প্রহেলিকা

প্রহেলিকা

পাটলীপুত্র নগরী গঙ্গা, সদানীরা ও হিরণ্যপ্রভার সঙ্গমস্থলে গড়ে ওঠা এক সুরম্য জনপদ, বহুশতাব্দী ধরে শক্তিশালী মগধ সাম্রাজের প্রাণকেন্দ্র ও রাজধানী। তবে পাটলীপুত্রের এই বৈভবের অন্যতম কারণ তার ভৌগলিক অবস্থান। নদীসঙ্গমে গড়ে ওঠা এই নগরীর উপান্তে নির্মিত সুবিশাল বন্দর পশ্চিমে ভৃগু কচ্ছ ও পূর্বে তাম্রলিপ্তের মাধ্যমে সুদুর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দুয়ের সাথেই সংযোগ রক্ষায় সমর্থ হয়েছে। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার গুণে পত্তনীর পরিবেশ দেশীয় তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পক্ষে বিশেষ অনুকূল; ফলে, দেশী বিদেশী বণিকদের আনাগোনায় এই নদী বন্দর কর্মচঞ্চল ও বর্ধিষ্ণু।

বাণিজ্যের প্রয়োজনে নগর প্রাচীরের বাইরে বন্দরসংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেকগুলি ছোট, বড় পান্থশালা ও শুণ্ডালয়। বর্ধিষ্ণু পান্থশালাগুলি প্রধানত দেশী ও বিদেশী বণিকদের সাময়িক আবাসস্থল, আবার বাণিজ্য সংক্রান্ত বৈঠকেরও কেন্দ্র অনেকক্ষেত্রেই। শুণ্ডালয়েও হরেকরকম মানুষের যাতায়াত; সন্ধ্যাকালে শীতল পানীয়, অক্ষক্রীড়া, এছাড়াও নানান বিনোদনের বন্দোবস্তপূর্ণ পানশালাগুলি কিছু সময়ের জন্য স্বদেশ বিরহ ভুলে থাকার আশ্রয়।

ভদ্র রৈবতের পানশালাটি বর্ধিষ্ণু ও অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও বিদেশী নাগরিকদের নিত্য যাতায়াত সেখানে। বিকেল থেকেই অতিথি সমাগমে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পানসভা কক্ষ; দীপস্তম্ভের মায়াবী আলো আর চম্পকগন্ধী কাম্পিল্যের সুবাসে পরিবেশ হয় মোহময়। সুবেশ সেবকের দল ত্রস্তপায়ে অভ্যর্থনা জানায় অতিথিদের, ফুলমালা, তাম্বুল হাতে এগিয়ে আসে সুন্দরী পরিবেষিকারা। সুরা পরিবেষন ছাড়াও মানী অতিথিকে সঙ্গদানেও বিশেষ পটু এই সুরসিকাগণ। নিভৃতে একাকী সময় যাপনের উদ্দেশ্যে একান্ত কক্ষেরও বন্দোবস্ত আছে অতিথি বিশেষের জন্যে। তবে এই পানশালাটির আরেকটি সম্পদ হল কিলাত, সে এক খর্বকায় মানব; রহস্যালাপ ও শারীরিক অনুশীলন দেখিয়ে মনরঞ্জনে পাটলীপুত্রে তার জুড়ি মেলা ভার।

***

স্বায়ংকাল আসন্নপ্রায়, গোধূলির রঙের ছোঁয়া নদীবক্ষে, ব্যস্ত বন্দরে কর্মবিরতির উদ্যোগ; সুন্দর পোশাক ও সাজসজ্জায় বণিক ও শ্রেষ্ঠীরা চলেছেন দিবসের ক্লান্তি দূর করতে বিভিন্ন পানশালায়। রৈবতের শুণ্ডালয়ের ভিতরে অতিথি সমাগম শুরু হয়েছে, পানকক্ষের একপাশের বেদীতে বসে আছেন এক সঙ্গীতকার, তাঁর বাঁশীতে বেজে উঠেছে মধুর তান। কিলাত রংবিরঙ্গী বিচিত্র পোশাকে সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কক্ষময়, কিছুপরে শুরু হবে তার অভিনব উড়ান খেলা, কক্ষের ছাদ থেকে ঝোলানো রজ্জুতে ভর করে সে উড়ে বেড়াবে বায়বীয় কপির মত। এবিষয়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যেই, এ খেলা বিপজ্জনক, বিশেষ উপলক্ষ ভিন্ন কিলাত দেখায়না এটি। এক বিদেশী রাজপুরুষের আতিথ্যকে ঘিরে এদিনের এই আয়োজন। রাজপুরুষ ভীমদেব যৌধেয়বাসী, অক্ষক্রীয়ায় বিশেষ আসক্ত, সবান্ধব যাওয়া আসা করছেন বিগত কয়েকদিন, কিলাতকে এরই মধ্যে বিশেষ সন্তোষের চোখে দেখেছেন তিনি।

রাজপুরুষ তখনও আসেননি, কয়েকজন ভিনদেশী বণিক বসে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে; শ্রেষ্ঠী সোমদত্ত ও ভদ্রিল কোনও বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন, তাঁদের দুজনেরই সুবিশাল ভাণ্ডশালা আছে বন্দরে। এসময়ে কক্ষে প্রবেশ করেন রুদ্রষেণ, পোষাক ও ব্যক্তিত্বে তিনি অন্যদের থেকে কিছু আলাদা, এক নজরেই বোঝা যায় সেকথা। রুদ্রষেণ পাটলীপুত্রের এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, শুল্ক বিভাগের কর্মী। বিগত একমাস যাবৎ বিশেষ দায়িত্বে বন্দর চত্ত্বরেই বহাল আছেন, সেই অবধি নিয়মিত এই শুণ্ডালয়েই সন্ধ্যাকাল যাপন করেন তিনি। স্বভাবগম্ভীর মানুষটি বাক্যালাপ সামান্যই করে থাকেন, তবে সেবক ও পরিবেষিকাদের পারিতোষিক দেন মুক্তহস্তে। রৈবতের পানশালায় তাঁর বিশেষ খাতির পদমর্যাদাগুণে।

রুদ্রষেণ কক্ষের মধ্যস্থলে একখানি শূণ্য উৎপীঠিকার সমুখে গিয়ে বসেন, এটি তাঁর পছন্দের জায়গা, রৈবত সেটি প্রতিদিন সংরক্ষিত রাখে তাঁর জন্য। রূদ্রষেণ স্বল্পবাক এবং হয়তো কিছুটা উদ্ধতও, তবে পানকক্ষের কেন্দ্রতে বসে অতিথিদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে পছন্দ করেন সুরা পানের অবকাশে। কিছু সময়ের মধ্যে ঘর ভরে ওঠে; একসময় সপারিষদ দেখা দেন ভীমদেবও। তাঁকে দেখে কিলাত এগিয়ে যায় হাসিমুখে, অনুমতি নিয়ে শুরু করে সে তার অভিনব খেলা। উপরের খিলান থেকে ঝুলছে কয়েকটি রজ্জু, একখানি বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে তার একটি ধরে ঝুলে পড়ে কিলাত; আর তার পর শুরু হয় এক থেকে আরেক রজ্জু ধরে তার বায়বীয় সঞ্চারণ। অতিথিরা বাহবা রবে উৎসাহ দেন, ভীমদেবের চোখেমুখে উত্তেজনা, এ দৃশ্য তাঁকে বিস্মিত করেছে সন্দেহ থাকে না। সেবকের দল সতর্ক ভাবে লক্ষ্য রাখে কিলাতের উপর, তাদের চোখেমুখে আশঙ্কা। রুদ্রষেণ অবশ্য খেলায় তেমন মনযোগী নন, তিনি লক্ষ্য করছেন অতিথিদের অভিব্যক্তি; অযথা জীবনের ঝুঁকি নেওয়া তাঁর কাছে বাতুলতা মাত্র।

‘অতি উত্তম! জয়তু কিলাত!’ ভীমদেব সরব হন অতি উচ্ছ্বাসে, আর ঠিক তখনই ঘটে যায় এক বিপর্যয়, কিলাত সামনের ঝুলন্ত রজ্জুটি ধরতে গিয়ে ব্যার্থ হয়। সমস্ত কক্ষে নিমেষে নেমে আসে এক শ্বাসরোধকারী নিস্তব্ধতা, শূন্য থেকে অসহায়ভাবে পতন ঘটে কিলাতের, তবে ভূমি নয়, সে আছড়ে পড়ে রুদ্রষেণের পৃষ্ঠে। একঝটকায় তাকে মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ান রুদ্রষেণ, তাঁর মুখভাব থমথমে, নিষ্ঠুর ভাবে পদাঘাত করেন তিনি কিলাতকে অসম্ভব ক্রোধে। রৈবত ছুটে আসে কিলাতকে সরিয়ে নিতে, অতিথিরা নিজেদের মধ্যে উষ্মা প্রকাশ করেন এই অমানবিক ঔদ্ধত্যে। অল্পসময় পরে, রৈবতের সাথে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করে কিলাত রুদ্রষেণের কাছে, তখনও তার চোখেমুখে বিপর্যয়ের রেশ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে এর পরে, বংশীবাদকের সুরজাল বয়ে আনে স্বস্তি।

প্রায় দুইদণ্ডকাল কেটে গেছে, ‘পানপাত্র খালি যে আর্য?’ বিলোল কটাক্ষ হেনে সুন্দরী মহল্লিকা সুরাভাণ্ড হাতে রুদ্রষেণের পাশে এসে দাঁড়ায়। সে ব্যস্ত ছিল নিকটে বসা এক বিদেশী বণিকের সেবায়, রুদ্রষেণ বহুক্ষণ চুপচাপ, পানীয়তেও আগ্রহ দেখাননি কিলাতঘটিত বিড়ম্বনার পর থেকে। সম্ভবত রৈবতের ইশারাতেই সে মনযোগী হয়েছে প্রভাবশালী অতিথির প্রতি; মহল্লিকাকে রুদ্রষেণ পছন্দ করেন।

‘প্রয়োজন নেই’ রুদ্রষেণ রুষ্টস্বরে উত্তর দেন, তাঁর মুখের ভাবে একপ্রকার জান্তব বিকৃতি।

‘একথা বললে যে ব্যাথা পাই প্রভু; সুরা কি প্রয়োজনে পান করার বস্তু? না হয় এই অধমার মান রাখতেই নিন’, কথাকটি বলে মহল্লিকা সুরা ঢেলে দেয় তাঁর পাত্রে অনুমতির অপেক্ষা না করে, সেই সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে সে।

‘এই অযাচিত আগ্রহ অন্যস্থানে প্রকাশ কর দাসী!’ পানপাত্র ঠেলে সরিয়ে দেন অতিথি, পানীয় ছলকে ছড়িয়ে পড়ে পীঠিকার উপরে। দাসী সম্বোধনে অপমানে রক্তাভ হয় মহল্লিকার মুখশ্রী; তবু অভ্যস্ত পেশাদারিত্বে আন্তরিক ভাব বজায় রাখে সে।

‘তবে এই মিষ্ট তাম্বুল নিন’ একখানি তাম্বুল রুদ্রষেণের ওষ্ঠপ্রান্তে ধরে মহল্লিকা, নিজের বামহাতখানি আলগোছে ছড়িয়ে দেয় সে অতিথির স্কন্ধে অন্তরঙ্গতায়। রুদ্রষেণের মুখচোখ অগ্নিগর্ভ, কপালে জমে উঠেছে স্বেদবিন্দু, এক ঝটকায় মহল্লিকার হাত খানি সরিয়ে, তার কেশগুচ্ছ চেপে ধরে সজোরে ধাক্কা মারেন তিনি, ‘কুহকিনি দূর হ!’ মহল্লিকা ভূপতিত হয়, পীঠিকার পদস্তম্ভে লেগে কপাল কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে তার।

‘কাপুরুষ! দুর্বলের উপর পৌরুষ দেখাও?’ পার্শ্ববর্তী পীঠিকার বণিক গর্জে উঠে রুদ্রষেণের সামনে এসে দাঁড়ান, কিছুপূর্বে এঁর সেবাতেই ব্যস্ত ছিল মহল্লিকা; পূর্বের কিলাতপর্বও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নীরবে। ‘সাহস থাকে আমার সাথে শক্তিপরীক্ষায় এসো’, রুদ্রষেণকে প্ররোচিত করেন তিনি। কক্ষমধ্যে পুনরায় নেমে আসে স্তব্ধতা; জনগনের নীরব সমর্থন বণিকের পক্ষে, সন্দেহ থাকে না। হঠাতই উন্মত্ত ক্রোধে কোষবদ্ধ ছুরিকা বের করে বণিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন রুদ্রষেণ, বণিকও ছুরিকা বের করেন আত্ম প্রতিরোধে। আচমকা শুণ্ডালয়ের পরিবেশ যে এরূপ ভয়াবহ হয়ে উঠবে কল্পনা করেনি কেউই; অথচ এই মরণপণ দ্বন্দযুদ্ধে মধ্যস্থতা করতে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল। বাধ্য হয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে সকলেই।

মল্লযুদ্ধের প্রচণ্ডতায় ভূলিন্ঠিত হয়েছেন দুজনেই, তবু একে অন্যের দৃঢ় বন্ধন থেকে বিচ্যূত হননি কেউই, ঝন্ঝন্ শব্দে রুদ্রষেণের ছুরকাটি ছিটকে পড়ে একসময়, আর সেই সাথে এক মরণান্তক আর্তনাদে সচকিত হয় পরিবেশ। রৈবত মরীয়া হয়ে ছুটে যায় কাছে, ততক্ষণে রুদ্রষেণ প্রাণহীন পুতুলের মত ধরাশায়ী, বণিক হতভম্ব বিস্ময়ে চেয়ে আছেন প্রতিপক্ষের বুকে বিঁধে থাকা ছুরিকাটির দিকে। হুটোপুটি, চিৎকার, নারীকন্ঠের রোদন, এসকল বিভ্রান্তির মাঝে কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়, ‘এখনও শ্বাস চলছে!’ হেঁকে ওঠে এক সেবক এর মাঝখানে। নিকটবর্তী কোনও বৈদ্যকে খবর দিতে ছুটে বেরিয়ে যায় কয়েকজন রৈবতের নির্দেশে। শ্বাস দ্রুত ক্ষীণ হয়ে আসে, অবচেতনায় তলিয়ে যেতে থাকেন বলিষ্ঠ রাজপুরুষ। বণিক কিছুদূরে হেঁটমুণ্ডে বসে থাকেন, বিদ্ধ্বস্ত, বিহ্বল; যেন সত্যকার পরাজয় হয়েছে তাঁরই।

বৈদ্য আসেন, দেহ পরীক্ষা করে হতাশভাবে মাথা নাড়েন, ‘বড় দেরী হয়ে গেছে’, মৃদুস্বরে নিধান দেন তিনি। মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত, ইচ্ছাকৃত হত্যা নয়, তবু বন্দর রক্ষীদের সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন। রক্ষীরা এসে প্রাথমিক তদন্ত শেষে দেহ নিয়ে যায় দণ্ডাধিকারিক কার্যালয়ে; অস্বাভাবিক মৃত্যু নথীভুক্ত করা প্রয়োজন, তায় রুদ্রষেণ রাজকর্মচারী। বণিক ও রৈবতকেও সঙ্গে নেন তাঁরা, এঁদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হবে অধিকারিকের দপ্তরে।

***

কুমার পুষ্পকেতু নিজ কক্ষের নিভৃত কোনে একখানি পীঠিকার উপর নিবিষ্ট হয়ে আছেন, একান্ত মনযোগে একটি জ্যামিতিক প্রহেলিকা সমাধানে ব্যস্ত তিনি। কুমারের জ্যামিতিপ্রীতির কথা সকলেই জানে, এই তরুণ বয়সে রাজকুলজাত হয়েও তিনি অবসর যাপন করেন জ্যামিতি ও সঙ্গীতচর্চায়; অনেকের কাছে এ এক বিস্ময়। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় কুমারের এই নিবিষ্ট রূপ বড় মনোরম, তাঁর মুখখানি সৌন্দর্য ও বুদ্ধির দীপ্তিতে অসামান্য।

‘প্রভু আপনাকে স্মরণ করেছেন দেব, তিনি কার্যালয়ে আছেন’, গৃহসেবক এসে সংবাদ দিতে, মনযোগ ভঙ্গ হয় পুষ্পকেতুর, কিছুটা বিস্মিত দেখায় তাঁকে।

‘পিতা এই প্রত্যুষেই কার্যালয়ে?’ স্বগোক্তি করেন তিনি, এরপর অতিদ্রুত প্রস্তুতি নেন বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে।

মহাদণ্ডনায়ক বিশাখগুপ্তের ন্যায়পরায়ণতা ও কর্তব্যবোধ সর্বজনবিদিত; সম্রাটের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হিসাবে নয়, নিজগুণেই এই পদ তিনি আলোকিত করে চলেছেন প্রায় এক যুগ কাল। অতি প্রত্যুষে কার্যালয়ে তাঁর উপস্থিতি কোনও বিশেষ প্রয়োজনে সে কথা বলাই বাহুল্য; তবে পুত্র পুষ্পকেতুকেও এই জরুরী আহ্বান কোনও জটিল সমস্যারই ইঙ্গিত বহন করে। বুদ্ধিমান পুত্রের বিশ্লেষনী ক্ষমতার উপর তাঁর অগাধ আস্থা, পুষ্পকেতুও এবিষয়ে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন বারম্বার।

***

‘একটি বিশেষ কারণে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি কেতু, ভদ্র চিত্রক একটি গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করতে চান’, কক্ষে উপস্থিত আর এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তির প্রতি নির্দেশ করেন বিশাখগুপ্ত। চিত্রক একজন অভিজ্ঞ দণ্ডাধিকারিক, কর্মজীবনের শুরুতে গুপ্তচর বিভাগে দায়িত্ব পালনের সুবাদে বিষবিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি হত্যাজনিত সমস্যায় শরীর পরীক্ষা করে থাকেন দণ্ডালয়ের পক্ষ থেকে।

‘কাল রাত্রে বন্দর সংশ্লিষ্ট একটি শুণ্ডালয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন কি আর্য?’ পুষ্পকেতুকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন চিত্রক।

‘হ্যাঁ পিতার মুখে শুনেছি সে কথা; আপনি কি সে বিষয়েই কিছু জানাতে চান?’

‘কতকটা তাই; দেহ পরীক্ষা করে বিভ্রান্ত বোধ করছি। গত সন্ধ্যায় বন্দর রক্ষীদের বক্তব্যের সাথে আমার পর্যবেক্ষণের কিছু বিরোধ ঘটেছে, বিভ্রান্তি সে কারণেই।’এরপরে চিত্রক যা বলেন তা এইপ্রকার।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ছুরিকাঘাতে মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু দেহ পরীক্ষা করে তিনি দেখেন যে ছুরিকাঘাত গভীর ছিল ঠিকই কিন্তু তা প্রাণঘাতী নয়। ছুরিকা বুকে বিদ্ধ হলেও হৃদপিণ্ড স্পর্শ করেনি। দেহে বিষের লক্ষ্মণ স্পষ্ট, আন্দাজ হয় মৃত্যু বিষক্রিয়া থেকে ঘটেছে। সম্ভবত ছুরিকাটিতে বিষ মাখানো ছিল। এ অবস্থায়, মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত একথা বলা চলেনা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল এমন ধারণা অসঙ্গত নয়।

‘সেক্ষেত্রে ঘটনাটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা কর্তব্য, বণিককে আটক করেছেন কি ভদ্র?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।

‘বণিক বিদেশী, সম্মানিত ব্যক্তি, দণ্ডাধীশের অনুমতি ভিন্ন কারারুদ্ধ করা সমীচীন বোধ হয়নি; তবে তিনি শুণ্ডালয়েই অপেক্ষমান, সেখানে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

‘ঠিক কি ধরণের বিষ ব্যবহৃত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন ভদ্র?’

‘এখনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারিনা, তবে এ অতি তীব্র বিষ, মৃত্যু ঘটেছে অতিদ্রুত।’

পরিস্থিতি বিচার করে পুষ্পকেতু শুণ্ডালয়ে যাওয়া স্থির করেন, পূর্বদিনের ঘটনার সঠিক বিবরণ পেতে যাবতীয় প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলা প্রয়োজন।

***

শুণ্ডালয়ে পৌঁছিয়ে প্রথমে রৈবতের সাথে দেখা করেন পুষ্পকেতু, তার কাছে ঘটনার বিশদ বিবরণ শোনেন তিনি। বণিক ভৃগুকচ্ছের বাসিন্দা, নাম জয়কেশী; সম্বৃদ্ধ গন্ধদ্রব্য ব্যবসায়ী, কর্মোপলক্ষে পাটলীপুত্রে এসেছেন বেশ কয়েকবার। এছাড়া বাকী অতিথিদের মধ্যে ভীমদেব সপারিষদ এই প্রথম এসেছেন পাটলীপুত্রে, বন্দরসংলগ্ন একটি বর্ধিষ্ণু পানশালার একাংশ ভাড়া নিয়ে রয়েছেন বেশ কিছুদিন হল। স্থানীয় ব্যবসায়ী সোমদত্ত ও ভদ্রিল নগরীর অভ্যন্তরে শ্রেষ্ঠী পল্লীতে বাস করেন, দুজনেই মসলা ব্যবসায়ী। বাকী যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, কেউই নিয়মিত অতিথি নন, তাঁদের অবস্থান জানা নেই রৈবতের।

‘ঘটনাকালে উপস্থিত সকলের সাথেই কথা বলতে চাই ভদ্র, আপনি ব্যবস্থা করুন।’

‘আমার কর্মচারীরা সকলে এখানেই রাত্রিযাপন করে, পরিবেষিকা চারজন কাছেই থাকে, ডেকে আনার বন্দোবস্ত করছি। কিন্তু মানী অতিথিদের কেমন করে সংবাদ পাঠাই প্রভু?’ রৈবতকে চিন্তিত দেখায়।

‘আপাততঃ এদের সাথেই কথা বলব, আপনি অতিথিদের ঠিকানা জানাবেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় আমরাই করে নেব।’

এরপর শুরু হয় সাক্ষাৎকারপর্ব; সঙ্গত কারণেই প্রথমে ডাক পড়ে বণিকের, তিনি একান্ত কক্ষে বিশ্রাম করছিলেন, ধীর পায়ে এসে আসন গ্রহণ করেন। বণিক সুপুরুষ, পোশাক ও আভুষণ দেখে তাঁর আর্থিক সাচ্ছ্বল্য অনুমান করা যায়; বয়স যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের সন্ধিক্ষণে, যদিও দেহের গঠন অত্যন্ত বলিষ্ঠ, যা আর্যাবর্তের পশ্চিমা দেশগুলির একটি বৈশিষ্ট। চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ, তিনি একজন পদস্থ ব্যক্তি আচরণে তা স্পষ্ট হয়; তবে সাম্প্রতিক ঘটনার বিপাকে একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত।

‘রূদ্রষেণের সাথে পরিচয় কতদিনের ভদ্র?’ পুষ্পকেতুর প্রশ্নে চমকে ওঠেন জয়কেশী।

‘পরিচয় ছিলনা।’

‘বিনা পরিচয়েই হত্যা করলেন?’

‘হত্যা? এ কি বলছেন আপনি? এ নিছক দুর্ঘটনা, আত্মরক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করেছিলাম আমি।’ স্খলিত শোনায় বণিকের স্বর।

‘কিন্তু তাঁকে দ্বন্দযুদ্ধে আপনিই প্ররোচিত করেছিলেন অস্বীকার করতে পারেন সেকথা?’

‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল, যেকোনও পুরুষ আমার স্থানে এরূপ ব্যবহারই করত।’

‘সেসময়ে এখানে আপনি ভিন্ন কোনও পুরুষ ছিল না, এই কি আপনার মত ভদ্র?’ একথা শুনে ক্রোধে রক্তবর্ণ দেখায় বণিকের মুখ।

‘নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ মগধে অপরাধ, জানা ছিল না আর্য। আমাদের দেশে নিয়ম কিছু ভিন্ন।’

‘বিষাক্ত ছুরিকার আঘাতে পরিকল্পিত হত্যা, সেও কি অপরাধ নয় আপনাদের দেশে?’

‘বিষাক্ত ছুরিকা?’ বিহ্বল দেখায় জয়কেশীকে।

‘আপনার ছুরিকায় বিষ ছিল, অস্বীকার করতে পারেন ভদ্র?’

না না, এ সব মিথ্যা!’, অসহায় আর্তিতে ভেঙ্গে পড়েন বণিক। তাঁকে আপাততঃ রক্ষীদের প্রহারায় রেখে অন্যদের সাথে বাক্যালাপ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘ভদ্র রুদ্রষেণকে তুমি কতদিন ধরে দেখছ?’ সেবক বল্লভকে প্রশ্ন করেন কুমার। বল্লভ সেবকদের মধ্যে প্রধান ও সবচেয়ে পুরোনো কর্মচারী।

‘প্রায় মাসাধিক কাল হল তিনি রোজই আসতেন প্রভু।’

‘একাই আসতেন সর্বদা, না সঙ্গীও থাকত কেউ? অন্যান্য অতিথিদের সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল তাঁর?’

‘একাই আসতেন, তেমন মিশুক স্বভাবের ছিলেননা ভদ্র, নীরবে সুরাপানে সন্ধ্যাযাপন করে বিদায় নিতেন।’

‘শ্রেষ্ঠী জয়কেশী কতদিন হল আসছেন?’

‘সেও প্রায় মাসাধিককাল হবে, তার আগে ওঁকে কখনও দেখিনি।’

‘উনি মেলামেশা করতেন বাকী অতিথিদের সাথে?’

‘মেলামেশা করতেননা সেভাবে, তবে কারও অক্ষক্রীড়ায় সঙ্গীর অভাব ঘটলে খেলায় যোগ দিতেন মাঝে মধ্যে।’

‘জয়কেশীর সাথে আলাপ পরিচয় ছিল রুদ্রষেণের?’

‘এখানে তাঁদের আলাপ করতে দেখিনি কখনও, তবে একে অপরকে চিনতেন কিনা বলতে পারিনা।’

‘কালকের দ্বন্দযুদ্ধ জয়কেশীর অযথা প্ররোচনায় ঘটেছিল কি? এব্যাপারে তোমার কি মত।’ প্রশ্ন শুনে কিছুটা সময় নেয় বল্লভ, শেষে সসঙ্কোচে উত্তর দেয় সে।

‘অপরাধ নেবেননা প্রভু, আমি সামান্য সেবক। তবু ভদ্র রুদ্রষেণের কাল সন্ধ্যার আচরণ অতি গর্হিত ছিল। প্রথমে কিলাত, তারপর মহল্লিকা; হয়তো কিলাত পৃষ্ঠে পড়ে যাওয়ায় আঘাত পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সে তো একটা দুর্ঘটনা। তাঁর পৃষ্ঠে না পড়লে কিলাতের প্রাণসংশয় ঘটতে পারত, অথবা জীবনভর পঙ্গু হয়ে যেতো সে।’ বল্লভের কাছে আরো যা জানা গেলো সে হল, মহল্লিকার সঙ্গ পছন্দ করতেন জয়কেশী, বিগত কয়েকদিনে কিছু বেশীই অন্তরঙ্গতা ঘটেছিল দুজনের। রুদ্রষেণও অন্যদের তুলনায় অধিক সদয় ছিলেন মহল্লিকার প্রতি, গতকালের পূর্বে কোনওদিন অন্যায় আচরণ করেননি তার সাথে।

এরপর একে একে বাকী সেবক ও পরবেষিকাদের সাথে কথা হয়, বল্লভ যা জানিয়েছে, তার বাইরে এরা কিছু জানাতে পারে না। সর্বশেষে প্রশ্নোত্তরের জন্য ডাক পড়ে যথাক্রমে মহল্লিকা ও কিলাতের।

‘কতদিন যাবৎ এই কর্মে নিযুক্ত আছ?’ মহল্লিকাকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু। মহল্লিকা সুন্দরী যুবতী, পেশাগত ভাবে হয়তো চটুলাও; তবে এই মূহুর্তে তার শান্তশ্রী শুণ্ডালয়ের পরিবেশে যেন কিছুটা বেমানান।

‘বিগত চার বর্ষকাল।’

‘তার আগে কোথায় কর্ম করতে?’

‘কর্ম করতাম না, গৃহস্থালী সামলাতাম।’

‘তুমি গৃহস্থ কন্যা?’ কিছুটা অবাক হলেও, নিজেকে সামলে নেন কুমার। শুণ্ডালয়ের পরিবেষিকারা সাধারণত গণিকা পল্লী থেকেই আসে।

‘এহেন পরিণতির কারণ?’

‘কারণ আর কি, অকাল বৈধব্য, শ্বশুরগৃহের গঞ্জনা। অন্যের আশ্রয়ে বড় হয়েছি, অনাথা; স্বামী দরিদ্রকন্যা জেনেও পরিবারের অমতে বিবাহ করেছিলেন।’ মহল্লিকার দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে কক্ষের বাতাস।

দুর্ঘটনাজনিত কোনও অতিরিক্ত সংবাদ দিতে পারে না সে, শুধু জানায়, রুদ্রষেণের উগ্র মেজাজের পরিচয় আগেও পেয়েছে সেবকেরা, যদিও তার সাথে এই প্রথমবার। জয়কেশী অত্যন্ত ভদ্রব্যক্তি, মহল্লিকার অতীতের পরিচয় জেনে অবধি তার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি।

‘তোমার কিলাত নামটি কি পিতৃদত্ত?’

‘আজ্ঞে না; এই প্রাণটুকু ভিন্ন কিছুই পিতৃদত্ত নয়।’ কিলাতের শ্লেষপূর্ণ মন্তব্যে কৌতুহল বোধ করেন পুষ্পকেতু; সেকথা বুঝে নিজ মন্তব্য ব্যাখ্যা করে সে। জন্মের কিছু কাল পরে, তার বিকৃত আকার সংসারে অভিশাপ ডেকে আনবে এই আশঙ্কায় নদী সংলগ্ন এক বটবৃক্ষের তলায় তাকে ফেলে রেখে যায় পরিবারের লোকজন; হয়তো নদীবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু শেষ মূহুর্তের দুর্বলতায় তা সম্ভব হয়নি। বন্দরের একটি গণিকালয়ের বৃদ্ধ রক্ষী প্রাতঃস্নান করতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করে, অসহায় শিশুকে ফেলে যেতে মায়া হওয়ায় সে নিয়ে যায় নিজকক্ষে। এরপর সেই গণিকালয়েই মানুষ হয়েছে কিলাত, খর্ব চেহারার কারণে উপহাস করেই তার এই নাম রাখে সুরসিকা গণিকার দল। উপহাসময় জীবনে, হাস্যরসকে জীবিকা করে নিতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলি বছর। এখন এই শুণ্ডালয়ে চাকুরীর দৌলতে সে সকলের প্রিয়পাত্র; এক রোমক নটের কাছ থেকে বিচিত্র নটখেলা শিখে তার জনপ্রিয়তা ও সঙ্গতি দুইই বেড়েছে।

‘রুদ্রষেণের সাথে কিরূপ সম্পর্ক ছিল তোমার?’

‘উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সাথে নগন্য কৃপাভোগীর যেরূপ সম্পর্ক হওয়া উচিৎ, তার অধিক কিছু নয়’, মৃদু হেসে জবাব দেয় কিলাত।

‘তোমার প্রতি বিরূপ হবার কারণ ঘটেছিল কি কিছু?’

’এই বিকৃত আকারই তো বিরূপতার পক্ষে যথেষ্ট প্রভু, এর অধিক কিছু ঘটে নি; তবে কাল সন্ধ্যায় পতনকালে তাঁর পৃষ্ঠ অবলম্বন করেছিলাম, এই অপরাধও তো সামান্য নয়।’

‘কালকের দুর্ঘটনায় জয়কেশীর আচরণকে সমর্থন কর তুমি?’

‘না করিনা; অন্যায়ের প্রতিবাদের অছিলায় প্রাণনাশ সমর্থনযোগ্য নয়।’

‘তোমার ধারণা এই প্রাণনাশ নিছক দুর্ঘটনা নয়?’

‘দুর্ঘটনা অবশ্যই, তবে উগ্রব্যক্তিকে অহেতুক উত্তেজিত করা সঙ্গত নয়।’এই উত্তরে কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হয় কুমারের। আপাতত প্রশ্নপর্ব শেষ করে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে মনযোগী হন তিনি, এব্যাপারে সহযোগিতা করে একজন প্রহরী। বিগত রাত্রি থেকেই বন্দর আধিকারিক কক্ষটিকে অর্গলবদ্ধ রেখেছিলেন পরবর্তী অনুসন্ধানে সূত্র নির্ধারণের প্রয়োজনে।

পানকক্ষটির মাঝখানে কতগুলি পীঠিকা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, উল্টে পড়ে আছে সুরাদান; ভূমিতে একটি অংশে শুকনো রক্তের দাগ বিগত সন্ধ্যার বিভৎস্যতার সাক্ষ্য বহন করছে, আর তার পাশেই পড়ে আছে শুকনো ফুলের মালা অকরুণ পরিহাসে। মাথার উপরে কড়িকাঠ থেকে স্থানে স্থানে ঝুলছে কয়েকটি মজবুত নারিকেল রজ্জু; যে পীঠিকাটিতে রুদ্রষেণ বসেছিলেন সেটির উপরে লম্বমান একখানি রজ্জু, এই রশিটি ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নীচে পড়েছিল কিলাত সন্দেহ থাকেনা। পীঠিকাটির উপর তখনও রয়েছে একখানি অর্দ্ধপূর্ন সুরাপাত্র, কি মনে হতে সেটি সঙ্গে নেবার নির্দেশ দেন পুষ্পকেতু। চারপাশের পরিবেশ একবার বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে কক্ষত্যাগের জন্য অগ্রসর হতে, কিছু একটা চামড়ার পাদুকায় বিদ্ধ হয়েছে, অনুভব করেন কুমার। পাদুকার তলা থেকে বস্তুটি বের করে হাতে নিয়ে দেখেন, একটি ক্ষুদ্র অথচ তীক্ষ্ণ ধাতববস্তুর ভগ্নাংশ, দেখে পরিচয় অনুমান করা কঠিন, সেটিকেও সঙ্গে নেন তিনি কি মনে করে।

পরবর্তী আদেশ না মেলা অবধি, বণিককে শুণ্ডালয়েই প্রহরাধীন রাখার নির্দেশ দিয়ে কার্যালয়ে ফেরেন কুমার। সেখানে চিত্রকের সাথে দেখা করে সংগৃহীত বস্তুগুলি তাঁকে পরীক্ষা করার অনুরোধ করেন পুষ্পকেতু।

‘আপনি কি সন্দেহ করেন ছুরিকাতে বিষ ছিল না?’ চিত্রককে বিস্মিত দেখায়।

‘ছুরিকাতেই বিষ ছিল আপনি নিশ্চিত কি ভদ্র?’

‘না সেভাবে কিছু বলা কঠিন, তবে বিষক্রীয়ায় মৃত্যু ঘটেছে, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ঘাড় শক্ত, হাত পায়ের পেশীতে প্রবল টান, সময়ের বহুপূর্বেই মৃতদেহে কাঠিন্য এসেছে, এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে পচনের পূর্বাভাস। আমার ধারণা বিষতিন্দুর প্রভাবে মৃত্যু ঘটেছে রুদ্রষেণের। তবে মৃতের কাঁধে ও গলায় আঁচড়ের চিহ্ন আছে, মল্লযুদ্ধ চলাকালীন এই ক্ষত ঘটেছে সম্ভবত, এই ক্ষতস্থান দিয়েও বিষ ঢুকে থাকতে পারে।’

‘বিষতিন্দু, মানে কিচিলা ফলের বীজ? কিন্তু এই বিষ তো সহজলভ্য নয়! গুপ্তহত্যায় এ বস্তু ব্যবহার হয়ে থাকে জানি। তার অর্থ এই যে, ঝোঁকের মাথায় নয় পূর্বপিরিকল্পিত এই হত্যা।’ চিন্তিত দেখায় পুষ্পকেতুকে। ‘আপনি পাত্রের সুরায় বিষ আছে কিনা পরীক্ষা করান ভদ্র।’

‘বেশ, পরীক্ষা করে দেখব; তবে সুরাপানের মাধ্যমে বিষ শরীরে গেলে মৃত্যু এত তাড়াতাড়ি হোত না আর্য। বিষের লক্ষ্মণ পরিস্ফুট হোত মৃত্যুর বেশ কিছু আগে থেকেই।’

‘জয়কেশীর ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে এসেছ কি কেতু?’ বিশাখগুপ্ত প্রশ্ন করেন; চিত্রকের সাথে আলোচনার পর পিতাকে অনুসন্ধান বিষয়ে অবহিত করতে তাঁর কার্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন কুমার।

‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ও সাক্ষীদের বয়ান জয়কেশীকেই অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে; ভদ্র চিত্রকও নিশ্চিত যে মৃত্যু বিষক্রীয়া থেকেই ঘটেছে।’

‘তবে তাকে বন্দী করতে বাধা কোথায়? তোমার মনে কি সংশয় আছে কোনও?’

‘পূর্বপরিকল্পিত হত্যার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকা চাই, এক্ষেত্রে জয়কেশীর স্বার্থ সম্পর্কে অনুসন্ধানের প্রয়োজন; বিদেশী বণিককে সন্দেহের বশে নির্যাতন করা অনুচিত বলে মনে করি পিতা।’

‘কিন্তু অনন্তকাল তাকে শুণ্ডালয়ে পাহারায় রাখা চলেনা, আবার মুক্তি দিলে পাটলীপুত্র ছেড়ে পলায়নের আশঙ্কা। আমার মতে তাকে কারারূদ্ধ করা দরকার, তবে বন্দীশালায় সুখ সুবিধার যাতে ত্রুটি না হয় সে বিষয়ে নির্দেশ দেব কারা প্রতিহারিকে।’

জয়কেশীকে কারারূদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে আলোচনা শেষ করেন বিশাখগুপ্ত।

***

‘আমার প্রতি এরূপ অত্যাচারের অর্থ কি কেতু?’ ব্যস্তপায়ে কুমারের শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন উল্মুক, বাল্যবন্ধুর প্রতি অভিযোগ আনলেও তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস।

‘তোমাকে অত্যাচার করছি আমি? এতদিন তো জানতাম কেবল চম্পাবতীরই সে ক্ষমতা আছে’, কপট বিস্ময়ে অনুযোগের উত্তর দেন কেতু। উল্মুকের সদ্যবিবাহিতা পত্নী চম্পাবতীকেই রসিকতার অস্ত্র করেন তিনি।

‘ওসব বললে শুনছি না; শুণ্ডালয়ের ঘটনা শীঘ্র খুলে বল।’ অতএব হত্যারহস্যের সকল কথা বিস্তারিত জানাতেই হয় মিত্রকে।

‘এক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায়? জয়কেশী যে হত্যাকারী সেকথা পরিষ্কার’, উল্মুক মতামত দেন।

‘হত্যা সেই করেছে, তা সুনিশ্চিত প্রায়, কিন্তু কেন একাজ করল গোলমাল সেখানেই।’

‘আরে, এত বোঝ আর এটা বুঝলে না? মহল্লিকা! মহল্লিকাকে সে স্নেহ করে, তার এই অপমান মেনে নিতে পারেনি তাই।’

‘জয়কেশী কি পূর্ব থেকে জানত যে রুদ্রষেণ মহল্লিকাকে অপমান করবে? নাকি বিষাক্ত ছুরিকা সাথে নিয়ে ঘোরা তার ব্যাসন?’

‘বিদেশী বণিক, আত্মরক্ষার্থে বিষাক্ত ছুরিকা রাখে হয়তো; গুপ্তচর নয়তো?’

‘ভৃগুকচ্ছ ক্ষত্রপ রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র, সেদেশের রাজপরিবার শকবংশীয়, মগধের মিত্রশক্তি নয়। গুপ্তচরবৃত্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কিন্তু, রুদ্রষেণকে হত্যা করবে কেন? তবে কি তিনি জয়কেশীর সত্য পরিচয় জেনে ফেলেছিলেন? সন্ধান করতে হবে এবিষয়ে।’ পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘তাহলেই বল, সমস্যার সমাধান করে দিলাম কেমন?’

‘বুদ্ধি তোমার দিনে দিনে চন্দ্রকলার মত বৃদ্ধি পাচ্ছে; এ কি তবে পুস্তপালের দপ্তরে হিসাবচর্চার গুণ?’

‘হিসাবচর্চা নয়, হৃদয়চর্চার গুণ; তবে তুমি সেসব বুঝবে না’, পুষ্পকেতুকে তাঁর বিবাহ বিমুখতার প্রতি ইঙ্গিত করে খোঁচা দেন উল্মুক।

‘কাল প্রাতে ভীমদেব ও শ্রেষ্ঠীযুগলের সাথে সাক্ষাৎ করব, সংবাদ পাঠিয়েছি।’

‘আমাকে সঙ্গী করবে আশা করি?’

‘অবশ্য! পুস্তপালের চেয়ে তোমার উপর আমার দাবী কি কিছু কম?’ হেসে ওঠেন দুজনেই।

***

বন্দরসংলগ্ন পান্থশালাটির কৌলিন্য বোঝা যায় ভবনের স্থাপত্যশৈলী দেখে; উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মধ্যম আকারের গৃহটির কারুকার্যমণ্ডিত থাম ও দরজা-জানালার সুদৃশ্য খিলানে সুক্ষ রুচির পরিচয়। প্রাচীরদ্বারের ভিতরে সযত্নে লালিত পুষ্পবিতান, গৃহের পিছনদিকে পরিচ্ছন্ন অশ্বশালা, সবকিছুতেই দক্ষ ব্যবস্থাপনার ছাপ সুস্পষ্ট। ভবনটির পূর্বপ্রান্তের মহলটিতে সপারিষদ বাস করছেন ভীমদেব, এই অংশটি স্বয়ংসম্পূর্ন ও ভবনের বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। পুষ্পকেতু ও উল্মুক উপস্থিত হলে ভীমদেবের এক অনুচর তাঁদের একটি বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যায়; শীতল তক্র, মিষ্টান্ন, আপ্যায়নের বন্দোবস্ত রীতিমত রাজকীয়, মনে মনে স্বীকার করেন দুই মিত্র। অপেক্ষায় কেটে যায় বেশ কিছু সময়, কিন্তু রাজপুরুষের দেখা মেলেনা। ‘প্রভুর নিদ্রাভঙ্গে বিলম্ব ঘটে, আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরুন আর্য’, অনুচর সবিনয়ে জানায়। ‘শ্যালক মহাশয় বোধকরি অধিক রাত্রি অবধি রাজকার্য করে পরিশ্রান্ত’ উল্মুক মৃদুস্বরে মন্তব্য করেন, কুমার বিরক্তি ভুলে হেসে ওঠেন তাঁর মন্তব্যে।

প্রায় একদণ্ডকাল পরে কক্ষে প্রবেশ করেন ভীমদেব, সময়ের পূর্বে নিদ্রাভঙ্গের রেশ স্পষ্ট তাঁর চোখেমুখে। তিনি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, পোশাক আশাকে অতি সৌখিন, চেহারাটি দুগ্ধ-ঘৃতের প্রভাবে সুডৌল; এক প্রকার উগ্র দাম্ভিকতা দিয়ে ব্যক্তিত্বের অভাবকে ঢেকে রাখার চেষ্টা তাঁর আচরণে। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় শেষে শুরু হয় সাক্ষাৎকার পর্ব।

‘আপনি মাননীয় রাজপুরুষ, যৌধেয়রাজ কিপুনদের শ্যালক; মগধাধীশের আতিথ্য না নিয়ে বন্দরের এই পান্থশালায় উঠলেন কেন?’ ভীমদেবকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘রাজকার্যে আসিনি, রাজ আতিথ্য নেব কেন?’

‘কি কার্যে এসেছেন তবে?’

‘দেশভ্রমণ, অবসরযাপন।’

‘এখান থেকে কোথায় যাবার ইচ্ছা রাখেন?’

‘ভেবে দেখিনি এখনও, এই জায়গাটি বেশ সরেশ, হয়তো আর কোথাও না যেতেও পারি।’

‘দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল আর্য। সেদিন সন্ধ্যায় রুদ্রষেণের আশেপাশে কারা ছিলেন, বলতে পারেন কিছু?’

‘সে আমি কি করে বলব? আমি তো খেলা দেখায় মত্ত ছিলাম, কিলাত পড়ে গিয়ে সব মাটি করল যদিও।’

‘আপনার কি মনে হয়, রুদ্রষেণের ব্যবহার অন্যায্য ছিল কিলাত ও মহল্লিকার প্রতি?’

‘কিলাত তো একটা ভাঁড়, তাকে বিরক্ত হয়ে প্রহার করে থাকলে সে কিছু নয়। তবে সুন্দরী নারী, হোক না গণিকা, তাকে নির্যাতন করা অত্যন্ত অন্যায় আচরণ।’

‘সেক্ষেত্রে জয়কেশীর প্রতিক্রিয়া আপনি সমর্থন করেন?’

‘হ্যাঁ করি, তবে ঐ হুঙ্কার অবধিই ঠিক ছিল; রুদ্রষেণ যে অমন ছুরিকা নিয়ে চড়াও হবে সেটা বেচারী বোঝেননি সম্ভবত।’

‘রুদ্রষেণ ও জয়কেশীর সাথে আপনার পরিচয় হয়েছিল কি আর্য?’

‘রুদ্রষেণের নামটিও তো জানলাম তার মৃত্যুর পশ্চাতে, তবে জয়কেশীর সাথে দু একদিন অক্ষক্রীড়ার সৌভাগ্য ঘটেছে; পটু খেলয়াড়, তবে বড্ড হিসেবী, খেলে আমোদ হয় না।’

‘মহল্লিকা সম্পর্কে আপনার মত কি?’

‘মন্দ নয়’, মন্তব্যের সাথে যে হাসিটি তাঁর ঠোঁটে উঁকি দিল তাকে আর যাই হোক ভদ্রোচিত বলা চলে না। এরপর ভীমদেবের কাছে বিদায় নিয়ে দুই বন্ধু পথে নামেন; ভদ্রিলের বন্দরসংলগ্ন ভাণ্ডার তাঁদের লক্ষ্যস্থান।

‘কিলাতকে প্রহার করা চলে, তবে সুন্দরী নারীর প্রতি দুর্ব্যবহার অসঙ্গত। ভীমদেবের ন্যায় অন্যায় বোধ অসাধারণ!’ উল্মুক মন্তব্য করেন।

‘মিত্রদেশ যৌধেয়রাজের শ্যালক, তবু এরূপ অজ্ঞাতপরিচয়ে জীবনযাপন; রাজ আতিথ্য না নিলেও, অন্তত নগরীর বিশিষ্টজনেদের সাথে তো যোগাযোগ স্থাপন করবেন? কিছু গোলমাল আছে এর মাঝে।’ পুষ্পকেতু নিজের দ্বিধার কথা জানান মিত্রকে।

‘মিথ্যা পরিচয়ে সুবিধা ভোগের চেষ্টা হয়তো। বিদেশী রাজপুরুষ জানালে বিশেষ আপ্যায়ন পাওয়া যায়; রুদ্রষেণ হত হয়ে গোলমাল বাধবে তা কি আর জানা ছিল?’

‘সে সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া চলেনা, সেক্ষেত্রে শ্রীমানের সত্য পরিচয় জানা প্রয়োজন।’

অল্পসময়েই ভদ্রিলের ভাণ্ডারগৃহ এসে পড়ে, অশ্বশকট থেকে নামতেই শ্রেষ্ঠীর ভৃত্য আপ্যায়নে এগিয়ে আসে। ভাণ্ডারের একটি বহির্কক্ষে ভদ্রিল আগে থেকেই কুমারের আসার অপেক্ষায় ছিলেন। মধ্যবয়স্ক সদাশয় মানুষটি ব্যস্ত হয়ে পড়েন আন্তরিক আতিথেয়তায়। তিনি জানান, শ্রেষ্ঠী সোমদত্তের ভাণ্ডারগৃহ নিকটেই, ভৃত্য গেছে তাঁকে সংবাদ দিতে। কিছুপরে তিনি ও এসে পড়বেন, কুমারকে কষ্ট করে যেতে হবে না তাঁর কাছে।

‘সেদিন সন্ধ্যায়, রুদ্রষেনের নিকট কারা গিয়েছিল লক্ষ্য করেছিলেন কি ভদ্র?’ পুষ্পকেতু জানতে চান।

‘বারুণি শুরুতেই সুরা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল, সে যেমন করে থাকে বিশেষ অতিথিদের; তবে তাকে বাদ দিলে মহল্লিকা ছাড়া আর কাউকে তাঁর সাথে ঘনিষ্ট হতে দেখিনি।’

‘আপনার পরিচয় ছিল আশা করি তাঁর সাথে?’

‘আমি শ্রেষ্ঠী, শুল্কদপ্তরের আধিকারিককে চিনব না তাই কি হয়? তবে পরিচয় ছিলনা। কি থেকে কি হয়ে গেলো! রৈবত ভদ্রব্যক্তি, মাঝখানে পড়ে তার হয়রানিই সবচেয়ে বেশী।’ আক্ষেপের সুরে মন্তব্য করেন ভদ্রিল, রুদ্রষেণের প্রতি যে তাঁর বিশেষ সহানুভুতি নেই বোঝা যায় সেকথা।

আলাপচারিতার মাঝে সোমদত্ত এসে পড়েন, তিনি বয়সে ভদ্রিলের তুলনায় কনিষ্ঠ; দুজনের সম্পর্কও বেশ অন্তরঙ্গ, মনে হয় ব্যবসায়িক লেনদেনও আছে নিজেদের মধ্যে। পুষ্পকেতুর প্রশ্নের উত্তরে সোমদত্ত জানান যে তিনি রুদ্রষেণের দিকে পিছন করে বসেছিলেন, সেকারণে কে বা কারা তাঁর নিকটে গিয়েছিল সেদিন, তিনি বলতে পারবেন না। তবে অন্যদিনের তুলনায় তাঁর আচরণ অধিক উগ্র ছিল; কোনও কারণে অত্যন্ত অস্থির ছিলেন আধিকারিক মহাশয়, তাঁর মুখচোখের ভাব ছিল বেশ অস্বাভাবিক। জয়কেশী সম্পর্কে দুজনেই জানান, তাঁকে সজ্জন বলেই মনে হয়েছে তাঁদের; ভীমদেব সম্পর্কে মন্তব্য এড়িয়ে যান তাঁরা, বিতর্ক এড়াতেই সম্ভবত।

***

কারাগৃহের অপ্রশস্ত কক্ষের এককোণে একটি আসনে অন্যমনস্ক ভাবে বসে আছেন জয়কেশী, সামনে রাখা থালিকায় কিছু ফল, মিষ্টান্ন ও যবমণ্ড। দেওয়ালের উপরভাগের জানালা দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে পাথরের মেঝেতে, সেই আলোকে বণিকের মুখ শীর্ণ ও চিন্তাক্লিষ্ট; খাদ্য অভুক্ত পড়ে থাকে।

‘কেমন আছেন দেব?’ একটি সুমিষ্ট স্বরের সম্বোধনে চমকে দ্বারের পানে চেয়ে দেখেন জয়কেশী; ছায়ান্ধকার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থাকা নারীমূর্তির সাথে শুণ্ডালয়ের সুরসিকা সেবিকার মিল পাওয়া যায়না। মোটা সুতীর কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা, মুখ প্রসাধনহীন, দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে দৃঢ়তার ছাপ।

‘তুমি এখানে কেন ভদ্রে? এই স্থান নারীর উপযুক্ত নয়’, বিস্মিত দেখায় জয়কেশীকে।

‘এই স্থানে আপনারও তো থাকার কথা নয় প্রভু; আজ আমার কারণেই আপনার এই পরিণতি!’ গভীর হতাশায় কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে মহল্লিকার।

‘আমার অদৃষ্ট আমারই, নিজেকে অকারণে দোষ দিও না।’

‘কিন্তু আপনি যে বিষপ্রয়োগ করেননি, একথা আমার থেকে বেশী কেউ জানেনা; আজ সেকথাটিই আপনাকে জানাতে এলাম প্রভু।’

‘আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আছে জেনে সুখী হলাম, কিন্তু কতটুকু জানো তুমি আমার সম্পর্কে?’

‘যা জানি, আমার কাছে সেটুকুই যথেষ্ট দেব। আমার মত হতভাগিনীর জন্য আপনি যা করেছেন, কয়জন করে? আপনি চিন্তা করবেন না, সত্যের জয় হবেই।’মহল্লিকার দুচোখ বেয়ে নেমে আসে নীরব অশ্রু, জয়কেশী স্তব্ধ হয়ে থাকেন গভীর আবেগে।

***

মহামন্ত্রী হরিষেণের সুরম্য প্রাসাদটি সকাল থেকেই কর্মব্যস্ত; গৃহস্বামী রাজসভার অতি বিশিষ্টব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় বিভাগের অথিকর্তা, সম্রাটের অতি নিকটের জন। তাঁর কাছে সাধারণ মানুষেরও অবারিত দ্বার, বিশেষ প্রয়োজনে দ্বারস্থ হন অনেকেই পরামর্শ লাভের আশায়। প্রাসাদের একটি অন্তরঙ্গ বিশ্রামকক্ষে পুষ্পকেতু ও হরিষেণ বিশেষ আলোচনায় বসেছেন আজ, কুমারকে পত্র পাঠিয়ে ডেকে এনেছেন তিনি।

‘তোমাকে এভাবে ডেকে পাঠাতে হল, পরিস্থিতি কিছু গম্ভীর বৎস্য।’

‘আপনি না ডাকলে আমি নিজেই আসতাম দেব, আমারও কিছু আলোচনা ছিল আপনার সাথে।’

‘বেশ, আগে আমার বক্তব্য তোমাকে জানাই, সব কথা জানলে তোমারও সুবিধা হবে বলেই আমার বিশ্বাস।’ এরপর হরিষেণ যে বিবরণ দেন তা এই প্রকার,-

প্রায় চারমাস আগে বন্দরে দুই পেটি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র আসে, কিন্তু তারপর আর শুল্ক প্রদান করে সে সামগ্রী ছাড়াতে আসেনা কেউ; এক পশ্চিমা বণিকের পণ্য ছিল এগুলি। বাধ্য হয়ে বন্দরের পান্থশালাগুলিতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, কয়েকদিন পূর্বেই শ্রেষ্ঠী একদিন মধ্যরাত্রে তড়িঘড়ি পান্থশালা ত্যাগ করেছেন, সেইসাথে সম্ভবত পাটলীপুত্রও। এরূপ ব্যবহারের অর্থ পাওয়া যায়না, সামগ্রী রাখা থাকে সরকারী ভাণ্ডারে। এরপর কেটে যায় আরো দুই মাস, কিন্তু আবারও অনুরূপ ব্যাপার ঘটে, এক বিদেশী বণিক তাঁর মশলা সম্ভার বন্দরে ছেড়ে রেখে অদৃশ্য হন আচমকা। শুল্ক দপ্তর থেকে এই নিয়ে খোঁজ শুরু হয়, ইতিমধ্যে এক স্থানীয় স্বর্ণব্যাবসায়ী চন্দ্রদত্ত নিজে শুল্ক দপ্তরে এসে জানান যে এক মালব দেশীয় শ্রেষ্ঠী তাঁর কাছে কিছু গহনার ক্রয়চুক্তি করে আর আসেননি; শ্রেষ্ঠীর খোঁজে পান্থশালায় গিয়ে তিনি শোনেন শ্রেষ্ঠী নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এতগুলি নিরুদ্দেশের ঘটনা অস্বস্তিকর, যদিও আইনভঙ্গ হয়নি কিছু, কিন্তু এবিষয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন অনুভব করে হরিষেণ স্বয়ং রুদ্রষেণকে সেই কাজে যুক্ত করেন। রুদ্রষেণ পুরাতন আধিকারিক ও বিচক্ষণ, সবদিক দিয়ে এই গোপন তদন্তের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনদিন পূর্বে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে মহামন্ত্রী অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। এরপর, পুষ্পকেতু হত্যারহস্যের অনুসন্ধান করছেন জানতে পেরে এবিষয়ে তাঁকে সকল কথা জানানো কর্তব্য মনে হয়, সেকারনেই আজকের এই আলোচনা পর্ব।

পুষ্পকেতু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন সব কথা শুনে, তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হয়, রহস্য নিঃসন্দেহে আরও জটিল আকার ধারণ করেছে এই নতুন তথ্য পেয়ে। হরিষেণ নিরুদ্দিষ্ট বণিক ও তাদের পান্থশালার একটি তালিকা তৈরী করিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকে, এখন সেটি তিনি কুমারকে দেন।

‘তোমারও কিছু বক্তব্য ছিল বলছিলে?’ হরিষেণ আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন।

হত্যার ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেন পুষ্পকেতু, আর তারপর জানান কি বিষয়ে সাহায্য চান। ‘এই হত্যার সাথে যুক্ত দুজন বিদেশীর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন, সে ব্যাপারেই আপনার সাহায্য পেতে চাই দেব। প্রথমজন, জয়কেশী, সে ক্ষত্রপ দেশীয় বণিক, ভৃগুকচ্ছে বাস, বিগত একমাস কাল এখানে রয়েছে ব্যবসায়িক কারণে। আমাদের সন্দেহ বিষাক্ত ছুরিকা দিয়ে পরিকল্পনা করেই হত্যাটি ঘটিয়েছে সে, অথচ রুদ্রষেণের সাথে আপাতভাবে কোনও বৈরিতা ছিলনা তার।

অন্যজন ভীমদেব, তিনি নিজেকে যৌধেয়রাজ কিপুনদদেবের শ্যালক বলে পরিচয় দিয়েছেন, অথচ বন্দর সংলগ্ন একটি পান্থশালায় অজ্ঞাতপরিচয়ের মত জীবনযাপন করছেন। রাজপুরুষের এরূপ আচরণ অত্যন্ত সন্দেহজনক, এঁর পরিচয় সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।’

‘আমি যতশীঘ্র সম্ভব সংবাদ সংগ্রহ করে জানাবো; তবে সুরাপাত্রে বিষপ্রয়োগের সম্ভাবনা কি একেবারেই নেই?’

‘ভদ্র চিত্রক ইতরপ্রাণীর উপর প্রয়োগ করেছেন পাত্রের অবশিষ্ট সুরা, তাতে বিষ ছিলনা দেব।’

আলোচনা শেষে বিদায় নেন পুষ্পকেতু, কার্যালয়ে দুজন আধিকারিক তাঁর অপেক্ষায় আছেন, এঁরা ঘটনাকালে উপস্থিত সকলের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের কাজে যুক্ত।

***

প্রাথমিক অভিভাদন শেষে বরিষ্ঠ আধিকারিক ধর্মদাস সংগৃহীত তথ্যের বিবরণ দেন পুষ্পকেতুকে। জয়কেশীর যাতায়াত ছিল মহল্লিকার গৃহে, তবে রুদ্রষেণকে সে ব্যক্তিগতভাবে চিনত এমন কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি। ভদ্রিল ও সোমদত্তের সাথে জয়কেশীর কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল না, যদিও এঁরা একে অপরকে চিনতেন। ভীমদেবের পরিচিত মহল মূলতঃ গণিকাপল্লী ও শুণ্ডালয়গুলিতেই সীমাবদ্ধ, জয়কেশীর সাথে তারও কোনও যোগাযোগের সংবাদ মেলেনি। গত একমাস যাবৎ রুদ্রষেন বন্দরের বিভিন্ন পান্থশালা ও গণিকাপল্লীতে যাতায়াত করতেন, তবে তিনি দিবাকালেই যেতেন সেইসব স্থানে। দুর্ঘটনার দিন রুদ্রষেন বন্দর সংলগ্ন কার্যালয়ে বেশ কিছু সময় কাটান, এছাড়া সেদিন স্বর্ণবণিক চন্দ্রদত্তের কর্মশালাতেও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোথাও এমন কিছু ঘটেনি যা থেকে তাঁর সন্ধ্যাকালের রূঢ় ব্যবহারের কোনও সদুত্তর মেলে।

সবশেষে আসে মহল্লিকার কথা, তার সম্পর্কে ধর্মদাস যা জানান সে বড় চমকপ্রদ। মহল্লিকার স্বামী অরুণি নগরীর এক বর্ধিষ্ণু গৃহে অশ্বপালের কর্ম করত, গৃহস্বামীর অশ্বপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত, চারখানি উৎকৃষ্ট অশ্ব ছিল তাঁর সংগ্রহে। অরুণি প্রভুগৃহেই রাত্রিবাস করত, মাঝে মাঝে নিজগৃহে যেত ছুটি নিয়ে, শাল্মলি গ্রামে তার বসত ভিটা; মহল্লিকা তখন শ্বশুরগৃহেই থাকত বাকি পরিবারের সাথে। চার বছর আগে একদিন রাতে অশ্বশালায় আগুন লাগে, ছোটাছুটি গোলমালের মাঝে অরুণি অশ্বশালে ঢোকে পশুদের বাঁধনমুক্ত করতে; অশ্বগুলি মুক্তি পেলেও অরুণি আর বের হতে পারেনি অগ্নিবলয় থেকে, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সেসময়ে লোকমুখে একটি গুঞ্জন শোনা যায় যে গৃহস্বামী একরকম জোর করেই অরুণিকে বাধ্য করেছিলেন জ্বলন্ত অশ্বশালায় প্রবেশ করতে। সেই গৃহস্বামী ছিলেন আধিকারিক রুদ্রষেণ।

‘মহল্লিকাও কি জানত তার স্বামীর মৃত্যুতে রুদ্রষেনের ভুমিকার কথা?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন ধর্মদাসকে।

‘সেকথা বলা শক্ত, তবে রুদ্রষেণ অরুনির পিতাকে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন; ফলে তার পরিবার কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেনি।’

সমস্যা ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে ভদ্র, আপনাকে আরো কিছু অনুসন্ধান কার্যের ভার দিতে চাই।’ পুষ্পকেতু হরিষেণের কাছ থেকে পাওয়া নিরুদ্দিষ্ট বণিক ও তাঁদের পান্থশালার তালিকাটি ধর্মদাসকে দেখিয়ে, বিশদ বিবরণ দেন।

***

‘এ তো রীতিমত রোমহর্ষক ব্যাপার; রুদ্রষেণ ব্যক্তিটি পৃথিবীসুদ্ধ লোককে ক্ষেপিয়ে রেখেছিল দেখছি।’ উল্মুক বন্ধুর কাছে সব কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

‘সমস্যা সেখানেই, হত্যা করার যথেষ্ট কারণ হয়তো অনেকেরই ছিল, কেবল যাকে বন্দী করা হয়েছে তার উদ্দেশ্যই তেমন সবল নয়। তাছাড়া হত্যার ইচ্ছে থাকলেও তা কার্যকরী করার স্নায়ু বেশীরভাগ মানুষেরই থাকে না।’

‘যাক, এটাই স্বান্তনা; নাহলে পুস্তপালের দপ্তরে কলম পিষ্টন করে আমারই কেমন হত্যাবৃত্তি প্রবল হচ্ছে ক্রমে ক্রমে।’ উল্মুক গুরুতর আলোচনার মাঝেও গম্ভীর থাকতে পারেননা বেশীক্ষণ। হাস্যালাপে পরিবেশ হালকা হয়ে আসে, কিন্তু দীর্ঘকাল বজায় থাকে না এই পরিস্থিতি। গৃহসেবক এসে সংবাদ দেয়, কার্যালয় থেকে জরুরি আহ্বান এসেছে, কুমারের উপস্থিতি সেখানে একান্তভাবে কাম্য। অতঃপর দুই মিত্র ব্যস্ত হয়ে কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

***

‘মহল্লিকা আপনার সাক্ষাতের আশায় বসে আছে বহুক্ষণ, দেখা না করে যাবে না সে কিছুতেই’, কার্যালয়ে পৌঁছতে এক কর্মচারী এসে সংবাদ দেয় পুষ্পকেতুকে।

‘আমার সাথে কি এমন প্রয়োজন তোমার, যা অন্যকে বলা চলেনা?’ প্রতীক্ষা কক্ষে প্রবেশ করে প্রশ্ন করেন কুমার মহল্লিকার উদ্দেশ্যে।

জড়োসড়ো হয়ে কক্ষের এককোনে বসে থাকা নারীমূর্তি সচকিত হয় এই সম্ভাষনে; তার শীর্ণ মুখের দিকে চেয়ে চমকে ওঠেন পুষ্পকেতু। এই কয়েকদিনেই যেন কত বদলে গেছে শুণ্ডালয়ের রসময়ী পরিবেষিকা! ঝড়ের প্রকোপে বাস্তুহারা পাখীর মতই অসহায় তার মুখচোখ।

‘যা বলার নির্ভয়ে বল ভদ্রে’, সহানুভুতি ঝরে পড়ে কুমারের কণ্ঠস্বরে।

‘আপনার কাছে আজ নিজমুখে অপরাধ স্বীকার করতে এসেছি আর্য’ মহল্লিকা রূদ্ধস্বরে বলে ওঠে।

‘কিসের অপরাধ?’ বিস্মিত হন কুমার।

‘ভদ্র রুদ্রষেণকে হত্যার অপরাধ।’

‘কি বলছ তুমি? হত্যা করেছ, একথা আগে বলোনি, হঠাৎ আজ বলতে এলে কেন?’

‘আমার কারণে একজন নিরপরাধী শাস্তি পাবেন, এ কথা ভেবে শান্তি ছিল না মনে, আপনি আমাকে বন্দী করুন প্রভু!’

‘ও! জয়কেশীর বন্দীদশা ঘোচাতে তোমার এই নতুন কাহিনী?’

‘কাহিনী নয় দেব, এ সত্যি!’

‘বেশ, হত্যা করলে কিভাবে?’

‘বিষ প্রয়োগ করেছিলাম।’

‘বিষপ্রয়োগে মৃত্যু ঘটেছে, একথা সকলেই জানে, কি ভাবে প্রয়োগ করলে জানতে চাই আমি। সুরাপাত্রে মিশিয়েছিলে?’

‘আপনি সুরা পরীক্ষা করিয়েছেন নিশ্চয়, পেয়েছেন কিছু?’ এক বিচিত্র হাসি খেলে যায় মহল্লিকার ঠোঁটে। ‘আমার এই অঙ্গুরীয়ের তীক্ষ্ণধারে বিষ মিশিয়ে আধিকারিকের স্কন্ধে আঘাত করেছিলাম।’ মহল্লিকা তার বামহস্তের অনামিকায় পরিহিত গহনাটি খুলে পুষ্পকেতুর দিকে তুলে ধরে, অঙ্গুরীয়ের উপরিভাগ ফুলের আকৃতি, আর তার পাঁপড়িগুলি সরু ও তীক্ষ্ণ; ইচ্ছা থাকলে এ দিয়ে কাউকে নখরাঘাত করা অসম্ভব নয়।

‘কি বিষ ব্যবহার করেছিলে?’

‘কিচিলার বীজ’, মহল্লিকার দৃঢ় উত্তরে কিছু মূহুর্তের জন্য স্তব্ধতা নেমে আসে কক্ষমধ্যে। অবশেষে কুমার প্রশ্নপর্ব শুরু করেন আবার।

‘এ বিষ তুমি পেলে কোথায়? আড়ঙ্গে মেলেনা এ বস্তু, জনবসতিতে ফলেনা এই বিরল উদ্ভিদ।’

‘আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অপারগ, ক্ষমা করবেন দেব।’

‘এবিষয়ে কি বলতে হবে, জয়কেশী প্রশিক্ষন দেন নি বোধকরি? কারাগারে তার কাছে গিয়েছিলে তুমি অস্বীকার করতে পারো সেকথা?’ পুষ্পকেতুর বিদ্রূপবাক্য কশাঘাতের মত নেমে আসে।

‘শ্রেষ্ঠীকে এর মধ্যে জড়িত করবেন না আর্য, দয়া করুন!’

‘তোমার এই প্রহসন ক্ষমার অযোগ্য, এখুনি এ স্থান ত্যাগ কর ভদ্রে।’

‘বেশ তবে শুনুন, কিলাতের সংগ্রহ থেকে চুরি করেছিলাম কিচিলা বীজচূর্ণ গোপনে।’

‘কিলাত! কিলাতের কাছে বিষতিন্দু থাকে কি কারণে?’

‘কিলাত নেশাসক্ত ব্যক্তি, গঞ্জিকায় আসক্ত সে। মাঝে মধ্যে কোনও কোনও অতিথিকেও গঞ্জিকা সরবরাহ করে সে গোপনে, আমি জানতাম সেকথা। প্রভু রৈবতও জ্ঞাত আছেন এ বিষয়ে, তবে ব্যবসায়ের খাতিরে নির্লিপ্ত থাকেন তিনি। একদিন তার বায়বীয় খেলা শুরুর আগে একটি ক্ষুদ্র রৌপ্য কোষ থেকে সূচাগ্র পরিমান চূর্ণ সেবন করতে দেখে কৌতুহলী হই। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে কিলাত জানায় এ কিচিলা বীজচূর্ন, মারাত্মক বিষ; তবে সূচাগ্র পরিমান সেবনে স্নায়ূ সতেজ হয়, মারণ খেলার পূর্বে তাকে সাহস যোগায় এ বস্তু।’

‘রুদ্রষেণকে হত্যা করলে কি কারণে?’

‘আজ তাঁর কারণেই এই শুণ্ডালয় ঠিকানা হয়েছে আমার, কেউ বলে দাসী, কেউ গণিকা। এতকাল পরে আধিকারিককে পানশালায় আসতে দেখে ক্রমে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে মনে; তিনি তো আমায় চিনতেন না, কাজ সহজ হয়েছিল তাই।’ মহল্লিকার পাণ্ডুর মুখে হাসির ঝলক যেন কান্নারই নামান্তর।

‘অঙ্গুরীয়টি রেখে তুমি এখন গৃহে যাও ভদ্রে, আমার অনুমতি ভিন্ন স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা কোরনা।’

‘গৃহে যাব? বন্দী করবেন না আমায়?’

‘আপাততঃ গৃহেই বন্দী থাকো, এই আমার ইচ্ছা।’ মহল্লিকা সসংকোচে কক্ষ থেকে প্রস্থান করে, তার চোখেমুখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর।

‘যেতে দিলে ওকে? যদি পলায়ন করে?’ উল্মুক এতক্ষণ নীরবে প্রত্যক্ষ করছিলেন পরিস্থিতি, এখন মিত্রের সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন বোধ করেন।

‘জয়কেশী যতক্ষণ কারাবন্দী, মহল্লিকা কোথাও যাবে না।’

‘তুমি কি মহল্লিকার স্বীকারোক্তি বিশ্বাস করোনি তবে?’

‘অবিশ্বাসও করিনি, তবে জয়কেশী তার সাথে যুক্ত ছিল কিনা সেটা দেখা দরকার; এখন একবার কিলাতের সাথে কথা বলতে হবে।’ এরপর কিলাতকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে আসে প্রহরী, তার সাথে শুরু হয় বাক্যালাপ।

‘তুমি গঞ্জিকা সেবন কর?’

‘বন্দর চত্বরে অল্পবিস্তর সকলেই সেবন করে প্রভু, আমিও ব্যতিক্রম নই’, কিলাত সবিনয়ে মেনে নেয়।

‘আর বিষতিন্দু সেও সকলেই সঙ্গে রাখে বুঝি?’ মূহুর্তে সচকিত হয় কিলাত, এরূপ প্রশ্ন সে একেবারেই আশা করেনি, স্পষ্ট হয় সেকথা।

‘আপনার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না দেব।’

‘বেশ, স্পষ্ট করেই বলছি তবে, তোমার সংগ্রহে বিষতিন্দু আছে একথা জানতে পেরেছি সম্প্রতি। তুমি জানো বোধহয় রুদ্রষেনের মৃত্যু ঘটেছে বিষপ্রয়োগে, আর তা বিষতিন্দু।’

‘ওঃ, এতক্ষণে বুঝলাম। বিদেশী বণিক সম্মানিত ব্যক্তি, তাকে শাস্তি দেওয়া সহজ নয়; এই বিকৃতদেহ বামনকে হত্যাকারী সাব্যস্ত করতে পারলে সবদিক রক্ষা পায়’, বিদ্রূপ ফুটে ওঠে কিলাতের প্রত্যুত্তরে।

‘এই অভিযোগ এনে স্বয়ং সম্রাটকে অবমাননা করেছ তুমি অর্বাচীন! মগধ সাম্রাজ্যের ন্যায়দণ্ডে উচ্চনীচ ভেদ নেই সেকথা তোমার জানা উচিৎ। বিষতিন্দু সংগ্রহে থাকলেই কেউ হত্যাকারী হয়ে যায় না, সত্য বল, তোমার কাছে আছে সে বিষ?’

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চূপ থেকে সম্মতি জানায় কিলাত। ‘প্রতিবার রজ্জুপথে মারণখেলা দেখাবার কালে ভাবি, হয়তো আজই শেষ হবে সব; এখন যারা বাহবা দিচ্ছে, মূহুর্তের ভুলে পতন ঘটলে আমার রক্তাক্ত দেহ দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে তারাই। এভাবে হাসিমুখে জীবনের বাজি রাখা বড় সহজ নয় আমার মত নগন্য মানুষের কাছে। বেশ কিছুকাল আগে এক কলিঙ্গদেশীয় বণিকের সহানুভুতি পেয়েছিলাম, বণিক চীনাদেশে কারবার করেন; তিনিই দিয়েছিলেন বিষতিন্দু, সেদেশে ওষধি প্রস্তুত করতে ব্যবহার হয় এই বিষ। অতি অল্পমাত্রায় সেবন করলে স্নায়ু সবল হয় বলেছিলেন বণিক, তবে সাবধান করেছিলেন এর তীব্র বিষক্রীয়ার সম্পর্কে। কিন্তু, এর সাথে হত্যার সম্পর্ক কি?’

‘ওই বিষপাত্রটি একবার দেখতে চাই, সঙ্গে প্রহরী দিচ্ছি, নিয়ে এসো সত্ত্বর।’

‘সে আর সম্ভব নয় আর্য, সম্প্রতি সেটি খুঁজে পাচ্ছিনা আমি।’

‘মহল্লিকা জানত তোমার এই বিষের কথা?’

‘মহল্লিকা? তবে কি সেই…?’ চিন্তিত দেখায় কিলাতকে, কিছুটা বিস্মিতও। এরপরে, তাকে বিদায় দিয়ে গৃহে ফেরেন পুষ্পকেতু, সঙ্গী হন উল্মুকও।

***

‘জয়কেশী এই ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এই তোমার বিশ্বাস?’ মধ্যাহ্নভোজের পরে দুই মিত্র বিশ্রাম করছেন, উল্মুক প্রসঙ্গ তোলেন সেসময়ে।

‘সবদিক বিচার করে সেরকমই মনে হয়; তবে ধর্মদাস কি সংবাদ আনে দেখি, রুদ্রষেণের অসমাপ্ত তদন্তের দিকটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জয়কেশী যদি এই হত্যা করে থাকে, তা সে মহল্লিকার জন্য নয়, কোনও বৃহত্তর স্বার্থে আঘাত লেগেছিল তার, এই আমার ধারণা। তবে মহল্লিকা সত্য বলছে এও সম্ভব, ঘটনাচক্রে জয়কেশী জড়িয়ে পড়বে এ তার কল্পনার অতীত ছিল।’

‘প্রেম বড় বিচিত্র বস্তু তাই না?’

‘সে তো তুমি ভালো বলতে পারবে হে’, পুষ্পকেতুর রসিকতায় দুজনেই হেসে ওঠেন।

দুই তরুণের আলাপচারিতা হত্যারহস্যের গণ্ডীতে বাঁধা থাকেনা বেশীক্ষণ, মনোরম দ্বিপ্রহরের অলস মেদুরতা আচ্ছন্ন করে হৃদয়।

***

এরপর কেটে গেছে কয়েকটি ঘটনাবিহীন দিন, নিত্যকার কাজের মাঝে কুমারকে থেকে থেকে ছুঁয়ে গেছে রহস্যের চিন্তাজাল। একদিন দিবার অগ্রভাগে হরিষেণের গৃহ থেকে এক দূত এসে দিয়ে যায় একটি পত্র। পত্রে হরিষেণ জানিয়েছেন দুই বিদেশীর সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য। ভীমদেব সত্যই কিপুনদদেবের শ্যালক, তবে লাম্পট্য ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তিনি স্বদেশে কুখ্যাত; সম্প্রতি একটি গণিকালয়ে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকে ঘিরে তাঁর নাম জড়ায়; যৌধেয়রাজ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন। কিছুকাল দেশান্তরে কাটিয়ে ভগ্নীর মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করে দেশে ফিরবেন সম্ভবত এরকমই পরিকল্পনা তাঁর।

জয়কেশী সম্পন্ন বণিক, রোমক সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে তাঁর; গৃহে তিনটি শিশুসন্তান, পত্নী দুই বছর আগে কনিষ্ঠটির জন্মকালে মারা যান, এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় বিবাহ করেননি তিনি। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে প্রায়ই ভ্রমণ করেন বিভিন্ন প্রদেশে, তাঁর পরিচিতিও ব্যপ্ত, তবে আইন বহির্ভুত কার্যকলাপের কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি। যদিও ব্যবসায়ের আড়ালে গুপ্তচরবৃতির সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না, সে কার্যের সুযোগ তাঁর আছে।

সেদিনই দ্বিপ্রহরে ধর্মদাস নিখোঁজ বণিক বিষয়ক তদন্তের তথ্যসহ দেখা করেন বিশাখগুপ্তের কার্যালয়ে।

‘এই সবকটি ঘটনাতেই লক্ষ্য করার বিষয় এই যে এঁরা প্রত্যেকেই বিদেশী ও অত্যন্ত সম্পন্ন ব্যক্তি। পান্থশালা থেকে মধ্যরাত্রে প্রায় চোরের মত অন্তর্হিত হয়েছেন সকলেই, এমনকি প্রয়োজনীয় দু একটি পেটী ভিন্ন সঙ্গে নেননি কিছুই; তাঁদের ফেলে যাওয়া সামগ্রী থেকে পান্থশালার বকেয়া মূল্য আদায় হয়েছে প্রতিক্ষেত্রেই।’

‘বন্দরে এঁদের ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল কিনা জানা গেছে কি?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।

‘কাজের উপলক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ থাকলেও তেমন বিশেষ কারো কথা যানা যায়নি কোনও ক্ষেত্রেই। তবে দুটি বিষয়ে এঁদের মধ্যে আশ্চর্য্য মিল পাওয়া গেছে; প্রথমতঃ অক্ষক্রীড়ায় আসক্তি এবং দ্বিতীয়তঃ, কোন না কোন সময়ে প্রত্যেকেরই রৈবতের পানশালায় যাতায়াত ছিল।’

‘রৈবতের পানশালা!’ বিশাখগুপ্ত চমকিত হন।

‘আমি কতক এরকমই অনুমান করেছিলাম পিতা। রৈবত একজন আপাত ভদ্রলোক, তার পানশালাটি লোকপ্রিয়, এখানেই নিহিত আছে কোনও রহস্যের জাল’, পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘কিছু অনুমান করতে পারছ কি বৎস্য?’

‘ধুসরতা সরে ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে সবকিছু, এখন শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। আপনি আশীর্বাদ করুন দেব, যেন সত্যসন্ধানে সফল হই।’

‘শুভমস্তু।’

***

উল্মুককে সঙ্গী করে রৈবতের পানশালার সান্ধ্য আসরে উপস্থিত হন পুষ্পকেতু, ধর্মদাস ও দুইজন প্রহরী নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষায় থাকে, যাতে প্রয়োজনে সাহায্যে আসতে পারে। রৈবত কিছুটা বিস্মিত হলেও হাসিমুখে এগিয়ে আসে অভ্যর্থনায়, প্রায়পূর্ণ সভাস্থলের মধ্যবর্তী একটি অংশে বসার ব্যবস্থা করে দেয় সে বিশিষ্ট অতিথিদের জন্যে। বল্লভ সুরা হাতে এগিয়ে এলে, শীতল তক্রের অনুরোধ জানান কুমার, নেপথ্যে বেজে চলে সুললিত বাঁশীর সুর। আজও মহল্লিকা অতিথি সেবায় ব্যস্ত, তবে সে দূরত্ব বজায় রেখে এড়িয়ে চলে রাজপুরুষ ও তাঁর সঙ্গীকে। একপাশে অনেকগুলি পিঠিকা জুড়ে ভীমদেব সপারিষদ সুরাপানে মত্ত, দুটি সুরসিকা তাঁদের সেবায় তটস্থ। গুটিকয় অতিথি অক্ষক্রীড়ায় ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে, রৈবত নিজে তাঁদের সুখ সুবিধার তদারকিতে মগ্ন। অক্ষক্রীড়া পণ রেখে খেলা হয়, পণ জিতুন যে পক্ষই, এতে বিলক্ষণ শুণ্ডপতিরও লাভ থাকে কিছু। বংশীবাদন থেমে যায় আচম্বিতে, কক্ষে প্রবেশ করে কিলাত, বর্ণময় পোশাক ও বিচিত্র সাজসজ্জায় সে আকর্ষনীয়। আগ্রহ ফুটে ওঠে অতিথিদের চোখেমুখে, কিলাতের জনপ্রিয়তা সন্দেহাতীত। সে সকলকে অভিভাদন করে শুরু করে তার খেলা। সেদিন নারীসুলভ চলন ও মুকাভিনয়ে ছিল তার রসকৌতুকের বিষয়, অল্পসময়েই মাতিয়ে দেয় সে আসর, আর তার মাঝেই চলে শরীরী কসরৎ কৌতুকের ছলে; বাহবায় ফেটে পড়ে পানকক্ষ, অতিথিদের সাথে সেবক ও রসিকারাও যোগ দেয় হাসিতে। খেলা শেষ হয়, এরপর ঘুরে ঘুরে তাম্বুলপাত্র হাতে অতিথিদের সম্মুখে যায় কিলাত পারিতোষিকের আশায়, সকলেই দরাজহস্তে অর্থদান করেন; ভীমদেব দুটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলে দেন থালিতে, কিলাত কৃতজ্ঞতা জানায় আভূমি অভিবাদনে। পুষ্পকেতুর সমুখে উপস্থিত হয় সে ক্রমে, উল্মুক থলি থেকে অর্থ বের করতে উদ্যত হন; কিলাত রমনীসুলভ কটাক্ষহানে কুমারের প্রতি। পুষ্পকেতু আচমকাই তার বামহস্তের মণিবন্ধ চেপে ধরেন, উল্মুক বিস্মিত হয়ে থমকে যান এই অদ্ভুত আচরণে; কিলাতের মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে ভীতি। কুমার ধীরে ধীরে তার হাতের উপরভাগ মেলে ধরেন; নর্তকীদের মত আলংকারিক ধাতব নখর পরা তার পাঁচটি আঙ্গুলে, তার মধ্যে মধ্যমাটির অগ্রভাগ ভাঙা।

***

কিলাত কারারূদ্ধ হয়েছে রুদ্রষেণকে হত্যার অপরাধে, তার চারসঙ্গীও ধরা পড়েছে বিদেশী বণিকদের বিরূদ্ধে ষঢ়যন্ত্র ও লুঠের অভিযোগে। দণ্ডাধীশের কার্যালয়ে আধিকারিকরা সকলেই জমায়েত হয়েছেন, উপস্থিত আছেন উল্মুকও। জটিল ধাঁধার উত্তর জানতে সকলেই উদগ্রীব।

‘শুণ্ডালয়ে যেসকল বিত্তবান বিদেশী আসতেন, বিশেষত যাঁরা অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত, কিলাত তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরী করত তার রসালাপ গুণে, কখনও বা গঞ্জিকা সরবরাহ করে; সে নিজে নেশাসক্ত নয়, ফাঁদ পাততেই সংগ্রহে রাখত এইবস্তু। ক্রমে ওই চার সঙ্গীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিত, অধিক পণে খেলার প্রলোভন দেখিয়ে। বাকী কাজ তার সঙ্গীরাই করত, কিলাতের সেখানে কোনও ভূমিকা নেই।

ওই চারজন নিজস্ব কক্ষে নিয়ে যেত বণিকদের খেলার জন্য, প্রথম প্রথম হয়তো জেতার সুযোগ করে দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করত, আর তারপরে ভঙ্গ প্রয়োগের মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত করে, যে কোনও একজন কলহ সৃষ্টি করত অতিথির সাথে। কলহকে দ্বন্দে পরিণত করতে সময় লাগত না, আর তারপরেই নেশাগ্রস্তকে বিশ্বাস করানো হোত যে তাঁর প্রতিপক্ষ হত হয়েছে। নেশা কেটে যেতে নিদারুণ ভয়ে বিদেশীর বুদ্ধি লোপ পেত, তখন তাঁর সংগ্রহের সমস্ত অর্থ ও গহনার বিনিময়ে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে তাঁকে রাতারাতি নগরসীমার বাইরে পলায়নে ব্যবস্থা করে দিত বাকি তিনজন। হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ফলে বণিকেরা কেউই আর ফেরত আসেননি, বা এই নিয়ে আলোচনা করতে সাহস করেননি। এভাবে ভালোই চলছিল, কিন্তু গোল বাধালেন রুদ্রষেণ। তিনি এই অপরাধ চক্রের সাথে কিলাতের যোগসাজস আন্দজ করতে পেরেছিলেন, আর তাতেই মরতে হল তাঁকে।

কিলাত সেদিন রজ্জুগুলি এমনভাবে টাঙ্গিয়েছিল, যে একটি রজ্জু ছিল রুদ্রষেনের জন্য নির্দিষ্ট পীঠিকার ঠিক উপরভাগে। ইচ্ছা করেই সে পড়েছিল তাঁর পৃষ্ঠে; আর সেই সুযোগে বামহস্তের বিষাক্ত নখর দিয়ে সে চিঁড়ে দেয় তাঁর স্কন্ধ ও পৃষ্ঠদেশ। যন্ত্রনায় বিচলিত হয়েই কিলাতকে প্রহার করেছিলেন রুদ্রষেণ। পরবর্তীতে তাঁর যে অস্বাভাবিক আচরণ, সে বিষক্রিয়ার ফল।’

‘কিন্তু মহল্লিকা কিরূপে জানল বিষতিন্দুর কথা? সে যে নির্দোষ সে সিদ্ধান্তেই বা তুমি এলে কিরূপে?’ বিশাখগুপ্ত প্রশ্ন করেন।

‘সে সত্যই কখনও দেখেছিল কিলাতকে বিষ সেবন করতে, আর সেকারণেই বলেছিল ওকথা। কিলাত তার স্বীকারোক্তির সুযোগ নিয়ে আমাকে জানায় যে বিষের কৌটা অপহৃত হয়েছে; কৌটাটি সে নিজেই হত্যার পরে নদীবক্ষে বিসর্জন দিয়ে থাকবে। মহল্লিকা গৃহস্থ কন্যা, চার বর্ষের পুরাতন ঘটনার কারণে হত্যার ইচ্ছা জাগলেও সে কার্য একা সম্পন্ন করার স্নায়ু তার নেই বলে মনে হয়েছিল; জয়কেশীকে রক্ষা করতেই তার এই উদ্যোগ সে সন্দেহ প্রবল হয় শুরু থেকেই। তাছাড়া তার অঙ্গুরীয়টি পরীক্ষা করে কোনও ভাঙা অংশ চোখে পড়েনি আমার।’

‘কিলাতের পরবর্তী লক্ষ্য কি ভীমদেব ছিলেন?’ উল্মুক জানতে চান।

‘সে তো অবশ্যই। মনে হয় শুরুতে জয়কেশীকেও কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু সাবধানী বিচক্ষণ শ্রেষ্ঠীর সাথে পেরে ওঠেনি।’

এর পর সভাভঙ্গ হয়, ধীরে ধীরে প্রস্থান করেন সকলে। প্রহরী এসে জানায়, জয়কেশী দেখা করতে চান পুষ্পকেতুর সাথে।

প্রতীক্ষা কক্ষের মাঝখানে অপেক্ষায় আছেন শ্রেষ্ঠী জয়কেশী, পূর্বের হতাশাগ্রস্ত ভাব কেটে গিয়ে বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখের ভাব; লজ্জিত ভঙ্গীতে পাশে দাঁড়িয়ে মহল্লিকা।

‘বিদায় নেবার পূর্বে সাক্ষাৎ করতে এলাম কুমার, আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’

‘কৃতজ্ঞতা কিসের? এ আমার কর্তব্য; মগধের ন্যায়দণ্ড সত্যের প্রতীক, আমি তার ক্ষুদ্র সেবক মাত্র।’

‘আগামী পঞ্চমী তিথিতে দেশে যাত্রা করব, মহল্লিকাও সাথে যাবে আমার, বিবাহ করব তাকে।’ ঈষৎ হেসে জানান জয়কেশী, মহল্লিকার মুখ রক্তিম হয় এই বাক্যে।

‘মহল্লিকা ভাগ্যবতী, সে আপনার দেখা পেয়েছে; আমার অভিনন্দন রইল ভদ্র।’

***

গোধূলির রক্তরাগে শয়নকক্ষটি স্বপ্নময়, পীঠিকায় রাখা যুথীপুষ্পের গন্ধ বাতাসে নেশা ধরায়। পুষ্পকেতু কক্ষের একপাশে রাখা বীণার তার স্পর্শ করেন ধীরে ধীরে, এক কোমল সুরের মৃদু ঝঙ্কারে মেতে ওঠে পরিবেশ। রাত্রি গভীর হয়, শাপভ্রষ্ট গন্ধর্বের মত সুরসাধনায় ডুবে থাকেন কুমার গভীর আবেগে।

*** ***

দুরূহ শব্দের অর্থ:

কাম্পিল্য – পারফিউম, অক্ষক্রীড়া – পাশা খেলা, বায়বীয় কপি – আকাশে লাফিয়ে বেড়ানো বাঁদর, উৎপীঠিকা – টেবিল, পীঠিকা – কাঠের বসার টুল, এক দণ্ডকাল – ২৪ মিনিট, বিষতিন্দু – স্ট্রিকনিন বিষ, গঞ্জিকা– গাঁজা, ভঙ্গ – ভাং , কিলাত – বামন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *