প্রহরজোড়া ত্রিতাল (রচনা ১৯৭৭-৮১। প্রকাশ ১৯৮২)
ত্রিতাল
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে
তোমারই ওই টুকরো-করা-শরীর
দুঃসময়ে তখন তুমি জানো
হলকা নয়, জীবন বোনে জরি।
তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা–
মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই
কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল!
*
বৈরাগীতলা
সেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চেয়েছিলে
সহজ করে বলেছি বন্ধুকে–
গাঁয়ের নাম উজালডাঙা, সইয়ের নাম জবা
পথ গিয়েছে বৈরাগীদের বুকে।
শরীর থেকে শীতের বাকল শহর গেছে খুলে
মাথার উপর ছড়িয়ে গেছে হাঁস–
ঠিক তখনই সৌরধুলোয় অন্ধ, বলেছিলাম
এই গোধূলি অনন্তসন্ন্যাস!
অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়, ঝাপসা রেখে আমায়
সঙ্গিনী যায় বৈরাগীগৌরবে–
দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?
*
উলটোরথ
ট্রেনের থেকে ঝাঁপ দিয়েছে ধানশিয়রে
গলার কাছে পাথরবাঁধা বস্তামানুষ
মাটির থেকে উঠছিল তার মাতৃভূমি
বুকের নীচে রইল বিঁধে বৃহস্পতি
ইচ্ছে ছিল তমালছোঁয়া দুঃখ ছিল
কিন্তু হঠাৎ টান দিয়েছে উলটোরথে
এসেছিলাম আমরা সবাই এসেছিলাম
বলতে বলতে ঝাঁপ দিল তাই অন্ধকারে
কামরাজোড়া অন্য সবাই চমকে উঠে
অল্প মুখের কৌতূহলে দেখল শুধু
ছন্দ আছে আসা-যাওয়ার ছন্দ আছে
আর তা ছাড়া ধ্বংস তো নয় বরং এ যে
সবার কাছে লাথি খাবার পদ্মবুকে
দেশ নেই যার এইভাবে দেশ খুঁজে বেড়ায়
উলটোরথের ভিখিরি দেশ খুঁজে বেড়ায়
গলায় পাথর বুকের নীচে বৃহস্পতি।
*
অন্ধ
ছোবল নিয়ে সে ঢুকেছে গহনে গহনে
সব সবুজকে করে দিয়ে যাবে শাদা
তুমি তার দিকে তাকিয়ে দেখোনি কখনো
হাত-পা আমার লতায় রেখেছ বেঁধে
মহাদেশ জুড়ে ঈথারে প্রতিধ্বনিত
পাথরে পাথরে শব্দের মাথাখোঁড়া
মনে হয় যেন ধ্বসে পড়ে যাবে সবই আজ
পুরোনোই নয়, নতুন সম্ভাবনাও
সকলেরই বুকে জাগা প্রকাণ্ড আমিতে
ভিতরে ভিতরে ঘন হয়ে আছে হাওয়া
ফিরে চলে যাওয়া ধমনীতে কেউ ডাকেনি
পাথরে পাথরে শব্দের মাথাখোঁড়া
খড়্গে খড়্গে খুবলে নিয়েছে অস্ত্র
হৃৎপিণ্ডে সে ঢালে মাদকের থুৎকার
চোখের উপরে লক্ষ লক্ষ শলাকা
উলটিয়ে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে শূন্যে
কাড়ানাকাড়ায় বাজিয়ে তুলেছে মজ্জা
পাথরে পাথরে শব্দের মাথাখোঁড়া
ছোবল নিয়ে সে ঢুকেছে গহনে গহনে
অন্ধকে ছুঁয়ে বসে আছে অন্ধরা।
*
ভয়
সি আই টি রোডের বাঁকে পাথরকুচির উপর
হাত ছড়িয়ে দিয়ে
ঘুমিয়ে আছে আমার মেয়ে
বুকের কাছে এনামেলের বাটি।
আজ সারাদিন ধরে বৃষ্টি ঝরেছে ওর ভিক্ষের উপর
তাই বুঝতে পারিনি
কোনটা ছিল জল আর কোনটা-বা কান্না।
সেদিন যখন হারিয়ে গিয়েছিল কানাগলির ঘূর্ণায়
কেঁদে উঠেছিল
অনাথ মেয়েরা যেমন করে কাঁদে।
বলেছিলাম, ভয় কী
আমি তো ছিলাম তোর পিছনে।
কিন্তু আমারও ভয় হয় যখন ও ঘুমিয়ে পড়ে
আর ওর ঠোঁটের কোণের মেঘ ভেঙে
গড়িয়ে আসে একটুকরো আলো।
*
জ্যাম
ভালুকের পেটে ভালুকের থাবা।
স্থির হয়ে আছে কালের অসীম।
ঝুলে পড়ে আছে জিরাফের গলা
ঝাঁপ দিয়ে ওঠে জেব্রা ক্রসিং।
ঝটপট করে ক’হাজার হাঁস
ছিঁড়ে নিতে চায় এ ওর পালক–
বাতুল দুপুরে ডুগডুগি নিয়ে
গান গেয়ে যায় ভিখারি বালক।
মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা
কিছু-বা পুরোনো কিছু-বা তরুণ
হাঁক দিয়ে বলে কনডাকটর :
পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন।
*
শ্লোক
সেই মেয়েটি আমাকে বলেছিল :
সঙ্গে এসো, বেরিয়ে এসো, পথে।
আমার পায়ে ছিল দ্বিধার টান
মুহূর্তে সে বুঝেছে অপমান
জেনেছে এই অধীর সংকটে
পাবে না কারো সহায় একতিলও–
সেই মেয়েটি অশথমূলে বটে
বিদায় নিয়ে গাইতে গেল গান।
আমি কেবল দেখেছি চোখ চেয়ে
হারিয়ে গেল স্বপ্নে দিশাহারা
শ্রাবণময় আকাশভাঙা চোখ।
বিপ্লবে সে দীর্ঘজীবী হোক
এই ধ্বনিতে জাগিয়েছিল যারা
তাদেরও দিকে তাকায়নি সে মেয়ে
গ্লানির ভারে অবশ ক’রে পাড়া
মিলিয়ে গেল দুটি পায়ের শ্লোক।
*
দশক
কথা বলছিল শাদা তিন বুড়ি
সাবেককালের প্রথায়;
সবদিক এত চুপচাপ কেন?
সেই ছেলেগুলি কোথায়?
মরা হয়ে আসে বিকেলের আলো
শহিদবেদির ঋণ–
নিচু নিশ্বাসে ভালোয় ভালোয়
গেল আরো এক দিন।
বেদি আর বুড়ি, মাঝখানে কিছু
হাড় হয়ে আছে ঘাস–
একা পেলে তারা পায়ে বিঁধে বলে :
কিছু কি শুনতে পাস?
মুণ্ডমালায় ওই হেঁটে যায়
দশ বছরের দেনা।
বুড়ি শুধু ডাকে : ও বাপু ছেলেরা
কেউ কিছু বলবে না?
*
পিকনিক
মনে পড়ে আমাদের ডায়মন্ডহারবারে পিকনিক।
বৃষ্টিভরা মেঘগুলি জমে ছিল নদীর ওপারে
এপারে গম্ভীর ছিল বসতির মধ্যে ভাঙা চার্চ
মাঝখানে ভাসমান নৌকো নিয়ে মগ্ন ছিল জাল।
মনে পড়ে সকলের ব্যস্ত যৌবনের তাপ থেকে
অগোচরে ঘুরে যাওয়া পাতাময় শীতল ভিতরে
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সনাতন ক্রস, কনকেশন।
কিন্তু কোন্ কনফেশন? ভয় হয়। চলো ফিরে যাই।
ওইপার থেকে মেঘ এপারে আসেনি এতদিনে?
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে নেওয়া হয়ে গেছে শেষ।
আমাকে নেয়নি কেউ, আমাদের, তাই সারি সারি
বসেছি মেঘের দল, কিন্তু কোনো বৃষ্টি নেই বুকে
অবাধ ভাতের স্বাদে ফিরে আসে সাবেক আহ্লাদ।
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে, বৃষ্টি নয় ঠিক
ভুক্তাবশেষের দিকে লুব্ধ কাক, ইতর শিশুরা,
ঢেউ লেগে নৌকোগুলি চলে যায় নদীর ওধারে।
তারপরে উঠে আসি, শরীরে সজল প্রবণতা
শোনা যায় আমাদের ডায়মন্ডহারবারে পিকনিকে
ফিরে আসবার পথে কারা যেন পাথর ছুঁড়েছে।
পাথর ছুঁড়েছে? কিন্তু কনফেশন? চলো ফিরে যাই।
*
ভাষা
নিচু হয়ে বসে আছি পথের কিনারে, হাতে বাটি
যাওয়া-আসা করে লোক, স্রোত আছে, মনোবল নেই।
সূর্যরেখা ভরে দেয় প্রহরে প্রহরে, যেন জল
এ ছাড়া সম্বল নেই, হাওয়া শুধু মুছে নেয় চোখ।
এ হাওয়া তোমারও চোখে তার চোখে এর তার চোখে
কেন তবে আমাদের আরো কিছু জানাশোনা নেই?
ধুলো মাখি বুকে, কিন্তু তবু চোখে জল নেই কেন?
কেন মনোবল নেই? কেন এ ধাতব শব্দে আলো
হাতুড়ি নাচায় শূন্যে? আমি শুধু নিচু ও নিথর
মাথায় আঘাত চেয়ে এতদূর প্রতীক্ষায় কেন?
যাওয়া আসা করে চোখ, চোখের পাথরে ঘূর্ণি, স্রোত
বুঝি না ওদের নাম, করুণা বা ক্রোধের প্রভেদ
এমনকী ছুঁই না ওই নিম বা শিরীষও, ভয় হয়
ভয় হয় যদি ওরা কথা বলে ইংরেজি ভাষায়!
*
আত্মঘাত
এখানে আমাকে তুমি কিসের দীক্ষায় রেখে গেছ?
এ কোন্ জগৎ আজ গড়ে দিতে চাও চারদিকে?
এ তো আমাদের কোনো যোগ্য ভূমি নয়, এর গায়ে
সোনার ঝলক দেখে আমাদের চোখ যাবে পুড়ে।
বুঝি না কখনো ঠিক এরা কোন্ নিজের ভাষায়
কথা কয়, গান গায়, কী ভাষায় হেসে উঠে এরা
পিষে ধরে আমাদের গ্রামীণ নিশ্বাস, সজলতা,
কী ভাষায় আমাদের একান্ত বাঁচাও হলো পাপ।
আমার ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে। গ্রামের অশথ
মনে পড়ে। তাকে আর এনো না কখনো এইখানে।
এইখানে এলে তার হৃদয় পাণ্ডুর হয়ে যাবে
এইখানে এলে তার বিশ্বাস বধির হয়ে যাবে
বুকের ভিতরে শুধু ক্ষত দেব রাত্রির খোয়াই।
আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ
সব ফেলে যাব বলে প্রস্তুত হয়েছি, শুধু জেনো
আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে, তাই হব
পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী।
*
দাবি
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে মনে রেখো পিছনে কী ছিল।
দায়িত্ব সুন্দর, প্রতিমুহূর্ত বাড়িয়ে দেয় হাত
সম্পর্কে আনন্দে দূর্বাজলে।
হয়তো সে নিজেই দেয় না, নিজে তুলে নিতে হয় তাকে
আধেক গড়নে কোনো অভিমানী প্রতিমাবলয়।
অবসাদে ভরে আসে চোখ?
হোক, তবু তুমি তো সমস্তখানি নও
ততটা নিজস্ব পাবে যতখানি ছেড়ে দিতে পারো।
কেউ এসে বসেছিল, কেউ উঠে চলে গেল, কেউ কথা বলেনি কখনো
মন তার চিহ্ন রাখে সবই।
কুঠুরিতে কুঠুরিতে আর্ত স্বরে ভয় পেয়ে উঠে যায় কবুতরদল
গলায় শিকলচিহ্ন লাল হয়ে জ্বলে থাকে দুরূহ রশির চাপা টানে
মন তার চিহ্ন রেখে দেয়।
তবু তুমি ভুলে যেতে পারো না কখনো এরই দায়ে
জীবন তোমার কাছে দাবি করেছিল যেন প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি।
*
ভাস্কর
সেই ব্রাহ্মমুহূর্তের পিঙ্গল প্রবাহ থেকে জাল ফেলে তুলেছিল আলো
গঙ্গার যুবক সঙ্গীদল
ভাস্করের হাতেগড়া আদম শরীর, বুকে দাহ।
আমরা ছিলাম বিস্ফারিত
এলেমেলো ডাঙার নৌকোয় বসে পূর্বপাথরের দিকে চেয়ে।
আমাদের কপালের যেন ঠিক মাঝখানে সেই মুহূর্তের কোনো গম্ভীর আঙুল
স্পর্শ রেখে চলে গেল। আর, সেই থেকে
সেই থেকে আমাদের শরীরের আবরণ হয়ে আছে আলো
আমরা সহজে যাই ভস্মাধার থেকে ভস্মাধারে
এত যে নিশান ওড়ে, সব নিশানের কেন্দ্রে আমাদেরই রক্তচাপ দেখি
অগণ্য থাবার লাফ আমাদের কাছে এসে ভেঙে যায় বুদবুদের জলে
বটের মজ্জার থেকে তুলে আনি আমাদের প্রাত্যহিক চোখের যমুনা—
আমাদের হেরে যাওয়া সাজে?
ওই হাত নিয়ে তুমি কোথায় পালাবে ভাবো যে-হাতে সূর্যের রেখা আছে?
*
শিলালিপি
রঙে ভেসে যায় চোখ ঝলকে ঝলকে তবু অন্তরাত্মা দেখে অন্ধকার
শব্দের প্লাবনে ডুবে জলজ ভুবনভাঙা নিঃশব্দ বধির হয়ে আছে
তীরের ফলকগুলি খুলে নেওয়া হয়ে গেছে বহু ক্ষত সাড় নেই শুধু
ধূমল পূজার গন্ধ এক বুকে টেনে নেয় মণ্ডপের পাশে ছোটো মঠ
বালির খরতা নিয়ে জিবে এসে লেগে থাকে প্রতিবিন্দু আনন্দের জল
ভাস্কর্যে ধরেছি গতিমালা
ধ্বংসের কিনারা গাঁথা জীবন পাথর হলো তার সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়া।