1 of 2

প্রাণের সাড়া

প্রাণের সাড়া

নীচের বারান্দায় কারা কথা বলছে, এত সকালে কে এল। ঝড়েশ্বর উঠে বসলেন। দেয়াল ঘড়িতে চোখ গেল—ছটা বেজে গেছে। সারারাত গরমে ভাজা ভাজা হয়েছেন, তোররাতের দিকে ঘুমটা লেগে এসেছিল। বয়স হয়ে যাওয়ায় ঘুম এমনিতেই তার কম। রাতে দু-তিনবার টয়লেটে না গেলেও চলে না। লোডশেডিং, সেই রাত আটটায়, তারপর আর কারেন্টের পাত্তা নেই। জ্যৈষ্ঠের গরম, চাতক পাখির মতো আকাশ-বাতাস একটুকু বৃষ্টির জন্য কবে থেকে ছটফট করছে।

কারা কথা বলছে নীচে? কাজের মেয়েটা, এবং মনে হল নিরু সঙ্গে। দুজনেরই বেশ ব্যস্ত গলা পাওয়া গেল।

ভিতরে এসে বসো। এত রোগা! পারবে! বাচ্চা। তোমাকে তো আরও বড় মেয়ের কথা বলেছিলাম।

পারবে মাসিমা। গাঁয়ে থাকে, গরিবের ঘরে বড়ো হয়, খেতে-পরতে পায় না। জল-বাতাস লাগলে দেখবেন দুদিনে ফন ফন করছে।

ঝড়েশ্বর ভাবলেন—তাহলে সেই লোকটা এসে গেছে। সল্টলেকে রিকশ চালায়, পূর্ত ভবনে পেনশনের লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে গিয়ে নিরু লোকটাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। কাজ সেরে অফিস থেকে বের হতে তার দেরিই হয়ে গেছিল, ফিরে দেখে গাছের ছায়ায় লোকটা রিকশয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ইস, খুবই দেরি হয়ে গেছে, নিরুর যত বয়স হচ্ছে, তত ন্যায়-নীতিবোধের কামড় বাড়ছে। ফলে খুবই সহৃদয়, নিরু না বলে পারেনি, দেরি হয়ে গেল! কিছু খাবে? বলে ব্যাগ থেকে ভাড়া বাদেও অতিরিক্ত দশটা টাকা দিয়ে বলেছিল, খেয়ে এস। পেট তো পড়ে গেছে। সকালে কী খেয়ে বের হয়েছিলে?

নিরুর এমনই স্বভাব, রিকশয় উঠতে কথা, বসতে কথা, চলতে কথা। নাম, কোথায় থাকে, ছেলেপুলে কি? সারাদিনে কত রোজগার, ঝড় বাদলায় বন্ধে কী করে চলে! নিরুকে নিশ্চয়ই রিকশওয়ালা তোয়াজ করে কথা বলেছে, তোয়াজ করলেই নিরু কেমন বড়ো বেশি বিবেচক হয়। কে বলবে, বৈকুণ্ঠের রিকশয় সে সেদিনই উঠেছে। যেন কতকালের চেনা।

তাহলে সেই বৈকুণ্ঠ হাজির। সুন্দরবনের বাঁদা অঞ্চলে কোথায় কোন সুদূরে থাকে। ট্রেনে, বাসে, ভটভটিতে যেতে হয়—হেঁটেও যেতে হয় ক্রোশতিনেক সকালে বের হলে গাঁয়ে পৌঁছতে তার সাঁজ লেগে যায়। নদীনালা, খাঁড়ি আর সুন্দরী গাছের জঙ্গল। নদী পার হয়ে বাঘও চলে আসে—সুযোগ পেলে। বেনা ঘাসের মাঠের মধ্যে ফরেস্টার বাবুদের কোয়ার্টার। তার বউ সেখানে জল বাটনা দেয়। নিরু এসে কত খবর দিয়েছিল। তার বড়ো মেয়েটাকে রাখার একটা জায়গা খুঁজছে। খেতে-পরতে দিলেই হবে। আর যদি কিছু টাকা ধরে দেন মাসিমা—এই পর্যন্তই কথা।

ঝড়েশ্বর আর বসে থাকতে পারলেন না। তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে বলে নিরু নীচের বারান্দায় খুবই আস্তে কথা বলছে। বৈকুণ্ঠ গাঁয়ের লোক, আস্তে কথা বলার অভ্যাস নেই। সে জোরেই কথা বলছে। মাঝে মাঝে নিরু বলছে, আস্তে কথা বল। বাবুর ঘুম ভেঙে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বৈকুণ্ঠের গলার স্বর নিস্তেজ। এমনই যখন চলছিল, তিনি শিয়রের কাছ থেকে চশমাটা চোখে পরে চাবির গোছা হাতে নিয়ে স্লিপার পায়ে গলিয়েও কী ভেবে আর গলালেন না। সিঁড়িতে নামার সময় চটির ফট ফট শব্দে নিরু বুঝতে পরবে, তিনি নামছেন। নিরুর অনেক কিছুই তখন পছন্দ না, সেজন্য নিরু সতর্ক হয়ে যেতে পারে।

এ-বাড়িটায়, এখন বলতে গেলে তাঁরা দুজন। পুত্ররা সবাই কাছাকাছি জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছে। সতের-আঠারো বছরে, বলতে গেলে বাড়িটা খালিই হয়ে গেল। বাড়িটাতে ঘরেরও অভাব ছিল না। দু-তলা, তিনতলা মিলিয়ে মেলা ঘর। এক একটা অংশে, বাথরুম এবং দুটো শোবার ঘর, পুত্রদের বিবাহিত জীবনে কোনো অসুবিধা না হয় ভেবেই করা। রান্নার লোক, ঠিকে ঝি এবং সব সময়ের টুকিটাকি কাজের জন্যও একজন চব্বিশ ঘণ্টা থাকার মতো কাজের মহিলার বন্দোবস্ত আছে।

তবু কাউকে ধরে রাখা গেল না। কী যে অসুবিধা, তবে অসুবিধা থেকেই যায়, নানা কারণে ঠোকাঠুকিও হয়, মানিয়ে নেওয়ার মতো জীবনই তৈরি হয়নি হয়তো।

তিনি নীচে নেমে আসার সময়ই বাড়িটার ভবিতব্য ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলেন।

নীচে নেমে দেখলেন কাকলাশ মতো একটি লোক বসার ঘরে মেঝেতে বসে আছে। আর একজন বালিকা, আট-দশ বছরের, ছেঁড়া ফ্রক গায়ে দিয়ে, নিরুর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। তাঁকে দেখেই নিরু বলল, বলেছিলাম না বৈকুণ্ঠ ঠিক লোক নিয়ে আসবে। বৈকুণ্ঠের বড়ো মেয়ে, ফুলি, এই প্রণাম কর। দাদু বলে ডাকবি।

তাহলে সব ঠিকই হয়ে গেছে। কিন্তু এতটুকুন মেয়ে, শীর্ণকায়, চোখ কোটরাগত, অনাহার এবং অনিদ্রার ছাপ চোখেমুখে, কতটা পারবে বুঝতে পারলেন না ঝড়েশ্বর। কিন্তু কিছু বলারও উপায় নেই। নিরুর ফুটফরমাশ খাটায় লোকের যে দরকার তিনিও বোঝেন। কোমরে-হাঁটুতে বাতের ব্যথা লেগেই আছে–বয়স হলে শরীরও ভালো যায় না, রান্নার মেয়েটা, রান্না করে চলে যায়, ঠিকা ঝি কাজ করে চলে যায়, চব্বিশ ঘণ্টার কোনো লোকই আর থাকে না, বিপদে আপদে বাড়িতে কেউ না থাকলে এ-বয়সে দিশেহারা হতেই হয়। নিরুকেও দোষ দেওয়া যায় না। শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে ফোন ধরতে পারবে, বাজার থেকে দৌড়ে দরকারি টুকিটাকি জিনিসও নিয়ে আসতে পারবে, বড়োই জরুরি সংসারের পক্ষে। তবে বড়ো করে না তুললে, কোনো কাজেই লাগবে না।

কত মাইনে চায়? ঝড়েশ্বর না বলে পারলেন না। নিরু বলল, কী দিতে হবে বৈকুণ্ঠ?

বড়ো বিগলিত বৈকুণ্ঠ।—দেবেন আপনাদের যা মনে লয়।

না, যা মনে লয় না। সাফ সাফ বলে নেওয়া ভালো। পরে ঝামেলা পাকালে মুশকিল। এই নিভা বৈকুণ্ঠকে চা করে দাও।

ঝড়েশ্বর সোফায় বসে পড়েছেন, ফুলি দরজায় চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বড়ো বড়ো চোখে কেমন ঘরবাড়ি দেখছে।

নিভা বলল, আমার দেরি হয়ে যাবে মাসিমা।

বাড়িটা সাফসোফ রাখা, থালাবাসন মাজা, কাচাকাচির কাজ তার। চার-পাঁচটা বাড়িতে একলপ্তে কাজ করে বলে, সময়মতো না ঢুকতে পারলে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। নিভাননী যে কাউকে ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নয়, ঝড়েশ্বর ভালই জানেন। সারাদিনই প্রায় তার কাজ-এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঢুকে বসে থাকলে তার চলে না। মাসিমার যে দরদ উথলে পড়ছে টের পেয়েই নিভা সরে পড়তে চাইছে। তারপর বললেই হল, নিভা বৈকুণ্ঠকে রুটি করে দাও। আলুর সেঁচকি করে দাও।

রান্নার মেয়ে মায়ার আসতে দেরিই হয়। সে একবাড়ির কাজ সেরে, এ-বাড়িতে ঢোকে। লোক থাকলেই কাজ বাড়ে, কাজের মেয়েরা এটা ভালোই জানে, আর যদি মেয়েটা কাজ ধরে নেয় তবে তো কথাই নেই। কোনোদিন না মাসিমা বলে দেন, কাচাকাচির কাজ করতে হবে না। থালাবাসন মাজতে হবে না।

তারপর একদিন যদি বলে দেন, মোছামুছির কাজ তো ফুলিই পারে, তা হলেই হয়ে গেল—কেউ বাড়িতে কাজে ঢুকলে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না।

কেউ কাজে নতুন ঢুকলে যে নিভা কিংবা মায়া প্রমাদ গুনতে থাকে, ঝড়েশ্বর ভালোই জানেন। নতুন লোকটিকে না তাড়িয়ে তারাও শান্তি পায় না। কারণ এ বাড়িটায় দেখাশোনার লোকের অভাব বলে স্বাধীনতা একটু মাত্রাতিরিক্ত। বউমারাও নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, রান্নাঘরে কেউ উঁকি দিয়েও দেখে না। আট দশ বছর ধরে একই মাসোহারা-ঝড়েশ্বর-পুত্ররা কিছু দিলেই খুশি ছিলেন, এতকিছু সুবন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও বাড়িটা শেষ পর্যন্ত খালিই হয়ে গেল।

ঝড়েশ্বর মাথা চুলকে বললেন, পারবে তো? নিরু সোফায় বসে বলল, পারবে না কেন। কাজটা হাতি না ঘোড়া। এটা-ওটা এগিয়ে দেবে। পারবে না কেন?

না বলছিলাম, থাকতে পারবে তো? মন টিকবে তো? এই মেয়ে, পারবি থাকতে? বাবা-মার জন্য মন খারাপ করবে না?

ফুলির চোখ বড়ো হয়ে গেল, গোল গোল হয়ে গেল। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

ঝড়েশ্বর বললেন, দ্যাখ, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবি, তারপর বৈকুণ্ঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা দুজনে বাড়িটায় থাকি তোমার মেয়ে কষ্ট পাবে না। যদি নিজের মতো থাকে, থাকতে থাকতে বড়ো হয়ে যায়, বিয়ের খরচ পাবে। কাছে থাকলেই মায়া বাড়ে। বড়ো করলাম, আর হুটহাট একজনকে ধরে গছিয়ে দেবে সে হবে না।

আসলে বাড়িটা এত খালি, কেউ থাকলেই যেন ভরে যায়।

নিরু বলল, মাকে ছেড়ে থাকা কঠিন, আমি তো ভেবেছিলাম, বড়োই হবে। বারো-চোদ্দো বছর, আর আট-দশ বছরের যে অনেক ফারাক বৈকুণ্ঠ। তোমার পরিবারের কষ্ট হবে, তার তো বুক খালি হয়ে যাবে।

ঝড়েশ্বর বললেন, বুক খালি কার না হয়। তুমি কি ভালো আছ? রাতের নৈঃশব্দ্য তোমাকে পীড়ন করে না! বল, দিনের বেলাটাও ভালো যায় না। কেমন সব শুনশান মনে হয়।

তারপরই কেন যে মনে হল, তিনিও নিরুর মতো কেমন নিজেকে বড়ো অসহায় বোধ করছেন। বৈকুণ্ঠ টের পেলে চেপে ধরতে পারে—বাড়িটায় সে এবং তার পরিবার যদি একটু থাকার জায়গা পায়, বাড়িটা তত খালি পড়েই আছে, তারা থাকলে বিপদে-আপদে কাজে আসবে। বলতেই পারে, বাবু আমাদের থাকতে দিন না। বনজঙ্গলে বউ ছেলে-মেয়ে ফেলে রেখে এতদূরে থাকা যে খুব কষ্ট।

নিরু বলল, কী হল বৈকুণ্ঠ, কত দেব?

না মাসিমা, আপনি বলুন।

দুশো টাকা পাবে। একটা লোকের খেতেও কম খরচা না। কলকাতায় খাওয়া পাওয়া যায়, থাকার জায়গা পাওয়া যায় না।

তাই দেবেন মাসিমা। আমি মাসপয়লা টাকাটা নিয়ে যাব।

নিরু বলল, ফুলি তো কথাই বলছে না! কিরে, তোর ভালো লাগছে না। আমাদের?

ও ভাববেন না, ঠিক মানিয়ে নেবে। আমি তাহলে উঠি।

এই যা, ও নিভা, মায়া আসেনি! একটু চা করে দিতে বললাম, তোমরা যে কী কর না! বলেই নিরু ডাইনিং প্লেস পার হয়ে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল সব ফাঁকা।

নিরু ফিলে এসে বিরস গলায় বলল, তোমাকে যে চা খাওয়াব তারও উপায় নেই বৈকুণ্ঠ। মায়া যে কী করে! কত বেলা হল, এখনও আসার নাম নেই। তোরা মাগনা কাজ করিস! নিভা যাওয়ার সময় বলে যাব তো! নিভাও কিছু না বলে চলে গেল।

বৈকুণ্ঠ কাঁচুমাচু গলায় বলল, এত বড়ো বাড়ি, আর কেউ থাকে না। দাদা বউদিরা, তারপরই কী ভেবে বলল, সব কপাল মাসিমা, আমরা একটা ঘরে পাঁচজন শেয়ারে থাকি। বাগমারির বস্তিতে আলো নেই, পাখা নেই, আমাদের কোনো কষ্ট হয় না। মানুষ না থাকলে কীসের ঘরবাড়ি? বলেন!

ঝড়েশ্বর বললেন, থাকত। এখন নেই। এত বড়ো বাড়িতেও কুলাল না। এখন তো আমার শিরেসংক্রান্তি। বাড়িটা যে রং করাব, মেরামত করব, তারও ইচ্ছে হয় না। উদ্যম হারিয়ে ফেললে মানুষেরই এই হয় বৈকুণ্ঠ।

বৈকুণ্ঠ বলল, দুদিন কাজ কামাই করে নিয়ে এলাম। মাসিমা এত করে বলল, কাছে তো না! তারপর ট্রেনে, বাসে, ভটভটিতে কাল রাতে নিয়ে এসেছি। আমি উঠছি, এই পুলি, ভালো হয়ে থাকবি। দাদু-দিদার কথা শুনবি।

ফুলি শুধু তাকিয়ে আছে।

কখনো বাপের কথা শুনছে, কখনো বাবুর কথা শুনছে। কোনো কথা বলছে না।

ঝড়েশ্বর না বলে পারলেন না, কিরে ফুলি, তুই কি কথা বলতেও পারিস না?

সব পারে বাবু। দমে আছে। এতটা রাস্তা, বুঝতেই পারেন! আমি উঠি বাবু, না উঠলে আজও লস হবে। আমাদের খাটলে ভাত, না খাটলে—তারপর সে তার পেট দেখাল-উপোস।

ফুলির বগলের পুঁটলি বগলেই আছে।

ঝড়েশ্বর ভাবলেন, ফুলির উচিত পুঁটলি খুলে দেখানো।

ফ্রক আর এনেছে।

আছে আর একটা।

নিরু বলল, এই ফুলি চল তোকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি। সার্ফ দিচ্ছি, সব ধুয়ে নে। বাজারে বের হলে তোর জন্য নতুন ফ্রক, চিরুনি, আয়না এনে দেব। সাফসোফ থাকবি। এই নাক খুঁটছিস কেন? তোর কি ঘেন্নাপেত্তা নেই! আয়।

ফুলি দাঁড়িয়েই থাকল। ঝড়েশ্বরের মনে হল, বৈকুণ্ঠ রওনা হলে ফুলিও পিছু পিছু দৌড় মারবে। দৌড় মারারই কথা—এখনও কথা বলছে না কেন! হাবা-কালা নয়তো! বাবাও হতে পারে। সে যাই হোক, থাকলে ক্ষতির প্রশ্ন নেই। মেয়েটা ছোটাছুটি করলেও বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পাবে। কাজ করুক না-করুক, তাঁরা ছাড়াও বাড়িতে আর একজন আছে ভাবতেও ঝড়েশ্বরের ভালো লাগছে।

তাহলে বাবু যাই। বৈকুণ্ঠ একবার মেয়েকে দেখল, তারপর বাবুর পারে গড় হল। নিরুকেও প্রণাম করল।

ঝড়েশ্বর কেমন এই প্রণামের বহরে মুগ্ধ হয়ে বলল, মেয়ের জন্য ভাববে না। নিজের মতো থাকলে আখেরে ভালোই হবে। বড়ো হলে বিয়েও দিয়ে দেব। কাজের লোক তো আছেই। সব সময়ের লোক না থাকলে অসুবিধা, এটা-ওটা এগিয়ে দিলেও আমাদের অনেক কাছে থাকলে মায়া পড়ে যায় বোঝই তো!

আজ্ঞে যাচ্ছি।

মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যেও।

সে তো আসতেই হবে। মাসপয়লাতেই আসব। মাসের টাকাটায় সংসারে পঁচিশ-ত্রিশ কেজি চাল হয়। ওর ভাইবোনগুলো খেয়ে বাঁচবে। সোজা কথা!

তারপর সদর খুলে দিলে বৈকুণ্ঠ বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়িটা দেখল। রাস্তাঘাট দেখল। গলিখুঁজিতে মেয়েটা হারিয়ে না যায়, যদিও মাসিমা একখানা কার্ড দিয়েছে, ওতেই ঠিকানা লেখা ছিল, সেই ঠিকানা যে ভুলও নয়, নিজে এসে তাও দেখে গেল।

ফুলি জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় বাপকে দেখছে! বাপ হেঁটে যাচ্ছে। যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, জানালা থেকে নড়ল না। বাপ রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকল। সদরে কেউ এসেছে। সদর খুলে দেওয়ার জন্যও লোকের দরকার। কে খোলে! নীচে এতবার ওঠানামা আর করতে পারেন না ঝড়েশ্বর।

তিনি ডাকলেন, এই ফুলি, দরজা খুলে দে।

ফুলি তরতর করে ছুটে এল। দরজা খুলে দিল।

ঝড়েশ্বর বসার ঘরে। মায়া ঢুকছে। দরজা খোলা-বন্ধ করাও একটা বড়ো কাজ। সকাল থেকেই কেউ না কেউ আসছেই। শহরে বাড়ি হলে যা হয়, বড়ো সতর্ক থাকতে হয়। কোলাপসিবল গেট আছে সদর দরজায়। তবে সদর কমই খোলা হয়। বাড়িটার ভেতরের দিকেও দুটো দরজা আছে। কাজের লোক, মুড়িওয়ালা, দুধওয়ালা, ছাত্রছাত্রীরা সবাই ঢেকে দ্বিতীয় দরজাটা দিয়ে। কলপাড়ের দিকেও একটা দরজা আছে, সেখানে নিরুর কিছু শৌখিন গাছপালা বড়ো হয়।

একটা টিউকলও আছে, বাসন মাজার আলাদা জায়গাও আছে। বেসিনে এত বাসনকোসন ধোওয়া যেত না—তখন তো বাড়িটায় বারো-চোদ্দোজন লোক। পুত্ররা, পুত্রবধূরা, নাতি-নাতনিরা… বাড়িটা মানুষের কলরবে ভরে থাকত। এখন তিনি আর নিরু। ফলি আসায় তারা তিনজন। কলপাডে আর কেউ যায় না। কলপাড়ের দরজাটা বন্ধ থাকে। গাছে জলটল দিতে হয়। গাছের গুঁড়িও খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। মৌসুমি ফুলেরও চাষ আছে। অবসর নেওয়ার পর, নিরু এই গাছপালা নিয়েই বিকেলটায় ব্যস্ত থাকে। একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে থাকতে পারে না।

আসলে বাড়ির গলিটা দিয়ে ঢুকে দ্বিতীয় দরজা। সেটাই বেশি খুলতে হয়। বন্ধ করতে হয়। যতক্ষণ তিনি নীচে থাকেন, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কেচিংয়ে ভিড় করে থাকে, সবাই হয় অনার্সের ছাত্র-ফিজিক্সের অধ্যাপক ঝড়েশ্বরের খুবই সুনাম, ভালো ছাত্র পেলে তিনি পয়সাও নেন না, এসব কারণে সুখ্যাতি আছে তাঁর—সব সময়ের জন্য মাসমাইনের লোকও ছিল তাঁর। কিন্তু যা হয়, সুযোগ পেলেই কোপ বসিয়ে চলে যায়। আর বয়েস হয়ে যাওয়ায় এবং পুত্ররা সব আলাদা ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ায়, বয়স্ক লোক রাখতে কেন জানি আর সাহস পাচ্ছিলেন না। নীচে যতক্ষণ থাকেন, তিনিই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেন, বন্ধও করেন—এতে তাঁর কাজের অসুবিধা হয়, কিছু স্কুল বই আছে, প্রেসের লোকও আসে, বইয়ের প্রুফটুফ দেখারও কাজ থাকে। ছেলেমেয়েরা বাবা-মার খবর নিতেও আসে, ভালোমন্দ রান্না হলে কাজের লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, নিজেরাও আসে, ছুটিছাটায় তারা থেকেও যায়। বাড়িটা তখন জমজমাট। তিনি তখন বাজারে নিজে যান—নিরুর বাজার পছন্দ না তার। কে কী খেতে ভালোবাসে, সব বাছবিচার করে কেনেন—এটা তাঁর একটা হবি।

কিন্তু বাড়িটা খালি হয়ে যাওয়ার পর বাজার করার হবিটাও তাঁর চলে গেছে। দুজনের আর কী লাগে! একদিন বাজার করলে চার-পাঁচদিন চোখ বুজে চলে যায়। তবে রান্নার মেয়েটির হাতটান থাকায়, তাঁর হিসেব ঠিক থাকে না। বারবার মায়াকে সতর্কও করে দিয়েছেন, হলে কি হবে, সে নেবেই—কী করে সরায়, এই বিষয়টাই তাঁর মাথায় আসে না। কিচেন, ডাইনিং প্লেস সম্পূর্ণ আলাদা বলে নজর রাখাও কঠিন। নিরুকে বললেও বিপদ, সে পাহারা দেওয়ার নামে এমন সব জটিলতা সৃষ্টি করবে যে, তখন তাঁর মধ্যস্থতা ছাড়া উপায় থাকে না। মাছের পিস, মাংসের পিস, গুনেও রাখা হয়, চারদিন চলার কথা, তিনদিনও যায় না—সংসারে এত সব জটিলতায় পড়েই এই ফুলিকে তুলে আনা—অন্তত নিজের করে নিতে পারলে, সে-ই সব লক্ষ রাখতে পারবে।

যদিও তিনি জানেন রান্নার মেয়েটি খুবই ধুরন্ধর। দুদিনেই ফুলিকে হাত করে নেবে, সংসারে তার কেবল নাই নাই মাসের বাজার বিশ-বাইশ দিনে শেষ। তিন কেজি আলু দুদিনেই শেষ। চারদিনের বাজার তিনদিনও যায় না। কিছুকাল যে তালা-চাবির বন্দোবস্ত করেছেন তাও নয়। তারপর তালাও থাকে না, চাবিও থাকে না। নিরুর পূজাআর্চাতে সকালটা কেটে যায় পুজোয় বসলে তার সঙ্গে কেউ কথাও বলতে পারে না–

বাবু চা নেই, বাবু চিনি নেই, বাবু পোস্ত আনতে হবে।

মাসের বাজার শেষ। পাঁচশ পোস্ত, কে খায়! কদিন আলুপোস্ত হয়! ছোটো পুত্রটি বাড়ি এলে কিংবা থাকলে, পোস্ত হয়। তিনি কিংবা নিরু পোস্ত বিশেষ পছন্দ করেন না। দুজন লোকের রান্না তিন কেজি আলু তিনদিন যায় না, এক কেজি পেঁয়াজ তিনদিন যায় না। এক রান্নাঘর আর রান্নার মেয়েটাকে নিয়েই পাগল হওয়ার জোগাড়। তার ওপর অপচয় তো আছেই। ছাড়িয়েও দিতে পারেন না। পরের বস্তুটি আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি যে করবে না, এই আতঙ্কে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেও শেষে আর সাহসে কুলায় না।

শিবানী মেয়েটা মন্দ ছিল না। চালাকচতুর, যাক সে রান্নাঘরটায় নজর রাখতে পারবে। বছর দুই ছিল, কিছুদিন যেতে না যেতেই শিবানী তাঁদের চেয়ে রান্নার মেয়েটার বেশি বাধ্যের হয়ে গেল।

এই শিবানী, যা তো রসিকের দোকান থেকে দু দিস্তা কাগজ নিয়ে আয়।

শিবানীর সাড়া নেই।

কী হল! শুনতে পাচ্ছিস না শিবানী?

রান্নার মেয়ে মায়া তখন ডাকবে, এই শিবানী, তুই কোথায়! মেসো তোকে ডাকছে।

আর সঙ্গে সঙ্গে তিনতলা থেকে জবাব, যাই।

ঝড়েশ্বর কুপিত না হয়ে পারেন না।

তিনতলায় কী করছিস?

দিদুর ছাড়া কাপড় ধুয়ে মেলে দিচ্ছি তারে।

আসলে কিছুই করছে না। কাছেপিঠে থাকলেই কাজ, তাকে দেখলেই দিদুর কাজের ফরমাশ, যতদূরে গা বাঁচিয়ে থাকা যায়। ঝড়েশ্বর সবই বোঝেন, রান্নাঘরে থাকলে মায়াই তাকে এটা-ওটা খেতে দেবে।

নে যা।

বলে, চিংড়ি মাছ ভাজা দেবে খেতে, তেলের বড়া দেবে খেতে, এমনকী দুধরুটি মায়াও খাবে, সে-ও খাবে। সবই লুকিয়ে-চুরিয়ে, দুজনের সংসারে এত টানাটানি। তাঁর খাবার বেলায় দুধ থাকে না, চিনি থাকে না, এই তো কাল বিকেলে দু প্যাকেট দুধ আনা হল, সকালেই বলছে দুধ নেই। তোমার কি! তোমাদের চোখে লাগে না।

একদিন তিনি রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আক, তাঁরা কেউ খাননি, শিবানী আর মায়া দুজনেই আম মুড়ি কলা দুধে হাপুস-হুপুস ফলার খাচ্ছে।

মাথা ঠিক থাকে?

তিনি বলেছিলেন, তোমরা কি মানুষ না!

শিবানী এককদম এগিয়ে গেল। বলল, খেলে কী হয়? তোমরা খাও না!

শিবানী এতটাই মাথায় চেপে বসেছিল যে ঝড়েশ্বর আর ধৈর্য রাখতে পারেননি। শিবানী তার খুশিমতো কাজ করত। অথবা মায়া যা বলত, এমনও হয়েছিল শেষদিকে, তিনি শিবানীকে কিছু বলতে সাহসই পেতেন না। মায়াকেই বলতে হত, শিবানীকে বল তো, দু-প্যাকেট সিগারেট এনে যেন রেখে দেয়। শিবানী সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত।

লোকজন সকাল থেকেই বাড়িতে ঢুকছে। তাদেরও চা দিতে হয়। শিবানীই এনে দেয়। তারপর সেও এককাপ চা নিয়ে বসে যায়। তখন ডাকলে এক কথা, দাদু চা খাচ্ছি। চাও একটু নিশ্চিন্তে খেতে পারব না! এক দণ্ড বসতে দাও না। কী বাড়িরে বাবা!

যাঁর মারফতে শিবানীকে এনেছিলেন, তাকে ডেকে পাঠালেন।

সে এসে বলল, ভাই গোকুল আমাকে রক্ষা করো।

কী হল!

কিছুই হয়নি। এই শিবানী, তোর ফ্রক প্যান্ট ব্যাগে ভরে নে। এই নে তোর এ মাসের টাকা। গোকুল তোকে দিয়ে আসবে।

গোকুলদার দরকার হবে না। আমি একাই যেতে পারব।

তুই বাড়ি যা। গোকুল দিয়ে আসুক। তারপর বাড়ি থেকে একা খুশিমতো বের হবি, ঢুকবি। আমার দায় থাকবে না। তোর বাবাকে দেখা করতে বলবি।

গোকুলের এক কথা, কী করেছে দাদা!

কী করেছে!

তোমার মাসিকে ডাক্তার দেখাতে গেছি। ফিরে দেখি, মায়া নেই, শিবানী নেই। সদরে তালা দেওয়া।

মানে!

মানে আর কি! তিনি মায়ার সঙ্গে বের হয়েছিলেন পান খেতে। আজকাল একা একা বের হওয়া স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

কোথায় গেল! কাউকে কিছু বলে যাবে না। কিছু হলে তো আমাকেই ধরবে। দেখি তিনি পান চিবুতে চিবুতে ফিরছেন। ধমক দিতেই, অ মা এ কি কথা গ। আমি কি হারিয়ে গেছি! তুমি আমাকে বকছ। তোমাদের দেরি দেখেই তো এগিয়ে দেখছিলাম, ফিরছ কি না। একা এত বড়ো বাড়িতে থাকা যায়, বল!

তিনি নিজেই হতভম্ব। এই সব জটিলতায় এক সময় ঝড়েশ্বর ঠিক করে ফেললেন, না আর রাখা যাবে না। মাঝে মাঝে ভয়ও দেখাতেন, তোর বাবাকে ডেকে পাঠাব। তোকে আর রাখা যাবে না। ছাড়িয়ে দেব।

দাও না। আমার কি কাজের অভাব!

শিবানীর বেলাতেও তার বাবাকে ঝড়েশ্বর বলেছিলেন, নিজের মতো থাকলে, ওর ভালোই হবে। আমরা দুজন, আরও একজন থাকলে বাড়িটা প্রাণ পায়। ভালো হয়ে থাকলে, ওর বিয়ের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।

এজন্য শিবানীকে, নানা লতাপাতা আঁকা ফ্রক, প্যান্ট কিনে দিয়েছেন। তিনতলায় একটি পুরো ঘর ছেড়ে দিয়েছেন—ড্রেসিং টেবিল, আয়না, একটা ক্যাম্পখাট, কাফুই স্নো-পাউডার কিছুই বাদ দেননি। লতাপাতা আঁকা একটা টিনের সুটকেসও কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাখা গেল না।

একমাত্র মায়াকে তাড়ালে যদি হত, কারণ মায়া এবং নিভা, দুজনেই জানে, বাড়িতে সবাই থাকতে—তাদের মাইনে, জলখাবার, পুজোয় শাড়ি, নতুন বছরকার শাড়ি সব ঠিক হয়ে আছে।

পুত্ররা বাবা-মার অসুবিধে হবে ভেবেই, যা দেওয়ার তারাই দেয়। মাইনে, পুজোয় শাড়ি, অসুখে-বিসুখে ওষুধ, পুজোয় বখশিস—সব। মা-বাবার প্রতি তাদের গুরুদায়িত্ব এভাবেই পালন করছে। কাজেই তিনি ইচ্ছে করলেই বলতে পারেন না, না দরকার নেই!

তখন এক কথা।

আপনি কে?

মাইনে দেয় বাবুরা।

তারাই বলবে, যাব কি থাকব।

ঝড়েশ্বর অবশ্য বলতে পারেন, দ্যাখ বাবা, এত অপচয় আমার সহ্য হয় না। আমি গরিব বাবার ছেলে, তোমরা যে কাজ করছ, তার মাইনে যে মাত্রাতিরিক্ত তোমরাও বোঝ, আমিও বুঝি। বাড়ি ছাড়া বাড়ি না হয়ে যায়, তাই পুত্ররা বাড়িটার তদারকিতে তোমাদের রেখে গেছে। দোতলা, তিনতলায় অর্ধেকটাই এখন তালা দেওয়া। যার যার এলাকা, তালা দিয়ে রেখে গেছে। কারও দুটো ঘর, কারও তিনটে ঘর, বাথরুম, বারান্দা, খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি সবই রয়েছে। মাসে দু-মাসে তারা এলে, সব সাফসোফ হয়। না থাকলে, না এলে, ঘরগুলি সাফ হয় না, মাইনে ঠিকই আছে, বারন্দায় ঝাঁট পড়ে না—মাইনে ঠিকই আছে, মোছামুছির বালাইও থাকে না। এখনও দোতলা এবং তিনতলায় মিলে চার-পাঁচটা ঘরে ন্যাতাই পড়ে না। মাইনে তো অর্ধেক হয়ে যাওয়ার কথা। আর রান্নাঘরটা তো লঙ্গরখানা, খুশিমতো খাওয়াদাওয়া। ভালোমন্দ তোমরা আগে খাও, আমরা পড়ে থাকলে খাই। কাজেই ঝড়েশ্বর বোঝেন, তাঁর মাথা গরম হলে সবাইকে তিনি ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারেন। এখন আর এক বাই উঠেছে ছোটপুত্রের—একজন চব্বিশ ঘণ্টার লোক না হলে চলছে না। মাঝে আরার বন্দোবস্তও হয়েছিল, মাসচারেক ছিলও, তবে শুধু খাওয়া আর ঘুম, এবং মশারি টাঙানো ছাড়া, অথবা টেবিলে তাঁদের ভাত, ডাল, মাছ, সবজি সাজিয়ে দেওয়া ছাড়া কাজও বিশেষ ছিল না।

তিনি রাজি ছিলেন না।

কী দরকার, চব্বিশ ঘণ্টার লোকের!

তোমাদের বয়েস হয়েছে। বাজারে গেলেই লোকের দরকার। একা কোথাও বের হওয়া ঠিক না। কখন কী হবে, খবর কে দেয়! বড় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। রোজ ছুটেও আসতে পারি না। টেনশন। কেউ থাকলে কিছুটা নিরাপত্তা থাকে। বোঝ না। ছোটোপুত্রই আয়ার ব্যবস্থা করে যাওয়ার সময় বসেছিল, পেছনে লেগে থেক না।

রাত আটটায় আসত। সকালে বাজার করে ফিরত তার সঙ্গে। তারপর ছুটি। রাতে খেত, সকালেও একপেট খেত। সারাদিন বোধহয় আর না খেলেও চলত। সঙ্গে রোজ পঞ্চাশ টাকা।

ঝড়েশ্বরের গা জ্বালা করত। এত পরিশ্রমের উপার্জনে, শুধু শুয়ে-বসে ভাগ বসাবে।

এক দুপুরে ফোন।

হ্যালো, হ্যাঁ আমি বলছি। কাল থেকে আসতে বারণ করেছি।

বাবা আপনারা দুজনে একা বাড়িটায় থাকবেন! মার শরীর ভালো না।

সারাটা দিন তো একাই থাকি। একাই বা বলছ কেন, তোমার মা কি সংসারে একেবারেই বাতিল হয়ে গেল! তিনি তো আছেন। সারাদিন একদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেন না। বউমারা তোমাদের ফুসলে-ফাঁসলে নিয়ে গেছে, এই এক অভিযোগ। আমার ব্যক্তিত্বের অভাব কাউকে কিছু বলি না, তা না হলে সাহস হয় কী করে, আলাদা ফ্ল্যাট কেনার। আমরা কেউ না!

তিনি ফের বলেছিলেন, রান্নার মেয়েটা তো বারোটার আগে যায় না। কখনো একটা। আমাদের খাইয়ে সে যায়। নিজেও খায়। যত বেলা বেশি হয়, তত তার ক্ষুধা বাড়ে। তার তো সকালে শুধু রুচি-চা খাবার কথা ছিল। ঠিকা মেয়েটাও সঙ্গে বসে যায়। আমি দেখেও দেখি না—আরে বাজারটা তো আমাকেই করতে হয়? লোক বাড়লে কাজ বাড়ে বোঝ না! তোমার মা তো সারাদিন কখনো বাইরের দরজায়, কখনো ভাঁড়ারে তালা দিয়ে বেড়ায়। তারপর চাবি কোথায় রাখে মনে রাখতে পারে না, সারাদিন তারও কাজ মেলা। চাবি খুঁজতে খুঁজতেই তার বেলা যায়।

না বাবা, এভাবে হয় না। এভাবে আপনাদের ফেলে রাখা যাবে না। আপনারা বরং আমার এখানে চলে আসুন। কী হবে বাড়ি দিয়ে! আপনিই তো বলেছেন, বাড়িতে থাকা কঠিন। লোক বাড়ছে, বাড়ি হচ্ছে, উৎপাত বাড়ছে, আপনার প্রতিষ্ঠায়, প্রতিবেশীদের কেউ কেউ ঈর্ষাকাতর। কী দরকার ওখানে থেকে!

তা দিনকাল ভালো না, তিনিও জানেন। বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এত সস্তায় কে দেয়! এত বড়ো বাড়ি বিশ-বাইশ লাখ টাকার কমে করা যায় না। বাড়িটারও খামতি আছে—জমির পাট্টা নেই। কো অপারেটিভের নামে তার এক সময়ের প্রিয়জন, এভাবে ঠকাবে বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি। বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের পর জানতে পারেন, কো-অপারেটিভের সরকারি স্বীকৃতিই নেই। তবু মাথা গোঁজার ঠাঁই, সবাইকে নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকায় স্পৃহাতেই এত বড়ো বাড়িটা করেছিলেন। নিজের রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া যেন বাড়িটা। সেগুন কাঠের দরজা, দামি মোজাইক টাইলসের মেঝে, বাজারের সেরা ইট, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে—এই বাড়ি নিয়ে-কেমন এক নেশায় পড়ে গেছিলেন। এখন সেই বাড়িটাই তাঁর কাছে উপদ্রবের সামিল। তার ওপর ছোটোপুত্রের বায়না, তোমরা এখানে চলে এস।

বললেই যাওয়া যায় না। তারও স্বাধীনতা আছে। নিরুর স্বাধীনতা আছে। পুত্রদের কারও ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার অর্থই ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা। নিরু রাজি হবে না কিছুতেই।

বাড়িটা বিক্রি করে একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারলেও হত। এমন ভাবলেই বুক চিরে যেন রক্ত নির্গত হতে থাকে। এত শখের এত পরিশ্রমের বাড়ি, বললেই কি বিক্রি করা যায়! বাড়িটাকে ঘিরে সন্ত্রাসেরও শেষ নেই। পুত্ররা চায় না, বাড়িটায় তিনি একা নিরুকে নিয়ে থাকেন। অন্তত কেউ পাশে থাকুন।

এ সব ভাবতে ভাবতেই তাঁর কেন যে মনে হল, পুত্রটি যা নাছোড়বান্দা, ঠিক তুলে নিয়ে যাবে।

তিনি বলেছিলেন, আমি খুঁজছি। তোমার মাও খোঁজ করছেন।

এই খোঁজাখুঁজির ঠেলাতেই শেষবেলায় ফুলি হাজির। শিবানীকে দিয়ে হল না, যদি ফুলিকে দিয়ে হয়। অন্তত সারাদিন তারা ছাড়াও কেউ একজন থাকবে। তাঁদের প্রতি থাকতে থাকতে ফুলির মায়া গড়ে উঠবে। এ বাড়িতে বসবাসের ফের আকর্ষণ গড়ে উঠবে।

তখনই নিরু এসে বলল—কী ঝামেলা বল তো?

কী হয়েছে?

ফুলি বাথরুমে ঢুকতে চাইছে না। দরজা বন্ধ করলেই চেঁচামেচি শুরু করে দিচ্ছে।

কেন! তুমি ওকে বকেছ!

বকব কেন! ওর নোংরা ফ্রক ধুয়ে চানটান করে নিতে বলছি। বিসুনের ধোওয়া ফ্রক প্যান্টি বের করে দিয়েছি। কী নোংরা সব। গায়ে পলেস্তারা পড়ে গেছে।

তুমি পারবে না। একদিনের ঘষামাজার কাজ না। নিভা চলে গেছে? না আছে। কলপাড়ে বাসন মাজছে।

সকালে নিভার কাজ সব ঘর-বারান্দা ঝাড় দেওয়া, মোছা। তারপর এ-বাড়ি সে-বাড়ির কাজ সেরে ফিরে এসে চা-ও খায়, চপাটিও খায়। কলপাড়ে বসে বাসনও মাজে। বেল, আটটা না বাজলে এ বাড়িতে চা-জলখাবার খাওয়া যায় না। তার কাজের চেয়ে জলযোগের লোভ বেশি। বাসন-কোসন মেজে রান্নাঘরে কতক্ষণে পা ছড়িয়ে বসবে, স্টিলের গ্লাসে এক গেলাস উত্তপ্ত চা আঁচলে চেপে খাবে, রুটি আলুর হেঁচকি খাবে। খাওয়ার কথা নেই, তবু খায়। কে খাবে বাবুর? তারা খায় বলে সংসার সচল বায়ুর বোঝা উচিত। মায়াও আছে, নিভাকে হাতে রাখতে না পারলে, চাল, ডাল, তেল, নুন সরানো কঠিন—নিভারও বায়নার অন্ত নেই–

কী হচ্ছে?

ফুলকপির ডালনা।

দাও তো দেখি, কীরকম রাঁধলে?

মায়া অক্লেশে হাতায় তুলে দেয়।

কী বসিয়েছ!

চাউমিন।

দাও তো–

অক্লেশে চাউমিন দিলে, নিভার সতর্ক নজর।

সস দাও একটু। বেশি সুযোগ পেলে ডিমের ওমলেট। বাবু-বিবি দোতলার ঘরে। সারা সকাল কাগজ আর কলম—কী যে লেখেন? না হয় পড়েন। আর টিউশিনি। দুজন থাকলে সুযোগ বেশি, তৃতীয় কেউ থাকলেই ঝামেলা, তার আর মায়ার আনতে চললেই হয়ে গেল। তৃতীয় জন থাকতে থাকতেই বুঝে যায়, এ বাড়িতে এ-দুজনের মৌরুসিপাট্টা।

লপ্তে লপ্তে কাজ, লপ্তে লপ্তে টাকা।

ঠাকুরের বাসন, পঞ্চাশ টাকা।

রান্নাঘরের এঁটো বাসন, একশো টাকা।

নালায় দু-বালতি জল ঢেলে দেয় তারজন্য পঞ্চাশ টাকা। জামাকাপড় কাচা–একশো টাকা, এত বড় বাড়ির ঘর-বারান্দা মোছা—তিনশো টাকা।

মায়া সকালে রান্না করে খাওয়ায় টেবিলে সাজিয়ে রেখে যায়। ঝড়েশ্বর চান করে বের হলে, নিরু পুজোর ঘর থেকে নেমে আসে। খেতে দেয়। তারপর বাকিটা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে দেয়। সাঁজবেলায় আবার মায়া আসে, ফ্রিজের খাবার গরম করে ফাঁক বুঝে এটা-ওটা খেয়ে যায়। কিছু নিয়েও যায়। যেতে-আসতে হাতে তার একটি পলিথিনের ব্যাগ ঝুলবেই। সকালে-সন্ধ্যায় তার আসল কাজ— নিয়ে যাওয়া। দিনরাতের কেউ না থাকলে হচ্ছে না, ছোটোপুত্র খরচের বহর দেখেই টের পায়।

দিন-রাতের বয়স্ক মহিলা রাখারও চেষ্টা করেছেন ঝড়েশ্বর। তবে রাখতে পারেননি।

এল একা। মাস যেতে না যেতেই মাইনে হাতে পড়তেই দেশে না গেলে চলছে না। সপ্তাহ কাটিয়ে একা এল না। সঙ্গে কচাকে নিয়ে এল।

কোথায় রেখে আসব বলুন? কেউ রাখতে চায় না। মরদ আমার নতুন বউ নিয়ে কোথায় ভেগে গেছে।

বাবুর শিরেসংক্রান্তি। নিয়ে গেলে ফেলতে পারবে না বাবু। এই ভরসা বউটির। তিনি যে কী বলেন! কিন্তু ঝড়েশ্বর বোঝেন, এক মাসেই সংসারের হাল বুঝে গেছে বউটি। হাতের কাছে কেউ না থাকলে বাবু-বিবি নাচার। নাও এবারে ঠ্যালা সামলাও। কিন্তু ঝাড়েশ্বর বোঝেন, বাড়িটার অপচয়ের বহর টের পেয়েই সঙ্গে পুত্রটিকে নিয়ে আসতে সাহস পেয়েছে। ছাড়িয়ে দিলে লোক পাবেন কোথায়! লোক পাওয়া সোজা!

কিন্তু ঝড়েশ্বর যে একগুঁয়ে এটাই বোধহয় দিন-রাতের মহিলাটির জানা ছিল না।

হবে না।

কী হবে না?

তোমার থাকা হবে না।

কেন?

আমার দরকার নেই। কার কাছে রেখে আসব বলুন! বাড়ির এক কোনায় পড়ে থাকবে। কোনো উৎপাত করবে না।

না, আমি রাখব না।

কে করবে কাজ?

নিজেই করে নেব? কিন্তু যায় না, বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না। তারপর অগত্যা পুলিসের ভয় দেখাতেই তিনি নিষ্ক্রান্ত হলেন।

তারপর এল শঙ্করী। মাস যেতে না যেতেই স্বামী এসে হাজির। টাকা নিতে এসেছে—ভালো। টাকা দিলেন, সেদিন গেল না। পরদিনও গেল না। তিনতলার ঘরটায় শুয়ে-বসে থাকে—আর কীর্তন গায়।

কী হল শঙ্করী! তোমার বরের যে নড়ার নাম নেই। মাঝে মাঝে কীর্তনও গায়। বাড়িটা যে পীঠস্থান হয়ে যাবে দেখছি।

আজই যাবে। আমার গোঁসাই বেশিদিন কারও বাড়িতে থাকে না। গেল ঠিক, মাস শেষ হলে আবার চলেও এল। ঝড়েশ্বরের ছোটোপুত্রের এক কথা, মেয়েটা বাবা বিশ্বাসী। বর এসে দু-চার দিন থেকে যায় তো কী হয়েছে! থাকুক না। তোমার তো কথা বলারও লোক নেই। বিশ্বাসী লোক পাবে কোথায়। কথা বলার লোক পাবে কোথায়?

তারপরের মাসে এল, যাওয়ার আর নাম করছে না।

ছোটোপুত্রকে না জানিয়েই বললেন, শঙ্করী এই নাও টাকাপয়সা। অন্য কোথাও ঠিক কাজ পেয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে বরকে নিয়ে থাক। আমার অসুবিধা হচ্ছে। সেখানে গিয়ে যত কেত্তন গাও, মচ্ছব বসাও, আমার কিছু বলার নেই। আমি রাখতে পারব না।

নিরুরও এক কথা, বিশ্বাসী লোক পাওয়া দুষ্কর। বর আসে, থাকে খায়, তোমার কী? বর আসবে না। ও বেচারারই বা দোষ কোথায়। শরীর বলে কথা।

ঝড়েশ্বরের এক কথা, থাকবে না বলেছি, থাকবে না। বর না কে দেখগে!

অগ্যতা শঙ্করী রফায় এসেছিল।

মাসে বাবু দু-দিন।

দু-দিনে হয়ে যাবে?

তা হয়ে যাবে বাবু। আমরা গরিব মানুষ, দু-দিনই পাই কোথায়!

বর থাকে কোথায়? কাজে ঢোকার সময় তো বলেছিলে সংসারে কোনো পিছুটান নেই। দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, পুত্রটি তোমার রাজের কাজ করে।

মিছে কথা বলি না বাবু। স্বোয়ামিও নাই। একা মানুষ। এই লোকটাই তো বুদ্ধি দিল, তোর গতর আছে, খেটে খাগে। তোর ঝুপড়ি পাহারা দেব। ব্যাংকে পাসবই করে দেব। বাবুর বাড়িতে খরচ নাই। খাবি থাকবি ব্যাংকে টাকা জমাবি।

তোমার গতর আছে, অন্য লোকে বুঝে ফেলল, তুমি বুঝতে পারনি।

কী করে পারব কন! লোকটা ঝুপড়িতে উঠে না এলে বুঝতেই পারতাম না। নর্ডার পার হয়ে চইলে এল, গাঁয়ের মেয়ে আমি, ছেলেমেয়েরা উড়ে গেছে। পরান খা-খা করে। ভাদু দাদার পরামর্শ, ঘরে বসে থাকিস না পোকায় কাটবে গতর। সকালে এল, ফকটে খেল। তারপর বারান্দায় বসে নীলময় প্রভুর গান জুড়ে দিল। মনে হল লোকটা থেকে গেলে মন্দ হয় না। গরিব মেয়েছেলের কেউ না থাকলে যে বড়ো সমস্যে বাবু। আমার পিছুটান থাকলে কাজে জুড়ে যাই, বলেন।

ঝড়েশ্বরের সহসা মনে হয়েছিল, এই তার দোষ। কাজের লোকের কাছে তিনি ইজ্জত রাখতে পারেন না। এত কথা এত ব্যাখ্যা তাঁর চাওয়া ঠিক হয়নি। চাপে পড়ে শঙ্করী সোজাসুজি বলেই দিল, স্বোয়ামী থাকলে, পোলাপান থাকলে পিছুটান থাকে বাবু। আমার কিছুই নেই। ভাদু দাদা পালাগান গায়, গলায় কণ্ঠি, সাচ্চা মানুষ। দু-চারদিন থাকে দু-চারদিন উড়ে বেড়ায়। পালাগান করতে কোথায় কোথায় চলে যায়। মাস মাইনের সময় আসে। টাকা নিয়ে যায়। ব্যাংকে জমা রাখে।

ব্যাংকের বই আছে তোমার? লেখাপড়া জান?

আজ্ঞে না।

নিয়ে আসবে। দেখব কত জমেছে।

ভাদু দাদা বড়সাধু মানুষ বাবু। ঠাকুর দেবতা নিয়ে কারবার। টাকাপয়সা চিনে না। খেতে পেলেই খুশি।

ঝড়েশ্বর ভাবলেন, তা খেতে পেলেই খুশি। অন্ন কিংবা শরীর। লোকটি শঙ্করীর আসলে রক্ষিতা, রক্ষিতা হয় কী করে, বরং রক্ষিতই বলা চলে। তিনি না বলে পারেননি, মেয়ে-জামাইরা আপত্তি করে না? লায়েক পুত্র আপত্তি করে না?

না গো বাবু, কে দেখে! একটা যখন লোক পাওয়া গেছে, গার্ডিয়ানের মতো আছে, আপত্তির কথা উঠেই না।

ঠিক আছে, আট-দশ মাস তো হয়ে গেল। কত জমেছে আমাকে এসে দেখাবে। তারপর কী ভেবে ঝড়েশ্বর বলেছেন, কত জমেছে বলতে পার।

নিরুর তখন কী ক্ষোভ!

ঝড়েশ্বর পড়ে যেতেন বিপাকে।

নিরুর সেই এক কথা, তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?

শঙ্করীর পেছনে এত লাগলে হয়! তার টাকাপয়সা কী জমছে না জমছে, তুমি দেখার কে? তারটা সে বুঝবে।

না, ভাবছি যদি ঠকায়।

ঠকালে ঠকবে। তার বিশ্বাসের দাম দেবে না! এত পেছনে লাগলে কেউ থাকে! এমন জেরা শুরু করলে, সে বেচারা ফাঁপরে পড়ে সব গড় গড় করে বলে গেল। বোঝ না শঙ্করী কত সোজাসরল মানুষ। না হলে বলে, মাসে তার দু-দিন হলেই চলবে! লোকটা তোমার এখানে এসে যে ওঠে, কখনো মনে হয় খিচকে হারামজাদা? তোমাকে বাবু বলে না, কর্তাবাবুও না, সোজা তোমাকে বাবা সম্বোধন। প্রভু গৌরহরি বলে পায়ে তোমার গড়িয়ে পড়ে। এত সুবন্দোবস্ত আছে বাড়িতে তিনতলায় ফাঁকা ঘর, ফ্যান-লাইট, করিডর পার হলে বাথরুম, অপর্যাপ্ত জল, সে যে এখানে এসে উঠতে চায়, বোঝ না? বাবা বললে তো গলে যাও। তা ভাদু তোমাদের দিকে চালের দর কত? গ্রাম জায়গায় তরিতরকারি মেলা—

আর যায় কোথায়।

বাবা লাউটা গাছের। আপনের সেবায় লাগুক।

বাবা মাচানের শিম। আপনার সেবায় লাগুক।

বাবা, বাজারে ভালো মানচুক উঠল। আপনার সেবায় না লাগলে খেয়েও সুখ নাই।

তুমি তো বিগলিত। আর ভাদু, চলে গেলেই, সোজাসরল বউটাকে নিয়ে পড়। শঙ্করী, আমার বাড়িতে এসব চলবে না। চলে যাও। তোমাকে রাখব না। পিছুটান নেই, এই তোমার পিছুটান না-থাকা! শঙ্করী প্রাইভেসি পর্যন্ত থাকল না! তুমি কী!

শঙ্করীরও রেহাই নেই।

কী হল? বাড়ি যাও। ঝড়েশ্বরের এক কথা।

আপনাদের চলবে কী করে?

এক-দুদিন চালিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না।

শঙ্করী না বলে পারল না, মাসিমার শরীর ভালো না।

সে তোমার ভাবতে হবে না। ভাদুকে বলবে, বাবু আমার পাসবইটা দেখতে চেয়েছে। নিয়ে যেতে বলেছে।

শঙ্করীও মুখঝামটা না দিয়ে পারেনি। আমার গোঁসাই রে আপনে সন্দ করেন বাবু। ঠাকুর-দেবতা ছাড়া লোকটা কিছু বোঝে না। পালাগানে একবার গেলে বুঝতে পারতেন, কেষ্ট কীর্তন পালা, গলায় গেঁদাফুলের মালা কপালে তিলক, নাকি তিলক, দু-হাত তুলে দোহারিরা চারপাশে ঘোরে, হারমানিয়াম বাজে। খোল করতাল বাজে আর সমস্বরে গান, হরে কৃষ্ণ হরে রাম, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে তার পরেই গোঁসাইর খাম্বাজ গলা, কহিলা যদুপতি, আমার বালগোপাল যায় ধেনু লইয়া, মথুরায়…। আর মানুষের দু-চোখ বহে যায় অশ্রুতে। আপনে গেলেও আসর সেরে উঠে আসতে পারবেন না। আর পয়সার পুস্পবৃষ্টি, সিকি, আধুলি, টাকা–কী নেই! পয়সার অভাব আছে তার?

আসলে ঝড়েশ্বরেরও গোঁ কম না। মাথায় কিছু ঢুকলে তা নড়তে চায় না। শঙ্করীর টাকাপয়সা থাকল কি গেল, কে ঠকাল শঙ্করীকে তাঁর দেখার কথাই না। কিন্তু ওই যে রোখ, রোখ চেপে গেলে যা হয়, শঙ্করী বিনি মাগনায় পয়সা পায় না। বাড়িটায় সারাদিন বেজায় খাটে, খাটে বলেই টাকাটা দিতে ঝড়েশ্বরের গায়ে লাগে না, তাই বলে মেয়েটার ঘাড়ে বসে খাবে! আর শরীরে রোখ চেপে গেলে দশক্রোস হেঁটে চলে আসবে! দু-দিনের অনুমতি এমনিতেই আছে, তিনতলার ফাঁকা ঘরটায় খাঁটিয়া পাতা থাকেই, বয়স হয়েছে বলে, ঝড়েশ্বর কিংবা নিরু কেউ ওপরে প্রায় ওঠেই না, সিঁড়ি ভাঙলেই হাঁপ ধরে, এমন সুবর্ণ সুযোগ ভাদু ছাড়ে! মাঝে মাঝে সাড়াও পাওয়া যায়, এই শঙ্করী কোথায় গেলে? আরে সাড়া দিচ্ছ না কেন? ঝড়েশ্বর ওপরেও উঠতে পারেন গিয়ে কী দেখবেন, যদি দেখেন মথিত হচ্ছে, তবে আর এক কেলেঙ্কারী। ধরা পড়ে গেলে শঙ্করীর মাথা হেঁট হয়ে যাবে তাঁকে মুখ দেখাতে পারবে না, লজ্জায় কাম-কাজ ছেড়ে পালালেই নিরুর চোপা শুরু হয়ে যাবে।

কে বলেছিল অসময়ে ওপরে যেতে। বাড়িটায় এটুকু প্রাণের সাড়াও তুমি সহ্য করতে পার না। কেউ থাকে। পালাবে না। তোমার ঘটে এটুকু এলেমও নেই। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ, ওরা দিবানিদ্রা দিচ্ছে আর তুমি গিয়ে সেখানে হাজির হলে। তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে! তার পাসবই গেল কি থাকল, তোমার কী? শঙ্করী তো কচি খুকি না! সে তার নিজের ভালোমন্দ না বুঝলে তোমরা কী? তার গোঁসাই তারে মারে কি রাখে, সে বুঝবে।

ঝড়েশ্বর চুপচাপ শোনেন, কোনো মন্তব্য করেন না। মন্তব্য করলেই নিরুর চোপা শুরু হয়ে যাবে। তবু কী যে হয় তার, একটা দামড়া বাড়িটায় যখন-তখন ঢুকে যাবে, রাত্রিবাস করবে, ভালোমন্দ খাবে, শত হলেও গোঁসাই সে শঙ্করীর। সে এলে শঙ্করী নানা অজুহাতে একটু বেশি বেশিই নানা কিশিমের পদ তৈরি করে—

বাবু, দুধ জমে গেছে। আপনাদের জন্য পায়েশ করে রাখি।

রাখ।

দুধ জমে গেছে, ক্ষীর করে রাখি?

রাখ।

সন্দেশ করে রাখি।

রাখ।

বাজারে যাচ্ছেন, ভালো ইলিশ যদি পান। মাসিমা বলছিল, এ-বাজারে ভালো মাছ পাওয়া যায় না। বাগুইহাটির বাজারে গেলে পাবেন। পদ্মার ইলিশের ছড়াছড়ি।

গোঁসাই এলেই এটা শঙ্করীর বেশি হত।

সব তিনি চোখ বুজে সহ্য করেন। মেয়েটার হাতটান নেই। চুরি করে খায় না। দীক্ষা নিয়েছে গুরুর কাছে—মাগগিগণ্ডার বাজারে এমন কাজের লোক পাওয়া সত্যি কঠিন–নিরুকে কুটোগাছটি নাড়তে দেয় না, নিরু বাথরুমে ঢুকলেই শঙ্করীর এক কথা—মাসিমা ছাড়া কাপড় কাচতে যাবেন না। আমি আছি কী করতে মাসিমা, আমি তো মরে যাইনি।

ঝড়েশ্বর জানেন, পাসবই নিয়ে লড়ালড়ি করতে গিয়ে শঙ্করী যদি হাতছাড়া হরে যায়, তবে তাঁর রক্ষা নেই। তিনি শুধু দেখতে চান, টাকা ঠিকমত তার জমা পড়ছে কিনা। শঙ্করীর রক্ত জল করা পয়সা কেউ না আবার মেয়ে দেয়।

তার তো কোনো খরচ নেই।

শাড়ি সায়া ব্লাউজ যা লাগে দেন।

কাচাকাচির সাফও দেন। শঙ্করীর আলাদা সার্ফ, আলাদা সাবান।

অসুখ-বিসুখে ডাক্তার, ওষুধ—সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। ভবিষ্যতে তার কষ্ট না হয়। শরীর তো, কখন পড়ে যাবে–বুড়ে হলে খাওয়াবে কে? কিছু টাকাপয়সা ব্যাঙ্কে থাকলে সেই লোভে পুত্র-কন্যারা শেষ সময়ে মুখে গঙ্গাজলটুকু অন্তত দেবে। এতসব চিন্তা থেকেই, তিনি শঙ্করীর পাসবই দেখতে চাইছেন।

শঙ্করীর বছর চল্লিশও বয়েস হবে না। মুখে শ্ৰী আছে। খুবই মজবুত গঠন। তার প্রথম সন্তান পুত্র। পনেরো বছর বয়সেই আঁতুড় শুরু। তারপর বছর পার না হতে মেয়ে, তারপর আবার বছর পার না হতে আর একটি মেয়ে, শেষে হেলথ সেন্টার থেকে নাড়ি কাটিয়ে এখন একেবার ঝাড়া হাত-পা। ওতেও শানাচ্ছিল না, বছরখানেক আগে দীক্ষাও হয়ে গেছে। শঙ্করী থাকলে বাড়িটাতে প্রাণের সাড়া থাকে তাও তিনি টের পান, সরলসোজা হলে যা হয়! কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ত। ডাক খোঁজে খুবই আন্তরিক।

সেই মেয়েটার শেষে কিনা পাসবই নিয়ে মরণ হল।

ঝড়েশ্বর এখনও শঙ্করীর জন্য কষ্ট পান।

তার টাকাপয়সা ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে কি হচ্ছে না, তাঁর কী দায়! নিরু বলত, তোমার এই পরোপকারী ভাবটা ছাড়। তোমার বাড়িতে কেউ থাকে!

শঙ্করী বাবুর তাড়াও সহ্য করতে পারছিল না।

কী হল শঙ্করী, বাড়ি যাও।

যাব।

যাব বললে তো আর হয় না, যেহে হয়। বাবু আর মাসিমাকে একা ফেলে যায়ই বা কী করে! খুবই ন্যায্য কথা।

ঝড়েশ্বর বলেছিলেন, ঠিক আছে, ভাদু মাসের শেষে আসে। ওকে বল, বাবু পাসবইটা দেখতে চেয়েছে। আবার যখন মাইনে নিতে আসবে, পাসবইটা সঙ্গে যেন আনে।

বলব। বলে বালতিতে ছাড়া কাপড় ভেজাতে বাথরুমে ঢুকে গেছিল।

গোঁসাই মাসের শেষে হাজির।

ঝড়েশ্বরই বলেছিলেন, তোমার সঙ্কোচ যখন শঙ্করী, আমিই না হয় বলব। কত নিয়মকানুনের বালাই থাকে—ভাদু হয়তো লিখতে ভুল করতে পারে, লেখাপড়া কতটা জানে, তাও জানি না। চোর-বাটপাড়ের তো অভাব নেই। ব্যাঙ্কের বাবুরাও খুব সুবিধের লোক হয় না। কোথায় কি গোঁজামিল থাকবে—ভাদু বুঝতেও পারবে না।

বাবু, গোঁসাই এত কথা বললে রাগ করতে পারে। আপনি বরং বুঝিয়ে বললে কথা ফেলতে পারবে না।

সেইমতো গোঁসাই এলে তিনি বলেছিলেন, ভাদু আবার যখন আসবে পাসবইটা সঙ্গে এন।

তা বাবা, আমি ঠিক আনব। আপনি ঠিকই বলেছেন। ভাদু দু-দিনের জায়গায় চার-পাঁচদিন থেকে যাওয়ার সময় বলে গেল পাসবইটা আপনার কাছেই রাখবেন বাবু, আমি বাড়ি থাকি না, শঙ্করীও ঘরছাড়া, তালাবন্ধ ঘরে রাতে ঢুকে কেউ চুরি করে নিলে আমার ধর্ম থাকবে না। আপনি খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি—পাসবইয়ের এত কি আমরা বুঝি!

ঝড়েশ্বর ভেবেছিলেন, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। শঙ্করীর কষ্টের উপার্জন, বয়স তো এক জায়গায় থেমে থাকে না, শেষ বয়সের সঞ্চয় বলতে কথা, তাঁর পক্ষে চোখ বুজে থাকাও সম্ভব নয়, শঙ্করীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি উচিত কাজই করেছেন।

ভাদু নিজেও একবাক্যে রাজি।

অসুবিধার আর কিছু থাকল না।

ভাদু ঠিক নিয়ে আসবে!

মাসের শেষে শরীরের রোখ দমনও হয়, হাতে টাকাপয়সাও হয়—ভাদু ঠিক চলে আসবে।

বরং মাস শেষ হওয়ার অনেক আগেই চলে আসতে পারে।

দিন যায়।

ঝড়েশ্বর ক্যালেন্ডারের খাতা দেখেন।

কিন্তু ভাদু আসে না।

শঙ্করী জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। বড়ো রাস্তার মোড় থেকেই বাড়িটা দেখা যায়। ভাদুর আসার কথা থাকলে, শঙ্করীর শরীরেও যে রোখ চেপে যায় ঝড়েশ্বর ভালোই টের পান।

জানালায় শঙ্করী দাঁড়িয়ে থাকলেই বলতেন, চলে আসবে।

শঙ্করীর খুবই ব্যাকুল কথাবার্তা।

বাবু মাস তো শেষ হয়ে গেল।

আসবে। কত কাজে আটকে যেতে পারে। পালাগান গায় যখন, এক জায়গায় আটকে থাকার পাত্র সে নয়। কোথাও গ্যাছে, দু-চারদিন দেরি হতেই পারে। মচ্ছব থাকলে, তো কথাই নেই। খাওয়ার লোভ ভাদুর বেশি মাত্রাতেই। খাওয়ার লোভে পড়ে গেছে হয়তো।

দিন যায়। ভাদু আর আসে না।

মাস যায়, ভাদু আর আসে না।

দশ ক্রোশ রাস্তা, হাঁটাপথে। বাসটাসের। রাস্তা হলেও না হয় এক কথা ছিল, শঙ্করীর কেমন পাগল পাগল অবস্থা। পরপর দু-মাস বেপাত্তা থাকলে চিন্তা হওয়ারই কথা। শঙ্করী বাবুকে ফেলে যেতেও পারে না। তার খাওয়াদাওয়ায় রুচিও যেন নেই—একদিন সেই পাগল পাগল অবস্থাতেই শঙ্করীর হঠাৎ কী হল। সকালবেলায় চা-জলখাবার দেওয়ার সময় সহসা বলে ফেলল, বাবু আমি ঘুরে আসব। মন মানছে না। দু-চারদিন একটু কষ্ট হবে আপনাদের। আমারও মরণ। মন মানছে না। ঠিকা কাজের মেয়েটা তো আপনার আছে, সে-ই না হয় ডাল-ভাত করে দিয়ে যাবে।

নিরু বলেছিল, যাও। সত্যি তো ভাদুর আক্কেলখানা কি, আসতে পারছিস না, একটা খবর তো দিবি! চিন্তা হয় না। আমরা ঠিক চালিয়ে নিতে পারব। অসুখ বিসুখ হতে পারে। তুমি বাড়ি থেকে বরং ঘুরেই এস।

শঙ্করী গেল ঠিক, তারও পাত্তা নেই।

যে গেল খুঁজতে, সেও বেপাত্তা।

ঝড়েশ্বর পড়ে গেলেন মহাফাঁপরে।

আবার চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক খোঁজা, পাওয়া যায়, তবে শঙ্করীর মতো বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া কঠিন। অগত্যা তিনি নিজেই রওনা হবেন ঠিকঠাক যখন, শঙ্করী নিজেই এসে হাজির। সেই এক পাগল পাগল অবস্থা।

সে এসেই বাবুর পায়ে পড়ে গেল।

কী হয়েছে?

শঙ্করীর এক কথা, বাবু গো, গোঁসাই আমার কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেছে।

বল কি! কোথায় যাবে। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ জানে না, তোমার ছেলেমেয়েরা কেউ জানে না, কোথায় গেছে?

না গো বাবু, কেউ কিছু বলতে পারে না। ঘর তালাবন্ধই পড়ে আছে। ঘর খুলে খুঁজেছ!

কী খুঁজব?

তোমার পাসবই রেখে গেছে কিনা?

আজ্ঞে মানুষটাই নিখোঁজ, আমার পাসবই দিয়ে কী হবে গো বাবু। আপনি কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলেন গো বাবু। কী দরকার ছিল, পাসবইয়ের কথা বলার! এখন আমি তাঁরে কোথায় খুঁজে পাই?

ঠিক আছে, স্নানটান করে কিছু খাও। পরে ভেবেচিন্তে কিছু না হয় করা যাবে।

আমার যে খেতে ইচ্ছে করে না। কেবল তারে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। কোথায় না গেছি! কীর্তনিয়া ঠাকুর প্রসাদের কাছে গেলাম, কোনো খবরই দিতে পারল না। কত জায়গায় গেলাম, কেউ কিছু জানে না। গোঁসাই কার কীর্তনের পালায় গান গাইত তাও কেউ বলতে পারল না একটা খবর আছে, দেশের টানে বর্ডার পার হয়ে যদি চলে যায় আপনাকে খবর না দিলেও নয়, বর্ডার পার হয়ে চলে যাব। গোঁসাই ভেবেছে কী— মন তার উদাস বুঝি। আমি মানুষ না!

ঝড়েশ্বর আর একটাও কথা বললেন না।

তবু ঝড়েশ্বরের যে কী হয়!

শোন।

শঙ্করী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল, ফোঁপানি কিছুতেই কমছে না, বাবু যত নষ্টের গোড়া, পাসবইয়ের পেছনে লেলিয়ে না দিলে, গোঁসাই কখনো দেশান্তরী হত না। ঝড়েশ্বর না বলে পারলেন না, পাসবইটা কি পেলে? সে তো না হয় চলে গেছে। এতগুলি টাকা, ঘরে রেখে গেছে কিনা খোঁজাখুঁজি করলে না! তোমার ছেলেমেয়েদের কাছে যদি রেখে যায়—

না গো বাবু, গোঁসাই তার সুটকেস নিয়ে চলে গেছে। গোঁসাই তো বলেছে, পাসবই সুটকেসে তালা দেওয়া থাকে।

নাও ভালোই হয়েছে। মন খারাপ করে কী হবে? হাতমুখ ধুয়ে কিছু খাও। চেহারা কী করেছ! চোখমুখের দিকে তাকানো যায় না। দেখি পুলিশ তোমার পাসবই যদি উদ্ধার করতে পারে। উজ্জ্বলকে ফোন করে, আসতে বলি।

বাবু গো আপনি আমার আর সর্বনাশ করবেন না গো বাবু! পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। আমি নিজেই খুঁজতে বের হব।

তাহলে কি কাজ ছেড়ে দিচ্ছ!

না না। খুঁজে পেলেই চলে আসব। মাসের টাকাটা যদি আগাম দেন।

নিরু দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছে।

ঝড়েশ্বর স্ত্রীর ওপরই খাপ্পা হয়ে গেলেন।

নাও বোঝ—প্রাণের সাড়া বাড়িটায় কোথায় গেল! তিনি তো চললেন।

শঙ্করী এখুনি কেমন বেপরোয়া হয়ে গেল—আমি যাচ্ছি না গো বাবু। আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন না। গোঁসাই আমাকে ফেলে যাবে কোথায়! জায়গা আছে তার। এত মান-অপমান থাকলে হয়! বাবু কি মিছে কথা বলেছে, পাসবই বলতে কথা। ঠক-জোচ্চরের অভাব নেই, বাবু পাসবইটা দেখতেই পারে। সেই রাগে দেশান্তরী! তোমারে সন্দেহ করছে বাবু!

শঙ্করীর এমন সব কাণ্ডে নিরু ফুঁসছে!

 দাও বিদেয় করে। ধর আগাম টাকা। খোঁজ গিয়ে তোমার গোঁসাইকে।

গোঁসাইকে খুঁজতে সেই যে গেল আর শঙ্করীও ফিরে এল না। ঝড়েশ্বরও আর খোঁজ নিলেন না। না, চব্বিশ ঘণ্টার লোকের আর দরকার নেই এমনও ভেবেছিলেন—নিজের কাজ নিজেরাই করে নেবেন। এত বড়ো বাড়িটায় দুটো জীব একা থাকাও যে কঠিন। লোকজনও আসে দরজা খোলা বন্ধ করার কাজটাও কম না। নিরু শেষ পর্যন্ত আর একটাকে নিয়ে এল—আর কিছু না হোক কেউ এলে, নিভা কিংবা মায়া, যেই আসুক দরজা খুলে দিতে পারবে, কাজ সেরে চলে গেলে দরজা বন্ধও করতে পারবে। এই বয়সে বারবার সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামা-ওঠাও কম হ্যাপা না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *