প্রাককথন

প্রাককথন

১৬৯০ সালের আগে জোব চার্নক কলকাতায় এসেছিলেন বার দুয়েক। প্রত্যেকবারই প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। চলে যেতে হয়েছিল মোগলদের সঙ্গে ঝামেলার কারণে। অবশেষে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে থিতু হন ১৬৯০ সালে। স্থানটা অবশ্যই সুতানুটি। তবে এর সঠিক অবস্থান স্পষ্ট নয়। পরবর্তীকালে সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নিয়ে গড়ে ওঠে আধুনিক কলকাতা। প্রথম দিকে চার্নক তাঁর চিঠিপত্রে ‘Calcutta’ শব্দটা কখনো ব্যবহার করেননি। ইংরেজদের মধ্যে ‘Calcutta’ শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন চার্লস আয়ার (Charles Eyre) ও রোগার ব্রাডিল (Rogger Braddyll)। ১৬৮৮-র ২২জুন তাঁরা চার্নককে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে উল্লেখ ছিল ‘Calcutta’ শব্দটার।

এরপর কলকাতা ধাপে ধাপে হয়ে ওঠে ইংরেজদের কলকাতা। সে এক অন্য ইতিহাস। কোম্পানির ব্যাবসা-বাণিজ্য যত ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকল, ভারতে কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা পেল, কলকাতা হয়ে উঠল ইংল্যান্ডসহ সমস্ত ইউরোপের মানুষের কাছে শক্তিশালী চুম্বক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়ার দিকের নথিপত্রে দেখা যায়, ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজদের মধ্যে একটা প্রবাদ চালু ছিল, ‘বাংলায় প্রবেশের কয়েকশো দ্বার উন্মুক্ত, কিন্তু প্রস্থানের জন্য একটিও নয়।’ পলাশির পর কথাটা প্রযোজ্য হয়ে ওঠে কলকাতার ক্ষেত্রে।

পলাশি পর্যন্ত কলকাতার ইংরেজদের মোটামুটি একরকম চেহারা। এদিশিদের সামাজিক আচরণ, জীবনচর্যায় প্রভাবিত। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়, কখনো বিরূপ জল-হাওয়ার তাড়নায়। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ভারতীয়করণের একটা একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ভারতীয় আচার, অভ্যেস টিকে ছিল উনিশ শতকের প্রায় চল্লিশের দশক পর্যন্ত। আঠারো শতকে কয়েকজন সায়েব তো জীবনচর্যায় একেবারে হিন্দু অথবা মুসলমান হয়ে উঠেছিল। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত এদেশে কোম্পানির কর্মচারীদের দীর্ঘ সময় অবস্থান। স্বদেশের সঙ্গে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যয়বহুল সমুদ্রযাত্রার কথা চিন্তা করে অনেকেই পঞ্চাশ-ষাট বছর কাটাতে বাধ্য হত এদেশে। ছুটি-ছাটা মিলত কদাচিৎ। উইলিয়ম অগাস্টাস ব্রুক ১৭৬৯ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে চৌষট্টি বছর এদেশে কাটিয়েছিলেন এক নাগাড়ে। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এ হেন ব্যক্তি জীবনচর্যায় ভারতীয় প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেননি কোনো ভাবেই। স্বদেশের প্রতি চরম উদাসীনতা গড়ে উঠেছিল তাঁর মনে। জোনাথান ডানকান দীর্ঘ উনচল্লিশ বছর বাস করে প্রায় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠেন আচার-ব্যবহারে। তবে হিন্দু-মুসলমানের প্রভাবে তাদের ওপরের খোলসটা পাল্টে গিয়েছিল মাত্র, ভেতরটা পাল্টায়নি। ইংরেজরা তাদের ‘ব্রিটিশত্বের’ বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেনি বলে মনে করেন পি, জে, মার্শাল। পলাশির পর বাংলায় ক্ষমতার ভারসাম্য টলে যেতেই শাসক জাতি হিসেবে অহমিকা ক্রমশ গ্রাস করে ইংরেজদের। তাদের ভারতীয়করণের উপকরণগুলো চোখের বালি হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক শাসকের কাছে। মেকলে কলকাতায় তাঁর ‘নির্বাসিত জীবনের’ তেরটা মাস কাটান চল্লিশ জন ল্যাটিন ও গ্রিক লেখকের রচনা পড়ে, যাতে কোনো প্রাচ্য প্রভাব তাঁর মনে দাগ কাটতে না পারে।

আবার ভিন্নতর ছবিও চোখে পড়ে একই সঙ্গে। যে ওয়েলেসলির আমলে ভারতীয়দের জীবনচর্যাকে ঘৃণার চোখে দেখা শুরু হয়, সেই সময়েই দেখা যায়, হায়দ্রাবাদের রেসিডেন্ট জেমস কার্কপ্যাট্রিক এবং পুণার দরবারে রেসিডেন্ট উইলিয়ম পামার ভারতীয় মহিলাকে বিয়ে করে দিব্যি ভারতীয় হয়ে উঠেছেন সব দিক থেকে। জীবনের বেশির ভাগ সময় ভারতে কাটাবার পর তাঁদের মনে হয়েছে স্বদেশে ফিরে গিয়ে তাঁরা ভালো থাকবেন না। ভারতই হয়ে উঠেছে তাঁদের স্বদেশ।

আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কলকাতার ইংরেজদের মাথার ওপর যে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছিল, পলাশির পর তা কেটে যায়। ইংরেজদের কাছে কলকাতা তথা বাংলার আকাশ ঝলমল করে ওঠে হঠাৎই। ফলে উত্তর পলাশি পর্বে ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় পর্যন্ত যে রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, তার সুয়োগ নিয়ে কয়েকজন সায়েব ‘নবাব’ হয়ে ফিরে যায় বিলেতে। গোটা ইংরেজ জাতির চোখ ঝলসে যায় তাদের বিলাস-বৈভবের জৌলুসে। কলকাতা-ফেরত সায়েবরা তাদের সামনে তুলে ধরে কলকাতার এক মোহন ছবি। সকলেই হন্যে হয়ে ওঠে একবার কলকাতায় গিয়ে প্যাগোডার (দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা) গাছটা নাড়া দিতে। কিন্তু বাস্তবটা ছিল একটু অন্যরকম। ‘চিচিং ফাঁক’-এর মন্ত্রটা সকলে পেরে ওঠেনি রপ্ত করতে। ওয়ারেন হেস্টিংস হিসেব কষে দেখিয়েছেন, ১৭৬২ থেকে ১৭৮৪ সাল, বাইশ বছরে নিযুক্ত হয়েছিল ৫০৮ জন সিভিলিয়ন। তাদের মধ্যে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিল মাত্র ৩৭ জন, যারা অনেকেই কুড়ি হাজার পাউন্ডের বেশি সঞ্চয় করে নিয়ে যেতে পারেনি। ১৭৮৫ সালে হেনরি থোমাস কোলব্রুক তাঁর বাবাকে লিখেছিলেন, এদেশ আর আগের মতো সোনার খনি নয়। তবে হেস্টিংস বা কোলব্রুক যা-ই বলুন না কেন, বাঁকা পথে সিভিলিয়নরা পেয়ে গিয়েছিলেন সোনার খনির সন্ধান। স্বয়ং কর্নওয়ালিশই ১৭৮৭ সালে কবুল করেছিলেন, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট বিচার ও রাজস্ব বিভাগে কর্মরত সিভিলিয়নদের হাত থেকে ব্যক্তিগত ব্যাবসার ক্ষমতা কেড়ে নিলেও তারা আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবের নামে ব্যাপক ব্যাবসা-বাণিজ্যে ডুবে থাকত। তার সঙ্গে ছিল প্রতারণা ও অন্যান্য দুর্নীতি।

বিলেতের মানুষের মনেও এই প্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, সৌভাগ্যের খনি রয়েছে কলকাতার মাটিতে। তাই সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছোকরা সায়েবরা ছুটে এসেছিল কলকাতায়, সৌভাগ্যের সন্ধানে। কিন্তু শুধু এই উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড থেকে হাজার হাজার যোজন দূরে, ছ’মাসের সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা আসেনি। কিছু তরুণ অদম্য ইচ্ছের টানে এই অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপ দিলেও সেটা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছিল বেঁচে থাকার তাগিদ। আঠারো শতকের আশির দশক থেকে উনিশ শতকের প্রায় চল্লিশের দশক পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইংল্যান্ডের মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল চরম আর্থিক সংকটে। আঠারো শতকে ইংরেজ তরুণদের কলকাতায় আসার প্রাণান্তকর প্রয়াস, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় পতির সন্ধানে আসা কুমারী মেমদের ঢল, নাবিক-ভবঘুরেদের দীন জীবনযাত্রা সমসাময়িক ইংল্যান্ডের আর্থিক সংকট ও সামাজিক হতাশার এক মলিন বর্ণহীন ছবি তুলে ধরে মাত্র। বেঁচে থাকার জন্য বিলেতের গরিব ঘরের মেয়েদের নির্ভর করতে হত ত্রাণ ভাণ্ডারের ওপর।১০ এই আর্থিক সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ ছিল ভারতে এসে ভাগ্য পরীক্ষা করা। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও আর্থিক বিপর্যয় ছাড়াও বিলেতের সমাজের আর এক প্রথা অনেক ছেলেদের বাধ্য করত এদেশে রুটি-রুজির সন্ধানে ছুটে আসতে। সে দেশে পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হত বড়ো ছেলে। অন্য ভাইদের গড়ে নিতে হত নিজেদের ভবিষ্যৎ। তাই ভারতে আসা। পরিচালক সমিতির প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১৮১৩ সালের পর বিলেতের মানুষকে এদেশে আসার পথে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু কলকাতার ভীষণ অস্বাস্থ্যকর জল-হাওয়া ও পরিবেশে এই শহরে বেঁচে থাকাটাই ছিল কঠিন সমস্যা। তবুও জলন্ত প্রদীপে দেওয়ালি পোকার ঝাঁপ দেওয়ার মতো ইংরেজরা কৈশোরের সীমা পার হতেই চেপে বসত ভারতগামী জাহাজে। কেউ পরিচালক সমিতির ছাড়পত্র নিয়ে, কেউ গোপনে।

কলকাতার সায়েব বিশেষ করে পদস্থ সিভিলিয়ন, মার্চেন্ট, অ্যাটর্নিদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, তাদের অবাক করা অমিতব্যয়িতার কথা লিখে গেছেন সমসাময়িক ইউরোপীয় পর্যটকরা। উঁচুতলার সায়েবদের ঠাট-বাটে সংক্রমিত হয়েছিল কলকাতার প্রায় গোটা শ্বেতাঙ্গ সমাজ। অবসরপ্রাপ্ত সেনা যারা ট্যাভার্ন চালাত, ছোট দোকানদার, নাবিক, কারিগর, এমনকী ভৃত্যরা পর্যন্ত অনুকরণের চেষ্টা করত উঁচুতলার সায়েবদের জীবনযাত্রা। ‘কেরানি আর ফেরিওয়ালাদের ঔরঙ্গজেবের সিংহাসনে বসার সুয়োগ করে দিয়ে ভারত উল্টে দিয়েছিল ব্রিটিশ সামাজিক বিন্যাসকে’।১১

আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথম দিকে যে বিষয়টা পদস্থ সিভিলিয়নদের আভিজাত্যকে প্রকাশ করত, তা হল, তাদের ভৃত্যবিলাস। তবে এটা শুধু কলকাতা বা ভারতে নয়, বিশ্বের সর্বত্র অভিজাত শ্রেণির আভিজাত্যের অনিবার্য অনুষঙ্গ। সিভিলিয়নদের এই জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রার পেছনে অবশ্য একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল। তারা এ ব্যাপারে সচেতন ছিল যে মোগলের উত্তরসূরি হিসেবে এদেশকে শাসন করতে হলে এদেশের মানুষের সামনে মোগলাই আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে হবে আদব কায়দায়। ভারতীয়রা জানত, ইংরেজরা বণিক মাত্র। অভিজাত নয়। হিন্দু-মুসলমানের চোখে তারা নীলরক্তশূন্য একটা বানিয়ার জাত। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ঔপনিবেশিক শাসক সম্প্রদায় চেষ্টা চালিয়েছিল ভারতীয় ধারণা অনুযায়ী শাসক শ্রেণির চেহারা ও আচরণ রপ্ত করে তাদের চোখে সাবেকি শাসক শ্রেণির রূপকে তুলে ধরতে। বস্তুত, ইংরেজ ‘নবাব’ ছিল ভারতীয় ও ব্রিটিশ ধারণার মিলনের ফসল।১২ সুতরাং সায়েবদের ভৃত্যবিলাস তাদের প্রভুত্বের প্রতীক, না আভিজাত্যের প্রকাশ, না একান্তভাবে অনায়াস জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য, সে বিতর্ক থেকে যাচ্ছে। ব্রিটেনে প্রাচ্যের এই বিলাসভোগের প্রবণতাকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক মনে হয়েছিল, কারণ সেটা সে দেশের অর্থব্যবস্থাকে করে তুলেছিল দুর্বল ও পৌরুষহীন।১৩ ভারত-ফেরত ‘নবাব’দের ব্রিটেনবাসী এত হীনদৃষ্টিতে দেখত যে, সে দেশের শাসকদলের সদস্যপদ এবং পার্লামেন্টে আসন লাভের উচ্চাশা বাধা পেত স্বদেশবাসীর কাছ থেকে। এজন্যই এদেশে সিভিলিয়নরা অবসর গ্রহণের পর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত স্বদেশে ফেরার পর তাদের আত্মীয়-স্বজনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে।১৪

কোম্পানির আমলে কলকাতার মেমদের অবস্থা কি এদেশের মেয়েদের থেকে ভালো ছিল? এমন প্রশ্ন মনে জাগে। আঠারো শতকে কলকাতায় শ্বেতাঙ্গিনীর অভাবে মেমদের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। সে চাহিদা হ্রাস পায় উনিশ শতকে মেমদের জোগানে জোয়ার আসার ফলে। এর পরিণতি ভালো হয়নি। উনিশ শতকে বাঙালি সমাজের মতো মেয়েদের বাল্যবিবাহ না হোক, কিশোরী ও অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেমদের বিয়ে খুব একটা অপ্রচলিত ছিল না শ্বেতাঙ্গ সমাজে। সে সময় কলকাতা ছিল কুমারী মেমদের বিয়ের ছাদনাতলা। সেই সঙ্গে ছিল অসম বয়সের মধ্যে বিয়ে, পঁয়তাল্লিশ বছরের বর আর পনেরো বছরের কনে। উনিশ শতকে কলকাতায় কুমারী মেমদের পতি সন্ধানের বিপুল প্রয়াস, ব্যর্থ হয়ে কোনো পরিবারে মিসট্রেস হয়ে থাকা কিংবা পতিলাভে ব্যর্থ হয়ে আবার স্বদেশে ফিরে যাওয়া রীতিমতো করুণা জাগানো ঘটনা।

কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজ আপাতদৃষ্টিতে শ্রেণিহীন জনসমাজ মনে হলেও বস্তুত তা ছিল না। তাদের মধ্যেও ছিল শ্রেণিবৈষম্য। আঠারো শতকে সেটা তেমন টের পাওয়া না গেলেও উনিশ শতক থেকে তা প্রকট হতে থাকে। ১৮১৩ সালের পর এদেশে শ্বেতাঙ্গদের আসার ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পরিচালক সমিতির হাত থেকে চলে যাওয়ায় কলকাতায় শ্বেতাঙ্গ সমাজের কলেবর বৃদ্ধি পায়। কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে দেখা দেয় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, যাদের অবাঞ্ছিত নিম্নমানের জীবনযাত্রা, রুচিহীনতা, অপরাধ প্রবণতা ঠেলে দেয় সভ্য সম্ভ্রান্ত শ্বেতাঙ্গ সমাজের বাইরে। ওপরতলার ইংরেজরা বিব্রত বোধ করত এইসব নিচু শ্রেণির স্বদেশবাসীর উপস্থিতিতে। ঔপনিবেশিক শাসকরা উদ্বিগ্ন ছিল তাদের অসামাজিক কার্যকলাপে, কারণ, এর ফলে শাসকজাতি হিসেবে ইংরেজদের ভাবমূর্তি মলিন হয়ে যেত নেটিভদের চোখে।

কোম্পানির সেনা বাহিনীর মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল রাজকীয় সেনা অফিসারদের উচ্চমন্যতার কারণে। তাদের দেমাকি মনোভাব প্রশ্রয় দিয়েছিল বাহিনীর মধ্যে শ্রেণিবিদ্বেষকে। কোম্পানির সেনা অফিসাররা হীনম্মন্যতার শিকার না হয়ে পারত না। এজন্য অবশ্য দায়ী ছিল কর্তৃপক্ষের পক্ষপাত নীতি। ফৌজি অফিসার পত্নীদের অহমিকা উসকে দিয়েছিল শ্রেণিবৈষম্যকে। তারা অসামরিক সায়েবপত্নীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত সচেতনভাবেই। সেই সঙ্গে তাদের বর্ণবিদ্বেষ ছিল প্রবল। তার দৃষ্টান্ত শ্রীমতী ফেনটন, জেমিমা কিন্ডারসলি।

আঠারো-উনিশ শতকে যে সব পর্যটক কলকাতায় এসেছিলেন তাদের বিবরণ একরকম নয়। অনেকক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। শুধু তাই নয়, তাদের দেওয়া তথ্য অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সঠিক তথ্যের নিরিখে। যেমন, R. G. Wallace তাঁর Memoirs of India গ্রন্থে লিখেছেন (p.359) বিলেত থেকে নবাগত ইংরেজ তরুণদের পক্ষে এই শহরে কেরানির কাজজোটানোও কঠিন ছিল, কারণ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কেরানির পদে নেটিভদের প্রায় একচেটিয়া অবস্থান। খেয়াল রাখতে হবে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ১৮২৪ সালে, যখন কোম্পানির দপ্তরে ইংরেজি জানা নেটিভদের এমন আধিপত্য সম্ভব ছিল না কোনোভাবেই। ১৮৪৬ সালেও ইংরেজিতে দক্ষ পণ্ডিত ও মুনশির অভাবে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কর্তৃপক্ষকে।

আঠারো-উনিশ শতকে যে সব সায়েবমেম কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁদের এই শহরকে দেখার মধ্যেও পার্থক্য ছিল। কলকাতা সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতাও একরকম নয়। কলকাতাকে ক্লাইভের মনে হয়েছিল ‘One of the most wicked places in the Universe।’ অন্যদিকে শ্রীমতী হফল্যান্ড লিখেছেন, ‘Calcutta is the finest place in the world… bride like city’.১৫ মেমসাহেবরা কেউ কেউ এই শহরকে দেখেছেন এক ভয়ংকর স্থান হিসেবে, কেউ কলকাতাকে ভালবেসে বার বার এসেছেন এই শহরে দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ধকল অগ্রাহ্য করে। তারপর আর ফিরে যাননি স্বদেশে। মাটি নিয়েছেন এই শহরে। কেউ এই শহরে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে গিয়ে স্বস্তি পাননি। স্বদেশকে মনে হয়েছে বিদেশ। কেউ আবার দীর্ঘ কাল বাস করে কলকাতাকে এমন গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিলেন যে, বিদায় বেলায় ভেঙে পড়েছিলেন চরম বিষাদে। অনেক সায়েব আধিকারিক কলকাতার উন্নয়নে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁদের ভাবনা-চিন্তাকে।

কলকাতার সায়েবমেম বলতে সমস্ত ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনীকে বোঝালেও কলকাতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনী ছিল ইংরেজ। কলকাতার সায়েবমেম বলতে প্রধানত তাদেরই বোঝানো হয়েছে। তারাই আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। কিছু তথ্যের বহুমুখী প্রাসঙ্গিকতার জন্য সেগুলির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠেছে একাধিক অধ্যায়ে। পাঠক-পাঠিকারা এটাকে পুনরাবৃত্তি মনে করে যেন বিরক্ত বোধ না করেন।

সূত্রনির্দেশ

১. Oneil Biswas, Calcutta and Calcuttans : From Dihi to Megalopolis, Calcutta (1992), p.22

২. Theon Wilkinson, Two Monsoons, London (1976), p.3

৩. L.S.S. O’Malley, The Indian Civil Service, 1661-1930, London (1931), p. 178

৪. তদেব।

৫. P.J Marshall, British Society in India under the East India Company, (Modern Asian Studies, 31.1.1997, p. 108.

৬. Theon Wilknison, প্রাগুক্ত, p.8.

৭. William Dalrymple, White Mughals, Gurgaon (2002) p.308.

৮. L.S.S. O’Malley, The Indian Civil Service, 1601-1930, London(1931),pp.31-32.

৯. তদেব, p.34.

১০. The Asiatic Journal, New Series, vol,18, 1835, p.129

১১. E.M. Collingham, Imperial Bodies, Malden, USA,(2001), p.21

১২. তদেব, p.19

১৩. তদেব, p.22

১৪. তদেব, pp. 35-36

১৪ক. General (General) Proceedings.17 June 1846. No 42

১৫. P.T. Nair, (ed),Calcutta in the 19th Century, Calcutta (1989) p.980

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *