প্রাচীন ভারতে সামাজিক সহিষ্ণুতার সমস্যা
প্রাচীন ভারতবর্ষ এক অতি বিস্তৃত সময়কে চিহ্নিত করে। এই নিবন্ধ তার মধ্যে প্রধানত বৈদিকযুগের ওপর নিবদ্ধ থাকবে এবং মহাকাব্যিক যুগকে প্রান্তিক ভাবে স্পর্শ করবে।
সাধারণ ধারণা এই যে, বৈদিক আর্যরা মূলত এক নিরক্ষর শ্রেণির যাযাবর, পশুচারী সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে এরা উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে পদার্পণ করে। তারা এখানে এক উন্নততর সুশিক্ষিত এবং কৃষিকেন্দ্রিক সংস্কৃতিমান স্থায়ী অধিবাসীদের মুখোমুখি হয়। আন্তর্গোষ্ঠী এবং আন্তঃকৌম বিরোধ আর্যদের নিজেদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। দেশজ লোকদের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের পরাজিত করে, আর্যরা সুদূর বিন্ধ্যঅঞ্চলে প্রেরণ করেছিল এবং তার সঙ্গে প্রাগার্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও তাদের করতে হয়েছিল। ফলে সামাজিক সমন্বয়ের সমস্যাগুলি অঙ্কুরিত হল। সম্ভবত পূর্বতন কালে অন্য কোনও আর্যগোষ্ঠী এ দেশে এসে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। হয়তো এদেরই পরবর্তী কালে বৈদিক আর্যরা ‘ব্রাত্য’— এই আখ্যা দিয়েছিল; কিন্তু দেশজ মানুষ ও বৈদিক আর্য— উভয়ের থেকেই এরা অনেকাংশে পৃথক ছিল। কিন্তু সংস্কৃতিগত সমন্বয়-সাধনের প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এবং নিশ্চিত ভাবে এই সব ভিন্নধর্মী উপাদানগুলির সংহতি সাধন করে তুলেছিল। দেশীয় মানুষ এবং বৈদিক আর্য— দু’পক্ষের কাছেই দু’টি পন্থা ছিল: অন্য গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা অথবা তাদের যথাসম্ভব আত্মীকরণ। ভারতবর্ষীয়রা দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিয়েছিল এবং সম্যক ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার সঙ্গে তারা দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করতে লাগল।
শাসক আর্যরা যে এই সব সমস্যাগুলির সম্মুখীন হয়েছিলেন, শাস্ত্রে তা স্পষ্ট। ঋগ্বেদের শেষ মন্ত্রে আমরা পাঠ করি: ‘প্রাচীনেরা যেমন ভোগ্যসমূহের সমবণ্টন করেছিলেন, আমরাও যেন তেমন করতে পারি। বাক্যে এবং চিত্তে আমরা যেন সমভাবাপন্ন হই। আমাদের মন্ত্রী, আমাদের গতি যেন ঐক্যবোধযুক্ত হয়, আমাদের হৃদয় এবং বুদ্ধি যেন এই লোকের সঙ্গে ঐক্যে সংহত হয়। আমাদের কামনা বাসনা হৃদয় ও সত্তা যেন একীভূত হয়। আমরা যেন তোমাদের প্রতি সহিষ্ণুতায় সৌম্য হয়ে উঠতে পারি।’ সেই বিখ্যাত অন্তিম মন্ত্রটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। ‘আমরা যেন একতালে চলি, একসুরে কথা বলি, আমাদের হৃদয় যেন এক হয়।’ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রার্থনা নিয়েই যজুর্বেদের ‘শিবসংকল্পসূত্র’টি রচিত। সপত্ন অর্থাৎ শত্রুর প্রতি ঘৃণার মনোভাবকে অবলুপ্ত করে এক উদার ও প্রসন্ন মানসকে আহ্বান করেছে এই মন্ত্র। ‘যেমন ভীষণ আদিত্যগণ মরুৎ ও বসুগণের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে মিলিত হয়েছিলেন, সেই ভাবে আমাদের হৃদয় ও চিত্ত যেন দ্বেষ-হিংসা-রহিত হয়ে এই সব মানুষগুলির সঙ্গে মিশে যায়। দূরস্থিত, নবাগত, অভ্যাগত— সকল মানুষকে আমরা যেন দেবতার মতো শ্রদ্ধা করি। বাজসনেয়ী সংহিতার একটি সূক্ত থেকে আদি বৈদিক সমাজের সমস্যাগুলির রূপ স্পষ্টতর ভাবে প্রতীয়মান হয়। ‘জন্মসূত্রে বা পরিচয়সূত্রে যাঁরা আমাদের ঘনিষ্ঠ নয়, যাঁরা আমাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন, যাঁরা আমাদের থেকে ভিন্ন মতের, আমরা যেন তাঁদের সানুগ্রহে বরণ করতে পারি, এবং তাঁদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করতে পারি।’ অথর্ববেদ এই কামনাকে সর্বাপেক্ষা যথাযথ ভাবে ও বলিষ্ঠরূপে ব্যক্ত করেছে: ‘স্বজনবর্গের প্রতি যেমন, বিদেশি ও বহিরাগতের প্রতিও আমরা যেন সমান দাক্ষিণ্য বহন করি। আমাদের মানসে যেন তাঁদের প্রতি কোনও বৈরীতা পোষণ না করি, আমরা যেন তাঁদের সঙ্গে সহমত হই।’
এ বার কিছুক্ষণের জন্য আমরা এই দেশে বহিরাগত ক্ষুদ্র বা বৃহৎ গোষ্ঠী, যাঁরা বিশ্বাস ও আচারে ভিন্ন পথের, তাঁদের দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পরিবর্তে, নিজ মতবাদ ও আচরণের বাধ্যতামূলক প্রবর্তনের পরিবর্তে এই সব সুসংস্কৃত ও পরম মানবিক মন্ত্রগুলির লক্ষ্য ছিল অন্যান্য মতাদর্শকেও পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহিরাক্রমণ বহুগণিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক আক্রমণ থেকে শুরু করে বহিরাগতের প্রবাহ একে একে আছড়ে পড়েছে; এসেছে পারদ, পল্লব, মূতিব, কুষাণ, শক এবং হূণ-রা। ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে এরা এসেছিল, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অজ্ঞাত দেবমূর্তি, অপরিচিত ধর্মীয় আচরণ, ভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাস্কৃতিক অভ্যাস এবং মূল্যবোধ। এই সব গোষ্ঠী বা কৌমগুলি দেশীয় মানুষের থেকে যেমন পৃথক ছিল, তেমনই নিজেদের মধ্যেও পরস্পরের থেকে ভিন্ন ছিল। এই ধরনের অভ্যাগম সামাজিক কাঠামোয় সুস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে সামাজিক ভাবে পুনঃপুন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, এবং সেই বিশৃঙ্খলাকে প্রতিবার পুনর্বিন্যস্ত করার জন্য সমাজের প্রবীণরা অগ্রণী হয়েছিলেন। তথাপি, কাউকে বিতাড়িত করা হয়নি, কাউকে চির-অপাঙ্ক্তেয় করা হয়নি, কাউকে অবাঞ্ছিত, ভিনদেশিতে পরিণত করা হয়নি।
সূক্তগুলি থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রতিশোধপ্রবণতা, বিদ্বেষ দ্বারা বৈরীতা— পরিশোধের প্রবণতা তখনও প্রবল ছিল, তাই প্রায়শই শোনা যায়— ‘যারা আমাদের ঘৃণা করে’ বা ‘যাদের আমরা ঘৃণা করি’। সুতরাং স্বভাব প্রবণতা তখনও ছিল। তৎসত্ত্বেও প্রার্থনাগুলি মূলত শান্তি, বোধ এবং সহাবস্থানের উদ্দেশে রচিত। কোনও ঐশী শক্তির অপেক্ষায় এই প্রার্থনা অবসিত ছিল না, মানুষ নিজেই এর দ্বারা তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরাভূত করে মহত্তর সত্তার জয়লাভে গৌরব অর্জন করেছিল।
মিলিন্দ পঞ্চহতে আমরা বুদ্ধের প্রচারবাণী শুনি, শত্রুর প্রতিও প্রেমপূর্ণ আচরণ করা উচিত।’ সদ্ধর্মপুণ্ডরীকে বুদ্ধ এই নীতি প্রবর্তন করেছেন— ‘বর্ষাধারার মতো সর্ব জীবের কল্যাণ করা উচিত।’ ললিতবিস্তরের সেই অমর বাণী— ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায় লোকানুকম্পায়ে মহতো জনঙ্কায়স্যার্থায় সম্ভবত বিশ্বের সর্বোত্তম নৈতিক আদর্শ এখানে ব্যক্ত হয়েছে। ‘আমি তোমাকে ওই একটি সত্য বলছি যুধিষ্ঠির, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই’— যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মের এই উক্তি থেকে মহত্তর কিছু পৃথিবীর আর কোনও ধর্মে কখনও উচ্চারিত হয়নি।
সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধী উপাদানগুলিও বিদ্যমান ছিল। আটশত বছরের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন বিদেশি গোষ্ঠীর প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিকে জটিলতর করেছিল, সামাজিক শান্তিকে সন্ত্রস্ত করেছিল, সামাজিক ভারসাম্যকে বিপন্ন করেছিল এবং যুগোপযোগী ভাবে গড়ে-ওঠা বিভিন্ন ভাবে একত্রে পরিশীলিত সামাজিক গঠনকে বিপর্যস্ত করতে চেয়েছিল। আমরা বলে থাকি— ‘ধারণাৎ ধর্মঃ’ অর্থাৎ ধর্ম সামাজিক সংহতি দান করে, কী ছিল সেই দার্শনিক গুণগুলি যার দ্বারা প্রাচীন ভারতীয় সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন মূল্যবোধযুক্ত এবং জীবনযাত্রায় ভিন্নচারী বহিরাগতকেও দিয়েছিল মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান? এই আত্মীকরণের নিরীক্ষায় তারা কতদূর সফল হয়েছিল? আধুনিক সমাজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখা যাক। কেউ কি আজ আর এ কথা বলতে পারেন— এই ব্যক্তির পিতৃপিতামহ গ্রিক ছিলেন বা এঁর পূর্বপুরুষ কুষাণ বা হূণবংশীয়? অসম্ভব। শুধুমাত্র এই কারণে যে ওই প্রক্রিয়াটিতে প্রকৃত আন্তরিকতা ছিল, কেবলমাত্র এই কারণে তাদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, বিভিন্ন জাতিগত উপাদানের সমন্বয় সাধন করে, বিশেষিত করে, বৈদেশিক ধ্যান ও ধারণাকে আত্মীকরণের দ্বারাই ভারতবর্ষের প্রভূত উন্নতি ঘটবে। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, এ পথেই প্রকৃত অগ্রগতি, অন্যথায় সমূহ বিপর্যয়— মহতী বিনষ্টি।
এ কথা ভুললে চলবে না যে, তখন সমস্যাগুলি ছিল আত্যন্তিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তা তাদের অন্তরতম তন্তুকে দংশন করেছিল, তাদের পরম-আদরে লালিত এবং ঈপ্সিত জাতিগোষ্ঠী এবং মতাদর্শের অস্তিত্বকে ভীতিকর ছায়ায় ঢেকে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল।
বৈদিক সাহিত্যের পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয় যে, ধীরে ধীরে অনির্ণেয় অথচ অনিবার্য ভাবে অবিরাম এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভিন্নধর্মী পরস্পরবিরোধী সত্তাগুলি একটি যৌগিক জাতি-সমগ্রের মধ্যে সংমিশ্রিত হয়ে গেছে। এবং এ ভাবেই একটি অনুপশমিত বিরোধিতা এবং বৈরিতা থেকে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐক্যের নির্মাণ ঘটেছে। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে মানুষের মহত্তর সত্তার এ এক বিজয়। দুই ভাইবোন একই শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। দু’জনেই এক সঙ্গে পরীক্ষায় বসে, একজনের পরীক্ষার ফল অন্য জনের থেকে ভাল হয়। এই কারণে কি দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরে অথবা পারস্পরিক বৈরিতা জন্মায়? এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, ঈর্ষা বা বিদ্বেষ নেই। বাড়িতে তারা একে অন্যের উত্তম ফলের জন্য আনন্দে মেতে ওঠে।
ভারতবর্ষ বহু জাতি-ভাষা-ধর্ম সমন্বিত দেশ। সুতরাং এ দেশের সংস্কৃতিও বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ বলা যায়, এ হল অনেকগুলি বিশিষ্ট গোষ্ঠী, যার ঐতিহ্যশালী ইতিহাস বিক্ষিপ্ত ভাবে তিন হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে— তারই সংমিশ্রণে নির্মিত। সুতরাং ভিন্নমুখীনতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর স্বীয় বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়েছে। অর্থাৎ যখন যেমন প্রয়োজন, সে অনুসারে তারা নিজেদের সংস্কৃতি, অভ্যাস এবং আচরণকে বিশেষ ভাবে প্রকাশ করেছে, যাতে প্রতিবেশীদের থেকে তাদের অনন্যতা বজায় থাকে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিশেষত্বগুলি তেমন ভাবে গর্ব করার মতো কিছু নয়, এগুলি শুধু গোষ্ঠীগুলির বস্তুগত প্রকৃতিকে চিহ্নিত করে। কিন্তু এগুলিকে যদি উচ্চতর উৎকর্ষের নজির হিসাবে তুলে ধরা হয়, তখন সেই উদ্দেশ্যপূর্ণ তুলনাকে প্রতিবেশীরা নিন্দার্হ বলে মনে করেন। এখন প্রশ্ন হল— যদি এই উৎকর্ষ সত্যিও হয়, তাতেই কী? উত্তর হচ্ছে— কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎকৃষ্টতর হওয়াটাই ভারস্বরূপ; বরং প্রতিবেশীর সংস্কৃতিকেও বিনয়ের সঙ্গে প্রশংসা করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মহৎ ব্যক্তিও তাঁর পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীর মতোই দৈনন্দিন জীবন সাধারণ ভাবে নির্বাহ করেন। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবেশীর থেকে বিশিষ্টতর, সেই ক্ষেত্রেই শুধু তাঁর অনন্যতা প্রতিভাত হয়। সুতরাং উভয়ের মধ্যে যোগাযোগের এক বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে যায়।
আমাদের ভারতীয় প্রদেশগুলিতে এই বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের জীবনযাপন, আচরণ, চিন্তাধারা এবং ধর্মধারা একই রকম। অভারতীয় জনগণের পাশাপাশি রাখলে এই চিত্র স্পষ্টতর হয়। এই অন্তর্নিহিত সাদৃশ্য আমাদের ভারতীয়ত্বের উপাদান। প্রত্যেক প্রদেশ যে যে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট, সেই সেই ক্ষেত্রই সংহতির ভিত্তিস্বরূপ। এবং সেই কারণেই কোনও বিশেষ রাজ্যের সারবত্তাহীন আস্ফালন বা অন্যকে হীন প্রতিপন্ন করার প্রয়াস একেবারেই সমর্থনযোগ্য হয় না। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে উত্তর ভারতে ষোলোটি প্রদেশ বা মহাজনপদের উত্থান সম্বন্ধে জানা যায়। পরবর্তী কালের কিছু শতক ধরে কিছু কিছু অঞ্চল এবং জনপদ সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য শোনা যায়। এই সব জনপদ-অধিবাসীদের নির্বোধ এবং অজ্ঞ বলা হয়েছে। আর পরের সাহিত্যগুলিতে কিছু জনগোষ্ঠীকে ইন্দ্রিয়পরায়ণ বলা হয়েছে, আবার কিছু লোককে ধনলিপ্সু আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট যে, কোনও প্রদেশের সমস্ত অধিবাসী একই দোষদুষ্ট বলা যায় না এবং কোনও প্রদেশের অধিবাসীই এত নিষ্কলঙ্ক নয় যে, অন্যদের সংশোধন করার মতো নৈতিক অধিকার তাদের থাকবে। কাজেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমূলক হলেও সার্বিক একটা প্রবণতা ছিল কিছু শ্রেণির মানুষকে অবজ্ঞা করার এবং কদর্য ভাবে বর্ণনা করার।
দুর্ভাগ্যবশত এই পক্ষপাত এখনও বিদ্যমান এবং একজন বাঙালি হিসাবে আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যেই এর কারণ আছে। আমাদের এক সাংঘাতিক প্রবণতা আছে যে, আমরা ভিন্ন রাজ্যের প্রতিবেশীদের দুর্নামসূচক আখ্যা দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে প্রয়াসী হই। কার্যত, কিছু অপ্রয়োজনীয় তিক্ততার সূচনা করা ছাড়া এতে কোনও লাভ হয় না— না আমাদের প্রতিবেশীরা কলঙ্কিত হন, না আমাদের নিজস্ব ভাববৃর্তি দীপ্ততর হয় না, শুধুমাত্র যে সব ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অন্যেরা অগ্রবর্তী এবং যে সব ক্ষেত্রে আমাদের অযোগ্যতা ও অসাফল্য রয়েছে— সেই সব দুর্বলতাগুলিকে তা প্রকট করে। এর দ্বারা একটা অমূলক বিদ্বেষও প্রকাশ হয়ে পড়ে। নিজেদের ঘাটতি পূরণ করে উচ্চতর উৎকর্ষের সমান মাপে আসার বদলে আমরা তাদের দুর্নাম ছড়াই এবং নিন্দাবাদ করি। এ কথা ভুললে চলবে না যে, জনসংখ্যার সামগ্রিক বিচারে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলি এ কথা প্রমাণ করে যে, প্রতিভার বিচারে ভারতবর্ষ অদ্বিতীয়।
সেই ভাই এবং বোন পরীক্ষার্থীর প্রসঙ্গে ফেরা যাক। যদি তাদের মধ্যে কেউ সাহিত্য এবং ইতিহাসে এবং অন্য জন বিজ্ঞান ও অঙ্কে মেধার পরিচয় দেয় ও পরীক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে উত্তরগুলির তুলনামূলক আলোচনা করে, তা হলে সাধারণত তারা কী করে? তারা পারস্পরিক দুর্বলতা মেটাবার জন্য পরস্পরকে সাহায্য করে এবং এ ভাবে দু’জনেই লাভবান হয়।
গোখেলের সেই উক্তিটি যে সময়ে সত্য ছিল, সেই সময় আজ অতিক্রান্ত ‘বাঙালি আজ যা ভাবে, বাকি ভারতবর্ষ আগামীকাল তা ভাববে’, পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হবার পথে বাঙালি এক কদম আগেই অগ্রসর হয়েছিল। এবং ফলত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার সংস্পর্শ ঘটেছিল। পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাজগুলি এর পরে পরেই এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু আত্মতুষ্টিজনিত নিরুদ্যম এবং দীর্ঘসূত্রিতার জন্য বাংলার ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের অভাব দেখা দিল। আজ বহুল পরিমাণে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা পিছিয়ে পড়েছে। এ কথা সত্যি যে, এখনও বহু স্বনামখ্যাত মনীষী, সৃজনশীল শিল্পী, বিদগ্ধ বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসক আছেন। কিন্তু সেই একই চিত্র অন্যান্য রাজ্যে গেলেও দেখা যায়। সেখানেও এমন সব অগ্রণী ব্যক্তি আছেন যাঁদের অবদান বাঙালির কৃতিত্বের সমতূল্য তো বটেই, কখনও কখনও তাকেও ঔজ্জ্বল্যে অতিক্রম করে যায়। এই সব উচ্চতর উৎকর্ষকে স্বীকৃতি দিতে বা প্রশংসা করতে কেন আমরা কুণ্ঠিত হব? বরং তাঁদের বরণ করে নিলে, তাঁদের কৃতিত্বকে অনুধাবন করলে আমাদেরই লাভ হবে।
এ কথা যথার্থ, সে দ্রুতি বা প্রতিবেগ প্রতিযোগিতার অঙ্গ। কিন্তু প্রতিযোগী যদি আত্মবিশ্বাস ও আত্মতুষ্টির প্রাবল্যে স্ফীত রূপ ধারণ করে, তবে পরিণামে এক বেদনাদায়ক এবং অসম্মানজনক শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। পশ্চিমবঙ্গ এক দরিদ্র রাজ্য এবং দারিদ্র্য উন্নতির পথে বহুলাংশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু বিগত শতকে বহু প্রতিভাশীল মানুষ শুধুমাত্র নিজ দক্ষতা, সহজাত সৃজনশীলতা বৈদগ্ধ্য এবং এক অদম্য ইচ্ছাশক্তির দ্বারা এই সব প্রতিবন্ধকতা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ফলত শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক চিন্তা ব্যক্তিত্বের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রসমাবেশ গড়ে উঠেছিল। এই প্রারম্ভিক প্রজন্মের পর, মনে হয়, দুটি কারণে অধঃপতন ঘনিয়ে এসেছিল— প্রথমত, ইতস্তত বিচ্ছিন্ন ভাবে পাওয়া দু’-একটি দৃষ্টান্ত ছাড়া সর্বত্র সমপর্যায়ের প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অভাব। দ্বিতীয়ত, পূর্বতন প্রজন্মের গৌরবজনিত যে পাখা তাদের উত্তরপুরুষ অনুভব করত তা তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নৈষ্কর্মের জন্ম দিয়েছিল। এই গর্বিত মনোভাবই তাদের প্ররোচিত করেছিল প্রতিবেশীর প্রতি সম্পূর্ণ অমূলক এক বিদ্বেষের সূচনা করতে এবং এই কারণেই আত্মঘাতী এক সন্তুষ্টি দেখা দিয়েছিল। পূর্বতন প্রজন্মের কৃতিত্ব ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে বাঙালি ভাবতে শুরু করেছিল যে, তারাই একমাত্র ঈশ্বরের কৃপাধন্য মানুষ।
এখান থেকেই বাস্তববিমুখীনতার শুরু। গুণগত মান ও যোগ্যতার যেমন অবনতি হতে লাগল, তেমনি গর্বিত আত্মপ্রসাদ তুঙ্গে উঠল। মানসিক ভাবে, বাঙালির ধীশক্তি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ল, তার গ্রহণ করার ক্ষমতাও সঙ্কুচিত হতে থাকল। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে এই চিত্র আর একটু অন্য রকম। বলাই বাহুল্য যে, অনেক প্রদেশেই বহু বিশিষ্ট নরনারী আছেন, হয়তো অন্যত্র তাঁদের সংখ্যা কিছু কমও হতে পারে। কিন্তু সেই অল্পত্ব সেই সব প্রাদেশিক জনগণকে অযোগ্য প্রমাণ করে না। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে, আছে লোককথা, শিল্প, নৃত্যগীত এবং নিজস্ব ভাবধারার প্রকাশবাহী বহু আঙ্গিক। এগুলি তাদের নিজস্ব সত্তার বিশেষত্ব বহন করে, এর দ্বারা সামগ্রিক ভাবে দেশের কাছে তারা স্বীকৃতি ও সম্মান দাবি করে নেয়। বাংলা বা অন্য যে কোনও রাজ্যেরই অপর কারও অবদানকে ঘৃণা করা বা অবজ্ঞা করার কোনও যৌক্তিকতা নেই, কারণ তা সার্বিক ভাবে জাতীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত। অন্যান্য রাজ্যেও বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ মনস্বী এবং প্রভূত কৃতিত্বশালী নরনারীর উপস্থিতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
তাই এখন সমস্ত রাজ্যগুলি সম্মিলিত ভাবে এমন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যার আনুকূল্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রচেষ্টার দ্বারা এক সন্নিধি রচনা করা যায়। প্রতিবেশী রাজ্যগুলি সম্পর্কে অধিকতর অবহিত থাকলে নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ সুদৃঢ় হয়। ভারতীয় রাজ্যগুলির পক্ষে সন্নিহিত থাকার এই উপায় বেশ কার্যকর। ঐক্যের জন্য প্রয়োজনীয় বৃহত্তর এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলিকে বিদ্বিষ্ট মনোভাব নষ্ট করে ফেলে ও জনগণকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। ঐক্যের অর্থ পার্থক্য নির্মূলী করে অর্জিত সহমত অর্জন করা নয়, সমস্ত ব্যবধানকে অতিক্রম করে বহুমুখীনতার মধ্যে যে ভারতীয়ত্ব তাই হল ঐক্য। আমাদের ধর্মক্ষেত্রে বস্তুগত ও গুণগত মানের ব্যাপারে এক বিশাল সমস্যা দেশকে পীড়িত করেছে। এখন এই সমস্যা শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিকতার মানের নিরিখেই সর্বশ্রেষ্ঠ উৎকর্ষ যাচাই হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাবই দেশের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সুনিবিড় সহযোগিতার দ্বারা আমাদের উৎপাদনের গুণগত মানকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।
প্রতিযোগিতায় সফল হবার পথে এক ভীতিপ্রদ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বহুজাতিক সংস্থাগুলির সমগ্র দেশে আগ্রাসী ভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং সামন্ততান্ত্রিক বাতাবরণে অভ্যস্ত জনগণের মানসিকতাকে পূর্ণ ভাবে গ্রাস করার চেষ্টা। সমস্ত শ্রেণির ভোগ্যপণ্যকে এক অপরিহার্যতার রূপে তুলে ধরা হয়ে থাকে। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার কাছে এগুলি এক প্রতিস্পর্ধা এবং দেশীয় সংস্থাগুলির কাছেও ভয়ঙ্কর। পরোক্ষে এ ভাবে আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এটা আঘাত হানছে। কারণ, সংস্থাগুলি আমাদের যুবশক্তির অকল্পনীয় পারিশ্রমিক ও লোভনীয় আনুষঙ্গিক দ্বারা প্রলুব্ধ করতে এগিয়ে এসেছে। প্রতিশ্রুতিমান এবং প্রতিভাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা সুদীর্ঘ শ্রমসাপেক্ষ গবেষণা পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিতব্যে অনাগত পুরস্কারের চেয়ে নবীন সমাজ তাদের বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কামনা-বাসনার দ্রুত পরিপূর্ণতা চাইছে। এ ভাবে গবেষণা হারাচ্ছে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে, দেশ হারাচ্ছে জাতীয় বৌরবের উপযুক্ত মেধা, শুধুমাত্র লাভ হচ্ছে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যেরই। কারণ, মহার্ঘ মেধাকে হরণ করে তারা আর্থিক লাভকে বহুগুণিত করতে পারছে। আমাদের যোগ্যতার কাছে এ এক দুর্ভাগ্যের সম্ভাবনা, এ একটা সংকট যা আমাদের গোষ্ঠী, ভাষা ও রাজনৈতিক সীমানা বিদীর্ণ করে দিয়েছে, এ একটা প্রতিকূল আহ্বান যা ভারতবর্ষের মহত্তর গৌরবের জন্য নিবেদিত মেধার কাছে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সূচনার সেই উদাহরণে ফিরে যাই। স্কুলের সেই তরুণ ভাইবোনের মতো ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত্ব অর্জন করার জন্য রাজগুলির মধ্যে নিশ্চয় পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থাকবে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যসূচক এবং অসূয়াবিহীন। কারণ, পরীক্ষায় তাদের যে যেমনই করুক না কেন, যেই উচ্চতর নম্বর পাক না কেন, তারা দু’জনেই পরিবারের বৃহত্তর ক্ষেত্রে আনন্দ আর কৃতিত্ব বহন করে আনে।
বলা হয় যে, সাফল্যের চেয়ে সফলতর কিছুই নেই, সত্যি কথা, সাফল্য কি শুধু জাগতিক সম্পদ আর সমৃদ্ধি? এটা একেবারে ভুল ধারণা। কারণ, জাতিগত সম্পদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, হ্রাস পায় এবং বিনষ্ট হয়। কিন্তু প্রকৃতির জীবনধ্বংসী শক্তিগুলিকে পরাভূত করে যে সাফল্য, প্রকৃতির সঙ্গে এক অন্যানোজীবী বাস্তব সম্পর্কে গড়ে তোলার যে সাফল্য, বিভিন্ন ভাবে প্রতিকূলতাকে আয়ত্ত করে সুদূরপ্রসারী মানবিক বিজয়ের যে সাফল্য— সেগুলি এবং সৃজনশিল্পের প্রকাশগুলি স্বার্থান্বেষণজাত সহজ পরিতৃপ্তির ঊর্ধ্বে এক পরম নৈতিক বিজয়কে আহ্বান করে মানব-ইতিহাসে স্থায়ী এক দিকচিহ্ন এঁকে দেয়।
চার হাজার বছরের সুবিদিত ইতিহাসের অধিকারী, ভাষা এবং শিল্পের বৈচিত্র্য সমন্বিত, বিজ্ঞানের উৎকর্ষে সমৃদ্ধ জনসংখ্যায় বিপুলায়তন ভারতবর্ষে এক বিশাল গৌরবদীপ্ত সম্ভাবনা নিহিত আছে। তা হল— যদি সমস্ত রাজ্যগুলি তাদের সম্পদ আহরণ করে এক সুসমঞ্জস প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আপাত বিভেদগুলিকে উত্তীর্ণ হতে পারে, তা হলেই একদিন দূর থেকে দূরতর দিগন্তরেখাকে অতিক্রম করে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। ঋগ্বেদের শেষ মন্ত্রের প্রথম চরণটি হল— গতি, বাক্য ও মনের একতার জন্য প্রার্থনা। এই মন্ত্র আমাদের অনুপ্রাণিত করে বিভেদের ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করার জন্য, সত্য এবং আনন্দকে লাভ করে সৌষম্যকে রচনা করার জন্য। এই মন্ত্র আমাদের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য সচেতন ও সক্রিয় ভাবে প্রয়াসী হতে আকৃষ্ট করে। এর জন্য আশু প্রয়োজন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং একত্রে অগ্রগতির জন্য এক গভীর আকাঙ্ক্ষা।