প্রাতে প্রৌঢ় সন্ধ্যায় যুবতী
।। দৃশ্য : এক ।।
প্যাঁচানো-প্যাঁচানো ছড়ি দুলিয়ে-দুলিয়ে এদিকে-ওদিকে আস্ফালন করতে-করতে হরিরাম দ্রুত পায়ে সরোবরের ধার ঘেঁষে প্রাত:ভ্রমণ করছেন। ফাইন মার্সিডইজড ধুতি প্রায় হাঁটুর ওপর তোলা। গায়ে সূক্ষ্ম পাঞ্জাবির ওপর তসরের জ্যাকেট। পায়ে সাদা মোজা আর কেডস। কলকাতায় কয়েকটি সরোবর এখনও আগলে রাখাহ ড় হয়েছে হরিণের জল পান বা বকের একঠ্যাং মৎস্য-সাধনার জন্যে নয়; বিউটির জন্যে। বিউটিফুল ক্যালকাটার জন্যে। বাত আর বদহজম আর হৃদরোগীদের জন্যে। সন্ধেবেলা যুগলমিলনের জন্যে। আর্ট স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থীদের আউটডোর স্কেচের জন্যে। রাতের দিকে কারুর-কারুর রোজগারের জন্যে, জীবিকার জন্যে আর স্বেচ্ছায় যারা জীবনে ফুলস্টপ মারতে চান, তাদের জন্যে।
হরিরাম দ্রুত পায়ে একশোবার প্রদক্ষিণ করবেন। তিনি করবেন। তাঁর ভুঁড়ি করবে। পেটের খোলে পোরা পাঁচপো ঘোলের সরবত করবে। নেচারের সঙ্গে প্রতিদিন সকালে এই এক ঘণ্টাই যা তাঁর মাখামাখি। এই ঘণ্টাখানেকেই যা পদযুগলের ব্যবহার। এরপর হরিরামের সারাদিন শরীর ‘ইউক্লিড’। কখন তিনি গোল, কখন ত্রিভুজ, কখন দ, কখন পেন্টাগন, হেকসাগন। বড়বাজারের সাদা চাদরের ঢালাও গদি, দুটি পুরুষ্টু তাকিয়া, একটি গোলাপি ফোন হরিরামের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থকে জ্যামিতিক কায়দায় রাত ন’টা অবধি ধরে রাখে। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি একটি দুরূহ একস্ট্রা। হরিরামের জীবন-ঐশ্বর্যের রহস্য সমাধানের বাইরে। মাঝে-মাঝে ফোন বেজে ওঠে। ঢোলা-পাঞ্জাবি-পরা হাত বাড়িয়ে একটি হাতের কনুই তাকিয়ায় ঠেসিয়ে, রিসিভারটি আয়েস করে কানে লাগান। কানের পাতার কয়েক গাছা চুল শিল্পীর তুলির মতো রিসিভারে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। হরিরাম কথা বলতে-বলতে কাপড় কখন হাঁটুর কাছে তোলেন, কখন আরও ওপরে। সাইকেল পিওনের মতো টেলিফোন বেল বাজিয়ে হরিরামের লকারে, হিরে আনে, মুক্তো আনে, বান্ডিল-বান্ডিল নোট আনে।
ছড়ির প্রয়োজন নেই, তবু রিদমের জন্যে হরিরামের হাতে ছড়ি। হরিরাম প্রায় ছুটছেন, পেছনে ছুটছে ছেঁড়া প্যান্টপরা খালি গা একটি শিশু। পাঁচটা পয়সার আশায়, সকালে কিছু খাবে। সকালে হরিরামের চোঁয়া ঢেঁকুর ওঠে, শিশুটির ওঠে খিদের হিককা। কলকাতার জল, কলকাতার ফল, কলকাতার গ্যাঁড়াকল এখনও তাকে বদহজমের যোগী করতে পারেনি। হরিরাম ছুটতে-ছুটতে আরও মোটা হতে থাকেন। ছেলেটি পাঁচটা পয়সার আশায় ছুটতে-ছুটতে আরও রোগা হতে থাকে। হরিরাম মাঝে-মাঝে পেছন ফিরে ছেলেটিকে বলেন, প্রভুকে নাম গাও, হরিকো গুণ গাও, আরও প্রভুকো নাম গাও।
।। দৃশ্য : দুই ।।
শেষ পাক মেরে হরিরাম জলের ধার ঘেঁষে একটি বেনচিতে বসলেন। একটু রেস্ট। জলের ধারে-ধারে ছোট ছোট আগাছা। ল্যাজওয়ালা ব্যাঙাচি। লম্বা ঠ্যাং মাকড়সা সকলেরই ঘুম ভেঙেছে, আহার্যের জন্যে ছোটাছুটি। দু-পায়ের ফাঁকে হরিরামের ছড়ি আর একটা ঠ্যাঙের মতো বেরিয়ে আসে সমানে। পাশে এসে বসেছেন গণেশরাম। হাতে সকালের ইংরেজি কাগজ। দুজনের মুখই প্রভাতের আকাশের মতোই উদ্ভাসিত। দেখা হরিরামজি কেয়া কিয়া। কেয়া কিয়া ভাই। ভাসওয়া দিয়া। শিউজি, শিউশঙ্কর ভগবান, তেরা নাম, তেরা নাম! গঁড়েশজির চোখে ভক্তির অশ্রু। দূর থেকে দেখলে মনে হবে দুই ভক্ত সরোবরে প্রভাত-রবির অরুণ বরণ দেখে বিশ্বলীলার মাধুর্যে ভাবে গদগদ। আসলে তা নয়, ওরে ব্যাটা বঙ্গবাসী, মৎস্যদেবী, তৈলপায়ী আমি গঁড়েশরাম কাশীর বিশ্বনাথজিউর মাথায় পরশু দিন চার্টার্ড প্লেনে গিয়ে চালিশ মণ খাঁটি ভঁইয়া দুধ ঢেলে এসেছি। হুমন করেছি। রেপসিড তেল-বোঝাই জাহাজ দেখো, ইয়ার, ক্যালকাটা পোর্ট ছেড়ে ভাগলবা। কোনও বন্দরেই ভিড়ছে না সে তরি। এখন মাঝ-দরিয়ায় তেল ডেলিভারি দাও। খুব তো ভেবেছিল, পরিষ্কার বাঙলায় গঁড়েশজি গেয়ে উঠলেন, তেলের ওই ঝরনাধারায় ডুবিয়ে দাও…ডুবিয়ে দাও। হরিরামজি উঠে দাঁড়িয়ে ছড়িটাকে কাঁধে ফেলে কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে বারকতক বললেন, চলবে না, চলবে না, দিতে হোবে, দিতে হোবে। দুজনেই তারপর হোহো করে খানিক হাসলেন। গাছের ডালে একটা পাখি ডেকে উঠল। শুনা কেয়া বোলা, পিউ কাঁহা, তেল কাঁহা, তেল কাঁহা।
।। দৃশ্য : তিন।।
যদুনন্দনবাবু পিকআপ নিচ্ছেন। লো প্রেসার। অ্যানিমিক। সকালে বিছানা ছাড়তে পারেন না। তাঁর স্ত্রী স্টার্ট দিয়ে দিচ্ছেন। গাড়ি একবার স্টার্ট নিলেই সারা দিন ঠিক চলবে। দুজনেরই সাইলেনসার বুজে গেছে। চললেই মাঝে-মাঝে ভটাস-ভটাস করে শব্দ হয়। ওঠো যদুনন্দন, ছাড়ো ক্যাঁতাবন্ধন। স্ত্রীর হাতে এক কাপ গরম ডিজেল মোবিল মেশানো। যদুনন্দনের বনেট খুলে ঢেলে দিতে হবে। সতেরো টাকার জনতা চা। যেমন লিকার, তেমনি ফ্লেভার। শুধু ডিজেলে হবে না, মাঝে-মাঝে স্পার্ক দিতে হবে ইঞ্জিনে। ওঠো যদুনন্দন, আলু আজ দু-টাকা, খোলো চোখ নন্দন, ছেলের স্কুলের তিন মাসের মাইনে, নাম কেটে দেবে। কাল মুদি মেরেছে তাগাদা, ইলেকট্রিকের বিল, চাল নেই, তেল বাড়ন্ত, ওহে যদুনন্দন। দুটো রুটের বাস বন্ধ, এ মাসে আপিসে সাতদিন লেট, যদুনন্দন, ছাড়ো বন্ধন। বাসে যদুবাবু স্টার্ট নিয়ে নিয়েছেন। স্টার্ট নিলেই তাঁর সাইলেনসার থেকে একটা শব্দ বেরোয়—তেরি নোলে খেলি, স্যাংচু মারি খ্যাং খেলি, এ মাসে তোরা ক’কেজি তেল খেলি, ক’টন চাল খেলি, ক’একর আলু খেলি, এটা কি চা না স্নানযাত্রার পাঁচন। বলাই আছে ঠিক এই মুহূর্তের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করে দুটো জিনিস ছাড়া হবে কয়লার উনুনের ভলকে-ভলকে ধোঁয়া আর রেডিয়ো—প্রভাতে যারে বন্দে পাখি কিম্বা তুমি গাও, তুমি গাও কিম্বা ভোলে বাবা পার লাগাও, ত্রিশূলধারী শক্তি যোগাও। বোম বোম তারক বোম।
।। দৃশ্য : চার ।।
ধোঁয়া দিয়ে যদুনন্দনকে হাতে বাজারের থলি আর রোজকার বরাদ্দ চার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে মধু-নন্দিনী রাস্তায় বের করে দিলেন। যদুর শ্বশুরের নাম মধু। এক পোয়া পথ হাঁটলেই বাজার। যদুর মাথায় জটিল অঙ্ক। আলু পাঁচশো না সাতশো না এক কিলো। মাছ, পঞ্চাশ না একশো না দেড়শো। তারপর। কাগজটা একবার দ্যাখ তো সতীকান্ত, আমাদের ডি এ-টার কি হল! নো হোপ! সরকার চাকরেদের কথা এখন ভাবছেন না। শহর নয়, গ্রামের ওপর বেশি স্ট্রেস। বেকারদের চাকরি? সাকাররা ক্রমশই নিরাকার। কি বললে, তেলের জাহাজ কূলে ভিড়ছে না। মরেছে, ভেড়ি লুট। এক কাপ চা ছাড়, বাঞ্ছাদা। না থাক। চার টাকা থেকে কুড়ি পয়সা গেলে তিন আশি থাকে। কাঁচা লঙ্কা বাদ পড়ে যাবে। বাবা শুভঙ্কর বিয়োগটা এখনও মনে আছে ভাগ্যিস! যোগটা তো প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছ।
।। দৃশ্য : পাঁচ ।।
যদুবাবু বাজারে। কী হাঁকচিস তুই! হাঁকচিস নয়—হাঁকচেন। তুই নয়—স্যার। কী হাঁকচেন, স্যার। নিতে হয় নিন, না নিতে হয় তো ফোট। লিতে হয় লিন, না লিতে হয় না লিন। লেনেওলা মাল চিনি। দূর থেকেই জেললা দেখি। অলাবু অথবা কুষ্মান্ড। পিয়া, পাপিয়া থলিয়া থেকে ঝাড়ো দুটি তেলাপিয়া। মারো পোস্ত, ঢালো ছটাক খানেক রেপসিড। আসলের পাশে রাখো পরিপাটি ন্যাপকিন। বাঁ-হাতে নাকটি চেপে ধরে বনেটে ঠুসে দাও। স্টার্ট ভিটামিন এ. বি. সি. ডি. জেড.। তারপর এক ড্রপ ওডিকোলন খেয়ে তৃপ্তির উদগার। বাকিটা কেয়ার অফ পেট।
।। দৃশ্য : ছয় ।।
সেই সরোবর। সেই জলের কিনারায় বেনচি। সময় : উত্তীর্ণ সন্ধ্যা। জল থেকে উঠে আসছে শহর কলকাতার আলোর ঝাঁক। পাশাপাশি, কাছাকাছি দুটি মাথা। হরিরাম, গঁড়েশরামজী নয়। সকালের বেঙাচিরা এতক্ষণে ব্যাং হয়ে স্থলচর হয়ে গেছে। কথোপকথন। আর কতকাল থাকব বসে পরান খুলে লরেল আমার? ততদিন যতদিন না হরিরাম তিনশো টাকার চাকরি দিচ্ছে হাওড়ার ফ্যাকটরিতে। তিনশো টাকা মাত্র! ও বাবা তাই তো অনেক। আমার শাড়িরই দাম দেড়শো! আমার ট্রাউজারও দেড়শো! তাহলে হিসেব তো মিলেই গেল। হরিরাম প্রাণারাম অন্তত উলঙ্গ করে রাখবে না। ফুচকাওয়ালা দেড় হাজার কামায়, তুমিও ব্যাবসা করো না! করছি তো, সেলিং। লাস্ট ড্রয়িং বোর্ড আর টি সেট বেচে সেদিন ট্যাক্সি চড়ে দুজনে গঙ্গার ধারে জাহাজ দেখেছি।
।। দৃশ্য : সাত ।।
গভীর রাতে সরোবরে জল নিতে এসেছেন যুধিষ্ঠির। অন্ধকার থেকে আদেশ ভেসে এল—দাঁড়াও! কে? আমি বকরূপী ধর্ম। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তবে জলে হাত দিতে পারবে। তোমার ফচকেমি রাখো তো, ও আমার শোনাও আছে, জানাও আছে। গাছের আড়ালে ছেনতাইয়ের তালে আছ। না, আমি ধর্ম। সরোবরের মায়া ছাড়তে পারিনি। তাহলে আসল যুধিষ্ঠিরের অপেক্ষায় থাকো। আমি ফুটপাথের যুধিষ্ঠির, সাত ছেলের বাপ। এইমাত্র আমার বউ অষ্টম সন্তানের জন্ম দিয়েছে। কলকাতার আর একটি নাগরিক। জল চাই। তবু শুনি, প্রশ্নটা কী? কলকাতার মানুষ বেঁচে আছে কী করে? প্রশ্ন শুনে যুধিষ্ঠির হেহে করে হাসল খানিক। শুনবে উত্তর—
তোমার পাছায় লাথি মেরে।।