প্রসন্ন পাষাণ – ৩৭

৩৭

বিকেলবেলা আলীমকে সঙ্গে করে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির সকলেই এখনও বিশ্রাম করছেন। রেললাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে মাঝে আঙুলে কাঁকর লাগে, ব্যথা পাই। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের রোদ চোখে মুখে পিঠে স্পর্শ বুলিয়ে দিতে থাকে। হাই স্কুলের ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলছে। চোখের সামনে রেললাইন দুটি সমান্তরাল রেখার মতো ছুটে চলেছে। এইবার রেললাইন ছেড়ে, মাঠ পেরিয়ে আমরা পথে এসে পড়লাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম উল্টো দিকে। মুদির দোকানে কেরোসিন টিন, বাতাসা, মুড়ি-মুড়কি, চাল ডাল নুন তেল, খড়ম, আগরবাতি, আলতা সাবান—এমন কত কি। মুদি একটি তক্তার ওপর বসে দুটি হাত দিয়ে মশার আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করছে। বাম দিকে লাইব্রেরি ফেলে আমরা কুষ্টিয়া বাজারের দিকে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেবে আসছে। কুষ্টিয়া বাজার এসে পড়ল। আমরা দু’জন ওভার ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়ালাম। এইমাত্র যাকে বলে ভৈরব হরষে একটি মেইল ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। চতুর্দিক কুলি কুলি রব, দ্রুত পায়ে ওঠানামা, সতর্ক দৃষ্টি, কুলির মজুরি নিয়ে বিবাদ—তারপর আবার হুঙ্কার ছেড়ে ট্রেনের প্রস্থান। আস্তে আস্তে আওয়াজ কমে আসে এবং এক সময় ঝিল্লিরব ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। আমরা তবু সেইভাবেই ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। আকাশে একটি-দুটি তারা ফুটতে থাকে। ঠাণ্ডা হাওয়ার কাঁধে চড়ে শীত এসে কামড় দেয়। আমি ভালো করে আঁচলটা জড়িয়ে নি।

আলীম বলে : এবার ফিরে চলো।

—না। চলো পাশের নদীটা দেখে আসি।

নদীতে অবশ্য দেখবার কিছু ছিল না। শীর্ণ নদী ক্ষীণ কটি নটীর মতো হেলেদুলে এগিয়ে যায়। তারই ওপর দিয়ে একটি নৌকা চলেছে। ভিতরের লণ্ঠনটি মিটমিট করতে থাকে। আমরা নদীর যে তীরে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানটা ভারি নোংরা। আজ তাও আমাকে বিচলিত করতে পারল না। নদীর অন্য তীরে কার যেন চিতা পুড়ছে। অন্ধকারে তারই আগুন দপদপ করতে থাকে। এক বদ গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। তবু আমি নির্বিকার।

ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধ্যার কুয়াশা ঝরছে। কাপড়ের কলটিও একটু আগেই আজকের মতো তার চাকা থামিয়েছে। আমরা পায়ে হেঁটেই ফিরে চলেছি। ফিরবার সময় দেখতে পাই ডান দিকের গলিতে একটি সিনেমা হল। ছাত টিনের। মেঝেও মাটির। কলের গান চলছে সরবে। সিনেমার পাশেই একটি পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। সেখানে ভিড় করে আছে চিত্র-বিলাসীরা। মাঝ বয়সী নরনারী যুবক-যুবতী একে একে সিনেমা দেখতে আসছে। গিলে করা পাঞ্জাবির আস্তিনটা, শাড়ি সরু আঁচলটি, কপালের জ্বলজ্বলে সিঁদুরটুকু, পানের রসে সিক্ত ওষ্ঠপ্রান্তের প্রসন্ন হাসিটুকু, চুড়ির একটুখানি নিক্কণ, ঘোমটার ভিতর দিয়ে অন্তরঙ্গ আলাপ—চোখে পড়ে, কানে বাজে।

বেশ শীত পড়ে গেছে। সকলের চোখেই শিশিরের মতো একরকম সিক্ততা, পায়ের চলনে একটুখানি জড়তা, হাতে-মুখে এক ধূসর পাণ্ডুরতা যার নিজস্ব একটা শ্ৰী আছে, এইসব কিছুই আজকের সন্ধ্যাবেলা শীত যে আসন্ন, তাই ঘোষণা করছে। শীতের সন্ধ্যায় মানুষের মন একটা অবলম্বন আশ্রয় করে উষ্ণতা এনে দিতে পারে না। অলস মন্থর আলাপের খণ্ড খণ্ড নুড়ির মতো ধ্বনি সেই উত্তাপ সঞ্চারিত করে।

পথের দুই ধারে বড় বড় গাছগুলো অন্ধকারে প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছগুলোর পায়ের কাছে ছোট ছোট দোকান। দোকান এরই মধ্যে বন্ধ হতে শুরু করেছে। দোকানের বারান্দায় বাঁশে ঠেস দিয়ে সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। একটি দোকানে কলের গান বাজছে; যন্ত্রটি বুঝি নিখুঁত নয়! মনে হয় গায়িকার কণ্ঠ দু’হাত দিয়ে কে চেপে ধরেছে। তবু শ্রোতার অভাব নেই। ঝিঁঝি ডাকে অবিশ্রান্ত। অদূরে কোথায় শিয়ালও ডাকতে থাকে। হঠাৎ পায়ের কাছে একটা ব্যাঙ লাফ মারে।

একটু দূরে কতগুলো লণ্ঠন দেখতে পাই। লণ্ঠনের আলোয় পথে মানুষের দীর্ঘ ছায়া পড়তে থাকে। একটি টর্চলাইটও দানবের চোখের মতো জ্বলতে থাকে, অন্ধকারে নড়তে থাকে। আর আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।

সেই মন্ত্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম : এই যে আপনারা। এদিকে আমরা সবাই ভেবে অস্থির।

আমি কোনো জবাবই দিলাম না। আলমগীর সাহেব আলীমের সঙ্গে মৃদুস্বরে আলাপ করতে লাগলেন, তাও আমার কানে গেল না। আমি কেবল শিয়ালের ডাক শুনতে পাই।

বাড়ি ফিরে এলে যথারীতি প্রশ্নোত্তর শুরু ও শেষ হলো। জয়নাব বিবির মুখ ভার। আব্বা বললেন : এটা মফস্বল টাউন। একটু বিবেচনা করে চলাফেরা করতে হয়।

আমি কারো কোনো কথার জবাব দিলাম না। একবার শুধু আলীমকে প্রশ্ন করলাম : তুমি কালই ফিরে যাচ্ছ? সে বললো : হ্যাঁ।

সার্কেল অফিসারের বাড়ি সকলের দাওয়াত ছিল। আজ ঈদে-মিলাদুন নবী। মুসলিম জাহানের সবচাইতে বড় দিন। সার্কেল অফিসারের বাড়ি মিলাদ হবে। তারপর খানা-পিনা। দাওয়াত আমারও ছিল। কিন্তু মাথা ধরেছে বলে আমি গেলাম না। আমি গেলাম না দেখে নতুন মা-ও থেকে গেলেন। বাকি সবাই গেলেন চলে জিয়াফতে।

কোনোমতে খাওয়া সেরে আমি আমার ঘরে চলে এলাম। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। আস্তে আস্তে অনেক রাত হয়ে গেল। পথে গরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ আর শোনা যায় না। পথিকের পদশব্দ আর কণ্ঠস্বরও বিরল হয়ে এলো।

কত রাত হবে জানি না। বারান্দায় অনেকগুলো জুতোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। সবাই মিলাদ থেকে ফিরে এলেন বুঝতে পারলাম। তারপর মিনিট দশেক ছোটখাট আওয়াজ শোনা গেল। তারপর চারদিক এত নিঃশব্দ যে নিজের নিশ্বাসের আওয়াজও শুনতে পাই। মাঝে মাঝে দূর থেকে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসে। তারপরই শিয়ালের জবাব। ঘড়িতে একটা একটা করে সব কটা বেজে যেতে লাগল।

কি মনে হলো, আমি চেয়ার টেনে বাইরে এসে বসলাম। এই রাত্রের কথা কিছুটা কাহিনীর গোড়ার দিকে বলেছি। সাঁঝ রাতে ধুম বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন শীত বড় দুরন্ত। গোটা কুষ্টিয়া শহরটাই ঘুমে মগ্ন। কেবল থেকে থেকে ট্রেজারি থেকে হুঙ্কার ওঠে : হু কাম দার? জবাব ও আসে : ফ্রেন্ড!

এবং কোথায় জানি না একটা ডাইনামো বাজতেই থাকে ঢিপ ঢিপ ঢিপ।

আকাশের সারা গায়ে তারা ফুটেছে। চাঁদ হাসছে বড় মধুর হাসি। তারই নিচে পড়ে থেকে লোহার রেললাইন চিকচিক করছে। সামনের তালগাছটি ক্লান্ত পানখা পুলারের মতো মাঝে মাঝে নাড়ছে পাতা। তারই ঠিক নিচে জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোকে সম্মুখের কুঁড়েঘরটি ঘোমটা পরা গ্রাম্যবধূর মতোই দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম, একটি খরগোস লাফিয়ে রেললাইন পেরিয়ে চলে গেল। ডান দিকের ডোবাটির ময়লা পানির ওপর জ্যোৎস্নার আলো সরের মতো ভাসছে।

আমার কি মনে হলো, বারান্দা পেরিয়ে মাঠের ওপর এসে বসলাম। ঘাস শীত রাত্রের শিশিরে ভিজে গেছে। কিন্তু হাতে শিশিরের স্পর্শ শিশুর অঙ্গের স্পর্শের মতোই কোমল মনে হতে লাগল। মাটি ভিজে নরম হয়ে গেছে। হঠাৎ আমার সারা শরীর শিউরে উঠল এক অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতিতে। দু’হাত দিয়ে মাটি তুলে আমি চোখেমুখে মাখলাম—সে স্পর্শের সুখই-বা কত কি করে বোঝাব? আমার বিগত মা যেন খোলা আকাশের নিচে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত গভীর রাতে আমাকে ছুঁয়ে গেলেন। তারের বেড়ার কাছে ঘাস হাওয়ায় থরথর করে কাঁপতে থাকে। শিশু তার হাত নাড়ছে।

আমি বসে বসে তাই দেখতে থাকি আর ডাইনামোর ঢিপ ঢিপ ঢিপ আওয়াজ বুকের স্পন্দনের সঙ্গে তাল রেখে বাজতে থাকে।

শরৎকালের প্রভাত প্লাটফর্মের ওপর রুপালি মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে। বাতাসে বাঁশির করুণ সুর। বুঝি পূজাও এসে গেছে।

ট্রেন আছে দাঁড়িয়ে। ইঞ্জিন ফুঁসছে থেকে থেকে, আর গোটা ট্রেনের গা উঠছে নড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। লোকের ছুটোছুটি আর ব্যস্ততা দেখে ট্রেন আরো একবার গর্জে উঠল।

আমার দৃষ্টি ভিড় ঠেলে সকলের মাথার ওপর দিয়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল। একটি সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টের জানালার কাছে আলীমের মাথা দেখতে পেলাম।

কোনোমতে হ্যান্ডেল ধরে আমিও উঠে পড়লাম।

ট্রেন তখনো গজরাচ্ছে।

আলীম ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ফেলল।

— তুমি?

—হ্যাঁ আমি।

—এখানে একা?

—তুমি তো আছ।

—সকলে মনে করবেন কি?

—তুমি তো কিছু মনে করবে না? তুমি তো সব জানো?

আলীম এক মুহূর্ত চুপ থাকল।

তারপর বললো : হ্যাঁ তিশনা! আমি স-ব জানি। আমি কিছু মনে করব না।

—তাহলে যাও, আরো একটা টিকিট করে আন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *