প্রান্তর
রক্ষিতরা সম্পন্ন, অর্থে এবং পরিবার সভ্য সংখ্যাতেও।
রান্নাঘরে উনান রেহাই পায় না,—শিশুদের কলরবে দেয়াল রেহাই পায় না। প্রতিধ্বনি করিয়া ক্লান্তি আসে। যেন একটি ছোটো কারখানা। এ বাড়ির গুঞ্জনের সঙ্গে ভোরবেলা যেকোনো লোকের এমনি হঠাৎ পরিচয় হইলে মনে হয়, রাত থাকিতেই যেন এখানকার দিন-মানের কোলাহলের তোড়জোড় চলিতেছে। কোনো ছেলের ভোরে ইস্কুল, তাহার খাওয়ার ব্যবস্থা, বা কোনো শিশু রাত্রিশেষ কাঁদিয়া উঠিলে আর উপায় নাই। তারপর আস্তে আস্তে ভোর হয়, তাড়া খাইয়া চাকর বাকর ওঠে, সঙ্গে বাড়ির অন্যান্য ঘুমকাতর ছেলেমেয়েরাও। বাড়ির গৃহিণীকেই অতি সকালে উঠিতে দেখিয়া বধূরাও অতিকষ্টে আয়নার কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, অবিন্যস্ত চুল অথবা কপালের সিঁদুর ঠিক করিয়া লয়।
মনোরমার পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে। সবকটি ছেলেমেয়েরই বিবাহ হইয়াছে। মেয়েরা বেশির ভাগই থাকে দূর বিদেশে, কেবল ছোটো মেয়েটির এই শহরে বাস। ছেলেদের মধ্যে চারটি উপযুক্ত, অর্থাৎ যথেষ্ট অর্থ বহন করিয়া আনে। তারপর ছোটো ছেলেটির সম্বন্ধে বলিতে এইরূপ কোনো অশুভ প্রভাতে বাড়ি ঘিরিয়াছিল পুলিশ, তারপর কী হইয়াছিল মনোরমা জানেন না, জ্ঞান হইলে দেখেন, বাড়ি ঘিরিয়া পুলিশ নাই, ছোট ছেলে অজয়ও নাই। ছেলেটা মাত্র এম. এ. পাস করিয়াছিল,—নিজের ইচ্ছায় একটি গরিবের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে। এখানেই মনোরমার দুঃখ। ছেলেকে লইয়া অনেক আশা তিনি করিয়াছিলেন, বিলাত যাওয়ার খরচ সুন্ধু কত ডানাকাটা পরীর বাপও ঘোরাঘুরি করিতেছিল তাঁহার কাছে। তার উপর জেলে যাওয়া! দৈনিকপত্রের বহু বিজ্ঞাপিত ব্যাপার শেষে তাঁহারই ঘাড়ে আসিয়া চাপিল!
তারপর একটি বছর কাটিয়া গিয়াছে। এখন সবই আগের মতো সহজ। কক্ষের অভ্যন্তরে শিশুদের দাপাদাপি, কোলাহল, বধূদের চাপা হাসি, চুড়ির শব্দ চাকর বাকরের চেঁচামেচি, মনোরমার ব্যস্ততা—স্বামীর মৃত্যুতিথির উৎসব দিনেও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিবার সময় নাই।
তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। কিছুক্ষণ নীচতলার পেছন দিকের বারান্দার গলায় আঁচল জড়াইয়া সতী একাকী ঘুরিতেছিল। একপাশে একটি ছোটো ঘরের দরজার কাছে দেয়াল ঘেঁসিয়া বৃদ্ধা লাবণ্যলতা বসিয়াছিলেন। বংশের মধ্যে সকলের ঊর্ধ্বতন দৃষ্টান্ত তিনি, মনোরমার শাশুড়ি। কিন্তু সাংসারিক রীতি অনুযায়ী আপন নন, সৎ; মনোরমার মৃত স্বামী তাঁহার নিজের ছেলে নয়, আগের পক্ষের। কিন্তু শোনা যায়, সেই ছেলে অনেক বড়ো হইয়াও নাকি জানিতে পারে নাই, লাবণ্যলতা তাহার মা। নয়। যা-হোক, সেই ছেলে অবশেষে মানুষ হইয়াছে, শহরে বাসা বাঁধিয়াছে, অজস্র টাকা উপার্জন করিয়াছে, আবার নিজের সন্তানদের মানুষ করিয়াছে, তারপর হঠাৎ একদিন মারা গিয়াছে। সেও খুব অল্প দিনের কথা নয়, তবু আজও সেই লাবণ্যলতা বাঁচিয়া আছেন। চোখে কম দেখিতে পান, নিজে রাঁধিয়া খান।
কপালে কুঁচকানো চামড়া আরও কুঁচকাইয়া লাবণ্যলতা বলিলেন, তুই কে?
উত্তর আসিল, আমি।
–আমি? আমি কে?
সতী কাছে গেল, ইচ্ছা করিয়া কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, অজয় নামে একটা ছেলে আছে না? আমি তারই বন্ধু, নাম হল সতী।
লাবণ্যলতা নিজের মুখ সরাইয়া নিলেন, ঠোঁট উল্টাইয়া বলিলেন,
-ওমা—তোদের সব কান্ড! সোয়ামীর নাম মুখে আনা যেন হেলা খেলা, দিনে দিনে আরও কত দেখতে হবে। আবার বলা হচ্ছে বন্ধু, বন্ধুই যদি, তবে বন্ধুর বিহনে একবারও চোখের জল ফেলিসনে কেন শুনি? অমন তাজা সোয়ামিটাকেও ঘরে আটকে রাখতে পারলিনে কেন শুনি? তোদের ভালোবাসায় ছাই!
হাসিতে হাসিতে সতী বলিল, আমাদের তো কিছুই নয়, কিন্তু সেকালে আপনাদের ভালোবাসার নমুনা দু-একটি বলবেন শুনি?
-না, না, বাপু, অত বকবক করতে আমি পারিনে। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিলেন, হুঁ আবার নাম রাখা হয়েছে সতী!
দীর্ঘ বারান্দার ওই পাশে ইলেকট্রিক আলো জ্বলিতেছে। উপরে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার শব্দ শোনা যায়। নীচে মনোরমা অথবা মেজছেলের ডাকাডাকি, ঝি চাকরদের কলরব। এদিকে কোনো সাড়া না পাইয়া লাবণ্যলতা মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, সতী নীরবে কাঁদিতেছে। —ওকি, কাঁদছিস? ওতে কাঁদবার কী হল? আমি ঠাট্টা করেছি বৈ তো নয়! হতভাগী, কাঁদিসনে তোর কান্না দেখে আমারও যে কান্না পায়। মুখটি কোলের মধ্যে টানিয়া লাবণ্যলতা তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন, একি, কুঁচবরণ রাজকন্যের অমন মেঘবরণ চুল কোথায় গেল? এযে খড়ের আঁটি। আর কদিন পরেই একদম নেড়া হয়ে যাবি যে। আমাদের সময় কেমন ছিল জানিস? চুলের ভারে গড়াগড়ি যেতাম মাটিতে।
এবার সতী মুখ তুলিয়া চাহিল, কিছুক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া শেষে হাসিয়া ফেলিল, লাবণ্যলতা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন, অনেকক্ষণ পরে ঝি দামিনী আসিল, ভাঙা বাসনের মতো বাজিয়া উঠিয়া বলিল, খাওয়া দাওয়া আপনার হবে না গো বৌঠান? সবাই তো খেয়ে উঠল।
যাওয়ার সময় লাবণ্যলতা সতীকে বলিয়া দিলেন, এবার এলে আমার ওষুধ নিয়ে যাস, স্বামীকে বশ করবি।
পরদিন দুপুরবেলা। বারোটা বাজিতে না বাজিতেই সমস্ত বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ। মনোরমার চার ছেলে গিয়েছে কর্মস্থলে, বাড়ির ছেলেমেয়েরা যার যার ইস্কুলে অথবা কলেজে; আর মনোরমার মেজছেলের এক শালী লীলা, এখানে থাকিয়া কলেজে পড়ে। সেও কলেজে গিয়াছে।
সতী আস্তে আস্তে লাবণ্যলতার পেছনে গিয়া দাঁড়াইল, ডাকিল,-ঠাকুমা? তিনি ফিরিয়া চাহিলেন, তাহাকে দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছে সতী। ভ্র জোড়া, চোখের পল্লব আর পক্ষে এখনও যেন জল লাগিয়া রহিয়াছে। ভিজা চুলগুলি খোলা, মাথায় ঘোমটা নাই। সিঁথি আর কপালে সিঁদুর।
—আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতাম , বউ!
সতী হাসিয়া উঠিল, হাসিতে হাসিতে লাবণ্যলতার গায়ে ঢলিয়া পড়িল; তিনি চেঁচাইয়া উঠিলেন, উঃ, মাগো। বউ, তোর মতো আর একটিও দেখিনি। তোর মতো দস্যি নাকি আমি! ব্যাথা পাইনে?
হঠাৎ তাঁহার মুখে দুই হাত চাপিয়া সতী বলিল, চুপ, বউ নয়, সতী।
লাবণ্যলতা দুই চোখ কপালে তুলিলেন-সে কী! তুই কী এ বাড়ির বউ নয়? তোর আমি দিদিশাশুড়ী নই?
—না, না আমি আপনার বোন, বুঝলেন?
লাবণ্যলতা হাসিয়া বলিলেন, বুড়ো বেঁচে থাকলে সে সর্বনাশটা আজ হত বটে। বোন না হয়ে তার কাছাকাছি তো হতিস।
আজ একাদশী। লাবণ্যলতা খাওয়ার আয়োজন করিতেছিলেন। কিন্তু আয়োজনটা ভাতের দেখিয়া সতী আশ্চর্য হইয়া বলিল,-ওকি, ভাত-তরকারি যে?
–এ ছাড়া আরও খাওয়ার আছে কিছু বলিস?
সতী বোকার মতো বলিয়া ফেলিল, আজ না একাদশী!
উপরে সে একাদশী উপবাস-ক্লিষ্টা মনোরমার জন্য খাওয়ার বিপুল আয়োজন। দেখিয়া আসিয়াছে।
লাবণ্যলতা ফিরিয়া চাহিলেন। তাহার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চাহিয়া হঠাৎ হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, না বাপু আর পারিনে, ওসব আর সয় না। আমি মনে মনে হিসেব করেছিলাম কাল, ওরা কেউ আমায় বলেনি—সে যাক, ভালোই হয়েছে ওসব কী আর এখন সয়? এবার সহজ হওয়ার চেষ্টায় সতী সামনের দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, দেখি কী রাঁধছেন?
সব আড়াল করিয়া লাবণ্যলতা বলিলেন, না না দেখে কাজ নেই। নিজের চরকায় তেল দাওগে বাপু।
—তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
—হ্যাঁ। সই, তুই আমার কাছ থেকে যা, তোকে দেখে আমার হিংসে হয়।
সতী তবু বলিল, আহা দেখিনা কোন রাজভোগ আপনি খাচ্ছেন?
—রাজভোগই বটে!
চমকিয়া সতী ফিরিয়া চাহিল, দেখিল তীব্র দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া মনোরমা বলিলেন, রাজভোগই বটে! কিন্তু তোমার না হয় খাওয়া দাওয়া সংসার ধর্মের ওপর বিতৃষ্ণা, সেজন্য তো আর কেউ না খেয়ে বসে থাকতে পারে না! রোজই এ কী ব্যাপার শুনি? আমরা এমন কী অপরাধ করেছি শুনি যে তোমার খেয়ালের বোঝা আমাদের বইতে হবে?
নিজের যা কিছু খাওয়ার আয়োজন, সেগুলি কোনরকমে ঢাকিতে ঢাকিতে লাবণ্যলতা বলিলেন, সেকী?
সতী বলিল, যাই। তারপর মনোরমার পেছনে পেছনে চলিল।
খাওয়া দাওয়ার পর বসিল মিটিং। চার বধূই বিনা উদ্দেশ্যে একত্রিত হইয়াছে। প্রধান বক্তা মনোরমা। শ্রোতার দল যার যার সন্তানরক্ষা কার্যে আর অধিক ব্যাপৃত থাকিয়া বক্তার প্রতি কান খাড়া করিল।
-বুঝলে সেজ বৌ? সেজ-বউর প্রতি মনোরমার টান একটু বেশি; তার বাপ মস্ত বড়োলোক। কনট্রাকটরি করিয়া পয়সা করিয়াছেন, মেয়ের খোঁজ বরাবর লইয়া থাকেন, ভারী অমায়িক লোক, তাহার তুলনায় তাহারা কী-ই বা। মনোরমা বলিলেন, বুঝলে সেজ-বউ, বলে কিনা কোন রাজভোগ খাওয়া হচ্ছে দেখি।
মেজ বউর উপর ঢলিয়া পড়িয়া, ঘোমটা ফেলিয়া সুলেখা ভয়ানক হাসিয়া উঠিল, বলিল, তাই নাকি?
মনোরমা ভ্রূ কুঁচকাইয়া বলিলেন, দ্যাখো কী সব বিশ্রী কথা। তাও কিনা আমার সামনে, যেন বুড়ি না খেয়ে থাকছে! আর উনি সেটা বরাবর লক্ষ করে আসছেন। ওঁর মতো হিতাকাক্ষী জগতের আর দুটি মেলে? কী দুর্বুদ্ধি পেটে দ্যাখো। আমি বলি কী—
সকলেই অবাক। সুলেখাই কেবল অনর্থক অতিরিক্ত হাসিতেছে।
—আমি বলি কী, রাজভোগ কাকে বলে সে তো আর জানা নেই, জানবার ভাগ্যিও কোনদিন হয়নি। এখানে এসে ধাঁধা লেগেছে।
সুলেখা তেমনি হাসিতে লাগিল : অর্থাৎ এ সম্বন্ধে আমি কোন মতামত প্রকাশ করিতে চাই না, আমার হাসি হইতে যা হয় বুজিয়া নাও। তাহার হাসি দেখিয়া চার বছরের শিশু মন্টুও ছোটো ছোট দাঁত বার করিয়া হাসে।
সন্ধ্যার পর সতী আবার গিয়া হাজির হইল।
লাবণ্যলতা তাহার খুপড়িতে তেলের প্রদীপটা জ্বালাইয়া এইমাত্র নিজের বিছানার উপর বসিয়াছেন। ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা থাকিলেও ব্যবহার করেন না, বলেন, বুড়ো চোখে অত আলো সয় না।
সতী বলিল, তখন খাওয়া হয়েছিল?
হঠাৎ একটা গলার স্বর শুনিয়া লাবণ্যলতা চমকাইয়া উঠিলেন, ভালো করিয়া দেখিয়া বলিলেন, তুই সতী?
ধপ করিয়া একপাশে বসিয়া সতী বলিল, হ্যাঁ, আমি! ঠাকুরমা, আপনি চোখে কম দেখতে পান বুঝি?-কত বয়েস হয়েছে আপনার?
—বয়েস? বয়েস, আমার..হ্যাঁ, কালো-গোরার যুদ্ধ কবে হয়েছিল জানিস? হিসাব করিয়া সতী আশ্চর্য হইল, সে তো আশি বছরের কাছাকাছি। আপনি তাহলে আজকের নন ঠাকুরমা?
লাবণ্যলতা হাসিলেন, কিছু পরে বলিলেন, আর একবার এমনি চোখ খারাপ হয়েছিল, সেবার ভীষণ খারাপ হয়েছিল, রাত্তিরে তো একেবারেই দেখতে পেতাম না, দিনে তবু কিছু পেতাম—কিন্তু সেই দুঃখের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি এক স্বপ্নের ছায়ায় ঘোর হইয়া আসিল। সতী তা লক্ষ করে নাই, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তখন খাওয়া হয়েছিল?
তেলের প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলে, বিকীর্ণ আলোতে ছায়ার ভাগই বেশি, দুজনের মুখেই আলোর চেয়ে ছায়ার প্রলেপ বেশি।–খেয়েছিলাম। কারোর ওপর রাগ করে না খেয়ে থাকব এমন বোকা আমি নই। যাই বলিস, ছোঁড়াটার ওপর রাগ করে কখনো না খেয়ে থাকিসনে, পেটের কষ্ট বড়ো কষ্ট! নিজের রসিকতায় নিজেই হাসিয়া উঠিয়া লাবণ্যলতা আসল কথা চাপিয়া গেলেন, আসলে তিনি খান নাই।
সতী মুচকি হাসিয়া বলিল, সেই দুষ্টু ছোঁড়াটার কথা আর বলবেন না ঠাকুরমা, সে তো এখন জেলে পচছে!
–ষাট ষাট, ষাট, কী যা মুখে আসে তাই বলিস, তোর কী এতটুকু মায়া-দয়া নেই বাছা?
সতী তবুও মুচকিয়া হাসিতে লাগিল। একটু পরে হঠাৎ তাঁহার কোলের কাছে শুইয়া পড়িয়া বলিল, একটা গল্প বলুন না, ঠাকুরমা!
—আহা, আবার এখানে কেন? এই ছেঁড়া, ময়লা বিছানায়–
-তা থাক, সতী অন্য কথা পাড়িল, আচ্ছা বুড়ো আপনাকে খুব জ্বালাতন করত, না?
লাবণ্যলত্য অন্যদিকে নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পরে শুধু বলিলেন, ছাই!
সতী তাঁহার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, একটু পরে শুনিতে পাইল লাবণ্যলতা বলিতেছেন: জ্বালাতন না ছাই! সময় কোথায়? রোজ রাত বারোটা একটার পর খেয়ে দেয়ে শুলেও রাত থাকতে উঠতে হবে, নইলে রক্ষে নেই। তারপর আবার আড়াইটে-তিনটে অবধি বাড়িশুদ্ধ সকলের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজেদের খাওয়া, চান করে খেতে-খেতে চারটে বাজত, আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই রান্না ঘরে ঢোকা। এক রাত্তির ছাড়া বুড়োর মুখ আর কখনো দেখিনি। এর মধ্যে আবার জ্বালাতন করা, মাঝে মাঝে কথা বলা গলায় দড়ি দিতে আর বাকি থাকবে। কোনোদিন অসুখ-বিসুখ হলে তোর ঠাকুরদা একটিবার কাছে এসে বসলে চারিদিক থেকে কতরকমের কথা এসে তীরের মতো বিধত-ওমা গো, এত করেও যশ নেই, নিজের চোখে না দেখলে বুঝি বিশ্বেস হয় না! অবিশ্যি অসুখ-বিসুখ হলে তোর ঠাকুরদা একবারের জন্যেও কাছে এসে বসেনি, জ্বর ছাড়তে না ছাড়তেই আবার ভোর থেকে মধ্যরাত সমানে হাঁড়ি ঠেলতে হয়েছে! অসুখ হওয়াটাই যেন অপরাধ! প্রায় চিরকাল এমনি কেটেছে, কাজ করেও একটু আনমনা হবার উপায় নেই, কারোর আশায় বাইরের দিকে তাকাবার সাহস নেই। কিন্তু দিদি, সারাজীবনে এমন কয়েকটা দিনের কথাও জানি—তাঁহার চোখের দৃষ্টি আবার আচ্ছন্ন হইয়া আসিল, গলার স্বর বদলাইয়া গেল—সেসব দিনের কথা ভেবে আর সব দুঃখকে ভুলেছি। সেসব দিনের কথা ভাবলে আমার নিজেরই একসময় আশ্চর্য মনে হয়। তাহলে শোনো বলি। চোখ যখন আমার খারাপ হল, তখন পঁয়ত্রিশ পার হয়ে আমি প্রায় বুড়ি হতে চলেছি। শরীর ভয়ানক ভেঙে পড়েছে, অত খাটনি আর সয়না। তবু মুখ ফুটে বলতে সাহস নেই। আর বললেই বা কী হত? তাহলেও কোন উপায় ছিল না। চোখ খারাপ হলে পর সেই ভাঙা শরীর আর খারাপ চোখ নিয়েই কিছুদিন সমস্ত কাজ করেছি, কিছুতেই কাউকে বোঝাতে পারিনি যে, আমার কখনো অসুখ হয়েছে। কোনো সময় হয়তো কথাচ্ছলে জানালে তাঁরা বলতেন, তোমার আবার অসুখ কী গো, বেশ তো আছ, খাওয়া-দাওয়া তো বেশ হচ্ছে!—তবু কিছু বলিনি, চোখে না দেখার ভান করছি, —এই অজুহাতে সকলের হাসির কারণ হয়েও চুপ করে থেকেছি।
লাবণ্যলতা বলিয়া চলিলেন, কিন্তু যে রাতে আলো হাতে রান্নাঘর থেকে বার হবার সময় দরজার চৌকাঠে ঠেকে উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়লাম, তখন ভারী কান্না পেল, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সই, যা পেয়ে তখনকার কান্না পেল, আমি ভুলেছি, সে-কথা ভাবলে আজও ভারী আশ্চর্য মনে হয়। কার হাতের স্পর্শ টের পেয়েই চমকে মুখ তুলে দেখি, তোর ঠাকুরদা! বড় আরামে তার হাতে ভর দিয়ে ঘরে এসে, অনেকক্ষণ কাঁদলাম। সেদিন মনে হল, এ সংসারে আমি আর একা নই, এমন একজন কেউ আছে যে আমাকে ভালোবাসে। শুনে তোর হাসি পাবে জানি, বিয়ের পর প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়েও যখন কারোর এই প্রথম ভালোবাসার কথা মনে হয়! কিন্তু বুড়ো বয়েসে এমন এক ভীমরতি হল। সমস্ত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আমি ভুলে গেলাম, বুড়ো বয়সে এমন এক রাজ্যের রানি আমি হলাম, যে রাজ্যে ঢোকবার অধিকার কারোর ছিল না। সে বলল, ওগো, তুমি আগে আমায় জানাওনি কেন? তোমার শরীর এমন খারাপ, এভাবে বিনে চিকিৎছেতে দিন কাটালে যে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে। আর কোন চিকিচ্ছের কথা তো জানিনে বউ, যাকে খুব বড়ো চিকিচ্ছে বলে তখন মনে ভেবেছিলাম, সেই কথা বলি। রাতে যখন কোনো কারণে বাইরে যাবার দরকার হয়েছে, তোর ঠাকুরদা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই হাতে ভর দিয়ে আমি কোথায় যে যেতে হবে সে-কথা ভুলেছি। শুনে হাসবি, শুধু বাইরে যাবার জন্যে সেই বুড়ো বয়সে মিথ্যে কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। রাত্তিরে জল তেষ্টা পেলে তার হাতে জল খেয়ে এমন স্বাদ পেয়েছি, রোজই জল তেষ্টা পেয়েছে। খাওয়ার সময় কাছে বসে থেকে খাওয়ানোর কী যে আনন্দ হয়েছে, তা বলতে পারিনে।
সতী চুপ করিয়া শুনিতেছিল। লাবণ্যলতা বলিতে লাগিলেন, এমনি করে অনেকদিন কাটল, তিন-চার মাসের কম নয়। সেদিন জ্যোৎস্না রাত। গভীর রাতে কী কারণে যেন বাইরে বার হলাম, তোর ঠাকুরদা কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী সুন্দর জ্যোৎস্না, তুমি দেখতে পাচ্ছ বউ? আমি সবই দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছু আবছা, কিছু অস্পষ্ট। হঠাৎ তোর ঠাকুরদা, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললে, তুমি আমায় দেখতে পাও বউ? বোন, শুধু সেই রাতটিতেই সবচেয়ে বেশি করে আমি আমার মহিমা টের পেয়েছিলাম। তারপর চোখও ভালো হল, শরীরও সারল, কিন্তু যা আবার হারালাম, তা আর কিছুতেই সারবার নয়? তার ভয়ানক জ্বর হল, মাত্র তিনদিনের জ্বরে তাকে আমার ঘোমটার আড়াল থেকে বিদায় দিলুম। তারপর কত বছর আজ হয়েছে, শকুনের আয়ু নিয়ে আজও বেঁচে আছি, কিন্তু সারা জীবনে—শুধু তোর কাছেই বলি বউ, সারাজীবনে সেই ক-টা দিনের কথা কখনো ভুলতে পারিনে।
গল্প শেষ করিয়া লাবণ্যলতা সতীর গায়ে হাত রাখিয়া ডাকিলেন, ওরে বউ ঘুমিয়ে পড়লি?
সতী নিরুত্তর, ঘুমাইয়াছে কিনা বোঝা গেল না।
সেদিন অবনী রক্ষিতের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে কিছু লোক খাওয়ানো হয়। সবাই অতি সম্রান্ত আত্মীয়স্বজন। এইদিনে মনোরমাকে কচিৎ ঘরের বার হইতে দেখা যায়। রুদ্ধ ঘরে মৃত স্বামীর কথা স্মরণ করিয়া অচিরে নিজের মৃত্যু কামনাই করেন তিনি। পুত্র সৌভাগ্যের গর্বটা সজোরে চাপা দিয়া কোনো অদৃশ্য দেবতার পায়ে মাথা ঠুকিতে থাকেন। বন্ধুদের ভিতর শুশ্রুষার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। সমস্ত কাজ ফেলিয়া সেদিন তাহারা তাঁহাকে ঘিরিয়া থাকে। কিন্তু চারদিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া মনোরমার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি আরও অর্থহীন হইয়া আসে। সেজোবউ নাই যে! ক্ষীণস্বরে বলেন, সুলেখা কোথায়?
সুলেখাকে তৎক্ষণাৎ খবর দেওয়া হয়। সে আসিলে মনোরমা আবার কাতরস্বরে বলেন, তোমাদের বাসার সবাই এসেছে তো? তোমার মা-বাবাকে অনেকদিন দেখিনি। ওঁদের ঠিকমতো আদর-যত্ন করা হচ্ছে তো।
লোকটা মস্ত বড়লোক। কন্ট্রাকটারি করিয়া বিস্তর পয়সা করিয়াছেন, অতি সজ্জন সুলেখা তাঁহারই মেয়ে তো! এতক্ষণ পরে সেই সুলেখাকে হাতের কাছে পাইয়া মনোরমার দুই চোখে বিপুল বন্যা ছুটিল।
সন্ধ্যার পরে স্বল্প অন্ধকারে এক নীরব ছায়ামূর্তির মতো সতী বারান্দার রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আকাশে অজস্র তারা। মাঝে মাঝে মিষ্টি বাতাসের ঝলক আসিয়া চোখেমুখে ছড়াইয়া পড়ে, দুই পাশের ভাঙা চুলগুলি গালের পাশে কাঁপিতে থাকে। রাস্তার ওই পাশের বাড়িটিতে ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি, মস্ত লম্বা—যেন আকাশ ছুঁইতে আর বাকি নাই। সেই গাছের চারিদিকে গাঢ়তর অন্ধকারের আবরণ। বাড়ির প্রতি জানালায় উজ্জ্বল আলো, কোথাও দীপ্তকক্ষের আভাস। এই দালানের অভ্যন্তরেও লোকজন আর ছোটো ছেলেমেয়েদের চেঁচামিচি। চারদিকে বিশৃঙ্খল দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া কোন সময় সতীর দুই চোখ জলে ভরিয়া আসিল। পাশের আনন্দ-কোলাহল হইতে বিচ্ছিন্ন সতীর এই ঘরের নিঃশব্দতাটুকু স্পষ্ট ধরা পড়ে। ঘরের আলো নিবাইয়া বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়া সতী দাঁড়াইয়া আছে। চারপাশ শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। নিস্তব্ধ এই অন্ধকারের পটভূমিকায় কাহারও মূর্তি আজ চোখে পড়ে না। এই অন্ধকারের প্রসন্নতায় কেউ আসিয়া মুখোমুখি দাঁড়ায় না। সতী আঁচল মুখে চাপিয়া ধরিল।
কতক্ষণ সেইভাবে সে দাঁড়াইয়াছিল, ঠিক খেয়াল নাই, চমক ভাঙিল নীলার ডাকে–এখানে দাঁড়িয়ে কেন ভাই বউদি?
গলারস্বর যথাসম্ভব অবিকৃত রাখিয়া সতী বলিল, এমনি।
এমনি? নীলা কাছে আসিয়া তাহার গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু এত ঘনিষ্ঠতায় ধরা পড়িবার ভয়ে সতী চকিতে পাশ কাটাইয়া সরিয়া আসিল। একটা কাজ সেরে আসি ভাই, এখুনি আসছি,—এই বলিয়া দীর্ঘ বারান্দা দ্রুত অতিক্রম করিতে লাগিল।
নীলা তো অবাক! সতীর স্বর-বিকৃতি তাহার কাছে ধরা পড়ে নাই এমন নয়।
সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় পেছন হইতে বড়-বউ বলিল, ছোটো বউ শোন
কিন্তু সতীর কোনদিকেই খেয়াল ছিল না, তরতর করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া সে তখন নীচে নামিয়া গিয়াছে।
ছেলে বুকে করিয়া বড়বউ নাক সিটকাইলেন।–আহা, দেমাক দ্যাখো মেয়ের!
লাবণ্যলতার ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীরে অগ্রসর হইয়া সতী ডাকিল, ঠাকুরমা?
কোনো উত্তর নাই। কেবল একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসিল।
সতী আবার ডাকিল, ঠাকুরমা?
তবুও উত্তর নাই।
ভয়ে-ভয়ে আরও কিছুটা অগ্রসর হইয়া বিছানার উপর হাত রাখিয়া সতী দেখিল, না, লাবণ্যলতা শুইয়াই আছেন। মুখের কাছে মুখ লইয়া আবার ডাকিল,—ঠাকুরমা কত ঘুমুচ্ছেন?
তবুও কোনো উত্তর নাই। সভয়ে লাবণ্যলতার চোখে-মুখে-বুকে দুটি শিথিল হাত বুলাইয়া সতীর সারাদেহ হিম হইয়া আসিল। চারপাশে জমাটবাঁধা সারি সারি অন্ধকারের ভয়গুলি যেন তাড়া করিয়া আসিল তাহাকে। চীৎকার করিয়া আবার ডাকিতে গেল—ঠাকুরমা, কিন্তু পারিল না, কে যেন খুব চাপিয়া ধরিয়াছে তাহার গলা। ভয় আর দুর্বোধ্য বিস্ময়ে তাহার দীর্ঘায়ত চোখ বেদনায় বুজিয়া আসিল। সতী বৃদ্ধ লাবণ্যলতার কুঞ্চিত হিমশীতল দেহের উপর পড়িল।
পরদিন অনেক চেঁচামিচি, নতুন বিষয়ে এক নতুন কোলাহল। কথায় কথায় উঠিল : বুড়ির জ্বর হইয়াছে, পরদিন নাকি ইহা কার মুখে শোনা গিয়াছিল। মনোরমা বলিলেন, আহা, এতখানি বয়সে বুড়ী কী সুখেই না মরল! এবং নিজের কপালে করাঘাত করিলেন, আর শুধু তাঁহার বেলায়ই কী মৃত্যুর দেবতা পথ ভুল করিয়াছেন।
সতী তাহার রুদ্ধ গৃহাভ্যন্তরে কতক্ষণ জাগিয়াছিল, আর কতক্ষণই বা শুইয়াছিল, সে নিজেও জানে না। তখন রাত বারোটার কম হইবে না। কাপড়টি সর্বাঙ্গে ভালো করিয়া জড়াইয়া (যেন শীতার্ত কোনো রাত্রি) সতী ঘরের বাহির হইয়া আসিল। চারদিকে থমথম করে, টুশব্দও শোনা যায় না। দীর্ঘ বারান্দা পার হইয়া সে সিঁড়ির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। উজ্জ্বল আলোকিত সিঁড়িপথ। সতী নামিতে লাগিল।
বউদি?
সতী ফিরিয়া তাকাইল : তাহার ঘরের কাছে বারান্দায় এই রাত্রে একাকী পায়চারি করিতেছে নীলা।
নীলা বলিল, কোথায় যাচ্ছ ভাই, বউদি?
–ঠাকুরমার জ্বর হয়েছে, সে কি জানো না? বোধহয় জ্বরে ছটফট করছে এখন, একটু দেখতে যাই।
নীলা তাড়াতাড়ি তাহার কাছে গিয়া দুই হাতে তাহাকে জড়াইয়া ধরিল, বলিল, চলো, আমার ঘরে শোবে চলো।
সতী তাহার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল।
নীলা দেখিল, তাহার দুই চোখে জল, ইলেকট্রিক আলোয় চিকচিক করিতেছে।