প্রাচ্য বিদ্যাবিশারদ
সঠিক বাঙলা অনুবাদ করা হল কি না তাই নিয়ে অনেকেরই মনে ন্যায্য সন্দেহ হতে পারে। ইংরেজিতে একে বলে অল ইনডিয়া অরিনটাল কনফারেন্স। আমার এতদিন বিশ্বাস ছিল এর নাম অল ইনডিয়া অরিএনটালিসটস কনফারেন্স দুটো নামই আমার কাছে কেমন যেন সামান্য বেখাপ্পা ঠেকে। অল ইনডিয়াই যদি হবে তবে তার সঙ্গে অরিএনটাল জোড়া যায় কী প্রকারে পক্ষান্তরে দ্বিতীয় নাম অল ইনডিয়া অরিএনটালিসটসও কেমন যেন মনে সাড়া জাগায় না। অরিএনটালিসট বলতে বোঝায়, অরিএনট সম্বন্ধে যিনি বিজ্ঞ পণ্ডিত। কিন্তু রূঢ়ার্থে বোঝায়, যেসব ইউরোপীয় পণ্ডিত অরিএনট নিয়ে চর্চা করেন। এই নিয়ে যখন আমি আমার এক দর্শনে সুপণ্ডিতা বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করছি তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, কেমন যেন ঠিক মনে হয় না। মাকসমলার অরিএনটালিসট আবার রাধাকৃষ্ণনও অরিএনটালিসট? আমার মনে হল, তার মনে ধোকা জেগেছে, দু জনার মাহাত্ম কি একই? রাধাকৃষ্ণন তার আপন দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানদর্শনের চর্চা করছেন, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে সাত সমুদ্রের ওপারের মাকসমুলার ভারতের জ্ঞানবিজ্ঞানদর্শনের চর্চা করলেন– এ দু জনাতে তো একটা পার্থক্য আছে। তুলনা দিয়ে বলি, আপনি ভারতীয়, তাই আপনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেন। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সাতসমুদ্রের ওপারের পুণ্যশ্লোকা এ্যানি বেসানত, দীনবন্ধু এ্যানড্রজ যখন এ-আন্দোলনে যোগ দিলেন, সে দুটো কি একই?
যদ্যপি জর্মন ভাষা কাঠখোট্টা তবু প্রাচী = অরিএনট এবং প্রতীচী = অকসিডেনট নিয়ে কথা বলতে গেলে ওরা ওই দু ভূখণ্ডের জন্য দুটি বড়ই সুন্দর নাম দেয়। এই প্রাচ্যভূমিকে বলে মরগেন লানট = ভোরের দেশ সূর্যোদয়ের দেশ–জর্মন ভাষায় মরগেন শব্দের অর্থ সকাল ভোর। তাই তারা সকালবেলা কারও সঙ্গে দেখা হলে বলে গুটেন মরগেন। = গুড মরনিং। পক্ষান্তরে তাদের নিজের দেশ তথা ইউরোপকে বলে আবেনট লানট অর্থাৎ সূর্যাস্তের দেশ। তাই বিকেলবেলা সন্ধেবেলা, এমনকি রাত্রেও দেখা হলে বলে গুটেন আবেনট।
খুব সম্ভব এই কারণেই ভারতবর্ষের প্রতি জর্মন পণ্ডিতদের একটা বিনয় ভাব-শ্রদ্ধা আছে। ইংরেজি-ফরাসি-ডাচদের সে শ্রদ্ধা নেই। কারণ তারা প্রাচ্যভূমি এশিয়াতে রাজত্ব করত। তাই এনারা যখন ইউরোপের কোনও অরিএনটালিসটস কনফারএনসে যান তখন কেমন যেন মুরুব্বিয়ানা করেন। ভাবটা এই, তারা যে ভারতের ব্যাপারে ইনটরেসট দেখাচ্ছেন সেটা যেন, অনেকটা মুনিব তার চাকরের বউবাচ্চার সম্বন্ধে পলাইট বাট ডিসটেনট খবর নিচ্ছেন (পাছে না দু টাকা খসাতে হয়)।
এই মুরুব্বিয়ানাটা আমাকে ঈষৎ পীড়িত করে। হপ্তা তিনেক পরে পূর্বে আমি বলেছিলাম আমি অত সহজে অপমানিত হই না। ইতোমধ্যে খান আবদুল গফফার বাদশাহ মিঞা বলেছেন, ভারত যে রাবাতে গিয়েছিল সেটা অনুচিত হয়নি। কিন্তু পত্রান্তরে জনৈক সম্পাদক অতিশয় দ্র ভাষায় সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, কিন্তু সকলেই এ মত পোষণ না-ও করতে পারেন (নট এভরিবডি শেয়ারজ ইট) এবং এই আনন্দবাজারেই জনৈক পত্রলেখক আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আপত্তি জানান। ধর্ম সাক্ষী করে বলছি, এঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনও ফরিয়াদ নেই। কে কোন আচরণে অপমানিত হবেন না হবেন সেটা তার স্পর্শকাতরতার ওপর নির্ভর করে। এরা স্পর্শকাতর। কিন্তু আমার গায়ে গণ্ডারের চামড়া। মরক্কো লেদার তার তুলনায় ধূলিপরিমাণ লস্যি লস্যি।
মূল বক্তব্যে ফিরে আসি।
ইউরোপীয়রা বিশেষ করে ইংরেজ-ফরাসি-ডাচ যদি আমাদের প্রতি মেহেরবানি দেখায় তবে আমরাই-বা তাদের প্রতি মেহেরবানি দেখাব না কেন?
অতএব আমি প্রস্তাব করি এই ভারতবর্ষে যেন অকসিডেনটালিসট কনফারেন্স নির্মিত হয়। ইউরোপের ইংরেজ ফরাসি ডাচ অরিএনটালিসটরা যেরকম আমাদের সতীদাহ, বহুবিবাহ নিয়ে আলোচনা করেন, আমরা ওই কনফারেনসে সাহেবদের কল গার্ল, কিলার প্রফুমো ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু বিপদ এই : আমাদের ভারতীয় সভ্যতা যায় নিদেন খ্রি.পূ. দু হাজার বছর পূর্বে। ইউরোপীয়দের সত্যতা মেরে কেটে ছ-শো বছর পূর্বে। যতই প্রাচীন সভ্যতা হয়, তত তাকেই আঘাত করা যায় বেশি। বুড়ো-ঠাকুরদাকে গাট্টা মারা খুবই সহজ।
এই প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার জন্য আমি সুপণ্ডিত শ্রীযুক্ত নীরদ সি চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করি। ইউরোপীয় কাণ্ডকারখানা উনি বিলক্ষণ বিচক্ষণরূপে জানেন। তদুপরি তিনি সংস্কৃত ভাষা এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে উত্তমরূপে সুপরিচিত। সেয়ানা পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, তিনি সপ্তাহের পর সপ্তাহ শুধুমাত্র ইউরোপীয় গুণীজ্ঞানীরই উদ্ধৃতি দেন।