প্রসন্ন পাষাণ – ৯

নয়

কোথায় যেন জমি কেনা হচ্ছে; একটি নকশা দেখাবার জন্য ছোট চাচা আমার ঘরে এলেন। তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেবে গেলেন।

আমিও তাঁর পিছু পিছু ছুটতে লাগলাম।

ছোট চাচা সিঁড়ির একটি ধাপে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

—কিছু বলবি?

— হ্যাঁ।

কিন্তু তক্ষুণি কিছু বলতে পারলাম না। চাচা অপেক্ষা করতে লাগলেন।

—কিরে চুপ করে রইলি কেন! আমার তাড়া আছে।

—তুমি নামাজ পড় না কেন? রোজাই-বা রাখ না কেন?

ছোট চাচা অবাক হয়ে গেলেন।

—এই তোর জরুরি কথা!

—জরুরি নয় তো কি।

ছোট চাচা অল্প অল্প হাসতে লাগলেন।

—শোন পাগলি, সারাটা জীবন যেভাবে কাটিয়েছি, তারপর এখন নামাজ-রোজা করলে খোদাতালা মনে করবেন আমি তামাসা করছি। তাতে হিতে বিপরীত হবে। আর আমাকে যে

এত করে বলছিস, তোকেও তো কোনোদিন নামাজ পড়তে দেখলাম না।

—কখনো পড়তে বলেছ!

—আচ্ছা বলছি; পড়িস।

—তুমিও পড়ো।

কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোট ফুপু চাচা-ভাইজির আলাপ শুনছিলেন।

এক লহমা সেদিকে দেখে নিয়ে ছোট চাচা বললেন : আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। তবে যা কুঁড়ে হয়ে গেছি।

—কাল থেকে রোজা শুরু তুমি জানো?

—ও তাই না কি!

এবার ছোট চাচা চলে গেলেন। ছোট চাচার সব ভালো, কিন্তু ঐ এক দোষ। কিছুতেই যদি নামাজ-রোজা করবেন।

সেইদিন দুপুরে যে সময়টা ছোট চাচা আহারাদির পর বিশ্রাম করেন, আমাকে ডেকে পাঠালেন। এটা নিয়মের ব্যতিক্রম। আমি আশ্চর্যই হলাম।

ছোট চাচা একটা চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর চোখমুখ গম্ভীর; দেখেই মনে হলো তিনি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট।

—কাল সন্ধ্যাবেলা তুই ছিলি কোথায়?

–কেন, ঘরেই!

—কামিল তোর কামরায় গিয়েছিল?

—হ্যাঁ।

—আর কে ছিল?

—কেউ না।

এ কথা বললাম না যে আমি নিজেও সেখানে ছিলাম না।

–কামিলের কি দরকার ছিল?

কোনো জবাবই দিলাম না।

—হুম! আজ রাত্রে উঠে তুই নিচে নেবে গিয়েছিলি?

—হ্যাঁ।

—কেন?

—এমনি। -এমনি?

এবার ছোট চাচা গর্জন করে উঠলেন। কিন্তু আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, কোনো জবাবই দিলাম না।

—দাঁড়িয়ে থেক না। এবার যাও। যা–ও!

দুঃখ পেয়েছিলাম? না। আমার সমস্ত শরীর-মন বিবশ হয়ে গিয়েছিল। কিছু পর মনের মধ্যে এক অসহ্য রাগ ফুঁসতে লাগল। এত রাগ হয়েছিল যে একবার মনে করলাম নিজের হাতেই নিজের গলা কেটে ফেলি। তাহলেই ছোট চাচার উপযুক্ত শাস্তি হবে।

এমন সময় কনিজ এলো আমার কামরায়। সে রাগে গরগর করছিল।

—লাগিয়েছে কে জানো? ঐ তোমার ফুপুজান। বড় বুবু এত মিথ্যা কথাও বলতে পারে। আমাদের গরিবের জিব হলে খসে পড়ত। জানি না কেন, তোমার ছোট ফুপু পিছনে লেগেছে। সেদিনকার চালের বিত্তান্ত জানো? মোটে তিন টিন চাল দিয়ে বলে কি না ছ’পো দিয়েছে! তা আমিও কাউকে ছেড়ে কথা কই নি। তুমি চলে আসার পরই আমি ছোট সাহেবের কাছে গিয়ে সব বলে এসেছি। কামিল মিয়া যখন তোমার ঘরে গেল, তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলে না? আমি নিজের চোখে দেখেছি। আর সকালবেলার কথা? তাও বলছি। আমি তখন উনুন ধরাবার জন্য কয়লা ভাঙছিলাম না? আমি সব দেখেছি। আমার কথা শুনবার পর ছোট সাহেবের মুখের হাল যদি একবার দেখতে! ছোট সাহেবকে দুপুরবেলা কেউ কোনোদিন তাঁর ঘরের বাইরে দেখেছে? আজ কি না তিনিই আমার সব কথা শুনে গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে ভরদুপুরে কোথায় বেরিয়ে চলে গেলেন।

আমি তেমনি নিরুত্তর বসে থাকলাম। এইবার একটু একটু করে মনের আকাশ থেকে রাগভাব সরে যাচ্ছিল। সেই শূন্যস্থানে এবার দুঃখের পুঞ্জপুঞ্জ মেঘ এসে জমা হচ্ছিল। দুর্নিবার আবেগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে; চোখের ভিতর দিয়ে অশ্রুও ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু কনিজ যতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল আমি কোনোমতে আত্মসংবরণ করলাম। তারপর বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়ে দুঃখের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলাম। কতক্ষণ যে সেইভাবে কাতরেছি জানি না। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল, দেখি চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। মাথার কাছে বিছানার ওপর কে একজন বসে আছেন। দেখলাম, ছোট চাচা! তাঁর একটি হাত আমার কপালের ওপর।

আমাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন : আমি ভুল করেছি, মা!

তারপর বহুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারি না। এক সময় আমার গলার ভিতর দিয়ে খান খান হয়ে এই ক’টি কথা বেরিয়ে এলো : তুমি ঝি-চাকরকেও আমার চাইতে বেশি বিশ্বাস কর।

ছোট চাচা বললেন : এমন ভুল আর কোনোদিন হবে না।

এই বলে তিনি উঠে চলে গেলেন। তার পরমুহূর্তে কনিজ এলো। এসে সুইচটা টিপে দিল।

—ওঠ ওঠ। আর শুতে হবে না। দেখ এসে ছোট সাহেব বাজার থেকে তোমার জন্য কত কি কিনে এনেছে!

—কনিজ, আজ দুপুরের কথা ছোট ফুপু শুনেছে?

–না গো না। এসে দেখ না, কত মিঠাই, শাড়ি, আরো কত কি আমি অত নামও জানি না।

—কনিজ, ছোট ফুপু যেন কিছুতেই জানতে না পান!

—সে আক্কেল আমার আছে।

এবার কনিজ আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করল।

—কি সুন্দর একটা পাছাপেড়ে শাড়ি গো, একবার এসে দেখেই যাও না।

—আচ্ছা, তোমাকে দিয়ে দিলাম।

—ছোট সাহেব রাগ করবে না?

—না না করবে না। তুমি নাও গে।

এই শুনে কনিজ যেভাবে লাফাতে লাফাতে এসেছিল, সেইভাবে লাফাতে লাফাতেই চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *