বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতির ন্যায় অমন একজন লোকপ্রিয় কবির পদসমূহ একত্রে পুস্তকাকারে সংগৃহীত হইল, তাহার টীকা, অর্থ, পাঠ-বিভেদ ও (স্থানে স্থানে) ব্যাকরণের সূত্র বাহির হইল, তথাপি তাহা লইয়া একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল না, ইহা কেবল বাংলাদেশের জলবাতাসের গুণে। সম্পাদক শ্রীঅক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁহার যথাসাধ্য যে কথার যেরূপ অর্থ করিয়াছেন, যে শ্লোকের যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, পাঠকেরা কি একবার মনোযোগ করিয়া দেখিবেন না, যে, তাহা ব্যাকরণ-শুদ্ধ হইল কি না, সুকল্পনা-সংগত হইল কি না? সে বিষয়ে কি একেবারে মতভেদ হইতেই পারে না? পাঠকেরা কি সম্পাদকবর্গকে একেবারে অভ্রান্ত দেবতা বলিয়া জ্ঞান করেন, অথবা তাঁহাদের স্বদেশের প্রাচীন– আদি কবিদের প্রতি তাঁহাদের এতই অনুরাগের অভাব, এতই অনাদর যে, তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার দেয় স্বরূপে যৎসামান্য শ্রম স্বীকার করিতেও পারেন না? বঙ্গভাষা যাঁহাদের নিকট নিজের অস্তিত্বের জন্য ঋণী, এমন-সকল পূজনীয় প্রাচীন কবিদিগের কবিতা-সকলের প্রতি যে-সে যেরূপ ব্যবহারই করুক-না, আমরা কি নিশ্চেষ্ট হইয়া চাহিয়া থাকিব? তাহারা কি আমাদের আদরের সামগ্রী নহে? যিনি এই-সকল কবিতার সম্পাদকতা করিতে চান তিনি নিজের স্কন্ধে একটি গুরুতর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতি পদে সাধারণের নিকটে হিসাব দিবার জন্য তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে পাঠক-সাধারণ নিশ্চেষ্ট, নিরীহ-প্রকৃতি, এবং সম্পাদকবর্গও নিজের দম্ভ পাকাইয়া পাকাইয়া একটা অপরিমিত উচ্চ আসন প্রস্তুত করিয়া তুলেন; সেখান হইতে পাঠক বলিয়া যে অতি ক্ষুদ্র-কায়া একদল প্রাণী কখনো কখনো তাঁহাদের নজরে পড়ে, তাহাদের জন্য অধিক ভাবনা করা তাঁহারা আবশ্যক মনে করেন না। কবিদিগের কাব্য যিনি সংগ্রহ করেন, তাঁহার সংগ্রহের মধ্যে যদি অসাবধানতা, অবহেলা, অমনোযোগ লক্ষিত হয়, তবে তাঁহার বিরুদ্ধে আমরা অত্যন্ত গুরুতর তিনটি নালিশ আনিতে পারি– প্রথমত, কবিদের প্রতি তিনি অন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সহিত তিনি যে চুক্তি করিয়াছিলেন, সে চুক্তি রীতিমত পালন করেন নাই; তৃতীয়ত, পাঠক-সাধারণকে তিনি অপমান করিয়াছেন। তিনি তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অথচ যথাযোগ্য আয়োজন করেন নাই; যথারীতি সম্ভাষণ করেন নাই; এতই কি তাহারা উপেক্ষার পাত্র? “অক্ষরের ভুল হইল হইলই, তাহাতে এমনি কী আসে যায়? অর্থবোধ হইতেছে না? একটা আন্দাজ করিয়া দেও না, কে অনুসন্ধান করিয়া দেখে?” পাঠকদের প্রতি এরূপ ব্যবহার কি সাহিত্য-আচারের বিরুদ্ধ নহে?
শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতি-রচিত পদাবলী পুস্তকাকারে সংগ্রহ করিয়াছেন, অপ্রচলিত শব্দের ও দুরূহ শ্লোকের অর্থ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের সাহিত্যে এরূপ উদ্যোগ সম্প্রতি আরম্ভ হইয়াছে; অতএব এই উদ্যোগীদের আমরা নিরুৎসাহ করিতে চাহি না; ইঁহাদের চেষ্টা সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। কেবল আমরা যথাসময়ে ইঁহাদের সাবধান করিয়া দিতে চাই। আধুনিক বঙ্গীয় পাঠকগণকে নিশ্চেষ্ট জানিয়া ইঁহারা যেন নিজ কাজে শৈথিল্য না করেন। ইঁহাদের পরিশ্রম ও উদ্যমের পুরস্কার হাতে হাতে যদি-বা না পান বঙ্গ-সাহিত্যকে ইঁহারা ঋণী করিয়া রাখিবেন, ও একদিন-না-একদিন সে ঋণ পরিশোধ হইবেই।
“যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি, কোহত্র দোষ” সে কথা সত্য বটে; কিন্তু আমাদের আলোচ্য পুস্তকের সম্পাদক নিরলস হইয়া যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছেন কি না আমাদের সন্দেহ। রসেটি শেলীর কবিতাসমূহের যে সংস্করণ মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি প্রতি কমা ও সেমিকোলনের উপর মাথা ঘুরাইয়াছেন; ইহাতে কবির প্রতি তাঁহার অসাধারণ অনুরাগ ও সাধারণের সমীপে তাঁহার কর্তব্য পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এরূপ তুলনা বৃথা। কোনো বিষয়েই যাহাদের সহিত মিলে না, একটা বিশেষ বিষয়ে তাহাদের সহিত তুলনা দিতে যাওয়ার অর্থ নাই। বঙ্গদেশ ইংলণ্ড নহে, এবং সকল লোকই রসেটি নহে।
শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রাচীন কবিতা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, এজন্য তাঁহাকে উৎসাহ দিয়া তাঁহার কৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা সমূহ লইয়া আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এরূপ না করিল কবিতা-সকলের যথার্থ মর্ম বাহির হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। এ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা উত্থাপন করা আবশ্যক।
প্রাচীন কবিতাবলীর টীকা প্রকাশের নানাবিধ দোষ থাকিতে পারে। ১| ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ অর্থ ব্যাখ্যা; ২| সুভাব-বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা; ৩| সহজ শ্লোকের প্যাঁচালো অর্থ ব্যাখ্যা; ৪| দুরূহ শ্লোক দেখিয়া মৌন থাকা; ৫| সংশয়ের স্থলে নিঃসংশয় ভাব দেখানো; ইত্যাদি। এই-সকল দোষ যদি বর্তমান পুস্তকে থাকে, তবে তাহা সংশোধন করিয়া দেওয়া আমাদের কর্তব্য কার্য। বিদ্যাপতির পদাবলীর মধ্যে, ঈষৎ হউক, বা অধিক হউক, দুরূহ শ্লোক দেখিলে পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা তাহার অর্থ করিতে চেষ্টা করিব।
পুস্তকে নিবিষ্ট প্রথম গীতিতে কবি রাধিকার শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী অবস্থার কথা বর্ণনা করিয়াছেন।
নিরজন উরজ হেরই কত বেরি। হাসত আপন পয়োধর হেরি॥ পহিল বদরি সম পুন নবরঙ্গ। দিনে দিনে অনঙ্গ উঘারয়ে অঙ্গ॥
সম্পাদক ইহার শেষ দুই চরণের এইরূপ টীকা করিতেছেন; “প্রথম বর্ষার মতো নূতন নূতন ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল। বদরি (হিন্দি) বর্ষা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে এই চরণের অন্যরূপ অর্থ হয়। কিন্তু বদরি শব্দের বর্ষা অর্থও সুপ্রসিদ্ধ নহে।” “বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করা” শুনিলেই কেমন কানে লাগে যে, অর্থটা টানাবোনা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে কিরূপ অর্থ হয় তাহাও দেখা উচিত ছিল। “প্রথম বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল” এরূপ অর্থ করিলে পুন শব্দের সার্থকতা কী থাকে? যাহা হউক, এ স্থানের অর্থ অতিশয় সহজ, কেবল উপরে উদ্ধৃত চারি চরণের মধ্যে শেষের দুই চরণকে প্রথম দুই চরণের সহিত পৃথক করিয়া পড়াতেই ইহার অর্থবোধে গোল পড়ে। নিম্নলিখিত অর্থটি সহজ বলিয়া বোধ হয়। “রাধা নির্জনে কতবার আপনার উরজ দেখেন, আপনার পয়োধর দেখিয়া হাসেন। সে পয়োধর কিরূপ? না, প্রথমে বদরির (কুল) ন্যায় ও পরে নারাঙ্গার ন্যায়।” নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা অভিধানে নাই। “নাগরঙ্গ’ ও “নার্য্যঙ্গ’ শব্দ নারাঙ্গা বলিয়া উক্ত হইয়াছে। কিন্তু নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা, সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। বিদ্যাপতির আর-একটি পদ হইতে এই একই ভাবের দুইটি চরণ উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি, তাহাতে আমাদের কথা আরো স্পষ্ট হইবে।
পহিল বদরী কুচ পুন নবরঙ্গ। দিনে দিনে বাঢ়য়ে, পীড়য়ে অনঙ্গ।
৩-সংখ্যক পদে সম্পাদক
খেলত না খেলত লোক দেখি লাজ। হেরত না হেরত সহচরী মাঝ॥
এই দুই চরণের অর্থ করিতেছেন : “খেলার সময় হউক বা না হউক লোক দেখিলে লজ্জিত হয় ও সহচরীগণের মধ্যে থাকিয়া একবার দৃষ্টি করে ও তখনি অপর দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে।” “খেলত না খেলত” এবং “হেরত না হেরত” উভয়ের একই রূপ অর্থ হওয়াই সংগত বোধ হয়; উভয়ের বিভিন্ন অর্থ মনে লয় না। “খেলত না খেলত” অর্থে সম্পাদক কহিতেছেন “খেলার সময় হউক বা না হউক” অর্থাৎ খেলে বা না খেলে, তাহা যদি হয় তবে “হেরত না হেরত” শব্দের অর্থ “দেখে বা না দেখে” হওয়াই উচিত; কিন্তু তাহা হইলে কোনো অর্থই হয় না। ইহার অর্থ নিম্নলিখিত রূপ হওয়াই উচিত; “খেলে, খেলে না; লোক দেখিয়া লজ্জা হয়। সহচরীদের মধ্যে থাকিয়া দেখে, দেখে না।” অর্থাৎ খেলিতে খেলিতে খেলে না; দেখিতে দেখিতে দেখে না; ইহাই ব্যাকরণ-সম্মত ও অর্থ-সংগত।
নয়ন নলিনী দউ অঞ্জনে রঞ্জিত ভাঙবি ভঙ্গি-বিলাস॥
সম্পাদক “ভাঙবি”, শব্দের অর্থ “প্রকাশ করিতেছে” লিখিয়াছেন। তিনি কহেন “ভাঙ বিভঙ্গি-বিলাস এই পাঠ সংগত বোধ হয় না।” ব্যাকরণ ধরিতে গেলে “ভাঙবি’ শব্দের অর্থ “প্রকাশ করিতেছে’ কোনোমতেই হয় না। “বি’ অন্ত ধাতু কোনোমতেই বর্তমান কাল-বাচক হইতে পারে না। বিদ্যাপতির সমস্ত পদাবলীর মধ্যে কোথাও এমনতর দেখা যায় না। “ভাঙবি’ অর্থে “তুই প্রকাশ করিবি’ হয়, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তা থাকিলে “সে প্রকাশ করিবে’ও হয়, কিন্তু বর্তমান কাল-বাচক ক্রিয়ায় “বি’ যোগ বিদ্যাপতির কোনো পদেই দৃষ্ট হয় না। এমন স্থলে “ভাঙ বিভঙ্গি বিলাস’ পাঠ কী কারণে অসংগত বুঝিতে পারা যায় না। রাধিকার নয়ন-নলিনীদ্বয় অঞ্জনে রঞ্জিত, এবং তাহার ভ্রূ বিভঙ্গি-বিলাস। অর্থাৎ বিভঙ্গিতেই তাহার ভ্রূর বিলাস। এ অর্থ আমাদের নিকট বেশ সুসংগত বোধ হইতেছে।
অলখিতে মোহে হেরি বিহসিতে থোরি। জনু বয়ান বিরাজে চান্দ উজোরি॥ কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল। মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল॥
সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ এইরূপ করিয়াছেন : “কুটিল কটাক্ষের শোভায় চারি দিক এমন শোভিত হইল যেন মধুকর ডামরে (মৌমাছির ঝাঁকে) আকাশ (অম্বর) আচ্ছন্ন হইল।’ “যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন, এবং “আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি– “অলখিত ভাবে আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করাতে তাহার মুখ উজ্জ্বল চাঁদের ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিল। মুখ যদি চাঁদ হইল, কটাক্ষ সে চাঁদের ছটা স্বরূপ হইয়া পতিত হইতে লাগিল এবং মধুকরের ঝাঁক সে চাঁদের অম্বর অর্থাৎ আকাশ হইল। রাধার মুখের গন্ধে এত মধুকর আকৃষ্ট হইয়াছিল।’ এই গীতেরই মধ্যে মধুপের কথা পুনশ্চ উল্লেখ করা হইয়াছে; যথা–
লীলাকমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি। চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি॥
অর্থাৎ “লীলাকমলের দ্বারা ভ্রমরকে কিবা নিবারণ করিয়া, চকিতে চাহিয়া চমকিয়া ধনী চলিল।’ ইহাতে কুমারসম্ভবের তৃতীয় সর্গে গৌরীর বর্ণনা মনে পড়ে–
ভ্রমর তৃষিত হয়ে নিশ্বাস সৌরভে বিম্ব অধরের কাছে বেড়ায় ঘুরিয়া, চঞ্চল নয়ন পাতে ঊষা প্রতিক্ষণ লীলা-শতদল নাড়ি দিতেছেন বাধা।
আমরা “লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি’ ইত্যাদি দুই চরণের যে অর্থ করিলাম সম্পাদকের টীকার সহিত তাহার ঐক্য হয় না। তাহাতে আছে– “লীলা-কমলে স্থিত ভ্রমর বা বারিবিন্দুর ন্যায় চঞ্চল নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া চলিল।’ এ অর্থ যে অসংগত, তাহা মনোযোগ করিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে–
লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি। চমকি চললু ধনি চকিতে নেহারি॥
“লীলা-কমল’ ও “চকিতে নেহারি’ এতদূর; এবং মাঝে “চমকি চললু ধনি’ এমন একটা ব্যবধান স্বরূপে পড়িয়াছে যে উহাকে একত্র করিতে গেলে অনেক টানাটানি করিতে হয় ও “ন্যায়’ নামক একটা যোজক পদার্থ ঘর হইতে তৈরি করিয়া আনিতে হয়। আমরা যে অর্থ দিয়াছি তাহা ইহা অপেক্ষা সহজ। “বারি’ শব্দের অর্থ নিবারণ করা অপ্রচলিত নহে। যথা–
"পুর-রমণীগণ রাখল বারি।'
অর্থাৎ পুর-রমণীগণ নিবারণ করিয়া রাখিল।
১১- সংখ্যক গীতে সম্পাদক,
"একে তনু গোরা, কনক-কটোরা অতনু, কাঁচলা-উপাম।'
এই দুই চরণের অর্থ করিতে পারেন নাই। তিনি কহিয়াছেন, “এই চরণের অর্থগ্রহ হইল না।’ আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি– “তনু গৌরবর্ণ; কনক কটোরা (অর্থাৎ স্তন) অতনু অর্থাৎ বৃহৎ, এবং কাঁচলা-উপাম, অর্থাৎ ঠিক কাঁচালির মাপে।’
যব গোধূলি সময় বেলি,
ধনি মন্দির বাহির ভেলি,
নব জলধরে বিজুরি-রেখা দ্বন্দ্ব পসারিয়া গেলি॥
সম্পাদক টীকা করিতেছেন : “বিদ্যুৎ রেখার সহিত দ্বন্দ্ব (বিবাদ) বিস্তার করিয়া গেল। অর্থাৎ তাহার সমান বা অধিক লাবণ্যময়ী হইল।’ “সহিত’ শব্দটি সম্পাদক কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন? ইহার সহজ অর্থ এই– “রাধা গোধূলির ঈষৎ অন্ধকারে মন্দিরের বাহির হইলেন; যেন নব জলধরে বিদ্যুৎ রেখা দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল।’ ইহাই ব্যাকরণশুদ্ধ ও সুভাব-সংগত অর্থ।
সম্পাদক ২০-সংখ্যক গীতের কোনো অর্থ দেন নাই। আমাদের মতে তাহার ব্যাখ্যা আবশ্যক। সে গীতটি এই–
এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ। শুনইতে মানবে স্বপন স্বরূপ॥ কমল যুগলপর চাঁদকি মাল। তাপর উপজল তরুণ তমাল॥ তাপর বেড়ল বিজুরী লতা। কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা॥ শাখাশিখর সুধাকর পাঁতি। তাহে নব পল্লব অরুণক ভাতি॥ বিমল বিম্বফল যুগল বিকাশ। তাপর কির থির করু বাস॥ তাপর চঞ্চল খঞ্জন যোড়। তাপর সাপিনী ঝাঁপল মোড়॥
ইহাতে কৃষ্ণের শরীরের বর্ণনা হইতেছে। “নখ চন্দ্রমালা শোভিত-পদকমলদ্বয়ের উপরে তরুণ তমালবৎ কৃষ্ণের শরীর উঠিয়াছে। পীতাম্বর বিদ্যুতে তাঁহাকে বেড়িয়াছে। সে তমাল তরুর শাখাশিখর, অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বোধ করি অরুণ ভাতির পল্লব। ওষ্ঠাধর বিম্বফলদ্বয়। তাহার উপর কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির বাস করে। নেত্র খঞ্জন। কুন্তল, সাপিনী।’
অন্ধকার রাত্রে রাধিকা অভিসার উদ্দেশে বাহির হইয়াছেন, কৃষ্ণ বিঘ্ন আশঙ্কা করিতেছেন।
গগন সঘন, মহী পঙ্কা; বিঘিনি বিথারিত উপজয়ে শঙ্কা দশদিশ ঘন আন্ধিয়ারা; চলইতে খলই, লখই নাহি পারা। সব যোনি পালটি ভুললি আওত মানবি ভানত লোলি।
সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ নিম্নলিখিতরূপে করিতেছেন। “শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার অনুপস্থিতিতেও তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন “লোলে, (লোলি) তুমি যদি (নিরাপদে) উপস্থিত হও (আওত) তাহা হইলে আমি মনে মনে করিব (মানবি) যে, সকল জীবকে (যোনি) দৃষ্টিপাত দ্বারা (পালটি) তোমার প্রভায় নত করিয়া (ভানত) ভুলাইয়াছে (ভুললি)।’ এইরূপ অর্থ কষ্টসাধ্য সন্দেহ নাই, কিন্তু আমরা অন্য কোনো সুলভ অর্থ বা পাঠ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না।’ সম্পাদক স্বীকার করিয়াছেন উপরি-উদ্ধৃত অর্থটি কষ্টসাধ্য। আমরা কহিতেছি, উহা ব্যাকরণ-সংগতও নহে। “ভুললি’ অর্থে “ভুলাইয়াছ’ হয় না, উহার অর্থ ভুলিলি, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তার সহিত যুক্ত হইলে, ভুলিল। “মানবি’ শব্দের অর্থ “মনে করিব’ নহে, “মনে করিবি’ হইতে পারে; বিশেষত উহার কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ নহে। আমরা উপরি-উক্ত দুই চরণের এইরূপ অর্থ করি : “আওত মানবী, ভানত লোলি। ভানত অর্থাৎ ভাবের দ্বারা লোলা, চঞ্চল মানবী আসিতেছেন । সব যোনি পালটি ভুললি। সকল প্রাণীকে দেখিতে ভুলিলেন। এত অধীরা যে, কাহারো প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারিতেছেন না।’
রাধিকা শ্যামকে ভর্ৎসনা করিয়া দূতী পাঠাইতেছেন। দূতীকে কহিতেছেন:
যো পুন সহচরি, হোয় মতিমান্। করয়ে পিশুন-বচন অবধান॥
সম্পাদক টীকা করিতেছেন “কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ করেন!’ এ টীকার টীকা কে করিবে? অনেক অনেক মতিমান্ দেখিয়াছি, তাঁহারা কাকের কথায় কিছুমাত্র মনোযোগ দেন না। টীকাকার মহাশয় নিজে কী করেন? যাহা হউক, এমন মতিমান্ যদি কেহ থাকেন যিনি কেবলমাত্র কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ না করেন, এক-আধবার আমাদের কথাও তাঁহার কানে পৌঁছায়, তবে তিনি অনুগ্রহ করিয়া এ রহস্য কি আমাদের বুঝাইয়া দিবেন? বলা বাহুল্য, ইহার অর্থ– “যাঁহারা মতিমান্ তাঁহারা পিশুন-বচন অর্থাৎ নিন্দাবাক্যও অবধান করেন।’
"কুজনক পীরিতি মরণ-অধীন।'
এই অতি সহজ চরণটির টীকায় সম্পাদক কহেন– “কুজনের সহিত প্রীতি করিয়া এক্ষণে মরণের বশতাপন্ন হইলাম অথবা কুজনের প্রেম মরণাপেক্ষাও মন্দ।’ এত কথা সম্পাদক কোথায় পাইলেন? ইহার অতি সহজ অর্থঃ
“কুজনের প্রীতি মরণের অধীন, অর্থাৎ অধিক দিন বাঁচে না।’
পুস্তকের এক এক স্থান এমন দুর্বোধ যে, আমাদের সন্দেহ হয়, যে, হয় মূলের হস্ত-লিপিতে নয় ছাপিতে ছাপার ভুল হইয়া থাকিবে। একটা দৃষ্টান্ত দিই,
হরিণী জানয়ে ভাল কুটুম্ব বিবাদ, তবহুঁ ব্যাধক গীত শুনিতে করু সাধ॥
সম্পাদক ইহার টীকা দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। কিন্তু আমরা ইহার অর্থ খুঁজিয়া পাই না। ইহার ঠিক অর্থ এই–“হরিণী কুটুম্ব-বিবাদ উত্তম রূপ জানে তথাপি ব্যাধের গান শুনিতে তাহার সাধ।’ এখানে “কুটুম্ব-বিবাদ’ কথাটার কেন ব্যবহার হইল, তাহা কি পাঠকেরা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন? আমাদের বোধ হয় যে, উহা “কুটিল নিষাদ’ হইবে। অথবা কূট (অর্থাৎ ফাঁদ) শব্দজ একটা কিছু শব্দ ছিল, তাহাই ভ্রমক্রমে “কুটুম্ব’ শব্দে পরিণত হইয়াছে, এবং “বিবাদ’ শব্দ বোধ করি, “নিষাদ’ হইবে। আর-একটি অক্ষর-ভুলের উদাহরণ তুলিয়া দিই–
হরি যদি ফেরি পুছসি ধনি তোয়। ইঙ্গিতে নিবেদন জানাওবি সোয়॥ যব চিতে দেখবি বড় অনুরাগ। তৈখনে জানয়বি হৃদয়ে জনু লাগ॥
বিরহিণী রাধিকা কৃষ্ণের নিকট দূতী পাঠাইতেছেন। পাছে অপমান হইতে হয় এইজন্য প্রথমে ইঙ্গিতে কৃষ্ণের মনের ভাব বুঝিতে দূতীকে অনুরোধ করিতেছেন। রাধিকার ইচ্ছা, তাঁহার প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ লক্ষিত হইলে তবেই যেন মুখ ফুটিয়া সমস্ত নিবেদন করা হয়। সমস্ত গীতটির এই ভাব। উপরি-উদ্ধৃত শ্লোকের চতুর্থ চরণটি বুঝা যায় না। কিন্তু “জানয়বি’ শব্দ যদি “জানাওবি’ হয় তবে এইরূপ অর্থ হয়– যখনি চিত্তে বড়ো অনুরাগ দেখিবি, তখনি জানাবি; হৃদয়ে যাহাতে লাগে। অর্থাৎ সেই সময় জানাইলেই হৃদয়ে লাগিবে।
রাধিকা ছল করিয়া সখীদের কহিতেছেন– কাল ঘুমাইয়াছিলাম, এমন সময় এক পুরুষ আসিলেন, তাঁহার অরুণ আঁখি ও লোহিত অধর দেখিয়া ভয়ে আমার কেশপাশ বিশৃঙ্খল হইয়া গেল, কপালে কাজল ও মুখে সিন্দুর লাগিল।
এক পুরুখ পুন আওল আগে। কোপে অরুণ আঁখি অধরক রাগে॥ সে ভয়ে চিকুর চির (চীর?) আনহি গেল। কপালে কাজর মুখে সিন্দুর ভেল।
সম্পাদক টীকা করিতেছেন “সেই ভয়ে চিকুর (বিদ্যুৎ) চির (দীর্ঘকালের জন্য) অন্যত্র গমন করিল।’ এ টীকার কি কোনো অর্থ আছে? কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, এমন সময় সহসা বিনামেঘে একটা বিদ্যুৎ খেলাইয়া যাইবে কেন, আমরা ভাবিয়া পাই না। চিকুর অর্থে কেশ। রাধিকা বলিতেছেন, সেই পুরুষের ভয়ে তাঁহার চিকুর ও চীর অন্যত্র গেল; এবং বেশভূষার বিপর্যয় হইল।
হিম হিমকর-কর তাপে তাপায়লু ভৈগেল কাল বসন্ত। কান্ত কাক মুখে নাহি সম্বাদই কিয়ে করু মদন দুরন্ত।
শীতল চন্দ্রের কিরণও আমাকে তাপিত করিল, বসন্ত আমার কাল হইল। কান্ত কাহারো মুখে সংবাদ লইলেন না, দুরন্ত মদন কী যে করিতেছে। সম্পাদক টীকা করিয়াছেন “কান্ত কাকমুখেও সংবাদ পাঠাইলেন না, আমি এই দুরন্ত মদনে কি করিব?’ কাকের সহিত সম্পাদকের বিশেষ সখ্য দেখা যাইতেছে। তিনি কাককে প্রেমের দূত এবং মতিমান্ লোকদের মন্ত্রী বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কাকের বরঞ্চ বুদ্ধিমান বলিয়া একটা খ্যাতি আছে, কিন্তু প্রেমিক বলিয়া তাহার যশ আজ পর্যন্ত শুনা যায় নাই। হিন্দুস্থানীতে “ক’ বিভক্তি যষ্ঠীতে ব্যবহার হয়, অতএব “কাক’ শব্দের অর্থ কাহার।
মাধব অবলা পেখনু মতিহীনা। সারঙ্গ শবদে মদন স কোপিত তেঞ দিনে দিনে অতি ক্ষীণা॥
টীকা উদ্ধৃত করি। “সারঙ্গ শবদে– হরিণের শব্দ শুনিলে’ হরিণের শব্দ শুনিলেও মদন প্রকুপিত হন মদনের এমন স্বভাব কোনো শাস্ত্রে লেখে না। সারঙ্গ শব্দের অর্থ যখন ভ্রমর হয়, কোকিল হয়, মেঘ হয়, ময়ূর হয়, তখন মদনকে রাগাইবার জন্য হরিণকে ডাকিবার আবশ্যক?
দক্ষি পবন বহে কৈছে যুবতী সহে,
তাহে দুখ দেই অনঙ্গ।
গেলনুঁ পারাণ আশা দেই রাখই
দশ নখে লিখই ভুজঙ্গ॥
সম্পাদক কহিতেছেন– “ইহার সম্যক অর্থগ্রহ হয় না।’ চতুর্থ চরণটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য সন্দেহ নাই। ইহার অর্থ এমন হইতে পারে যে, “শিবের ভূষণ ভুজঙ্গকে মদন বিশেষরূপে ডরান, এই নিমিত্ত বিরহিণী নখে ভুজঙ্গ আঁকিয়া তাহাকে ভয় দেখাইয়া প্রাণকে আশা দিয়া রাখিতেছেন।’ রাধিকার পক্ষে ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে, কারণ ইতিপূর্বে তিনি রাহু আঁকিয়া বিরহিণীর ভীতিস্বরূপ চাঁদকে ভয় দেখাইতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন।
কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করিয়া গেলে পর দূতী তাঁহার নিকটে গিয়া ব্রজ-বিরহিণীদের দুরবস্থা নিবেদন করিতেছেন।
তোহারি মুরলী সো দিগে ছোড়লি
ঝামরু ঝামরু দেহা।
জনু সে সোনারে কোষিক পাথরে
ভেজল কনক রেহা।
সম্পাদক প্রথম দুই চরণের অর্থ স্থির করিতে পারেন নাই। ইহার অর্থ– “তোমার মুরলী তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিল (ছোড়লি; স্ত্রীলিঙ্গেই) ও তাহাদের দেহ শীর্ণ মলিন হইয়া আইল।’ ঝামরু শব্দের অর্থ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে পরে কহিব।
বড় অপরূপ দেখিনু সজনি নয়লি কুঞ্জের মাঝে। ইন্দ্রনীল মণি কেতকে জড়িত হিয়ার উপরে সাজে।
সম্পাদক “কেতক’ শব্দের অর্থ নির্মলী বৃক্ষ স্থির করিয়া বলিয়াছেন, “কিরূপ উপমা হইল বুঝিতে পারিলাম না।’ কেতক শব্দে কেয়া ফুল বুঝিতে বাধা কি? রাধা শ্যাম একত্র রহিয়াছেন যেন কেয়াফুলে ইন্দ্রনীল মণি জড়িত রহিয়াছে।
পুস্তকের মধ্যে ছোটো ছোটো অনেকগুলি অসাবধানতা লক্ষিত হয়। তাহার কতকগুলি দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করা আবশ্যক। আমাদের মতে এরূপ প্রাচীন কবিতা-সমূহ সংগ্রহ করিতে গেলে নিতান্ত সাবধানতার সহিত যথাসম্ভব নিখুঁত করিয়া তোলা উচিত, তিল পরিমাণ দোষ না থাকে যেন।
“কিয়ে’ শব্দের অর্থ” “কি’। কি শব্দ বাংলায় অনেক অর্থে ব্যবহার হয়। জিজ্ঞাসার স্থলে, আশ্চর্যের স্থলে, যেমন– কি সুন্দর! এবং কিংবা অর্থেও প্রয়োগ হইয়া থাকে। প্রাচীন কবিতাতেও “কিয়ে শব্দের ঐ কয়টি অর্থ। সম্পদক মহাশয় স্থানে স্থানে উলটাপালটা করিয়া একটার জায়গায় আর একটা বসাইয়াছেন। দেখিলাম তিনি জিজ্ঞাসাসূচক “কি’ শব্দের উপর নিতান্ত নারাজ।
লোচন জনু থির ভৃঙ্গ আকার, মধুমাতল কিয়ে উড়ই না পার?
অর্থাৎ, তাঁহার লোচন স্থিরভৃঙ্গের ন্যায়; মধুমত্ত হইয়া সে কি উড়িতে পারিতেছে না? সম্পাদক কহেন “যেন মধুমত্ত হইয়া উড়িতে অক্ষম।’
দারুণ বঙ্ক বিলোকন থোর কাল হোই কিয়ে উপজল মোর?
নিদারুণ ঈষৎ বঙ্কিম দৃষ্টি কি আমার কাল হইয়াই উৎপন্ন হইল? সম্পাদক কহেন “কি বা আমার কালস্বরূপ হইয়া উপস্থিত হইল!’ ইহা অত্যন্ত হাস্যজনক।
চিকুরে গলয়ে জলধারা
মুখশশি ভয়ে কিয়ে রোয়ে আন্ধিয়ারা?
এখানে “মুখশশির ভয়ে আঁধার কি বা রোদন করিতেছে!’ অর্থ করা অপেক্ষা “মুখশশির ভয়ে কি আঁধার রোদন করিতেছে?’ বলিলেই কানে ভালো শুনায়।
সম্পাদক “কহসি’ শব্দের এইরূপ টীকা করিয়াছেন– “কহে (সি সংস্কৃত বিভক্তি)।’ এ কেমন কথা বুঝিতে পারিলাম না। “কহে’ তৃতীয় পুরুষ, কিন্তু সংস্কৃতে দ্বিতীয় পুরুষ নহিলে “সি’ বিভক্তি হয় না। সম্পাদক এত স্থলে সি-অন্ত ধাতুর ভ্রমাত্মক অর্থ দিয়াছেন যে, উদ্ধৃত করিতে প্রবন্ধের কলেবর বাড়িয়া যায়;
চলইতে চাহি চরণ নাহি যাব॥
সম্পাদক “যাব’ শব্দের অর্থ বিশেষ করিয়া “যায়’ বলিয়া লিখিয়াছেন। ইহা ভবিষ্যৎকাল-বাচক-ক্রিয়া, ইহার অর্থ “যায়’ হইতে পারে না। ইহার অর্থ “চলিতে চাহিতেছে তথাপি পা চলিবে না।’
“ঝামর’ শব্দে সম্পাদক মেঘ কহিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত পুস্তকের মধ্যে কোথাও ঝামর শব্দ মেঘ অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই; অথচ পদাবলীর মধ্যে পঞ্চাশ জায়গায় মেঘের উল্লেখ আছে।
কহ সখি সাঙরি ঝামরি দেহা॥ এবে ভেল বিপরীত, ঝামর দেহা॥ পুনমিক চাঁদ টুটি পড়ল জনু ঝামর চম্পক দামে॥ তোহারি মুরলী সোদিগে ছোড়লি ঝামরু ঝামরু দেহা॥ কুবলয়-নীল বরণ তনু সাঙরি ঝামরি, পিউ পিউ ভাষ॥
সর্বত্রই ঝামর অর্থ শুষ্ক মলিন শব্দেউক্ত হইয়াছে। এক স্থলে শ্যামের কেশ বর্ণনায় ঝামর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, সে স্থলে তাহার অর্থ কৃষ্ণবর্ণ হইতে পারে। সম্পাদক যদি এই পুস্তক ব্যতীত অন্য কোনো সূত্রে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়া থাকেন যে, ঝামর অর্থে মেঘ, তাহা হইলে আমাদের আর অধিক বক্তব্য থাকে না।
"আশ নিগড় করি জীউ কত রাখব অবহ যে করত পয়াণ!'
সম্পাদক “নিগড়’ অর্থে “গড়বন্দী করা’ লিখিয়াছেন। সকলেই জানেন নিগড় অর্থ শৃঙ্খল। যাহা হউক, এরূপ ভুল তেমন মারাত্মক নহে; যাঁহারা সংস্কৃত জানেন তাঁহাদের ইহাতে হানি হইবে না।
সমস্ত পুস্তকের মধ্যে এত অসাবধানতা, এত ভ্রম লক্ষিত হয়, যে, কিয়দ্দূর পাঠ করিয়াই সম্পাদকের প্রতি বিশ্বাস চলিয়া যায়। ইহার সমস্ত ভ্রম যে কেবল সম্পাদকের অক্ষমতা-বশত ঘটিয়াছে তাহা নহে, ইহার অনেকগুলি তাঁহার অসাবধানতা-বশত ঘটিয়াছে। এমন-কি, স্থানে স্থানে তিনি অভিধান খুলিয়া অর্থ দেখিবার পরিশ্রমটুকুও স্বীকার করেন নাই। এত অবহেলা এত আলস্য যেখানে, সেখানে এ কাজের ভার গ্রহণ না করিলেই ভালো হইত। আমাদের দেশে পাঠকেরা তেমন কড়াক্কড় নহেন বলিয়া তাঁহাদিগকে বিপথে চালন করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত অনুচিত। সম্পাদকের প্রশংসনীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাঁহাকে যে এত কথা বলিলাম, তাহারা কারণ বিদ্যাপতির কবিতা আমাদের অতি প্রিয় সামগ্রী, এবং পাঠকসাধারণকে আমরা উপেক্ষণীয় মনে করি না। আমরা এই প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহের উদ্যোগকে উৎসাহ দিই। আমাদের ইচ্ছা, কোনো নিরলস, উৎসাহী ও কাব্যপ্রিয় সম্পাদক পুনশ্চ এই কার্যের ভার গ্রহণ করেন। শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতির উপরেই প্রথম হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত তাহাতে যে-সকল ভ্রম আছে তাহা অনেকটা মার্জনা করা যায়; এখন আশা করি, এ বিষয়ে তাঁহার হাত অনেকটা পাকিয়া আসিয়াছে; অতএব অধিকতর মনোযোগ সহকারে এই দেশহিতকর কার্য তিনি যেন সুচারুতর রূপে সম্পন্ন করিতে পারেন, এই আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা।
শ্রাবণ, ১২৮৮।