প্রাণের প্রহরী (কাব্যনাটক) — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
[একজন ডাক্তারের চেম্বার। সাহেবপাড়ায়। সন্ধের পর এ অঞ্চল নিঝুম হয়ে আসে। চেম্বারটি বেশ প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন। টেবিল ও অনেকগুলি চেয়ার ছাড়াও একটি কালো রেক্সিনে মোড়া গদির বিছানা। সেখানে দু’জন বয়স্ক যুবক বসে আছে। এদের নাম প্রতীক ও সংবরণ। এরা অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য, নিচু গলায় কথা বলছে।
ডাক্তারের দশাসই চেহারা। গলার আওয়াজ গমগমে। তাঁর নাম হৃষীকেশ। সবাই ঋষি বলে ডাকে। তিনি একটু চেঁচিয়ে কথা বলেন, অনেকটা নাটুকে ধরনের। তিনি প্রকৃতপক্ষে একটি প্রৌঢ় চেহারার শিশু।]
.
দূর থেকে ডাক্তারের গলার আওয়াজ শোনা যায়:
ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা কী?
প্রতীক : ঐ আসছে ঋষি, সারা পাড়াটা কাঁপিয়ে
সংবরণ : সারাদিন এত খাটনি, তবু ওকে ক্লান্ত হতে
দেখি না কখনও!
ডাক্তার: ব্যাপারটা কী হে! সব এত চুপচাপ
বসে আছো কেন? দূর থেকে ভাবলাম
কেউ নেই, আলো জ্বলছে, যেন কোনও বাগানের মধ্যে একটা
ঘর।
কী রে সংবরণ, তুই কী যেন ভাবছিস মনে মনে?
প্রতীক: চুপচাপ থাকব না কি নাচানাচি করব দু’জনে?
কতক্ষণ ঠায় বসে আছি!
সংবরণ: আর ঠিক পাঁচ মিনিট দেখতাম, তারপর ভাই
কেটে পড়তাম।
ডাক্তার: আরে বোস বোস, এত রাগারাগি কেন,
আমি একা বহুক্ষণ এখানে ছিলাম। এ সময়
কোনও সুস্থ মানুষের দেখা পেতে খুব মন চায়
সারাদিন রুগি আর রুগি!
কটা বাজল?
প্রতীক: সাড়ে আটটা, না, না, তার পাঁচ মিনিট কম
ডাক্তার: যথেষ্ট হয়েছে! আজ রুগি দেখা এখানে খতম!
কানাই, কানাই, কেউ এলে বলবি, আটটার পর
সব অসুখের ছুটি। আমি নেই, দরজা বন্ধ কর,
এখন আনন্দ হবে, ফুর্তি হবে…
কে ওখানে?
সংবরণ: কেউ না তো?
ডাক্তার: মনে হল একটা ছায়া
সংবরণ: কিছু নেই।
ডাক্তার: ওফ এক পার্শি মহিলাকে দেখে আসছি এক্ষুনি,
মাগীর অসুখ নেই কোনও
সংবরণ: ল্যাঙ্গোয়েজ! ল্যাঙ্গোয়েজ
ডাক্তার: যত বলি, মা জননী। তোমার তো অসুখ কিচ্ছু না!
ঘ্যানোর ঘ্যানোর করে তবু বলে, ডাক্তার, আমায় তুমি
ঠিক মতন ওষুধ দিচ্ছ না!
এখানে সেখানে ব্যথা, প্রতিদিন ঘুম যাচ্ছে কমে,
টাকার বান্ডিল, অতি বড়লোক ঘুম হয় টাকার গরমে?
প্রেসার নর্মাল, স্টুল, ইউরিন, কিংবা রক্তে চিনি,
সমস্ত পরীক্ষা করে দেখা হল, স্বাভাবিক। তবু
প্রতিদিনই
ডাক পড়ে
প্রতীক: আহ্ ঋষি, রাত্তির অনেক হল, আমরা এখনও
পেচ্ছাপ বাহ্যির কথা শুনব? এর মানে হয় কোনও?
ডাক্তার: না, না, ফুর্তি হবে, আজ ফুর্তির দরকার
আমারই সবচেয়ে বেশি। কে ওখানে?
সংবরণ: কেউ না তো?
ডাক্তার: মনে হল, ঠিক যেন কোনও
মেয়ে, বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে কেন এ রকম?
প্রতীক: টাকার ধান্দায় রোজ এত পরিশ্রম!
এরপর চোখে সর্ষেফুল দেখবে কোন্দিন, ঋষি!
ডাক্তার: (নিচু গলায়, আগেকার ভাষায় যাকে বলা হত
জনান্তিকে। অর্থাৎ তার এ কথাটা অন্য কেউ শুনতে
পাবে না)।
না, না, সে রকম নয়। বাবলুর অসুখের পর
একটি মেয়ের ছায়া দেখতে পাই কদিন অন্তর
চুপ করে দরজার পাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়
আবার চোখের এক পলক ফেলার আগে চলে যায়
আমি তো চিনি না, ও কে?
প্রতীক: মেয়েটি কেমন দেখতে?
ডাক্তার: (চমকে) কোন মেয়েটি?
প্রতীক: ঐ যে পার্শি মেয়েছেলে, যার কথা তুমি বলছিলে!
ডাক্তার: অসুন্দর পার্শি আমি এ পর্যন্ত দেখিনি কখনও,
ডাক্তারি শাস্ত্রের মতে যে শরীরে রোগ নেই কোনও
তবুও অসুখ থাকে সেখানেও। এই যে মহিলাটি,
রোগ নেই, তবু তিনি অসুস্থ যে সে কথাও খাঁটি।
সংবরণ: তোমাদের প্রচণ্ড সুবিধে,
শুধু ভাই আমাদেরই যা কিছু দুর্ভোগ
যে অসুখ সারাতে পারো না, বলে দাও,
ওটা মানসিক রোগ!
ডাক্তার: হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! সকলেরই খুব রাগ ডাক্তারের প্রতি,
অথচ ডাক্তার ছাড়া চলেও না, কিছু হলে কাকুতি মিনতি!
অন্যান্য সময়ে দুর শালা!
মনের অসুখ চিনে নিতে
ভুল তো হতেই পারে। ইচ্ছে আছে এই মনটাকে
একদিন ঠেসে ধরব ল্যাবরেটরিতে।
পঞ্চভূত মানুষের দেহে
ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু আর ব্যোম। অত্যন্ত সস্নেহে
শরীর এদের পোষে। এর মধ্যে পঞ্চমটি বাদে
বাকি চারটিকে ঢের নেড়ে চেড়ে দেখা হয়ে গেছে,
কিন্তু গোল বাধে
অদ্ভুত জিনিসটি নিয়ে, ঐ ব্যোম, অর্থাৎ শূন্যতা
তার কোনও দিশা নেই, কোনও শাস্ত্রে নেই তার কথা।
সংবরণ: রবীন্দ্রনাথের লেখা আছে এ বিষয়ে, সে সব পড়োনি বুঝি?
তা পড়বে কেন? ডাক্তারেরা বই-টই পড়েন না। শুধু মাত্র
রুজি-রোজগারের ধান্দাতেই মত্ত সমস্ত সময়
প্রতীক: সারা দিনে অ্যাভারেজ ঠিক কত হয়?
দশ, বিশ হাজার, না বেশি?
ডাক্তার: বাজে কথা বোলো না হে! প্রতিদিন দশ কি বারোটি
গ্রন্থপাঠ করি আমি। মানুষের নোখ থেকে মাথার করোটি,
হাড় মজ্জা রক্তের জীবন, এর চেয়ে বড় আর গ্রন্থ আছে?
প্রতীক: এ সমস্ত সস্তা দার্শনিকতা দিয়ে কি পেট টেট ভরবে ভাই?
ঢের হল! মালকড়ি ছাড়ো কিছু মাল-টাল খাই?
ডাক্তার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফুর্তি হবে, আজ ফুর্তির দরকার
আছে খুব আমার নিজেরই। মন ভালো নেই।
দিতে হবে এক ড়ুব ফুর্তির সাগরে কিছুক্ষণ।
.
(বোতল থেকে মদ ঢালা হয়। তিন বন্ধু চিয়ার্স বলে পান শুরু করে।)
ডাক্তার: কে, কে কে ওখানে?
প্রতীক: জ্বালালে দেখছি আজ? থেকে থেকে বারবার কে, কে?
ভুল হতে হতে তবু মানুষ তো খানিকটা শেখে!
রাত্তিরে ঘুমোও না বুঝি?
ডাক্তার: না, না, ভুল নয়, খুব স্পষ্ট চোখে দেখা
বাবলুর অসুখের পর থেকে
সংবরণ: বাবলু, তোমার ছেলে,
তার কী হয়েছে?
ডাক্তার: কী হয়েছে…
আমি নিজেই যে
জানি না উত্তর–
প্রতীক: ধুত্তোর!
খালি শুধু অসুখ,
অসুখ!
[নেপথ্যে একজন কেউ ডাকল, ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু! নদীতে মাঝিরা যে-রকম সুর করে করে জল মাপে, সেই রকম কণ্ঠস্বর।]
সংবরণ: ঐ তো এসেছে কেউ
প্রতীক : ফের কোনও রুগি-টুগি
সংবরণ: এ লোকটিই বহুক্ষণ থেকে আছে দরজার পাশে?
ডাক্তার: না, না, এ সে নয়। একে জানি, চিনি এর
গলার আওয়াজ
মাঝে মাঝে আসে। সাত দিন পর আবার এসেছে বুঝি আজ।।
[আগন্তুকের প্রবেশ। বৃদ্ধ, মুখে সাত দিনের পাকা দাড়ি। একটা রংজ্বলে-যাওয়া নীল জামা গায়, সে আর কারুর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে শুধু ডাক্তারের দিকে চেয়ে থাকে।]
আগন্তুক: ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার: কে, ধরণী?
আবার এসেছ, তুমি এখনও মরোনি?
আগন্তুক: (সাগ্রহে) মরব, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার: মরার কি অন্য কোনও জায়গা পেলে না?
আমার কাছেই বুঝি আছে শুধু দেনা?
আগন্তুক: মরব, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার: সাত দিন কোথা ছিলে? ফের চাড়া দিয়ে উঠে এলে?
আগন্তুক: মরব, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার: চুপ করো! মরণের উচ্চারণ এখানে নিষেধ!
[ডাক্তার পকেট থেকে তিরিশ-চল্লিশটা টাকা বার করে দিলেন। লোকটি কোনও কৃতজ্ঞতা বা নমস্কার না জানিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল।]
প্রতীক: কী ব্যাপার লোকটাকে দিলে এত টাকা?
আমাদের ফুর্তির খোরাক সব ফাঁকা?
সংবরণ: আগেও দেখেছি, তুমি ঐ বুড়োটাকে টাকা দাও,
ব্ল্যাকমেল নাকি?
ডাক্তার: ব্ল্যাকমেলই বটে! এই বুড়ো লোকটি প্রাক্তন নাবিক,
ছিল জলে ভ্রাম্যমাণ। এখন ডাঙায় এসে দিক
হারিয়েছে। ও চেনে না শহরের বাঁধা পথ; মাটির নিয়ম
ও জানে না। সংসারের বুদ্ধি ওর কম
ও বোঝে না নিজের সুবিধে
বাড়িতে পাঁচটি বাচ্চা, রোগা বউ, আর আছে খিদে
বেকারের খিদে পাওয়া অতি বড় দোষ
বেকারের সন্তানের খিদে পাওয়া আরও বেশি দোষ!
প্রতীক: আবার দুঃখের গপ্পো! আজ শুধু অনন্ত ঝামেলা।
ডাক্তার: না, না, না, না; এবারই তো শুরু হবে খেলা!
সংবরণ: ও বেকার, কিন্তু তুমি কেন দিতে যাবে ওর অন্ন?
তুমি কি সমাজ? নাকি রাষ্ট্র? নাকি খোদ দাতা-কর্ণ?
ডাক্তার: সে সব কিছু না।
আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনচর্যায়
এ রকম ফাঁক থাকে। ঐ লোকটা শূন্য-হাতে বাড়ির দরজায়
যদি ফেরে, ঠিক পাখির ছানার মতো, পাঁচটি হাঁ-করা মুখ
মেলে আছে। ওরা রোগী, এর নাম খিদের অসুখ!
ও তো পয়সা চায় না,
বিষ চায়! দু-তিন বার ওর বাড়ি গেছি।
যা দেখেছি,
মনে হয়, এতকাল বইপত্রে যা কিছু শিখেছি
সেখানে উত্তর নেই এ সব প্রশ্নের।
এ পর্যন্ত খিদের ওষুধ কিছু বেরিয়েছে? তবে?
নাকি বিষ দেব?
আমি তো ডাক্তার, কিছু একটা দিতে হবে—
প্রতীক: ওসব বাতেলা ছাড়ো, মাল আনো
মালের উৎসবে
বুঁদ হয়ে থাকি! তুমি অতি বুদ্ধ তাই এখনও উত্তর
চাও, এখনও বিবেক নিয়ে প্যানপ্যান করে চলেছ, ধুত্তোর
ডাক্তার: কানাই, নিয়ায়, আরও মাল আন্ আজ ফুর্তি করি,
মন ভালো নেই
আমার নিজের ছেলে হাসপাতালে দিনের পর দিন…
সংবরণ: এমন ফুটফুটে ছেলে, তার কিছু হতেই পারে না
ডাক্তার: সুইডেন থেকে তার জন্য কিছু অ্যামপিউল কেনা
বিশেষ দরকার
প্রতীক: মাই সান, মাই এক্সিকিউশানার
ডাক্তার: (চমকে) তার মানে?
প্রতীক: ওরে পুত্র, জল্লাদ আমার!
ডাক্তার: কার পুত্র? কে জল্লাদ?
প্রতীক: প্রত্যেক পিতার পুত্র, পিতার জল্লাদ
এক ছোকরা এই নিয়ে লিখেছে কবিতা।
দিনে দিনে বাড়ে কালকেতু, আর দিনে দিনে বড় হয় ছেলে
আর তুমি, তার পিতা ততই মৃত্যুর দিকে যাও তুমি হেলে!
ডাক্তার: এক্ষেত্রে আমিই বুঝি পুত্ৰহন্তা, সেই বুঝি ভালো…
মাত্র নবছর, এর মধ্যে মৃত্যু শিয়রে দাঁড়াল।
একি প্রতিশোধ?
আমি বহুবার বহু বাড়ি থেকে
মৃত্যুকে ফেরাই
মরণের সঙ্গে হয় পাশাখেলা
আমি জিতে যাই
তাই মৃত্যু এবার কি জাল ফেলে ছেঁকে
আমারই সংসারে দেবে থাবা?
সংবরণ: কী রকম আছে বাবলু?
যখন ঘুমন্ত থাকে, ভালো থাকে,
হাসে, কথা বলে,
সত্যিই ঘুমের মধ্যে হাসে কথা বলে। যখনই সে জেগে ওঠে,
অসহ্য যন্ত্রণা,
যেন কাকে দ্যাখে
ক্যাবিনের বাইরে, কেউ নেই তবু দ্যাখে
সংবরণ: কী ঠিক অসুখ ওর?
ডাক্তার: নেটিক সিন্ড্রম। তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে না,
দুটি কিডনিতেই ওর অজানা অসুখ
সংবরণ: অজানা অসুখ?
ডাক্তার: আশ্চর্য হলে কি? শুধু মন নয়,
মনুষ্য শরীরে
এখনও অচেনা কিছু রয়ে গেছে
প্রতীক: বিশ্বাস করি না! তুমি চিকিৎসা ছেড়ে মন্ত্রট নাও
সংবরণ: কিডনির অসুখ? আজকাল প্রায়ই শুনি
মাদ্রাজে ভেলোরে,
চমৎকার সেরে যায় সব…
প্রতীক: আরও একটু সরে
হোয়াইট ফিল্ড গ্রামে যাও, সাধু সন্ন্যাসীর দেওয়া ছাই ভস্ম,
হাওয়া থেকে ফুল…
ডাক্তার: ও সমস্ত কথা থাক, এসো খাই
সংবরণ: ঋষি, তুমি বড়ই অস্থির হয়ে আছো ভাই
ডাক্তার: হয়তো বাঁচানো যায়, আজ থেকে মাস দেড়েক আগে
ডাক্তার লোম্যান নামে একজন সেন্ট পিটার্সবার্গে
পরীক্ষা চালিয়েছেন বাঁধা-মৃত্যু দশ জন রোগীর শরীরে
নতুন ওষুধ কিংবা বিষ-ফল, ঠিক যেন মেঘ চিরে
হঠাৎ বিদ্যুৎ কিংবা বজ্রপাত কিংবা আশীর্বাদ,
শুভ কিংবা অশুভ সংবাদ…
পাঁচ জন বেঁচে গেছে, পাঁচটি বাঁচেনি!
সংবরণ: পাঁচ জন বেঁচে গেছে, পাঁচটি বাঁচেনি?
এ যে সাংঘাতিক
একি সার্থকতা নাকি ব্যর্থতারই আর এক দিক
ডাক্তার: যাক আর ও কথা নয়। ভুলে থাকতে চাই।
ফুর্তি হোক। শালা মরণের মুখে ছাই
দাও, তুড়ি মারো, এই তো এসেছে, সব গ্লাসে ঢালো
কে ওখানে?
কে ওখানে?
[ঝনঝন করে গেলাস ভাঙার শব্দ ও জলতরঙ্গ বাজতে থাকে।]
প্রতীক: কেউ নেই, কাছাকাছি আর কেউ নেই
সংবরণ: আমরা তো কিছুই দেখছি না
একসঙ্গে
ডাক্তার: আমিই কি শুধু দেখি? মনে হয় যেন খুব চেনা
একটি নারীর কণ্ঠস্বর: ঋষি, ঋষি
ডাক্তার: কে তুমি? তুমি কে?
প্রতীক: ঋষি, তুই এত চ্যাঁচাচ্ছিস কাকে দেখে?
নারীকণ্ঠ: ঋষি ঋষি
ডাক্তার: কে তুমি? দেখাও মুখ, এসো, কাছে এসো
নারীকণ্ঠ: আমি তো রয়েছি ঠিক তোমারই সম্মুখে
ডাক্তার: কুয়াশায় ঢাকা কেন, কায়া নেই বুঝি?
শুধু যেন ছায়া
নারীকণ্ঠ: চোখের কুয়াশা! ঋষি, এসো একবার
তুমি আর আমি শুধু মুখোমুখি বসি
দু’জনে মনের কথা এক মনে বলি
ডাক্তার: তোমাকে চিনি না, তবু দু’জনে মনের কথা হবে বলাবলি?
তুমি কোনও পাগলিনী বুঝি?
পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছ?
প্রতীক: আমাদের বন্ধুটি যে একা একা কথা বলছে
হঠাৎ পাগল হল নাকি।
সংবরণ: ঋষি, তোর কী হল, কী হল?
ডাক্তার: তোরা আয় তো মেয়েটাকে ধরি
নারীকণ্ঠ: না, না, ঋষি, আমাকে ছুঁয়ো না তুমি, না, না ছুঁতে নেই।
(দু-তিন বার এই কথা বলতে বলতে কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায়)
.
দ্বিতীয় দৃশ্য
[হাসপাতাল, ক্যাবিনের মধ্যে খাটে ঘুমিয়ে আছে বাবলু, ন-দশ বছর বয়েস। তাকে ঘিরে চার-পাঁচ জন ডাক্তার। সকলের মুখ মেঘলা, ঋষি তার অধ্যাপক এক প্রবীণ ডাক্তারকে শেষবার অনুরোধ করলেন।]
ঋষি: স্যার, নতুন ওষুধ এইমাত্র আমি নিজে দেখে
সব ঝুঁকি নিয়ে, সব ভেবে চিন্তে ভরেছি সিরিঞ্জে
আপনি দিন
স্যার: ঋষি, তুমি ক্ষমা করো, আমাকে বোলো না
বুড়ো হয়ে গেছি, আজকাল হাত কাঁপে
ঋষি: স্যার, কে না জানে আজও কলকাতা কিংবা সারাদেশে
আপনার তুল্য চিকিৎসক বেশি নেই
স্যার: তবু তুমি ক্ষমা করো এই বৃদ্ধটিকে!
যে ওষুধ পরীক্ষিত নয়, তা আমি কী করে জেনেশুনে
দিই?
তোমার সন্তান সে যে আমারও অনেক আদরের
ওকে আমি কী করে অজানা পথে নিয়ে যাব, বলো?
ঋষি: (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে) ডক্টর লাহিড়ী, আমি
আপনাকে যদি
লাহিড়ী: না, না, ঋষি, ক্ষমা করো
ঋষি: ডক্টর সামন্ত? আপনিও ভয় পেয়ে
সামন্ত: ভয় নয়, ঋষি, এ যে অর্ধেক হত্যার
ঝুঁকি নেওয়া
ঋষি: অর্ধেক জীবন? তার ঝুঁকি নেওয়া যায় না বুঝি?
ঠিক আছেতা। হলে আমিই নিজে পুত্রঘাতী হব,
নিজ হাতে এই বিষ আমি ওর শরীরে মেশাব।
আপনারা সবাই বাইরে যান তবে
[ঘর খালি। ঋষি ছেলেকে ডাকলেন]
ঋষি: বাবলু, বাবলু, ঘুম থেকে উঠে আয়,
আমরা দু’জনে ফের ভোরবেলা বাগানে বেড়াব
বাবলু: বাবা
ঋষি: বাবলু, বাবলু
বাবলু: বাবা, তুমি কত দূরে আছো?
ঋষি: এই তো এখানে আমি, শিয়রের কাছে
বাবলু: ভীষণ যন্ত্রণা! বাবা, তুমি হাত ধরে নিয়ে যাও,
আমাকে অনেক দূরে এমন কোথাও
যেখানে একটুও ব্যথা নেই—
ঋষি: এই দ্যাখ, আমার ডান হাতে ছুরি, আমি
চোখের নিমেষে
তোকে নিয়ে যাব সব যন্ত্রণার শেষে
এক শান্ত অন্য দেশে
বাবলু: খুলতে পারি না চোখ, এত ব্যথা,
কেন এত ব্যথা?
ঋষি: চোখ যে খুলতেই হবে, অন্ধকারে কী করে না দেখে
যাবি সেই অন্য দেশে?
বাবলু: ছুরি কই? এ যে ইঞ্জেকশান!
ঋষি: বাবলু, বাবলু, শোন,
খুব মন দিয়ে তুই শোন,
সিরিঞ্জে ভরেছি আমি নতুন ওষুধ কিংবা বিষ
হয়তো উঠবি বেঁচে, কিংবা চলে যাবি পরপারে
যদি পরপার বলে কিছু থাকে,
সেখানে আমাকে দোষ দিস,
ভেবে নিস, বাবা তোকে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায়
পাঠিয়েছে সেইখানে। আর যদি কোনও ক্রমে বেঁচে
উঠিস তা হলে সেটা তোরই নিজের জয়
বাবলু: বাবা, তুমি সব যন্ত্রণার শেষ করে দাও
ঋষি: দেব, তাই দেব, তোর মা আমাকে মাথার দিব্যিতে
নিষেধ করেছে, বুঝি কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যাবে।
আত্মীয় বন্ধুরা, চিকিৎসক, কেউ রাজি নয়
তুই রাজি? তুই ছেলেবেলা থেকে দারুণ সাহসী
বাবলু: আমি রাজি। আমাকে ওষুধ দাও, কিংবা বিষ
ঋষি: তাই হোক। চোখ চেয়ে থাক
[মৃত্যুর প্রবেশ। মহাভারতের বর্ণনার মতন অনেকটা তার রূপ৷ সে একটি নারী। সর্বাঙ্গে কালো পোশাক। নতুন তামার বাসনের মতন গাত্রবর্ণ। পিঠের ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ আঙুর ফলের মতন কোঁকড়ানো চুল। তার চোখে জল।]
মৃত্যু: একটু দাঁড়াও ঋষি। কথা আছে
ঋষি: কে তুমি?
মৃত্যু: চেয়ে দেখো। খুব কি অচেনা লাগে? বহুবার
দেখা
হয়েছে তোমার সঙ্গে
ঋষি: তুমি সেই? খরা মাঠে বিমানের ছায়ার মতন
চকিতে মিলিয়ে যাও
মৃত্যু: বারবার ফিরে আসি
ঋষি: আমাকে না দেখে বুঝি মন কাঁদে? এমন প্রণয়?
আপাতত বাইরে যাও
মৃত্যু: আমি এই শিশুটির অনন্তকালের ধাত্রী
আমি তমসার মধ্য দিয়ে ওর হাত ধরে
নিয়ে যাব
ঋষি: তুমি এই ছেলেটিকে জননীর কোল থেকে ছিঁড়ে
নিয়ে যেতে চাও
মৃত্যু: আমি এই শিশুটিকে কালের সীমানা ভেঙে শুধু
অসীমে পাঠাব
ঋষি: ওর মা’র স্নেহ, আর আমার বুকের ভালোবাসা
তাও কি অসীম নয়? পৃথিবীর এই মায়াপাশ
যদি ছিন্ন করো বারবার, তবে কেন তা বেছাও?
মৃত্যু: ঋষি, তুমি দেখেছ অনেক মৃত্যু, শুভ ও অশুভ
তবু কেন অস্থিরতা? সব মিথ্যে, আমি শুধু ধ্রুব
ঋষি: তুমি অহংকারী, তবু তোমার দু’চোখে
কেন জল? তোমার কি চক্ষুরোগ?
মৃত্যু: আমার হৃদয় নেই, তবু আমি দুঃখী।
আমি একা।
আমার আকাঙ্ক্ষা নেই, তবু আমি নিত্য ভ্রাম্যমাণা,
অনধিকারিণী আমি, অথচ আমিই হাত পাতি
বাবলু: বাবা, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?
ঋষি: কেউ না, বাবলু সোনা! নিছক মনের ভুল,
ছায়া।
বাবলু: বাবা, তুমি সব ব্যথা শেষ করে দাও
ঋষি: এই তো এক্ষুনি দিচ্ছি, দেখি ডান হাত
মৃত্যু: ঋষি, থামো
ঋষি: আঃ, বিরক্ত কোরো না, যাও!
মৃত্যু: ঋষি, তুমি হেরে যাবে
ঋষি: যাই যাব। তবু আমি কোনও দিন না লড়ে
ছাড়িনি
তুমি নয়, মৃত্যু নয়, জীবনের কাছে আমি ঋণী!
তুমি নারী, তুমি সরো, যমরূপী পুরুষ পাঠাও
যার সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়, তুমি যাও!
মৃত্যু: শোনো ঋষি, কেন এই চঞ্চলতা, এখনও দুমাস
দিতে পারি ওর আয়ু, এখনও রয়েছে ওর শ্বাস
কেন তা থামাবে তুমি? এই পৃথিবীর রূপ রস
আরও কিছুদিন ওর প্রাপ্য, ওর নবীন বয়স
দ্বিগুণ শক্তিতে সব নিতে পারে, ততটুকু নিক
আমি ওকে স্নেহ দিয়ে ঘিরে রাখব জননী অধিক!
ঋষি: কে চায় তোমার কৃপা? আমি আছি প্রাণের প্রহরী।
শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে লড়ে যাই, মুষ্টি মধ্যে ভ্রমরকে ধরি।
এই যে তরল বিষ, এর মধ্যে অর্ধেক জীবন,
অথবা অর্ধেক মৃত্যু, দেখি আমি এর মধ্যে
কোন অর্ধাংশটি জিতে যায়, আমি আছি জীবনের দিকে
—তোমার সন্তান নেই, রাক্ষসিনী, তাই তুমি এই শিশুটিকে
নিয়ে জয়ী হতে চাও?
রাক্ষসিনী, রাক্ষসিনী!
মৃত্যু: ঋষি, শান্ত হও
বাবলু: বাবা, বড় ব্যথা, তুমি ব্যথা শেষ করে দাও
ঋষি: দেব রে, বাবলু সোনা, দেখি ডান হাত
মৃত্যু: ঋষি, শোনো
ঋষি: চুপ!
[ঋষি ইঞ্জেকশানের সুচ ছুরির ভঙ্গিতে ঢুকিয়ে দিলেন বাবলুর হাতে। বাবলু দু’বার বাবা বলে ডেকেই থেমে গেল হঠাৎ। তার গলায় সেতারের তার ছেঁড়ার মতন শেষ শব্দ হল। ঋষি সে দিকে একটুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে সিরিঞ্জটা ছুড়ে ফেলে দিলেন।]
মৃত্যু: ঋষি, তুমি হেরে গেলে
ঋষি: (শান্ত ভাবে) জানি। ওর ব্যথা শেষ হয়ে
গেছে
মৃত্যু: আগেই বলেছি হেরে যাবে
ঋষি: খেলতে এসেছি তাই আমি জানি খেলার নিয়ম,
হারজিত আছে। শুধু তুমি আর তোমাদের যম
কখনও হারো না, শুধু জয় নিয়ে দারুণ উল্লাস।
এবার তো সুখী হলে? নিয়ে যাও শিশুটির লাশ।
আমার প্রাণের টুকরো এই শিশু
মৃত্যু: সুখী নই, সুখী নই
যতবার জিতে যাই, ততবার মনে মনে হারি
অনন্ত কালের মধ্যে
আমি এক সুখশূন্য নারী।
এই হাত দুঃখ দিয়ে গড়া, চোখ দুঃখের সমাধি
এসো ঋষি, তুমি আমি দু’জনেই একসঙ্গে কাঁদি।
ঋষি: তোমার চোখের জল, প্রতিটি বিন্দুই মৃত্যু বিষ
তুমি যাও, আমার সন্তানটিকে নিয়ে যাও
কিন্তু আমি হেরে যাইনি, এর পরও প্রতি অহর্নিশ
লড়ে যাবে
আমার বাবলুর মতো আরও শত সহস্রকে নিশ্চিত বাঁচাব
কখনও তোমার সঙ্গে আমার লড়াই থামবে না
মৃত্যু: তোমার প্রতিদ্বন্দিনী নই আমি, আমি আসি কালের
নিয়মে সমস্ত সংগীত এসে থামে এক সমে
গাছের পাতারা ঝরে যায়
সকালের ফুলগুলি সন্ধেবেলা সুষমা হারায়
ঋষি: এই সব ছেঁদো কথা, বস্তা পচা সান্ত্বনার ভাষা
শুনলে মাথায় রক্ত জ্বলে ওঠে, যাও, যাও
নাকি আমাকেও সঙ্গে নিতে চাও?
দেব গলা টিপে?
মৃত্যু: ছুঁয়ো না, আমাকে ছুঁতে নেই
বিশুদ্ধ কুমারী আমি, কোনও জীবিতের স্পর্শ
এই ভাগ্যে নেই
আমার একমাত্র সুখ পরাজয়ে
[হঠাৎ যেন বাবলু ঘুম থেকে জেগে উঠে বাবা, বাবা বলে ডাকে]
ঋষি: বাবলু, বাবলু, তুই ফিরে এসেছিস?
বাবলু: বাবা, সব ব্যথা সেরে গেছে।
ঋষি: আঃ আঃ, এ কী স্বপ্ন, নাকি সত্যি?
ঋষি, তুমি বীর যোদ্ধা, হাতে তলোয়ার
গর্ব দৃপ্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ, এই দৃশ্যে
কী যে সুখ, কত সুখ হল যে আমার…
ঋষি: অর্ধেক মৃত্যুর ঝুঁকি, অর্ধেক জীবন
আমি জীবনের দিকে, আমি জেদি জীবনের দিকে!
.
এর পর ঋষি ও মৃত্যু দু’জনে বাবলুর দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসে। দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
[এই কাব্যনাটকটি কেউ অভিনয় করতে চাইলে আগে লেখকের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। অভিনয়ের সময় লাইনগুলি কবিতার মতন নয়, গদ্যের মতন স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারণ করা যেতে পারে।]