প্রাইভেট ডিটেকটিভ
বিধু বলত-ম্যাট্রিক পাশ করেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হব৷
বিধু যে ম্যাট্রিকের ফটক পেরোতে পারবে এত বড়ো দুরাশার জন্ম অসম্ভব৷ বিড়ালের কাছে কুকুর যেমন, তার কাছে ইস্কুলের বইগুলো ছিল তেমনই চক্ষুশূল৷ দিন-রাত পড়ত খালি গোয়েন্দা-কাহিনি৷
অসংখ্য গোয়েন্দা-কাহিনি পড়ে পড়ে বিধুর এখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, ডিটেকটিভ হতে গেলে যা যা জানা দরকার সে-সবের কিছুই তার আর জানতে বাকি নেই৷
বিধু যখন-তখন নাক-মুখ সিঁটকে বলত, ‘যত হাঁদারাম গিয়ে বাংলা দেশের পুলিশ দলে ভরতি হয়েছে! চোর-ডাকাত ধরবার আসল ফন্দিই তারা জানে না৷ শার্লক হোমসের মতো পাকা ডিটেকটিভ এখানে নেই৷ আমিই হব বাংলা দেশের প্রথম শার্লক হোমস৷’
বিধুর মুখে রোজ এমনই সব কথা শুনে শুনে ক্রমে আমারও তার বুদ্ধি আর শক্তির উপরে শ্রদ্ধা বাড়তে লাগল৷
যখন শোনা যেত অমুক জায়গায় খুব বড়ো চুরি হয়ে গেছে, কিন্তু পুলিশ চোর ধরতে পারছে না, বিধু তখন আফশোস করে বলত, ‘ওঃ, বাংলা দেশের পুলিশ কেবল ফুলিশ নয়, বদ্ধ অন্ধও! আমি হলপ করে বলতে পারি ঘটনাস্থলে চোর নিশ্চয় কোনো চিহ্ন রেখে গেছে! একটা বোতাম, আঙুলের দাগ, কি একটা পায়ের ছাপ৷ তাই দেখেই আমি চোর ধরে দিতে পারি! এ-সব মামলার কিনারা করবার জন্যে পুলিশ আমার কাছে আসে না কেন? বিলেতের পুলিশ তো শার্লক হোমস-এর কাছে আনাগোনা করত!’
আমি চমৎকৃত হয়ে বলতাম, ‘ভাই বিধু, এদেশে কেউ তোমাকে চিনতে পারল না! গেঁয়ো যোগী ভিক্ষা পায় না কিনা! কিন্তু তোমাকে বন্ধুরূপে পেয়ে আমি গর্বিত!’
বিধু মুরুব্বিয়ানা চালে বার-দুয়েক আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলত, ‘শার্লক হোমসের সঙ্গে ছায়ার মতন থাকতেন তাঁর বন্ধু ওয়াটসন৷ তুমিই হবে আমার ওয়াটসন! আমরা দুজনে বাংলা দেশের চোর-ডাকাতদের বংশ নির্মূল করে ছাড়ব!’
আমি বলতাম, ‘এ আমার সৌভাগ্য!’
সেইদিন থেকেই বিধু আমাকে ওয়াটসন বলে ডাকতে শুরু করল৷
আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি না, হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে হল এক দুষ্ট চোরের আবির্ভাব৷
রাত্রে চোর এসে লোহার সিন্দুক খোলবার চেষ্টা করছিল৷ পাশের ঘরে ছিলেন বাবা৷ হঠাৎ কী শব্দ শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়৷ তিনি গোলমাল করতেই চোর দেয় চম্পট! কিচ্ছু করতে পারেনি৷
বিধু সেই খবর শুনেই উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওয়াটসন, এই ব্যাপার থেকেই আমাদের ডিটেকটিভ-জীবনের পত্তন করা যাক! যে চুরি করতে এসেছিল আমি তাকে ধরে দেব!’
সবিস্ময়ে বললাম, ‘কেমন করে?’
বিধু মুখে বিপুল গাম্ভীর্যের বোঝা চাপিয়ে বলল, ‘ডিটেকটিভের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সূত্র আবিষ্কার করা৷ ঘটনাস্থলে চোর কিছু চিহ্ন রেখে গেছে?’
‘গেছে৷ একটা কোট৷’
‘কোট তো থাকে গায়ে, চোর সেটা ফেলে গেছে কেন?’
‘কাল রাতে কীরকম গুমোট গরম গেছে জানো তো? সিন্দুক খোলবার আগে কাজের সুবিধে হবে বলে চোর ব্যাটা বোধ হয় কোটটা গা থেকে খুলে রেখেছিল৷ তার পর তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়িতে কোটটা নিয়ে লম্বা দিতে পারেনি৷’
আমার পিঠ চাপড়ে বিধু বলল, ‘ওয়াটসন, তোমার আন্দাজ করবার শক্তি দেখে খুশি হলাম! বহুত আচ্ছা, নিয়ে এসো সেই কোটটা!’
এক দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে কোটটা নিয়ে এলাম৷ ছোটো ছোটো চৌকো ঘর-কাটা ছিটের কোট৷
কোটের পকেট থেকে বেরোল এক প্যাকেট পাসিং-শো সিগারেট আর কাগজে মোড়া খানিকটা দোক্তা, এবং একটা নয়া পয়সা৷
বিধু একটা ফিতে নিয়ে কোটটা খানিকক্ষণ ধরে মাপল, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ওয়াটসন, যে এই কোটের মালিক, সে পান খেতে ভালোবাসে, সে বড়োলোক নয়, সে দেহে খুব লম্বা-চওড়া৷’
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললাম, ‘কী করে এমন অদ্ভুত আবিষ্কার করলে?’
‘সে চিনেবাদামও খায়৷’
‘কী আশ্চর্য, কী করে জানলে?’
‘পকেটে যে দোক্তা নিয়ে বেরোয় সে পানের ভক্ত না হয়ে যায় না৷ যার সম্বল খালি একটা নয়া পয়সা আর যে পাসিং শো-র মতন কম দামের সিগারেট ব্যবহার করে, নিশ্চয়ই সে বড়োলোক নয়৷ কোটের গলা, ছাতি আর ঝুলের মাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটার দেহ খুব লম্বা-চওড়া৷ পকেটের ভেতরে কতকগুলো চিনেবাদামের খোসা পেয়েছি, সুতরাং চোর চিনেবাদামও খায়৷’
আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, ‘ধন্য বিধু, ধন্য তোমার বুদ্ধি!’
বিধু গর্বিত কন্ঠে বলল, ‘চোরের চেহারা আর স্বভাব জানা গেল৷ এখন তাকে গ্রেপ্তার করতে আর বেশি দেরি লাগবে না৷ বলতে কী, সে তো আমার এই হাতের মুঠোয়’-বলেই সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে ধরল৷
আমি বিস্ফারিত চোখে রোমাঞ্চিত দেহে বিধুর হাতের মুঠোর দিকে তাকিয়ে রইলাম-যদিও বুঝতে পারলাম না যে, তার অতটুকু মুঠোর ভিতর অত-বড়ো একটা লম্বা-চওড়া চোর বন্দি হবে কেমন করে?
বিধু আবার বলল, ‘ধিক এই বাংলা দেশের পুলিশ! এইবারে দেখুক তারা, বুদ্ধি থাকলে কত সহজে টপ করে চোর ধরা যায়!’
বিধু মুখে আবার বিপুল গাম্ভীর্যের ভাব এনে বলল, ‘ডিটেকটিভের দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে, সর্বদা সতর্ক চোখ খুলে রাখা৷’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সর্বদা চোখ খুলে রাখলে চোখে কিছু পড়বেই-নিদেন পোকা-মাকড়টাও৷’
তার পর কিছুকাল বিধু পথে-পথেই দিন কাটায়৷ আমাকেও দায়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই থাকতে হয়-কারণ আদি শার্লক হোমসের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতেন তাঁর বন্ধু ওয়াটসন, আর আমি হচ্ছি সেই ওয়াটসনেরই মূর্তিমান দ্বিতীয় সংস্করণ৷ না বলবার জো নেই৷
পথে ঘুরে ঘুরে পায়ে পড়েছে যখন ফোসকা এবং রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের রং হয়েছে যখন তামাটে, তখন হঠাৎ একদিন আমাদের খুলে রাখা সতর্ক চোখে পড়ল একটি অতিশয় সন্দেহজনক মূর্তি!
বিধু উত্তেজিত আনন্দে একটি লম্ফ ত্যাগ করে বলল, ‘ওয়াটসন, দেখছ লোকটার চেহারা কীরকম লম্বা-চওড়া?’
‘হুঁ!’
‘ওর গায়ের কোটটা দেখো!’
‘ছোটো ছোটো চৌকো ঘর-কাটা ছিটের কোট৷ চোর আমাদের বাড়িতে যে কোটটা ফেলে গেছে ঠিক যেন তারই জোড়া!’
‘লোকটা সিগারেটও টানছে৷ কিন্তু ওটা কী সিগারেট?’
‘পাসিং শো হতে পারে৷ কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসব নাকি?’
‘ওয়াটসন, তুমি একটা আস্ত এবং মস্ত চডড! তাহলে সন্দেহ করবে যে! . . . আরে দেখো দেখো, লোকটা কাকে ডাকল!’
‘চিনেবাদামওয়ালাকে!’
‘সব হুবহু মিলে যাচ্ছে! চলো, আমরা ওর পিছু নিই!’
পিছু নিলাম৷ আধ ঘণ্টা এ-পথে সে-পথে ঘুরে লোকটা একটা পানওয়ালার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷
বিধু তফাত থেকে উঁকি মেরে দেখে বলল, ‘ওয়াটসন, এ কী হল! ও যে গোল্ড-ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট কিনল!’
‘ব্যাটা বোধ হয় অন্য কোথাও চুরি করে হঠাৎ বড়োলোক হয়ে পড়েছে!’
‘ওয়াটসন, তুমি একটি জিনিয়াস৷ ঠিক ধরেছ! এখন একবার যদি ওর কোটটা হাতে পাই!’
‘তাহলে কী হবে?
‘চোরের কোটের সঙ্গে ওর কোটের মাপ মিললেই তো কেল্লা ফতে!’
‘কিন্তু ও তোমার হাতে কোটটা দেবে কেন?’
‘সেইটেই তো সমস্যা! লোকটা গুণ্ডার মতন দেখতে৷ জোর করে কোট দেখতে চাইলে হয়তো ধাঁ করে মেরেই বসবে!’
লোকটা আবার চলতে শুরু করল৷ আমরাও তার সঙ্গ ছাড়লাম না৷
তারপর সে হঠাৎ একখানা বাড়ির ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
বাড়িখানার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিধু বলল, ‘আজ রাত বারোটার সময় এইখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে৷’
* * *
বিধু মুখে গাম্ভীর্যের জাহাজ নামিয়ে এনে বলল, ‘ডিটেকটিভের তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে, অসীম সাহসে বিপদ-আপদকে তুচ্ছ করা৷ ওয়াটসন, নিশ্চয়ই তুমি ভীতু নও?’
রাত বারোটা৷ আবছা চাঁদের আলোয় আমরা দু-জনে সেই বাড়িখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ চারিদিক কী স্তব্ধ! পথে নেই জনপ্রাণী৷
বললাম, ‘আমার বিশ্বাস আমি ভীতু নই৷ কী করতে হবে বলো!’
‘বাড়ির গা বেয়ে ওই যে নলটা, ওইটে অবলম্বন করে দোতলায় উঠতে হবে৷ অবশ্য আমিও উঠব৷’
প্রস্তাব শুনেই হৃৎকম্প উপস্থিত হল৷ কিন্তু মুখে বললাম, ‘তারপর?’
‘সেই লোকটা নিশ্চয়ই এখন কোনো ঘরে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে৷ ঘুমোবার আগে কোটটা সে খুলে রেখেছে৷ আমাদের সেই কোটটা আবিষ্কার করতে হবে৷’
‘যদি ধরা পড়ি?’
‘এটা দেখলে কেউ আর আমাদের ধরতে আসবে না! দেখছ, এটা কী?’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘কী সর্বনাশ! তুমি কি মানুষ খুন করতে চাও? ওটা যে রিভলভার!’
বিধু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, নকল রিভলভার৷ বিলিতি খেলনার দোকানে পাওয়া যায়৷ এখন এসো, আমরা উপরে উঠি৷’
নল বেয়ে দোতলায় ওঠার হাঙ্গামাটা আমার মোটেই ভালো লাগল না৷ একবার হাত ফসকালেই হয় হাসপাতাল, নয় নিমতলা ঘাটে যাত্রা করতে হবে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে৷ ওয়াটসন হওয়ার এত বিপদ, তা জানতাম না! মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম৷ কিন্তু তবু ছাড়ান নেই, শেষ পর্যন্ত উঠতে হল৷
ফাঁড়ার প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেল৷ জ্যান্ত অবস্থাতেই ছাদের উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম বটে, কিন্তু বুকের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পেলাম স্পষ্ট৷
এক হাতে টর্চ আর এক হাতে নকল রিভলভার নিয়ে বিধু চুপিচুপি বলল, ‘ওইদিকে সিঁড়ি রয়েছে৷ পা টিপে টিপে আমার সঙ্গে নেমে এসো৷’
পা টিপে টিপেই অগ্রসর হলাম বটে, কিন্তু মনে হতে লাগল আমার বুকের দুপদুপুনির শব্দে সারা পাড়া এখনই জেগে উঠবে৷ মনে মনে বললাম-হে মা-কালী, হে মা-দুর্গা! এ-যাত্রা যদি মানে মানে আমাকে রক্ষা করো, তাহলে আর কখনো ওয়াটসন হবার নাম মুখে আনব না৷
কিন্তু আমার কাতর প্রার্থনা মা-কালী বা মা-দুর্গার কাছে পৌঁছোবার আগেই বারান্দার ওধারের অন্ধকারের ভিতর থেকে গর্জন করে কে বলে উঠল, ‘কে রে! কে রে! কে রে!’ তারপরেই অতি দ্রুত পায়ের শব্দ৷
বারান্দার এ-পাশ হাতড়ে বিধু তৎক্ষণাৎ একটা দরজা আবিষ্কার করে ফেলল এবং চোখের পলক পড়বার আগেই আমাকে টেনে নিয়ে একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল৷ বিধু বলল, ‘ডিটেকটিভের চতুর্থ কর্তব্য হচ্ছে, উপস্থিত বুদ্ধি খাটাতে পারা৷ ভাগ্যিস আমি উপস্থিত বুদ্ধি হারাইনি, নইলে এতক্ষণে ওরা আমাদের ধরে ফেলত!’
হঠাৎ সুইচ টেপার শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতর যেন তীব্র আলোর ঝড় খেলে গেল!
এক মুহূর্ত অন্ধের মতো থেকে যখন আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলাম, তখন স্তম্ভিত নেত্রে দেখলাম যে, খাটের উপরে অবাক বিস্ময়ে বসে আছেন আমাদেরই স্কুলের হেড-পণ্ডিতমশাই!
নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না-এও কি সম্ভব? আমাদের ইস্কুলের সদাই-খাপ্পা হেড-পণ্ডিতমশাই, ভয়ংকর খোট্টাই-গাঁট্টার আবিষ্কারক রূপে ছেলে-মহলে যিনি অত্যন্ত বিখ্যাত, আমরা কি আজ অজান্তে তাঁরই বাড়িতে, তাঁরই শয়নগৃহে এসে পড়েছি? একেবারে বাঘের মুখে! ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে আমার মূর্ছার উপক্রম হল৷
ওদিকে বাহির থেকে ঘরের দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল এবং সেই সঙ্গে চিৎকার শোনা গেল, ‘চোর! চোর! দাদা, তোমার ঘরে চোর ঢুকেছে?’
এ আবার কী হল-চোরের খোঁজে এসে নিজেরাই চোর বলে ধরা পড়ব নাকি?
হেড-পণ্ডিত শুধোলেন, ‘কে রে? প্রেমলাল না? আরে বিধুভূষণও যে! ব্যাপার কী হে, তোমার হাতে রিভলভারের মতন ওটা আবার কী? তোমরা স্বদেশি ডাকাত হয়েছ নাকি?’
ধন্য বিধু, তখনও উপস্থিত বুদ্ধি হারাতে রাজি হল না সে৷ মুখে হাসি আনবার মিথ্যা চেষ্টা করে বলল, ‘আজ্ঞে না স্যার, আমরা স্বদেশি ডাকাত নই-আমরা হচ্ছি প্রাইভেট ডিটেকটিভ!’
‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ? বটে, বটে? তাই রাত বারোটার সময় চোরের মতো ঢুকেছ আমার বাড়িতে? ওদিকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছ আমার ঘরে? আমাকে ন্যাকা পেয়েছ, না? আচ্ছা দাঁড়াও!’-পণ্ডিতমশাই খাট থেকে লাফিয়ে পড়ে বেগে তেড়ে এসে বিধু-ডিটেকটিভের মাথায় ঘটাং করে বসিয়ে দিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ খোট্টাই-গাঁট্টা৷
ইতিমধ্যে আমার ভীত ও ব্যস্ত চোখে পড়ল, ঘরের একটা জানলায় একটা গরাদ নেই৷ পণ্ডিতমশায়ের দ্বিতীয় গাঁট্টা বিধুর মাথায় অবতীর্ণ হবার আগেই সেই ভাঙা জানলা দিয়ে আমি রাস্তায় ঝাঁপ খেলাম৷ হাতে-পায়ে যথেষ্ট চোট লাগল বটে, কিন্তু সুবিখ্যাত খোট্টাই-গাঁট্টার তুলনায় সে-সব আঘাত কিছুই নয়৷
পরদিন সকালে বিধু ম্লানমুখে এসে দেখাল, গাঁট্টার চোটে তার মাথায় এগারো জায়গা ফুলে ঢিবি হয়ে উঠেছে৷
খোট্টাই-গাঁট্টার কীর্তি-কথন যখন শেষ হল, বিধু অভিমানভরে বলল, ‘ওয়াটসন, তুমি যে এমন কাপুরুষ আমি তা জানতাম না! আমাকে যমের মুখে ফেলে অনায়াসে চম্পট দিলে?’
দুঃখিত স্বরে বললাম, ‘পালিয়ে আর এলাম কোথায় ভাই, যমের মুখ থেকে কি পালিয়ে আসা যায়? ইস্কুলে গেলেই টের পাব, খোট্টাই-গাঁট্টা আমারও জন্যে বিপুল বিক্রমে অপেক্ষা করছে!’
বিধু মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তোমার আর ভয় নেই, তুমি হচ্ছ মাত্র ওয়াটসন আর আমি হচ্ছি বাংলার শার্লক হোমস-তোমার চেয়ে ঢের বড়ো, আর বড়ো গাছই ঝড়ে পড়ে৷’
বিধুর জাঁক আজ আর ভালো লাগল না৷ বিরক্ত ভাবে বললাম, ‘তার মানে?’
বিধু বলল, ‘সমস্ত ঝড় আমার মাথার উপর দিয়েই বয়ে গেছে, তোমার আর কোনো ভয় নেই৷’
‘তাই নাকি? গাঁট্টা-বৃষ্টি যখন থামল তুমি তখন কী করলে?’
‘আমি পণ্ডিতমশাইকে সব কথা খুলে বললাম৷ শুনে তিনি পাঁচ মিনিট ধরে হো হো করে হেসে বললেন-এ-সব কথা জানলে আমি তোমাকে এত জোরে অতগুলো গাঁট্টা মারতাম না; তাঁর ঘরে রসগোল্লা ছিল, আমাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে তবে ছেড়ে দিলেন৷’
‘আমরা যার পিছু নিয়েছিলাম, সে লোকটা কে?’
‘পণ্ডিতমশায়ের ভাই৷ আমাদের বড়োই ভুল হয়ে গেছে, আবার দেখছি গোড়া থেকে তদন্ত আরম্ভ করতে হবে৷ ডিটেকটিভের পঞ্চম কর্তব্য হচ্ছে-‘
বাধা দিয়ে বললাম, ‘তোমার ও ডিটেকটিভের কর্তব্যের তালিকা রেখে দাও! মানুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য হচ্ছে, নিজের প্রাণ বাঁচানো৷ আমি আর তোমার দলে নেই৷’
‘সে কী ওয়াটসন?’
‘কে ওয়াটসন? আমার নাম প্রেমলাল মিত্র৷ নিজের নাম কখনো আমি ভুলব না!’