেন।

মিস্টার হোড় হেসে বললেন, আজ্ঞে না, সেকথা আর বলতে।

তবে?

অশোক শুধোল।

না। তবে কিছু না, মানে, দশ হাজার একটু বেশি মনে হচ্ছে, এই আর কী।

তৃতীয় দিনের শুনানি আরম্ভ হল। অশোক জুনিয়র কাউন্সেল। টেবিলের ওপর উপুড় করে বই সাজিয়ে রেখে একটি একটি করে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের গোলার মতো সিনিয়র সুকল্যাণ সেনকে জোগান দিচ্ছে। আর দেখতে দেখতে ডিপার্টমেন্টাল রিপ্রেজেনটেটিভের যুক্তির জঙ্গি বিমানগুলি ভূতলশায়ী হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। মিস্টার হোড়ের উত্তেজনা বাড়ছে। মাঝে মাঝেই কোর্ট রুম থেকে বাইরে গিয়ে সিগারেট খেয়ে আসছেন।

বহুমূল্য আংটি-পরা দু-হাতের তেলোয় সাঁতরাগাছির ওলের মতো মুখখানি রেখে, শ্মশানেরাজা হরিশ্চন্দ্র যেমন বিবাগির মতো মুখ করে বসেছিলেন; মুখে তেমনি একটি কৈবল্য ভাব ফুটিয়ে বসে আছেন। আর মাঝে মাঝে মুলতানি গোরুর মতো জোরে জোরে নি:শ্বাস ফেলছেন।

লোকটাকে দেখে প্রথম দিন থেকেই মনে হয়েছে, লোকটা একটা ঘুঘু। অ্যাপেলেন্টের কর্মচারীই নয় হয়তো! হয়তো কনট্রাক্ট করেছে কেস জিতিয়ে দেবার জন্যে; তার পর পাকা রেসুড়ে যেমন ঘোড়া বুঝে জান-লড়ায়, তেমনি সুকল্যাণ সেনকে খুঁজে বের করে সেই ঘোড়ায় বাজি লাগিয়েছে। জিতলে বাজিমাত। হারলেই বা কী? ওর থোড়াই গ্যাঁট থেকে কিছু খরচ হচ্ছে। লোকটার অতিবিনয় দেখেই মনে হয়, হয় লোকটা দালাল; নয় খুনে।

এদিকে আর্গুমেন্ট প্রায় শেষ হয়ে এল। সেনসাহেব সামিং-আপ করছেন। মেম্বারেরা হাইলি ইম্প্রেসড। অ্যাপারেন্টলি। যেমন চমৎকার পেপারবুক করা হয়েছিল তেমনি খেটেছিলেন সেনসাহেব কেসটিতে। অশোকও কম খাটেনি। এতদিনের শ্রম এক্ষুনি পুরস্কৃত হবে। একটি বড়ো কেস তৈরি করা কি সোজা কাজ? কতবার অ্যাডজোর্নমেন্ট নেওয়া হল—কত কাগজ জোগাড় করতে হল, শয়ে শয়ে পাতা ডিকটেশান, শয়ে শয়ে পাতা টাইপ—তার পর তৈরি হল পেপার-বুক। একটি বড়ো কেসের শুনানি শেষ হতে হয়তো দু-দিন তিন দিন লাগে কিন্তু সে কেস তৈরি করতে লাগে দু-তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম। সেইসব রাতগুলোর কথা ভাবে অশোক। টেবিলে রাশীকৃত বই ছড়িয়ে বসে আছে। দেওয়াল ঘড়িটা একলা টিকটিক করছে। অফিসের সবাই যথাসময়ে চলে গেছে—। ও একা বসে বসে পাতা হাতড়াচ্ছে, নোট নিচ্ছে; ভাবছে।

ও অনেক দিন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেছে, মানুষ কি কখনো টাকার জন্য এত পরিশ্রম করতে পারে? ওর দৃঢ় ধারণা, টাকার জন্যে বা নিজের জন্যে কোনো মানুষই কিছুই করতে পারে না। অশোক যা কিছু করে সবই জেদের জন্যে, মজার জন্যে। একটি ভালো ইনস্যুয়িং বল ফেলে কোনো দুঁদে ব্যাটসম্যানকে আউট করার মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি পেয়েছে ও, একটি কেস ভালোভাবে জিতে ও ঠিক তেমনি আনন্দই পেয়েছে। ওর ঠাসবুনোনি যুক্তি, সুন্দর ডেলিভারি এবং গুড হিউমারের বিপক্ষে ওর প্রতিপক্ষ যখন উলটে-দেওয়া তেলাপোকার মতো আইনের যুক্তির পিচ্ছিল মেঝেতে হাত-পা ছুড়েছে তখন ওর খুব ভালো লেগেছে কিংবা কোনো অভদ্র, কুজাত প্রতিপক্ষ ওর সওয়ালের মুখে যখন গুড়ের হাঁড়িতে-পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো যন্ত্রণায় জবজব করেছে তখনও ওর খুব ভালো লেগেছে। শুধু টাকার জন্যে ও অন্তত কিছু করতে পারত না জীবনে। না, এ পর্যন্ত পারেনি। অথচ মুশকিল হচ্ছে টাকারও প্রয়োজন। সে প্রয়োজনটা আবার বেশি করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, যখনই চোখের সামনে দেখতে পায় ওর চেয়ে সর্ববিচারে নিকৃষ্ট অনেক লোক যেন-তেন প্রকারেণ পকেটভরতি টাকা রোজগার করে হাজারিবাগি টেঁটন ষাঁড়ের মতো শিং-উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেইসব দুর্বিনীত, ঘেয়ো গুণহীন কুকুরগুলিকে দেখলে ওর-ও বড়োলোক হতে ইচ্ছে করে। টাকা রোজগারের ইচ্ছাকে ও সবসময়েই অবদমিত করে রাখে। অথচ ও বুঝতে পায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো টাকা দিয়েই কেবলমাত্র ওই শ্রেণির টাকাওয়ালা লোককে শায়েস্তা করা যায়! ও অনেক কিছু বোঝে, সেই বোঝা যে ভুল তাও বোঝে, তার পর সব কিছু ভুলে যেতে পেরে তৃপ্তি পায়।

অবশ্য টাকা ছাড়াও অনেক কিছু দুশ্চিন্তার আছে। এসব চিন্তা ছাড়াও তার মনকে পীড়িত করার মতো অনেক চিন্তা মাথার মধ্যে দপদপ করে।

নীরেন, অশোকের স্ত্রী জুলির সেই কলেজে পড়া বন্ধু। কালো ঘোড়ার মতো চকচকে চেহারা, উলটো-করে ফেরানো চুল; অশোক জানে যে, অশোক বাড়ি না থাকলে সে আসে, যায়। মাঝে মাঝে জুলি তার সঙ্গে বাইরেও দেখা করে। কোনো রেস্তরাঁতে খায়। নীরেনদের একটি কটেজ আছে গঙ্গার ধারে। শ্রীরামপুরে। সেখানেও যায়। সব জানে অশোক। অথচ জুলির চোখ চেয়ে বিশ্বাস করতে পারে না যে, সে অসৎ। ওর চোখে চাইলে মনে হয়, ও বড়ো যন্ত্রণা পাচ্ছে। কিন্তু যন্ত্রণা ছাড়া বিশ্বাসঘাতকতার কোনো চিহ্ন জুলির চোখে দেখেনি কখনো। জুলি ওকে ভালোবাসে এবং অশোকের প্রতি সমস্ত ব্যাপারেই জুলি সৎ। কেবল যেদিন নীরেনের সঙ্গে জুলির দেখা হয়—সেদিন রাতে জুলির চোখের কালো মণি দুটি মৌটুসি পাখির মতো স্পন্দিত হতে থাকে ওর বুকের যন্ত্রণাটা চোখে এসে বাসা বাঁধে। জুলির প্রতি সমবেদনাও হয় অথচ ওকে ক্ষমা করতেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু ক্ষমা ও করে দেয়, কারণ ওর বিশ্বাসে এখনও ফাটল ধরায়নি জুলি। সুস্থ মেলামেশার যে সীমা ও মনে মনে এঁকে রেখেছে, সেই প্রান্তসীমা জুলি কখনো লঙ্ঘন করে গেছে বলে মনে হয়নি ওর।

আর্গুমেন্ট শেষ করে সেনসাহেব বসে পড়লেন। একটি ছাই-রঙা স্যুট পরেছিলেন সেদিন। ওডিকোলোন মাখানো সাদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন, তার পর ফিসফিস করে অশোককে বললেন, কেমন বুঝলে?

বোঝবার তো কিছু নেই স্যার। জিত। জিত হয়ে গেছে।

মিস্টার হোড়, একটু নড়ে চড়ে বসে রথের মেলার ‘আহ্লাদি’ পুতুলের স্বামীর মতো মাথা নেড়ে বললেন।

সেনসাহেব বললেন, না-আঁচালে বিশ্বাসই নেই। দেখো, কী হয়।

ফ্যানটা চিড়িক চিড়িক করে ঘুরতে লাগল। কোর্ট রুমের জানলা দিয়ে অশোক দেখল, আমগাছের ডালে একটি কাক গদগদ গলায় একটি সাদা-গলা মেয়ে-কাককে কী যেন বলছে।

মেম্বার উঠে গেলেন।

সেনসাহেব বললেন, আমি চলি অশোক। হাইকোর্টে একটা ম্যাটার আছে। হবে না বোধহয়; তবুও একবার যাওয়া দরকার। সেনসাহেব চলে গেলেন তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে।

মিস্টার হোড় অশোককে ডাকলেন।

কেমন বুঝলেন স্যার?

অশোক চটে উঠল, বলল দেখুন, আপনাকে রানিং কমেন্টারি দিতে পারব না। শুনলেন তো সবই।

মিস্টার হোড় মুখে ক্ষমার হাসি এনে বললেন, আহা! চটবেন না স্যার।

আসুন এদিকে একবার আসুন।

বারান্দার কোনায় ডেকে নিয়ে মিস্টার হোড়, তাঁর ঢোলা, ঝলঝলে টেরিলিনের প্যান্টের পকেট থেকে তাড়া তাড়া ঘামে-ভেজা এক-শো টাকার নোট বের করে দিতে লাগলেন।

অশোক তার স্যুটের এ-পকেট ও-পকেটে নোটগুলি ভরে রাখতে রাখতে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, কী ব্যাপার?

মিস্টার হোড় বললেন, সেনসাহেবের। আট আছে। মানে আট হাজার। ট্রাইব্যুনালের অর্ডার পেলে আর দু-হাজার দেব। ওঁকে বলবেন।

অশোক নিজের ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ক্যাপাসিটিতে এই কেস রিপ্রেজেন্ট করছে না। করছে, তার অফিসের হয়ে। এই কেসের জন্যে তার অফিসকে মিস্টার হোড় কত টাকা দিয়েছেন বা দেবেন তা অশোক জানে না। সে মাস গেলে মাইনে পায়। তা ছাড়া অন্য কিছু না।

অশোক ভাবল, মুখ ফুটে মিস্টার হোড়কে বলেই ফেলে কথাটা; বলে, যে সিনিয়রকে ফি দিলেন, জুনিয়রকে কিছু দেবেন না? বলি বলি করেও, বলতে পারল না কথাটা অশোক। অশোক এ কেসে কম খাটেনি। ওর বাড়িতেই পিসতুতো বোনের বিয়ে হল। অথচ ও গত সাত দিন সকাল আটাটা থেকে রাত এগারোটা অবধি এই কেস নিয়েই ডুবে থেকেছে। অনেকেরই অনেক অন্যায় কথা শুনতে হয়েছে। বিদ্রূপাত্মক কথা। কিন্তু অশোক চিরদিনই এই কর্মবিমুখ, পরনিন্দামুখর, ঈর্ষা-জরজর সমাজে বিশ্বাস করে এসেছে যে, ‘ইন আ ম্যানস লাইফ, নাথিং কামস বিফোর ওয়ার্ক।’

কাজকে জীবনের ব্রত করেছে ও। পুজো।

অশোকের খুব ইচ্ছে করল যে, বলে একবার বলে।

এসব লোক মুখ ফুটে না বললে দেবে না; কোনো দিন দেয়নি।

কিন্তু মিস্টার হোড় সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। পেছনে ফিরে তাকাচ্ছেনও না।

অশোক সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রইল, ভাবল, মুখ ফেরালেই বলবে। মিস্টার হোড় হঠাৎ মুখ ফেরালেন ও হাত নেড়ে বললেন; সেনসাহেবকে বলবেন, রসিদ চাই না।

অশোক নিজের কথা কিছুই বলতে পারল না, মিস্টার হোড়ের কথার উত্তরে মাথা নোয়াল।

তার পর, বেয়ারাদের বিস্ফারিত চোখের সামনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়ির দরজা খুলল। দরজা খুলে ভেতরে বসল। অফিসের গাড়ি। ও নিজেই চালায়। বড়ো গরম লাগতে লাগল অশোকের।

গাড়িটা তেতে আগুন হয়ে গেছে। স্যুটটা ঘামে জবজব করছে। সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় গায়ে পাউডার দিয়েছিল। বুঝতে পারছে, গেঞ্জির ভেতরে গলে গলে পিঠ-চুঁইয়ে ঘামের সঙ্গে পড়ছে। মোজা-জুতো-মোড়া পায়ের পাতা দুটি জ্বালা করছে।

গাড়িটা স্টার্ট করল। গিয়ার দিতে গিয়ে বাঁ-হাতটা বাঁ-পকেটে লাগল—অনেকগুলোটাকাতে পকেটটা ভারী হয়ে আছে।

গুরুসদয় রোডের ট্রাইব্যুনাল অফিস থেকে ধর্মতলা স্ট্রিটে কল্যাণ সেনের এয়ারকণ্ডিশাণ্ড চেম্বারে পৌঁছোতে সময় লাগবে অনেক বেশি। কিন্তু অশোককে পৌঁছোতেই হবে। কতক্ষণ পরের বোঝা বয়ে বেড়াবে এমন করে?

রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন না? কী যে বলেছিলেন মনে পড়ল না অশোকের, শুধু মনে পড়ল; বলেছিলেন টাকা জিনিসটা আদৌ ভালো নয়।

আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কাছাকাছি এসে পৌঁছোল। লাল আলোতে দাঁড়াল। ডান দিকে একটি রেডিয়ো-রেফ্রিজারেটরের দোকান। অশোক একবার তাকাল।

আজও অফিসে বেরুবার সময় জুলি বলেছিল, হায়ার-পারচেজে একটা রেফ্রিজারেটর কেনো না গো? একদিন বাজার করে কতদিন রাখা যায়। কোকাকোলা রেখে দেওয়া যায় কিনে। কেউ এলে দেওয়া যায়। আরও কত কী রাখা যায়। তুমি বেশ কিপটে আছ! যাই বলো বাবা।

অশোক মনে মনে হাসে। কিপটেই বটে। কিপটে নিশ্চয়ই! কিন্তু সে কেবল নিজের বেলায়—। অন্য কারো জন্যে কিছু করবার বেলায় সে কিপটে নয়; কোনোদিনও ছিল না। যাক, টাকা হাতে না থাকলে কি কেউ মন দেখাতে পারে? আজকালকার মন তো অন্য কিছু দিয়ে দেখানোও যায় না।

আসলে জুলির অনেক শখ আছে। অশোকেরও কি নেই? এটা করবে, সেটা করবে; পুজোর সময় দূরে কোথাও বেড়াতে যাবে। আরও কত কী, কত কী করবে—। কত কিছু ভাবে দুজনে মিলে। অনেক কিছু ভাবে।

একটা ফ্রিজের দাম কত! আড়াই তিন হাজার?

অশোকের পকেটে এখন নগদ আট হাজার টাকা। সুকল্যাণ সেন কখনো মিস্টার হোড়কে শুধোবেন না, উনি কত টাকা দিয়েছেন। মিস্টার হোড় কখনো সুকল্যাণ সেনের ঘরে ঢোকার সাহসই পাবেন না। ওসব লোকের একটা জন্মগত হীনম্মন্যতা থাকে। ওঁরা অনেক কিছুই করতে পারেন হয়তো; আবার অনেক কিছু করতে পারেনও না।

অশোক ভাবল, যদি দু-হাজার টাকা রেখে দিয়ে, বাকি টাকা সেনসাহেবকে দিয়ে বলে, মিস্টার হোড় মাত্র ছ-হাজারই দিলেন। আর দু-হাজার অর্ডার পাবার পরে দেবেন। তবে সেনসাহেব নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পারবেন না। তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কী, সেনসাহেব নিজেও কি সত্যিই ভেবেছিলেন, যে হোড় সত্যি সত্যিই এককথায় এতগুলোটাকা দেবেন? তা ছাড়া অশোককে অবিশ্বাস করার প্রশ্নও ওঠে না।

পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে আবারও দাঁড়াতে হল। ভীষণ গরম লাগছে। গাড়ির আয়নাটা ঘুরিয়ে দিয়ে অশোক নিজের মুখটা দেখল। এমন করে কাছ থেকে ও নিজেকে অনেক দিন দেখেনি। ঘামে চুলগুলো ভিজে গেছে, কপালে শুয়ে রয়েছে, নাকটা লালচে দেখাচ্ছে—দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে গলা বেয়ে। অশোক আয়নার দিকে চেয়ে বলল, এই যে, উনি মাত্র ছ-হাজার দিলেন। অশোক পুলকিত হয়ে দেখল, ওর মুখে কোনোরকম ভাবান্তর হল না। আর একবার মহড়া দিয়ে নিল। ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের নাট্যরূপ দিয়ে ওরা নাটক করত। অনেকে বলত, অশোক খুব ভালো অভিনেতা। ও নাকি খুব ন্যাচারাল অভিনয় করে। আজ অশোকের মনে হল, ওরা ঠিকই বলত।

দুটি ড্রেনপাইপ-পরা ছেলে বই-খাতা হাতে নিয়ে রাস্তা পেরুচ্ছিল। বোধ হয় সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ে।

একজন বলল, বল? তাই না?

অন্যজন বলল, আরে, সব, সব। আজকাল চুরি না করে উপায় আছে? ইটস আ ভিশাস সার্কল।

ট্র্যাফিক লাইটটা হলুদ হল। অশোকের মনে হল একটা হলুদ বৃত্ত ওর চোখের সামনে ঘুরছে। ভিশাস সার্কলের রং কি হলুদ হয়?

কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে?

নিজের ওপরই রাগ হল।

জোরে গাড়ি চালিয়ে দিল। অ্যাকসিলারেটরে যত জোরে পারে চাপ দিল। মনে মনে বলল—শালা! এত দ্বিধা কীসের? আমি কি ফালতু নাকি? সিনিয়ার পাবে, আর জুনিয়রকে কিছুই দেবে না? কেন না? না কেন?

তার পরই অশোক মনস্থির করে ফেলল।

ওর ভীষণ ঘাম হতে লাগল।

দেখতে দেখতে কখন ধর্মতলা স্ট্রিটে পৌঁছে গেল।

সোজাই লিফটে করে ওপরে গেল। ডান পকেটে দু-হাজার টাকা, থার্ড-ফ্লোরে পৌঁছেই ল্যাভাটরিতে গিয়ে আলাদা করে ফেলবে ও। বাঁ-পকেটে ছ-হাজার।

বড়ো বড়ো পা ফেলে বেশ সপ্রতিভভাবে সেনসাহেবের চেম্বারের স্যুয়িং-ডোর খুলে ঢুকল অশোক—। দরজাটা বলে উঠল, কিঁয়্যা কাঁও।

চমকে এবং একটু ভয় পেয়ে মুখ তুলে চাইল অশোক।

সেনসাহেব কোটটা খুলে ফেলেছেন কিন্তু একটি ফিকে হলদে-রঙা হাফ-হাতা সোয়েটার পরে বসে আছেন। ঘরে এয়ার-কণ্ডিশনার চলছে বলে।

অশোকের আবার সব গোলমাল হয়ে গেল। সেনসাহেবের সোয়েটারের সমস্ত হলুদ রং একটা হলুদ বৃত্ত হয়ে ঘুরতে লাগল ওর চোখের সামনে।

কী হল? বোসো?

বেয়ারা দুটি কোকাকোলা নিয়ে ঘরে ঢুকল সঙ্গে সঙ্গে।

এ কী? দুটি কেন? আপনি কি জানতেন আমি আসব?

তোমার হাবভাব দেখেই কোর্টে বুঝেছিলাম, মক্কেল তোমায় আজ কিছু টাকা দেবে। আরে এতটুকু না বুঝলাম তো কীসের ওকালতি করি?

দাও। এনেছ নাকি কিছু?

অশোক খুব তাড়াতাড়ি তোতলাবার মতো করে বলে উঠল—মানে, ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, দিলেন; মানে সব নয়; আট হাজার। আট হাজার টাকা।

সেনসাহেব বললেন, মোটে আট হাজার? অর্ডার পেলে আরও দু-হাজার দেবেন?

অশোক আবার বলল, হ্যাঁ।

সেনসাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, তোমাকে কিছু দিল?

অশোক লজ্জার সঙ্গে মাথা নাড়ল, মুখ নামিয়ে। নেতিবাচক।

হুঁ। সেনসাহেব স্বগতোক্তি করলেন।

অশোক দু-পকেটে একসঙ্গে হাত গলিয়ে টাকাগুলো বের করে টেবিলে রাখল। বলল, গুনে নিন।

ভারমুক্ত হল ও। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

সেনসাহেব টাকাগুলো একটি একটি করে গুনে নিলেন। অশোক ভাবল, উনি হয়তো বলবেন; নাও হে। এই পাঁচ-শো আমিই তোমাকে দিলাম। কিংবা নিদেনপক্ষে একখানি এক-শো টাকার নোট?

না। সেরকম কিছুই ঘটল না। সেনসাহেব টাকাগুলো নিয়ে আয়রনসেফে তুলে রাখলেন। প্রত্যেকটি নোট।

একচুমুকে কোকাকোলা শেষ করে অশোক বলল, আমি তাহলে আসি?

যাবে? আচ্ছা এসো।

কেন জানে না, অশোকের খুব ভালো লাগতে লাগল। খুবই হালকা লাগতে লাগল ওর! খুব খুশি-খুশি লাগতে লাগল। নীচের পানের দোকানে এসে দাঁড়াল। অশোক বলল, একপ্যাকেট ভালো ফিলটারটিপড সিগারেট দাও তো ভাই।

দোকানে একটি বড়ো আয়না টাঙানো ছিল। প্রায় ফুলসাইজ। ভালো করে চোখ তুলে চাইল। দেখল, ক্লান্তিমাখা ওর দিনান্তের মুখটি ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য, পাংশু হয়ে আছে। মুখটি হতাশায় হিম হয়ে আছে।

সিগারেটের প্যাকেটটি হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে অশোক বুঝতে পারল, ও অভিনেতা নয়; কোনোদিনই ছিলই না; যারা ওর অভিনয়ের প্রশংসা করে বেড়াত এতদিন, তারা অভিনয়ের কিছুই বোঝে না। আস্তে আস্তে হেঁটে, ভাবতে ভাবতে; ও পথটুকু পেরুল।

অশোকের মনে হল, যেন সততার সুন্দর ঘর পার হয়ে এসে সততা ও অসততার দুই ঘরের মধ্যবর্তী চৌকাঠে পা রেখে ও দাঁড়িয়ে আছে। অজানিতে এতদিন দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু কতদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তা ও জানে না। অশোকের মতোই জুলি এবং ওদের চারপাশে—ওরা যাদের চেনে জানে, সকলেই বোধ হয় অনুক্ষণ এই দু-ঘরের মধ্যবর্তী চৌকাঠে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো অসতর্ক মুহূর্তেই ওদের মধ্যে যে-কেউই অসততার ঘরে পা ফেলতে পারে। আজকের জীবন বড়োই মার্জিনাল; ভঙ্গুর।

একথা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে অশোকের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *