প্রাচীর প্রহরী
‘পুব দিকের সীমানা-পাঁচিলের তলায় কয়েকটা কঙ্কাল পাওয়া গেছে।’ মি শর্মা বললেন, ‘আশ্চর্য কাণ্ড, এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ওই পাঁচিলটাই শুধু খাড়া আছে।’
‘শোনেননি,’ মি কাপুর একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আগে এমন একটা বিশ্বাস ছিল যে, মৃত মানুষের দেহ মাটির তলায় পুঁতে তার ওপর ভিত গড়লে সে-বাড়ি সহজে ভেঙে পড়ে না।’
‘বোগাস।’ মি সোন্ধি গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই বিংশ শতাব্দীতে এসব কেউ বিশ্বাস করে!’
‘আমি কিন্তু শুনেছি,’ মি যোশী মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘মৃতের প্রেতাত্মা নাকি ধ্বংসের হাত থেকে ইমারত রক্ষা করে। বড়ো বড়ো প্রাসাদ কিংবা সেতু তৈরির আগে মাত্র একশো দেড়শো বছর আগেও মানুষ খুন করা হত। তাদের সমাধির ওপর গড়ে উঠত সুরম্য প্রাসাদ।’
‘অত পেছনে যাবার দরকার নেই।’ মি দাশগুপ্ত মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার জীবনেই এমন একটা ব্যাপার ঘটেছিল, যার ব্যাখ্যা আজও আমি খুঁজে পাইনি।’
সবাই মি দাশগুপ্তের কাহিনি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।
নির্জন প্রান্তরে তাঁবু খাঁটিয়ে ওঁরা অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছেন। সবাই ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মী। এ জায়গাটা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। গভীর জঙ্গলে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিরাট এক ভগ্নস্তূপ। তাই মাটি খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, আর সেইসূত্রেই পাওয়া গেছে কয়েকটা কঙ্কাল।
এখানে ওখানে আগুন জ্বলছে। ঠান্ডা পড়েছে, তাই আগুনের পাশে ভিড় করেছে কুলি-মজুরের দল। হরিণের মাংস রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। পুরু অথচ নরম আর গরম রুটির সঙ্গে মাংস এই ঠান্ডায় ভালোই লাগবে।
‘তখনও আমি সরকারি চাকরিতে ঢুকিনি।’ মি দাশগুপ্ত তাঁর কাহিনি শুরু করলেন। ‘সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়ে একটা আর্কিটেকচারাল কনসার্নে ঢুকেছি। কোম্পানি একটা কাজে পাঞ্জাবে এক জায়গায় যাবার নির্দেশ দিল আমাকে। কাজটা আর কিছুই নয়, ওখানে এক প্রাচীন জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে একটা নকশা বানাতে হবে আমাকে। প্রাচীনকালের অনেক ঐতিহাসিক, অ-ঐতিহাসিক বাড়ির কারুকার্য কিংবা পুরোনো স্থাপত্য বর্তমান স্থপতিশিল্পে আমরা আমদানি করেছি, একথা আপনারা সবাই জানেন।
‘যথাসময়ে আমি সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। জায়গাটা আধা গ্রাম, আধা শহর। ধ্বংসস্তূপটা দেখে কিন্তু আমি অবাক হলাম। শুনেছিলাম ওটার বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি, কিন্তু ভেঙে পড়লেও কিছু দেয়াল আর খিলান তখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা হয়তো একসময় চারপাশে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা ছিল। এখন শুধু পেছন দিকের পাঁচিলটা জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনোমতে খাড়া রয়েছে। পাঁচিলের পাশ দিয়েই চলে গেছে একটা নদী। ভাঙা ইট-পাথরের স্তূপের ভেতর মাঝে মাঝে কিছু জায়গা সমান। আর যা চোখে পড়ে, তা হল আধখানা সিঁড়ি, এখানে ওখানে পাথরের দেয়াল ভাঙা কার্নিশ, মুখ থুবড়ে পড়া ছাদ, আরও অনেক কিছু।
‘বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা; ভগ্নস্তূপের চারপাশে ঘাসবনে ভরা জমি। আমার স্কেচ করতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না, বরং বেশ আনন্দই পাচ্ছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো, এক গৃহস্থ পরিবারে একটা ঘর ভাড়া পেয়েছিলাম। পরিবারের কর্তা একজন শিখ ভদ্রলোক, বহুদিন কলকাতায় ছিলেন, তাই আমাকে বেশ আদরযত্ন করেছিলেন। আমার কাজেও তাঁর খুব আগ্রহ লক্ষ করে আমি খুশিই হচ্ছিলাম। প্রত্যেক দিন সন্ধের কিছু আগে মিস্টার সিং ওই ভগ্নস্তূপের কাছে এসে আমাকে ডাক দিতেন, তারপর গল্প করতে করতে আমরা বাড়ির দিকে হাঁটা দিতাম। ভগ্নস্তূপটা ছিল লোকালয়ের একটু বাইরে, মিস্টার সিং-এর বাড়ি থেকে হাঁটাপথে প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট। ফেরার পথে প্রাচীন বাড়িটার স্থাপত্যশিল্প সম্বন্ধে আমি তাঁকে বলতাম। তিনি চুপ করে আমার কথা শুনতেন, উচ্ছাসের বাধা দিতেন না।
‘মিস্টার সিং যে রোজ বিকেলে আমার কাছে এসে হাজির হতেন এবং ফেরার পথে আমাকে সঙ্গ দিতেন, তার জন্য তখন তাঁর প্রতি আমার মনের ভাব প্রসন্ন হলেও পরে বুঝেছিলাম কেন তিনি সন্ধেবেলা ওখানে একা আমাকে থাকতে দিতেন না। আমি যেদিন ওখান থেকে চলে আসব, তার আগের রাতে আমি ঠিক করলাম শেষবারের মতো ভগ্নস্তূপের কাছে যাব। কারণ অবশ্য ছিল। আমার নকশা শেষ, শুধু তোরণটার কাঠামোর কিছু খুঁটিনাটি কাজ বাকি। ভাবলাম, চাঁদনি রাত আছে, তেমন অসুবিধে হবে না, খাওয়া-দাওয়া সেরে ওখানে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলব। কতক্ষণ আর লাগবে, বড়োজোর আধ ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। চাঁদনি রাতে এইসব প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ অন্য রূপ নেয়, সেটাও আমার কাছে কম লোভনীয় নয়।
‘রাতের খাওয়া সেরে মিস্টার সিংকে আমি আমার উদ্দেশ্য জানালাম। তিনি কিন্তু আমার কথা শুনে যেন আঁতকে উঠলেন, বললেন, ‘কী সর্বনাশ! আপনি এই রাত্তিরে ওখানে যাবেন!’
‘কেন, রাত্তির তো কী হয়েছে!’ আমি বেশ অবাক হয়েই জবাব দিলাম, ‘ওখানে তো আর বাঘ, ভালুকের ভয় নেই।’
‘সন্ধের পর আপনার ওখানে যাওয়া চলতে পারে না।’ বেশ একটু উঁচু গলায় তিনি বললেন, ‘পাগল ছাড়া কেউ অমন কাজ করবে না।’
‘কেন!’ আমি অনেকটা বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করলাম। ভদ্রলোকের আচরণে আমি যেন হতবাক হয়ে গেছি।
‘কারণ আপনি আর ফিরে আসতে পারবেন না, নদীর ধারের দেয়ালটা আপনাকে আটকে দেবে।’
আমি তাঁর মুখের দিকে স্তম্ভিতের মতো তাকালাম। ‘দেয়ালটা আমাকে আটকে দেবে।’ কোনোমতে আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, তাই।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন দীর্ঘদেহী, বৃদ্ধ মিস্টার সিং। ‘রোজ সন্ধের আগে আমি কি এমনি এমনি আপনার ওখানে যেতাম বলে আপনি মনে করেছেন! যাতে আপনি সন্ধের পর ওখানে না থাকেন, তাই যেতাম। আপনি এখানে বিদেশি, আমাদের অতিথি, আপনার ভালো-মন্দ দেখা আমার উচিত মনে করেই আমি ও কাজ করেছি।’
‘কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, মিস্টার সিং!’ আমি একটু ধাতস্থ হয়ে বললাম, ‘দয়া করে আমাকে ব্যাপারটা খুলে বলবেন?’
‘প্রীতম সিং আর তার ছেলেদের প্রেতাত্মা ওখানে ঘুরে বেড়ায়।’
‘তারপরই মিস্টার সিং আমাকে অবিশ্বাস্য এক কাহিনি শোনালেন। অতীতে ওই অঞ্চলে দুটি বর্ধিষু পরিবার বাস করত। প্রীতম সিং আর তার জ্ঞাতি ভাই মাখন সিং। জ্ঞাতি হলে কী হবে, দুই পরিবারের মধ্যে অনেকদিন ধরে মনোমালিন্য চলছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন চূড়ান্ত পরিণতি নিল তাদের বিরোধ। বিরোধটা বেধেছিল এখন যেখানে ভগ্নস্তূপ সেই জমি নিয়ে। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একরাতে দু-দলের মধ্যে সংঘর্ষ হল। প্রীতম সিং আর তার দুই ছেলে মারা গেল সেই সংঘর্ষে। মাখন সিং তাদের মৃতদেহ ওই জমিতে পুঁতে তার ওপর বাড়ি তৈরি শুরু করল। বিরাট বাড়ি। ভারতবর্ষের নানা জায়গা থেকে মালমশলা আর কারিগর জোগাড় করে চমৎকার একটা ইমারত গড়ে তুলল মাখন সিং।
‘প্রীতম সিং আর তার ছেলেদের যেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তার ওপরেই শোনা যায়, নদীর দিকের পাঁচিলটা উঠেছিল। ইমারত ভেঙে পড়েছে, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, পেছন দিকের পাঁচিলটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অন্য তিন দিকের পাঁচিলের চিহ্ন নেই, শুধু ওটাই কালের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। শোনা যায় প্রীতম সিং আর তার দুই ছেলের প্রেতাত্মা রক্ষা করছে ওই পাঁচিলকে।’
‘আপনার কথা না হয় মানলাম,’ আমি এবার একটু ঠাট্টা করে বললাম, ‘কিন্তু রাতে ওখানে গেলে বিপদ আছে বলছেন কেন? প্রেতাত্মারা যদি পাঁচিলটাকে রক্ষাই করে, তবে ওটা যে আমার ওপর ভেঙে পড়বে, এমন সম্ভাবনা নিশ্চয়ই নেই।’
‘আপনি পরিহাস করছেন?’ মি সিং-এর দু-চোখ যেন জ্বলে উঠল, ‘আমার কাছে শুনুন, রাত্তিরে যারা ওখানে গেছে, তাদের কেউ ফিরে আসেনি। প্রীতম সিং আর তার ছেলেদের প্রেতাত্মা শুধু পাঁচিলটা রক্ষাই করছে না, সুযোগমতো অন্যদেরও ওই দায়িত্বের অংশীদার করে নিচ্ছে।’
‘অর্থাৎ রাত্তিরে যারা ওখানে যায়, তারা ওখানে থাকতে বাধ্য হয়?’
‘আমার গলায় ব্যঙ্গের সুর ছিল। মিস্টার সিং-এর দীর্ঘ শরীর যেন হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন, ”আমার বাপ, ঠাকুরদা ঘটনা জানতেন। আমার বাবার মুখেই আমি দু-জনের কথা শুনেছি, যারা ওখান থেকে ফেরেনি। তাদের মধ্যে একজন ছিল রাখাল। হারানো গোরুর খোঁজে ওখানে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন এসেছিল আপনাদেরই মুলুক থেকে। আপনার মতোই সে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। ভূতপ্রেতে তার বিশ্বাস ছিল না।”
‘মিস্টার সিং এরপর আর আমার সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করলেন না, নিজের কাজে চলে গেলেন। তবে তাঁর কথা আমি অবিশ্বাস করছি, তার জন্য তিনি মনে মনে আহত হয়েছেন, তা বুঝতে আমার বাকি রইল না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তাঁর গল্পের এক বর্ণও বিশ্বাস করিনি। তবু ওখানে যাবার আগে আমার মনে মুহূর্তের দ্বিধা এল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক করলাম। বিশেষ করে তোরণটার নকশা আমার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, ওটা সম্পূর্ণ না করে ফেরা আমার উচিত নয়।
‘পকেটে টর্চ আর জিনিসপত্তর নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। সত্যি কথা বলতে কী, আমার গা একটু ছমছমই করছিল। হয়তো মিস্টার সিং ওই কাহিনি না শোনালে আমার মনে কোনো প্রতিক্রিয়াই হত না। নির্জন পথ দিয়ে যেতে যেতে সামান্য শব্দে আমি চমকে উঠেছিলাম। ভগ্নস্তূপের যখন খানিকটা দূরে তখন আমি থমকে দাঁড়ালাম, একবার ভাবলাম ফিরে যাই। কিন্তু মিস্টার সিং-এর মুখে যে হাসি ফুটে উঠবে, তা মনে করে আমি সাহসে বুক বাঁধলাম। আমি শুধু তোরণটার কাছেই যাব না, নদীর ধারে পাঁচিলটার কাছে গিয়ে প্রীতম সিংদের প্রেতাত্মাকে বিদায় জানিয়ে আসব।
‘মনে সাহস ফিরে আসায় আমি এগিয়ে গেলাম। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় ভগ্নস্তূপটা প্রেতের মতো দেখাচ্ছে। টর্চের আলোয় আমি কাগজে চটপট টান শুরু করলাম। আমি যতক্ষণ ভেবেছিলাম, তার অনেক কম সময়ের মধ্যেই আমার কাজ হয়ে গেল। ততক্ষণে আমার ভয় একেবারে কেটে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে, টর্চ জ্বালিয়ে আমি তোরণের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। আমার লক্ষ্য অক্ষত ওই পাঁচিলটা।
‘বুঝতেই পারছেন, পাঁচিলের কাছে পৌঁছোতে আমাকে স্তূপীকৃত জঞ্জালের ওপর দিয়ে যেতে হচ্ছিল। পাঁচিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ওটার ওপর টর্চ ফেললাম, আর তখুনি আমার পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা নিভে গেল।
‘ভয় পাইনি, একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ফিরে দাঁড়িয়ে তোরণ লক্ষ করে ছুটব ভাবলাম, কিন্তু যেমন করেই হোক ভয়কে জয় করলাম। একটা পাঁচিলের ভয়ে পালিয়ে যাব! একথা ভাবতেই মনে সাহস ফিরে এল। চাঁদের আলো থাকলেও একটু একটু করে কুয়াশা জমতে শুরু করেছিল, তাই খুব ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না। দৌড়োতে গেলে ইতস্তত ছড়ানো ইট-পাথরে ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা ষোলো আনাই। শুধু তো ছড়ানোই নয়, ছোটো ছোটো স্তূপ হয়ে আছে সর্বত্র। পড়ে গেলে পা মচকে সারারাত ওখানে পড়ে থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেটা মোটেই সুখকর কল্পনা নয়।
‘টর্চটা কয়েকবার ঝাঁকিয়ে, হাতের তালুতে আস্তে আস্তে আঘাত করে আমি চেষ্টা করলাম ওটা জ্বালাতে। হয়তো কোনো যান্ত্রিক গোলযোগে ওটা নিভে গেছে, কিংবা ঠিক কনট্যাক্ট পাচ্ছে না। কিন্তু বার বার চেষ্টা সত্ত্বেও টর্চটা জ্বলল না, অথচ মাত্র ক-দিন আগেই আমি নতুন ব্যাটারি ভরেছি।
‘একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে আমি টর্চটা ওভারকোটের পকেটে পুরলাম। আমাকে এখন হামাগুড়ি দিয়ে তোরণের কাছে যেতে হবে, নইলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাব। হঠাৎ মনে পড়ল আমার পকেটে একটা দেশলাই আছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে-জায়গাটা কিন্তু বেশ অন্ধকার। উঁচু পাঁচিলের ছায়ায় অন্ধকার। আমি সাবধানে দেশলাই বার করে একটা কাঠি ঘষলাম, কিন্তু আগুন জ্বলল না। কাঠির যে দিকে বারুদ থাকে তার উলটো দিক ঘষেছি মনে করে আমি একবার আঙুল দিয়ে বারুদটা অনুভব করে ঠিকমতো কাঠিটা ধরলাম। কিন্তু এবারও জ্বলল না দেশলাইয়ের কাঠি। আমার বুক দমে গেল। খুব আশা করেছিলাম, দেশলাইয়ের আগুনের আলোতেই পথ করে আমি এগোব, কিন্তু এ কী ফ্যাসাদে পড়লাম। এটা বর্ষাকাল নয়, শীতের শুরু, সুতরাং স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ার জন্য দেশলাইয়ে ছাতা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃথা সে-চেষ্টা। এবার আমার হাত কাঁপতে লাগল। পাগলের মতো একটার পর একটা কাঠি আমি দেশলাইয়ের বাক্সের গায়ে ঘষতে লাগলাম আর হতাশায় ছুড়ে দিতে লাগলাম সামনের দিকে। শেষ কাঠিটা হাতে নিয়ে আমি মনে মনে ভগবানকে ডাকলাম, তারপর খুব সাবধানে ঘষলাম কাঠির বারুদের দিকটা। ফ্যাস করে একটা শব্দ হল, আগুন জ্বলল না।
‘দেশলাইটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। চারদিক শান্ত, টুঁ শব্দটি নেই। একটা অস্বাভাবিক ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতর ধুকধুকুনি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমি ঘামতে শুরু করেছি।’
মি দাশগুপ্ত একটু থামলেন। হিম পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তাঁবুর মধ্যে একটা বড়ো লোহার চুল্লিতে আগুন গনগন করছে বলে বেশ গরম হয়ে উঠেছে ভেতরটা— আরামদায়ক পরিবেশ। গরম কফি এল। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সবার মুখের দিকে চোখ বুলোলেন মি দাশগুপ্ত। উৎকণ্ঠ প্রত্যাশা ভরা কয়েকজোড়া চোখ। মৃদু হেসে পেয়ালাটা নামিয়ে রাখলেন তিনি।
‘একটা কথা আপনারা বিশ্বাস করুন,’ তিনি আবার শুরু করলেন, ‘ওই অবস্থার মধ্যে তখনও আমি নার্ভ হারাইনি। আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করলাম। তোরণের কাছে যে পৌঁছোতে পারব, সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। এবড়োখেবড়ো জঙ্গলের ওপর দিয়ে আমি চলেছি। বেশ অনেকটা যাবার পর ভাবলাম, পাঁচিল থেকে দূরে, তোরণের কাছাকাছি হয়তো এসে পড়েছি। মুখ তুলে তাকিয়েই আমি চমকে উঠলাম, আমার সামনে বাধার মতো দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলটা।
‘সঙ্গেসঙ্গে আমি পেছন ফিরে উলটোদিকে হামা দিতে লাগলাম। খানিক পরে অনুভব করলাম যেন একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পড়েছি। তার মানে পাঁচিল থেকে সরে এসেছি। ইট-পাথরের জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছে গেছি তোরণের কাছাকাছি। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে মুখ তুললাম আমি। কিন্তু এ কী। পাঁচিলটা এখানেও আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এতক্ষণে আমার মনের বাঁধ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। একটা ভয়ানক আতঙ্ক আমাকে যেন গ্রাস করতে চাইছে। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়োতে গেলে শক্ত ইট-পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাব, অবচেতন মনের এই আশঙ্কাটাই হয়তো ও কাজ থেকে নিবৃত্ত করল আমাকে। আমি তাড়া-খাওয়া জন্তুর মতো এদিক-ওদিক হামা দিয়ে এগোতে লাগলাম, লক্ষ্য ওই পাঁচিল থেকে দূরে সরে থাকা, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমার এগোবার চেষ্টা বাধা পেতে লাগল ওই পাঁচিলে। একটা পাঁচিলই যেন চারটে হয়ে আমাকে ঘিরে ধরেছে, আমার বেরোবার পথ নেই, সারাজীবন চার পাঁচিলে বন্দি হয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমাকে। সে যে কী ভয়াবহ মনের অবস্থা, তা আপনাদের বুঝিয়ে বলতে পারব না।
‘কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল, তা জানি না। সময়ের জ্ঞান আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রত্যেকবার পাঁচিলে বাধা পেয়ে হতাশায় আমার মন ভেঙে পড়ছিল, তারপর আবার নতুন উৎসাহে উলটোদিকে হামা দিয়ে পালাতে চাইছিলাম, কিন্তু ওটা যেন আমাকে পালাতে দেবে না বলেই আমার সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।’
মি দাশগুপ্ত একটানা কথা বলার পর বোধ হয় একটু দম নেবার জন্য থামলেন। একটা উৎকট নিস্তব্ধতা, কারো মুখে কথা নেই। কফি কখন জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া তাঁবুর ভেতর ঢুকে আগুনে গরম পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে দিতে চাইল।
‘তারপর একসময় সব আশা ছেড়ে একটা উঁচু পাথরের ওপর আমি বসে পড়লাম।’ মি দাশগুপ্ত আবার তাঁর কাহিনি শুরু করলেন, ‘সারারাত চেষ্টা করলেও ওখান থেকে আমি বেরোতে পারব না, এটা উপলব্ধি হবার পর আশ্চর্য একটা শান্ত ভাব এল আমার মনে। পরের ঘটনার জন্য মনকে শক্ত করলাম আমি। হঠাৎ ভাঙা ইট-পাথরে কেমন যেন একটা শব্দ হল, প্রীতম সিং আর অন্যদের প্রেতাত্মারা কি আমার দিকে এগিয়ে আসছে? আমাকেও কি তাদের সঙ্গী হয়ে পাহারা দিতে হবে এই পাঁচিলকে যুগ যুগ ধরে! মনে মনে ভগবানের নাম নেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না আমার।
‘তারপরই হঠাৎ এক ঝলক আলো এসে পড়ল আমার মুখের ওপর। দু-চোখ বুজে ফেললাম। কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে আমার দিকে। চোখ খোলার সাহস হল না, না জানি কী বীভৎস দৃশ্য দেখতে হবে। আমি বোধ হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। মনে হল কারা যেন চাপা গলায় কথা বলছে। তারপরই অনুভব করলাম, মাটি ছাড়া হয়ে আমি ওপরে উঠছি, পাঁজাকোলা করে কেউ যেন আমাকে তুলে নিয়েছে। সঙ্গেসঙ্গে আমি জ্ঞান হারালাম।
‘জ্ঞান ফিরতেই দেখি, আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরের ভেতর এক ঝলক রোদের আলো, আর আমার বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে, মিস্টার সিং ঢুলছেন। আমি নড়েচড়ে উঠতেই তিনি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে আমার দিকে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন, ”তবিয়ত ঠিক লাগছে তো?”
‘আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে আমার মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগল, সমস্ত ব্যাপারটা স্বচ্ছ হয়ে উঠছে;;;
‘আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব,’ মৃদু কণ্ঠে বললাম আমি, ‘দেয়ালটা চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরেছিল, আমি মরবার জন্য তৈরি হয়েছিলাম…ওটা কিছুতেই বেরোতে দিচ্ছিল না আমাকে।’
‘ভগবানকে ধন্যবাদ, ওটার হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে পেরেছি। আমার একার ওখানে যাবার সহস ছিল না, তাই ডাগদার সাব আর চারজন লোক নিয়ে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। লণ্ঠন আর টর্চ ছিল আমাদের হাতে।’
ডাক্তার বেদি এলেন একটু পরেই। মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, বেশ হাসিখুশি মনে হল।
‘ইয়ংম্যান, আপনি তবে ভূত বিশ্বাস করেন না!’— হাসিমুখে তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন।
আমার নাড়ি পরীক্ষা করে তিনি আবার বললেন, ‘রাতের ওই অভিজ্ঞতার পর পালস বিট খারাপ নয়। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন না। আমিও বোধ হয় করি না, তবে রাতে একা ওখানে আমি যেতাম কি না সন্দেহ।’
তাঁর চোখ দুটো যেন হাসছে। আমিও হাসলাম। গতরাতের নিদারুণ অভিজ্ঞতার পর দিনের আলো আর ডাক্তার সাহেবের খোলা মন আমার শরীরে যেন শক্তি জোগাল।
‘এবার বলুন তো…,’ তিনি আমার বিছানার পাশে বসে পড়ে বললেন, ‘কী ঘটেছিল? আমরা আপনাকে ওখান থেকে যখন নিয়ে আসছিলাম, আপনি শিশুর মতো কাঁদছিলেন।’
‘তাই নাকি!’— আমি লজ্জা পেলাম, ‘আমার মনে পড়ে না।’
‘লজ্জা পাবার কিছু নেই।— ডাক্তার সাহেব আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘আপনার মনে যে ভয় জমেছিল, তা ভেসে যেতে সাহায্য করেছে ওটা। কিন্তু হয়েছিল কী!’
‘আমি থেমে থেমে আদ্যোপান্ত তাঁকে খুলে বললাম। টর্চ আর দেশলাই যে জ্বলেনি, তা বলতেও ভুললাম না।
‘হুম!’— আমার কথা শেষ হবার পর তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় ভয় পেয়ে আপনি বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাই একই জায়গায় গোল হয়ে ঘুরছিলেন। অন্ধকার ঘরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুঁজে পাচ্ছে না, এমন ঘটনা বিরল নয়।’
‘কিন্তু আমার টর্চ! আমার দেশলাই!’— আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম।
‘দেখি টর্চটা!’— তিনি বললেন।
‘আমার ওভারকোটের পকেটে আছে ওঠা।’— কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বললাম আমি।
‘তিনি দেয়ালে ঝোলানো আমার ওভারকোটের দিকে এগিয়ে গেলেন। টর্চটা বার করে বোতাম টিপতেই জ্বলে উঠল ওটা। কয়েকবার টর্চটা জ্বালালেন আর নেভালেন ডাক্তার সাহেব। তারপর বললেন, ‘হুম! এটা থেকে কিছু প্রমাণ হয় না। একদিন আমার মোটর গাড়ির হর্ন বাজছিল না। দোকানে নিয়ে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু তার দরকার হয়নি। পরে আবার বাজতে শুরু করেছিল। যান্ত্রিক গোলযোগ, আপনা থেকেই আবার ঠিক হয়ে গিয়েছিল।’
‘টর্চটা রেখে দিয়ে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর বললেন, ”আমি সমস্ত ঘটনার সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা করতে চাইছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, শুধু রাতেই নয়, দিনের আলোতেও ওখানে যাবার প্রলোভন আমার হবে না।”’