প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আত্মকথা

প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আত্মকথা

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী। হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।। (চর্যা ৩৩)

পাড়ায় (লোকালয়ে) আমার বাড়ি, (কিন্তু) প্রতিবেশী নেই। ঘরে ভাত (খাবার) নেই, অথচ নিত্য অতিথি সেবা করতে হয় (কারণ, অতিথি নারায়ণ, নিজে অনাহারে থেকেও তার সেবা করতেই হবে—এটাই সামাজিক প্রথা)।

কিংবা,

আলো ডোম্বী তোএ সম করিব মো সাঙ্গ। নিঘিণ কাহ্ন কপালি জোই লাগ।…

হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে। আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ।।

তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া। তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া।।

তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী। তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী।।

সরবর ভাঞ্জীঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ। মারমি ডোম্বী লেমি পরান।। (চর্যা ১০)

ওলো ডোমনী, তোকে আমি বিয়ে করব। আমি কাহ্ন, ঘৃণাহীন (ডোমনী নীচু জাতের বলে তার প্রতি কোনো ঘৃণা নেই), কাপালিক-যোগী সম্প্রদায়ের এক নি:সঙ্গ যুবক। ডোমনী, তোর জন্য আমি আমার বহুরূপীর সাজ ছেড়েছি। তোর পছন্দসই হাড়ের মালা পরেছি। কিন্তু তা-ও তুই অন্যের নৌকায় যাতায়াত করিস। বল সেকে? কেন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা? তোকে মারব, তোর প্রাণ নেব।

সাহিত্যপাঠের বিনির্মাণ-পদ্ধতি অনুসারে ওপরের উদ্ধৃতাংশটির যে অর্থ গ্রহণ করা হল তাতে দেখা যায় প্রথম উদ্ধৃতিটি এক নি:সঙ্গ নিরন্ন কবির বিপন্ন আত্মকথন, আর দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে আছে প্রেমে প্রতারিত এক নি:সঙ্গ ও ঈর্ষান্বিত কবির জিঘাংসু আত্মকথন। এই অর্থোদ্ধার থেকে কোনো সমালোচক যদি সিদ্ধান্ত করেন যে, বাংলা সাহিত্যের একেবারে আদি পর্ব থেকেই কবির আত্মকথার নিদর্শন পাওয়া যায় তবে তাতে চমক থাকলেও তা সত্য ও ইতিহাসসম্মত নয়। কারণ, দুটি অংশেই আত্মকথনের ভঙ্গিতে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কবির ব্যক্তিজীবনের সম্পর্ক নেই। এখানে চর্যাপদের মুনিদত্তের টীকা অনুসারে বোঝা যায় আত্মকথনের ভঙ্গিটি আরোপিত। ভাষা সন্ধ্যাভাষা অর্থাৎ দ্ব্যর্থবোধক। আত্মকথনের বাচ্যার্থের আড়ালে কবিরা এখানে সহজযান বৌদ্ধধর্মের সাধনতত্ত্বের কথাই বলেছেন। সুতরাং এ অংশ দুটিকে কবিদের প্রকৃত আত্মকথা বলা যায় না।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত আত্মকথার সূত্রপাত মোটামুটি পঞ্চদশ শতকের কাব্য রচনায়, বিশেষত অনুবাদ, মঙ্গলকাব্য ও জীবনী কাব্যের মতো আখ্যান কাব্যের ধারায়। এই সব কাব্যে কবিদের আত্মকথার নিদর্শন পাওয়া যায় প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে— ১. ভণিতা অংশে, ২. গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে। ভণিতা প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, আদি পর্বের চর্যাপদেও কোনো কোনো কবি ভণিতায় গুরুকে স্মরণ করেছেন, যেমন, লুই পাদের শিষ্য দারিকপাদ ‘লুইপাঅ পএ দারিক দ্বাদশভুঅনেঁ লধা’ (চর্যা ৩৪)—লুইপাদের প্রসাদে দারিক দ্বাদশ ভুবনের রাজা (অর্থাৎ সমস্ত পার্থিব মোহের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত); জালন্ধরিপাদের শিষ্য কাহ্ন পা—‘শাখি করিব জালন্ধরি পাএ’ (চর্যা ৩৬)—(তত্ত্বদর্শনে) জালন্ধরি পাদকে সাক্ষী করা হবে। তবে এই সব ভণিতা খুব সংক্ষিপ্ত। পক্ষান্তরে মধ্যযুগের কবিদের ভণিতা আর একটু বিস্তৃত। যেমন, ‘চৈতন্যমঙ্গল’ (মধ্যখন্ড) কাব্যে নরহরি দাসের শিষ্য লোচনদাসের ভণিতা :

ঠাকুর শ্রীনরহরি দাষ প্রান য়ধিকারী জার পদ প্রতি য়াসোয়াষ।

য়ুধমোহা সাধ করে গৌরগুন কহিবারে ভরষা এ লোচন দাস।।

[রচনাকাল ১৬শ শতক; বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত এই পুথির লিপিকাল সন ১০৯৯ সাল = ১৬৯২খ্রি:]। লক্ষণীয়, এখানেও কবি গুরুকে স্মরণ করেছেন, কিন্তু তার পরিসর একটু বিস্তৃত। মধ্যযুগের কাব্যের ভণিতায় গুরুস্মরণ ছাড়াও কবির ব্যক্তিজীবনের নানা তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, কাশীরাম দাসের মহাভারতের অনুবাদে (সপ্তদশ শতকের গোড়ায় রচিত; বিরাট পর্বের রচনাকাল ১৫২৬ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬০৪-৫ খ্রি:) বিস্তৃত আত্মকথা না থাকলেও নানা ভণিতা থেকে তাঁর কুলপরিচয়, পৈতৃক বাসস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। যেমন,

আদিপর্ব ভারথ গরুড় জন্মকথা। কাশীরাম দেব কহে পাঁচালির গাথা।।

এ থেকে বোঝা যায় তাঁর কৌলিক পদবি ছিল ‘দেব’। আর একটি ভণিতায় তাঁর বংশপরিচয় ও পৈতৃক বাসস্থানের নাম পাওয়া যায়:

কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিদ্ধিগ্রাম [বিশ্বভারতী পুথি সংখ্যা ১৭২০, পত্রাঙ্ক ৮৫/ক]। মহাভারতের আর একটি পুথির [বিশ্বভারতী পুথি সংখ্যা ৯২০, পত্রাঙ্ক ১৬১/খ] একটি ভণিতায় কবির পিতৃপুরুষের পরিচয় পাওয়া যায়:

ইন্দ্রানী নামেতে দেশ বাস সিদ্ধিগ্রামে। প্রিয়ঙ্কর দাসপুত্র সুধাকর নামে।।

তস্যজ কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা। কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।।

কবির প্রপিতামহ প্রিয়ঙ্কর, পিতামহ সুধাকর, পিতা কমলাকান্ত। কমলাকান্তের তিন পুত্র—জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণদাস, মধ্যম কালীদাস, কনিষ্ঠ গদাধর। অন্যদিকে মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গলে’ কবির বিস্তৃত আত্মকথা থাকলেও তাঁর বিভিন্ন ভণিতা থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলি তাঁর আত্মকাহিনিতে অনুপস্থিত। যেমন, ক্ষুদিরাম দাস সম্পাদিত কবিকঙ্কণ চন্ডীর একটি ভণিতায় পাই তাঁর পারিবারিক পরিচয় :

মহামিশ্র জগন্নাথ হৃদয় মিশ্রের তাত কবিচন্দ্র হৃদয়নন্দন।

তাহার অনুজ ভাই চন্ডীর আদেশ পাই বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কণ।। (পৃ: ৪৮)

ঐ সংস্করণের আর একটি ভণিতায় পাই তাঁর স্নেহভাজন আত্মীয়স্বজনের নাম :

উরহ কবির কামে কৃপা কর শিবরামে চিত্রলেখা যশোদা মহেশে।। (পৃ: ৪৯)

শিবরাম কবির পুত্র, চিত্রলেখা পুত্রবধূ, যশোদা কন্যা, মহেশ জামাতা।

ড. পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত মুকুন্দের ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যের একটি ভণিতায় কবির পুরাণচর্চা ও সঙ্গীতচর্চার সংবাদ পাওয়া যায় :

গুণিরাজ মিশ্রসুত সঙ্গীত কলায় রত বিচারিয়া অনেক পুরাণ।

দামিন্যা নগরবাসী সঙ্গীতের অভিলাষী শ্রীকবিকঙ্কণ রস গান।। (পৃ:৩)

ড. পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত ঐ সংস্করণের (পৃ.৬) একটি ভণিতায় কবি বলেছেন:

দুই গায়নের কান্ধে দিঞা পা। মূল গায়নে স্মরে উর চন্ডী মা।।

এ থেকে বোঝাই যায় যে, কবি নিজেই ছিলেন তাঁর কাব্যের মূল গায়ন, তাঁর সহকারী ছিলেন আর দুজন সহ-গায়ন বা দোহার।

এছাড়া পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত চন্ডীমঙ্গলে উল্লিখিত দুটি ভণিতা চমকপ্রদ :

১. রচিঞা ত্রিপদী ছন্দ গান কবি মুকুন্দ কৌসল্যানন্দন যার নাম।। (পৃ: ৭১)

২. দামিন্যা নগরে প্রভু রাম চক্রাদিত্য। শিশুকাল হৈতে তার সেবা কৈলা নিত্য।।

সেপ্রভুচরণ মনে ভাবি অনুক্ষণ। চন্ডিকামঙ্গল রচে শ্রীকবিকঙ্কণ।। (পৃ: ১৭৮)

এই ভণিতা দুটি থেকে মনে হয় কবি প্রথম জীবনে রাম-উপাসক ছিলেন।

যেসব পুথিতে ছোটো বা বড়ো কোনো রকম আত্মপরিচয় থাকে না, সেখানে একমাত্র ভণিতার মাধ্যমেই কবির নাম জানা যায়। যেমন, মনসামঙ্গলের কবি বিষ্ণুপালের কাব্যে কোনো আত্মপরিচয় নেই। শুধু ভণিতা থেকে জানা যায় যে, কাব্যটি বিষ্ণুপালের রচনা। এছাড়া কাব্যের মধ্যে ভণিতায় একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে :

সীতা দেবীপতি শ্রীরামচরণে গতি বিষ্ণুপালে পায় দেবীর বর।।

এই ভণিতা থেকে বোঝা যায় যে তিনি রাম-উপাসক ছিলেন।

অনুরূপভাবে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ২৪৯ সংখ্যক পুথিতে কবির কোনো আত্মকথা নেই। পুথির ভণিতা থেকে কবিনাম ও কবির বাসস্থানের নাম উদ্ধার করা যায়। পুথি খন্ডিত থাকায় পুথির নাম পাওয়া যায়নি, তবে অন্যসূত্রে সংকলক একে ‘ভারতীমঙ্গল’-এর পুথি বলে চিহ্নিত করেছেন।

১. কবিনাম-সূচক ভণিতা :

সুসঙ্গ নগর নাম তথা ভূপ অনুপাম শ্রীকিশোর সিংহ অভিধান।

গনপতি পদাম্বুজে ভণে তার অবরজে রাজসিংহ জাহার আখ্যান।।

২. বাসস্থান-সূচক ভণিতা :

সুন মাতা সরস্বতী করি তকে (র?) সত নতি রাখ মাতা চরণ সরোজে।

দুর্গাপুরে নিজধাম দ্বিজ রাজ সিংহ নাম ভণে ভূপতির অবরজে।।

মধ্যযুগের কোনো কোনো কবি নিজের কাব্যে ভণিতা ছাড়াও যে আত্মকথা যোগ করেছেন তার প্রধান উদ্দেশ্য পাঠক তথা শ্রোতাসমাজে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা ও কাব্যরচনার প্রেরণা হিসাবে দৈবাদেশ বা স্বপ্নাদেশের কল্পিত বৃত্তান্তের মাধ্যমে কাব্যে একটি অলৌকিক মহিমা সংযোজন। বাংলা ভাষার বিকাশের গোড়ার দিকে বাংলাভাষী কবিরা মাতৃভাষায় কাব্য লিখতেন না। কারণ তখন সমাজে লেখ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃত ছিল সংস্কৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশ ভাষা। বিশেষ করে রাজদরবারের কবিরা বাংলাভাষী হলেও কাব্য লিখতেন সংস্কৃত ভাষায়। যেমন, পাল রাজদরবারের কবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ কাব্য লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায় এবং লক্ষ্মণ সেনের রাজসভাকবি জয়দেবও ‘গীতগোবিন্দ’ লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়। তাছাড়া ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ভাগবতে’র মতো পুরাণ-সম্পৃক্ত কাব্য সংস্কৃত ছাড়া অন্য লৌকিক ভাষায় পড়া ও লেখার ব্যাপারে সমাজে নিষেধাজ্ঞা ছিল কঠোর। বলা হত : ‘ভাষায়াং রামায়ণং শ্রুত্বা রৌরবং নরকং গচ্ছেৎ’—লৌকিক ভাষায় রামায়ণ শুনলে রৌরব নরকে যেতে হবে। নরকের ভয় শুধু রামায়ণের ক্ষেত্রেই নয়। উচ্চবর্ণের কবিরা লৌকিক ভাষায় যে কোনো কাব্য লিখতেই পাপের ভয় পেতেন। তুর্কি আগমনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। তুর্কি আগমনের পর বাঙালি হিন্দুসমাজে ব্যাপক ধর্মান্তরণের ঢেউ লাগল। সমাজপতিরা দেখলেন হিন্দু পুরাণের কথা এবার সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করতে হবে। শুরু হল ভাগবত ও রামায়ণের বঙ্গানুবাদ, কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রচ্ছন্ন পাপবোধের সংস্কার তাঁদের মনে কুন্ঠার সৃষ্টি করতে লাগল। তাই উচ্চবর্ণীয় হওয়া সত্ত্বেও বাংলায় লেখার জন্য তাঁরা কাব্যে কৈফিয়ত দিতে লাগলেন : ‘লোক নিস্তারিতে কহি লৌকিকের ভাষে’ (মালাধর বসু)। রামায়ণের অনুবাদক কৃত্তিবাস বললেন :

সাত কান্ডের কথা হয় দেবের সৃজিত। লোক বুঝাইতে কৈলা কৃত্তিবাস পন্ডিত।।

কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কবিরা আত্মপরিচয় দেওয়ার প্রেরণা বোধ করলেন। কারণ আত্মপরিচয় দান উপলক্ষ্যে কবিরা জানাতে পারবেন তাঁরা বাধ্য হয়ে বাংলায় লিখলেও তাঁরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্তবংশীয়। তাছাড়া, কাব্যরচনার পেছনে একদিকে যেমন পৃষ্ঠপোষক রাজা বা ভূস্বামীর আদেশ ছিল, অন্যদিকে তেমনি দৈবাদেশও ছিল যা লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। এই কৈফিয়ত দেওয়ার প্রবণতা শুধু রামায়ণ বা ভাগবতের অনুবাদের ক্ষেত্রেই নয়, মঙ্গলকাব্যের মতো অন্যান্য আখ্যান কাব্যের ক্ষেত্রেও দেখা গেল। বাংলা লেখার ব্যাপারে উচ্চবর্ণীয় কুন্ঠা দূর হয়েছিল চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর। কারণ তিনি সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত হয়েও বাংলা পদাবলী গেয়েছেন, বাংলায় হরিনাম কীর্তনে উৎসাহ দিয়েছেন। ফলে মাতৃভাষায় তাঁর ভক্তি-আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চার একটা ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেল। তবে আত্মকথা রচনা এবং তাতে দৈবাদেশ প্রাপ্তির বর্ণনার প্রথা চৈতন্যোত্তর যুগেও অব্যাহত রইল। বাংলায় কাব্যরচনার ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন পাপবোধ ও তা থেকে মুক্তির জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার প্রবণতা শুধু হিন্দু কবিদের মধ্যেই নয়, মুসলমান কবিদের মধ্যেও দেখা দিল। পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে গৌড়ের সুলতান গিয়াসু-দ-দীন আজম শাহের অনুগৃহীত কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যের গোড়ায় সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছেন :

চতুর্থে কহিমু কিছু পোথার কথন। পাপভয় এড়ি লাজ দড় করি মন।।

গুণিয়া দেখিলু আহ্মি ইহ ভয় মিছা। ন হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা।।

শুনিয়াছি মহাজনে কহিতে কথন। রতন ভান্ডার মধ্যে বচন সেধন।।

বচন রতন মণি জতনে পুরিয়া। প্রেমরসে ধর্মবাণী কহিমু ভরিআ।।

পুরাণ কোরান মধ্যে দেখিলুঁ বিশেষ। ইছুফ জলিখা বাণী অমৃত অশেষ।।

কহিমু কিতাব চাহি সুধারস পুরি। সুনহ ভকত জন শ্রুতিঘট ভরি।।

দোষ খেম গুণ ধর রসিক সুজন। মোহাম্মদ ছগির ভণে প্রেমক বচন।।

(ড. মুহম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত, পৃ: ৪-৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৪)।

ফকির গরীব উল্লাহ তাঁর ‘আমির হামজা’ কাব্যে (১৭৬৬ খ্রি:) লিখেছেন :

আমির হামজা কিশ্চা (চ্ছা) ফারসি কিতাব। না বুঝিআ লোকের মনেত পাই তাব (প)।।

বঙ্গেত ফারসি ন জানএ সব লোকে।….

এই হেতু সেই কথা মুঞি রছিবার। নিজবুদ্ধি চিন্তি মনে কৈলুম অঙ্গিকার।।

মুছলমানি কথা দেখি মনেহ ডরাই। রচিলে বাঙ্গালা ভাসে কোপে কি গোঁসাই।।

লোক উপকার হেতু তেজি সেই ভএ। দরভা (বা) রে রছিবারে ইচ্ছিলুম হৃদএ।।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুথি ৬০৭)

শেখ মুতালিব তাঁর ‘কিফায়তুল মুসল্লিন’ পুথি (ঢা. বি. ৫৭৮)-তে লিখেছেন (রচনাকাল ১৬৩৮ খ্রি):

আরবিত সকলে না বুজে ভালমন্দ। তেকারণে বাঙ্গালা রচিলুম পদবন্দ।।

মুছলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুম। বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চএ জানিলুম।।

কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে। বুঝিআ মুমিনে দোআ করিব আমারে।।

সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নছিয়ত নামা’ (ঢা.বি. পুথি ৪৫৬)য় বলেছেন :

আরবী পড়িয়া বুঝ শাস্ত্রের বচন। জতেক এলেম মৈদ্দে আরবী প্রধান।।

আরবী পড়িতে যদি না পার কদাচিত। নিজ দেশী ভাসে সাস্ত্র পড়িতে উচিত।।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে কবিদের আত্মকথা সংযোজনের কারণ কী তা এতক্ষণ নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হল। এবার একালের পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে এইসব আত্মকথার সাক্ষাৎ পরিচায়নের জন্য কয়েকটি নির্বাচিত আত্মকথা উদ্ধৃত করা হবে। প্রথমে একটি ছোটো অথচ যথাযথ উদাহরণ। এটি ড. মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া সম্পাদিত বিরলপ্রচার ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্য (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৩) থেকে উদ্ধৃত। এই কাব্যের রচয়িতা কবি শ্রীরায় বিনোদ (আসল নাম ‘শ্রীরাম’) ষোড়শ শতকে পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলার আটিয়া পরগনার অন্তর্গত টাঙ্গাইল এলাকার ধোবড়িয়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। পিতা শতানন্দ ছিলেন গ্রামের জমিদার। প্রথমে ‘আত্মপরিচয় ও গ্রন্থোৎপত্তি’:

বঙ্গদেশে আটিয়া কেবল ভোগস্থল। ধোবড়িয়া নামে গ্রাম অতি মনোহর।।

ব্রাহ্মণ সজ্জন বৈশ্য পন্ডিত ব্রহ্মচারী। সদাচার পুণ্যরত পবিত্র গুণশালী।।

ভাগবত পুরাণ সভে করএ শ্রবণ। কৃষ্ণভক্তি বিনা যার অন্য নাহি মন।।

ধার্মিক সকল লোক অতি সত্যবাদী। গ্রামের পশ্চিমে আছে লোহজঙ্গ নদী।।

ব্রহ্মপুত্রের মুখ্যধারা অতি পুণ্য জল। স্নান কৈলে দূর হএ পাতক সকল।।

পুণ্যবস্তু সর্বলোক বিষ্ণুভক্তি মন। অধিকারী রায় কেবল পুণ্যজন।।

বিষ্ণুভক্তি শুদ্ধমতি পূজেন ব্রাহ্মণ। রাম কৃষ্ণ নাম বহি নাহি অন্য মন।।

জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী গুণের নিধান। দানধর্ম দয়াশীল অতি পুণ্যবান।।

কমলাক্ষ সেনের পুত্র নাম শতানন্দ। ধর্মরায় নাম তার রাজার প্রবন্ধ।।

তাহার তনয় শ্রীরাম নাম ধরে। শ্রীরায় বিনোদ কবি সর্বলোকে বোলে।।

নিশাতে বুলিলা স্বপ্নে শঙ্কর কুমারী। পদ্মাপুরাণ পোথা রচিতে পাঁচালী।।

নানা দিশা নানা ভাষা নানাবিধি ছন্দ।  আজ্ঞা কৈলা ব্রহ্মাণী রচিতে পদবন্ধ।।

আমার মাহিত্য জেন গাএ সর্বজন। রচহ পাঁচালী তুমি পুরাণ কথন।।

মুঞি আজ্ঞা কৈলুঁ তোরে সদয় হইয়া। শুদ্ধপদ বুলিব আমি তোর কন্ঠে রৈয়া।।

শুনিয়া সানন্দ জেন হএ সর্বজন। রচহ পাঁচালী তুমি পুরাণ কথন।।

ব্রহ্মাণীর চরণে করিয়া নমস্কার। শ্রীরায় বিনোদে ভণে সরস পয়ার।। (পৃ: ৫-৬)

(টীকা: রাজার প্রবন্ধ—রাজপ্রদত্ত সম্মানসূচক উপাধি। মাহিত্য—মাহাত্ম্য।)

এরপর কাব্যে অলৌকিক মাহাত্ম্য সংযোজন হিসাবে ‘পদ্মামাহাত্ম্য ও পাঁচালী শ্রুতিফল’;

পদ্মার চরিত্র পদ্মাপুরাণের সার। রচিব পাঁচালী আমি মধুর সুসার।।

পদ্মপুরাণ পোথা নানা ইতিহাস। শ্রীরায় বিনোদে তাহা করিল প্রকাশ।।

অষ্টাদশ পুরাণ মধ্যে পদ্মাপুরাণ সার। পড়িলে সুনিলে হএ সর্বত্র সুসার।।

পঞ্চ মহাপাতক আদি জত পাপ হএ। পড়িলে শুনিলে সব পাপ হএ ক্ষয়।।

বিষ্ণুভক্তি হএ তার ঘুচএ আপদ। পদ্মার মাহিত্যে বাড়ে অতুল সম্পদ।।

মনসার গীতকীর্তন করএ জেহি জন। রাজপদ হএ তার বাড়ে ধনজন।।

যমের ভয় তার নাহি জ্ঞহএঞ্চ কোন কালে। দেবীর প্রসাদে লোক স্বর্গভোগ করে।।

দরিদ্রের দারিদ্র্য ঘুচে আরোগ্য হএ রোগী। দেবীর কৃপায় লোক হএ সুখভোগী।।

ব্রহ্মাণীর মাহিত্য কহি শুন সর্বজন। বিপদ বিনাশ হএ বন্ধন মোচন।।

ব্রাহ্মণে শুনিলে মুক্তি পাএ সুনিশ্চিত। খেত্রিএ শুনিলে বলবীর্য বাড়ে নিত।।

বৈশ্য শুনিলে হএ ধন অধিকারী। শূদ্রে শুনিলে তার বাড়ে ঠাকুরালি।।

সামান্যে শুনিলে তার খন্ডএ আপদ। অন্তে স্বর্গবাস ইহলোকেত সম্পদ।।

মনসার চরণে ভক্তি করে জেহি জন।  কামনা করিয়া করে গীতকীর্তন।।

দেবীর প্রসাদে তার কামনা সিদ্ধি হএ। দেবীর চরণ ভজ সানন্দ হৃদয়ে।।

নানা রঙ্গ নানা ছন্দ পুরাণ কথন। মনসার চরিত্র কহি শুন সর্বজন।।

দধি মথিলে জেন ঘৃত পাএ সার। পদ্মার চরিত্র তেন পুরাণ মাঝার।।

ইক্ষুদন্ডের রস কিবা অমৃতের ধার। শ্রীরায় বিনোদে ভণে সরস পয়ার।।

পদ্মাপুরাণ পোথা পদে পদে রঙ্গ। মন দিয়া শুন নরে জে পড়ে প্রসঙ্গ।। (পৃ:৬-৭)

[টীকা: সুসার ® ১. সর্বোত্তম; ২. সুবিধাজনক। ঠাকুরালি ® সম্মান।]

এরপর পঞ্চদশ শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝার বহুচর্চিত আত্মকথা। এই আত্মকথার নানা পাঠান্তর আছে। আমরা সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কবিদের পরিচয় ও সময়’ গ্রন্থে (২০০৬) উদ্ধৃত ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর পাঠের একটি দীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করলাম :

পূর্ব্বেতে আছিল বেদানুজ মহারাজা। তার পুত্র আছিল নারসিংহ ওঝা।।

দেশের উপান্ত ব্রাহ্মণের অধিকার। বঙ্গভোগ ভুঞ্জিলেক সংসারের সার।।

বঙ্গদেশে প্রমাদ পড়িল হইল অস্থির। বঙ্গদেশ ছাড়ি ওঝা আইল গঙ্গাতীর।।

শুভ ভোগ কর‌্যা বিহরয় গঙ্গাকুলে। বসত করিতে স্থান ব্রাহ্মণ খুজ্যা বুলে।।

গঙ্গাতীরে দান্ডায়্যা ব্রাহ্মণ চতুর্দ্দিগে চাই। রাত্রিকাল হইল ওঝা শুতিল তথাই।।

পোহাইতে আছে যখন দন্ডেক রজনি। ব্রাহ্মণের মুখে শুনি কু:কুরের ধ্বনি।।

কু:কুরের ধ্বনি শুনি ওঝা চারিদিকে চাহে। আকাশবাণী হয়্যা তথা গোসাঞি যে রহে।।

মালীজাতি ছিল পূর্ব্বে মালঞ্চেতে থানা। ফুলিয়া বলিয়া কৈল তাহার ঘোষণা।।

গ্রামরত্ন ফুলিয়া যে জগতে বাখানি। দক্ষিণ-পশ্চিম চাপ্যা বহেন গঙ্গা সোনি।।

ফুলিআ চাপিআ হইল তাহার বসতি। ধনে ধান্যে পুত্র পৌত্রে বাড়য় সন্ততি।।

গর্ভেশ্বর নামে পুত্র হইল তাহার আলয়। মুরারি সূর্য্য গোবিন্দ তাহার তনয়।।

জ্ঞানেতে কুলেতে শীলে মুরারি ভূষিত। সাত পুত্র হইল তার সংসারে বিদিত।।

জ্যেষ্ঠ পুত্র হইল তার নাম যে ভৈরব। রাজার সভায় তার অধিক গৌরব।।

মহাপুরুষ মুরারি জগতে বাখানি। ঠাকুরাল ধর্ম্মচরিত্র গুণে মহাগুণী।।

মদন আলাপে ওঝা সুন্দর মূরতি। মার্কণ্ড ব্যাস আছেন শাস্ত্রে অবগতি।।

সুস্থির ভাগ্যবান তথি বনমালী। প্রথম বিভা কৈল ওঝা কুলেতে গাঙ্গুলি।।

কুলে শীলে ঠাকুরালে গোসাঞির প্রসাদে। মুরারি পুত্র সব বাড়এ সম্পদে।।

মাতা পতিব্রতার যশ জগতে বাখানি। ছয় সহোদর হইল এক যে ভগিনী।।

সংসার আনন্দ লয়া আইল কৃত্তিবাস।  ভাই মৃত্যুঞ্জয় ষড়রাত্রি উপবাস।।

সহোদর শান্তিমাধব সর্র্ব্ব্যুলোকে ঘুসি। শ্রীকর ভাই তার নিত্য উপবাসী।।

বলভদ্র চতুর্ভুজ নামেতে ভাস্কর। আর এক বহিনি হইল সতাই উদর।।

মালিনী নামেতে মাতা বাপ বনমালী। ছয় ভাই উপজিল সংসার গুণশালী।।

আপনার জন্মরস কহিব যে পাছে। মুখটি বংশের কথা আর কহিতে আছে।।

সূর্য্য পন্ডিতের পুত্র হইল নামে বিভাকর। সর্ব্বত্র জিনিঞা পন্ডিত বাপের সোসর।

সূর্য্যপুত্র নিশাপতি বড় ঠাকুরাল। সহস্রসংখ্য লোক রয় যাহার দুয়ার।।

রাজা গৌড়েশ্বর দিল প্রসাদ ঘোড়া। পাত্রমিত্র সকলে দিলেন খাসা জোড়া।।

গোবিন্দ জয় আদিত্য ঠাকুর বড়ই সুন্দর। বিদ্যাপতি রুদ্র ওঝা তাহার কোঙর।।

ভৈরব সুত গজপতি বড় ঠাকুরাল। বারাণসী পর্যন্ত কীর্ত্তি ঘুষএ সংসার।।

মুখটি বংশের পদা শাস্ত্র অনুসার। ব্রাহ্মণে সজজনে শিখে যাহার আচার।।

কুলে শীলে ঠাকুরালে ব্রহ্মস্বজ্য গুণে। মুখটি বংশের কথা কত কব জনে জনে।।

আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস। তথি মধ্যে জন্মিলেন পন্ডিত কৃত্তিবাস।।

শুভক্ষণে গর্ভে থাকি পড়িলাম ভূতলে। উত্তম বস্ত্র দিআ পিতামহ আমা কৈল কোলে।।

দক্ষিণ যাইতে নাম রাখিল কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস বলিয়া নাম করিল প্রকাশ।।

এগার নীবড়ে যখন বারতে প্রবেশ। হেন বেলা পড়িতে গেল্যাম উত্তর দেশ।।

বৃহস্পতিবারের উষা পোহালে শুক্রবার। বারান্তর উত্তরে গেল্যাম বড় গঙ্গা পার।।

তথায় করিনু আমি বিদ্যার উদ্ধার। যথা যথা পাইলাম আমি বিদ্যার প্রচার।।

সরস্বতী অধিষ্ঠান আমার কলেবর। নানা ছন্দে নানা ভাষ বিদ্যার প্রসর।।

আকাশবাণী হইল সাক্ষাৎ সরস্বতী। তাহার প্রসাদে কন্ঠে বৈসেন ভারতী।।

বিদ্যাসাঙ্গ হইল প্রথম করিল মন। গুরুকে দক্ষিণা দিয়া ঘরকে গমন।।

ব্যাস বশিষ্ঠ যেন বাল্মীকি চ্যবন। হেন গুরুর ঠাঞি আমার বিদ্যার প্রসন।।

ব্রহ্মার সদৃশ গুরু মহা উর্ম্মাকার। হেন গুরুর ঠাঞি কৈল বিদ্যার উদ্ধার।।

গুরুকে মেলানি কৈল মঙ্গলবার দিসে। গুরু প্রশংসিলা মোরে অশেষ বিশেষে।।

সাত শ্লোকে ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বর। সিংহময় রাজা আমি করিলাম গোচর।।

সপ্তঘটী বেলা যখন দিয়ানে’ পড়ে কাটী। শীঘ্র ধায়্যা আইল দূত হাথে সুবর্ণ লাটী।।

কাহার নাম ফুলিয়ার পন্ডিত কৃত্তিবাস। রাজার আদেশ হইল করহ সম্ভাষ।।

নয় বৃহন্দ গেল্যাম রাজার দুয়ার। সোনা রূপার ঘর দেখি মনে চমৎকার।।

রাজার ডাহিনে আছে পাত্র জগতানন্দ। তাহার পাছে বস্যা আছেন ব্রাহ্মণ সুনন্দ।।

বামেতে কেদার খাঁ ডাহিনে নারায়ণ। পাত্রমিত্রে বস্যা রাজা পরিহাসে মন।।

গন্ধর্ব রায় বসি আছে গন্ধর্র্ব্ব্যু অবতার। রাজসভা পুজিত তিহোঁ গৌরব অপার।।

তিন পাত্র দান্ডাইয়া আছে রাজপাশে। পাত্রমিত্রে বস্যা রাজা করে পরিহাসে।।

ডাহিনে কেদার রায় বামেতে তরুণী। সুন্দর শ্রীবৎস্য আদি ধর্ম্মাধিকারিণী।।

মুকুন্দ রাজার পন্ডিত প্রধান সুন্দর। জগদানন্দ রায় মহাপাত্র কোঙর।।

রাজা সভাখান যেন দেব অবতার। তখন আমার চিত্তে লাগে চমৎকার।।

পাত্রেতে বেষ্টিত রাজা আছে বড় সুখে। অনেক লোক দান্ডায়্যাছে রাজার সমুখে।।

চারিদিকে নাটগীত সর্বলোকে হাসে। চারিদিকে ধাওয়াধাই রাজার আওয়াসে।।

আঙ্গিনায় পাতিয়াছে রাঙ্গা মাজুরি। তথির উপর পাতিয়াছে পাট নেত তুলি।।

পাটের চাঁন্দয়া শোভে মাথার উপর। মাঘ মাসে খরা পোহায় রাজা গৌড়েশ্বর।।

দান্ডাইলাম গিয়া আমি রাজার বিদ্যমান। নিকট যাইতে রাজা মোরে দিলা হাথ সান।।

রাজা আজ্ঞা কৈল পাত্র ডাকে উচ্চস্বর। রাজার নিকটে আমি চলিলাম সত্বর।।

রাজার ঠাঞি দান্ডাইলাম হাথ চারি আন্তর। সাত শ্লোক পড়িলাম শুনে গৌড়েশ্বর।।

পঞ্চদেব অধিষ্ঠান আমায় কলেবরে। সরস্বতী প্রসাদে আমার মুখে শ্লোক স্বরে।।

নানা ছন্দে শ্লোক আমি পড়িয়ে সভায়। শ্লোক শুন্যা গৌড়েশ্বর আমা পানে চায়।।

নানা মতে নানা শ্লোক পড়িলাম রসাল। খুশি হইয়া মহারাজা দিল পুষ্পমাল।।

কেদার খাঁ শিরে ঢালে চন্দনের ছড়া। রাজা গৌড়েশ্বর দিলা পাটের পাছাড়া।।

রাজা গৌড়েশ্বর বলে কিবা দিব দান। পাত্রমিত্র বলে গোসাঞি করিলে সম্মান।।

পঞ্চগৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা। গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা।।

পাত্রমিত্রে সভে বলে শুন দ্বিজরাজে। যত খুজ তত দিতে পারে মহারাজে।।

যথা যথা যাই আমি গৌরবমাত্র সার। কার কিছু নাঞি লই করি পরিহার।।

আকৃতি প্রকৃতি আমি যত অস্থিতি। পাটপাছড়া পাইনু আমি চন্দনে ভূসিতি।।

ধন আজ্ঞা কৈলে রাজা ধন নাঞি লই। যথা যথা যাই আমি গৌরব যে চাহী।।

যত যত মহাপন্ডিত আছয়ে সংসারে। আমার কবিত্ব কেহ নিন্দিতে না পারে।।

প্রসাদ পাইয়া বাহির হইনু রাজার দুয়ারে। অপূর্ব জ্ঞানে ধায় লোক আমা দেখিবারে।।

চন্দনে ভূষিত আমি লোকে আনন্দিত। লোকে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পন্ডিত।।

মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি। পন্ডিতের মধ্যে বাখানি কৃত্তিবাস গুণী।।

বাপ মাএর আশীর্ব্বাদ গুরুর কল্যাণ। বাল্মীকি প্রসাদে রচে রামায়ণ গান।।

সাত কান্ডের কথা হয় দেবের সৃজিত। লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পন্ডিত।।

[টীকা : আর এক বহিনি হইল সতাই উদর—বৈমাত্রেয় ভগিনী। বাপের সোসর—পিতার সমতুল্য। কোঙর—কুমার, পুত্র। ঠাকুরাল—সম্মান। ব্রহ্মস্বজ্য—ব্রহ্মচর্য্য। দক্ষিণ যাইতে—মৃত্যুকালে (দক্ষিণ যাত্রা—পরলোকগমন)। এগার নীবড়ে—এগার বছর পূর্ণ করে। উর্ম্মাকার—শুদ্ধ পাঠ ‘উষ্মাকার’—তেজস্বী। মেলানি—বিদায়। সপ্তঘটী বেলা—‘সকাল সাড়ে নয়টার মতো সময়’ (সুখময় মুখোপাধ্যায়)। দিয়ানে—রাজসভায়। বৃহন্দ—মহল। ধাওয়াধাই—ছুটোছুটি। মাজুরি—মাদুর। নেত—রেশমি কাপড়। হাথ সান—হাতছানি, ইশারা। করি পরিহার—নমস্কার করি। এগার নীবড়ে… রাজা আমি করিলাম গোচর—এই বিবরণ অনুসারে Indian Ephemeries (Vol. v, p. 88-110)-এর ভিত্তিতে সুখময় মুখোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত করেছেন, ‘‘কৃত্তিবাস ১৪৪৩ খ্রি:-র ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা হন এবং ১৪৬৫ থেকে ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে তিনি গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দীন বারবক শাহের সভায় গিয়ে তাঁর কাছে সংবর্ধনা লাভ করেন’’ (পৃ: ১৭১)। [পূর্বোক্ত Ephemeries-এ দেখা যায় ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি ছিল শুক্লাপঞ্চমী রবিবার। এগারো বছর পর ৪ঠা জানুয়ারি ছিল শুক্রবার শ্রীপঞ্চমী] কৃত্তিবাসের এই আত্মকথায় একদিকে যেমন মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি কৃত্তিবাসের ব্যক্তিত্বের নম্র তেজস্বিতা ও গভীর আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানেই এই আত্মকাহিনির বিশিষ্টতা।

এরপর ষোড়শ শতকের চন্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর আত্মকথা। এটি ড. পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত চন্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে উদ্ধৃত (পৃ:৭-৮)

‘শুন ভাই সভাজন কবিত্বের বিবরণ এহি গীত হৈল জেনমতে।

উরিঞা মাএের বেশে কবির শিহর দেশে চন্ডিকা বসিল্যা আচম্বিতে।।

শহর সিলিমাবাজ তাহাতে সজজনরাজ নিবসে নিওগী গোপীনাথ।

তাহার তালুকে বসি দামিন্যায় করি কৃষি মিরাস পুরুষ ছয় সাত।।

ধন্যরাজা মানসিংহ  বিষ্ণুপদাম্বুজভৃঙ্গ গৌড়বঙ্গ উৎকল মহীপ।

রাজা মানসিংহ গেলে প্রজার পাপের ফলে বিলাত পাইল মামুদ শরিফ।।

উজীর হৈল রায়জাদা বেপারিয়া ভাবে সদা ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবে হৈল অরি।

মাপে কোণে দিয়া দড়া পনের কাঠায় কুড়া নাহি মানে প্রজার গোহারি।।

সরকার হৈল কাল  খিলভূমি লিখে লাল বিনি উপগারে খাএ ধুতি।

পোতদার হইল যম টাকায় আড়াই আনা কম পাই লভ্য খায় তঙকা প্রতি।

মিথ্যা হে জগাতি ভন্ড পরদ্রব্য করে দন্ড টাকা নেই দিবস দুপুরে।

বিষম রাজ্যের লোক পরধন খাইতে জোঁক দেখি দেখি নিত্য বিত্ত হরে।।

ডিহিদার অজব খোজ টাকা দিলে নাহি রোজ ধান্য গরু কেহ নাঞি কিনে।

প্রভু গোপীনাথ নন্দী বিপাকে হৈলা বন্দী কোন হেতু নহে পরিত্রাণে।।

জানদার প্রতি নাছে প্রজারা পলায় পাছে দুয়ার চাপিঞা দেই থানা।

প্রজা হঞা ব্যাকুলি বেচে ঘর কুটিআলি টাকাকের দ্রব্য দশআনা।

সহায় শ্রীমন্ত খাঁ চন্ডীবাটী যার গাঁ যুক্তি কৈল গম্ভীর খাঁ সনে।

দামিন্যা ছাড়িয়া যাই সঙ্গে রমানাথ ভাই পথে চন্ডী দিলা দরশনে।।

ভেলিঞাতে উপনীত রূপরায় নিল বিত্ত  যদুকুন্ডু তিলি কৈল রক্ষা।

লইঞা আপনার ঘর নিবারণ কৈল ডর  তিন দিবসের দিল ভিক্ষা।।

পারাইঞা মুড়াই নদী সদাই সোঙরি বিধি কেঙুট্যায় হৈনু উপনীত।

দারুকেশ্বর তরি পাইলু পাতুলপুরী গঙ্গাদাস বড় কৈল হিত।।

না বাহে পরাশর এড়াইল আমোদর উত্তরিল গোচড়্যা নগরে।

তৈল বিনু কৈনু স্নান করিলুঁ উদক পান  শিশু কান্দে ওদনের তরে।।

আশ্রয় পোখরিআড়া নৈবেদ্য শালুকনাড়া পূজা কৈল কুমুদ প্রসূনে।

ক্ষুধা ভয় পরিশ্রমে  নিদ্রা যাই সেই ধামে চন্ডী দেখা দিলেন স্বপনে।।

করিঞা পরম দয়া  দিঞা চরণের ছায়া  আজ্ঞা দিলা রচিতে সঙ্গীত।

হাতে লৈঞা পত্রমসী আপনি কলমে বসি নানা ছান্দে লিখিত কবিত্ব।।

পড়্যাছি অনেক তন্ত্র নাহি তথা সেই মন্ত্র মহামন্ত্র জপি নিত্য নিত্য।

চন্ডীর আদেশ পাই শিলাই তরিয়া যাই আরড়ায় হৈলুঁ উপনীত।।

আরড়া ব্রাহ্মণভূমি ব্রাহ্মণ জাহার স্বামী নরপতি ব্যাসের সমান।

পড়িঞা কবিত্ববাণী সম্ভাষিল নৃপমণি রাজা দিল দশ আড়া ধান।।

সুধন্য বাঁকুড়া রায় ভাঙ্গিল সকল দায় সুত পাঠে কৈলা নিয়োজিত।

তার সুত রঘুনাথ বহু গুণে অবদাত গুরু বল্যা করিল পূজিত।।

দুলাল সিংহের সুতা দনা দেবী পাটমাতা কুলেশীলে গুণে অবদাত।

তার সুত নৃপরত্ন করিল বহুত যত্ন বৈরিশূন্য দেব রঘুনাথ।।

আমন নূতন ধান কত আছে স্থানে স্থান বান্ধিলু ধাগালি সাজনুনি।

থাকিতে এসব দান না করিঞা অনুমান আগুয়ান কাল্যাধান বুনি।।

কি আর কহিব কাজ কহিতে বড়ই লাজ গীত না করিয়া মৈল্যা ছাল্যা।

শুন রঘু নরপতি দুঃখে কর অবগতি আকালে বিকাল্য মোর হাল্যা।।

সঙ্গেতে দামাল নন্দী সেজানে স্বপনসন্ধি অনুদিন করএ যতন।

নিত্য দেয় অনুমতি রঘুনাথ নরপতি গায়নেরে দিলেন ভূষণ।।

আরড়া উচিত ভূমি  পুরুষে পুরুষে স্বামী সেবক গোপাল কামেশ্বর।

দ্বিগুণ করিয়া আশে নৃপতির অভিলাষে গাইল মুকুন্দ কবিবর।।

অষ্টমঙ্গলা সায় শ্রীকবিকঙ্কণ গায় শ্রীকামেশ্বরের মন্দিরে।

চারি প্রহর রাতি জ্বালিঞা ঘৃতের বাতি গায়ন প্রসাদের আদরে।।

বিক্রমদেবের সুত গান করে অদ্ভূত বাখান করএ সর্বজন।

তাল মানে বিজ্ঞ দড় বিনয় সুন্দর বড় নতিমান মধুর বচন।।

বীর মাধবের সুত রূপে গুণে অদ্ভূত বীর বাঁকুড়া ভাগ্যবান।

তার সুত রঘুনাথ রাজগুণে অবদাত বারভুইঞা যার করে মান।।

কানে সোনা করে বালা গলে দিল কন্ঠমালা করাঙ্গুলি রতন ভূষণ।

শিরে পাগ পরিতে জোড়া দিল চড়নের ঘোড়া গায়নের যত আবরণ।।

ধন্য রাজা রঘুনাথ কুলে শীলে অবদাত প্রকাশিল নূতন মঙ্গল।

তাঁহার আদেশ পান শ্রীকবিকঙ্কণ গান সমভাষা করিয়া কুশল।’’

[টীকা: মিরাস—বাসস্থান ও ভূ-সম্পত্তির বংশানুক্রমিক অধিকার। বিলাত—রাজপাট, শাসনের অধিকার। রায়জাদা—রাজপুত্র। মাপে কোণে… পনর কাঠায় কুড়া—কুড়া = বিঘা। জমি কোণাকুণি মেপে পনেরো কাঠার জমি এক বিঘা দেখায়, যেখানে এক বিঘা হয় কুড়ি কাঠায়। গোহারি—কাতর অনুনয়। সরকার—রাজকর্মচারী। খিলভূমি—অনুর্বর জমি। লাল—উর্বর জমি। খাএ ধুতি—ঘুষ খায়। পোতদার—মুদ্রার মূল্য পরীক্ষক, মহাজন। টাকায় আড়াই আনা কম—টাকার মূল্য আড়াই আনা কম দেখায়। পাই লভ্য খায় তঙ্কা প্রতি—প্রতি তঙ্কা (টাকা)-য় এক পাই করে জরিমানা নেয়। জগাতি—শুল্ক আদায়কারী কর্মচারী। টানা নেই—টানা (উৎকোচ) নেয়। খোজ—একগুঁয়ে, নিষ্ঠুর। টাকা দিলে নাহি রোজ—টাকা দিয়েও রোজকার জোগান পাওয়া যায় না। জানদার—পাহারাদার। নাছে—সদর রাস্তায়, রাজপথে। থানা—পাহারা, চৌকি। বেচে ঘর কুটিআলি টাকাকের দ্রব্য দশআনা—টাকার (-ষোলো আনা)-র জিনিস দশ আনা দরে ঘরদোর বেচে দেয়। (কুটিআলি-কুঁড়েঘর)। দনা দেবী পাটমাতা—দনা একধরনের সুগন্ধি পুষ্প, এই পুষ্পের নামে রানির নাম। পাটমাতা—প্রধান রাজমাতা। গীত না করিয়া মৈল্যা ছাল্যা…আকালে বিকাল্য মোর হাল্যা।। কবি চন্ডীর গীতরচনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে তাঁর পুত্রের অকালমৃত্যু হয় এবং আকালে হালের গোরু বিক্রি হয়ে যায়। তাই এবার ‘দ্বিগুণ করিয়া আশে নৃপতির অভিলাষে গাইল মুকুন্দ কবিবর’।।]

এরপর সপ্তদশ শতকের দুটি কাব্যের কবিদের আত্মকথা। প্রথমে মনসামঙ্গলের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্য (রচনাকাল ১৫৬০ শকাব্দ বা ১৬৩৮ খ্রি:)। এটি শ্রীঅক্ষয়কুমার বড়াল ও চিত্রা দেব সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে উৎকলিত (পৃ:৫-৭)

‘‘শুন ভাই পূর্ব্বকথা দেবী হৈলা বরদাতা সহায়পূর্ব্বক বিষহরী।

বলিভদ্র মহাশয় চন্দ্রহাস সম হয় তাহার তালুকে ঘর করি।।

তাহার রাজত্ব শেষ  চলি গেলা স্বর্গদেশ  তিন পুত্রে দিয়া অধিকার।

শ্রীযুত আস্কর্ণরায় গুণের অবধি তায় রণে বনে বিজই যাহার।।

তিন পুত্র অল্পবয় প্রসাদ গুরু মহাশয় তালুকের করে লিখাপড়া।

তাহার কলমবশে প্রজা নাঞি চাষ চষে  শমনঘর হইল কাথড়া।।

রণে পড়ে বারা খাঁ  বিপাকে ছাড়িব গাঁ যুক্তি করে জননী-জনক।

দিন কম ছাড়্যা যাই তবে সেনিস্তার পাই দেয়ানে হইল বড় ঠক।।

শ্রীযুত আস্কর্ণ রায় অনুমতি দিন নায় যুক্তি দিল পলাবার তরে।।

শুনহ মণ্ডল তুমি উপদেশ কহি আমি গ্রাম ছাড় রাত্রির ভিতরে।।

প্রসাদ তাহার পাত্র  ইঙ্গিত পাইল মাত্র পলাইল শঙ্কর মণ্ডল।।

প্রসাদ হরিষ হয়্যা যুক্তি দিল আশ্বাসিয়া ধান্য কিছু দিলেন সম্বল।।

নিজগ্রাম ছাড়্যা যাই জগন্নাথপুর পাই হেনকালে নিশি অবসান।

তথা তেলি লম্বোদর উত্তরিতে দিল ঘর চালু হাঁড়ি সিধা গুয়া পান।।

রাজা বিষ্ণুদাসের ভাই তাহারে ভেটিতে যাই নাম তার রায় ভারামল।

তিনি দিলা ফুলপান আর গ্রাম পাঁচ খান বসতি করিতে দিলা স্থল।।

এইরূপে কথ দিন আশ্রমে সম্বল হীন কপালে কি লিখিল বিধাতা।

শুন পুত্র ক্ষেমানন্দ কতেক করিব দ্বন্দ্ব খড় কাটিবারে বলে মাতা।।

তোরা কি রাজার বেটা দ্বারে নাঞি খড়কুটা দেখ পুত্র পরের আশ্রম।

জননী এতেক যদি  গালি দিল নানাবিধি তখনি ঘুচিল মনে ভ্রম।।

মনে করি সবিস্ময় বেলা আছে দন্ড ছয় সঙ্গে লয়্যা অভিরাম ভাই।

অবসান হৈল বেলা  গ্রামের উত্তর জলা খড় কাটিবারে দুহে যাই।।

তথায় ছাওয়াল পাঁচে খোলা দিয়া জল সেচে মচ্য ধরে পঙ্কেতে ভূষিত।

আমার কৌতুক বড় ছাওয়াল পাঁচেতে জড় সেইখানে হৈলু উপনীত।।

আগে আমি কহি গিয়া মচ্য ধর আমা লয়্যা তারা বলে ইহা নাঞি হয়।

যত মচ্য ধর‌্যাছিল সকল কাড়িয়া নিল অল্পবুদ্ধি মনে নাঞি ভয়।।

গালাগালি দেয় তারা মচ্য ছিল হাঁড়িভরা সকল লইল ক্ষেমানন্দ।

যতেক ছাওয়াল মেলি সভে করে গালাগালি পথ আগলিয়া করে দ্বন্দ্ব।।

মচ্য লয়্যা অভিরাম  চলি গেলা নিজ ধাম যত শিশু গেল নিজ ঘরে।

আমি হৈনু একেশ্বর মনেতে নাহিক ডর রহিলাম খড় কাটিবারে।।

একেশ্বর হৈলু যদি  অড় না মিলায় বিধি কপালে লিখিল এই লাগি।

আচম্বিতে আইল ঝড় পগার-গোড়ায় খড় সমুখে দাঁড়ায় মুচি মাগী।।

সেই গ্রামে কর্ম্মকার পগার-গোড়ায় তার খড় কাটিবারে রহি আমি।

মুচিনীর মূত্তি ধরি বলে জয় বিষহরি সত্য কহ কোথা আছ তুমি।।

বিচিত্র বসন আনি বলে বিষ বিনোদিনী কাপড় কিনিতে আছে টাকা।।

বসন দেখায়্যা মোরে কপট চাতুরী করে যত্নে লুকাইয়া দেয় ঢাকা।।

চরনে পিপিড়া খায় ক্ষেমানন্দ ফির‌্যা চায় সমুখে মুচিনী অদর্শন।

মুচিনীরে না দেখিয়া মনেতে বিস্ময় হয়্যা ভাবি মনে এই কোন জন।।

পাইলাম মনস্তাপ দেখিলু অনেক সাপ আমারে বেড়িল কথগুলা।

বেষ্টিত ভুজঙ্গঠাটে অবতার মাঝ মাঠে দেখি মুখে উড়ি গেল ধুলা।।

যেরূপ দেখিলু পথে মানা কৈলা প্রকাশিতে কহিলে নহিব তোর ভাল।

সুন পুত্র ক্ষেমানন্দ  কবিত্ব করিয়া বন্ধ আমার মঙ্গল গায়্যা বুল।।

শূন্য রস বাণ শশি  সিয়রে মনসা আসি  আদেশিলা রচিতে মঙ্গল।

দেবী মনসার গীত ক্ষেমানন্দ বিরচিত নায়কের করিবে কুশল।।

[টীকা: তালুকের করে লিখাপড়া—তালুকের দেওয়ানি করে। কলমযশে—কলমের কৌশলী প্যাঁচে। প্রজা নাঞি চাষ চষে—প্রজারা চাষ করতে পারে না। শমনঘর হইল কাথড়া—কাথড়া গ্রাম যমালয় তুল্য হল। রণে পড়ে বারা খাঁ—স্থানীয় ডিহিদার বারা খাঁ যুদ্ধে মারা গেলেন। দেয়ানে হইল বড় ঠক—এলাকায় জালজুয়াচুরীর মতো উপদ্রব ছড়িয়ে পড়ল। আশ্রমে সকল হীন—এলাকায় জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিল। মচ্য—মৎস্য, মাছ। বেষ্টিত….মাঝমাঠে—সর্পসজ্জায় সজ্জিত হয়ে দেবী মনসা মাঝমাঠে অবতীর্ণ হলেন। নহিলে—না হলে, নইলে]

এখানে কবি সমাজের নিম্নতর স্তর পর্যন্ত তাঁর আরাধ্যা দেবীর মহিমা প্রচারের জন্য মনসাকে দৈব আভিজাত্য থেকে মুক্ত করে লোকায়ত ‘মুচিনী’র ছদ্মবেশে উপস্থিত করেছেন। এটা একটা অভিনব কৌশল যা আগেকার আখ্যানকাব্যগুলিতে দেখা যেত না।

এরপর ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি রূপরাম চক্রবর্তীর আত্মকথা (রচনা ১৫৭১ শকাব্দ বা ১৬৪৯ খ্রি:)। শ্রীঅক্ষয়কুমার কয়াল সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে অংশটি উদ্ধৃত (পৃ. ৭-৯)

অনেক দিবস বাড়ি কাইতি শ্রীরামপুর। চারি ভাই ঘর করি বিধাতা নিষ্ঠুর।।

পরম পন্ডিত পিতা কেবা নাঞি জানে। বিশাশয় পড়ুয়া যাহার বিদ্যমানে।।

ছোট ভাই রামেশ্বর প্রাণের সমান। বড় ভাই রত্নেশ্বর বুদ্ধি হৈল আন।।

বড়দাদা রত্নেশ্বর বড় নিদারুণ। খাত্যে শুত্যে বাক্য বলে জ্বলন্ত আগুন।।

খাত্যে শুত্যে মন্দ বাক্য বলে নিরন্তর। মনে হৈল পড়িতে যাইব দেশান্তর।।

মনঃকথা মরমে বান্ধিল খুঙ্গি পুঁথি। মণিরাম রায় দিল পরিবার ধুতি।।

পথে যাত্যে সঙ্গে মোর নাই কিছু ধন। রাজারাম রায় দিল কড়ি বার পণ।।

কাখে লয়্যা খুঙ্গি পুঁথি জুমর অমর। পাষন্ডা পড়িতে যাই ভট্টাচার্যের ঘর।।

রঘুরাম ভট্টাচার্য কবিচন্দ্রের পো। খুঙ্গি পুঁথি দেখিয়া হইল মায়া মো।।

বেটা বলি বাসা দিল নিজ নিকেতনে। যতনে পড়ান পাঠ হরষিত মনে।।

আড়ুয়ে পড়ান গুরু চৌপাড়ির ঘর। শ্যামল উজ্জ্বল তনু পরম সুন্দর।।

পরম পন্ডিত গুরু বড় দয়াময়। ভট্টাচার্য কনাদ মানিল পরাজয়।।

বেদান্ত শুনিলে পথে ডানি বামে যান। রঘুরাম ভট্টাচার্য সভার প্রধান।।

নিরন্তর পাঠ পড়ি গুরুর চরণে। জুমর অমর ভেদ হৈল অল্প দিনে।।

সাত মাসে সাত টীকা পড়াল্য গোসাঞি। বিদ্যাবিনে ক্ষুধাতৃষ্ণা মনে কিছু নাঞি।।

যেখানে সেখানে করি টীকার বিচার। চক্রবর্তী সকল মানিল পরিহার।।

মাঘ রঘু নৈষদ পড়িল হরষিত। পিঙ্গল পড়িয়া মনে পাইল বড় প্রীত।

রামায়ণ ভারথ পড়িল যথাবিধি। বাখানিতে ভারথ বিস্তর পাইল নিধি।।

বাখানিতে কারক আগুন জ্বলে তায়। গুরু শিষ্য দুজনে অনর্থ বয়্যা যায়।।

তিনবার পূর্ব পক্ষ করিল সঞ্চার। সহিতে নারিল গুরু পাবকের ধার।।

ঐমনি পুঁথির বাড়ি বসাইল গায়। পড়াতে নারিল বেটা এখনি বিদায়।।

বিশাশয় পড়ুয়া রয়্যাছে মুখ চায়্যা। দুই পর বেলা যায় এহার লাগিয়া।

দুই গোটা অক্ষর পড়িতে দিন যায়। সদাই পাঠের বেলা জঞ্জাল ভেজায়।।

পড়াতে নারিল তোরে যাহ চল্যা দূর।  নবদ্বীপ যাহ কিবা যাহ শান্তিপুর।।

বিদ্যানিধি ভট্টাচার্য নবদ্বীপে আছে। ভারতী পড়িতে বেটা চল তার কাছে।।

নহে জউগ্রাম চল কনাদের ঠাঞি। তার সম ভট্টাচার্য শান্তিপুরে নাঞি।।

বলিতে বলিতে বাক্য পাবকের কণা। বিটঙক মুখের শোভা বসন্তের চিনা।।

এমন বচন শুনি মনে লাগে ডর। সূর্যের সমান গুরু পরম সুন্দর।।

অলঙঘ্য গুরুর বাক্য লঙঘে কোনজন। নবদ্বীপে পড়িবারে হইল চিন্তন।।

মনে দুঃখ বিষম বান্ধিল খুঙ্গি পুঁথি। নবদ্বীপে পড়িতে যাইব দিবারাতি।।

হেনকালে জননী পড়িয়া গেল মনে। পুনর্বার ফির‌্যা আইল শ্রীরামপুরের গনে।।

আড়ুয়া করিল পাছে ডানি দিগে বাসা। পুরান জাঙ্গালে নাঞি জীবনের আশা।।

ঘুর‌্যা ঘুর‌্যা বুলি শুধু পলাসনের বিলে। দুটা শঙ্খচিল উড়ে বিষ্ণুপদতলে।।

দুটা বাঘ দুদিকে বসিয়া লেজ নাড়ে। ঐমনি কাছাড় খাই গোপালদিঘির পাড়ে।।

সন্ধিটীকা পড়িল সুবন্ত টীকা নাঞি। আপনি কারকটীকা কুড়াল্য গোসাঞি।।

প্রথমে আপনি প্রভু কুড়াইল পুঁথি। সমুখে দান্ডাল যেন ব্রাহ্মণ মূরতি।।

সুবর্ণ পইতা গলে পতঙ্গ-সুন্দর। কলধৌত কাঞ্চন কুন্ডল ঝলমল।।

তরাসে বিকল তনু প্রাণ দুরদুর। আপনি বলেন তবে দয়ার ঠাকুর।।

আমি ধর্মঠাকুর বাঁকুড়ারায় নাম। বারমতি গীত গাও শুন রূপরাম।।

ঠাঁকুর বলেন তুল্যা রাখ খুঙ্গি পুঁথি। কালি হৈতে আমার গাইবে বারমতি।।

চামর মন্দিরা দিব অপূর্ব মাদুলি। তুমি যাও পাঠ পড়িতে আমি খুঁজ্যা বুলি।।

যে বোল বলিবে তুমি সেই হবে গীত। সদাই গাইবে গুণ আমার চরিত।।

এত বলি মহাবিদ্যা দিল মোর কানে।  দিবসে আন্ধার দেখি চাহি চারিপানে।।

বলিবারে বচন বিলম্ব সহে নাই। গলেতে হাড়ের মালা দিলেন গোঁসাই।।

আমি ধর্ম অনাদ্য তোমারে দিনু দেখা। দৈবের নির্বন্ধ তোর কপালের লেখা।।

এত বলি অনাদ্য হইলা অন্তর্ধান। তরাসে কাঁপিল তনু চঞ্চল পরাণ।।

দিবসে তিমির ঘোর দেখিতে না পাই। খুঙ্গি পুঁথি বান্ধিয়া ঐমনি দিল ধাই।।

আকাশে অনেক বেলা তৃষ্ণায় বিকল। শাঁখারী পুকুরে খাইল পরিপূর্ণ জল।।

সন্ধ্যাকালে আচম্বিতে ঘরে দরশন। প্রণাম করিতে চলি মায়ের চরণ।।

সোনা রূপা দুটি বনি দুয়ারে বসিয়া। রূপরাম দাদা আইল খুঙ্গি পুঁথি লয়্যা।।

হেনকালে আইল ঘর ভাই রত্নেশ্বর। দাদাকে দেখিয়া বড় গায়ে আইল জ্বর।।

তরাসে কাঁপিল তনু তালপাত পারা। পালাবার পথ নাই বুদ্ধি হৈল হারা।।

দাদা বড় নিদারুণ বলে উচ্চস্বরে। কালি গেল পাঠ পড়িতে আজি আইল ঘরে।।

কাছাড়িল অমর জুমর অভিধান। বাহিরে সুবন্ত টীকা গড়াগড়ি যান।।

কুড়াল্য যতেক পুঁথি বড় তাপ মনে। দুয়ারে বিদায় মাগি মায়ের চরণে।।

সোনা রূপা দুটি বনি আছিল দুয়ারে। জননীকে বারতা বলিতে নাঞি পারে।।

খুঙ্গি পুথি লয়্যা পুনু করিল গমন। তিনদিন উপবাসী দৈবের কারণ।।

সানিঘাট গ্রামে গিয়া দরশন দিল। পথের পথুক দেখ্যা জিজ্ঞাসা করিল।।

ঠাকুরদাস পাল সেই বড় ভাগ্যবান। না বলিতে ভিক্ষা দিল আড়াই সের ধান।।

আড়াই সের ধানের কিনিল চিড়াভাজা। দামোদরের জলেতে করিল স্নানপূজা।।

জল পান করি বস্যা বড়ো অভিলাষে। আচম্বিতে চিড়াভাজা উড়াল্য বাতাসে।।

চিড়াভাজা উড়্যা গেল শুধু খাই জল। খুঙ্গি পুঁথি বয়্যা যাত্যে অঙ্গে নাই বল।।

দিগনগর গ্রামে গিয়া দরশন দিল। তাঁতিঘরে কর্ম বড় পথেতে শুনিল।।

ধাওয়াধাই তাঁতিঘরে দিল দরশন। চিড়া দধির ঘটা দেখি আনন্দিত মন।।

মনে হৈল পরিপূর্ণ খাব চিড়া দই। তাঁতিঘরে ধর্মঠাকুর নাঞি দিল খই।।

দক্ষিণা আনিয়া দিল দশ গন্ডা কড়ি। দৈবের ঘটনে তার কানা দেড় বুড়ি।।

খুঙ্গি পুঁথি লয়্যা পুনু করিল গমন। বাহাদুর এড়াল্যে দিলাঙ দরশন।।

গোয়ালভূমের রাজা গণেশ রায় নাম। বিপ্রকুলচূড়ামণি বড় ভাগ্যবান।।

তারে গিয়া সপন দিলেন মায়াধর। প্রভাতে ভূপতি দিল মন্দিরা চামর।।

প্রতিষ্ঠা করিল মোরে দিয়া নানা ধন। আচম্বিতে দুই পালি দিল দরশন।।

পালি দেখি মহারাজ আনন্দিত মনে। বারমতি গীত জোড়াইল শুভক্ষণে।।

রাজমহলের অঙ্কে যবে ছিল পুজা। পরম কল্যাণে তার বৈসে যত প্রজা।।

সেই হৈতে গীত গাই আসর ভিতর। দ্বিজ রূপরাম গান শ্রীরামপুরে ঘর।।

[টীকা: বিশাশয়—বিশ অধিক শত, ১২০। আন—অন্যরকম। জুমর অমর—জুমর নন্দীর ব্যাকরণ ও ‘অমরকোষ’ নামক অভিধান। খুঙ্গি—পুথি রাখার উপযোগী বেত বা বাঁশের তৈরি পেটিকা। বাখানিতে কারক আগুন জ্বলে যায়—ব্যাকরণের কারকপ্রকরণের পঠন-পাঠনে গুরু-শিষ্যে প্রবল বিতর্ক বাড়ে। জাঙ্গাল—উঁচু বাঁধ। কাছাড়—আছাড়। বারমতি—বারো দিন ধরে গেয় ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যগীত। বনি—বোন, ভগিনী। পথুক—পথিক। কাছাড়িল—ছুঁড়ে ফেলল। ধাওয়াধাই—দ্রুত, ছুটে গিয়ে। পালি—দোহার।]

এই আত্মকথায় শেষ পর্যন্ত দৈবাদেশ প্রত্যাশিত প্রাধান্য পেলেও একান্নবর্তী পরিবারের পটভূমিকায় কবির জীবনসংগ্রাম ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বৃত্তান্ত বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। কারণ এর রস স্বতন্ত্র ও অভিনব।

অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যে আত্মকথার পূর্বতনধারা অব্যাহত থাকলেও এই শতাব্দীর আত্মকথায় কিছু কিছু নতুন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সম্ভবত সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তমানতা (যথা, মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয়—দেশীয় নবাবীর পত্তন—বর্গির হাঙ্গামা—ছিয়াত্তরের মন্বন্তর—ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ইত্যাদি) এই সময়ের কবিদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছিল। অষ্টাদশ শতকের কবি রামানন্দ যতির ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে (১৭৬৬ খ্রি:) তাই পাই পূর্বসূরি কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যে স্বপ্নাদেশের নামে অনৈতিক মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ :

মুকুন্দের বিরচন ইন্দ্রপুরে কাঁটাবন ইন্দ্রসুত তাহে তোলে ফুল।

সর্পভূষা শোভে আঁকে পুষ্পের কণ্টকে তাঁকে দংশিয়া করিল বেয়াফুল।।

আরো সুন অদভুত জন্মিবে ব্যাধের সুত সেখানে গেলেন ভগবতী।

কলিতে কলিঙ্গবনে কালকেতু সিংহাসনে মল্লযুদ্ধ করিলে…অতি।।

চন্ডী যদি দেন দেখা তবে কি তা যায় লেখা পাঁচালীর রচন।

বুদ্ধি নাই যা ঘটে তারা বলে সত্য বটে পথে চন্ডী দিলা দরশন।।

এত দোষ উদ্ধারিতে লোকের চৈতন্য দিতে চন্ডী রচে রামানন্দ যতি।

অনেকের উপরোধ কেহ না করিও ক্রোধ অনেক শিষ্যের অনুমতি।।

অষ্টাদশ শতকের আর এক কবি রাধাকান্ত মিশ্রের ‘শ্যামার মঙ্গল’ (১৭৬৭ খ্রি:) নামক কালিকামঙ্গলে পাওয়া যায় দৈবাদেশ সম্পর্কে পূর্বতন কবিদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ:

আর এক নিবেদন শুন মহাজন। প্রাচীন কবির সম কৈরাছি রচন।।

কেহো কহে মাএর হয়্যাছে প্রত্যাদেশ। কেহো কহে দিলা দেখা ধরি নিজ বেশ।।

কেহো বলে জিহ্বাতে কবিতা দিলা লিখি। কেহো কেহো বলে আমি স্বপনেতে দেখি।।

যে পদ ধিয়ান করি না পান বিধাতা। মানব হইয়া কেহ কহে হেন কথা।।

কেমনে এমন কথা লইয়ে জিহ্বায়। কিন্তু সত্য মিথ্যা কিছু কহা নাহি জায়।।

বেদে বলে ভকতবৎসলা মহামায়া। কে জানিবে এমন কাহার তরে দয়া।।

আপন সম্বাদ বলি সপুট বিনয়। ভজিলে তাঁহার নাম ভক্তি উপজয়।।

অষ্টাদশ শতাব্দীর আর একজন কবি রামানন্দ ঘোষ (কাব্য ‘নূতন রামায়ণ’—রচনাকাল আনুমানিক ১৭৮০ খ্রি:)-এর কন্ঠেও ধর্মের জন্য কৃচ্ছ্র সাধনের অসারতা প্রচারিত হতে শোনা যায়। ইনি প্রথম জীবনে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়ে দারুব্রহ্ম তথা জগন্নাথ দেবের উপাসনায় লিপ্ত হন। এই উপলক্ষ্যে সম্ভবত উড়িষ্যার জগন্নাথসেবক প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল। এই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধসমাজে ষোড়শ শতক থেকে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ভয়ে বাইরে বৈষ্ণব ভক্তিসাধনার আড়ালে জগন্নাথরূপী বুদ্ধের অবতার হিসাবে পূজা করা হত। রামানন্দও হয়তো এই প্রচ্ছন্ন ভক্তিসাধনার অঙ্গীভূত ছিলেন। তাই তিনি নিজেকে ‘বুদ্ধ’ বলে প্রচার করেছেন।

বিশেষের দ্বারে অন্তে এই পাই সার। আমি বুদ্ধ আমা অন্তে কল্কি অবতার।।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল না পেয়ে তীব্র আত্মধিক্কারে কবি বলে ওঠেন:

দারুব্রহ্ম সেবা করি জেরবার হৈল। বৃথা কাষ্ঠ সেবি কাল কাটা নহে ভাল।।

বস্তুহীন বিগ্রহ সেবিয়া নহে কাজ। নিজ কষ্টদায় আর লোকমধ্যে লাজ।।

আরও বলেন:

ক্ষুধায় না মিলে অন্ন পিয়াসে না পানি। মিথ্যা ধন্ধে গেল মোর দিবস রজনী।।

দারা ছাড়ি পাপ ভরা ভরিনু অপার। অস্থিচর্মসার কৈলা অভিশাপ তার।।

দারা সুত সুতা আর বন্ধু কেহ নাই। অবশেষে কি হইবে নাহি মিলে থাই।।

এ তো গেল দীর্ঘ আখ্যানকাব্যের কথা।অষ্টাদশ শতকে আত্মকথা নিয়ে (কখনো কখনো অন্যের জবানিতে) কবিরা ছোটো ছোটো কবিতাও লিখেছেন। বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ঐহিক এবং ব্যক্তিগত। যেমন, হটুরাম চক্রবর্তীর খেদ নিয়ে রচনা (বিশ্বভারতী পুথিসংখ্যা ৪৫৫)। হটুরাম সম্ভবত কবির ছদ্মনাম। পাত্রীর অভাবে ষাট বছর বয়সেও তাঁর বিয়ে হয়নি। খেদমিশ্রিত তাঁর এই আত্মকথন যুগপৎ কৌতুক ও করুণা উদ্রেক করে :

হটুরাম চক্রবর্তী গেঞেতে পলসাঞী। সাটি বৎসর বএক্রম বিয়া হল্য নাঞী।।

খেদ করে কেন্দে বলে ছাড়িয়া নিশ্বাস।  আমি বিধাতার মার্গে বুঝি চালায়াছিলাম বাঁশ।।

সুতিকাঘরেতে যখন লিখিল কপালে। বুঝি চক্ষের মাথা খেএছিল গেড়ে বেটার ছেলে।।

কানা খোঁড়া জদি একটা লিখিত দয়া করি। আমার সেই হত্য সাত রাজার ধন ইন্দ্রের অপছরি।।

মেগের প্রতি জত ভক্তি করে সর্বলোকে। আমি কি তা করিব নাক বল্যেছিলাম তাকে।।

কার বা বিশ পচিশ বিয়া মলই গেল দুটো। অতেএব বলি সেবেটা বিধাতা ওঅজ আজ নেটো।।

আর একটা মহাখেদে প্রাণ ধরিতে নারি। ইচ্ছে করে খেদে পোঁদে বটী মেরে মরি।।

পাট পড়শী বৌড়ি হয় ভ্রাতৃবধূ জারা। ছি ছি আইবড় বটঠাকুর বলে নাম রেখেছে তারা।।

ডেঙ্গ বলে কাছ ঘেসে না কেহু না চায় ফিরে। মড়ার মত পড়ে থাকি অনাথ মন্দিরে।।

আমি বিল্বদলে গঙ্গাজলে পূজিলাম শঙ্কর। মনে ছিল মেগে নিব বিয়া হবার পর।।

তার কথাতে হবে কেনে উদগেড়ের বিয়া। তার বেটা আইবড় আছে মউর পোঁদে দিয়া।।

আমি দফা দফা সত্তিপিরে সিন্নি দিলাম মেনে। বাড়ী নাই তার জত কারদানী নিলাম জিনে।।

তার পুজি মাত্র আছে কেবল মুখে চাপদাড়ী। তার কুদরতী নাঞী সিন্নিখাবার দাড়ি (ধাড়ি)।।

পুথিপরিচয়: ১ম খন্ড (বিশ্বভারতী), ১৩৫৮, পৃ. ১৯০।

[টীকা: ওলজ—কপট। নেটো—ভন্ড। ডেঙ্গ—স্ত্রীপুত্রাদিহীন পুরুষ (নিন্দার্থে ব্যবহার্য)। কারদানী—কৃতিত্ব, কর্মকৌশল। কুদরতী—সামর্থ্য, মহিমা।]

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই ধরনের আত্মকথামূলক ছোটো ছোটো কবিতা, ছড়া ও গান অনেক রচিত হয়েছিল। কোনো বড়ো কাব্যের আধারে নয়, ছোট ছোট পাড়ায় এগুলি রচিত হত। স্থানাভাবে বিস্তৃত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব হল না। আমরা বিশ্বভারতীর পুথিশালায় এই ধরনের আত্মকথামূলক একাধিক পাতড়ার সন্ধান পেয়েছি। যেমন, কানুদাসের ‘আত্মকাহিনী’ (পুথিসংখ্যা ১১৪১)। এতে একদিকে যেমন আছে আত্মজিজ্ঞাসা, অন্যদিকে তেমনই আছে নিজের জীবনের কৃতকর্মের কথা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে সম্পূর্ণ লৌকিক বিষয় (যেমন, তামাক, গাঁজা, মদ, সিদ্ধির নেশা) নিয়ে কবিরা আত্মকথা ও গান লিখেছেন (যেমন, সিত কর্মকারের ‘তামাকুপুরাণ’, শান্তি দাসের ‘হুক্কাপুরাণ’, রামানন্দ রচিত গাঁজার মাহাত্ম্যগীতি সেকালে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।) এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কবিদের আত্মকথা সনাতন ধর্মভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে লৌকিক দিগন্তে আত্মপ্রকাশের নতুন পথ সন্ধান করছিল, যার জের কোনো কোনো ক্ষেত্রে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলে এসেছিল।

মধ্যযুগের সাহিত্যে আত্মকথার আর একটি উৎস কাব্যের মূল অংশ নয়, কাব্যের পুথির শেষাংশস্থিত পুষ্পিকা। এর রচয়িতা কবি নয়, পুথির লিপিকর। সাধারণভাবে পুষ্পিকার পরিসর খুব বিস্তৃত নয়। পুষ্পিকায় লিপিকর সাধারণত কবি ও কাব্যের নাম, নিজের নাম ও ঠিকানা, লিপিসমাপ্তির তারিখ, পুথির মালিকের নাম, পুথি নকল করার পারিশ্রমিক ইত্যাদির উল্লেখ করতেন। সেইসঙ্গে থাকত সম্ভাব্য পুথিচোরের প্রতি অশালীন কটূক্তি ও অভিসম্পাত। এই অংশের ভাষা সাধারণত গদ্য। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিপিকরেরা পদ্যে বিস্তারিতভাবে আত্মপরিচয় দিয়েছেন।

যেমন, রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে রক্ষিত কাশীরাম দাসের মহাভারতের আদিপর্বের পুথি (সংখ্যা ১৩৭)-র লিপিকর (লিপিকাল ১১৮৬ বঙ্গাব্দ বা ১৭৮০ খ্রি.-র ২৫ ফাল্গুন) রামপ্রসাদ রায় পদ্যে (শেষাংশ গদ্যে) নিজের বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন:

শ্রীযুত শচীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় গুণের নি[ধা]ন। তার পুত্র বলরাম বড় গুণবান।।

তস্য পুত্র কৃষ্ণরাম বড় ভাগবান। তার পুত্র হাড়োরাম দেশেতে বাখান।।

তস্য পুত্র শ্রীপরীক্ষিত তিন সহোদর। তার পুত্র রামপ্রসাদ তিনের জোয়ার।।

শিবপ্রসাদ রাএ কৃষ্ণ তুমি দিয় আয়ুদান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুর্ণবান।।

আদি পর্ব আরম্ভ করিলাম লিখিতে। প্রথমে লিখিলাম পুথি পঁচাশী পৌষেতে।।

পূর্ণ হৈলে ছআশি ফাল্গুনের শেষে সমাপ্ত করিনু পুথি সপ্তদশ মাসে।।

শকাব্দা সতের সত্ত এক মাসের কুম্ভরাশি। পূর্ণ হইল পুথি দিবস পচিশি।।

সন এগার ছেয়াশি সাল অমাবস্যা তিথি। এতদিনে আদিপর্ব্ব করিলাম ইতি।।

সমাপ্ত হইল সেই দিনে রসখন্ড। সেই দিনে আছিল চতুর্দ্দশী দশ দন্ড।।

এই পুথি প্রবেশ হইল যেখানে। হেনকালে পুস্তক হইল সমাপনে।।

এই পুথি শ্রীরামপ্রসাদ রায়ের লিখন এবং তার পুথি। কেন্বাতে (কেন্নাই?) বসিয়া লিখিলাম।।

এই পুথি যে চুরি করিবেক সেই অধম দুরাচার। পাপিষ্ঠ নরাধম তাকে কৃষ্ণের দোহাই।।

বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে রক্ষিত কাশীরাম দাসের মহাভারতের আদি পর্বের আর একটি পুথি (সংখ্যা ১৪০)-র লিপিকর শ্রীরামমোহন দাস ১৭২০ শকাব্দের (১৭৯৮ খ্রি.) ১৮ পৌষ মঙ্গলবার পুথি নকল করে এ ব্যাপারে তাঁর আনন্দ ও দুঃখের মিশ্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন:

শকাব্দা বিধিমুখ নিন্দি তিন গুণ। রক্মিণী নন্দন অঙ্কে জলনিধি গুণ।।

বৃষরাশী বাইভূত…শ্চিতে। ভাল দিন চন্দ্রহীন গগন বিদিতে।।

মৃগাঙ্গী উদিত পক্ষ মাস অঙ্ক তিথে। শশিসুত দ্বিজের…মনস্থিতে।।

কাশীদাস কৃত নাম বিচিত্র পান্ডব। সাধুজন উপাষণ করিবারে ভব।।

আদি পর্ব্ব ভারত কেবল সুধাসিন্ধু। এ ভব সংসার মধ্যে এইমাত্র বন্ধু।।

পুস্তক লিখিয়া মনে আনন্দ জন্মিল। যতন পূর্বেতে এই তেই লিখিয়া রাখিল।।

কেহ যদি লয়্যা জায় পুস্তক লিখিতে। লিখিয়া সত্বরে আনি দিবে সুনিশ্চিতে।।

আমার পুস্তক যেই জন হরিবেক। তাহার বাপের মুখে বিষ্ঠা পড়িবেক।।

অনেক যতনে আমি লিখিলাম পুস্তক। শুনহ লিখিতে হৈল যতেক যে দুঃখ।।

কুড়িপাত সাগর যুগী লিখিতে দিয়াছিল। তারপর একপাত [ও] লিখিতে না দিল।।

পারুল্যাতে লিখিলাম দেড়শত পাত। তাহাতে যতেক দুঃখ জগত বিখ্যাত।।

আঙ্গলহাড়া হয়্যা তিনমাস দুঃখ পাইনু। এতেক দুঃখ যে ভাই তোমারে কহিনু।।

তেই পাকে বলি পুথি কেহ না হরিবে। হরিবেক যে জন যে নরকে পড়িবে।।

কোনো কোনো লিপিকর পুথির মালিকের সদয় বদান্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর মঙ্গল কামনা করেছেন। যেমন, ১২৩৪ বঙ্গাব্দে (১৮২৯ খ্রি:) রামায়ণের চারটি কান্ডের পুথি নতুন করে নকল করে লিপিকর দর্পনারায়ণ দাস মজুমদার পুথির মালিক ও তাঁর নিয়োগকর্তা গুরুচরণ দাসের জন্য রামচন্দ্রের কাছে দয়া প্রার্থনা করেছেন:

সেই মত আনন্দেতে রাখ গুরুচরণ দাসে। কোন প্রকারে পুস্তক লইয়া আমার পাশে।।

দাসবাবু আমারে দিলেন সাত টাকা। সেইমত দাসের পাপ খন্ডাহ প্রভু একা।।

পুস্তক লেখাইয়া আমার কৈলেন উপগার। অনেক জঞ্জালে ত্রাণ করিলেন বাবু কর্মকার।।

কর্মকারবাবুরে রাম তুমি কর দয়া। পুস্তক সাঙ্গ হৈলে বাবু দিবেন বস্ত্র মোয়া।।

আমাকে গামছা দিবেন বহুবাদ ঘুষি। অতএব রাম দয়া কর সগোষ্ঠি সপরিবারে আসি।।

কৃতজ্ঞতাবোধের সঙ্গে বিনয়ী নম্রতাও লিপিকরের আত্মকথায় পাওয়া যায়। ১২২৮ মঘী সনের (১৮৬৬ খ্রি:) ১২ আষাঢ় তারিখে লিপিকৃত একটি পুথিতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সংখ্যা ৬২৪) লিপিকরের আত্মদীনতার ভাব লক্ষণীয় :

লেখে হীন আজিজর রহমানে মনে ভাবি সার। হাওলা গেরামে জান কধুরখীল মাঝার।।

আবদুল্লার পুত্র আমি সবা হন্তে হীন। হাওলা গেরামে জান উদ্দেশিয়া চিল।।

মাতা পিতা পীর মুরসিদ জান এই চাইর। আর বহু আছ জান ওস্তাদ যে সার।।

হীনবুদ্ধি আজিজর রহমান মোর নাম। ওস্তাদ সবার চরণে মোর সহস্র প্রণাম।।

পিতাহীন শিশু আমি নাহি মোর বুদ্ধি। শান্ত [স্ত্র ?] হীন অজ্ঞান না বুঝিএ সিদ্ধি।।

পুস্তক লেখিতে আমি দিলে করি এই। তলাইস করিয়া তুই না পাইলুম ছহি।।

যেইমত দেখি আমি সেইমত লেখি। অপরাধ ক্ষেম মোর গুণিগুণে দেখি।।

হরফের ভুলচুক যদি পাও আর। গুণিগণে চাহি তবে করি দিবা সার।।

সার না করি যদি গালি দেও মোরে। পাইবা বহুল দুঃখ গোরের ভিতরে।।

এবে কহি সন মঘী তরিখের গৎ। বিংশ অষ্ট মঘী জান আর বার শত।।

তারিখ আষাঢ় জান বার দিন হৈল। সেই দিন এই পুস্তক লেখা হৈল।।

[টীকা: হন্তে—হতে। সার—সমাধান, মীমাংসা।]

পেশাদার লিপিকারের কাছে লিপিকর্ম একটি জীবিকা হলেও পুথি নকল করা সেযুগে পুণ্যকর্ম বলেও মনে করা হত। উচ্চবংশীয় শিক্ষিত মহিলারাও তাই লিপিকর্মে আত্মনিয়োগ করেছেন। যেমন, বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র মহতাবের বিধবা পত্নী কমলকুমারী দেবী বৈধব্যবেদনা বিস্মৃত হতে পুথি লিখেছেন। দৌলত উজীর বাহারাম খানের ‘লায়ল মজনু’ কাব্যের লিপিকর রহিমুন্নিসার আত্মকথনে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুথিসংখ্যা ৪৬৩, লিপিকাল ১৮২৯ খ্রি:) পাওয়া যায়:

ছিরিমতি ক্ষুদ্র মতি রহিমনিষ্যা নাম। সুলুকবহর নামে গ্রাম অনুপাম।।

পিতা অতি শুদ্ধমতি আবদুল কাদের। ছুপি খানদানে তাই আছিল সুধীর।।

আপদ কালেতে পিতা [গেলেন] স্বর্গগতি। পিতাসোকে ভাবিতে চিন্তিতে তনুক্ষতি।।

তেকারণে শাস্ত্রপাঠ শিখিতে নারিলুম। হেলে গেলে অভাগিনী কাল গোয়াইলুম।।

মোর তিন ভ্রাতা আর মাতৃ গুণবতী। যৎকিঞ্চিত শাস্ত্রপাঠ শিখাইল নিতি।।

গুরুর চরণে স্মরি বিরচিলুম পদ। আশীর্ব্বাদ কর গুণি ত্বরিতে বিপদ।।

দীনক্ষীণ অল্পজ্ঞান মুই কলঙ্কিনী। সতীত্ব থাকিতে আশীর্ব্বাদ কর গুণী।।

এই আত্মকথা থেকে বোঝা যায়, লিপিকর্মকে অবলম্বন করে সেযুগের সহায়সম্বলহীন মহিলারা আত্মসম্মান বজায় রেখে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করতেন।

পুষ্পিকায় লিপিকরের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থার কথা একটা বড়ো জায়গা জুড়ে থাকলেও কোনো কোনো লিপিকর পুষ্পিকায় নিজের সমকালীন সময়, সমাজ ও পরিস্থিতির বাস্তব বিবরণ দিয়েছেন। যেমন, পর্তুগালের লিসবনের জাতীয় মহাফেজনামায় রক্ষিত ১৭৪৩ (১৭৪৬?) খ্রিস্টাব্দে নকল করা মহাভারতের একটি পুথির পাতায় প্রাপ্ত বর্গির হাঙ্গামার বাস্তব বর্ণনা :

সন ১১৫২ সালে মাহ ৬ জৈষ্ঠে সোমবারে ফরাষ ডাঙ্গার বাগবাজার বরগিতে লুঠ করিয়া লইয়া গেল এবং সোনা বামনির ভাতারকে খুন করিয়া গেল রামন্দ্রে ষুরের সর্বস্ব লইয়া গেল ষুরের পিতা ও জামাতা ও নফর ও বৈবাহিক শ্রীসহশ্ররাম নিয়োগীকে প্রহার করিয়া গেল।

এ প্রসঙ্গে আর একটি ঐতিহাসিক তথ্যপূর্ণ পুষ্পিকার উল্লেখ করে আমরা আলোচনায় ছেদ টানব। পুষ্পিকাটি ১১৭৭ বঙ্গাব্দের ২৭ জ্যৈষ্ঠ তারিখে শ্রীনন্দ দুলাল দেবশর্মা কর্তৃক লিপিকৃত কবিকঙ্কণ চন্ডী (বিশ্বভারতী পুথিসংখ্যা ৬২৪০) র পুথির অন্তর্গত। এতে লিপিকরের উক্তিতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে :

ইতি লিখিতং শ্রীনন্দদুলাল রায় দেবশর্মণঃ সন ১১৭৭ সালের ২৭ জৈষ্ঠে বৃহস্পতিবারে অষ্টাহ পুস্তক সমাপ্ত হইল।। নিজ বাটীতে নিজঘরে দক্ষিণ দুয়ারির ঘরে পিড়ীতে বস্যা লিখা হইল।। ০।। শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডীকায়ৈ নমঃ [—] শ্রীশ্রী শিবায় নমঃ [—] শ্রীশ্রী জয়দুর্গায়ৈ নমঃ [—] শ্রীশ্রী গুরবে নমঃ সাং খন্ডঘোষ।। সন ১১৭৬ সাল মহামন্বন্তর হইল [।] অনাবৃষ্টী হইল [। ] সস্বি হইল না [। ] কেবল দক্ষিণ তরফ হইয়াছিল আর কোথাও কোথাও জলাভূমে হইল [। ] টাকায় ১২ বার সের চালু… সাড়ে ছয় পোণ সের চালু হইল [। ] তৈল ২।।০ আড়াই সের লবণ ১ এ [ক] সের কলাই ১১ এগার সের [। ] তরিতরকারি নাস্তী সাক নাস্তী কিছুমাত্রেক নাস্তী [—] এই কথা সর্ত্ত [র ] বৎসরের মন্বিসী বলেন আমরা কখন এমন শুনি নাই [। ] ইহাতে কত কত মন্বিসী মরিল [। ] বড় বড় লোকের বাড়ি নাই বাং সন ১১৭৭ সালের মাহ ভাদ্র কত মহাপ্রলয় হইল [। ] এই সন রহিল আর কী বা হয় [—] ১৮২ এক সত্ত বিরাসি পাতে ৪৩০ চারি সত্ত তিরিশ নেচাড়ে সমাপ্ত হইল [—] শ্রাবণ মাসে টাকায় ৪চারি সের চালু হইল [। ] অনেক মন্বিষ্যী নষ্ট হই [ল] মহামন্বন্ত্বর [। ]

[টীকা: সস্বি—শস্য; চালু—চাউল; মন্বিসী—মনুষ্য]

__________________________________________________

তথ্যসূত্র :

১. পুঁথি পরিচয়—১ম-৬ষ্ঠ খন্ড, বিশ্বভারতী, ১৩৫৮-১৩৯৫। ২. বাংলা পুঁথি, ৩য় খন্ড-বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, সংকলক—কল্যাণকিশোর চট্টোপাধ্যায়, ২০০৯। ৩. পান্ডুলিপি পঠন সহায়িকা—কল্পনা ভৌমিক; ঢাকা ১৯৯২। ৪. পান্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ সমালোচনা—মোহম্মদ আব্দুল কাইউস, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা ২০০৯। ৫. পুঁথিপাঠ ও সম্পাদনা রীতি—অণিমা মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ২০০১। ৬. বাংলা পান্ডুলিপি পাঠপরিক্রমা—ত্রিপুরা বসু, কলকাতা ২০০৩। ৭. সমকালের প্রেক্ষাপটে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য—জয়িতা দত্ত, কলকাতা—২০০২। ৮. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কবিদের পরিচয় ও সময়—সুখময় মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ২০০৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *