প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গদ্য)

প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গদ্য)

ধর্ম : বাস্তব

আমাদের পূর্ব পুরুষদের ছিলো গোলায় ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, ক্ষেতে সব্জি। তাই তাদের আনন্দ প্রাচুর্যের অভাব ছিলো না মোটেও। অবসর সময় ছিলো তাদের অনেক কিন্তু অবসর উপভোগের সরঞ্জাম ছিলো খুব কম। কেউবা ইচ্ছা মতো গান গাইতো কেউবা বাঁশি বাজাতো, কেউবা পড়তো পুঁথি সারি-গাঁথা ইত্যাদি। সারাদিন এটা সেটা কোরে যখন সময় আর কাটে না তখন কেউবা বেড়াতে যেতো পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ি— কিন্তু তাই বা কদিন যাওয়া সম্ভব! দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না। সারাক্ষন একটা অলস ভাব আচ্ছন্ন কোরে রাখতো।

তখন কিছু কিছু লেখাপড়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। লোকেরা যে সে সময় ধর্ম করতো না তা নয়— তবে তা ছিলো নিতান্তই একটা অদ্ভুত অনুমানের উপর। কারন মুসলমান ধর্মে নামাজ (প্রার্থনা) করার পূর্বে ওজু (হাত মুখ ধোয়া) করার যে পদ্ধতি তখন ছিলো তা কয়েকটা গ্রাম্য উদ্ভট শব্দ দ্বারা শুরু করা হতো। অথচ ধর্মগ্রন্থে তা সম্পূর্ন ভিন্ন রকমের।

কিছুটা যখন তারা জানতে শুরু করলো তখন বিভিন্ন সম্প্রদায় পেলো তাদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়বার সুযোগ। কিছু গোঁড়া ধার্মিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো—তারা নিজেদেরকে একজন ঈশ্বরভক্ত সাধুপুরুষ বোলে পরিচয় দান করবার জন্য গ্রন্থের যথেচ্ছা বিকৃত অর্থ কোরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইত এবং এমন কতগুলো অদ্ভুত ব্যাখ্যা করলো যা “সৃষ্টি ছাড়া” অবাস্তব। মানুষ তখন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়নি তাই বাস্তবতা উপলব্ধির ক্ষমতাও ছিলো তাদের সামান্য। ফলে ধার্মিকরা যে ব্যাখ্যা করলো তা-ই তারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলো। এবং তাদের অবসর সময়কে ঐ রূপ ধর্ম প্রক্রিয়ার মাঝে কাটানোরও সুযোগ হলো। তাদের মনে এমন একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হলো যে, যে কাজ তারা করছে তা তাদের পরকাল নামক স্থানে সুখের সহায়তা করবে। তারা দেখলো এমনিই যখন কোনো কাজ ছাড়াই চলছি তখন যদি এমন কোনো কাজ যা মোটামুটি ভালোই তা করতে দোষ কি!

ঠিক তখন থেকেই শুরু হলো ধর্মের প্রতি লোকের একটা অন্ধ অনুকরন। কালে কালে এই অন্ধতা এত প্রবল হলো যে অন্ধ বিশ্বাসই হলো ধৰ্ম।

পৃথিবীর গতি চন্দ্রমুখি হলো। প্রতিযোগিতা শুরু হলো বিজ্ঞানের; অজস্র অসংখ্য আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করতে লাগলো। ঠিক তখনই অন্ধ অনুসারিগন দেখল যে তারা যে ধর্ম পালন করছে তাতে এরকম কিছু লেখা বা তাদের জানা নেই। অতএব ধর্মের মতে এরা বিধর্মী। কি আশ্চর্য, বাস্তবতাকে এরা নীতি বা ধর্মের দোহাই দিয়ে অস্বীকার করতে চাইলো।

ফলে শিক্ষিত নবীনদের সাথে শুরু হলো তাদের দ্বন্দ্ব। নবীন চিরদিন গতিময়। কারন যৌবনই নবীনের প্রতীক আর যৌবনের ধর্ম নতুন সৃষ্টি করা। পুরনোকে কখনই যৌবন মেনে নেয় না— তার প্রমান অনেক পূর্বে থেকেই হয়ে আসছে। এই কারনেই বৃদ্ধদের চিরদিনের একটা অন্ধ বোবা আক্রোশ তরুনদের উপর।

শুরু হলো তখন অন্ধ ধার্মিকদের প্রতি নবীনদের অবহেলা ও ঘৃনা। তাতে সমাজ বা ধার্মিকরা মনে করলো ওরা নিশ্চয়ই ধর্মকে বিসর্জন দিতে লেগেছে। সমাজ খেপলো নবীনদের উপর। বাক্যবানে, শত বাধা, প্রতিবন্ধক সৃষ্টি কোরে আলোর সন্ধানের এই যাত্রীদের তারা নির্মমভাবে শেষ কোরে দিতে চাইলো। কিন্তু যা বাস্তব তাকে কে অস্বীকার করবে! জীর্ন জরার পতন হতে লাগলো। তা হলেও হবে কি, বৃদ্ধ বট গাছের কতকগুলো ডাল ভেঙে তো আর বট গাছটাকে মারা যায় না! তার জন্য প্রয়োজন একেবারে মূল থেকে সমস্ত শিকড় সমেত উপড়ে ফেলা। একবারে গোড়া থেকেও কেটে ফেললে চলবে না, কারন বটের শিকড় থেকে পরগাছা জন্মে।

আমরা প্রতিদিন সকালে দেখি আমরা বেঁচে আছি, আমরা নিত্যকার কাজ করছি— এটাই বাস্তব। কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো— তা ভাবার সময় এখন কোথায়? সামনে চপ কাটলেট নিয়ে যদি ভাবতে শুরু করো যে কিভাবে এর সৃষ্টি হলো, কে প্রথম এটা তৈরি করলো ইত্যাদি তাহলে কোনোদিন তোমার চপ কাটলেট খাওয়া হবে না। তেমনি আমরা কোথা থেকে এসেছি এই রহস্য আবিষ্কার করতে গিয়ে অনেক মহা মনীষী তাদের অমূল্য জীবন শেষ কোরে দিয়েছেন এবং শেষে বলেছেন— এ অনন্ত। আমরাও যদি এবারে শুধু ঐ একটি বিষয় নিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাই তাহলে পৃথিবীকে সমাজকে জীবনকে আমরা কি দিতে পারলাম?

একটা মানুষের কাছ থেকে সমাজ পৃথিবী সভ্যতা অনেক কিছুই দাবি করে। অনেক কিছুই আমাদের দেবার আছে। প্রতি মুহূর্তে আমরা বেঁচে আছি— এটাই সত্য এবং বাস্তব, তাই আমাদের কর্তব্য হবে সেই ধর্ম পালন করা যা সত্য এবং ন্যায়ের। শুধু বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গিতে ধর্ম পালন হয় না, শুধু সুখের কথায় ধর্ম পালন হয় না। ধর্ম পালন প্রকৃত কাজের মধ্যে। একজন মানুষকে ঘৃনা কোরে আমি আল্লাহ নামের প্রভুর কাছে তার একজন প্রকৃত অনুসারী হবো— সেটা তো ধর্ম নয়। ধর্ম পৃথিবীতে একটাই।

যে নিরাশ্রয় তার ধর্ম হবে আশ্রয় সংগ্রহ করা, যে গরীব তার ধর্ম হবে ধনী হবার; যে কাঙাল তার ধর্ম হবে বিত্তবান হবার। যে অর্থবান তার ধর্ম হবে আতুরের সাহায্য করা। যে মহৎ তার ধর্ম হবে মূর্খকে মানুষ হবার মন্ত্র শেখানো, আলোর পথ নির্দেশ করা। যে নিপীড়িত তার ধর্ম হবে মুক্তির সংগ্রাম। অত্যাচারিত জাতি যদি রাতদিন কল্পধর্মের আশ্রয় অবলম্বন কোরে থাকে তবে তার মুক্তি হবে কখন?

অনেক পিছিয়ে আমরা। এখনও আমরা শাদা কালো নিয়ে বিভেদে মত্ত— আমরা সৃষ্টি করবো কখন! সব ভুলতে হবে এবং একমাত্র বাস্তবকেই নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে নইলে সম্মুখে প্রচন্ড ঝড়!

১৩ কার্তিক ১৩৭৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *