চার
ছোট ফুপু প্রথম প্রথম আমাদের সাথেই খেতে বসতেন। আমরা সকলেই এক সঙ্গে বসতাম বটে; কিন্তু সবার শেষে দস্তরখান ছেড়ে উঠতেন ছোট ফুপু। তার কারণ এ নয় যে তাঁর খাওয়ার পরিমাণ আর দশজনের চাইতে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। তবে কামিল যে কেবল ভোজনবিলাসী তাই নয়, সে ভোজনপটুও বটে। আমরা শহরের সভ্য সমাজের প্রাণী, খাওয়াটাকে চার ভাগে ভাগ করে প্রতিবারের পরিমাণ কমিয়ে নিয়েছি। তাই দুপুরবেলার খোরাক আমাদের এমনিতেই কম। ছোট ফুপু আর কামিল সকালে এক পেয়ালা চা ছাড়া আর কিছুই খেতেন না, বিকেলে এক বাটি চা পর্যন্ত নয়। তাই দুপুর ও রাতে তাঁরা আমাদের তুলনায় বেশি খেতে পারতেন। তাই না দেখে আমরা আমাদের স্বল্পাহারকে আরো হ্রাস করে দিলাম; ভাবখানা এই, ভব্য সমাজে খাদ্যের ব্যবহার কি পরিমাণ হওয়া উচিত একবার শিখে নাও। কামিলের চোখ-কান খোলা থাকত বলা যায় না। তাই ফুপুজানের চোখমুখের ইশারায় আভাসে ইঙ্গিতে, তরকারি পরিবেশনের কৃপণতায় যে বক্তব্য সমস্বরে উচ্চারিত হতো তার অর্থ সে বেচারা বুঝত না। কিন্তু ছোট ফুপু বুঝতেন। ত্রিভুবনে এই সন্তানটি ব্যতীত আপনজন বলতে তাঁর আর কেউ ছিল না। কামিলের প্রতি তাঁর ব্যবহারে শূন্যগর্ভ কুম্ভের কোনো নিনাদ ছিল না, ছিল গভীর সমুদ্রের প্রত্যয়; তবু এই ছেলেটিকে তিনি সর্বপ্রকারে আঘাত থেকে রক্ষা করেই চলতেন। তাই ফুপুজানের অনুক্ত বক্তব্যের মধ্যে যে হুলটুকু ছিল কামিলকে তা দংশন করতে না পারলেও, ছোট ফুপুকে বিদ্ধ করত ঠিক। ছোট ফুপু কেবল দগ্ধই হতে লাগলেন, অসন্তোষের কোনো ধূম্রই কুণ্ডলিত হতে দিলেন না। তাই তাঁর দুঃখের পরিমাণ কেউ জানল না।
সেদিন আমরা খেতে বসেছি। কামিল সেই মাথা গুঁজে খেতে বসত, যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হতো মাথা তুলতই না! কেবল ছোট ফুপু চামচ দিয়ে তার পাতে মাঝে মাঝে প্রয়োজনমতো খাবার তুলে দিতেন। আমি আর ফুপুজান বসতাম মুখোমুখি। কামিলের খাওয়ার বহর দেখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটুখানি হাসতেন। আমিও ওষ্ঠের বিপরীত প্রান্ত দিয়ে একটুখানি হেসে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতাম। হাসির মতো বস্তুও যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে ফুপুজানের সে হাসি যে দেখে নি সে বুঝবে না। কিন্তু মজার কথা এই, হাসির যে ছিপটি ফুপুজান এইভাবে আমার সঙ্গে মৈত্রীর সমুদ্রে ছেড়ে দিতেন, যতই বিস্বাদ হোক তার টোপটি আমাকে গিলতেই হতো।
সত্য কথা বলতে কি, ছোট ফুপুও খেতেন একটু বেশি। সংলাপ বিহনেই ফুপুজান এবং আমার মধ্যে এই যে ভাবের আদান-প্রদান হতো প্রথম প্রথম তা ছোট ফুপুর দৃষ্টিগোচরই হয় নি। বস্তুত খাওয়ার পরিমাণ নিয়েও যে সংসারের বক্র হাসির উপলক্ষ হতে হয় ছোট ফুপুর বোধ করি এ অভিজ্ঞতাই ছিল না।
ভাতের ওপর আমার আঙুল নড়ছে, যেন ভাত খাচ্ছি না, সেতারের তার নাড়াচাড়া করছি। ফুপুজানও আমাকে অনুকরণের করুণ অধ্যবসায়ে তাঁর আঙুলের খেলা দেখাতে লাগলেন। ভাতের বাসনের ওপর তাঁর স্ফীত আঙুলগুলো রঙ্গমঞ্চের ওপর স্ফীতোদর বিগত যৌবনা নটির মতোই নৃত্য করছিল। আমরা রোজ যতটা খাই আজ তার সিকি পরিমাণ খেয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট হলাম। বস্তুত বেশ কিছুদিন থেকেই এই সাধনা চলছিল। এর জন্য ফুপুজানকে আত্মনিগ্রহ করতে হয় নি। এখানকার বারো আনি অনিবৃত্ত ক্ষুধাকে পুরোপুরি তৃপ্ত করবার ষোলো আনি ব্যবস্থা তাঁর ঘরের নেয়ামতখানায় সবসময়ই মজুদ থাকত। কিন্তু আমার দুঃখ এই যে সেই নেয়ামতে আমার কোনোই হিস্যা থাকত না এবং ক্ষুন্নিবৃত্তির কোনো গোপন ব্যক্তিগত ব্যবস্থাও আমার ছিল না। এই কারণে এই সময়টা আমার পেটের ক্ষুধা সর্বদাই মধ্য গগনে প্রচণ্ড রকম জ্বলতে থাকত।
কিন্তু যা বলছিলাম।
সেদিন বাড়া ভাত ফুরিয়ে গেল।
ফুপুজান ব্যস্ত হয়ে হাঁক দিলেন : কনিজ—আরে ও কনিজ—তোরা কি চোখকানের মাথা খেয়েছিস। ভাত গেল ফুরিয়ে নজর নেই।
কনিজ অত্যন্ত ম্লানমুখে অপরাধীর মতো সামনে এসে দাঁড়ালো।
—ফুপুজান, হাঁড়িতেও তো ভাত নেই। সব বেড়ে দিয়েছি।
—তুই যে অবাক করলি। ফুরিয়ে গেছে কি রে। তোকে না এই চারজনের জন্য ছ’পোয়া চাল বের করে দিলাম। তুই কি চাল চুরি করতে শুরু করে দিলি না কি!
—অমন চুরির মুখে ঝাঁটা। চুরি করুক আটকুড়ের বেটি। চুরি করে থাকলে আমার হাত- পা খসে যাক। আমি যা চাল পেয়েছি সবই চড়িয়ে দিয়েছি।
—তুই বললেই আমি বিশ্বাস করলাম আর কি। ছ’পোয়া চাল কি আর সোজা কথা! মা তিশনার খোরাক তো চিড়িয়ার মতো। আর আমি? আমার আবার খাওয়া। দু’জনে মিলে এক পোয়া চাল দু’বেলাতেও খেতে পারব না। তুই কি বলতে চাস, ময়না আর কামিল মিলে পাঁচ পোয়া চাল গিলে ফেলল। এটাই একটা বিশ্বাস করবার মতো কথা।
—দেখ বাপু ফুপুজান, তোমার অত কথা বুঝি না। আমি যা পেয়েছি সবই চড়িয়েছি। আর ছ’পো ছ’পো করছ তখন থেকে? ছ’পো চাল আবার তুমি কখন দিলে।
আমি আর মুখ তুলতে পারছি না। কামিলের হাতে ভাতের লুকমা তখনো ধরা ছিল—কিন্তু হাতটি চিত্রার্পিতের মতো বাসনের ওপর পড়ে ছিল। ছোট ফুপু তাঁর ভাত মাখানো হাত দিয়েই কামিলের সেই হাতটি শক্ত করে ধরে আছেন, তিনিও স্থির অধোমুখ।
সেইদিন থেকেই ছোট ফুপু তাঁর সেই ছোট কক্ষটির নির্জন জগতে আত্মগোপন করলেন।
তিনি চলাফেরাও করতেন, শতপ্রকার গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকতেন; কিন্তু মনে হতো তাঁর দুটি হাত আর পা সীমাবদ্ধতার শিকল দিয়ে বাঁধা।
.
ছোট ফুপুর বয়স যখন খুবই কম তখনই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। যে বয়সে আমরা ফ্রক পরে ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছি, পুতুলের বিয়ে দিয়েছি, সে বয়সেই তাঁর কোলে আসে কামিল। ভাবলে অবাক হতে হয়, মাত্র এক পুরুষের ব্যবধানে জমানা কিভাবে বদলে গেছে।
ছোট ফুপুর সংসারযাত্রার গল্প শুনেছি। শ্বশুরালয়ে তাঁদের নাইবার জন্য পুকুরে যে ঘাট ছিল তার তিনদিক বেড়া দিয়ে ঘেরা। সন্তর্পণে লোকচক্ষুর সঙ্গে সর্বপ্রকার সংযোগ এড়িয়ে, গুটি গুটি পা ফেলে তাঁদেরকে ঘাটে নাবতে হতো, তারপর টুপ করে একবার ডুব দিয়েই আবার উঠে পড়তেন। মাথার ওপর আম-জাম গাছের শাখাগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ত হাতের নাগালের মধ্যে। কিন্তু দুটি হাত দিয়ে বক্ষ চেপে সিক্ত বসনের লজ্জা নিবারণ করে বালিকা বধূ গৃহে ফিরে আসতেন। ফিরতে দেরি হলে জবাবদিহি করতে হতো। সেটি বড় সহজ কাজ ছিল না। ফল পাড়বার জন্য পথে দেরি হলো এই সত্য আর স্বাভাবিক কৈফিয়তটি কারো কাছে শোভন মনে হতো না বা বাড়ির বউ কাঁচা আম দেখে আত্মসম্বরণ করতে পারে নি এ লজ্জা ঢাকবার ঠাঁই আর যেখানে শ্বশুরবাড়িতে নেই। কথা বলতে হতো ফিসফিস করে, তবু কথা যদি শ্রুতিগোচর না হয় তা হলে একটু কথা শুনতে হতো। গলার স্বরটিকে গলার মধ্যে রেখেই শ্রোতার কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছে দেবার অসাধ্য সাধনায় ছোট ফুপুকে বহু অশ্রুপাত করতে হয়েছে।
অল্প বয়সে তাঁর বিবাহিত জীবন শুরু হয় এবং অল্প দিনেই তা চুকেও যায়। এগারোয় বিয়ে হয় সাড়ে বারোয় মা, এবং তেরোয় না পড়তেই বিধবা। ছোট ফুপু স্বামীর মৃত্যুর পরও পনের বছর শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলেন তখন তাঁর বয়স তিরিশও হয় নি। তিনি এতদিন কেন আমাদের কাছে কিংবা বাপের বাড়ির অন্য কোনো আত্মীয়ের কাছে আসেন নি তার কারণ আমি আজও জানি না।
তবে শিরগ্রামে তাঁর কিছু জমিজমা, গরু-বাছুর, বাগান-পুকুর ছিল। তার আয় যৎসামান্য হলেও তাঁর প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম নয়। এসব কথা আমাদের বাড়িতে কেউ জানত না।
সেদিন জানল।
ছোট চাচা আর আমি সবে নাশতা সেরে উঠেছি। ছোট চাচা মুখে তামাকের নল পুরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমিও ছোট চাচার কামরায় জানালার ওপর বসে পথে লোক চলাচল দেখছিলাম।
আশ্বিন মাসের সকালবেলা। শরৎকালের উতলা হাওয়া মনটিকে কেমন যেন অন্যমনস্ক করে দিতে চায়। গাছের ডালপালায় সবুজ ঘাসে অমল উদার আকাশে এক আশ্চর্য সজীবতা অনির্বচনীয় শান্ত প্রফুল্লতায় মনটি কোনো এক অজ্ঞাত দোসরের কাছে কৃতজ্ঞতায় অবনত হয়ে আসে। বাতাসে শীতের আমেজ। করপোরেশনের লোকে রাস্তায় হোসপাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে। আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে। পথে লোক চলাচল বিরল। হোসপাইপের পিতলের নজল পিচের রাস্তার ওপর পড়ে ঠং করে একটা আওয়াজ করে, কানে বেশ লাগে।
আশ্চর্য প্রকৃতির প্রভাব। অন্য সময় এই পথে অল্প লোক মিলেই কি বিষম হট্টগোল সৃষ্টি করে, সে আমি নিজেই দেখেছি। পথে দু’জন হাঁটলেও অত্যন্ত চড়া গলায় দিগ্বিদিক উচ্চকিত করে তোলে। কিন্তু আজকের সকালের এই মুহূর্তটিতে সকলেই যেন আপোস করে এই গলিটার নিঃশব্দতার পবিত্রতা রক্ষা করছে। প্রকৃতি ধ্যানে বসেছে। কেউ কোনো উপদ্রব সৃষ্টি করতে চায় না। কেবল পথের মোড়ে নন্দীদের বাড়ির হিন্দুস্থানি দারোয়ান দোরগোড়ায় ফুটপাতের ওপর একটি টুলে বসে হয়তো মীরারই কোনো ভজন গাইছিল। তার কথা কিছুই শোনা যায় না, সাধকের কণ্ঠও মধুর নয়, কেবল একটি করুণ সুর ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো আকাশের গায়ে লুটিয়ে-ছড়িয়ে পড়ছিল।
এমন সময় দেখলাম একটা ঠেলাগাড়ি আমাদেরই দরজার সামনে এসে থামল। ঠেলাগাড়ির ওপর অনেকগুলো বস্তা। সঙ্গে একটি লোক, পরনে তার লুঙ্গি আর হাত-কাটা ফতুয়া, মাথায় একটি গামছা পাগড়ির মতো বাঁধা। বয়স চল্লিশ হবে, শরীর সুঠাম। সে সোজা ঘরের ভিতর চলে এলো।
—চাচা, কে যেন এলো।
ছোট চাচা খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন : হবে কেউ। তুই জানালার ধার থেকে সরে আয়। ঠাণ্ডা লাগবে।
আমি সোজা নিচে নেবে এলাম।
নিচে এসে দেখি আগন্তুককে কেন্দ্র করে বেশ একটা ছোটখাটো আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ছোট ফুপুকে দেখে সে কারো অনুমতির অপেক্ষা না করেই সোজা ঘরের ভিতর চলে এসেছে। সেখানে ফুপুজান, কনিজ, জাফর—এমনকি আলীমও বেশ উত্তেজিত হয়ে তর্ক করছে। আলীম পারলে এখুনি এই বেয়াদবটির মাথা ভেঙে দেয়; কিন্তু পারছে না কেবল এই জন্য, বেয়াদবটির মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব থাকলেও, তার যে দুটি কবজি দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে কোনো প্রকার স্বল্পতার লক্ষণ ছিল না। ছোট ফুপু একটু আগেই ঘটনাস্থলে ছিলেন; কিন্তু শুনতে পেলাম আলীমকে দেখে একটু আগেই সেখান থেকে সরে গেছেন। খবরটি দিলেন ফুপুজান তাঁর মুখ বাঁকাবার বহর দেখেই তাঁর বিরূপতার পরিমাণ আন্দাজ করলাম।
আগন্তুকের নাম হুকুম আলী। সে এসেছে শিরগ্রাম থেকে চাল-ডালের বস্তা আর ঘিয়ের হাঁড়ি নিয়ে। ছোট ফুপুকে দেখেই সে মস্ত সালাম দিয়ে কি যেন বলতে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় তার পথ আগলে দাঁড়ালো জাফর আর আলীম।
পথশ্রান্ত হুকুম আলী এ ধরনের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বেচারা বস্তা বস্তা চাল-ডাল ট্রেনে করে শিয়ালদহ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তারপর ঠেলাগাড়িতে চড়িয়ে পিছনে পিছনে যক্ষের ধনের মতো আগলে এই বাড়িতে পৌঁছেছে। পথে তাকে বহুবার ঠিকানা খুঁজতে হয়েছে, বহু হয়রান হতে হয়েছে। তারপর সে যদি কিছুটা ভিন্ন প্রকার অভ্যর্থনার জন্যই তৈরি হয়েছিল তো তাকে দোষ দেয়া যায় না। ফুপুজানের জিজ্ঞাস্য সে কার হুকুমে ঘরের ভিতরে অমন হুট করে ঢুকে পড়ল। হুকুম আলীর বক্তব্য, যে বাড়িতে সে তার ছোট মাকে দেখতে পেয়েছে সে বাড়িতে তার গতিবিধি অন্য কারো বিধিনিষেধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।
এমন সময় ছোট চাচা নিচে নেবে এলেন।
—এত গোলমাল কিসের। তুমি কে?
—হুজুর। আমার নাম হুকুম আলী।
ছোট চাচা হেসে ফেললেন।
—খাসা নাম। কিন্তু এখানে কি দরকার?
—আমি শিরগাঁ থেকে এসেছি।
—কোন শিরগাঁ?
—হুজুর বলেন কি। শিরগাঁ আবার খোদার দুনিয়ায় ক’টা আছে। শিরগাঁ আপনি চিনলেন না! বস্তুত হুকুম আলীর কথায় ছোট চাচা রাগ করতে পারতেন; কিন্তু তার কথার ধরনে এমন কিছু ছিল যে আমারও মনে হচ্ছিল ঐ লোকটির ওপর রাগ করার কোনো অর্থ হয় না।
—তা হুকুম আলী, আমি জানিশুনি একটু কমই। প্রথমে তোমার শিরগাঁর দিশা পাই নি, আমাকে মাপই করে দাও।
হুকুম আলী এত বড় জিব কেটে এগিয়ে এসে ছোট চাচার পায়ের ধুলো নিল।
—হুজুর, কন কি। আমার যে দোজখেও ঠাঁই হবে না।
—তা নিয়ে আর দুঃখ করো না। কিন্তু তুমি চাও কি।
—এক গেলাস পানি।
ছোট ফুপু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এই কথা শুনছিলেন। এবার সেইখান থেকেই অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে বললেন : ও আমার শ্বশুরবাড়ির বিশ্বাসী লোক।
—কিন্তু এত সব চাল-ডাল কি হবে?
ছোট ফুপু সে কথার কোনো জবাব দিলেন না; কিন্তু দিলেন ফুপুজান।
—হবে আবার কি। শ্বশুরবাড়ির দবদবাই না দেখালে চলছিল না।
দরজার অন্তরাল থেকে আবার ছোট ফুপুর কণ্ঠ ভেসে এলো।
–বছরে বছরে প্রতিবার আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। না নিলে দুঃখ পাবে।
ছোট চাচা আর কিছু বললেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন : হুকুম আলীকে সরবত বানিয়ে দাও। আর দেখ ও যেন খাওয়া-দাওয়া না করে চলে না যায়।
ছোট চাচা চলে গেলে কৌতূহলী হুকুম আলী প্রশ্ন করে : একটা কথা শুধাব? এই সাহেব আমাদের বড় বাচ্চু মিয়ার ছোট পোলা না?
জাফর জবাব দিল : হ্যাঁ।
হুকুম আলী এক করুণ দীর্ঘশ্বাসে কক্ষটিকে কাঁপিয়ে বললো : আ হা হা হা। এমন আকাশের চাঁদ, দেশের লোক কোনোদিন দেখল না। একবার দেশে এলে, মাথার গামছা দিয়ে তাঁর পা মুছে দেব
এই বলে হুকুম আলী আপাতত গামছা দিয়ে তার নিজের মুখ মুছে সেখানেই বসে পড়ল। কনিজ এক গেলাস গোলাপ পানির সরবত এনে দিল।
দুপুরবেলা হুকুম আলীর আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থাটা ভালোই হয়ে থাকবে। বিকেলবেলা বিদায় নেবার আগে তার হাত দুটি মোনাজাতের ভঙ্গিতে তুলে বাড়িসুদ্ধ লোককে সে যে পরিমাণ দোয়া দিয়ে গেল, তারপর বংশ পরম্পরায় আমাদের সকলের স্বর্গারোহণ অনিবাৰ্য। অবশ্য ইহকালেও ধন-দৌলত মান-ইজ্জত শান-শওকত সবকিছুরই সে সুপ্রচুর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল।
ছোট চাচার প্রতি বিশেষ করে তার একটা পক্ষপাত দেখা গেল। ছোট চাচা তার আহার- বিশ্রাম আর খরচের নির্দেশ দিয়েই ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু হুকুম আলী তাঁকে অত সহজে ছুটি দিল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর ছোট চাচা নিত্যকার মতো আজও তাঁর দিবানিদ্রাটি সেরে নিচ্ছিলেন। এই সময়টিতে তাঁর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটানো একেবারে নিষেধ ছিল।
হুকুম আলী একটু গড়িয়ে নিয়ে, ভালো করে অজু করে আসরের নামাজটি পড়ে নিল। তারপর আবার গামছাটি মাথায় বেঁধে ফিরবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। একে একে সকলের কাছ থেকেই সে বিদায় নিল এবং সকলকেই অন্তত একবার শিরগাঁ আসতে দাওয়াত দিল।
অবশেষে বললো : এবার চলুন, ছোট সাহেবকে সালাম দিয়ে আসি।
সে যে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে এই আমন্ত্রণ জানালো তা নয় কিন্তু তার এই আহ্বানে সাড়া কেউ দিল না।
বরং ফুপুজান বললেন : সে এখন ঘুমুচ্ছে। সালাম দিতে চাও পরের বার দিও।
—তাও কি হয়।
—তাহলে বসে থাক। যখন উঠবে যত খুশি সালাম দিও।
—তাও কি পারি। পাঁচটার সময় আমার ট্রেন।
—এও না তাও না। তা করতে কি চাও বল?
হুকুম আলী কি করতে চায় মুখে না বলে কাজেই দেখিয়ে দিল। সে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে ছোট চাচার কামরায় ঢুকে পড়ল। ছোট চাচা এরই মধ্যে উঠে পড়েছিলেন। হুকুম আলী দেয়াল ঘেঁষে একপাশে সরে দাঁড়ালো।
হাত দুটি মাথার নিচে রেখে চাচা লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন। তাঁর চোখ দুটি খোলা। হঠাৎ সেখানেই হুকুম আলীকে দেখে তাঁর দুটি চোখে অসহ্য বিস্ময় আর বিরক্তি একটিবার উঁকি দিয়েই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল : বরং তাঁর দুটি চোখ প্ৰসন্ন কৌতুকে আলোকিত হয়ে উঠল।
—এবার কি হুকুম বল।
আবার হুকুম আলীর সেই জিহ্বা দংশন, সেই পদস্পর্শন।
—অভয় দেন যদি, একটা কথা বলতে চাই।
—বলেই ফেল। তোমাকে কি আর অভয় দেব বল। তুমিই কত লোককে অভয় দাও।
—হুজুর। দেশের মাটি দেখলেন না। বাপ-দাদার নিশ্বাসে গড়া ভিটাও একবার চোখে দেখলেন না। গ্রামের লোক যে বড় আফসোস করে।
—আফসোস করে? ঠিক বলছ?
—আপনাদের খানদানের শানেই গ্রামের নাম। আফসোস করবে না। আর আপনি কি না গ্রামের নামটাই ভুলে গিয়েছিলেন।
—ঠিক বলেছ। আমরা বেইমান।
—তওবা তওবা হুজুর কি যে বলেন। তবে একবার দেশটা ঘুরে গেলে আমরাও একটা উৎসব করতে পারি।
চাচা এক মুহূর্ত কি ভাবলেন।
—আচ্ছা। কথা দিচ্ছি। যাব।
ছোট চাচার কণ্ঠে পরিহাসের বাষ্পও নেই। আমরা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। হুকুম আলী কিন্তু এতটুকু অবাক হলো না। বরং অন্যরকম ঘটলেই যেন সে বিস্মিত হতো।
এবার চাচা আমাকে বললেন : হুকুম আলীকে নাশতা খাবার জন্য দশটা টাকা দিয়ে দে। হুকুম আলী প্রতিবাদ করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল; ছোট চাচা একটিবার তার দিকে তাকিয়ে পাশ ফিরে শুলেন।
সাক্ষাৎকার শেষ হলো। আর একটি কথাও না। হুকুম আলীও তা বুঝল।
হুকুম আলী যখন বিদায় নিতে এলো, ছোট ফুপু তার হাতে রুমাল বাঁধা আধসের খানেক চিড়ে ভাজা দিলেন।
—পথে খেও।
রুমালটি হাতে তুলে নিয়ে হুকুম আলী উঠে পড়ল।
—খোদা হাফেজ। মামণি তুমিও একবার দেশে এসো। দেখবে লোকে শাহজাদীর মতো ইজ্জত করবে।
দোরগোড়ায় কনিজকে দেখে সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।
—বহিন। সারাদিন তুমি বহুত আদর-যত্ন করলে। তুমিও এসো আমাদের দেশে।
–আ মরণ। মুখপোড়া মিনষে বলে কি।
মুখপোড়া মিনষে সে কথার কোনো জবাব না দিয়েই চলে গেল।
.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির বিজলি বাতিটাও বিগড়ে গেছে। ক’দিন থেকে প্রায়ই এমন হচ্ছে। ছোট ফুপুর লণ্ঠনটি সিঁড়ির কাছে জ্বলছে। বাড়িতেও কেউ ছিল না। কামিল সকাল থেকেই অনুপস্থিতি। সে গেছে বারাসত, আলীমের সঙ্গে, ফুটবল খেলা আছে। ফুপুজানও গেছেন পাশের বাড়িতে বেড়াতে। ছোট ফুপু তাঁর ঘরে কাঁথা সেলাই করছিলেন। দোতলা থেকে ছোট চাচা নিচে নেবে আসছেন, সিঁড়িতে তারই শব্দ। তাঁর পরনে ফর্সা আদ্দির পাঞ্জাবি, সোনার বোতামগুলো আধ-অন্ধকারে মুগের দানার মতো চিকচিক করছে। ধবধবে পাজামার নিচে তাঁর ফর্সা পায়ের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে, যতটা কালো পাম্পশুর ভিতর ঢাকা পড়ে নি। এইটে তাঁর বেড়াতে যাবার সময়।
—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে করছিস কি!
—তোমাকে একটা সুখবর দেব, তাই দাঁড়িয়ে আছি।
—সুখবর?
–শুনলে তুমি খুব খুশি হবে।
—চট করে বলেই ফেল না।
—হুকুম আলী কি বলে জান? তুমি না আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর।
ছোট চাচা হেসে ফেললেন।
–লোকটা বেশ সমঝদার মনে হচ্ছে। তা এত বড় খবরটা তুই আগে দিলিনে। এক জোড়া লুঙ্গি বকশিশ দিতাম।
ছোট ফুপু তাঁর ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে চাচা-ভাইঝির আলাপ শুনছিলেন। তাঁর কণ্ঠের একখণ্ড হাসি শোনা গেল।
সেই শব্দের দিকে একটিবার দৃষ্টিপাত করে ছোট চাচা মচমচ শব্দ করে বেরিয়ে গেলেন।