প্রাচীন বাঙলার ধর্মসাধনা

প্রাচীন বাঙলার ধর্মসাধনা

বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিধি ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, মানুষও প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, ‘টোটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য-পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূতপ্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা-জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই প্রাক-আর্য ধর্ম গঠিত ছিল। কালের গতিতে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি ক্রমশ আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। এই সকল সংস্কারই ক্রমশ হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্মে, মৃত্যু,বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক কিছু পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান যেমন—দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিদুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় ও পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও গৃহীত হয়েছিল আটকৌড়ে, সুবচনীপূজা, শিশুদের জন্মের পর ষষ্ঠীপূজা, বিবাহে গাত্র-হরিদ্রা, পানাখাল, গুটিখেলা, স্ত্রী-আচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মী-পূজার সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন ইত্যাদি আচার যা বর্তমান কালেও বাঙালী হিন্দু পালন করে থাকে। এসবই প্রাক্- আর্য সংস্কৃতির দান। এ ছাড়া নানারূপ গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা, ধ্বজাপূজা, বৃক্ষের পূজা যাত্রাজাতীয় পর্বাদি, যেমন—স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, মনসা, শীতলা, জাঙ্গুলি, পর্ণশবরী, প্রভৃতির পূজা ও অম্বুবাচী অরন্ধন, পৌষপার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক্-আৰ্য জাতিসমূহের কাছ থেকে গৃহীত।

দুই

এই প্রাক্-আর্য ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধধর্ম। বৈদিক ধর্মের অনুপ্রবেশ তখন বাঙলাদেশে খুব দুর্বলভাবেই ঘটেছিল বস্তুত গুপ্তযুগের পূর্বে ব্রাহ্মণাধর্মে বাঙলাদেশে সবলভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্যধর্মের রূপও তখন পালটে গিয়েছিল। তখন বৈদিক ধর্ম পৌরাণিক ধর্মে পরিবর্তিত হয়েছিল। তার আগে বাঙলায় বেশ প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধধর্ম। বস্তুত বহিরাগত ধর্মসমূহের মধ্যে জৈন-ধর্মই প্রথম বাঙলাদেশে শিকড় গেড়েছিল। এর প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ঘটেছিল মানভূম, সিংহভূম, বীরভূম ও বর্ধমান জেলায়। চব্বিশজন জৈন তীর্থঙ্করের মধ্যে কুড়িজনের নির্বাণ ঘটেছিল হাজারিবাগ জেলার পরেশনাথ পর্বতে। কিন্তু মনে হয়, জৈনধর্ম খুব সহজে বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারেনি। জৈনধর্ম প্রচারের জন্য মহাবীরকে যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেননা, জৈনগ্ৰন্থ ‘আচারাঙ্গ সূত্রে’ বলা হয়েছে যে রাঢ়দেশের অন্তর্ভুক্ত বজ্জভূমি ও সুব্বভূমিতে তাঁকে যথেষ্ট নিগ্রহ ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। এই দুই অঞ্চলের লোকেরা যে জৈন সন্ন্যাসীদের প্রতি কেবল বিরূপ আচরণই করেছিল তা নয়, তারা তাদের পিছনে কুকুর পর্যন্ত লেলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের এরূপ বিরুদ্ধ আচরণ খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। কেননা, আমরা হরিষেণ- রচিত ‘বৃহৎকোষ’ থেকে জানতে পারি যে, মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গুরু ভদ্রবাহু নামক জৈন আচার্যের জন্ম হয়েছিল পুণ্ড্রদেশের অন্তর্গত দেবকোটের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। এই উক্তি থেকে আমরা দুটি তথ্য অবগত হই। প্রথমত মৌর্যযুগেও ব্রাহ্মণরা এসে পুণ্ড্রবর্ধনে বসবাস শুরু করেছিলেন, আর দ্বিতীয়ত বাঙলাদেশে তখন জৈনধর্মের বেশ প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। জৈনদের ‘ষোড়শ জনপদে’র তালিকায় অঙ্গ, বঙ্গ, লাঢ় ( রাঢ়) দেশসূহের উল্লেখ থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে, জৈনরা তখন বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। জৈন ‘কল্পসূত্র’ গ্রন্থেও উল্লেখিত আছে যে, গোদাস প্রমুখ জৈন সাধুরা চার শাখায় বিভক্ত ছিলেন, যথা—’তামলিত্তিয়’ (তাম্রলিপ্তীয়), ‘কোডিবর্ষীয়’ (কোটিবর্ষীয়)’ ‘পুণ্ড্রবর্ধনীয়া’ (পুণ্ড্রবর্ধনীয়) ও ‘খব্বডীয়’ (কর্বটীয়)। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে বাঙলাদেশে জৈনধর্ম বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করতে না পারলে, এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে কখনই চারটি বিশেষ শ্রেণীর জৈন সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটত না। এদের অভ্যুত্থান যে খ্রিস্টপূর্ব যুগেই ঘটেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। খ্রিস্টপূর্ব যুগের বহু অনুশাসনেই এই সকল সম্প্রদায়ভুক্ত জৈন সাধুদের উল্লেখ আছে। মথুরায় প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর এক লিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে, জনৈক জৈন সন্ন্যাসীর অনুরোধক্রমে রাঢ়দেশে একটি জৈন মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত ১৫৯ জি-ই নম্বর অনুশাসন থেকেও আমরা জানতে পারি যে, জৈনদের বটগোহালি বিহারের সেবার্থে ভূমিদান করা হয়েছিল। পরিব্রাজক উয়াং চুয়াং ও বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গদেশে অসংখ্য জৈন সন্ন্যাসী দেখেছিলেন। তিনি আরও বলে গিয়েছেন যে, পুণ্ড্রবর্ধনে জৈনদের এক বিশেষ কেন্দ্র ছিল। এ-সব প্রমাণের উপর নির্ভর করে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙলাদেশে জৈনধর্মের বিশেষ প্রাদুর্ভাব ছিল। কিভাবে বাঙলাদেশে জৈনধর্মের বিলুপ্তি ঘটল, সে সম্বন্ধে ইতিহাস সম্পূর্ণ নীরব। কেননা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগের পর আমরা সাহিত্য ও অনুশাসনসমূহে জৈনদের সম্পর্কে আর কোন উল্লেখ পাই না, যদিও পালযুগের কয়েকটি জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি আমরা বাঙলাদেশে পেয়েছি। যে সকল মূর্তি আমরা পেয়েছি, সেগুলির অধিকাংশই হচ্ছে জৈন দিগম্বর-সম্প্রদায়ের মূর্তি; মাত্র একটি শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের। তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, বাঙলাদেশে জৈন দিগম্বর-সম্প্রদায়েরই প্রভাব ছিল। বলা বাহুল্য দিগম্বর- সম্প্রদায়ভুক্ত জৈনরা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় চলাফেরা করত।

তিন

প্রাচীন বাঙলায় আজীবিক ধর্মেরও বেশ প্রাবল্য ছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আজীবিক ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মহাবীরের বিশেষ বন্ধু এবং উভয়ে একসঙ্গে রাঢ়দেশে ছয় বছর বাস করেছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, পাণিনি- কর্তৃক উল্লিখিত ‘মস্করিন ‘ ও ‘আজীবিক’ অভিন্ন। তা যদি যথার্থ হয়, তা হলে বলতে হবে যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পশ্চিম বাঙলায় আজীবিকরা তাঁদের ধর্ম- প্রচারকার্যে বিশেষভাবে নিযুক্ত ছিলেন। কথিক আছে যে মৌর্যসম্রাট অশোক পুণ্ড্রবর্ধনদেশে জনৈক নির্গ্রন্থের অপরাধের জন্য ১৮,০০০আজীবিক সম্প্রদায়ের লোককে হত্যা করেছিলেন। তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সম্রাট আশোকের সময় পর্যন্ত আজীবিকরা বাঙলাদেশে বেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ছিল এবং জৈনদের সঙ্গে তাদের বিশেষ প্রভেদ ছিল না। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত আজীবিক সম্প্রদায় যে বাঙলাদেশে বর্তমান ছিল, তা আমরা চৈনিক পরিব্রাজক উয়াং চুয়াং-এর ভ্রমণবিবরণী থেকে জানতে পারি। আরও জানতে পারি যে, উয়াং চুয়াং প্রথমে তাদের জৈন মনে করে ভুল করেছিলেন। এ থেকে মনে হয় যে, পরবর্তীকালে আজীবিকরা জৈনদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আরও অনুমান করা যেতে পারে যে বহু জৈন বৌদ্ধ বা নাথপন্থী হয়ে গিয়েছিল।

চার

জৈন ও আজীবিক ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মও বাঙলাদেশে খুব প্রাচীনকাল থেকেই বিস্তারলাভ করেছিল। ‘সংযুক্তনিকায়’ অনুযায়ী স্বয়ং বুদ্ধ কিছুকাল পশ্চিমবঙ্গের শেতক নগর বাস করেছিলেন। ‘বোধিসত্ত্বকল্পলতা’-তেও উল্লেখিত হয়েছে যে, ধর্মপ্রচারার্থে বুদ্ধ ছয়মাসকাল পুণ্ড্রবর্ধনদেশে বাস করেছিলেন। বাঙলাদেশে বুদ্ধের বসবাস করা সম্বন্ধে উয়াং চুয়াংও তার ভ্রমণকাহিনীতে এক কিংবদন্তি নিবন্ধ করে গেছেন। তিনি বলেছেন যে বুদ্ধ তিনমাস পুণ্ড্রবর্ধনে এবং সাতদিন সমতটে ও কর্ণসুবর্ণে বাস করেছিলেন। এছাড়া উয়াং চুয়াং সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত বহু স্তূপ সমতট, তাম্রলিপ্তি ও কর্ণসুবর্ণে দেখেছিলেন। সাঁচীর এক দানানুশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে, ধর্মদত্ত ও ঋষিনন্দনা নামে পুণ্ড্রদেশবাসী জনৈক পুরুষ ও মহিলা সাঁচীস্তূপের তোরণ ও বেষ্টনীর নির্মাণকার্য সমাধার উদ্দেশ্যে কিছু অর্থদান করেছিলেন। বৌদ্ধ মহাযান-সম্প্রদায়ের সাহিত্য থেকেও আমরা জ্ঞাত হই যে ষোলজন বৌদ্ধ প্রাচীন মহাস্থবিরগণের অন্যতম কালিকা নামধারী সন্ন্যাসী তাম্রলিপ্তির অধিবাসী ছিলেন। এসব প্রমাণ থেকে বুঝতে পারা যায় যে বৌদ্ধধর্ম বুদ্ধের আমল থেকেই বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। এমনকি বাঙলাদেশে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিস্তারলাভ করে, তখনও বৌদ্ধধর্ম বাঙলাদেশে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রারন্তে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন যখন বাঙলাদেশে এসেছিলেন তখন তিনি তাম্রলিপ্তিতে বাইশটি বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন। ওই সকল বিহারে তিনি দুই বৎসরকাল যাপন করে বহু বৌদ্ধগ্রন্ত্রের অনুলিপি করে নিয়েছিলেন ও বৌদ্ধ মূর্তি ও চিত্র সংগ্রহ করেছিলেন। এ-সব থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মহাযান বৌদ্ধধর্ম তখন বাঙলাদেশে বেশ বিস্তার লাভ করেছিল। বাঙলার নানাস্থানে প্রাপ্ত বৌদ্ধ দেবমণ্ডলীর বহু মূর্তির দ্বারাও ইহা সমর্থিত হয়। বস্তুত গুনাইঘরের অনুশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে মহাযান বৌদ্ধধর্ম ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে যখন উয়াং চুয়াং ভারতে আসেন, তখন তিনি কজঙ্গল, সমতট, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্তি-অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রাবল্য লক্ষ্য করেছিলেন। তবে মনে হয়, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব তখন কিছু হ্রাস পেয়েছিল কেননা তাম্রলিপ্তিতে ফা-হিয়ান বাইশটি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন, আর উয়াং চুয়াং-এর সময় ছিল মাত্র ছয়টি। উয়াং চুয়াং ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত ত্যাগ করে যান এবং ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক ই- চিং ভারতে আসেন। এই দুই সনের মধ্যে আরও ৫৬ জন চৈনিক পরিব্রাজক ভারতে আসেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন সেং-চি। তিনি সমতটে এক বৌদ্ধ রাজবংশকে সিংহাসনে আসীন থাকতে দেখেছিলেন। কিন্তু তারনাথের ‘বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে গোপাল কর্তৃক পালবংশ প্রতিষ্ঠার সময় বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুণঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু পাল- রাজ-বংশের আমলে বৌদ্ধধর্ম আবার নূতনভাবে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং বাঙলাদেশ বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। পালবংশের দ্বিতীয় সম্রাট ধর্মপাল বৌদ্ধ শিল্প ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনুশীলনের জন্য ন্যূনতম পঞ্চাশটি কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ত্রৈকুট বিহার, দেবীকোট বিহার, পণ্ডিত বিহার, সন্নগর বিহার, ফুলুরী বিহার, পট্টিককৈরক বিহার, বিক্রমপুরী বিহার, ও জগদ্দল বিহার। এই সকল বিহারের অধিকাংশই বাঙলাদেশে অবস্থিত ছিল এবং সেগুলিতে তিব্বতদেশীয় বহু বৌদ্ধ- শ্রমণ এসে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বহু গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। বস্তুত এই সকল বিহারে সহস্র ছাত্র নানাদেশ থেকে এসে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি ও সম্বন্ধে অনুশীলন করতেন এবং তাঁরা বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমশিলার মহাবিহারে ৫১জন মহাপণ্ডিত ছিলেন।

পাঁচ

বজ্রযান নামে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের এই সময়েই অভ্যুত্থান ঘটে। কেননা, এই সময় আমরা বাঙলাদেশে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বিশেষ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করি। কালযান ও সহজযান নামে বজ্রযানেরই দুই প্রভাবশালী শাখা ছিল। তার মধ্যে সহজযানের প্রবর্তক ছিলেন একজন বাঙালী, তার নাম লুইপাদ। তিব্বতীরা তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলে পূজা করে। তিনি অনেক বাংলা দোহাগান লিখে গিয়েছেন। তা ছাড়া, অনেক সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থেরও তিনি টীকাটিপ্পনী লিখে গিয়েছেন। আর একজন বাঙালী যাঁকে তিব্বতীরা ‘মানুষী বুদ্ধ’ হিসাবে পূজা করে তিনি হচ্ছেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতে যান এবং তিব্বত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডে সদ্ধর্ম প্রচার করেন। অতীশ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ও দেহ রেখেছিলেন ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে।

তারনাথের মতে তন্ত্রের উৎপত্তি বহু পূর্বেই হয়েছিল, কিন্তু উহা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, এবং গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় লুক্কায়িত ছিল। পালরাজগণের পৃষ্ঠ-পোষকতায় ও সিদ্ধাচার্যদের সক্রিয় প্রভাবে উহা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বজ্রযানের চারটি কেন্দ্র বা পীঠস্থান ছিল—উড্ডীয়ান, কামাখ্যা, শ্রীহট্ট ও পূর্ণগিরি। এ চারটি পীঠস্থানে একটা করে বজ্রযোগিনীর মন্দির ছিল।

অষ্টম শতাব্দীতে বজ্রযানের বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি হয়। খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তা প্রবলভাবে চলে। বৌদ্ধরাই তন্ত্রের গূঢ় সাধন পদ্ধতি লিখিতভাবে প্রথম প্রকাশ করে। তারা যে তন্ত্রগ্রন্থ প্রথম রচনা করেন তার নাম হচ্ছে ‘গুহ্যসমাজতন্ত্র’। সম্ভবত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে অসঙ্গ কর্তৃক এখানা রচিত হয়েছিল। বইখানা বরোদায় গায়কোয়াড় ওরিয়েন্টাল সিরিজে প্রকাশিত হয়। এই সিরিজে বজ্রযান সম্বন্ধে আরও তিনখানি বই প্রকাশিত হয়েছিল— ‘অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ’, নিষ্পন্নযোগাবলী’, ও ‘সাধনমালা’। কিন্তু সবগুলিই এখন দুষ্প্রাপ্য। এ ছাড়া আরও বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ ছিল। যদিও বলা হয় যে, বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা ৭৪, তা হলেও বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে এদের সংখ্যা বহু সহস্ৰ।

বজ্রযানকে সহজযান বা সহজিয়া ধর্মও বলা হয়। এই ধর্মকে ‘সহজ’ বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এ সহজপথে মানুষকে আত্মোপলব্ধির পথে নিয়ে যায়। সহজাত মনুষ্যস্বভাবকে অতিক্রম করবার চেষ্টা না করে স্বভাবের অনুকূল পথ অবলম্বন করে আত্মোপলব্ধি করাই সহজ পথ। সহজিয়ারা বলেন যে মন্ত্রতন্ত্র, ধ্যানধারণা হচ্ছে বৃথা; মহাসুখ স্বরূপ সহজের উপলব্ধিই পরম নির্বাণ। যাঁরা সহজপথে যান, তাঁদের জন্মমৃত্যুর আবর্তের মধ্যে ফিরে আসতে হয় না। এই বৌদ্ধ চিন্তাধারাই আমরা চর্যাপদসমূহের মধ্যে লক্ষ্য করি। সহজপথে নির্বাণ লাভ করা যায়, গুরু উপদেশে ও সহজপথে সাধনার দ্বারা। দেহই হচ্ছে এ সাধনার অবলম্বন। ‘দেহভান্ডই হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতি ব্রহ্মান্ড’। মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিঃশেষ নিমজ্জনই হল পরম নির্বাণ।

বজ্রযানীদের কল্পনায় আদিবুদ্ধই হচ্ছেন সৃষ্টির কারণ। তিনি সর্বব্যাপী। সৃষ্টির প্রত্যেক অণুপরমাণুতে তিনি বিদ্যমান। সেজন্য সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই স্বভাব-সিদ্ধ শূন্যরূপ নিঃস্বভাব ও বুদ্বুদ-স্বরূপ। কেবল শূন্যই নিত্য। আদিবুদ্ধই হচ্ছেন এই শূন্যের রূপ-কল্পনা। এই শূন্যই হচ্ছে ‘বজ্র’। সেজন্য দেবতা হিসাবে আদিবুদ্ধকে বজ্রধর বলা হয়। তাঁর শক্তি প্রজ্ঞাপারমিতা। কোন কোন মূর্তিতে তাঁকে প্রজ্ঞাপারমিতার সঙ্গে যুগনদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর একক মূর্তিও পাওয়া যায়। একক অবস্থায় তিনি শূন্য, আর যুগনদ্ধ অবস্থায় তিনি বোধিচিত্ত। একটি শূন্যতা, অপরটি করুণা। বজ্রযানীদের সাধনার লক্ষ্য হচ্ছে বোধিচিত্ত লাভ করা। বোধিচিত্তে কেবল মহাসুখের অনুভূতি ছাড়া আর কোন অনুভূতি থাকে না। এই মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিমজ্জনই হচ্ছে পরম নির্বাণ। সবই আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপার।

বৌদ্ধ দেবতামণ্ডলীতে অসংখ্য দেবতা আছে। নানাপ্রকার বোধিচিত্ত থেকেই এসব দেবতার উৎপত্তি। বৌদ্ধ দেবতাদের মধ্যে আছেন আদিবুদ্ধ, পাঁচটি ধ্যানী বুদ্ধ ও তাঁদের শক্তি, যথা অক্ষোভ্য (শক্তি মামকী), অমিতাভ (শক্তি পাগুরা), অমোঘসিদ্ধি (শক্তি তারা), বৈরোচন (শক্তি লোচনা), রত্নসম্ভব (শক্তি বজ্রধাত্বীশ্বরী), ও বজ্রসত্তা (শক্তি বজ্রসাত্ত্বিক)। তার পরের পর্যায়ের দেবতাগণ হচ্ছে সাতটি মানুষী বুদ্ধ ও তাঁদের শক্তি, বোধিসত্ত্বগণ ও তাঁদের শক্তিদেবীসমূহ, অমিতাভকুলের দেবদেবীসমূহ, অক্ষোভ্যকুলের দেবদেবীগণ, বৈরোচনকুলের দেবদেবীগণ, রত্নসম্ভবকুলের দেবদেবীগণ, অমোঘকুলের দেবদেবীগণ, দশ দিগ্‌দেবতা, ছয় দিগ্‌দেবী, আটটি উষ্ণীষ দেবতা, পঞ্চ রক্ষাদেবী, চার লাস্যাদি দেবী, চার দ্বারদেবী, চার রশ্মিদেবী, চার পশুমুখী দেবী, চার ডাকিনী, দ্বাদশ পারমিতা, দ্বাদশ বশিতা, দ্বাদশ ভূমিদেবী, দ্বাদশ ধারিণী ইত্যাদি।

ছয়

বলা বাহুল্য যে, তান্ত্রিক ধর্ম বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাঙলাদেশের জনপ্রিয় ধর্ম ছিল, এবং মনে হয় জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের পথ সুগম করবার জন্যই বৌদ্ধরা বৌদ্ধ তান্ত্রিকধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন।

দেখা যায় যে, দুই মূলগত বিষয়ে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য-তন্ত্রধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। প্রথম, বজ্রযান-বৌদ্ধধর্মে গুরুর সহায়তা ছাড়া তান্ত্রিক আরাধনা হয় না। ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। দ্বিতীয়ত, বজ্রযান-বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞার সার হচ্ছে বোধিচিত্ত-অবস্থায় আরোহণ করতে হলে স্ত্রী-পুরুষের যৌনমিলন অবশ্য অবলম্বনীয়। ব্রাহ্মণ্য- তন্ত্রধর্মেও শক্তিপূজার নিমিত্ত এইরূপ যৌনমিলন অবশ্য অবলম্বনীয় বা করণীয়।

বৌদ্ধধর্ম, যখন এভাবে প্রসারলাভ করছিল, তখন বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের -কি ঘটছিল সে সম্বন্ধে এখানে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে যে, রীতিমতভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশ বাঙলাদেশে গুপ্তযুগেই ঘটেছিল। এই সময় বেদ-অনুশীলনরত শত শত ব্রাহ্মণ বাঙলাদেশে আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ভূমিদান লাভ করেন। যদিও সূচনায় তাঁরা বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে রত ছিলেন, কালক্রমে তাঁরা এখানকার জনপ্রিয় আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা- পার্বণাদির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। পুরাণ ও তন্ত্রসমূহ এই যুগেই রচিত হয়েছিল এবং বৈদিক ধর্ম সম্পূর্ণভাবে নূতন রূপ ধারণ করেছিল। নূতন নূতন দেবতা, যাঁদের অস্তিত্ব বৈদিক আর্যগণের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল, তাঁদের প্রবর্তন এই যুগেই হয়েছিল। যে নূতন দেবতা-মণ্ডলী সৃষ্ট হয়েছিল তাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, পার্বতী, গণেশ, মনসা প্রমুখ দেব-দেবীগণ প্রাধান্যলাভ করেন। তাঁরা শুধু হিন্দুগণ কর্তৃক নয়, বৌদ্ধগণ কর্তৃকও উপাসিত হতে থাকেন। এই বৈপ্লবিক সংশ্লেষণ গুপ্তযুগেই সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই জন্যই আমরা গুপ্তযুগকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুদয়ের যুগ বলে অভিহিত করি। পালরাজগণ বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আর সেনরাজগণের তো কথাই নেই, তাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রসারের কাজে নিজেদের বিশেষভাবে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। বস্তুত তাঁদের সময়েই বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্ম উভয়ই সমধারায় প্রবাহিত হয়ে উভয়ে উভয়কে প্রভাবান্বিত করেছিল। বস্তুত মুসলমান যুগের অনতিপূর্বে উভয় ধর্মই বাঙলার নিজস্ব তন্ত্রধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল।

সাত

তন্ত্রধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত আছে। হিন্দুরা বলেন যে তন্ত্রধর্মের বীজ বৈদিক ধর্মের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর বৌদ্ধরা দাবি করেন যে, তন্ত্রের মূল ধারণাগুলি, ভগবান বুদ্ধ যে সকল মুদ্রা, মন্ত্র, মণ্ডল, ধারণী, যোগ প্রভৃতির প্রবর্তন করেছিলেন তা থেকেই উদ্ভূত। মনে হয় তন্ত্রধর্মের আসল উৎপত্তি সম্বন্ধে ‘সূত্রকৃতঙ্গ’ নামে এক প্রাচীন জৈনগ্রন্থ বিশেষ আলোকপাত করে। এটা সকলেরই জানা আছে যে, তন্ত্রের আচার, অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি অত্যন্ত গূঢ় এবং উক্ত প্রাচীন জৈনগ্ৰন্থ অনুযায়ী গূঢ় সাধন-পদ্ধতি শবর, দ্রাবিড়, কলিঙ্গ ও গৌড়-দেশবাসীদের এবং গন্ধর্বদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। মনে হয় এই জৈনগ্রন্থের কথাই ঠিক, কেননা তান্ত্রিকসাধন-সদৃশ ধর্মপদ্ধিতি পূর্বভারতে প্রাক্-বৈদিক জনগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল এবং তা-ই ‘ব্রাত্যধর্ম’ বা তৎসদৃশ কোন ধর্ম হবে। পরে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা যখন তা গ্রহণ করেছিল, তখন তারা দার্শনিক আবরণে তাকে মণ্ডিত করেছিল। প্রায় ষাট বছর পূর্বে এ সম্বন্ধে বক্রেশ্বরের বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধু অঘোরীবাবা যা বলেছিলেন তা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বেদের উৎপত্তির বহু শতাব্দী পূর্বে তন্ত্রের উৎপত্তি। তন্ত্র মন্ত্রমূলক নয়, ক্রিয়ামূলক। অনার্য বলে আর্যরা যাদের ঘৃণা করতেন, সেই দ্রাবিড়দের ভাষাতেই তন্ত্রের যা কিছু ব্যবহার ছিল। পুঁথি পুস্তক ত ছিল না, বেদের মতই লোক পরম্পরায় মুখে মুখে তার প্রচার ছিল। সাধকদের স্মৃতির ভিতরই তা বদ্ধ ছিল। তার মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র জাতির নাম-গন্ধও ছিল না। কারণ তন্ত্রের ব্যবহার যে-সব মানুষকে নিয়ে তার মধ্যে জাত কোথায়? সাধারণ মানুষের ধর্ম-কর্ম নিয়েই ত তন্ত্রের সাধন। তন্ত্রের জগতে বা অধিকারে ঘৃণার বস্তু বলে কিছুই নেই। শবসাধনা, পঞ্চমুণ্ডি আসন, মদ্য-মৎস্য- মাংসের ব্যবহার—তন্ত্রের এসব তো আর্য-ব্রাহ্মণদের ধারণায় ভ্রষ্টাচার। শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণরা যতদিন বাঙলায় আসেননি, ততদিন তাঁদেরও এ ভাবের যে একটি ধর্মসাধন আছে আর সেই ধর্মের সাধন প্রকরণ তাঁদেরই একদল গ্রহণ করে ভবিষ্যতে আর একটি ধর্ম গড়ে তুলবেন, একথা কল্পনায়ও আনতে পারেননি। তারপর তন্ত্রের ধর্ম গ্রহণ করে ক্রমে ক্রমে তাঁরা অনার্যই হয়ে পড়লেন—তাঁদের বৈদিক ধর্মের গুমোর আর কি রইল?’

বস্তুতঃ তন্ত্রধর্মের উদ্ভব হয়েছিল নবোপলীয় যুগে ভূমিকর্ষণের ব্যাপার নিয়ে। প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষ ছিল যাযাবর প্রাণী। পশুমাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য। পশুশিকারের জন্য তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে যেতে হত। পশুশিকার থেকে পুরুষের যখন ফিরতে দেরী হত, তখন মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর তাদের ভাবনাচিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্যা অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেই হেতু তারা ভূমিকা মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি (আমাদের সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে। (পশি-লুসকি তাঁর ‘আর্য ভাষায় অনার্য শব্দ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’,’লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন)। মেয়েরা এইভাবে ভূমিকর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তাই দেখে অবাক হল। ফসল তোলার পর যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হল সেই উৎসবে জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এই আদিম উৎসব থেকেই উদ্ভব হয়েছিল শিব ও শক্তির পূজা। এবং এরূপ আরাধনা নিয়েই উদ্ভূত হয়েছিল তন্ত্রধর্ম। (লেখকের ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’, সাহিত্যলোক, দ্রষ্টব্য।)

আট

জনপ্রিয় ধর্ম হিসাবে আর একটি ধর্মেরও খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রকের শেষাংশে ও দ্বিতীয় সহস্রকের সূচনায় অভ্যুত্থান হয়। তার নাম ছিল ‘নাথধর্ম’। এটি শৈবধর্মেরই শাখাবিশেষ; তবে মনে হয়, এর ওপর বৌদ্ধ ও তন্ত্র-ধর্মেরও প্রভাব ছিল। কথিত আছে শিব যখন দুর্গাকে গুহ্যতত্ত্বের উপদেশ দিচ্ছিলেন, তখন নাথধর্মাবলম্বীদের আদিপুরুষ মীননাথ গোপনে তা শুনেছিলেন। শিবই নাথদের আরাধ্য দেবতা এবং ‘কায়া’ সাধনাই নাথদের চরম লক্ষ্য। নাথধর্মাবলম্বীদের গুরুগণ উপাধি হিসাবে ‘নাথ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সেই জন্যই একে নাথধর্ম বলা হয়। নাথধর্ম প্রধানত বাঙলার নিম্নকোটির লোকদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। তবে এই ধর্মকে অবলম্বন করে যে সাহিত্য গড়ে উঠেছিল তা থেকে আমরা মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ, গোরক্ষনাথের শিষ্যা রাণী ময়নামতী, রানী ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ও তাঁদের নানারূপ অলৌকিক শক্তির কথা জানতে পারি। ধর্মটি এক সময় সুদূর পেশওয়ার থেকে ওড়িশা পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বাঙলাদেশের নাথধর্মীরা অধিকাংশই জাতিতে যুগী ও তাঁদের জীবিকা কাপড় বোনা। তবে কেউ কেউ কবিরাজী চিকিৎসাও করেন। (নাথধর্মের সাহিত্য সম্বন্ধে পরের এক অধ্যায় দেখুন)। পালযুগে ধর্মঠাকুরের পূজারও যথেষ্ট প্রাবল্য ছিল। এ সম্বন্ধে পরবর্তী অধ্যায় দেখুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *