আট
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভেবেছি, তিনচারশ’ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস লোকে লেখে কি করে। যদি মুখ্য উদ্দেশ্য উপন্যাস লেখাই হয়, তাহলে সত্য-মিথ্যা বাস্তব-অবাস্তব ঘটনা একত্র করে উপন্যাসের পাটাতনে সঞ্চিত করা যায়। কাজটি দুরূহ—কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য আত্মকাহিনী রচনা; অবশ্য যদি সম্ভব হয় ঔপন্যাসিক রসের রসায়নে জারিয়ে নিয়েই এই কর্মটি সারতে চাই। কিন্তু এখন লিখতে বসে দেখছি, সেইটেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। বৃহৎ বৃহৎ বিশ্ববিজয়ী উপন্যাসে যেসব অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটতে দেখেছি, আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনে তেমন কিছুই হয় নি। সামান্য ঘটনা অনেক সময় চিত্তে অসামান্য হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কারণ বস্তুর চাইতে তার ছায়াকে বড় করে দেখেছি। আত্মকাহিনীটিকে উপন্যাসের মর্যাদা দেবার জন্য কপোলকল্পিত ঘটনাবলির শরণ নিতে পারতাম; কিন্তু তা করতে চাই নে।
বস্তুত বলবার মতো ঘটনা আমার জীবনে খুব যে ঘটেছে তা নয়। বুঝতেই পারছ আমার লেখনী কেন বারবার চড়ায় এসে ডিঙির মতো ঠেকে যাচ্ছে। ঘটনার জোয়ার-ভাটার অভাবে। সেই কারণেই আমার এই উপন্যাসের পালে তেমন করে হাওয়া লাগছে না।
মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গতার নিগ্রহ অসহ্য লাগতে থাকে; মনে হয় সে এক বিরাট হাঁ করে গিলতে আসছে।
সেদিন রাত্রেও সেই রকমই লাগছিল। আমি খাটে শুয়ে আছি, চোখে ঘুম নেই। আমার কামরাটি ছোটখাটো। আমার খাট, একটা আলমারি, পড়বার টেবিল, শেলফ, দুটি চেয়ার,- বাস্; আসবাবও ফুরিয়ে গেল এবং কক্ষটির সংকুলান শক্তিও। একটা সিন্দুক ছিল, সেটাও অন্য ঘরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। টেবিলে একটা ফুলদানি থাকত; প্রায়ই ফুল থাকত না।
এখানে আর একটা স্বীকারোক্তি করব। ফুলের মতো জিনিস যা বিশ্বময় রুচি নির্বিশেষে সকলের কাছেই বন্দিত, আমার ঠিক ততটা ভালো লাগত না। বিশেষ করে প্রত্যহ তোড়া করে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে তা চোখে এমনই অভ্যস্ত হয়ে যেত যে কামরার অন্যান্য আসবাবেরই অন্যতম মনে হতো; তা দেখে মনে বিশেষ কোনো ভাব বা আবেগ উপস্থিত হতো না। খাবার ঘরে সাইড বোর্ডের ওপর রাখা বিভিন্ন ফলের সম্ভার, ঠিক তারই ওপর দেয়ালের গায়ে বিখ্যাত তৈলচিত্র দেখলে আমার কাছে আজও হাস্যকর ঠেকে। যে পরিবেশ আর যে আসবাব সমস্বরে আর অনিবার্যভাবে ভোজনলীলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সেখানেই শিল্পকলার চরমোৎকর্ষ কেমন যেন বেমানান। খাদ্য ও শিল্প দুই আমার বিবেচনায় অতিশয় মূল্যবান; কিন্তু স্বস্থানেই তাদের সত্যকার মর্যাদা। তবে হ্যাঁ; অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো একদিন মনের এক বিশেষ অবস্থায় টেবিলের ওপর বর্ণের সমারোহ মনের ভিতর একটা আকস্মিক আবেগের ঢেউ তুলত। অথবা শুধু একটি বর্ণ, লাল গোলাপ কিংবা সাদা বেল ফুল, চোখের সামনে রঙের শিখার মতো জ্বলতে থাকুক, সেও মন্দ নয়।
কিন্তু আমি বলছিলাম অন্য কথা। চোখে ঘুম নেই। রাত তিনটে কি চারটে হয়েছে কিংবা আরো উতরে গেছে। মশারিটা তোলা ছিল; শুধু এক পাশে খানিকটা ঝুলছে। এক পাশে কাত হয়ে থাকা মশারির পাল্লাটিকে আমার অতন্দ্র চোখে মাকড়সার জালের মতো অসহ্য ঠেকছিল। আবছা আলো অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিলাম শূন্যগর্ভ ফুলদানিটা হাঁ করে আছে; কেন জানি না, সেটিকেও এক মরা শিশুর কঙ্কালের মতো বীভৎস মনে হতে লাগল। বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর পাতা আছে—আমার জন্য কাফনের কাপড় আনা হয়েছে কি! আমার মনের এইসব শিশুসুলভ প্রতিক্রিয়ার পরিচয় লাভ করে তোমরা হয়তো হাসছ। এখন লিখতে বসে আমি স্বয়ং আমোদিত হচ্ছি। কিন্তু সেদিন মনের অবস্থা অন্যরকম ছিল; হাস্যের সাথে তার কোনো সংশ্রবই ছিল না। অমন যে নিরীহ সর্বংসহা আলমারি সেটিকেও মনে হচ্ছিল অন্ধকার কোণে এক অতিকায় দানব বুঝি। বইয়ের শেলফে ইঁদুরের চলাফেরার শব্দ শুনতে পাই, কানে তা করাতের আওয়াজের মতো বাজতে থাকে।
না, আজ আর ঘুম হবে না। বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। এক মুহূর্তে আমার অশান্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে বশ করবার জন্য প্রসন্নতার এক সমুদ্র যেন জানালার ভিতর দিয়ে হুঙ্কৃত হয়ে এলো। আমি যা বলতে চাই কিছুতেই গুছিয়ে-বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
রাত্রি শেষের বিজন রাজপথ—অবিশ্বাস্য রকম নিস্তব্ধ। পথঘাট দালানপাট সবকিছুই সারাদিনেরর দাপাদাপি মাতামাতির পর গভীর সুপ্তিতে মগ্ন। পথটিকে দেখে মনে হয়, চিবুকের ওপর ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমার দোতলার জানালাটি একেবারে পথের উপরই খোলে। জানালার কাছে পথের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল বুঝি রূপকথার রাজকুমার কোনো এক কাঠি ছুঁইয়ে গোটা বিশ্বকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে—একাকী আমিই জাগ্রত। আমাদের এই গলিটি বেশি চওড়া নয়, কিন্তু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঠিক জানালার সামনেই গ্যাস পোস্টে টিমটিম করে আলো জ্বলছে, গ্যাস পোস্টটিকেও একটা বিরাট মোমবাতির মতো মনে হচ্ছিল। তার নম্র আলোকশিখাটিও মোমবাতির মতো মনোরম। গ্যাসপোস্টের নিচেই একটি কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তার গায়ের ওপর গ্যাসপোস্টের আলো জ্যোৎস্নার মতো গলে গলে ঝরছে। এই সামান্য দৃশ্যটিই চোখে এতো ভালো লাগল। খর রৌদ্র—ঝলসিত দ্বিপ্রহরে নির্জন প্রান্তরে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা ক্লান্ত রাখাল বালকের দৃশ্যের সঙ্গে কোথায় যেন এর মিলও আছে। এবং এমন নিস্তব্ধতা— এও কি পার্থিব হতে পারে? বিশ্বাস করবে, এই নিঃসীম নিস্তব্ধতাও এক আশ্চর্য সঙ্গীত শোনাতে পারে? শুনেছ কখনো, নিস্তব্ধতার সঙ্গীত? শুনেছিলাম আমি সেদিন রাতে।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। এমন সময় পথের ওপর ভারি বুটের আওয়াজ শুনতে পেলাম—মচ মচ মচ শব্দের ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি। বীটের পুলিশ তার ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরছে। সে একবার হাই তুলছে, একবার গলা ছেড়ে গাইছে—
কব পৌঁছে তেরই দুয়ার–
বারবার কানে বাজতে থাকে : কব পৌঁছে তেরই দুয়ার। ধীরে ধীরে তার বুটের আওয়াজ আর গলার গান দূরে মিলিয়ে গেল। সে হয়তো তার দুয়ারে পৌঁছে গেল।
এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগল চোখেমুখে।
অদূরে ট্রাম ডিপো থেকে দিনের প্রথম ট্রাম ঢং ঢং ঢং আওয়াজ করে বেরিয়ে পড়ল। ডিপোর সামনের হোটেলে আর চায়ের দোকানে বড় বড় উনুন ধরানো হচ্ছে; এক্ষুণি ময়দা পিষতে বসবে। বড় বড় হাঁড়িতে সারা রাত নিহারি চড়ানো আছে। খালি গায়ে লুঙ্গিটাকে নেংটির মতো কাছা দিয়ে পরে হোটেল কর্মচারীরা এক্ষুণি ছুটোছুটি শুরু করবে। তাদের দিনের প্রথম খদ্দের ট্রাম কোম্পানির কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার, গঙ্গার ধারের পাটকলের প্রথম শিফটের শ্রমিক; সংবাদপত্রের মফস্বল সংস্করণের শিফট ইন-চার্জ। তারা এসে পড়ল বলে। রাত না পোহাতেই এসে পড়বে। চাইবে হালুয়া, কচুরি, নিহারি আর নান। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসবই ভাবতে থাকি। মনে হয় আমার মুখে চুল্লির দগদগে আগুনের তাপ এসে লাগে। তখন পার্কের বৃক্ষশ্রেণীতে পাখ- পাখালির কলকাকলি একটু একটু শুরু হচ্ছে। পূর্ব দিগন্তে অন্ধকারও গলতে শুরু করেছে।
এবার আমি নিচে বাগানে নেবে এলাম। একটি গাছের নিচে পাতা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। একটি সদ্য ফোটা লাল গোলাপ আমার চোখের ঠিক সামনেই তার বৃন্তে ঝুলছে; তার গায়ে সকালবেলার শিশির। কি মনে হলো, দু’হাত দিয়ে গোলাপের গায়ের শিশির মুছে দিলাম।
—ভিতরে যাও মা। ঠাণ্ডা লাগবে। হিম পড়ছে।
ছোট ফুপু এরই মধ্যে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিয়েছেন; তাঁর চোখেমুখে বেল ফুলের মতো শুচি শুক্ল ফুল্ল নম্র সৌন্দর্য। বোধ করি ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছেন। হয়তো রোজই এই সময় ওঠেন।
আমার মনে হলো, ছোট ফুপুও যেন সকালবেলার এক ফোঁটা শিশির।
একটিবার মাত্র দুটি চোখ তুলে ছোট ফুপুকে দেখলাম, তারপর ভিতরে চলে এলাম।
তখনো ভালো করে ফর্সা হয় নি।
এবার বিছানায় গিয়ে পড়তেই ঘুমে অচেতন। যখন ঘুম ভাঙল, অনেক বেলা হয়ে গেছে।