প্রস্তরযুগের একটি গল্প ( A Story of the Stone Age )
[‘A Story of the Stone Age’ প্রথম প্রকাশিত হয় ধারাবাহিক আকারে ‘The Idler’ পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে। পরে ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। নভেম্বর ১৯২৭ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]
১। আঘ-লোমি আর উয়ায়া
এ গল্প ইতিহাস শুরু হওয়ার আগের গল্প। মানুষের স্মৃতি যদূর পৌঁছায়, তারও ওপারের গল্প। তখন মানুষ হেঁটেই চলে যেতে পারত আজকের ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে। তখন ঘোলাটে জলের চওড়া নদী টেমস আর তার জনক নদী রাইনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল জলাভূমির মধ্যে দিয়ে। মাঝখানে ছিল বিরাট সমতলভূমি–এখন যা উত্তর সাগর নামক জলরাশির তলায় তলিয়ে গেছে। ডাউন্সের সানুদেশ বরাবর উপত্যকার অস্তিত্ব ছিল না সুদূর সেই যুগে। সারের দক্ষিণে ছিল একটা পর্বতমালা। মাঝামাঝি ঢালু জায়গায় বিরাজ করত নিবিড় ফার বৃক্ষ। বছরের বেশির ভাগ সময় তুষার-ঢাকা থাকত শীর্ষদেশ। পর্বতমালার নিচের থাকে তৃণভূমিতে চরে বেড়াত বুনো ঘোড়া, জঙ্গলে টহল দিত হায়না আর বৃহদাকার ভয়ংকর ধূসর রঙের গ্রিজলি ভালুক। ডালে ডালে বিচরণ করত ধূসরবর্ণ বনমানুষ। তারও নিচে অরণ্য, জল আর ঘাসজমির মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ছোট্ট একটা নাটক। এ কাহিনি সেই নাটকেরই কাহিনি। পঞ্চাশ হাজার বছর আগেকার কাহিনি –ভূতত্ত্ববিদদের হিসাব অনুযায়ী।
এ যুগের মতো সে যুগেও বসন্ত ঋতুতে পলক জাগত প্রাণে, রক্ত উত্তাল হত ধমনিতে। বিকেলের আকাশ টলটলে নীল। পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঘের স্তূপ। দক্ষিণ-পশ্চিম সমীরণে গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। উড়ে উড়ে খেলা করছে সোয়ালো পাখি। নদীর জল ঘুলিয়ে তুলছে কালো দৈত্যের মতো জলহস্তীর দল।
একটু দূরেই নদীর জলে দাপাদাপি করছে একদল ছেলেমেয়ে। এদের বসতি নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে–সেইখানে। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এখান থেকেও। কানে লতি নেই– ওপরের অংশ ছুঁচোলো-আজও এই ধরনের কান দেখা যায় কোনও কোনও জায়গায়। নাক থ্যাবড়া। পরনে কিসসু নেই। লম্বা বাহু। যাযাবরে ভবঘুরেদের ছেলেমেয়ে। মাথার চুল জট পাকানো–কপাল ঢেকে গেছে চুলের জটায়–ফ্যাশনটা দেখা যায় আজও।
জল ঘুনিয়ে খেলা করছে এরাও। জলহস্তীদের এগিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে–বোলু! বোলু! বোলু! বায়ায়া, বোলু!
ফুর্তিবাজ ঠিকই কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করার ভাষাটা অপর্যাপ্ত।
বাচ্চাদের এই খেলার জায়গায় ছড়িয়ে আছে বিস্তর চকমকি পাথর। বাবা-মায়েরা দুহাত ভরে তুলে নিয়ে গিয়ে জড়ো করেছে নদীর বাঁকে। সকালবেলা শিকারি কুকুরের কামড়ে জখম হওয়া একটা হরিণের মাংস খেয়ে ভরপেট ঘুমাচ্ছে পুরুষরা হাঁটুতে মাথা রেখে। মেয়েরা এখনও হাড় চিবুচ্ছে আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলছে চারপাশে। বুড়িরা কাঠ খুঁজে দিচ্ছে ভায়া আগুন-এর মধ্যে যাতে–রাত ঘনিয়ে এলেই লম্বা হয়ে বনের পশুকে ঠেকিয়ে রাখে–নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়।
এদের কারও গায়ে পোশাক বলে কিছু নেই। কয়েকজনের কোমর ঘিরে ঝুলছে পশুর চামড়া। আর ঝুলছে একটা করে থলি। থলি ভরতি চকমকি পাথর–সেই যুগের মূল হাতিয়ার। কোনওমতে মেজে-ঘষে ধারালো করা পাথর। এদের সর্দারের নাম ধড়িবাজ উয়ায়া। গালে কালো দাড়ি। বুকে কালো লোম। বাহুবল এবং বুদ্ধিবলে সে এদের দলপতি। চকমকি পাথর দিয়ে ছুঁচোলো করছে একটা হাড়। সবাই ঘুমাচ্ছে–জেগে বসে আছে কেবল উয়ায়া। তার বউয়ের গলা ঘিরে দুলছে ঘেঁদা-করা জীবাশ্মর মালা। বসে বসে যারা ঘুমাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের পাশে রয়েছে শান দিয়ে ছুঁচোলো করা হরিণের শিং আর চকমকির ফলা লাগানো কাঠের ডান্ডা।
জঙ্গলের অলডার গাছের আড়ালে লুকিয়ে একটি মেয়ে চেয়ে রয়েছে এইদিকে। এর নাম ইউদেনা। নেহাতই বালিকা। চকচকে চোখ। হাসিটি সুন্দর। আজ তাকে উয়ায়া বড় রকমের মাংসের টুকরো খেতে দিতেই নেকলেস গলায় বউটা গজরে উঠছিল গলার মধ্যে। ঈর্ষা। সঙ্গে সঙ্গে চাপা গজরানি ছেড়েছিল একটি তরুণ। নাম তার আঘ-লোমি। ইউদেনা একদৃষ্টে আঘ-লোমির দিকে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। চোখ নামিয়ে নিয়েছিল আঘ-লোমি। কিন্তু ইউদোর দিকে চোখ তুলেছিল উয়ায়া। চোখের চাহনিটা ভালো লাগেনি ইউদেনার। ভয়ে পালিয়ে এসেছে জঙ্গলে। উয়ায়া হাড় ছুঁচোলো করছে কেন, বোঝা যাচ্ছে না। আঘ লোমিকেও ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ কোত্থেকে একটা কাঠবেড়ালি এসে ধমকাধমকি শুরু করে দিলে ইউদেনাকে। ভাবখানা যেন, সাহস তো তোমার কম নয়? বেটাছেলেদের কাছ থেকে এত দূরে এসেছ জঙ্গলে? যাও, ভাগ হিয়াসে!
কাঠের টুকরো ছুঁড়ে মেরেছিল ইউদেন। পাশ কাটিয়ে দূরে সরে গিয়েও তড়পানি কমেনি কাঠবেড়ালির। কাঠ ছুঁড়তে ছুঁড়তে এবার তাড়া করল ইউদো। খেলা মন্দ নয়। কিন্তু…
চোখ তুলে তাকিয়েছে উয়ায়া। অলডার গাছ খুব নিচু গাছ। গাছের মাথায় হাত দেখা গেছে ইউদোর। উঠে দাঁড়াল উয়ায়া। চকমকি হাতে এগল সেইদিকে।
পিঠটান দিল ইউদেনা। উয়ায়ার রকমসকম তার ভালো লাগেনি। ঢাল বেয়ে উঠে গেল গভীর জঙ্গলে। দূর হতে দূরে। এত দূরে কখনও না এলেও খেলার ছলে এর কাছাকাছি আগে সে এসেছে। তাই প্রাণে ভয় নেই।
সন্ধ্যা নামছে। হঠাৎ শূকরের ঘোঁতঘোঁতানি শোনা গেল অদূরে।
সরে দাঁড়াল ইউদেনা।
তারপরেই শুনল ধাবমান একটা শব্দ।
গাছের ডাল ধরে বানরের মতোই দোল খেয়ে ওপরে উঠে বসল ইউদেনা।
তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল দাঁতালো বরাহটা, ধাবমান শব্দটা কিন্তু এগিয়েই আসছে। একটা হরিণও ছুটে গেল তলা দিয়ে। ভয় পেয়েছে। বরাহ আর হরিণ–দুটোই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। কীসের ভয়ে?
বিষম উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে শব্দের দিকে চেয়ে রইল ইউদো।
আচমকা জঙ্গলের মধ্যে থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল আঘ-লোমি। মুখে রক্তের দাগ। ফের উধাও হল জঙ্গলের মধ্যে।
ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে-আসা শব্দটা তো কই থামল না?
আবার দেখা গেল একটা ছুটন্ত মূর্তিকে। উয়ায়া। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। মুখ সাদা। লম্বা লম্বা লাফ মেরে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
তারপরেই বেরিয়ে এল জঙ্গলের রাজা–গ্রিজলি ভালুক। রাজামশাইকে কোনওদিন দেখবার সৌভাগ্য হয়নি ইউদেনার। নাম শুনেছে ছেলেবেলা থেকেই। দুষ্টুমি করলেই মায়েরা যার নাম করে ভয় দেখায়, এই সেই অরণ্য অধিপতি মহাভয়ংকর গ্রিজলি ভালুক। বিরাটকায় লোমশ সচল টিলা বললেই চলে। অরণ্যের আতঙ্ক নামটা অকারণে দেওয়া হয়নি।
পলায়মান মানুষ দুটোকে উদ্দেশ্য করেই তর্জন-গর্জন করে চলেছে জঙ্গলের বিভীষিকা। এত বড় আস্পদ্দা–তারই এলাকায় রক্তারক্তি, মারামারি? আরে, আমি হলাম গিয়ে জঙ্গলের রাজা, গুহামানবদেরও রাজা… একটু সমঝে চল!
ঘোঁতঘোঁত গরগর করতে করতে হেলেদুলে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল অরণ্য আতঙ্ক।
গাছেই বসে রইল ইউদেনা। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল জঙ্গলের রাজা, উধাও হল ওপরের দিকে। কিন্তু উয়ায়া অথবা আঘ-লোমি তো কই এল না। রাত হল। নদীর ধারে জল খেতে নামল ম্যামথ হাতির দল। দূর থেকেই বৃংহতি ডাক শুনেই চিনতে পারল ইউদেনা। বাছুরের মতো ডাকতে ডাকতে গাছের তলা দিয়ে চলে গেল বৃহদাকার একটা প্রাণী। খুব সম্ভব ইয়ায়া গন্ডার। তারা দেখা দিল আকাশে। সারারাত ভয়ের চোটে ঘুমাতে পারল না বেচারি। সঞ্চরমাণ ছায়া দেখে আঁতকে উঠল বারবার।
ভোর হল। সূর্য উঠল। ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ইউদেনা। নেমে এল গাছ থেকে। কিন্তু যাবে কোনদিকে? একরাত বনে কাটিয়েই পথ গুলিয়ে গেছে। কান খাড়া করে রইল কিছুক্ষণ। অনেক দূর থেকে ভেসে এল একটা ক্ষীণ ঠং ঠং শদ। চকমকি শান দেওয়ার শব্দ।
শব্দ লক্ষ্য করে এগল ইউনো। অচিরেই দেখল একটা চেনা গাছ, ওপরে মৌমাছি উড়ছে ভনভন করে। তারপরেই কানে ভেসে এল নদীর জলে জলহস্তী আর বাচ্চাদের দাপাদাপির শব্দ। ওই তো দেখা যাচ্ছে নদী। ওই তো সেই অলডারকুঞ্জ, যার মধ্যে লুকিয়েছিল ইউনো। দেখেই উয়ায়া-আতঙ্ক আবার পেয়ে বসল বেচারাকে। লুকিয়ে রইল জঙ্গলে।
খিদে পেলেও কাতর হয়নি। আধুনিকাদের মতো তিন ঘণ্টা অন্তর খাওয়ার ট্রেনিং তো পায়নি। দরকার হলে তিন দিন না খেয়েও থাকতে পারে, কাহিল হয় না। সারারাত বনে কাটিয়ে গা-হাত-পা একটু আড়ষ্ট হয়েছে বটে, তবে সহবত দেখাতে গিয়ে আধুনিকাদের আড়ষ্ট হওয়ার মতো নয়। ভয়? পাবে বইকী। ডাগর চেহারা হলেও মনে মনে ইউদেনা তো বালিকা। তবে আধুনিকাদের মতো ছায়া দেখে চিল-চেঁচানোর মতো ভয়কাতুরে নয়। আমাদের ইউদেনা।
বাউ ছাড়া কোনও পুরুষকে দেখা যাচ্ছে না। চকমকি ঠুকে শান দেওয়াই ওর কাজ। বাউকে দেখে নিশ্চিন্ত হল ইউদেনা। অন্য পুরুষরা নিশ্চয় শিকারে বেরিয়েছে। কয়েকজন মেয়েও গেছে নদীর ধারে। হেঁট হয়ে শামুক-গেঁড়ি কুড়াচ্ছে। দেখেই খিদে পেয়ে গেল ইউদেনার। দৌড়ে গেল ফার্ন গাছের আশপাশ দিয়ে। মতলব, মেয়েদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া। আচমকা শুনল, মৃদুস্বরে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে। থমকে দাঁড়াতেই পেছন থেকে খড়মড় শব্দে ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল আঘ-লোমি। দুচোখে যেন আগুন জলছে। মুখে রক্ত। শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। হাতে উয়ায়ার সেই সাদা পাথর। সাদা আগুন-পাথর। এ পাথর উয়ায়া ছাড়া কেউ ছোঁয় না, কিন্তু বুকের পাটা তো কম নয় আঘ-লোমির! উয়ায়ার সাদা পাথর ওর হাতে এল কী করে?
লাফিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল আঘ-লোমি। খপ করে খামচে ধরল ইউদোর বাহু, ঠেলে নিয়ে গেল ঝোপের মধ্যে।
যেতে যেতেই ইউদেনা শুনল, শোরগোল উঠেছে পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, জল ঠেলে এগিয়ে আসছে দুটি মেয়ে। উঠে দাঁড়িয়েছে অন্য মেয়েরা। আগুনে কাঠ গুঁজে আগুন জ্বালিয়ে রাখা যার কাজ, দাড়িওয়ালা সেই বুড়িটা দুহাত নেড়ে চেঁচাচ্ছে। চকমকি ঠোকা বন্ধ রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে বাউ। চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছে বাচ্চার দল।
ব্যাপারটা কী? স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ইউদেনা।
তাড়া লাগাল আঘ-লোমি। বুঝিয়ে দিল কী ব্যাপার। উয়ায়া মৃত্যু পরোয়ানা ছেড়েছে দুজনের নামে। রক্ষে নেই ইউদেনা আর আঘ-লোমির।
আর বোঝানোর দরকার হল না। শুধু মেয়েরা নয়, আস্তানার দিক থেকেও দুজন বেটাছেলে আসছে এদিকে। জঙ্গলের মধ্যে থেকেও বেরিয়ে আসতে দেখা গেল একজনকে।
ইউদেনার হাত ধরে টেনে দৌড়াল আঘ-লোমি। দেখতে দেখতে আবার পৌঁছে গেল চেস্টনাট জঙ্গলে। এখন আর ভয় নেই ইউদেনার-আঘ-লোমি রয়েছে তো সঙ্গে। দৌড়ে বেশ মজাও পাচ্ছে। হাসছে খিলখিল করে। আঘ-লোমি দৌড়ায় ভালোই–তবে ইউদোর। সঙ্গে পাল্লা দিতে সে পারছে না।
খোলা জমি পেরিয়ে ফের চেস্টনাট জঙ্গলে গতিবেগ কমিয়ে আনল দুজনে। আর ভয় নেই। এত দূরে কেউ আসতে সাহস পাবে না।
ভুল ভেঙে গেল অচিরেই। হাত তুলে দেখাল ইউদেনা। গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো মানুষের ছুটন্ত পা। উয়ায়ার ক্রুদ্ধ হুংকার শোনা গেল তারপরেই।
এবার ভয় পেল দুই পলাতক। দুদিক থেকে তেড়ে আসছে দুটো দল। একটা দলে রয়েছে উয়ায়া। আরেকটা দলে বাউ আর মেয়েরা। বাচ্চাগুলোসুদ্ধ ভিড়ে গেছে দল দুটোয়।
এবার ইউদেনা দৌড়াল আগে–আঘ-লোমি পেছনে। ঝোপঝাড় টপকে, খানাখন্দ পেরিয়ে, পশুচলা পথ মাড়িয়ে, কাদা পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে দে দৌড়, দে দৌড়!
পেছন ফিরে দেখল ইউদেনা, পেছিয়ে পড়েছে আঘ-লোমি। খুবই স্বাভাবিক, উয়ায়ার আগুন-পাথর বয়ে আনতে হচ্ছে যে তাকে।
স্বয়ং উয়ায়াকে দেখা যাচ্ছে তার পেছনে। দলের আর সব পেছিয়ে পড়লেও শক্তিমান উয়ায় এগিয়ে আছে সবার আগে মাথার ওপর তুলে ধরেছে হরিণের ডালপালাওয়ালা শিং… যার প্রতিটি শাখার ডগা শানিয়ে ছুঁচোলো করা।
দুজনের মধ্যে ব্যবধান মোটে পঞ্চাশ গজ!
তাই পাশ ফিরে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে নজর রাখল ইউনো। দেখল, ব্যবধান আরও কমে আসতেই হরিণের শিং ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছে উয়ায়া।
সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ইউদেনা, আঘ-লোমি, সাবধান!
শুনেই টুপ করে বসে পড়েছিল আঘ-লোমি। শনশন করে হরিণের শিং বেরিয়ে গিয়েছিল মাথার ওপর দিয়ে–কিন্তু একটা শাখার খোঁচা লেগে কেটে গেল মাথার চামড়া।
সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ হংকার ছেড়ে পেছন ফিরেই দুহাতের আগুন-পাথর ছুঁড়ে মারল আঘ লোমি উয়ায়ার দিকে। পাথর গিয়ে লাগল উয়ায়ার পাঁজরে। দম আটকে এল তৎক্ষণাৎ। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।
হরিণের শিংখানা কুড়িয়ে নিয়েই আঘ-লোমি দৌড়াল ইউদেনার দিকে। এবার আর ধরে কে! দৌড়! দৌড়! দৌড়!
এদিকে মাটিতে আছড়ে পড়েও টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে ফের দৌড়াতে গিয়ে উয়ায়া দেখলে, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে–হাঁপ ধরছে। বাউ ছুটে এসেছে পেছন থেকে। উয়ায়ার পাশ দিয়ে দুদ্দাড় করে সে দৌড়ে গেল দুই পলাতকের দিকে।
পলাতকরা ততক্ষণে নদীর ধারে পৌঁছে গেছে। আঘ-লোমি নদী পেরিয়ে ওপরে উঠে দৌড়াচ্ছে। নদীর মাঝামাঝি যখন পৌঁছেছে ইউদেনা, এমন সময়ে….
নদীর এপারে এসে পৌঁছাল বাউ। বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ল নাগালের মধ্যে ইউনোকে পেয়ে। আদিম মানুষদের কাছে নরমাংস বড় প্রিয়। আজকের ভূরিভোজ হবে যে ওই দুজনের অন্তত একজনকে দিয়ে।
অতএব দুহাতে ধরা চকমকি পাথর দুটোর একটা উঁচিয়ে ধরল মাথার ওপর। ঝিনুকের গড়নে ক্ষুরের মতো ধারালো পাথর।
পাথর নিক্ষিপ্ত হল ইউদেনার দিকে। বাউয়ের লক্ষ্য কখনও ফসকায় না। ইউদোর হাঁটু কেটে রক্তারক্তি করে দিয়ে ঠিকরে গেল পাথর। যন্ত্রণায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাড় বেয়ে উঠতে যাচ্ছে ইউদেনা, এমন সময়ে ঠিকরে এল দ্বিতীয় ধারালো পাথরটা।
কিন্তু বেরিয়ে গেল মাথার পাশ দিয়ে। কেননা, ইউদোর গোঙানি শুনে ফিরে এসেছিল। আঘ-লোমি। এক ঝটকায় ইউদোকে টেনে এনেছিল পাথরের গতিপথ থেকে।
বাউ লাফিয়ে পড়েছে জলে। দেখল আঘ-লোমি। ইউদোকে টেনে টেনে ওপরে নিয়ে গিয়েই ছুটল লম্বা লম্বা লাফ মেরে। কিন্তু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে অত জোরে দৌড়ানোর ক্ষমতা তো আর নেই ইউদোর। পিছিয়ে পড়ল বেচারি।
এদিকে বাউ উঠে এল বলে পাড়ে।
দেখেই আবার ফিরে এল আঘ-লোমি। হিংস্র বিকট চিৎকার ছেড়ে হরিণের শিং ঘোরাতে ঘোরাতে ধেয়ে গেল বাউয়ের দিকে। এক ঘায়েই ঠিকরে গেল বাউ। জল লাল হয়ে গেল তার রক্তে।
হাঁপাতে হাঁপাতে ওপারে তখন এসে পৌঁছেছে উয়ায়া। দুজন ডাকাবুকো ছোকরা নদীর মাঝবরাবর গিয়েই আঘ-লোমির খুনে চেহারা দেখে পেছন ফিরেই চম্পট দিচ্ছে উয়ায়ার দিকে।
ওই পর্যন্ত দেখেই আর দাঁড়ায়নি আঘ-লোমি। পালিয়েছিল ইউজেনাকে নিয়ে। শক্তের ভক্ত প্রত্যেকেই। তরুণ আঘ-লোমি দেখিয়ে দিয়েছে শক্তির নমুনা। হঠাৎ যেন পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছে। উয়ায়া পর্যন্ত অবাক হয়েছে, ভয় পেয়েছে তার হুংকার শুনে, তার শিং ঘোরানো দেখে, এক ঘায়ে বাউ-নিধন দেখে।
অতএব, কেউ আর তার পেছন নিল না। ছুটতে ছুটতে অনেক দূর এসে বার্চ গাছে উঠে রাত কাটাল দুজনে। ঘুম এল না চোখে। খিদেও পেয়েছে বিলক্ষণ। শাখাপ্রশাখা আর কচি পাতা চিবিয়ে নিয়ে পেটের জ্বালা কমানো গেল কোনওমতে। গভীর রাতে অনেক হিংস্র পশু টহল দিয়ে গেল গাছতলায়। হেলেদুলে চলে গেল একটা লোমশ গন্ডার।
ভোর হতেই আরও দূরে সরে এল দুজনে। পৌঁছাল একটা নদীর পাড়ে। বিস্তর চকমকি পাথর পড়ে ছিল সেখানে। পাথর ঠুকে জ্বালিয়ে নিল দুজনে। পাথর ছুঁড়ে একটা খরগোশ মেরে আনল আঘ-লোমি৷ আগুনে পুড়িয়ে খেল মাংস। তারপর বসল চকমকি পাথরে শান দিতে।
হঠাৎ হাতে উঠে এল একটা অদ্ভুত পাথর। মাঝখানে একটা ফুটো। এরকম পাথর কখনও দেখেনি আঘ-লোমি। উলটে-পালটে দেখে কাঠের ডান্ডাটা গলিয়ে দিল ভেতরে খেলার ছলে। ডান্ডার ডগায় এত জোরে এঁটে গেল পাথরটা, যে টেনে খুলে আনতেও পারল না। মাথার ওপর বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে দেখলে, বেশ ভারীও বটে। অস্ত্র হিসেবে মন্দ নয়।
কুঠার আবিষ্কার করল মানুষ এইভাবে।
তারপর? দিনকয়েক পরে পুরানো আস্তানায় ফিরে গেল আঘ-লোমি–একা। দুদিন দুরাত আগুন জ্বালিয়ে একা বসে রইল। আঘ-লোমি ফিরে এসে উপহার দিলে একটা কণ্ঠহার।
চমকে উঠেছিল ইউদেনা। এ যে উয়ায়ার কণ্ঠহার!
কুঠার তুলে দেখিয়েছিল আঘ-লোমি। রক্তরঞ্জিত কুঠার। উয়ায়ার রক্ত। নতুন অস্ত্র কুঠারের এক ঘায়েই খতম হয়ে গিয়েছে ধড়িবাজ উয়ায়া। অঙ্গভঙ্গি করে বাঁইবাঁই করে মাথার ওপর কুঠার ঘুরিয়ে আঘ-লোমি দেখিয়ে দিলে, পরম শত্রুকে হনন করেছে সে কীভাবে।
পঞ্চাশ হাজার বছর আগে এইভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষ শিখল প্রস্তর কুঠারের মহিমা।
.
২। গুহা ভালুক
নতুন অস্ত্র দিয়ে জঙ্গলের রাজাকে জখম করল আঘ-লোমি এর কদিন পরেই।
দুজনে ঠাঁই নিয়েছিল একটা সংকীর্ণ খাদের মধ্যে। জন্তুজানোয়ারের উপদ্রব এখানে নেই। রাত্রে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দিব্যি ঘুমানো যায়।
কিন্তু এহেন নিরাপদ জায়গাতেও একরাত্রে হানা দিল অরণ্যের আতঙ্ক আন্দু-মানে, গুহা-ভালুক।
আন্দু কদিন ধরেই দেখছিল, দুটো দুপেয়ে জানোয়ার ঘুরঘুর করছে তার এলাকায়। দেখতে বাঁদরের মতো, আবার শুয়োরের মতোও বটে। শুয়োরের গায়েই অত লোম থাকে। গিন্নিকেও বলেছিল এই নতুন উৎপাতের কথা। মানুষ তখনও এ অঞ্চলে বেশি আসেনি। আন্দু তাই অবাক হয়েছিল প্রথম মানুষ দেখে।
চুপিসারে একদিন হানা দিয়েছিল খাদের মধ্যে। গাছপালা আঁকড়ে ধরে একটু একটু করে খাড়া দেওয়াল বেয়ে নেমে এসেছিল নিচে। কিন্তু শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থাতেই কোপ খেল প্রস্তর-কুঠারের।
মারাত্মক কোপ! জখম হয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে, দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল রাজা আন্দু৷ সেই ফাঁকে চম্পট দিলে মানুষ-শুয়োর দুটো।
মুখ চুন করে রক্তাক্ত দেহে গুহায় ফিরে এসেছিল আন্দু। গিন্নি তো অবাক রাজামশায়ের হাল দেখে।
এরপরেই যা ঘটল, তা কহতব্য নয়।
ভালুক-গুহায় পাথর খসে পড়ল ওপর থেকে। পড়ল এক্কেবারে আন্দুর মাথার ওপর। করোটি চুরমার হল সঙ্গে সঙ্গে। আন্দু আর নড়ল না।
বিকট হল্লা শুনে কোনওরকমে ওপরে তাকিয়ে আন্দুর বউ দেখেছিল সেই বাঁদর-শুয়োর দুটোকে। নাচছে আর চেঁচাচ্ছে।
প্রস্তর-কুঠার আর বুদ্ধির জোরে এইভাবেই জঙ্গলেও আধিপত্য বিস্তার শুরু করল আদিম মানব… আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
.
৩। প্রথম ঘোড়সওয়ার
বুদ্ধিই শক্তি। মানুষ আজ বুদ্ধির জোরেই মুঠোয় এনেছে পৃথিবীটাকে। কিন্তু তা একদিনে ঘটেনি। জঙ্গলের পশুনিধনই শুধু নয়, পশুকে বশও করতে হয়েছে এই বুদ্ধির জোরে।
ঘোড়া আজকে অতীব প্রিয় বাহন। কলের বাহনের অভাব নেই–ঘোড়ার কদর কিন্তু আজও যায়নি।
আঘ-লোমিই প্রথম মানুষ, যে ঘোড়া দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, ঘোড়ার কদর করতে শিখেছিল, ঘোড়ার পিঠে চেপেছিল।
ওদের আস্তানার কিছু দূরেই খোলা ঘাসজমিতে চরতে আসত একপাল বুনো ঘোড়া। দূর থেকে অবাক হয়ে দেখত আঘ-লোমি। শিং নেই, খোঁচা দাঁত নেই কিন্তু কী আশ্চর্য ছোটার বেগ। লাথির জোর অবশ্য আছে–কিন্তু ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর কায়দাটা অপূর্ব।
রোজ এইভাবে দেখতে দেখতে একটা মতলব মাথায় এল আঘ-লোমির।
নিরস্ত্র অবস্থায় বসে রইল মাঠের মাঝখানে। ঘোড়ার পাল দূর থেকে দেখল, বাঁদরের মতো একটা জীব চুপচাপ বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। কাজেই অযথা মাথা না ঘামিয়ে ব্যস্ত রইল ঘাস খাওয়া নিয়ে।
প্রথম দিন গেল এইভাবে। দ্বিতীয় দিন আরও কাছে সরে বসল আঘ-লোমি।
তৃতীয় দিন আরও কাছে। আস্তে আস্তে ওর সান্নিধ্য গা-সওয়া হয়ে গেল ঘোড়াদের।
সবচেয়ে তেজিয়ান ঘোড়াটাকে আগে থেকেই দেখে রেখেছিল আঘ-লোমি। তক্কে তকে ছিল তার পিঠে চাপবার। তরুণ বয়স তো, অ্যাডভেঞ্চারের মোহ রক্তে।
একদিন সুযোগটা এসে গেল হাতে।
ঘোড়ার পাল যে পথ দিয়ে রোজ ফিরে যায় ধুলো উড়িয়ে, সেই পথে একটা গাছের ডালে বসে রইল আঘ-লোমি৷ তেজিয়ান ঘোড়াটা পায়ের তলায় আসতেই টুপ করে লাফিয়ে নেমে এল পিঠে৷
আচমকা পিঠের ওপর কী খসে পড়ায় বিষম আতঙ্কে টেনে দৌড়েছিল ঘোড়াটা। খটখটাখট শব্দে প্রান্তির কাঁপিয়ে, চার পায়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটেছিল দিশেহারা হয়ে। কেশর খামচে ধরে, দুপা দিয়ে ঘোড়ার দুপাশ আঁকড়ে ধরে কোনওমতে পিঠে বসে ছিল আঘ লোমি। মাঠ-বন-নদী পেরিয়ে ঘোড়া বেচারা ছুটেছিল ঊধ্বশ্বাসে। ফেনা গড়িয়ে পড়েছিল কষ বেয়ে। বেদম হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শির-পা হয়ে খসিয়ে ফেলতে চেয়েছিল পিঠের উৎপাতকে, দুপা মুড়ে বসে পড়েও পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল আপদটাকে। কিন্তু পারেনি–কিছুতেই পারেনি। নাছোড়বান্দা আঘ-লোমিকে কিছুতেই পিঠ থেকে খসিয়ে ফেলা যায়নি। আবার শুরু হয়েছিল খটখটাখট খটখটাখট শব্দে মাঠ-বন-প্রান্তর কাঁপিয়ে দৌড়।
দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পৌঁছেছিল একটা নদীর ধারে। ঝাঁকুনির চোটে আঘ-লোমির অবস্থাও তখন কাহিল। ঝুলছে একপাশে। কিন্তু কেশর ছাড়েনি মুঠো থেকে। এইখানেই আচমকা বাহন দাঁড়িয়ে যেতেই পিঠ থেকে ঠিকরে গিয়েছিল আঘ-লোমি। তৎক্ষণাৎ হ্রেষা রবে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে বনের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল মানুষের হাতে পরাভূত প্রথম ঘোড়াটি।
বিশ্বের প্রথম ঘোড়সওয়ারটি কিন্তু এল কোথায়? এ যে তারই পুরানো আস্তানা। নদীর ওপারে ওই তো মেয়েরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চার পেয়ের পিঠ থেকে দুপেয়েকে অবতীর্ণ হতে দেখে হতভম্ব প্রত্যেকেই।
এরপরেই নতুন অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়ে গেল আঘ-লোমির টগবগে তাজা জীবনে।
.
৪। সিংহের নাম উয়ায়া
জোর যার মুলুক তার–এই তো নীতি এখনকার দুনিয়ার?
কিন্তু এ নীতি খুবই আদিম নীতি। এ গল্পের নায়ক আদিম মানুষ আঘ-লোমি গায়ের জোরে আর বুদ্ধির জোরে মুলুক দখল করেই তার প্রমাণ রেখে গিয়েছিল ইতিহাসেরও আগের ইতিহাসে।
ঘোড়ার পিঠ থেকে ঠিকরে পড়েই চম্পট দিয়েছিল সে। নদীর ওপার থেকে মেয়েরা তাকে ডেকেছিল–তবুও যায়নি। শুধু দেখেছিল, দলে পুরুষ একজনও না। শিকারে গেছে নিশ্চয়।
শিকারে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পশু শিকারে নয়, মানুষে শিকারের অভিযানে। এবং, আঘ-লোমি আর ইউদেনাই সেই মানুষ।
তাই, নিজের ডেরায় ফিরে এসে ইউনোকে আর দেখতে পায়নি আঘ-লোমি।
ব্যাপারটা আঁচ করতে দেরি হয়নি। তৎক্ষণাৎ কুঠার ঘাড়ে রওনা হয়েছিল ইউদেনা উদ্ধারের অভিযানে।
ইতিমধ্যে ইউদেনাকে নিয়ে ফিরে এল তারই উপজাতির মানুষরা। বিস্তর নিগ্রহ করার পর দিনকয়েক পরে বেঁধে রেখে এল জঙ্গলের মধ্যে সিংহ দিয়ে খাওয়ানোর জন্যে।
বেশ কিছুদিন ধরেই বুড়ো সিংহটা উৎপাত জুড়েছিল এদের ডেরায়। রোজই একজনকে ধরে নিয়ে যেত আগুনের কুণ্ড টপকে এসে। গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল, ধড়িবাজ উয়ায়া মরে সিংহ হয়েছে। হত্যাকারী আঘ-লোমি আর তার দোসর ইউদোকে না-খাওয়া পর্যন্ত কারও নিস্তার নেই।
সুতরাং উয়ায়া নামক সিংহটিকে ঠান্ডা করার জন্যেই ইউদোকে বেঁধে রেখে আসা হল গভীর জঙ্গলে।
রাত হল। কাঠ হয়ে রয়েছে ইউনো। আশপাশে শোনা যাচ্ছে নিশাচরদের হাঁকডাক। একবার রক্ত জল-করা গজরানিও শোনা গেল। সিংহের গর্জন। সত্যিই যেন রক্ত জল হয়ে এল ইউদেনার।
তারপরেই খসখস করে নড়ে উঠল ঝোপঝাড়। টলতে টলতে বেরিয়ে এল—
সিংহ নয়–আঘ-লোমি।
প্রস্তর-কুঠারের মহিমা প্রাণ দিয়ে বুঝেছে সিংহ। কিন্তু মারাত্মক জখম করে ছেড়েছে আঘ-লোমিকেও। একটা পা ফালাফালা করে দিয়েছে থাবার ঘায়ে।
জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল ইউদেনা নিঝুম আঘ-লোমিকে নিয়ে।
.
৫। শেষ লড়াই
দুজনে লুকিয়ে রইল একটা অলডার গাছের তলায়। ওঠবার ক্ষমতা নেই আঘ-লোমির। গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে বসে রইল দিনের পর দিন। সে যুগের মানুষ বলেই ওষুধপত্তরের দরকার হল না। ক্ষতস্থান সেরে আসতে লাগল একটু একটু করে।
কিন্তু খিদের জ্বালা যে বড় জ্বালা। ইউদেনা তো আর আঘ-লোমির মতো শিকারি নয়। তাই চুরি করা ছাড়া আর করে কী বেচারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চুরি। খাবার চুরি। ইউদেনাকে সিংহের আস্তানায় বেঁধে রেখে আসার পরের দিন সকালে পুরুষ যোদ্ধারা জঙ্গলে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে ধরে নিয়েছিল, আপদ গেছে সিংহের পেটে। কিন্তু রোজই এক ডেলা মাংস খুঁটির ডগায় গেঁথে রেখে আসত জঙ্গলের কিনারায় উয়ায়া সিংহের জন্যে। এই মাংসই চুরি করে এনে ভাগাভাগি করে খেত আঘ-লোমি আর ইউদো। কাঁচা মাংস অতিশয় বলকারক। দুদিনেই শক্তি ফিরে পেয়েছিল আঘ-লোমি। কিন্তু খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল বাকি জীবনের মতো।
কিন্তু রোজ রোজ চুপিসারে চুরি কি সম্ভব? একদিন ইউদোকে দেখেই আঁতকে উঠেছিল পুরুষ যোদ্ধারা। তারপরেই অবশ্য মার মার করে তেড়ে এসেছিল পেছন পেছন। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। প্রস্তর-কুঠারের এক-এক কোপে এক-একজনকে ধরাশায়ী করেছিল খোঁড়া আঘ-লোমি। ইউদেনাও কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকেনি–এ যুগের মেয়েরা যা করে। হরিণের শিং ঘুরিয়ে জখম করেছিল বেশ কয়েকজনকে। জনা তিনেক পুরুষ যোদ্ধা প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল জঙ্গলে।
পুরুষশূন্য দলটার অধিপতি হয়ে বসেছিল আঘ-লোমি–বাহুবলে এবং শক্তিবলে। শুধু জিঘাংসা নয়, ক্ষমাও ছিল বইকী তার অন্তরে–যা এ যুগের মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। জীবিত যোদ্ধা তিনজন পরে ফিরে এসেছিল–রোজ রোজ কাঁচা মাংস দূরে রেখে দূরেই বসে থাকত। একদিন মন নরম হল আঘ-লোমির। ক্ষমা করেছিল তিনজনকে।
দীর্ঘদিন দলপতি ছিল সে। তারপর বুড়ো হলে তার জায়গায় এসেছিল আর-একজন।
পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে চলছে এই একই কাণ্ড। সভ্যতা এগিয়ে চলেছে শনৈঃ শনৈঃ।
————
[অনুবাদক: ওয়েলস এই বৃহৎ গল্পটি লেখেন ১৮৯৯-তে। এডগার রাইস বারোজ টারজানের জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের প্রথম কাহিনি লেখেন ১৯১৪-তে। টারজানের গল্প আজ অধিকতর জনপ্রিয়। ওয়েলসের গল্পটি সংক্ষেপিত করা হল জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে।]