প্রাক্তন প্রেমিক

মিনিবাসে উঠে আর একবার চিঠিটা পড়ল অশোক। ‘তুমি পাঁচটার আগেই চলে এসো। আজ তোমার জন্মদিন। দেখেছ, আমার কেমন মনে আছে !’তারপর আবার ভাঁজ করে রেখে দিল পকেটে।
গোটা চিঠির কয়েকটি মাত্র লাইন, এর বেশি আর পড়বার দরকার হল না। মনে আছে, সবই মনে আছে মাধুরীর। এই ছ’বছরে, এত দীর্ঘ একটা সময়ে, অসংখ্য ফুল ঝরে গেছে, পুরনো হয়েছে ক্যালেণ্ডারের অনেকগুলি পাতা। কিন্তু, মাধুরী ভোলেনি। সেই একই রকম ভাষা; শ্তধু অক্ষরগুলেই যা পুরু হয়েছে একটু। বুকের ভিতর ছোট একটা মোচড় খেল অশোক। মনে পড়ল ছ’বছর বেড়ে গেছে তার- এই ছ’বছরে একবারও কারও তার জন্মদিনের কথা মনে পড়েনি।
এক স্টপ আগেই মিনিবাস থেকে নেমে পড়ল অশোক। হাতে সময় নিয়ে আসতে লিখেছে মাধুরী। কিন্তু এখনও পাঁচটা বাজেনি। এখনও আঁচ আছে পুবের রোদ্দুরে-পিচের রাস্তাটা যেন হাসছে হা হা করে। সামনের আরও একটা স্টপ হেেঁট যেতে কিছুটা অন্তত সময় লাগবে। এতক্ষণে হয়তো সুগন্ধী মেখে স্ন্ান শেষ করেছে মাধুরী, হয়তো তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। অশোক আসবে। ইচ্ছে হচ্ছিল মোড়ের ফুলওয়ালার কাছ থেকে একগুচ্ছ ফুল কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু কিছু ভেবে আর কিনল না। সামান্য ফুল উপহার দিয়ে আজ সে মাধুরীকে খুশি করবে না। আরও কিছু চাই-আরও বেশি কিছু। সেটা কী ভেবে পেল না।
দ্রুত হাঁটতে লাগল অশোক।
‘এই ক’বছর আমরা কলকাতায় ছিলাম না- মনে মনে শব্দময় হয়ে উঠল চিঠির কথাগুলো, কিন্তু সব মনে আছে আমার। আমার স্বামীকে তোমার কথা বলেছি।’ ভাবতে গিয়ে অহঙ্কারে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল অশোকের। মাধুরী ভোলেনি, ভাবল, আমিও কি ভুলতে পেরেছি!
মনে আছে, সব মনে আছে। এখনও কতদিন অন্ধকার বিছানায় শ্তয়ে বৃষ্টির শব্দ শ্তনতে শ্তনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে আশোক। এখনও কতদিন মাঝরাতে হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেলে- অশোক থেমে দাঁড়াল। এসে পড়েছে। নম্বর খুঁজতে খুঁজতে এগোতে লাগল সতর্কভাবে। সাতাশের বি, মেটে লাল রঙের ফ্ল্যাটবাড়ি, সামনে লোহার গেট, বারান্দায় পাতাবাহারের গাছ-সব মিলে যাচ্ছে।
সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ অনুভব করল অশোক। একবার ভাবল ফিরে যায়। ছ’বছর দীর্ঘ সময়, হয়তো এতদিনে অনেক বদলে গেছে মাধুরী। হয়তো আগের মতো কথায় কথায় উচ্ছল ভঙ্গিতে হেসে ওঠে না, হয়তো ওর স্বামী-যাকে অশোক কোনোদিনই দ্যাখেনি, পছন্দ করবে না।
কিন্তু, এত কিছু ভাবার পরেও এক পা নড়তে পারল না অশোক। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় অনুভব করল, ক্রমশ সহজ হযে আসছে নিঃশ্বাস। সে হাঁটছে।
তারপর মাত্র কিছুক্ষণ। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিল অশোক। তখনই ভাবল, কী প্রয়োজন ছিল ছ’বছর পরে স্মৃতি জাগিয়ে। মাধুরী তোমার নয়, সে এখন পরস্ত্রী। শ্তধুমাত্র একটি চিঠি, পরিচিত হাতের কয়েকটি অক্ষর- ইতিমধ্যে তার ঠিকানা বদল হলে চিঠিটা পৌঁছতই না। তাতে কি খুব ক্ষতি হত মাধুরীর!
আর সময় ছিল না। না চিন্তার, না ফিরে যাওয়ার। ততক্ষণে দরজা খুলেছে। তীব্র একটা সুগন্ধী অশোকের নাকে লাগল। মনে হল একটি স্বপ্নের মধ্যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সে।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাধুরী। সম্ভবত চুল আঁচড়াচ্ছিল, সেইভাবেই চলে এসেছে।
‘তুমি এসেছ ! এলে শেষ পর্যন্ত !’
হঁ্যা, মাধুরী। মাধুরীই বলছে, শ্তনল অশোক, ‘আ-রে কী আশ্চর্য ! আসবে তো !’
অশোক ঘরে ঢুকল। নিজেকে ধাতস্হ করার সময় নিয়ে বলল, ‘চিনতে পেরেছে।’
‘ওমা, চিনব না কেন !’ উচ্ছ্বসিত গলায় মাধুরী বলল, ‘আমি অত সহজে ভুলি না ! ভুললে কি চলে ! নাকি সকলকেই ভোলা যায় !’
না, যায় না। মনে মনে ভাবল অশোক। তারপর বলল, ‘হঠাত্ তোমার চিঠি পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম-’
‘হবেই তো !’ ঘাড় পর্যন্ত নামা চুলে ব্রাশ চালেয়ে মাধুরী বলল, ‘ছ’বছর হয়ে গেল !’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘বিযের দিন কিন্তু তুমি আসোনি !’
‘না। সোফায় বসে অশোক বলল, ‘মানে হঠাত্ একটা কাজে-’ বলতে পারল না যে সে গিয়েছিল, কিন্তু বিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত গিয়েও ইচ্ছের অভাবে ফিরে এসেছিল। ফিরে আসার পথে সানাইয়ের ধ্বনিটা অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিল তাকে।
বিকেল হযে গেছে। পাতাবাহারের আড়ালে উড়োউড়ো করছিল কয়েকটা চড়ুই। মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে মিহি শব্দে। ঘরের চারদিকে দেওয়ালের ছবিগুলোর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল অশোক। তখনও বিয়ে হয়নি মাধুরীর, একদিন বলেছিল, বিয়ের পর কিন্তু টাকা দিতে হবে আমাকে। ঘর সাজাবো আমি।’ হঠাত্ মনে পড়ে গেল।
সেদিনের কথাটা সহজভাবেই নিয়েছিল অশোক। সিগারেট টান দিয়ে বলেছিল, ‘আগে বিয়ে হোক।’ বিয়ে হযনি। কিন্তু ঘর সাজিয়েছে মাধুরী। এ ঘরের সর্বত্রই মাধুরীর স্ন্গি্ধ হাতের স্পর্শ। হালকা সবুজ রং পছন্দ করত। জানলার পর্দাগুলো টাঙিয়েছে মনের রঙ মিলিয়ে। মনে পড়ল, একবলর নিউ মার্কেট থেকে তাকে একটা সবুজ বেডকভার কিনে দিযেছিল। মেঝের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে স্মৃতিতে ফিরল অশোক।
‘কী ভাবছ!’ অশোককে অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞেস করল মাধুরী।
‘দেখছি কী সুন্দর ঘর সাজিয়েছ। সবুজ তোমার বরাবরের প্রিয় রং-’
‘তবু তো ভাড়া করা ফ্ল্যাট। ইচ্ছেমতো করতে পারি না সবকিছু। নিউ অলিপুরের দিকে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি। মাস তিনেকের মধ্যে রেডি হয়ে যাবে মনে হয।’ একটু থেমে বলল মাধুরী, তুমি তো সেই মেসেই থেকে গেলে। সেই অটোত্তরের এক-
‘হঁ্যা, চিঠিটা সেখানেই লিখেছিলে-’
‘আমি জানতাম ওখানেই পাবো।’ মাধুরী বলল, ‘যা ঘরকুনো ছিলে! ওই মেসেই বোধহয় তোমার সারাজীবন কেটে যাবে!’
সারা জীবন! হয়তো, হয়তো কেটে যাবে। এখন চৌত্রিশ আর কতদিন বাঁচব? পঁচিশ বছর? ত্রিশ বছর? ম্লান হাসল অশোক।
‘কী স্টাফি ঘরটা তোমার ! কী করে যে থাকো ! এখনও একাই আছ, না আর কেউ জুটেছে ?’
না। একাই। মিথ্যা বলল অশোক। অথচ, এখন অনায়াসে সত্যি কথাটা বলতে পারত সে। তখন প্রয়োজন ছিল। মাধুরী আসত প্রায়ই। এখন তো আর একান্তে কথা বলার জন্য আলাদা ঘরের প্রয়োজন নেই! নিঃসঙ্গ ঘরের নিস্ফলে সন্ধ্যাগুলো আর তাকে আকর্ষণ করে না। প্যাসেজে মেয়েলি চপ্পলের শব্দ পেয়ে উত্কর্ণ হতে হয় না আর, কিংবা মনে হয় না ঘড়ির কাঁটা বড়ই শ্লথগতি।
দূরের জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে কি দেখল মাধুরী। ওর স্বামীর কি বাড়ি ফেরার সময় হল !
ফিরে এসে মাধুরী বলল, ‘কী কান্ড দ্যাখো ! কী খাবে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি তোমাকে! চা না কফি ? সফ্‌ট্‌ ড্রিঙ্কও নিতে পারো। জানো, তোমার জন্যে আজ পুডিং বানিয়েছি নিজের হাতে। আর চিংড়ি কাটলেট। আমাদের কুকটা খুব এফিসিয়েন্ট, দিল্লিতে থাকতে পেয়েছি লোকটাকে। ও আবার বিরিয়ানি স্পেশালিস্ট।
অফিসের বড় সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল অশোকের। রোজ লাঞ্চ ফিস ফ্রাই কি চিকেন কাটলেট মৌজ করে খায় লোকটা। এই ভালো, সুখে আছে মাধুরী। এত সুখে, এমন স্বাচ্ছ্যন্দ আমি কি রাখতে পারতাম তোমাকে !
অশোক বলল, ‘সফ্‌ট ড্রিঙ্কসই তো ভাল।’
‘বসো। আমি নিয়ে আসছি।’
মাধুরী চলে গেল।
ঘরটা ক্রমশ আবছা হয়ে উঠছে। আবার বোধহয় মেঘ করেছে। ক’টা বাজল? হাতে সময় নিয়ে আসতে বলেছিল মাধুরী। কিন্তু কেন ? এইরকম উত্তরহীন সময় কাটানোর চেয়ে ফিরে গেলেই ভাল হত। ছ‘টায় বাড়ি ফিরবে মাধুরীর স্বামী, তার আগেই।
মাধুরী ফিরে এল। প্লেটের উপর কাচের গ্লাসে পেপ্‌সি বা কোক অশোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছ ?’
‘ভাল। তুমি?’
‘খুব ভাল।’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাধুরীর চোখ দুটো। সেই চোখ, সেই একই রকম দৃষ্টি। শরীরে মেদ জমেছে একটু, সুন্দর হয়েছে আরও। দুঃখিত মনেও মুগ্ধতা এড়াতে পারল না অশোক।
হঠাত্ ব্যস্ত হয়ে উঠল মাধুরী। উঠে পায়চারি শ্তরু করল ঘরের মধ্যে, আবার জানলার পর্দা সরিয়ে কী দেখল বাইরে। তারপর, বসতে বসতে বলল, ‘ছেলেটা কুকের সঙ্গে দোকানে গেছে। এখনও ফিরছে না কেন ভাবছি।’
‘তোমার ছেলে ?’
‘হঁ্যা।’ সলজ্জ আভা ছড়িয়ে পড়ল মাধুরীর মুখে। বলল, ‘ওই একটিই-বছর আড়াই বয়স হল-’
একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, না দেখেই বলো তো কার মতো দেখতে হয়েছে ?’
অশোক হাসল।
‘নিশ্চয়ই তোমার মতো।’
‘না, না।’ আপত্তি করার ধরনে মাধুরী বলল, ‘ওর বাবার মতো-’
ঠান্ডা পানীয়ের শেষ চুমুকটা গলায় প্রায় আটকে গিয়েছিল অশোকের। সেটাকে নেমে যেতে দিয়ে প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, তোমার কিছু মনে পড়ে, মাধুরী?’
সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না মাধুরী। গালে হাত দিয়ে কী ভাবল কিছুক্ষণ। প্রতিটি অপেক্ষার মুহূর্ত ঘাম হয়ে জমতে থাকল অশোকের কপালে।
‘সত্যি, কী ছেলে মানুষি করেছি তখন !’ মাধুরীর চোখ মেঝের কার্পেটের দিকে। বলল, ‘এখন ভাবলে হাসি পায় !’
ছেলেমানুষি ! জ্বালার মতো কী একটা ছড়িয়ে পড়ল অশোকের মাথায়। মাধুরী হাসছে। আলো পিছলে যাচ্ছে তার ঝকঝকে দাঁতে। অস্বস্তি এড়াতে পারল না অশোক। এই কথা শোনাবার জন্যেই কি জন্মদিনে তাকে ডেকে এনেছে মাধুরী !
চোয়াল কঠিন হয়ে উঠল অশোকের। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা চলে না।
অশোক উঠে দাঁড়ালো। আর, তখনই উচ্ছ্বসিত হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল মাধুরী, ‘ওরা এসে গেছে-’
বাইরের মোটরের হর্ন শ্তনেছিল অশোক। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন একটু স্হূলকায় এক ভদ্রলোক, পিছনে একটি শিশ্ত এবং কুক। বুঝতে অসুবিধে হল না অশোকের, কে মাধুরীর স্বামী।
অশোককে দেখে অবাক হলেন ভদ্রলোক। মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি-?’
‘বুঝতে পারছ না !’ গলায় সামান্য রহস্য মিশিয়ে মাধুরী বলল, ‘সেই যে গো-বলেছিলাম না তোমাকে-’
‘ওঃ, হো-হো-।’ শব্দ করে হাসলেন ভদ্রলোক। তাঁর মুখের সেই গহ্বরের দিকে তাকিয়ে অশোকের মনে হল, একটা জলহস্তী যেন শিকার ধরবার আগে মুখ খুলছে। হাসি থামিয়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ। দেখে আনন্দ হল। ওয়েলকাম, মোস্ট ওয়েলকাম-’
চোখের সামনে গোল হয়ে ঘুরছে কয়েকটা অস্বীকারের বিন্দু। অশোক জবাব দিল না।
‘তা, আজ নাকি আপনার জন্মদিন। মাধু বলছিল সকালে। তার আবার সেলিব্রেট করার ভীষণ শখ। তা একটা উপলক্ষ না হলে-’
কাচের গ্লাসটা তখনও ছিল হাতের সামনে। ইচ্ছে হল ছঁ ুড়ে মারে মাধুরীর মুখের উপর। কিন্তু কিছুই করল না অশোক। শ্তধু দেখল, যেখানে ছিল সেখান থেকে সরে গিয়ে তার স্বামীর সামনে দাঁড়িয়েছে মাধুরী। তারপর ভদ্রলোকের গলার টাইটা খুলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল।
একটা দীর্ঘশ্বাস সংবরণ করল অশোক। জানে আজকের উপলক্ষ তাকে নিয়ে হলেও সে এখন শ্তধুই দর্শক। দর্শক হয়েই থাকবে।

5 Comments
Collapse Comments

the writer is my one of the most favorite man, so i do like his every writing.

past is good…..just remmemeber it,dnt try to touch.i like dipdendu palit sir’s story,,,,

অসাধারন

Onk din holo, Tar kunu golpo paina….sei kobe 1ta golpo diyechilen tik mone nei…??? accha, Unar ki kunu noble upload deya jayna….??? dile valo hoto

Onk din holo, Unar kunu golpo paina….sei kobe 1ta golpo diyechilen tik mone nei…??? accha, Unar ki kunu noble upload deya jayna….??? dile valo hoto

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *